ধূর্ত শেয়াল বধ

ধূর্ত শেয়াল বধ

সাইনবোর্ডের উপরে বড় বড় অক্ষরে লেখাটি কালের বিবর্তনে মলিন হয়ে গেছে। এক সময় হয়ত রঙ্গিন অক্ষরে লেখা ঐ নাম খুব নজর কাড়ার মত আকর্ষণীয় ছিল, কিন্তু এখন আর তা দূর থেকে ঠিকমত পড়া যাবে না।
“ধূর্ত শেয়াল বধের খেলা”

খেলার ময়দানের নামফলক পুরনো হয়ে গেছে ঠিকই, খেলা কিন্তু পুরনো হয়নি! এখনও চলছে পুরোদমে। প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময়ে খেলার সিজন শুরু হয়ে যায়। শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত কোন বছর মিস হয়নি।

এই যায়গাটা এক সময় ছিল পশু পাখির অভয়ারণ্য। প্রায় তিন মাইলের মত এলাকা উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, পাঁচিলের উপর আবার লম্বা কাঁটাতারের বেড়া। দূর দুরান্ত থেকে মানুষ বেড়াতে আসত এই সাফারি পার্কে। প্রাকৃতিক পরিবেশে বন্য পশু পাখির অভিযোজন প্রক্রিয়া অবলোকন করত। কিন্তু একটা সময় কতৃপক্ষ আগ্রহ হারাল।

মালিক পক্ষের লোকজন একে একে এখানকার সমস্ত পশু ধরে নিয়ে চিড়িয়াখানা আর সার্কাস কতৃপক্ষের কাছে বিক্রি করা শুরু করে। দেখেতে দেখতে সমস্ত পশু পাখি শেষ হওয়া যাওয়ায় যায়গাটা পরিনত হল এক বিরান অঞ্চলে। এত বড় একটা যায়গা এভাবে খালি পড়ে আছে দেখে মালিকের চিন্তা দাঁড়াল- কীভাবে যায়গাটা কাজে লাগানো যায়?

ঠিক তখন থেকেই শুরু হয় এই খেলা। “ধূর্ত শেয়াল বধের খেলা”। প্রতিবছর খেলাকে কেন্দ্র করে এ তল্লাটের মানুষের মাঝে উৎসব শুরু হয়ে যায়। এই খেলাকে বলা চলে এক অঘোষিত জুয়া খেলার আসর। দূর দুরান্ত থেকে দক্ষ শিকারিরা আসে প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার জন্য। এক এক জন শিকারির পক্ষে মানুষ জন লক্ষাধিক টাকা বাজি ধরে। যে শিকারি যত দক্ষ, তার বাজির দর তত বেশি।

ঘড়িতে ঠিক ১২টা বাজার সাথে সাথে শুরু হয়ে যাবে এই ঐতিহাসিক খেলা। আমি এগিয়ে যাচ্ছি আমার প্রবেশের জন্য নির্ধারিত ফটকের দিকে। পেছনে প্রচুর মানুষের মাঝে চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুনতে পাচ্ছি। যারা আমার পক্ষে বাজি ধরেছে তারা আমাকে উৎসাহ দেয়ার চেষ্টা করছে। আমি জিততে পারলে তারা রাতারাতি আমীর বনে যাবে, হেরে গেলে হয়ত দুই চার জন পথেক ভিকিরি হবে।

আমি প্রধান ফটকের সামনে এসে দাড়াতেই দুজন রক্ষি সসম্মানে উঠে দাড়াল। এই অঞ্চলে আমি মোটামোটি পরিচিত একজন মানুষ বলা চলে। গায়ে শিকারির পোশাক। এক কাধে ঝুলছে রাইফেল, অন্যকাধে তীর ধনুক, কোমরের খাপে ধারালো ছুরি। চোখে মুখে দক্ষ শিকারির অভিব্যক্তি। গত বছরের ধূর্ত শেয়াল বধের খেলায় আমি ছিলাম চ্যাম্পিয়ন।

খেলার নিয়মটা খুব সহজ। একটা খুব চালাক শেয়াল নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হবে জঙ্গলের মাঝখানে নিয়ে। তিন মাইল এলাকার মধ্যে যেকোনো যায়গায় সে লুকিয়ে থাকতে পারে। প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া শিকারিরা বিভিন্ন ফটক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। সবার উদ্দেশ্য একটাই- শেয়ালটাকে খুঁজে বের করে মেরে ফেলা। যেই শিকারি শেয়ালটিকে বধ করতে পারে, সেই হয় ধূর্ত শেয়াল বধের খেলায় চ্যাম্পিয়ন।

এই খেলার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হচ্ছে খেলার কোন নিয়ম কানুন নেই। শিকারি যেকোনো উপায়ে তার কার্যসিদ্ধি করতে পারে। এই জন্য যদি অপর প্রতিযোগীদের ক্ষতি করতে হয়, এমন কি মেরেও ফেলা হয়, তাতে কোন আপত্তি নেই। তাই প্রতিযোগীরা শুরুতে শেয়ালের পেছনে না ছুটে মেতে ওঠে একে অপরকে মারার খেলায়। সবশেষে যে থাকে সি একাই শেয়ালটাকে খুঁজে বের করে মারে। প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়ার পরও যদি কোন শিকারি খেলার ময়দান ছেড়ে জীবিত অবস্থায় বেরিয়ে আসতে পারে তাহলে সে খুব ভাগ্যবান।

খেলা যতই ভয়ঙ্কর হোক না কেন, চাইলেই যে কেউ এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহন করতে পারেনা! এই জন্য নানা রকম বাছাই প্রক্রিয়া পার হতে হয়। সূক্ষ্ম নিশানার প্রমান দিতে হয়। তবেই কি না চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় প্রবেশের সুযোগ মেলে। সর্বমোট ১২ জন প্রতিযোগী অংশ নিতে পারে চূড়ান্ত খেলায়। তবে এই প্রতিযোগিতায় জয় পরাজয় যাই ঘটুক, প্রতিযোগীরা প্রচুর টাকা পয়সা পায়। চ্যাম্পিয়ন হতে পারলে একটা বিশেষ সুবিধা হচ্ছে আরেকবার অংশ নেয়ার সুযোগ মেলে।

তবে কতৃপক্ষ বলেছে এ বছর খেলায় একটু পরিবর্তন আনা হয়েছে। কিন্তু কি সেই পরিবর্তন তা আমাদের জানানোহয়নি। ব্যাপারটাকে প্রতিযোগীদের জন্য চমক হিসেবে রাখা হয়েছে। মানুষের মাঝে অনেক জল্পনা কল্পনা চলছে এই পরিবর্তন নিয়ে। কিন্তু এখনও কেউ কোন কূল কিনারা করতে পারেনি এই রহস্যের।

ঠিক ১২টায় ফটক খুলে দেয়া হল। আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ সবাই হুল্লোড় ধ্বনি তুলে আমাকে অভিবাদন জানাচ্ছে। ওদের ধারণা গতবারের মত এবারও আমি চ্যাম্পিয়ন হব! এখন পর্যন্ত এই রেকর্ড কেউ করতে পারেনি। চ্যাম্পিয়ন হই বা না হই, যদি অপর প্রতিযোগীদের রোষানল থেকে দূরে বেঁচে বের হওয়া আসতে পারি, তাতেও টাকা পয়সা কম কামাবো না!

আমি ভেতরে প্রবেশ করে প্রথমেই বিশুদ্ধ বাতাসে বুক ভরে শ্বাস নিলাম। মেজাজটা ফুরফুরে হয়ে গেল। চারপাশটা ভাল করে দেখে নিলাম। আমি প্রবেশ করেছি বাম দিকের দ্বিতীয় ফটক দিয়ে। এখানকার পরিবেশ একটু বেশি অন্ধকারাচ্ছন্ন, পায়ে হাটার উপযোগী একমাত্র রাস্তাটা খুব বেশি ঘন গাছপালায় আচ্ছাদিত। এদিকে শেয়ালটার লুকিয়ে থাকার সম্ভাবনা কম।

আমাকে খুব সাবধানে পশ্চিমের দিকে এগিয়ে যেতে হবে যেন অন্য শিকারিরা আমার ট্র্যাক খুঁজে না পায়। ওরা জানে আমি গতবারের চ্যাম্পিয়ন। তাই সবাই হয়ত আমাকে অনুসরন করার চেষ্টা করতে হবে।

পায়ে হাঁটা পথ ধরে বেশ খানিকটা পশ্চিমে সরে আসতেই হঠাৎ গাছ পালার আড়ালে একটু নড়া চড়া টের পেলাম। মনে হচ্ছে শেয়ালটাই! অথবা হয়ত কোন শিকারি লুকিয়ে থেকে আমার গতিবিধির দিকে নজর রাখছে। আমি বুদ্ধি করে যায়গাটা ঘুরে একটু পেছন থেকে নড়া চড়া লক্ষ করে এগিয়ে এলাম। এবার দেখতে পেলাম!

শেয়াল তো একটা নয়! তিনটা শেয়াল! একসাথে তারা মাথা নিচু করে কিছু একটা খুটিয়ে খুটিয়ে খাচ্ছে। তাহলে এই পরিবর্তনের কথা বলেছে কতৃপক্ষ! একটা নয়, তিনটা শেয়াল ছাড়া হয়েছে এবার শিকার হওয়ার জন্য। নিজের পিঠ চাপড়ে দিতে ইচ্ছে করছে আমার! এত প্রতিযোগীর ভিড়ে আমিই প্রথম শেয়ালগুলোর সন্ধান পেয়েছি! দ্বিতীয়বার চ্যাম্পিয়ন হয়ে রেকর্ড গড়া এখন আমার জন্য সময়ের ব্যাপার মাত্র!

আমি ভাবছি কীভাবে শেয়ালগুলো বধ করা ভাল হবে? চাইলে রাইফেল ব্যবহার করা যায়। কিন্তু সেক্ষেত্রে অন্য প্রতিযোগীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়ে যাবে। এত বড় ঝুঁকি নেয়া যাবেনা। কাজটা করতে হবে নিঃশব্দে।

আস্তে ধীরে কোন রকম শব্দ ছাড়াই ধনুকে তীর চড়ালাম আমি। নিশানা করলাম সবচেয়ে ডান পাশের শেয়ালটাকে লক্ষ করে। সুযোগ বুঝে ছেড়ে দিলাম মৃত্যুবীজ। দীর্ঘদিনের প্রশিক্ষন, অব্যর্থ নিশানা। ডানপাশের শেয়াল টার ঘাড়ের কাছে গিয়ে বিঁধল তীরটা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে পড়ে গেল শেয়ালটা। অবশ্য তাতে একটা ঝামেলা হয়ে গেল। বাকি শেয়ালদুটো সাবধান হয়ে গেল। আমি আর একবার ধনুকে তীর চড়ানোর আগেই বড় বড় লাফে শেয়ালদুটো ঝোপঝাড়ের আড়ালে চলে গেল।

আমি এগিয়ে গেলাম পড়ে থাকা শেয়ালটার কাছে। শেয়ালের মাথাটা কেটে ব্যাকপ্যাকে ভরতে হবে। একটা কতল করা হয়ে গেছে, আরও দুটো বাকি! বাকি প্রতিযোগীদের থেকে বেশ খানিকটা এগিয়ে আছি আমি। কিন্তু সামনে এসে যা দেখলাম তাতে পিলে চমকে গেল আমার! শেয়াল দেখে নয়, শেয়ালগুলো কি খাচ্ছিল দেখে!

একটা মানুষের দেহ ছিন্ন ভিন্ন হয়ে পড়ে আছে। ভাল করে খেয়াল করতেই মৃতদেহের গায়ে শিকারির পোশাক দেখতে পেলাম আমি। তারমানে শেয়াল তিনটিন অতর্কিত আক্রমণে এক প্রতিযোগী মারা গেছে। প্রতিযোগীকে চিনতে পারলাম আমি। এর নাম রিগ্যান। খুবই দক্ষ শিকারি। সম্ভবত পশ্চিমের ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকেছিল। এইবারের খেলায় সবচেয়ে ফেবারিট ধরা হচ্ছিল তাকে! সামান্য শেয়ালের আক্রমণে পটল তুলল! বিমর্ষ হওয়ার বদলে খুশি হয়ে উঠলাম আমি। যাক! ব্যাটা মরে যাওয়ার ভালই হয়েছে। আমার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথে বাঁধা থাকল না আর।

কিছু একটা আওয়াজ শুনলাম আমি। কিছু দূরে আরও কয়েকটা শেয়ালের জটলা দেখে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে গেল। ওগুলোও নিচু হয়ে কিছু একটা খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। দূর থেকে চেনা যাচ্ছে না কিন্তু মনে হচ্ছে ওখানেও একজন শিকারির মৃতদেহ পড়ে আছে। হচ্ছেটা কি? এবার কি তবে শেয়াল আর মানুষের সংখ্যা সমান? খেলার নিয়মের এই পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছিল?

তবে এক মুহূর্ত পরেই বুঝলাম পরিবর্তনটা আসলে কোথায় করা হয়েছে!

আধার নেমে আসছে। ঝোপ-ঝাড় আর গাছ গাছালীর পাতার আড়াল থেকে জ্বলজ্বল করতে থাকা অসংখ্য চোখ দেখতে পাচ্ছি আমি। ফোঁস ফোঁস নিঃশ্বাস ফেলছে নর মাংসের স্বাদ পাওয়ার জন্য ব্যকুল হয়ে থাকা অভুক্ত প্রাণীগুলো। একটা দুটো নয়! কয়েকশ প্রাণীর উপস্থিতি টের পাচ্ছি আমি! গোধূলির আলোয় চিক চিক করে উঠছে তাদের জান্তব দাঁত।

এতক্ষনে বুঝতে পারলাম কেন কতৃপক্ষ বার বার করে বলছিল এবছর খেলায় কিছু চমকপ্রদ পরিবর্তন থাকছে!
এটা এখন আর “ধূর্ত শেয়াল বধের খেলা” নয়! “ধূর্ত শেয়াল দ্বারা বধের খেলা”!

গল্পের বিষয়:
ফ্যান্টাসি
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত