একজন মধ্যবয়সী পুরুষকে কপালে ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় প্লেনে উঠতে দেখলে অন্যান্য যাত্রীরা কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে থাকবে- এটাই স্বাভাবিক। আমি উঠেছি কুয়ালালামপুর থেকে ঢাকাগামী একটা যাত্রীবাহী প্লেনে। কপালে মোটা করে ব্যান্ডেজ বাঁধা, চলা ফেরায় একটু আড়ষ্ট ভাব।
ইন্টারকমে ফ্লাইট ক্যাপ্টেন ঘোষণা দিলেন প্লেন ছাড়তে আর খুব বেশি সময় বাকি নেই। সবাই যেন নিজেদের সিট-বেল্ট বেঁধে নেয়।
আমার সিট-বেল্ট বাঁধতে একটু ঝামেলা হচ্ছে। ডান হাতে ব্যথা পাওয়ার দরুন কাজটা করতে হচ্ছে বা হাতে। হাতে খুব একটা জোর পাচ্ছিনা। একবারে নয়, দুইবারেও নয়, তিনবারের চেষ্টায় আমি সিট-বেল্টটা আটকাতে সমর্থ হলাম।
“আর ইউ অলরাইট?”
প্রশ্নটা শুনে পাশের সিটে তাকালাম। আমার পাশে একজন বৃদ্ধা বসেছেন। দেখে মনে হচ্ছে ইউরোপিয়ান।
“হ্যাঁ, আমি ঠিক আছি”। পরিষ্কার উচ্চারণে জবাব দিলাম আমি।
মহিলাকে দেখে মনে হচ্ছে একটু অবাক হয়েছেন। একজন এশিয়ানের মুখে হয়ত তিনি এত চমৎকার ইংরেজি আশা করেন নি।
“আমি ভাবলাম তোমার কোন সাহায্য দরকার কিনা”! বৃদ্ধা অমায়িক ভঙ্গিতে হাসলেন।
“না না, সব ঠিক আছে”! আমিও সুন্দর করে হাসার চেষ্টা করলাম।
“কপালের ব্যান্ডেজ দেখে মনে হচ্ছে ভালই আঘাত পেয়েছ”!
আমি একহাতে কপালের ব্যান্ডেজটা স্পর্শ করলাম। ভুলেই গিয়েছিলাম সেটার অস্তিত্বের কথা! বৃদ্ধার উদ্দেশ্যে বললাম, “ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছিলাম, পেটালিং জায়ায়, সানওয়ে পিরামিড হোটেলের সামনে”।
“বল কি?” মহিলাকে বিচলিত মনে হল। “কি ভয়ঙ্কর ব্যাপার! ওরা তোমার কাছ থেকে কিছু নিতে পেরেছে?”
প্রশ্নটা শুনে কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করলাম আমি। ঠোঁটের কোনে একটা তিক্ত হাসি ফুটে উঠল। মনে মনে বললাম, “নিয়েছে! অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস তারা নিয়ে গেছে”! মুখে বললাম, “হ্যাঁ, আমার ওয়ালেটটা ছিনতাই করেছে”।
“থাক! খুব বেশি ক্ষতি তাহলে হয়নি”। মহিলা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল যেন। অথচ আমার কত বড় ক্ষতি হয়েছে
সেটা ওনার ধারনার বাইরে! মহিলা পরিচিত হওয়ার জন্য হাত বাড়াল, “আমি প্যাট্রিসিয়া গোমেজ”।
আমি হাসিমুখে হাত মেলালাম, “আমি আব্দুর রশিদ”।
“তোমার সাথে পরিচিত হতে পেরে ভাল লাগছে রশিদ। তুমি কি বাংলাদেশি?”
“রশিদ” শব্দটা সঠিক উচ্চারণে বলতে পারলেও “বাংলাদেশি” শব্দটার উচ্চারণ শুদ্ধ হলনা। অনেকটা “ব্যাংলাদ্যাশি” শোনাল। আমি বললাম, “হ্যাঁ, আমি বাংলাদেশি। একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোফেসর। আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে যোগদানের উদ্দেশ্যে মালয়েশিয়া এসেছিলাম”।
“জিসাস! আমার পাশে একজন প্রোফেসর বসে আছেন! কি সৌভাগ্য আমার”! মহিলার কণ্ঠে অকৃত্রিম আনন্দের সুর।
আমি হাসি ধরে রেখেছি। “আপনি কেন যাচ্ছেন বাংলাদেশে?”
“আমি ডেনমার্কের নাগরিক। আমার স্বামী ভিনসেন্ট গোমেজ তোমাদের দেশে একটা ডেভেলপমেন্ট প্রোজেক্টে কাজ করছে”। মহিলা এমন ভঙ্গিতে কথাটা বলল যেন বাংলাদেশে কাজ কতে পারাটা বিরাট বড় গর্বের বিষয়। “আমি তার সাথে দেখা করতেই বাংলাদেশ যাচ্ছি। ডেনমার্ক থেকে তো সরাসরি বাংলাদেশে যাওয়া যায়না, মালয়েশিয়া পর্যন্ত এসে বিমান পরিবর্তন করতে হয়”।
“জেনে ভাল লাগল”। আমি হাসিমুখে বললাম।
ভাল করে দেখছি বৃদ্ধাকে। কত বয়স হবে ওনার? ষাটের উপরে নিশ্চয়ই! এই বয়সেও যথেষ্ট শক্ত-সামর্থ্য আছেন। আমাদের দেশে এই বয়সী বেশিরভাগ নারী অন্যের সাহায্য ছাড়া চলতে পারে না। আর উনি একা একা ভিনদেশে চলে এসেছেন স্বামীর সাথে দেখা করার জন্য।
ইন্টারকমে আবারো ক্যাপ্টেনের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। প্লেন আর কিছুক্ষণের মধ্যেই টেইক অফ করবে। সবাইকে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে বলা হল। এয়ার হোস্টেজরা শেষ বারের মত পরীক্ষা করে দেখছে সবার সিট-বেল্ট ঠিকমত বাঁধা হয়েছে কিনা!
প্লেনটা রানওয়ে ধরে ছোটা শুরু করল। একটু একটু করে গতি বাড়ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে আমি টের পেলাম প্লেনের চাকাগুলো মাটি ছেড়ে শূন্যে উঠে পড়ল। বাতাসে ভর দিয়ে ভাসছে। দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে বিমান। পেছনে ফেলে যাচ্ছি ব্যস্ত শহরের কোলাহল, সানওয়ে পিরামিড হোটেল আর এমন একটি ঘটনা যা আমার জীবনটাকে রাস্তার মাঝখানে এনে ছেড়ে দিয়েছে।
“অনেক টাকা ছিল তাইনা?”
আমি একটু অন্যমনস্ক ছিলাম। মিসেস গোমেজের প্রশ্নটা শুনে সংবিৎ ফিরে পেলাম। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, “আমাকে কিছু বলছেন?”
“তোমাকে একটু আপসেট দেখাচ্ছে। তাই জিজ্ঞেস করলাম ছিনতাই হওয়া ওয়ালেটে অনেক টাঁক ছিল কিনা”! মিসেস গোমেজ বললেন।
“আ.. আমি ঠিক জানিনা”। কি জবাব দিব বুঝতে পারছি না। আমার মনে পড়ল হাসপাতালের বিছানায় জ্ঞান ফিরার পর আমি কেমন হতভম্ব হয়ে পড়েছিলাম। আমি কে? কোথায় থাকি? কোত্থেকে এসেছি- কিছুই মনে পড়ছিল না। “খুব বেশি টাকা থাকার কথা না। আসলে ওরা মাথায় আঘাত করার পর আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। এর পর সব কিছু ঠিকমত মনে করতে পারছি না। বলতে পারেন একটু মেমোরি লসের প্রবলেম দেখা দিয়েছে”।
মহিলার মুখ থেকে আফসোস করার মত এক ধরনের শব্দ বেরিয়ে এলো। বোঝা যাচ্ছে ব্যাপারটা লোক দেখানো নয়।
আসলেও ব্যথিত হয়েছেন ঘটনাটা শুনে। “আহারে! কিন্তু এরপর তোমার স্মৃতিগুলো ফিরে এসেছে নিশ্চয়ই”?
“হ্যাঁ, কিছু স্মৃতি ফিরে এসেছে। পুলিশ আমার ওয়ালেট আর মোবাইলটা উদ্ধার করে এনেছে। মোবাইলের কন্টাক্ট লিস্ট, মেসেজ সহ সব কিছু গায়েব। কিন্তু ওয়ালেটের মধ্যে আমার বাংলাদেশি ড্রাইভিং লাইসেন্স আর ভিজিটিং কার্ড ছিল। নিজের নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর সব মনে পড়েছে আমার”।
“আর কোন স্মৃতি মনে পড়েনি?” মহিলা উদ্বিগ্ন যেন আমার স্মৃতি ফিরে না আসাটা তারই দোষ!
আমি বললাম, “হ্যাঁ, এই ঘটনার পরও কনফারেন্সের কাজে কিছুদিন থাকা লেগেছে মালয়েশিয়ায়। বিভিন্ন সময়ে একটু একটু করে টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো ফিরে এসেছে”।
“আর কি কি মনে পড়ল?”
“আমি বিবাহিত। আমার স্ত্রীর নাম স্বর্ণা, পুরোদস্তুর বাঙালী গৃহিণী। আমার দুটি সন্তান আছে। ছেলেটার নাম জিতু, হাই স্কুলে পড়ে। মেয়েটার নাম মিতু, ও পড়ে কলেজে। আমরা ছোট্ট সুন্দর একটা ফ্ল্যাটে বসবাস করি। এইতো, খুব সাধারণ জীবন আমার”!
“বাহ! একটা পারফেক্ট ছোট্ট সুখী পরিবার”। মিসেস গোমেজ আন্তরিক ভঙ্গিতে হাসলেন।
আমি ভাবছি কেন আমি এই মহিলার কাছে এসব কথা বলছি? মহিলা খুব আন্তরিক, মায়ের বয়সী, আমার প্রতি মায়া দেখাচ্ছেন- কিন্তু এগুলো কোন যুক্তিযুক্ত কারণ হতে পারেনা! যে কথাগুলো নিজের ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে বলিনি তা এই মহিলাকে কেন বলতে যাব? আসলে আমি সম্ভবত কাউকে খুজছিলাম যার সাথে এই কথা গুলো বলে একটু হালকা হওয়া যায়। এমন কেউ যে আমাকে চেনেনা, যাকে কথাগুলো বলার মাঝে কোন ক্ষতি নেই। আমার ফিরে আসা স্মৃতির মাঝে এমন কিছু বিষয় আছে যা পরিচিত কাউকে বলা সম্ভব নয়!
বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচে একটা আন্তর্জাতিক কর্মশালায় যোগদানের জন্য চারদিনের সফরে মালয়েশিয়া এসেছিলাম আমি। ছিনতাইয়ের ঘটনাটা ঘটেছে সানওয়ে হোটেলে ওঠার ঠিক পাঁচ ঘণ্টা পর। মাথায় আঘাত পাওয়ার পর আমাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। জ্ঞান ফেরার পর আমি কে? কোত্থেকে এসেছি? কিছুই মনে করতে পারছিলাম না!
পুলিশ আমার ওয়ালেট আর মোবাইলটা উদ্ধার করতে পেরেছিল। ওয়ালেট থেকে পাওয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স আর ভিজিটিং কার্ড দেখে নিজের পরিচিত খুঁজে পেলাম। মালয়েশিয়ায় এসেছি কি উদ্দেশ্যে তাও মনে পড়ল। কিন্তু নিজের পরিবার-পরিজন সম্পর্কে কিছুই মনে পড়েনি। হাসপাতাল থেকে ফিরে মাত্র ৬ ঘণ্টার বিশ্রাম নিয়েই আবার কনফারেন্সে যোগ দিলাম। এর পর নানা টুকরো টুকরো ঘটনার মধ্যে দিয়ে একটু একটু করে মনে পড়ছিল সব কিছু।
প্রথমেই মনে পড়ল আমার স্ত্রী স্বর্ণার কথা। তার সাথে প্রথম দেখা হওয়ার সেই স্মৃতি কখনও ভুলে যাওয়ার নয়। কোন এক পহেলা বৈশাখে লাল শাড়ি পরিহিতা মেয়েটি শাহবাগের মোড়ে একা একা দাঁড়িয়ে কাঁদছিল। ভিড়ের মধ্যে কে যেন তার পার্সটা চুরি করেছে। বান্ধবীদের কাছ থেকেও দলছুট হয়ে পড়েছে। চিটাগাং থেকে ঢাকায় বেড়াতে এসেছে কদিন হল, রাস্তা-ঘাট কিছুই চেনেনা।
আমি এগিয়ে গিয়েছিলাম তাকে সাহায্য করার জন্য। সারাটা বিকেল ধানমণ্ডি-কলাবাগান এলাকা তন্ন তন্ন করে খুঁজে অবশেষে রাত ১১টার দিকে তাকে ঠিকানামত পৌঁছে দিতে পারলাম। অবশ্য এর মধ্যে স্বর্ণার পাশাপাশি কাটানো কয়েকটি ঘণ্টা ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্তগুলোর মাঝে একটি। দুজনে ধরা পড়লাম প্রগাঢ় প্রেমের বন্ধনে।
এর পরের যে স্মৃতি আমার মনে পড়ছে সেখানে স্বর্ণা আমার স্ত্রী। আমি খুব ক্লান্ত হয়ে কর্মস্থল থেকে বাসায় ফিরেছি। স্বর্ণা এগিয়ে এসে আমার গা থেকে কোর্ট টা খুলে রাখল। টাইয়ের নট খুলে দিচ্ছে, পা থেকে জুতো খুলতে সাহায্য করছে। রাতে বাচ্চাদেরকে সাথে নিয়ে আমরা ডিনার করছি। ডিনার শেষে সবাই একসাথে বসে টিভিতে একটা ফ্যামিলি ড্রামা দেখছি। আরও কত কি…
তাহলে এখন তো সব ঠিক ঠাক ? মিসেস গোমেজ প্রশ্ন করলেন।
আমি সঙ্গে সঙ্গে মহিলার প্রশ্নের জবাব দিলাম না। পকেট থেকে রুমাল বের চশমার কাঁচ মুছলাম। বুঝতে পারছি না সমস্যাটা তার কাছ খুলে বলা উচিত হবে কিনা! বললাম, “মনে তো হচ্ছে সব ঠিকই আছে”।
নাহ! মহিলা মাথা নাড়লেন। আমার মনে হচ্ছে এখানে কোথাও একটা কিন্তু আছে যা তুমি আমার কাছে বলতে চাইছ না! অবশ্য তোমার আপত্তি থাকলে জোর করে বলার দরকার নেই।
আমি ভেবে দেখলাম। মহিলাকে বললে আসলে কোন ক্ষতি নেই। উনি আমাকে চেনেন না, জানেন না। কথাগুলো গোপনই থাকবে। আর আমারও মনে হচ্ছে কারো সাথে কথা গুলো শেয়ার করলে হয়ত সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যাবে!
বললাম- “সব কিছুই ঠিক আছে। শুধু একটা জিনিস বাদে”!
কি সেটা? আগ্রহে মহিলার চোখ দুটি চকচক করে উঠল।
“জেনি”! আমি সংক্ষেপে জবাব দিলাম।
“জেনি? কে জেনি?”
আমার মুখে তিক্ত হাসি। আমার স্মৃতি ফিরে এসেছে ঠিকই, কিন্তু সাথে নিয়ে এসেছে ভয়ংকর এক উপাদান। শিক্ষকের সাধারণ জীবন, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা ছাড়াও আমার জীবনে সম্ভবত আরও একজন আছে। বেশ লম্বা, আগুন-সুন্দরী আর কামোত্তেজক দৈহিক গড়নের অধিকারী একজন নারী! জেনি!
স্ত্রী স্বর্ণার কাছে প্রায়ই ফ্যাকাল্টি মিটিং আছে, অন্য বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে যাব, শহরের বাইরে বিশেষ ভাইভা এক্সামে এক্সটারনাল হিসেবে ডিউটি পড়েছে- এ ধরনের মিথ্যা বলে আমি গোপনে জেনির সাথে মিলিত হই। আমাদের বুনো জানোয়ারের মত জৈবিক চাহিদা পূরণের উদ্দাম খেলা চলে গভীর রাত অবধি!
কিন্তু আমি অনেক ভেবে দেখেছি। আমার শান্ত-ভদ্র-নিরুপদ্রব জীবনে কোথায় জেনি খাপ খাচ্ছেনা। সম্ভবত জেনি বাস্তব কোন চরিত্র নয়। আমার মনের ভেতর বাস করা এক ধনের ফ্যান্টাসি। যা কিছু আমি স্বর্ণার কাছ থেকে পাইনি তাই হয়ত পূরণ করে নিয়েছি জেনি নামের এই কাল্পনিক চরিত্রটিকে আপন করে নিয়ে!
আমি মিসেস গোমেজকে পুরো বিষয়টা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলাম। বৃদ্ধা চোখগুলো সরু করে খুব মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনলেন। সব বলা শেষে দেখলাম মহিলা চুপ করে আছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এমন ফ্যান্টাসির কথা শুনে নিশ্চয়ই খুব হাসি পাচ্ছে আপনার?”
“একদম না”! মিসেস গমেজ তাৎক্ষনিক জবাব দিলেন। “পৃথিবীতে কেউ পারফেক্ট হয় না! আমি একজন পুরুষের সাথে জীবনের ৩০টি বছর পার করেছি। এমন অনেক স্বপ্নই অধরা রয়ে গেছে যা আমার স্বামী পূরণ করতে পারেনি! ফ্যান্টাসির মাঝে ডুবে থেকে স্বপ্নের সেই সব শূন্যস্থান আমি নিজেই পূরণ করে নিয়েছি। তাই তোমার ঐ ধরনের ফ্যান্টাসি থাকাটা হাস্যকর কিছু নয়। অবশ্য সত্যিই যদি বিষয়টা তোমার ফ্যান্টাসি হয়”!
“সমস্যাটা আসলে এখানেই”। আমি বললাম।
প্রথমবার জেনির স্মৃতি মনে আসার সময়টুকু আমার আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে। কনফারেন্সে একটা বোরিং দিন কাটিয়ে এসে আমি হোটেলে ফিরেছি। নিজের রুমে ঢুকে কোর্ট টাই না খুলেই বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম। খুব টায়ার্ড লাগছে, মাথাটাও কেমন যেন ঝিম ঝিম করছে। ঠিক তখনই জেনির কথা মনে পড়ল আমার!
আমি আর জেনি খুব ঘনিষ্ঠ অবস্থায় রয়েছি। মুহূর্তগুলো বড় বেশি বাস্তব। প্রত্যেকটা ছোট ছোট বিষয়ের বিস্তারিত বর্ণনা দিতে পারব আমি। মানুষের কল্পনাগুলো হয় ব্যক্তিকেন্দ্রিক। বস্তুকেন্দ্রিক বিষদ বর্ণনা সেখানে স্থান পাওয়ার কথা নয়! তাহলে কি পুরোটাই বাস্তব? স্ত্রী-পরিবারের বাইরেও আমার একটা একান্ত গোপন জীবন রয়েছে?
আমি বিষয়টা আরও খোলাসা করে বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করলাম। তারপর প্রশ্ন করলাম, “আপনার কি মনে হয়? এটা কল্পনা নাকি বাস্তব?”
“তোমার কি ধারনা?” মহিলা উল্টো প্রশ্ন করলেন।
“আমি আসলে জানিনা”। আমি হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লাম। “তবে নিজেকে এই কয়েকদিনে যতটুকু চিনেছি বা জেনেছি তাতে মনে হয়েছে আসলে সাধারণ জীবনের যে স্মৃতি আমার মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে সেটাই হল বাস্তব। গোপন অভিসারের ব্যাপারটা পুরোপুরি ফ্যান্টাসি। আমার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলোর সাথে ব্যাপারটা আসলে যাচ্ছে না! জেনি নামে আসলে আমার জীবনে কেউ নেই”।
“আমিও তাই আশা করছি”। মিসেস গোমেজকে দেখে মনে হচ্ছে একটু চমকে গেছেন। কারো ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কৌতূহলী হওয়ার ফলে এমন বিশাল কোন বিষয় বেরিয়ে আসতে পারে এটা সম্ভবত আশা করেননি।
“তবে কি জানেন? এই স্মৃতি হারানো ও ফিরে আসার মধ্যে দিয়ে একটা বিষয় খুব ভালমতো বুঝতে পেরেছি আমি”।
“কি সেটা?” মিসেস গোমেজকে আর আমার ব্যাপারে আগ্রহী মনে হচ্ছে না।
“একজন মানুষের জন্য নিজেকে একটা নির্দিষ্ট জীবনের গণ্ডিতে নিজেকে বেঁধে রাখা ঠিক নয়”। আমি অনেকটা দার্শনিকদের মত করে বলার চেষ্টা করলাম। “প্রত্যেকটা মানুষের নদীর এপার-ওপার দুটোই দেখে নেয়া উচিত”!
“ওহ জিসাস! কি বলছ তুমি? দ্যাটস টোটালি অ্যাবসার্ড”! মিসেস গোমেজকে দেখে মনে হচ্ছে রেগে গেছেন। “যদি সবাই তোমার মত করে ভাবে তাহলে পরিস্থিতি কি দাঁড়াবে একবার ভেবে দেখছ? এই জগত থেকে আস্থা-ভালবাসা-বিশ্বাস সব উঠে যাবে! একজন মানুষের একাধিক জীবন থাকা উচিত নয়! এটা যাপিত জীবনে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে”!
কথাগুলো বলা শেষে মিসেস গোমেজ সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। মনে হয়না আমার সাথে আর কথা বলার ইচ্ছা আছে তার। আমি আপন মনে হাসলাম! একটু আগেও মহিলা কত্ত আগ্রহ দেখাচ্ছিলেন! কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসাতে ভীষণভাবে ঘাবড়ে গেছেন।
বাকিটা পথ আর কোন কথা হলনা। প্লেন ঢাকার মাটিতে ল্যান্ড করল। আমি কাস্টমসে দাঁড়িয়ে মিসেস গোমেজকে সাহায্য করলাম তার লাগেজগুলো কালেক্ট করার জন্য। ভারী ভারী বেশ কয়েকটা লাগেজ নিয়ে এসেছেন মহিলা। জীবনের বাকিটা সময় কি দুই বুড়োবুড়ি বাংলাদেশে কাটিয়ে দেওয়ার প্ল্যান করেছেন নাকি?
মিস্টার ভিনসেন্ট গোমেজ রিসেপশন কাউন্টারে বসে অপেক্ষা করছিলেন। স্ত্রীর দেখা পেয়ে মুখটা হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বুড়োবুড়ি পরস্পরকে প্রবল উচ্ছ্বাসে জড়িয়ে ধরলেন। কতদিন পর দুজনের দেখা হল কে বলতে পারে?
তাদের মিলন দৃশ্য দেখা শেষে আমি রিসেপশন ডেস্কের দিকে আরও খানিকটা এগিয়ে আসলাম। হঠাৎ করেই যেন দেখতে পেলাম তাকে। স্বর্ণা! আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে! পরিপাটি করে পড়া শাড়ি, কপালে টিপ, দু-হাত ভর্তি চুরি। যেমনটি দেখেছি তাকে ফিরে পাওয়া স্মৃতির পাতায়, পারফেক্ট বাঙালী বধূ!
আমিও স্বর্ণার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। তাহলে আমার ধারনাই ঠিক। আমি খুব সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত। জেনির বিষয়টা পুরোপুরি আমার কল্প-বিলাস। প্রতিদিন একই নিয়মে গণ্ডিতে আঁটকে থাকা জীবনে একঘেয়েমি থেকে উদ্ধার পেতে নিজের অজান্তে মনের ভেতর একটা কাল্পনিক চরিত্রের জন্ম হয়েছে।
একমাত্র লাগেজটা ঠেলতে ঠেলতে স্বর্ণার দিকে আরও কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই মনে হল স্বর্ণা আসলে আমার দিকে তাকিয়ে নয়, আমার পেছনে অন্য কাউকে মধুর হাসি হাসছে! আমি ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনটা দেখার চেষ্টা করলাম। রাহুল! আমার বাল্যবন্ধু, বর্তমান সহকর্মী। কিন্তু স্বর্ণা আমাকে ফেলে রাহুলকে দেখে হাসবে কেন?
রাহুল আমাকে টপকে গিয়ে স্বর্ণার মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। আমি কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে তাদেরকে দেখছি। স্বর্ণা দু হাতে জড়িয়ে নিল রাহুলকে। রাহুল তার কপালে চুমু খেল। এতক্ষণে স্বর্ণার সিঁথির সিঁদুর নজরে এলো আমার। স্বর্ণা আসলে রাহুলের স্ত্রী! যে সাধারণ জীবনের স্মৃতি আমার মস্তিষ্কে ঘুরছে তা আসলে আমার নয়, এ জীবন রাহুলের। থলে আমি কে? আমি কি তবে একজন একা, অসহায়, নিঃসঙ্গ মানুষ? যা কিছু টুকরো স্মৃতি একটু একটু করে ফিরে আসছে আমার তার পুরোটাই আমার অলীক চিন্তা! সমৃদ্ধ এক কল্প–জগতের কাণ্ডারির বাস্তবতা ভীষণ শূন্যতায় আবৃত!
আমি রাহুল আর স্বর্ণার কাছ থেকে বিদায় দিয়ে হেঁটে চলে এলাম এয়ারপোর্টের বাইরে। তখনও জানতাম না আমার জন্য কিছু চমক এখনও বাকি। ড্রাইভিং লাইসেন্সের ঠিকানা অনুযায়ী আমি বনানীতে থাকি। দাঁড়িয়ে থাকা ট্যাক্সি ড্রাইভারদের সাথে ভাড়া নিয়ে দরদাম করছি ঠিক তখনই চমৎকার একটা নিল রঙের প্রাইভেট কার কাছাকাছি এসে কড়া ব্রেক কষে থামল। গাড়ি থেকে নামল একজন আগুন সুন্দরী। আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। আমার কাছ থেকে মাত্র এক হাত দূরত্বে এসে দাঁড়াল জেনি!
বিদ্যুৎ চমকের মত মাথার ভেতর খেলতে থাকা কিছু অসংলগ্ন টুকরো টুকরো স্মৃতি নিমেষেই জোড়া লেগে গেল। আমি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ জেনির সাথে, স্বর্ণার সাথে নই! তাহলে গোপন জীবন বলে যা ভাবছি সেটাই আসলে বাস্তব! স্ত্রী- সন্তানদের নিয়ে যে ভাবনা গুলো মাথায় এসে ভিড় করছে সেটাই আসলে কল্পনা!
গোটা এয়ারপোর্ট এলাকা যেন থমকে গেছে, হা করে সব তাকিয়ে আছে জেনির দিকে। জেনি একজন ফ্যাশন ডিজাইনার, নিজেও খুব ফ্যাশন সচেতন। পরনের স্লিভলেস ব্লাউজ আর পাতলা শিফনের শাড়ি তারা দেহের ভাজগুলো লুকিয়ে রাখতে পারেনি। এই তপ্ত দুপুরে সূর্যের তেজ অপেক্ষা জেনির রূপের আগুন কয়েকগুণ বেশি প্রখর বলে বোধ হচ্ছে। মনে হচ্ছে স্পর্শ করলে হাতে ফোসকা পড়ে যাবে!
জেনি আহত-দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি খুব দুঃখিত রশিদ! পৌঁছাতে একটু দেরি করে ফেললাম! তুমি রাগ করেছ তাইনা?
এমন সৌন্দর্যের আধারের প্রতি কি রাগ করে থাকা যায়? আমি হাসিমুখে বললাম, ইটস অলরাইট।
তুমি হাসপাতালে থাকা অবস্থায় রাহুলদা ফোনে বলেছিলেন তোমার এক্সিডেন্টের ঘটনা। ফ্যাশন উইক চলছিল, আমি কাজ নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলাম, তাছাড়া তোমার সাথে যোগাযোগ করার উপায় পাচ্ছিলাম না…
আমি সবেমাত্র আবিষ্কার করেছি লক্ষ পুরুষের ঘুম হারাম করে দেয়া এক সুন্দরীর স্বামী আমি! স্ত্রীর সব অপরাধ নির্দ্বিধায় ক্ষমা করে দিতে প্রস্তুত! জেনিকে কথা শেষ করতে দিলাম না, দু পা এগিয়ে এসে একহাতে তার কোমর পেঁচিয়ে ধরে আমার গায়ের কাছে টেনে আনলাম, “বললাম না ইটস অলরাইট?”
কপট রাগে ভ্রু কুচকালো জেনি। আমার বুকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। “পাবলিক প্লেসে কি পাগলামি শুরু করলে? যাও, গিয়ে গাড়িতে ওঠো”!
জেনি উঠল ড্রাইভিং সিটে, আমি বসলাম তার পাশে। জেনি ড্রাইভার রাখেনা, যেকোনো যায়গায় নিজেই ড্রাইভ করে যায়। গাড়ি স্টার্ট দেয়ার পর থেকে সারাক্ষণ তাকেই দেখছি আমি। কল্পনার জেনির সাথে বাস্তবের জেনিকে মিলাতে চেষ্টা করলাম- বাস্তবের জেনি অনেক বেশি আকর্ষণীয়!
“কি ব্যাপার বলতো?” জেনি আড়চোখে আমাকে দেখে ঠোট টিপে হাসছে। “আজকের মত এতটা রোম্যান্টিক হতে তোমাকে আগে কখনও দেখেছি বলে তো মনে পড়েনা”!
কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, তখনই পকেটে রাখা মুঠোফোন বার কয়েক কেঁপে উঠল। হাতে নিয়ে দেখলাম অচেনা নম্বর থেকে ফোন এসেছে। হয়ত এই নম্বর আমার চেনাই, ফোনের কন্টাক্ট লিস্ট গায়েব হয়ে যাওয়ায় এখন অচেনা মনে হচ্ছে।
আমি রিসিভ করলাম, “হ্যালো”।
“হ্যালো, রশিদ”? সুরেলা নারী কণ্ঠ শুনতে পেলাম।
“হ্যাঁ, বলছি”।
“সরি রশিদ। আমি না… আসলে রাহুল সামনে ছিল তো, তাই তোমার সাথে ঠিকভাবে কথা বলতে পারিনি! তুমি প্লিজ রাগ করোনা লক্ষ্মীটি”।
আমি ঘাবড়ে গেলাম! এ কোন সুরে আমার সাথে কথা বলছে স্বর্ণা?
“ইয়ে… মানে…” আমতা আমতা করছি আমি।
“তোমার জন্য একটা দারুণ খবর আছে জানো”? স্বর্ণার কণ্ঠে ব্যাপক উচ্ছ্বাস, যেন কোন টিনেজ মেয়ে এডভেঞ্চারে যাচ্ছে!
“কি খবর?” সংক্ষেপে জিজ্ঞেস করলাম আমি। স্বর্ণার আচরণের কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছিনা।
“আজ রাতের ট্রেনে রাহুল বাড়ি যাবে, জমি জমা সংক্রান্ত কি যেন একটা ঝামেলা বেঁধেছে। জিতু আর মিতুও তার সাথে যাচ্ছে। দুদিন আগে ফিরবে না। কাজের মেয়েটাকেও দু দিনের জন্য ছুটি দিয়ে দেব। তারমানে কি দাঁড়াল? বাড়িতে আমি একা”!
হাত থেকে মোবাইলটা ফেলে দিতে গিয়েও শেষ মুহূর্তে সামলে নিলাম। স্পষ্ট টের পেলাম আমার গায়ের লোমগুলো সব দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। কি বলছে এসব স্বর্ণা? কি বুঝাতে চাইছে সে? তারমানে কি…
হ্যাঁ… টুকরো টুকরো কিছু স্মৃতি এখন জোড়া লাগতে শুরু করেছে। আমার গোপন অভিসারের স্মৃতিগুলো আসলে মিথ্যা নয়! আমি সত্যিই বাড়িতে মিথ্যা বাহানা দেখিয়ে গোপনে গিয়ে প্রেয়সীর সাথে মিলিত হই। আমার সেই অভিসারের সঙ্গী জেনি নয়, স্বর্ণা!
কিন্তু কেন? জেনিকে একনজর দেখলেই যেকোনো পুরুষের রাতের ঘুম হারাম হবে! কবি সাহিত্যিকরা হয়ত এমন নারীকে দেখেই বলে ওঠেন যেন বিধাতার নিজ হাতে সৃষ্টি! সুন্দরী, স্মার্ট আর ফ্যাশন সচেতন স্ত্রী ছেড়ে আমি কেমন করে পরের স্ত্রীর সাথে পরকীয়ায় লিপ্ত হলাম? কেন? কেন?
কেন?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে!
মনে পড়েছে!
স্বর্ণার সাথে শাহবাগের মোড়ে আমার প্রথম দেখা হওয়ার সেই স্মৃতি কোন অলীক কল্পনা নয়! কঠিন বাস্তব! আমরা পরস্পরকে গভীরভাবে ভালবাসতাম। কিন্তু ধর্মীয় বাধার কারণে দুজনের পরিবার আমাদের সম্পর্কটা মেনে নেয়নি। স্বর্ণার পরিবার তাকে জোর করে আমারই বাল্যবন্ধু রাহুলের সাথে বিয়ে দেয়! রাহুল উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে ছিল, সে স্বর্ণার সাথে আমার সম্পর্কের কথা জানত না। রাহুল এমনকি এটাও জানত না যে তার সাথে বিয়ের সময় স্বর্ণা একমাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল!
এদিকে আমার স্ত্রী জেনি বন্ধ্যা, একটা দুর্ঘটনায় পড়ে সে সন্তান ধারণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। পারিবারিকভাবে আমাদের বিয়েটা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাকে আমি কোনদিন মন থেকে ভালবাসতে পারিনি। সুখী একজন স্বামীর ভূমিকায় অভিনয় করে চলেছি প্রতিমুহূর্তে…
“কি হল? কোন কথা বলছ না কেন?” ফোনের ওপ্রান্তে স্বর্ণার অস্থির কণ্ঠ শোনা গেল।
“হ্যাঁ?… হ্যাঁ হ্যাঁ, শুনছি তো”। আমার গলা শুকিয়ে কাঠ, মনে হচ্ছে এক্ষুনি এক গ্লাস পানি না খেলে মরে যাব!
“তুমি জেনিকে কিছু একটা মিথ্যা বলে আজ রাতেই চলে আসবে। দেরি করবে না কিন্তু! তুমি তো জানোই যে আমি একা থাকতে ভীষণ ভয় পাই! কি বললাম বুঝেছ?”
কোনওমতে “আচ্ছা”,”ওকে”, “ঠিক আছে” ইত্যাদি বলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করলাম।
না! এ অন্যায়! বিয়ের আগে কি করেছি জানিনা, কিন্তু বিয়ের পর পরের স্ত্রীর সাথে অনৈতিক সম্পর্ক রাখাটা একটা জঘন্য ব্যাপার! একজন শিক্ষক হয়ে আমি এ কাজ করতে পারিনা! জেনি বন্ধ্যা তো কি হয়েছে? আমরা ইয়াতিমখানা থেকে একটা বাচ্চা পালক এনে ভরণ পোষণ করব! জেনিকে নিয়ে এ শহর ছেড়ে চলে যাব অনেক দূর! স্বর্ণার মুখ যেন আর কখনও দেখতে না হয়!
“কার ফোন ছিল?” জেনি প্রশ্ন করল।
“ইয়ে…” একমুহূর্ত ইতস্তত করলাম। আমি পারব না স্বর্ণাকে ছেড়ে থাকতে! স্বর্ণাকে আমি ভালবাসি! কোনকিছুর বিনিময়ে আমি স্বর্ণার সহচর্য ত্যাগ করতে পারব না! কণ্ঠ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলাম, “ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ ফোন করেছিল। আমাদের নারায়ণগঞ্জে একটা নতুন ক্যাম্পাস চালু হচ্ছে না? ওটার সার্বিক পরিস্থিতি প্রদর্শনের জন্য দুদিনের জন্য যেতে হবে আমায়”।
“আজই?”
“হুম, আজই”।
“তুমি আপত্তি জানাতে পারলে না?” জেনি অবাক হয়েছে। “সবে তো মাত্র বিদেশ থেকে ফিরলে, একটা দিন অন্তত রেস্ট নাও! তাছাড়া তুমি তো অসুস্থ”!
“না… আসলে… ফ্যাকাল্টির ডিন আর ভিসি স্যার যে আমার উপরে অনেক ভরসা করেন তা তো জানোই”। আমি যে এত চমৎকার করে মিথ্যা বলতে পারি সে সম্পর্কে আমার কোন ধারনাই ছিলনা! “ওনাদের কথায় আমি কিকরে আপত্তি জানাই বল?”
“ওহ আচ্ছা”! বলে গাড়ি চালানোয় মনযোগী হল জেনি। অভিমানী বাচ্চা মেয়ের মত ঠোট উল্টে রেখেছে।
এরপর কিছুক্ষণ নীরবে কেটে গেল। চুপচাপ ড্রাইভ করছে জেনি। রাগ করেছে। আমার মধ্যে রাগ ভাঙানোর কোন
লক্ষণ নেই। জেনিই আবার নীরবতা ভাঙল, “ঐ জিনিসটা খুঁজে পেয়েছি”।
“কিসের কথা বলছ?” আমি প্রশ্ন করলাম।
“যেটা হারিয়ে ফেলেছি বলে মাসখানেক আগে তুমি আমার সাথে খুব রাগারাগি করছিলে”!
“মানে?” আমি একটু অবাক হলাম। “আমার ঠিক মনে পড়ছে না”!
“এত জলদি ভুলে গেছ?” জেনিও অবাক হয়েছে। “তোমার আমার প্রথম দেখা হওয়ার দিন যে শাড়িটা পড়েছিলাম, ওরা খুঁজে পেয়েছি। সেই যে শাহবাগের মোড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলাম! আমার পরনে একটা লাল পাড়ের সাদা শাড়ি ছিল! এখন মনে পড়েছে?”
আমি মনে হচ্ছে কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি! চোখ দুটো বড় বড় করে তাকিয়ে থাকলাম জেনির দিকে! শাহবাগের মোড়ে দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকা মেয়েটি জেনি ছিল! তাহলে স্বর্ণা এলো কোত্থেকে? কীভাবে তার সাথে পরিচয়? কেন তার সাথে সম্পর্কে জড়ালাম?
জেনি বলে চলেছে, “পুরনো কাপড় চোপড়ের একটা বাক্সের ভেতর ছিল। ভেবেছিলাম আজকে পড়ে তোমাকে রিসিভ করতে আসব। কিন্তু একটু বেশি পুরনো হয়ে গেছে বলে পড়িনি। ইচ্ছে ছিল বাসায় ফিরে তোমার সামনে পড়ব। কিন্তু সে সুযোগ তো আর পাব না! তুমি তো মহাব্যস্ত মানুষ”!
আমার মনে হচ্ছে কোথাও বিরাট একটা গোলমাল হয়ে গেছে! মস্ত বড় গোলমাল! স্মৃতির এক গোলক ধাঁধাঁয় পড়ে গেছি আমি! কোনটা স্মৃতি আর কোনটা বাস্তব তা নিয়ে এতক্ষণ দ্বিধান্বিত ছিলাম, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে স্মৃতিগুলো সব এক সাথে পাক খেয়ে গুলিয়ে গেছে!
কে স্বর্ণা?
কে জেনি?
কার সাথে কীভাবে পরিচয়?
কাকে ভালবাসি?
ওহ গড! মনে হচ্ছে আমি পাগল হয়ে যাব!
মিসেস গোমেজ একটা কথা বলেছিলেন- “একজন মানুষের একাধিক জীবন থাকা উচিত নয়! এটা জীবনে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে”!
দেখা যাচ্ছে মহিলা ঠিক কথাই বলেছিলেন!
…………………………………………………………..(সমাপ্ত)……………………………………………………………