অতৃব্য

অতৃব্য

রুমটা খুবই শীতল।
আবছা অন্ধকার বিরাজ করছে। কিছুই ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না। কেমন যেন বোটকা একপ্রকার গন্ধও আছে এখানে। সব মিলিয়ে মোটেও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নয় এটা।

কিন্তু ও একারনে অস্বস্তিবোধ করছে না। অস্বস্থিবোধ করছে এখানে কেন ওকে আনা হয়েছে এটা ভেবে।

শুক্রবার দিনটা সাধারনত হোষ্টেলেই থাকে ও। দুপুরের শেষদিকে স্বর্ণার ফোন পেয়ে বাইরে বেরুনোর জন্য তৈরী হয়ে নিলো ও। ডেট আছে আজকে।

বাসা থেকে বের হতেই একটা কালো রঙের জীপ এসে থামে ওর সামনে। দু’জন লোক বেড়িয়ে আসে সেটা থেকে আর মুহূর্তের মধ্যেই ওকে গাড়িতে উঠিয়ে নেয়। তারপর নাকের সামনে একটা রুমাল বা ঐজাতীয় কিছু চেপে ধরে। পুরো ঘটনাটা ঘটতে ত্রিশ সেকেন্ডও লাগে নি। তারপর আর কিছুই মনে নেই ওর।

জ্ঞান ফেরার পর প্রথমে কিছুই মনে করতে পারছিল না। ধীরে ধীরে একসময় সব মনে পড়েছে ওর। মুখের উপর কালো কাপড় পড়েছিল লোকগুলো। তাই তাদের চেহারা দেখতে পায়নি ও। অবশ্য দেখতে পেলেও যে কিছু করতে পারতো, তা নয়। কিন্তু অচেনা শত্রুর চেহারা না দেখতে পাওয়া বেশী ভয়ের কারন।

নিজেকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করলো ও। একটা লোহার চেয়ারের মধ্যে বসিয়ে রাখা হয়েছে ওকে। হাত-পা হ্যান্ডকাফ দিয়ে চেয়ারের সাথে আটকানো। কয়েকবার জোড় ঝটকা দিয়ে দেখলো ও। বুঝতে পারছে কোন লাভ নেই। চেয়ারটা সম্ভবত মেঝের সাথে কোনভাবে আটকানো। ছোটানো যাবে না কিছুতেই। তবুও বারবার চেষ্টা করতে লাগলো ও।

এভাবে কতক্ষন কেটে গেছে বলতে পারবে না।
হঠাত করেই কোন আগাম নোটিশ না দিয়েই অল্প ওয়াটের একটা বাল্ব জ্বলে উঠলো রুমের ভেতর। সেই সাথে খুলে গেলো বদ্ধরুমের দরজা।
দুজন লোক এসে জাপটে ধরলো ওকে। জোড় করে দাড় করিয়ে দিল ওকে। তারপর তাদের সাথে হাটতে নির্দেশ করলো ওকে।

০২
‘এসো সাজিদ।’
কন্ঠটা শুনে চমকে উঠলো ও।
নতুন যে রুমে আনা হয়েছে ওকে, সেটাতে তীব্র আলো খেলা করছে যেন। চোখদুটো সয়ে আসার জন্য অপেক্ষা করছিল ও, এমন সময় কন্ঠটা শুনতে পায় ও।
এটা তো ভার্সিটির ফিজিক্স প্রফেসর শামসুল নওয়াবের কন্ঠ!
নতুন রুমে এনে ওকে আবারও একটা চেয়ারের সাথে হ্যান্ডকাফ দিয়ে আটকে দেয়া হয়েছে আগেরমতো করে। সামনে একটা টেবিল, ওপাশে দুটো চেয়ার। ভালোভাবে নড়াচড়া করার জো নেই ওর। বুঝতে পারছে, কঠিন ফ্যাসাদে পড়ে গেছে ও।

উজ্জ্বল আলোতে চোখ সয়ে আসতেই রুমের মধ্যে দুজন লোক দেখতে পেলো সাজিদ। একজন প্রফেসর শামসুল নওয়াব, অন্যজন অপরিচিত এক শ্বেতাঙ্গ।

‘সমস্যা কি আপনাদের?’ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো ও, ‘আমাকে এখানে এভাবে তুলে আনার কারনটা কি?’

কোন উত্তর পাওয়া যায় না ওপাশ থেকে। চুপচাপ টেবিলের ওপাশে দুটো চেয়ারে বসে পড়ে দুজন। টাইয়ের নডটা ঠিক করে নিলো শ্বেতাঙ্গ লোকটা। তারপর ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো প্রফেসরের দিকে।
একটু কেশে নিলেন প্রফেসর। যেন ভেতরে ভেতরে কি বলবেন গুছিয়ে নিচ্ছেন ভালোভাবে। কয়েক মুহূর্ত এভাবেই কেটে গেলো। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তারা সাজিদের চোখের দিকে।

‘হচ্ছেটা কি এখানে?’ অধৈর্য হয়ে উঠেছে সাজিদ, ‘কি চান আপনারা?’
‘তোমাকে,’ শান্তভঙ্গীতে জবাব দিলেন প্রফেসর, ‘তোমাকে দরকার আমাদের।’
‘কেন?’ প্রফেসরের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল সাজিদ। ‘কেন দরকার?’
‘বলছি,’ আবারো কেশে উঠলেন প্রফেসর। ‘কিন্তু সব শোনার পর আমাদের কাজে সাহায্য করতে হবে তোমাকে।’
‘মানে কি?’ অবাক হয়ে গেলো ও, ‘কি কাজে সাহায্য করবো?’
‘আগে ধৈর্য ধরে পুরোটা শোনো,’ ধমকে উঠলেন প্রফেসর নওয়াব।
থতমত খেয়ে গেলো সাজিদ। কিছুই মাথায় ঢুকছে না ওর। কি করতে চাইছে এরা!
‘ইনি,’ শ্বেতাঙ্গ লোকটার দিকে ইঙ্গিত করলেন প্রফেসর, ‘প্রফেসর রেডক্লিফ ব্রাউন। ইনিই খুজছেন তোমাকে।’
‘কেন?’ প্রফেসর ব্রাউনের দিকে তাকালো ও, ‘আমাকে কেন খুঁজছেন?’
‘কারন,’ স্পষ্ট বাংলায় বলে উঠলেন প্রফেসর ব্রাউন, ‘কারন তোমাকে আমার খুবই প্রয়োজন। তোমাকে নিয়ে স্টাডি করতে চাইছি আমি।’

‘কি?’ গলা দিয়ে উচ্চস্বরে চিৎকার বেড়িয়ে এলো সাজিদের, ‘আমাকে নিয়ে স্টাডি? মানে কি?’

এক হাত উপরে তুলে থামার নির্দেশ দিলেন প্রফেসর নওয়াব। ‘আগে পুরো ব্যপারটা শোন। প্রফেসর ব্রাউন “ডারপা”য় কর্মরত আছেন।’

‘ডারপা?’ ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো সাজিদ।
‘হ্যাঁ, ডারপা,’ ভারী গলায় জবাব দিলেন প্রফেসর ব্রাউন, ‘ডিফেন্স এডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্টস এজেন্সী। ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অফ ডিফেন্সের অধীনে একটা সংস্থা এটা। আমি সেখানকারই এক বিজ্ঞানী।’
‘তো!’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে ও, ‘আমাকে কি দরকার আপনাদের? এভাবে আমাকে ধরে আনা হলো কেন?’
‘বলছি,’ কিছুটা ঝুঁকে এলেন প্রফেসর ব্রাউন, ‘তুমি আমাদের জন্য একটা অমুল্য সম্পদ।’

‘মানে?’ ঠোঁট কামড়ে বলে ও।
‘কেইনের নাম শুনেছো কখনো?’ শান্তভাবে প্রশ্ন করে প্রফেসর, ‘কিংবা লিলিথ?’
বেশ কিছুক্ষণ ভাবে সাজিদ। এই নামে ওর পরিচিত কেউ নেই।
‘না,’ মাথা ঝাঁকায় ও, ‘কারা এরা?’
‘মিথ,’ একই ভঙ্গিতে বললেন প্রফেসর, ‘মিথের দুজন চরিত্র।’
‘মিথ?’ বুঝতে পারে না ও।
‘হ্যাঁ,’ মাথা নেড়ে জবাব দেয় প্রফেসর, ‘মিথ।’
‘কিসের মিথ?’ আবার জিজ্ঞেস করে সাজিদ, ‘মিথের দুই চরিত্রকে আমি চিনবো কিভাবে?’
‘কারন,’ ডানহাতের তর্জনী দিয়ে গালে ঘষা দেন প্রফেসর ব্রাউন, ‘এই দুইজনের সাথে তোমার গভীর সম্পর্ক রয়েছে।’
‘কিভাবে?’ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় সাজিদ।
‘মনে হচ্ছে,’ মাঝখানে বলে উঠেন প্রফেসর নওয়াব, ‘সবকিছু ওকে খুলে বলাই ভাল। তাহলে ও সাহায্য করতে উৎসাহী হবে বলে আমার ধারনা।’
‘হুম,’ মাথা নাড়ায় প্রফেসর ব্রাউন, ‘সবকিছু খুলেই বলতে হবে।’
বেশকিছুক্ষন চোপ থাকার পর শুরু করলেন তিনি।

০৩
‘পৃথিবীর সবচেয়ে আদিম ভ্যাম্পায়ারের প্রচলিত নাম হচ্ছে কেইন।
কেইনের সম্পর্কে বিভিন্ন সময় লেখালেখি হয়েছে, মিথোলজির ইতিহাসে বেশ কিছু বইয়ে বিভিন্নভাবে তাকে উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে কেইনকে সবচেয়ে বেশী হাইলাইট করা হয়েছে সম্ভবত এই বইগুলোতেই- বুক অফ নড, দ্য এরচিস ফ্রাগমেন্টস, দ্য লিলিথিয়ান এবং দ্য লুসিফারিয়ান।

কেইনের রেফারেন্স ক্যাইন(Cain) নামে পাওয়া যায় বুক অফ জেনেসিসেও। বুক অফ জেনেসিস হলো হিব্রু বাইবেল গ্রন্থের প্রথম বই এবং পুরাতন খ্রীষ্টানধর্মের একটি ভাগ বা দলিল। এখানে কেইনের কথা এসেছে কয়েকবার।
কথিত আছে, ভ্যাম্পায়ারদের কোন কোন গোত্র, যেমন ক্যামারিলা, নিজেদের কেইনিটিস (Cainites) বলেও পরিচয় দেয় তাদের জাতির অরিজিনের প্রতি সম্মান দেখিয়ে।

এডাম এবং ইভ পৃথিবীতে নির্বাসিত হওয়ার আগে যেখানে বসবাস করতেন সেই জায়গাটাকে বাইবেলে ইডেন নামে সম্বোধন করা হয়। এই ইডেন এর পূর্বদিকে ছিলো নড এর নগরী। নড নগরীর বাংলায় অনুবাদকৃত নাম হবে “ঘুমের রাজ্য” । না, এখানে ঘুম না, মোহাচ্ছন্নতা কাজ করে, বাস্তব ও কল্পনার মাঝামাঝি জগতের মত যার পার্থক্য করা কঠিন।

কেইনের গল্পটি “ঠাকুরমার” ঝুলির রূপকথার মত শোনাবে অনেকটা।

এডাম এবং ইভের অসংখ্য সন্তান-সন্ততির মধ্যে ছিলো ২ ভাই- কেইন এবং এবেল (Abel)। কেইন পেশায় একজন কৃষক ছিলো, এবেল ছিলো রাখাল বা শেফার্ড।

একবার দুজন ঠিক করলো তারা তাদের শ্রেষ্ঠ উপহার সামগ্রী ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করবে, ঈশ্বরকে খুশী করার জন্যে। কেইন তার চাষ করা সবচেয়ে ভালো ফল-ফলাদি এবং সবজি উৎসর্গ করলো। এবেল উৎসর্গ করলো তার লালন করা সবচেয়ে সুদর্শন পশুগুলো। কেন জানা যায় নি, তবে ঈশ্বর এবেলের আন্তরিকতায় বেশী মুগ্ধ হলেন।
বলা বাহুল্য উপহার সামগ্রী নেয়ার কোন দরকার ঈশ্বরের ছিলো না। তিনি তাদের কর্মেই খুশী ছিলেন।

এবেলের প্রাধান্য পাওয়াটা বড় ভাই কেইন মেনে নিতে পারেনি, ভেতরে প্রচন্ড হিংসা এসে গিয়েছিলো তার। তখন সে তার ছোটভাই এবেলকে হত্যা করে, এই অযুহাতে যে এবেলই ঈশ্বরকে তার দেয়া শ্রেষ্ঠতম উপহার।

কিন্তু যেই অযুহাতই দেখানো হোক, আসলে যে প্রতিশোধ নিতেই এই হত্যাকান্ড ঘটানো হয় তা বুঝতে কারো বাকি ছিলো না। ঈশ্বর মারাত্নক ক্রোধিত হলেন, কেইনের পিতা তার উপর একটি চিহ্ন লাগিয়ে দিয়ে তাকে অভিশপ্ত করলেন। ফলে কেইন নড নগরীতে নির্বাসিত হলো।

নড নগরীতে অভিশপ্ত জীবন নিয়ে গন্তব্যহীন ভাবে চলার পথে কেইনের দেখা হয় লিলিথের সাথে।

জেনেসিস রাব্বা ৮:১ অনুসারে লিলিথ হচ্ছে এডামের প্রথম স্ত্রী। তার পাখা ছিল। তাকে অ্যাডাম পছন্দ করেনি এবং ঈশ্বর তাঁর পরিবর্তে ইভকে সৃষ্টি করেছিল তারই পাঁজর হতে।

ব্যাবিলন মিথ বলে, লিলিথ ও অ্যাডাম একই মাটি থেকে সৃষ্টি হয়েছিল। আর এ কারনেই লিলিথ সম-অধিকার চেয়েছিল। সঙ্গমের সময় লিলিথ কিছুতেই নিচে থাকতে চায়নি। কারন, তারা একই উপাদান থেকে সৃষ্টি হয়েছে। অ্যাডাম বলেছিল, সে-ই শ্রেষ্ঠ তাই সে উপরে থাকবে। আর এতেই ঝগড়া চলতে থাকে অ্যাডাম ও লিলিথের। এক পর্যায়ে স্বর্গ ত্যাগ করে লিলিথ।

স্বর্গ ত্যাগ করার পর লুসিফারের সাথে মিলিত হয় সে। আশা ছিল এডামকে শিক্ষা দেয়া। যে কারনে ঈশ্বর তাকে ফিরিয়ে নিতে তিনজন এঞ্জেল পাঠালেও স্বর্গে ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানায় সে। পরবর্তীতে ঈশ্বর এডামের বাম পাজরের হাড় থেকে ইভকে সৃষ্টি করলেন। ইভকে পেয়ে এডাম লিলিথকে পুরোপুরি ভুলে যায়। অন্যদিকে যখন লুসিফার দেখলো যে লিলিথকে দিয়ে এডামের কোন ক্ষতি সে করতে পারছে না, তখন সেও লিলিথকে ত্যাগ করে চলে যায়। সেটা অন্য গল্প। যাইহোক!

খিদে-পিপাসায় এবং শীতে জর্জরিত কেইনকে লিলিথ আশ্রয় দেয়। একসাথে থাকতে থাকতে একসময় তারা একে অন্যকে ভালোবেসে ফেলে।

এদিকে কেইন লিলিথের সাথে থেকে বুঝতে পারে যে লিলিথের অনেক ঐশ্বরিক ক্ষমতা ছিলো, এবং এটাও বুঝলো যে লিলিথ ডার্ক ম্যাজিকের মাধ্যমে এরকম নানা ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে। কেইন এই ক্ষমতাগুলো পাওয়ার জন্য বার বার লিলিথের কাছে তাগিদ দিতে লাগলো, সে দিন দিন ক্ষমতাগুলোর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছিলো। লিলিথ কিছুটা ইতঃস্তত করছিলো তাকে অন্ধকার জগতে আনানোর ব্যাপারে, কিন্তু কেইনের আগ্রহে এক সময় লিলিথ রাজি হয়ে যায়।

একটি রিচুয়াল করা হলো, লিলিথ তার হাত কেটে এক বাটি রক্ত কেইনকে পান করতে দিলো।

কেইন তা পান করার সাথে সাথে ঈশ্বরের হয়ে ৩জন এঞ্জেল এর আগমন ঘটে। প্রত্যেকবার একেক এঞ্জেল কেইনকে এবেল হত্যার অনুশোচনা করতে বলে এবং প্রত্যেকবার কেইন তা করতে অস্বীকৃতি জানায়। প্রত্যেকবার না বলার জন্য একটা একটা করে মোট ৩টা অভিশাপ তার উপর দেয়া হলো। A weakness to fire, Vulnerability to sunlight, and The Beast Within that hungers for blood.

অভিশাপগুলো পাওয়ার পর নিয়ন্ত্রন ছাড়া সত্ত্বা কেইনকে ভয়ানক অনুশোচনা দেয়। অনুতপ্ত হয়ে এবং অনিচ্ছায় কিছু হত্যাকান্ডের পর সে একসময় লিলিথের সাথে সব সম্পর্ক ভেঙ্গে আবারো নড নগরীতে নির্বাসিত জীবন কাটাতে চলে যায়।

এখানে একটা কথা আছে। ততদিনে কেইনও লিলিথের মতো অমরত্ব পেয়েছে।

এক সময় আবারো একাকিত্ব চেপে ধরে তাকে, সে ঠিক করলো আবারো সে মানুষের মাঝে ফিরে যাবে। একটি কৃষিভিত্তিক জনপদে সে আবার বাস করা শুরু করলো যার নাম ছিলো ওবার (Ubar) । এই জায়গাটি সৌদি আরবের কোন একখানে, যা ধবংস হয়ে হারিয়ে গিয়েছে।

রাজ্যে কেইনের আগমনে কিং ইনোচ (King Enoch) তার কর্তৃত্ব কেইনের উপর ছেড়ে দেয়, নিজে রাজদরবারে কেইনের সহযোগী হিসেবে ছিলো। কেইনের অভিশাপের চিহ্ন দেখে সবাই সমীহ করে চলতো তাকে।

একটা সময় আগের রাজা ইনোচ কেইনের ক্ষমতা সম্পর্কে জানতে পারে। তারপর থেকে সে কেইনের মত হতে চাইলো। বারবার কেইনকে পীড়াপীড়ি করতে লাগলো তাকেও ডার্ক পাওয়ারগুলো দেয়ার জন্যে।

প্রথমে রাজি না থাকলেও একাকি থাকতে থাকতে একসময় কেইন রাজি হয়ে গেল একজন সঙ্গী পাওয়ার জন্য। এমব্রাস (Embrace) করে ইনোচকে ভ্যাম্পায়ার বানানো হলো।

অর্থাৎ মিথলোজি মতে ইনোচ হলো ভ্যাম্পায়ারের ২য় জেনেরেশান।

ইনোচ কেইনের প্রথম সন্তানের মত হয়ে থাকলো, খুবই ভক্ত ছিলো সে কেইনের। দিনকাল বেশ ভালোই যাচ্ছিলো কেইনের।

এরমাঝেই সে তার রাজ্যে এক জোড়া যুগল দেখতে পেলো। তাদের ভালোবাসা কেইনকে বড়ই মুগ্ধ করেছিলো, ফলে তাদের এই ভালোবাসাকে অমরত্ব দিতেই তাদের এমব্রাস করে ভ্যাম্পায়ার বানিয়ে দিলো।

এই দম্পতি যখন পরবর্তিতে বুঝতে পারে যে অমরত্বের বদলে ওরা অভিশাপ কিনে নিয়েছে এবং তারা কখনো বাবা-মা হতে পারবে না, তারা এক সাথে সূর্যালোকে আত্নহুতি দেয়।

কেইন এতটা কষ্ট পেয়েছিলো এই দম্পতির কথা উচ্চারণ করাতেও ট্যাবু (Taboo) লাগানো ছিলো।

এরা ছাড়াও কেইন জিল্লাহ, ইরাদসহ আরো কয়েকজনকে এমব্রাস করে ভ্যাম্পায়ার বানিয়েছিলো, বিভিন্ন সময় যাদেরকে কমন ভাবে এন্টিডিলিউভিয়ান বলা হয়।
সবশেষে নূহ(আঃ) এর মহাপ্লাবনের সময় কেইনের রাজ্যের সব কিছু ধবংস হয়ে যায়, হাতে গোনা এন্টিডিলিউভিয়ান ছাড়া কেউ সার্ভাইভ করতে পারেনি।

সর্বশেষ এই আঘাতের এর পরে কেইন আর নিজেকে দাড়া করাতে পারে নি, সম্পুর্ণ ভাবে নিজের ভিতর নিজেকে গুটিয়ে ফেলে নিরুদ্দেশ হয়ে যায় অজানা কোথাও।

পরবর্তিতে বাকি রয়ে যাওয়া একেক সার্ভাইভিং এন্টিডিলিউভিয়ান নিজ ভাবে নানা মিথলোজিতে আত্নপ্রকাশ করতে থাকে।’

০৪
‘তো,’ নিরবতা ভেঙ্গে বলে উঠে সাজিদ, ‘এর সাথে ডারপা, আপনার বা আমার সম্পর্ক কোথায়?’
মিথের কাহিনী শেষ করার পর নিরবতা নেমে এসেছিল রুমের ভেতর। বেশকিছুক্ষন কেউ কথা বলতে পারছিল না। প্রফেসর ব্রাউন এবং প্রফেসর নওয়াব সাজিদের প্রতিক্রিয়া দেখার অপেক্ষায় ছিলেন। সাজিদের কথা শুনে যে সম্বিৎ ফিরল তাদের মধ্যে।

‘আছে,’ মাথা নেড়ে জবাব দিলেন প্রফেসর ব্রাউন, ‘সম্পর্ক আছে।’
উৎসুক চোখে তাকিয়ে থাকে সাজিদ। অপেক্ষা করছে!

‘কেইন,’ কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান্তকন্ঠে আবার শুরু করেন প্রফেসর, ‘সে ছিল অমর। মানে লিলিথের সংস্পর্শে এসে অমর হয়েছিল আর কি। নুহ (আঃ) এর মহাপ্লাবনের পর তার খোঁজ আর পাওয়া যায়নি। না কেউ তাকে দেখেছে, না কোন মিথে সে এসেছে এর পরে। সে কিন্তু লুসিফার বা লিলিথের মতো ছিল না। যদিও সে অমর, তবুও সে তো মানুষই ছিল। তাহলে সে গেলো কোথায়?’

‘কোথায়!’ সগোক্তির মতো বলে উঠলো সাজিদ।

‘বলছি,’ শান্তকন্ঠেই জবাব দিলেন প্রফেসর। ‘লিলিথের সাথে থেকে কেইন এমনকিছু ক্ষমতা অর্জন করেছিল, যা তাকে সাধারন মানুষের চেয়ে ভিন্ন হতে সাহায্য করে। এটা তো বুঝতে পারছো যে সে আলোতে বের হতে পারে না। সূর্যালোক সহ্য করার ক্ষমতা তার ছিল না। তাহলে কিং ইনোচের সাম্রাজ্যের কর্তৃত্ব পাওয়ার পর কিভাবে সে রাজ্য চালাতো? একবারের জন্য হলেও তো তাকে জনসম্মুখে বের হতে হয়েছে, তাই না?’
‘আমি কি জানি!’ ভ্রু কুঁচকে বলল সাজিদ। প্রফেসরের কথাগুলো বুঝতে পারছে না আসলে।

‘আমার যতদূর ধারনা,’ দ্রুত বলতে লাগলেন প্রফেসর, ‘মিথোলজিতে কোন কিছুর বর্ণনা বাদ পড়ে গেছে। কালের আবর্তে কিছু কাহিনী চাপা পড়ে গেছে। তাই আমার নিজের কিছু ধারনা আমি এখানে ঢুকিয়ে দিতে চাই। যেমনটা করেছিল প্রাচীন রাব্বিরা।’

‘কি সেটা?’ নিজের অজান্তেই বলে উঠলো সাজিদ।
‘সেটা হচ্ছে এই,’ বড় করে একটা শ্বাস নিলেন প্রফেসর, ‘কোনভাবে কেইন এঞ্জেলদের সেই অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়ে যায়। সেটা কিভাবে, তা আমরা জানি না, তবে অনুমান করতে দোষ নেই নিশ্চয়ই। যাই হোক। আমি আবার আমার ধারনায় ফিরে যাই।

কেইন এঞ্জেলদের এই অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়ে গেছে কোনভাবে। যার ফলে তার আর সূর্যালোকে আসতে সমস্যা হয় না। শুধু তাই নয়, সে এখন শুধু রক্তের উপরই বেঁচে থাকে না। অন্য স্বাভাবিক খাদ্যও খেতে পারে। তবে নির্দিষ্ট সময় পর পর তার রক্তের প্রয়োজন হয়।’

‘বুঝলাম।’ মাথা নেড়ে জবাব দেয় সাজিদ। ‘কিন্তু এর মধ্যে আমি আসছি কিভাবে?’
‘আসছো,’ মাথা নেড়ে জবাব দিলেন প্রফেসর, ‘খুব ভালোভাবেই আসছো তুমি।’
‘হেয়ালি বাদ দিয়ে বলে ফেলুন তো।’ বিরক্তভঙ্গীতে বলে উঠে ও।

‘আসলে,’ সাজিদের দিকে কিছুটা ঝুঁকে আসেন প্রফেসর, ‘তোমাকে এতক্ষণ কেইনের কাহিনী বললাম কেন জানো?’
‘কেন?’ ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে সাজিদ।

‘যাতে তুমি পুরো ব্যপারটা বুঝতে পারো,’ শান্তভঙ্গীতে বলে চললেন প্রফেসর, ‘আসলে কেইন এখন কোথায় কি অবস্থায় আছে, সেটা জানার আগ্রহ থাকলেও আপাতত এটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না আমি। আমি মাথা ঘামাচ্ছি কিং ইনোচের ব্যপারে।’

-‘কিং ইনোচ?’

-‘হ্যাঁ। কিং ইনোচ। কেইন যাদেরকে এমব্রাশ করেছিল, তাদের মধ্যে সর্বপ্রথম এমব্রাশ হয় কিং ইনোচ। মজার কথা হচ্ছে, পরবর্তী ভ্যাম্পায়ারদের সাথে তার একটা বিষয়ে পার্থক্য ছিল। অন্যরা বাচ্চা উৎপাদন করতে পারতো না, কিন্তু কিং ইনোচ তা পারতো। আর কিং ইনোচ তা পারতো বলেই কেইন মনে করেছিল সবাই তা পারবে। তাই সে সেই প্রেমিক যুগলকে এমব্রাশ করতে উৎসাহী হয়। কিন্তু পরবর্তীতে তারা সূর্যালোকে আত্নহুতি দেয়, কারন তারা আর বাবা মা হতে পারেনি। একটু আগেই সেকথা জানিয়েছি আমি।’

চুপ করে আছে সাজিদ। পুরোটা মেলানোর চেষ্টা করছে আসলে। যদিও পুরো ব্যপারটা ওর কাছে কেমন যেন ঘোলাটে বলেই মনে হচ্ছে। অপেক্ষা করছে ও প্রফেসর ব্রাউন এর পর কি বলে শোনার জন্য।

মাথায় ছোটখাট একটা প্যাচ বেধে গেছে ওর। কিছুই বুঝতে পারছে না আসলে। কিসের মধ্যে কি এসে যাচ্ছে, পুরোটা না শোনা পর্যন্ত জানা সম্ভবও নয় ওর পক্ষে। তাই আপাতত চুপ করে থাকাই ভাল মনে হলো ওর কাছে।

একটু কেশে গলাটা ঠিক করে নিলেন প্রফেসর। তারপর আবার শুরু করলেন, ‘এবার আসল কথায় আসছি। আমি, মানে ডারপার কয়েকজন বিজ্ঞানী মিলে নতুন একটা প্রজেক্ট শুরু করতে যাচ্ছি। সুপার সোলজার তৈরী করতে চাই আমরা। অবশ্য এ কাজে আমরাই প্রথম, এটা বলা ঠিক হবে না। আমাদের আগেও অনেকেই এই প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করেছে। ডারপাও আগে কয়েকবার চেষ্টা করেনি, তাও নয়। কিন্তু পুরোপুরি সফলতা আসেনি কোথাও। তাই এবার নতুনভাবে শুরু করতে চাইছি আমরা। নতুন সাজে, সম্পূর্ণ নতুন থিউরী নিয়ে কাজে নেমে পড়বো আমরা। সেখানেই তোমাকে, মানে কিং ইনোচকে দরকার আমার।’

‘আমাকে, মানে কিং ইনোচকে,’ ভ্রু কুঁচকে গেলো ওর আবারো, ‘মানে কি? আপনি কি বোঝাতে চাইছেন?’
‘এর মানে হচ্ছে,’ গম্ভীরগলায় জবাব দিলেন প্রফেসর, ‘তুমিই হচ্ছো কিং ইনোচ।’
‘হোয়াট?’ বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠলো সাজিদ। ‘পাগল হয়ে গেছেন আপনি!’
মাথা নেড়ে সায় দিলেন প্রফেসর রেডক্লিফ ব্রাউন।
‘ব্যাখ্যা করছি,’ শান্তসুরে বললেন তিনি।
মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠেছে তার।

০৫
“একজন সাধারন মানুষের ডিএনএতে ৩.২ বিলিওন বেস পেয়ার থাকে। বেস পেয়ার বোঝ তো? অনেকটা খুঁটির মতো।

ডিএনএ নিউক্লিওটাইড অণুর সমন্বয়ে গড়া একটি লম্বা পলিমার। জীবদেহে ডিএনএ একটি একক অনু হিসেবে থাকে না, বরং চাপাচাপি করে জোড়া-অণু হিসেবে থাকে। এই লম্বা সূত্র দুইটি আঙ্গুরের মত প্যাচানো থাকে, যা দ্বৈত হেলিক্সের মত হয়। একটি ডিএনএ সূত্রে থাকে নিউক্লিওটাইড যা ডিএনএ মেরুদন্ডকে ধরে রাখে, এবং একটি ক্ষার যা অন্য ডিএনএ সূত্রের সাথে সংযোগ স্থাপন করে। এই নিউক্লিওটাইড ও ক্ষারের পুনরাবৃত্তিতেই ডিএনএ সূত্র গঠিত।

ডিএনএর দ্বৈত হেলিক্স ডান-হাতি সর্পিলাকার হয়ে থাকে। ডিএনএ সূত্রগুলো যখন প্যাঁচানো থাকে তখন তাদের ফসফেটের মেরুদন্ডের মাঝে জায়গা রাখা থাকে। এই জায়গাতে ক্ষারগুলো যুক্ত হয়। দ্বৈত হেলিক্সের তলে দুই জায়গায় এরকম প্যাচানো খাত (groove) থাকে। বৃহত্তর খাতটিকে বলে মেজর গ্রুভ ছোটটিকে বলে মাইনর গ্রুভ। মাইনর গ্রুভের সরুতার অর্থ হলো ক্ষারের প্রান্তগুলো মেজর গ্রুভে তুলনামুলক বেশি সহজে প্রবেশ করতে পারে।

ডিএনএর দ্বৈত হেলিক্স হাইড্রোজেন বন্ধনের মাধ্যমে স্থির থাকে, যা দুটি সূত্রের মধ্যে সংযুক্ত থাকে। এই বন্ধনকেই বলা হয় বেস পেয়ার।

তোমার বাবার ডিএনএর সাথে তোমার ডিএনএর মূল পার্থক্য হলো এর বেস পেয়ারের সাজানোতে। মূল বেস পেয়ারকে বিভিন্ন প্যাটার্নে সাজিয়ে নতুন ডিএনএ তৈরী হয়। কিন্তু যেহেতু এই বেস পেয়ারের সংখ্যা নির্দিষ্ট, তাই এর থেকে নতুন যেসব ডিএনএ তৈরী হবে, সেগুলোও নির্দিষ্ট হবে। বুঝতে পারছো?’

হা হয়ে গেছে সাজিদ। কিছুই বুঝতে পারছে না ও।

মুচকি হেসে তাই আবার শুরু করলেন প্রফেসর, ‘এর মানে বুঝতে পারো নি তুমি। এর মানে হচ্ছে, মোটামুটি নির্দিষ্ট একটা সময় পর পর একই ডিএনএ সিকুয়েন্স বিশিষ্ট মানুষ পৃথিবীতে ফিরে আসে।’

‘এর মানে,’ কথা আটকে যাচ্ছে সাজিদের, ‘এর ম-মানে হ-হচ্ছে আমাদের প্রত্যেকেরই পুনর্জন্ম ঘটে!’

‘আরে নাহ,’ হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গী করেন প্রফেসর, ‘ব্যপারটা পুনর্জন্ম নয়। আসলে একই ডিএনএ সিকুয়েন্স বিশিষ্ট মানুষ ফিরে আসছে বার বার। এটাই বোঝাতে চাইছি আমি।’

‘তারমানে,’ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সাজিদ, ‘আপনি বলতে চাইছেন, কিং ইনোচ আর আমার ডিএনএ সিকুয়েন্স সম্পূর্ণ এক!’

‘হুম,’ খুশী হয়ে উঠেন প্রফেসর ব্রাউন, ‘এই তো বুঝতে পেরেছো।’

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে ও। একবার প্রফেসর ব্রাউনের দিকে তাকাচ্ছে, আরেকবার প্রফেসর নওয়াবের দিকে।

‘কিং ইনোচ,’ গম্ভীরকন্ঠে বললেন প্রফেসর নওয়াব, ‘কেইনের কাছ থেকে সরাসরি এমব্রাসড হলেও পরবর্তী ভ্যাম্পায়ারদের থেকে তার একটা মূল পার্থক্য ছিল। সে সন্তান জন্ম দিতে পারতো। এই পার্থক্যই অন্যসব ভ্যাম্পায়ার থেকে তাকে পৃথক করে রেখেছে। আর একটা কথা আছে এখানে। আমরা বিভিন্ন উপন্যাস, গল্প বা মুভিতে দেখে থাকি সাধারন ভ্যাম্পায়াররা সূর্যের আলোতে বেরুতে পারে না, বা তাদের প্রতিদিন রক্ত পান না করলে চলে না। এই ধারনাগুলো সম্পূর্ণ ভুল। কারন, অভিশাপটা শুধু কেইনের উপর ছিল। অন্যদের উপর ছিল না। সেকেন্ড জেনারেশন ভ্যাম্পায়াররা সবাই রোদে বেরুতে পারতো, এবং নির্দিষ্ট বয়েস না হওয়া পর্যন্ত তাদের রক্ত না হলেও চলে। একুশ থেকে বাইশ বছর বয়েস থেকে কোন এক অজ্ঞাত কারনে তাদের দেহে রক্ত উৎপাদন ধীরে ধীরে কমে আসতে থাকে হয়ে যায়। যে কারনে এর পর থেকে নির্দিষ্ট সময় পর পর তাদের রক্ত লাগে। সময় যাওয়ার সাথে সাথে তা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। চল্লিশ বছর বয়েস পর্যন্ত প্রতি এক মাসে একবার রক্ত পান করলেই চলে তাদের।’

‘এখানে আমি একটা কথা বলতে চাই,’ প্রফেসর নওয়াবের কথা মাঝখানে বলে উঠলেন প্রফেসর ব্রাউন, ‘ভ্যাম্পায়ার বলতে সাধারনত যা আমরা বুঝি, তুমি তা নও। তুমি হলে সেকেন্ড জেনারেশন ভ্যাম্পায়ার। যাকে আমরা বলি অতৃব্য।’

‘তারমানে,’ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ও, ‘আপনারা বলতে চাইছেন যে, আমি হচ্ছি সেকেন্ড জেনারেশন ভ্যাম্পায়ার বা অতৃব্য?’

‘ঠিক তাই,’ মাথা নেড়ে সায় দিলেন প্রফেসর ব্রাউন।

‘কিন্তু,’ একইভঙ্গীতে বললো সাজিদ, ‘আমাকে যে বাংলাদেশে পাওয়া যাবে, তা জানলেন কি করে আপনারা? মানে, আমাকে ট্র্যাক করলেন কিভাবে? আর আমিই যে অতৃব্য, তা বুঝলেন কিভাবে?’

মুচকি হাসছেন প্রফেসর দুজন। ব্রাউন বললেন, ‘সবকিছু বলা যাবে না। টপ সিক্রেট।’
‘হুহ,’ হতাশায় মাথা নিচু করলো সাজিদ।

মাথা নিচু করে ভাবছে ও। ঘটনা বুঝতে এবং সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে সময় লাগছে ওর।

রুমের মধ্যে গাঢ় নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। দুই প্রফেসর ইতস্তত করছেন। সাজিদ মাথা নিচু করে ভেবেই যাচ্ছে।
‘এবার,’ নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে মুখ খুললেন প্রফেসর ব্রাউন, ‘নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো কেন তোমাকে আমাদের এতো প্রয়োজন?’

আরো কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো সাজিদ। তারপর প্রফেসর ব্রাউনের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টি ফেলে উত্তর দিলো, ‘বুঝতে পারছি। কিন্তু এটা আমি হতে দিতে পারি না। আমি আপনাদের কোন সহযোগিতাই করতে পারবো না। দুঃখিত।’
‘দেখো,’ একটু কাছে ঝুঁকে এলেন প্রফেসর নওয়াব, ‘একটু বোঝার চেষ্টা করো। এতে তোমারই লাভ। এই গবেষনা সফল হলে সবাই তোমার কথা জানতে পারবে। রাতারাতি তুমি বিখ্যাত হয়ে যাবে।’

‘লাভ কি?’ দৃঢ় কন্ঠে বলল সাজিদ, ‘ততোদিনে তো আর আমি বেঁচে থাকবো না, তাই না? আমাকে গিনিপিগ বানাতে চাইছেন আপনারা।’

‘আরে নাহ,’ ঝটপট বলে উঠলেন প্রফেসর ব্রাউন, ‘তোমাকে কোন কষ্ট দেয়া হবে না। শুধু তোমার টিস্যু নিয়ে কালচার করা হবে।’

‘মিথ্যে বলবেন না,’ অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো সাজিদ, ‘আমি ঠিকই বুঝতে পারছি কি করতে চাইছেন আপনারা। বাট আমি কখনো আপনাদের সহযোগিতা করবো না।’

‘তাই না?’ হঠাত করেই মুখের ভাব পুরোটাই পাল্টে গেলো প্রফেসর ব্রাউনের, ‘কিন্তু আমরা যে তোমার কাছ থেকে সহযোগীতা নিয়েই ছাড়বো।’

‘পারবেন না,’ মৃদু হাসি সাজিদের মুখে, ‘আমার উপর জোড় করা যায় না। কেন, তা আশা করি আপনাকে বলে দিতে হবে না!’

‘মানে?’ প্রফেসর নওয়াব খেঁকিয়ে উঠলেন, ‘তুমি কি করতে পারবে আমাদের বিরুদ্ধে?’

‘সেটা,’ প্রফেসর ব্রাউনের দিকে ইঙ্গিত করলো ও, ‘এই ভদ্রলোককেই জিজ্ঞেস করে দেখুন। একজন অতৃব্য কি করতে পারে, তার ধারণা আশা করি উনার রয়েছে।’

ঝট করে প্রফেসর ব্রাউনের দিকে তাকালেন প্রফেসর নওয়াব। প্রফেসর ব্রাউনের মুখটা শক্ত হয়ে উঠেছে। বুঝতে পারছেন নওয়াব, অনেক কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন ব্রাউন। আবার সাজিদের দিকে তাকালেন তিনি। ওর মুখে ফুটে উঠেছে রহস্যময় হাসি!

‘একটা কথা কি জানো?’ নিজেকে সামলে নিয়েছেন প্রফেসর ব্রাউন, ‘মুখে তুমি যাই বলো, যেতে তোমাকে হবেই। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, “যত গর্জে তত বরষে না।” তোমার অবস্থাটাও ঠিক তেমনই। নিজের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে কোন ধারনাই নেই তোমার।’

‘তাই?’ মাথা নেড়ে বলে উঠল ও, ‘তাহলে আপনিই সেই ধারণাটা দিন।’
‘দিচ্ছি,’ রহস্যময়ভাবে হেসে উঠলেন ব্রাউন, ‘এখনই দিচ্ছি।’

পকেট থেকে একটা সেলফোন বের করলেন তিনি। কয়েকটা বাটন চাপলেন তাতে। তারপর বললেন, ‘এবার পেছনের দিকে তাকাও।’

মৃদু হেসে ঘাড় বাকিয়ে পেছন দিকে তাকালো সাজিদ। কিন্তু পেছনে তাকানোর পর হাসিটা স্রেফ উবে গেলো ওর।
স্বর্ণা!!!

০৬
‘আমাদের সাথে সহযোগীতা না করলে মারা পড়বে মেয়েটা।’ কাটাকাটা গলায় বলে উঠলেন ব্রাউন।
পেছনের দেয়ালে একুশ ইঞ্চির একটা মনিটর শোভা পাচ্ছে। সেখানেই দেখা যাচ্ছে স্বর্ণার ভিডিও ফুটেজ। একটা চেয়ারে বসে আসে মেয়েটা। তাকিয়ে আছে ক্যামেরার দিকে।

ঝট করে সামনের দিকে তাকালো ও। ক্রোধে চোখদুটো জ্বলছে ওর। বুঝতে পারছে দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে ওর শরীরে।
‘রেগে লাভ নেই,’ গম্ভীরগলায় বলে উঠলেন ব্রাউন, ‘মেয়েটা এখানে নেই। আরেক জায়গায় রাখা হয়েছে ওকে। এখন কি আমরা আমাদের আলোচনা সেরে ফেলতে পারি?’

কাহিনী পাল্টে গেছে, স্পষ্ট বুঝতে পারছে সাজিদ। সমস্যা দুটো। ও যে অতৃব্য, তা এরা জেনে গেছে। আর স্বর্ণা এখন ওদের হাতে বন্দী। কিন্তু এখানে নয়, অন্য জায়গায়।

রাগে অন্ধ হয়ে যাচ্ছে ও। মেজাজ খিঁচড়ে গেছে। ইচ্ছে করছে সব ধ্বংস করে ফেলতে। কিন্তু তা করা যাবে না। সেটা করলে হয়তো কখনোও স্বর্ণাকে বাঁচাতে পারবে না ও।

হঠাত একটা জিনিস মাথায় এলো ওর। সেটা যাচাই করতে আবার পেছনে তাকালো ও। এবং সঙ্গে সঙ্গেই জিনিসটা বুঝতে পারলো ও।

স্বর্ণা মোটেও ভয় পাচ্ছে না!
মানে কি এর! স্বর্ণা কি জানে না কি বিপদে পড়েছে ও!
দ্রুত মাথা খাটাতে শুরু করলো ও। এবং সঙ্গে সঙ্গে পুরো ব্যাপারটাই বুঝতে পারলো ও।

স্বর্ণাও নিশ্চয়ই এই ষড়যন্ত্রের একটা অংশ! প্ল্যানটা তাহলে আজকের নয়! সব প্রস্তুতি নিয়েই মাঠে নেমেছে ওরা!
আড়চোখে প্রফেসর দুজনের দিকে তাকালো ও। একটু অধৈর্য হয়ে উঠেছে দুজনেই। একে অন্যের দিকে ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করছে।

একটা সুযোগ পাওয়া যেতে পারে!

আচমকা উঠে দাড়ালো ও। হাতের ঝাঁকিতে ছিড়ে গেছে হ্যান্ডকাফ। প্রফেসর দুজন চমকে উঠলো এই দৃশ্য দেখে। কোন মানুষের পক্ষে হ্যান্ডকাফ ছিড়ে এভাবে উঠে দাঁড়ানো একেবারেই অসম্ভব!

এক লাফে প্রফেসর নওয়াবের সামনে এসে দাড়ালো সাজিদ। একহাতে তার ঘাড় ধরে অন্যহাত দ্রুত নামিয়ে আনলো বুকের উপর। এই আঘাত সহ্য করতে না পেরে প্রফেসর মেঝেতে ছিটকে পড়লেন।
এবার প্রফেসর ব্রাউন!

এমনসময় হঠাত কামরার দরজা ছিটকে খুলে গেলো।
‘এভরিবডি হ্যান্ডস আপ,’ একটা মেয়েলি গলা শোনা গেল, ‘বিআইসিএবি হেয়ার।’
ঝট করে দরজার দিকে তাকিয়েই আবার অবাক হয়ে গেলো সাজিদ।
সেখানে অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে স্বর্ণা!

দ্রুত পেছনের দিকে মনিটরের দিকে তাকালো সাজিদ। মনিটরের মধ্যে এখনো স্বর্ণার ভিডিও ফুটেজ দেখা যাচ্ছে। মাথা নিচু করে বসে আসে সে।


একসপ্তাহ পর।
পাশাপাশি বসে আছে স্বর্ণা আর সাজিদ। একজন আরেকজনের দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে আছে শুধু।

সেদিন প্রফেসর ব্রাউনের ওখানে যে ভিডিও ফুটেজটা ওকে দেখানো হয়েছিল, সেটা নকল ছিল। পুরোটা আসলে কম্পিউটার গ্রাফিক্সের সৃষ্টি। স্বর্ণাকে কোনভাবেই কিডন্যাপ না করতে পেরেই এই কাজটা করতে হয়েছিল ওদের।
আটমাস আগে হঠাত একটা সূত্র থেকে বিআইসিএবি বা ‘বাংলাদেশ ইন্টেলিজেন্স কমিউনিটি এন্ড এন্টি-টেরোরিজম ব্রাঞ্চ’ খবর পায়, সিআইএ’র কয়েকজন সদস্য কোন একটা কাজে গোপনে বাংলাদেশে আসছে। তখন থেকেই এর তদন্ত শুরু করে ওরা। তদন্তে ভয়াবহ একটা জিনিস বেড়িয়ে আসে।

ওরা একটা নতুন প্রজেক্ট চালু করেছিল তেরো বছর আগে। সিআইএ’র অঙ্গসংগঠন ডারপা নিজস্ব ল্যাবোরেটরীতে নতুন এক প্রকার ভাইরাস তৈরী করেছিল। আর সেটার পরীক্ষা করার জন্য বেছে নেয়া হয় বাংলাদেশকে। এছাড়া আরেকটা নতুন প্রজেক্টও নাকি শুরু করতে যাচ্ছে ওরা। তবে সেটা কি নিয়ে, তা বোঝা যায়নি যদিও।
প্রফেসর নওয়াবের অবস্থা খুবই সঙ্গীন ছিল। তাকে দ্রুত হাসপাতালে পাঠানোর চেষ্টাও করা হয়েছিল, কিন্তু তার আগেই মারা যায় সে। প্রফেসর ব্রাউনকে এরেষ্ট করেছিল বিআইসিএবি’র এজেন্টরা। তাকে নিজেদের স্পেশাল কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। কিন্তু তাকে আটকে রাখতে পারেনি তারা। কোন এক কৌশলে সেখান থেকে পালিয়ে গেছেন প্রফেসর। ধারণা করা হচ্ছে সে তার সঙ্গীদের সাথে দেশের বাইরে চলে গেছে ইতোমধ্যে। তবে এখনো তাদেরকে খুঁজে বেড়াচ্ছে বিআইসিএবির এজেন্টরা।

স্বর্ণা আসলে বিআইসিএবি’র একজন স্পাই। দেশের ভেতরে ও বাইরে যেকোন সমস্যা সমাধানের জন্য মাত্র কয়েক বছর আগে সংস্থাটা খোলা হয়েছে। শুধুমাত্র স্পর্শকাতর কেস নিয়ে কাজ করে বলেই হয়তো এখনো পর্যন্ত এটার কথা খুব কম মানুষই জানে।

সাজিদও জানতো না। সাড়ে তিন বছর ধরে একই ভার্সিটিতে পাশাপাশি বসে ক্লাশ করছে ওরা, কিন্তু স্বর্ণা ওকে কখনো এই সিক্রেটটা সম্পর্কে খুলে বলেনি। যেমন নিজের সিক্রেট খুলে বলেনি সাজিদ নিজেও।

এখনো স্বর্ণা জানে না আসলে কি কারনে সাজিদ ওখানে ছিল। সাজিদ ওকে বলেছে প্রফেসর নওয়াবের সাথে একটা কাজে ওখানে ঢুকেছিল ও। প্রফেসরের কোন এক বন্ধু বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছে, তার সাথে দেখা করতে।
বিকেলের সোনা রোদ ঝরে পড়ছে চারদিকে। সূর্যের তেজ কমে আসছে ধীরে ধীরে। একে অন্যের দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে আছে ওরা দুজন।

‘রাগ করেছো?’ সাজিদের চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে স্বর্ণা।
‘রাগ করবো কেন?’ অবাক হয় সাজিদ।
‘না, মানে,’ ইতস্তত বোধ করে স্বর্ণা, ‘এতোদিন তোমাকে এসব বলিনি বলে!’

‘আরে দুররর,’ স্বর্ণাকে কাছে টেনে নেয় সাজিদ, ‘সবার জীবনেই কিছু সিক্রেট থাকে। আমারও থাকতে পারে। কিছু কথা না জানলে ক্ষতি নেই।’

অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে স্বর্ণা।

………………………………………………………………..সমাপ্ত…………………………………………………………….

গল্পের বিষয়:
ফ্যান্টাসি
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত