শাহজাদা কামার আল–জামান আর শাহজাদী বদর–এর প্রণয় কাহিনী

শাহজাদা কামার আল–জামান আর শাহজাদী বদর–এর প্রণয় কাহিনী

একশো সত্তরতম রজনীর দ্বিতীয় যামে ছোটবোন দুনিয়াজাদ গালিচা থেকে উঠে এসে শাহরাজাদের পাশে বসে বললো, এবার তোমার গল্প শুরু করে দিদি।

শাহরাজাল বললো, শাহেনশাহ যদি শুনতে চান নিশ্চয়ই শোনাবো বোন।

শাহরিয়ার বলে, আমি শোনার জন্যে হাঁ করে আছি। শাহরাজাদ। তুমি এবার শুরু করো।

শাহরাজাদ বলে, তা হলে শুনুন, জাঁহাপনা, এবার শাহজাদা কামার আল-জামান আর শাহজাদী বদর-এর প্রণয় কাহিনী বলছি :

বহুকাল আগে খালিদাসে শাহরিমান নামে এক প্রবল পরাক্রান্ত বাদশাহ ছিলেন। ধন-দৌলত, লোক-লস্কর, সৈন্য-সামন্তে তার তুল্য সুলতান সে সময়ে সমগ্র আরবে। আর কেউ ছিলো না। একদিকে কঠোর হাতে শত্রু দমন এবং অন্যদিকে দক্ষতার সঙ্গে প্রজা পালন তার চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিলো। বিলাস ব্যসনেও ছিলো তার প্রগাঢ় আসক্তি। চারটি বেগম এবং সত্তরটি রক্ষিতা ছিলো তার হারেমে। কিন্তু এ সত্ত্বেও বাদশাহর মনে সুখ ছিলো না। দেখতে দেখতে বয়স গড়িয়ে বিকেল হতে চলবো, কিন্তু বাদশাহর কোনও সন্তানাদি হলো না। তার এই বিশাল সলতানিয়তের কে হবে উত্তরাধিকারী, সেই চিন্তাতেই নিয়ত মূহ্যমান হয়ে থাকেন। তিনি।

চিন্তায় চিন্তায় দিন দিন কৃশকায় হতে থাকেন সুলতান। একদিন প্রধান উজিরকে মনের দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, আল্লাহ আমাকে সবই দিয়েছেন। কোনও দিকেই কোনও অভাব রাখেননি। কিন্তু একটি পুত্র সন্তান থেকে কেন আমাকে বঞ্চিত করলেন তিনি?

উজির চট করে এ কথার কোনও জবাব দিতে পারে না। এ দুঃখ তো শুধু তাঁর একার নয়। সমগ্র খালিদানবাসী সদা সর্বদা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানায়, সুলতান যাতে পুত্র লাভ করেন।

গভীরভাবে চিন্তা করে অনেকক্ষণ পরে উজির বললো, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া এ সমস্যার টম সমাধান কেউ করে দিতে পারে না, জীহাপনা। আপনি তাঁকেই স্মরণ করুন। নিশ্চয়ই তিনি আপনার আবেদনে সাড়া দেবেন। আজ রাতে যখন আপনি হারেমে যাবেন তার আগে শুদ্ধাচারভাবে হাতমুখ ধুয়ে রুজু করে নামাজ সেরে নেবেন। নামাজান্তে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানাবেন, আজ রাতের সহবাসে যেন একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়।

—চমৎকার কথা বলেছ উজির, আনন্দে প্রায় চিৎকার করে ওঠে শাহরিমান, আমারও মনে হয়। এতে আল্লাহ ফেরাতে পারবেন না আমাকে।

সুলতান খুশি হয়ে উজিরকে মূল্যবান সাজ-পোশাক উপহার দিলেন। সন্ধ্যাকালে একটি মনমতে রক্ষিতা পছন্দ করলেন। আজ রাতে তার ঘরেই তিনি কাটাবেন। উজিরের পরামর্শ মতো বেশবাস পরিবর্তন করে শুদ্ধ চিত্তে নামাজ সারলেন। নামাজান্তে কায়মনে প্রার্থনা জানাতে লাগলেন, আল্লাহ, তুমিই একমাত্র ভরসা, তুমি না দিলে আমি এই অতুল বৈভবের মালিক হয়েও দীনভিখারী হয়েই থাকবো।

সেই রাতে সুলতান যে রক্ষিতার ঘরে গিয়েছিনেল দশমাস পরে তারই গর্ভে এক সুদৰ্শন পুত্রের জন্ম হয়। শাহরিমান আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠেন। এতকালের সাধাতাঁর পূর্ণ হলো। সারা সালতানিয়তে আনন্দের বন্যা বয়ে যেতে লাগলো। প্রজারা নবজাতকের শতায় কামনা করে আল্লাহর কাছে মোনাজাত করলো। সুলতান আদর করে নাম রাখলেন কামার আল-জামানঅর্থাৎ এ যুগের চাঁদ।

তা চাঁদই বটে। এমন রূপ চোখে পড়ে না। তারায় ভরা চৈত্র মাসের রাতে ছাতের ওপর মাদুর পেতে চিৎ হয়ে শুয়ে দূর নীলনভে যে রূপের হাট প্রত্যক্ষ করা যায় একমাত্র তার সঙ্গেই বুঝি তুলনা চলে কামার আল-জামানের রূপ। অথবা কোনও এক বসন্তবিকালের বিদায়ী সূর্যের বিদায় চুম্বনে আরক্তিম ফোটা ফুলের সমারোহ তার তুল্য রূপ ধরা পড়ে।

শাহরিমান পুত্রকে কোনও সময় চোখের আড়াল করেন না। তার লেখাপড়া শেখানোর ভার দেওয়া হয় শহরের সবচেয়ে নামজাদা মৌলভীর ওপর। দিনে দিনে বড় হতে থাকে কামার অল-জামান।

যখন তার পনেরো বছর বয়স, জামানের দেহে যেীবনের জোয়ার আসতে থাকে। শাহরিমান পুত্রের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবেন, আল্লাহ তাকে যখন দিলেন, দুহাত ভরেই দিলেন। এমন রূপ তিনি কখনও চোখে দেখেননি।

সুলতান মনে মনে স্থির করলেন, এবার পুত্রের শাদী দিয়ে দিতে হবে। তার নিজের বয়স হয়েছে। মানুষের শরীর বলা যায় না, হুট করে মরে গেলে মনের সাধামনেই রয়ে যাবে। উজিরকে ডেকে বললেন, শোনো, উজির, ছেলে তো বড় হলো, আমার শরীর স্বাস্থ্যও দেখছো, খুব ভাল নাই। তা জামানের যদি শাদী দিয়ে দিই খুব কি খারাপ দেখাবে। ওর শাদীটা না দেখে যদি মরি আমার এত কালের সাধ অপূর্ণ থেকে যাবে।

উজির বললো, জাঁহাপনা পুত্র আপনার জ্ঞানে গুণে বিদ্যায় বুদ্ধিতে উপযুক্ত হয়ে উঠেছে। এখনই শাদীর প্রশস্ত সময়! আমার মনে হয়। আর দেরি না করে শুভ কাজ সম্পন্ন করে দিন। আপনার প্রজারাও এই শুভ দিনটির জন্যে অধীর আগ্রহে দিন গুণছে। তাছাড়া স্বামী স্ত্রীর সহবাসে দেহ ক্লেদ মুক্ত হয়। সুতরাং আপনি যা ভেবেছেন তা চমৎকার।

সুলতানের মনে যেটুকু দ্বিধা ছিলো তাও সাফ হয়ে গেলো। কামার আল-জামানকে খবর পাঠালেন। একটু পরেই জামান এসে বাবাকে কুর্নিশ জানিয়ে অবনত মস্তকে দাঁড়ায়।–আব্ববাজান, আমাকে ডেকেছেন?

এই সময়ে রাত্রি অবসান হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো। দুনিয়াজাদ বলে, কি সুন্দর করে তুমি বলতে পারে দিদি—!

শাহরাজাদ বলে, এবার একটু ঘুমিয়ে নে।

বাদশাহ শারিয়ার শাহরাজাদকে বুকের মধ্যে টেনে নেয়।–সত্যি শাহরাজাদ, কিসসাগুলো শুনতে শুনতে কোথা দিয়ে যে রাত কাবার হয়ে যায় বুঝতেই পারি না। তুমি আমার চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছ।

শাহরাজাদ বলে, সেই জন্যেই তো আমি সকাল হতে না হতেই গল্প থামিয়ে দিই, জাঁহাপনা। সারারাত্রি জাগরণের পরে আপনার যাতে ঠিক মতো ঘুম হয় সেটাও তো আমাকে দেখতে হবে।

শারিয়ার আরও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে, কেন? দেখতে হবে কেন? আমার তবিয়ৎ খারাপ হলে তোমার কী?

বা রে, আপনিই তো আমার সব। স্বামী ছাড়া মেয়েদের আর কি থাকে?

শারিয়ার শাহরাজাদের ঠোঁটে ঠোঁট রাখে। দুনিয়াজাদ দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে নিজের ঠোঁট। রক্ত বেরিয়ে যায়। আড়চোখে চেয়ে চেয়ে দেখে, সুলতান শারিয়্যারের বুকের নিচে কি করে তার দিদি হারিয়ে যেতে থাকে। শাহরাজাদ একটা মৃদু চাপড় দিয়ে দুনিয়াজদকে বলে, দূর মুখপুডি, পাশ ফিরে শো।

 

পরদিন একশো একাত্তরতম রজনী—

সারাদিন দরবারের কাজকর্ম সেরে সন্ধ্যা হতে না হতেই সুলতান শারিয়ার শাহরাজাদার কক্ষে চলে আসে। দুনিয়াজাদ নিচে গালিচায় গিয়ে শোয়। শাহরাজাদ সরে এসে শারিয়ারের গা ঘেঁষে বসে। শারিয়ার ওকে বুকে টেনে নিয়ে আলতো করে একটু চুমু খায়। তারপর চলতে থাকে পূর্বরাগের পালা। রাত বাড়ে। রিরংসাও বাড়তে থাকে দুজনের। উত্তেজনায় অস্ফুট স্তনন করতে থাকে শাহরাজাদ।

দুনিয়াজাদ এবার আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না। বুকে তাকিয়া চেপে দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে থাকে।

অনেকক্ষণ বাদে শাহরাজাদ ডাকে, দুনিয়া, ওপরে আয়!

দুনিয়া উঠে এসে শাহরাজাদের পাশে বসে। আবার গল্প শুরু হয়।

তারপর শুনুন, জাঁহাপনা, শাহজাদা কামার আল-জামান বাবাকে কুর্নিশ জানিয়ে বলে, আমাকে ডেকেছেন, আব্ববাজান?

-হ্যাঁ বাবা, বসো।

জামান সুলতানের পাশে গিয়ে বসে। শাহরিমান বলে, আমার বয়স হয়েছে, বেঁচে থাকতে থাকতে তোমার শাদীটা দেখে যেতে চাই, বাবা।

কামার আল-জামানের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়, কিন্তু আব্বাজান, এখনই আমি বিয়ে করতে চাই না। জীবনে নারীর প্রয়োজন নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত আমি তার কোনও অভাব বুঝতে পারিনি, আব্বাজান। মেয়েদের সম্বন্ধে আমার কোনও ধ্যান ধারণা গড়ে ওঠেনি। ওদের সম্পর্কে আমার কোন মোহ বা আকর্ষণ কিছুই নাই। এ অবস্থায় হঠাৎ একটা মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক, আমার মনে হয়, সুখের হবে না। আদিত কথা, শাদী নিয়ে আমি এখনও কিছু ভাবিইনি। আমার মন ঠিক তৈরি হয়ে ওঠেনি। আপনি অপেক্ষা করুন, আব্বজান। আমি শাদী করবো না—এমন কথা বলছি না। কিন্তু শাদী করার আগে আমাকে প্রস্তুত হতে দিন, এই আমার আর্জি।

শাহরিমান পুত্রের কথায় বিচলিত হলেন।–কিন্তু বাবা, শিক্ষাদীক্ষার পাঠ তোমার হয়ে শেষ হয়ে গেছে। এবার সংসার ধর্ম পালন করার সময় এসেছে। এখন তুমি বলছো, মেয়েদের সম্পর্কে তোমার কোনও ধ্যান ধারণাই গড়ে ওঠেনি। আমার মনে হচ্ছে, তুমি কিছু গোপন করছে। কিন্তু গোপন করার কোনও ব্যাপার থাকতে পারে না, বাবা। তুমি এখন বড় হয়েছে। অনেক পড়াশুনা করেছে। সব কিছু ভালোমন্দ বোঝার বিদ্যাবুদ্ধি তুমি অর্জন করেছে। তুমি বিনা দ্বিধায় বলো, আমি তোমার কথাই শুনতে চাই।

কামার আল-জামান মাথা নিচু করে বসে থাকে। বাবার কাছে সে ধরা পড়ে গেছে। সত্যিই সে আসল কথাটা শত চেষ্টা করেও বাবাকে বলতে পারেনি। কিন্তু বৃদ্ধ শাহরিমানের চোখ এড়ায়নি। জামান যে কি একটা গোপন করতে চাইছে তা তিনি বুঝতে পেরেছেন।

একটুক্ষণ পরে জামান বললো, আপনি ঠিকই ধরেছেন, আব্বাজান, আমি একটা কথা বলতে গিয়ে বলতে পারিনি। আপনি আমাকে নানা শাস্ত্র শিক্ষা দিয়েছেন। আমি বহু কিতাবে পড়েছি, মেয়েদের নানারকম ছলাকলা বিশ্বাসঘাটকতার কাহিনী। তাদের রূপ যৌবন দিয়ে কিভাবে পুরুষের সর্বনাশ করে সেই সব বিচিত্র বিবরণ জানলে কোনও মেয়েকে কেউ ভালো চোখে দেখতে পারে না, আব্বাজান। যে মেয়ে খারাপ হতে চায় তাকে আপনি জিঞ্জিরে বেঁধে কয়েদ করে রাখলেও সে পরপুরুষের অঙ্কশায়িনী হতে পারে। একথা আমি বানিয়ে বলছি না, আব্বাজান, আমাদের পীর পয়গম্বররা এই বাণী রেখে গেছেন। আর আমার একমাত্র আর্জি, জাঁহাপনা। আপনি আমাকে আর শাদীর কথা বলবেন না। এ সত্ত্বেও আমার কথা যদি না শোনেন, যদি জোর করে কোনও মেয়েকে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেন, ফল ভালো হবে না। হয়তো আপনার মনের একটা সাধ পূরণ করতে গিয়ে আমাকেই আপনি চিরকালের মতো হারাবেন।

বাদশাহ শাহরিমান শিউড়ে ওঠেন। —না না না, সে হতে পারে না। অমন অলুক্ষণে কথা মুকে আনতে নাই, বাবা। আমি তো তোমাকে জোর জবরদস্তি করছি না। তোমার বয়স হয়েছে। আর আমিও বুড়ো হয়েছি। এ অবস্থায় বিয়ে শাদী করে ধন দৌলত বুঝে নিয়ে প্রজােপালন করাই তোমার ধর্ম। আর আমার কথাটা একবার ভাবো, কবে মরে যাবো, মরার আগে কে না নাতির মুখ দেখে েেত চায়? যাই হোক, তুমি আদৌ ভেবো না তোমাকে ধরে বেঁধে শাদী দিয়ে আমার মনোবাসনা চরিতার্থ করবো। যাকে শাদী করবে। সে হবে তোমার খাস বেগম। সারাজীবনের সঙ্গী। তার সঙ্গে তোমার যদি বনিবনাও না হয় সে শাদী তো জহর সামিল। আমি কিছুতেই তা হতে দেব না। কিন্তু বাবা, তবুও একটা কথা থেকেই যায়। আমি জানি তুমি বহু জ্ঞান আহরণ করেছ। বহু দর্শন তোমার নখদর্পণে। তবু বলবো, আরও কিছু অনুসন্ধান করে দেখো, মেয়েদের সম্বন্ধে ভালো কথাও নিশ্চয়ই অনেক মনীষীই বলেছেন। তোমার বয়স অল্প। পুঁথিগত বিদ্যাই এখন একমাত্র মূলধন। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা অনেক সময় হব তোমার অধিত বিদ্যার দৃঢ় প্রত্যয়কে ভেঙ্গেচুরে তছনছ করে দেয়। সে সব নজির তো কিতাবে লেখা থাকে না। নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করতে হয়। যাই হোক, এখন আর তোমাকে উত্যক্ত করতে চাই না। তুমি যেমন ছিলে তেমনি থাক। পরে যদি কখনও তোমার চিন্তা-ভাবনার কোনও রদবদল হয়, আমাকে অসঙ্কোচে জানাবে।

এরপর আরও একটা বছর কেটে যায়। শাহরিমান আর কোনও প্রশ্ন তোলেন না। ছেলের প্রতি তার দারুণ দুর্বলতা। কোনও কথায় সে আহত হয় সুলতান তা আদৌ চান না।

শাহরিমানের শরীর দিন দিন জরাগ্রস্ত হয়ে থাকে। মৃত্যু হাতছানি দিচ্ছে, বুঝতে কষ্ট হয় না। একদিকে অপত্য পুত্র স্নেহ অন্যদিকে জীবনের শেষ সাধ। নির্জন প্রাসাদ কক্ষে একা একা বসে ভাবেন। ছেলে বড় হয়েছে, তার অমতে কোনও কিছু চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। অথচ এদিকে দিনও শেষ হয়ে আসছে। নাতির মুখ আর বুঝি দেখে যাওয়া হলো না। শাহরিমান নিশ্চিত জানেন, প্রথম যৌবনের স্বপ্নরঙিন কল্পনার দিনগুলো সব পুরুষের জীবনেই একবার আসে। ধরাবাঁধা জীবনের শাশ্বত আবর্তকে সে তখন কিছুকালের জন্য স্বীকার করতে চায় না। সকলে যা করে সকলে যা বলে তা সে করতে চায় না-বলতে চায় না। সে চায় নতুন কিছু একটা করতে—যাতে সে হতে পারবে অনন্য। তারপর বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধির প্রসারতা বাড়ে, অভিজ্ঞতার আয়তন ব্যাপ্ত হয়।

শাহরিমান ভাবেন। জামানকে ডেকে জিজ্ঞেস করলে হয়—তার ধ্যানধারণার কোনও পরিবর্তন হয়েছে কিনা।

কামার আল-জামান আবার এসে সুলতানকে কুর্নিশ জানিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়ায়। মুখের দিকে তাকালে কেউ ভাবতেই পারবে না। এ ছেলে বাবার কথার অবাধ্য হতে পারে। তার কথাবার্তায় হাব-ভাবে চাল-চলনে এত শালীনতা, এত ভব্যতা বিশ্বাসই করা যায় না যে বাবার একটি অপূর্ণ সাধ, সে মেটাবে না। শাহরিমান জিজ্ঞেস করেন, এখনও কি তোমার সেই একমত, জামান?

কামার আল-জামান বাবার বিষণ্ণ করুণ মুখের দিকে সোজাসুজি তাকাতে পারে না। তার একটি অপূর্ণ সাধ পূরণ করতে পারছে না সে। সেই অপরাধ তাকে এই একটা বছর ধরে দংশন করে আসছে। কিন্তু, তন্নতন্ন করে খুঁজেও, কোনও একটা কিতাবে মেয়েদের সম্পর্কে একটা ভালো কথাও তার নজরে পড়েনি। বরঞ্চ যতই বইয়ের পাত উল্টিয়েছে মেয়েদের সম্পর্কে আরও মারাত্মক খারাপ খারাপ উক্তি সে পড়েছে। তাদের মতো ভ্বষ্টা, নষ্ট চরিত্রা, নির্বোধি, বিশ্বাসঘাতিকা, ছলনাময়ী প্রাণী বিশ্ব সংসারে আর কিছু নাই। কামার আল-জামান-এর ধারণা দিন দিন বদ্ধমূল হতে থাকে। কোন নারীর সঙ্গে জীবনের গাঁটছড়া বাঁধার আগে তার যেন মৃত্যু হয়, এই তার আল্লাহর কাছে একমাত্র প্রার্থনা।

—আব্বাজান, আমি অনেক ভেবে দেখলাম, আপনার সাধ আমি কিছুতেই পূরণ করতে পারবো না। এই একটা বছরে আমি আরও নানা কিতাব পড়েছি। যতই পড়ছি, বিশ্বাস করুন, মেয়েদের সম্পর্কে ধারণা আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছে। দুনিয়াতে যত খারাপ কাজ আছে তার

সুলতান শাহরিমান বুঝলেন, পুত্র এখন ঘোরে রয়েছে। তাকে বোঝানো বিষম দায়। সময়ে সবই ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এখন জোর করে বোঝাতে গেলে হিন্তে-বিপরীত হতে পারে।

মনের দুঃখ কিছুটা হাল্কা করার জন্য উজিরকে ডেকে বললেন, দেখো উজির, আমি ভেবে দেখেছি, মানুষের চাওয়ার লোষ নাই। আমি যখন নিঃসন্তান ছিলাম তখন আল্লাহর কাছে আমার একমাত্র প্রার্থনা ছিলো, আল্লাহ আমাকে একটি পুত্র সন্তান দাও। আর কিছু বাসনা নাই আমার। তিনি আমার প্রার্থনা পূরণ করলেন। একটা চাঁদের মতো ছেলে দিলেন। আজ কিন্তু আমি তাতেই সন্তুষ্ট নই-আজ আমার সাধ একটি নাতির। কিন্তু জামান ঘোরতর নারী বিদ্বেষী। এক বছর। আগে যা ছিল এখন তার থেকেও আরও এক কাঠি বেশি। ভারি ভারি কিতাব পড়ে ওর দিন দিন মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মেয়েদের নামই সে কানে শুনতে চায় না। এখন কি করা যায় বলতো? অনেকক্ষণ একথার কোনও জবাব দিতে পারে না। উজির। তন্ময় হয়ে ভাবতে থাকে। তাইতো বড় কঠিন সমস্যা।

—জাঁহাপনা, উজির বলে, আপনি মেহেরবানী করে আরও একটা বছর ধৈর্য ধরে থাকুন। তারপর একদিন আচমকা তাকে দরবারে ডেকে পাঠাবেন। সেখানে উপস্থিত আমির ওমরাহ-গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সামনে আপনি ঘোষণা করে দেবেন, কামার আল-জামানের শাদীর দিন পাকা করে ফেলেছেন।

–কিন্তু উজির, ছেলে যেমন এক রোখা, এতে কি ফল ভালো হবে?

—হবে জাঁহাপনা, হবে। আমজিনি জামানের মতো বিনয়ী ভদ্র নম্র এবং পিতৃভক্ত পুত্র খুব বড় একটা হয় না। আপনি পাঁচজন গণ্যমান্য ব্যক্তির কাছে খেলো হয়ে যাবেন, আপনার কথার কোনও দাম থাকবে না তেমন বেয়াদপি সে কখনও করতে পারবে না। আমি তার স্বভাব চরিত্র খুব ভালো করে জানি, হুজুর। অমন চরিত্রবান ছেলে আমার জিন্দগীতে দেখিনি।

এই সময় রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

একশো বাহাত্তরতম রজনীতে আবার সে শুরু করে :

উজিরের পরামর্শে সুলতান শাহরিমান উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন।–তুমি ঠিক বলেছ, উজির। সে আমাকে ভক্তি করে, ভালোবাসে। আমার ইজৎ নষ্ট হতে পারে এমন কাজ সে কখনও করতে পারে না—একথা আমি জানি। যদি প্রকাশ্য দরবারে দশজন সম্রাস্ত মানুষের সামনে আমি বড় মুখ করে ঘোষণা করি, শাহজাদা জামানের শাদীর ব্যবস্থা পাকা করেছি। তাহলে তার অনিচ্ছা! থাকলেও, আমার মুখরক্ষা করার জন্যও সে না’ করতে পারবে না। তুমি ঠিকই বলেছে, উজির। তোমার বুদ্ধির তারিফ না করে পারছি না। তোমার মতো বিদ্বান বিচক্ষণ উজির পেয়ে আমি গর্বিত। এই নাও তোমার পুরস্কার।

শাহরিমান তাঁর কণ্ঠ থেকে মহামূল্যবান মণিমুক্তা খচিত রত্নহার খুলে উজিরের হাতে তুলে দিলেন। উজির দ্বিধা ভরে হাত পেতে নিতে নিতে অবাক হয়ে বললো, এ যে অমূল্য রত্নহার, জাঁহাপনা।

—তোমার এ পরামর্শ মূল্য দিয়ে যাচাই করা যায় না, উজির। আমি খুশি হয়ে দিলাম। তুমিও মনে কোনও সংশয় রেখো না।

এরপর আরও একটা বছর কেটে গেলো। একদিন পূর্ণ দরবার কক্ষে কামার আল-জামানকে ডেকে পাঠালেন শাহরিমান। পিতৃভক্ত পুত্র যথাবিহিত কুর্নিশ জানিয়ে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলো। জামানের রূপের আলোয় যেন দরবার কক্ষ আরও বেশি আলোকিত হয়ে উঠলো। আমির ওমরাহ। অভ্যাগতদের মধ্যে মৃদু গুঞ্জন উঠলো—আহা, আল্লাহ কি ভাবেই গড়েছেন? আসমানের চাঁদও হার মেনে যায়।

–শোনো বাবা, সুলতান শাহরিমান ধীরে ধীরে বলেন, আমি তোমার শাদীর ব্যবস্থা করছি। আমি বুড়ো হয়েছি। কবে আছি কবে নাই, তাই যাবার আগে তোমাকে শাদী দিয়ে যেতে চাই। আজ এখানে শহরের সম্রান্ত আমির ওমরাহরা আছেন। তাদের সামনে ঘোষণা করছি, যত সত্বর সম্ভব আমি তোমার শাদী দেব।

কামার আল-জামান এতক্ষণ বিনয়াবনত সুবোধ বালকের মতো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলো। সুলতানের কথায় সে লাঠি খাওয়া ক্রুদ্ধ সাপের মতো ফণা তুলে ধরলো। চোয়ালের হাড় শক্ত হয়ে উঠলো। রোষ কষায়িত বিস্ফারিত চোখে সে সুলতানের দিকে উদ্ধতভাবে চেয়ে রইলো। মুখে কোনও ভাষা নাই। চোখে তার অগ্নিঝরা প্রতিবাদ।

উপস্থিত আমির ওমরাহ। অভ্যাগতরা মাথা নিচু করে বসে রইলো। সুলতান গর্জে উঠলেন।—আমার অবাধ্য! এতবড় স্পর্ধা! এই-কে আছিস, ওকে বাধ। বেঁধে নিয়ে গিয়ে পাশের পোড়ো বাড়িটার চিলেকোঠার ঘরে বন্ধ করে রেখে দে।

সুলতানের হুকুম। সঙ্গে সঙ্গে শাহজাদাকে বেঁধে প্রহরীরা নিয়ে গেলো পোড়ো বাড়ির চিলে কোঠায়। অন্ধকার ঘরে বন্ধ করে তারা দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। যদি শাহজাদা কিছু বলেন এই প্রত্যাশায় উৎকৰ্ণ হয়ে রইলো তারা। কিন্তু না, কামার আল-জামান কোন সাড়াশব্দ করলো না। অন্ধকার ঘরের এক কোণে বসে ভাবতে লাগলো; এ-ই বরং ভালো হয়েছে। বাবার কথায় যদি সুবোধ বালকের মতো সে সায় দিত সে-ই হতো তার অপমৃত্যু। আজ এই জীর্ণবাড়ির অন্ধকার চিলেকোঠায় আমাকে বন্দী করে সুলতান আর একবার প্রমাণ করলেন, দুনিয়াতে যত অঘটন ঘটেছে তার মূলে সেই নারী।

শোক-কাতর অবসন্ন মনে সুলতান শাহরিমান প্রাসাদে নিজের শয়নকক্ষে ফিরে গেলেন। প্ৰাণাধিক একমাত্র পুত্র আজ তারই হুকুমে কারারুদ্ধ। অথচ এই পুত্র লাভের আকুতি তাকে একদিন পাগল করে তুলেছিলো। দু’হাতে মুখ ঢেকে শিশুর মতো ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগলেন। অপত্য স্নেহ একসময় পুত্রের সব গুনাহ মাফ করে দিলো। সুলতান ভাবলেন, তার কি দোষ? সে তো তাকে একাধিকবার তার মনের কথা খুলে বলেছে। এ অবস্থায়, ছেলে বড় হয়েছে, জোর করে তার ওপর কিছু চাপিয়ে দিতে যাওয়াই অন্যায়। এ জন্যে তার তো কোনও অপরাধ নাই। যত নষ্টের গোড়া ঐ উজির। তার ঐ বাজে পরামর্শ নিতে গিয়েই যত অনৰ্থ ঘটলো। যতই ভাবেন তিনি, সমস্ত আক্রোশ গিয়ে পড়তে থাকে উজিরের উপর। উজিরকে ডেকে পাঠালেন। শাহরিমান।

—তুমিই এর জন্যে একমাত্র দায়ী, উজির। তোমার ঐ বদ পরামর্শ নিয়েই আমার মান-ইজৎ সব গেলো। একমাত্র পুত্রকে আমি কয়েদ করলাম—সবই তোমার অপরিণামদৰ্শিতায়।যাক এখন উপায় বাতিলাও, কিভাবে এর সমাধান হতে পারে। তুমি তো জানো উজির, আমার বুকের কলিজা একমাত্র পুত্র সে। তাকে এইভাবে কষ্ট দিয়ে আমি কি করে বাঁচবো?

উজির করজোড়ে বলে, হুজুর। অধমের কথা শুনুন, ধৈর্য ধরে পনেরোটা দিন আপনি চুপচাপ থাকুন।

-কী বললে? পনেরো দিন? পনেরো দিন ধরে সে ঐ নোংরা অন্ধকার ঘরে পচবে?

—না হুজুর, পচবে কেন, তার সব ব্যবস্থাই আমি করে দিয়েছি।

একথা শুনে শাহরিমান-এর মুখ কঠিন হয়ে ওঠে।–কী ব্যবস্থা করে দিয়েছ। কার হুকুমে? তোমার আমি গর্দান নেবো।

—হুজুরের ইচ্ছা। যেদিন হুজুরের দরবারে চাকরী নিয়েছি সেইদিন জানি কবুল করেছি। জাঁহাপনার যদি তাই অভিপ্ৰায় হয় নিতে পারেন আমার গর্দান। কিন্তু সুলতানের কোনও ইজৎহানি হয় তেমন কোনও কাজ আমি করিনি। করতে পারি না। শাহজাদা আপনার যেমন পরম পেয়ারের আমাদেরও কি কম আদরের? আপনার সালতানিয়তের প্রতিটি মানুষ তাকে বড় ভালোবাসে। সে-ই আমাদের একমাত্র আশা ভরসা। ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী। এই কারণে, যদি কোনও প্রহরী শাহজাদার কষ্টে কাতর হয়ে তার সুখস্বাচ্ছন্দ্যের একটু ব্যবস্থা করে থাকে। তবে কি সুলতান তাদের সে গুণাহ উপেক্ষার চোখে এডিয়ে যেতে পারেন না?

–উজির, সত্যিই তোমার বুদ্ধির তুলনা নাই। কিন্তু সাবধান এসব কথা আমি জানি তা যেন তোমার প্রহরীরাও জানতে না পারে।

—আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন জাঁহাপনা, শাহজাদা জানেন না, আমার হুকুমে প্রহরীরা তার থাকা খাওয়ার আমন সুন্দর ব্যবস্থা করে দিয়েছে। তার ধারণা প্রহরীরা ভালোবেসে সবারই অলক্ষ্যে এসব করছে। তারা তাকে এ-ও শুনিয়ে দিয়েছে, সুলতান জানতে পারলে তাদের হয়তো গর্দান যাবে। তা যাক। কিন্তু তাই বলে তাদের শাহজাদাকে এইভাবে তারা কষ্টে রাখতে পারবে না।

সুলতান শাহরিমান শুনে খুশি হয়। বলেন, কিন্তু পনেরো দিন তার আদর্শন আমি কেমন করে সইবো? তাকে পাশে না পেলে যে আমি ঘুমাতে পারি না, উজির।

উজির বলে, এছাড়া কোনও উপায় নাই, জাঁহাপনা। এই পনেরোটা দিন আপনাকে কষ্ট করে থাকতেই হবে। তারপর দেখবেন, শাহজাদা আপনার কত বাধ্য হয়ে গেছে। শাদীতে আর সে অমত করবে না।

সুলতান সবই বুঝলেন জামান-এর সুখ-স্বাচ্ছন্দোর কোনও ত্রুটি হবে না তা সত্ত্বেও সে রাতে তিনি ভালো করে ঘুমাতে পারলেন না। পালঙ্কে শুয়ে শুধু বার বার জামানের শূন্য শয্যার দিকেই নজর চলে যায়। বুকের মধ্যে কেমন হু হু করতে থাকে। রাত্রির প্রহর বাড়ে। সুলতান ঘরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত অবধি পায়চারি করতে থাকেন। ঘুম আর আসে না।

ওদিকে কামার আল-জামান রাতের খানাপিনা শেষ করে। বইপত্র নিয়ে বসে। অনেক রাত অবধি একমনে পড়াশুনা করে শুতে যাবার আগে রোজ-এর অভ্যাসমতো হাত মুখ ধুয়ে রুজু করে কোরানের কয়েক পাতা সুর করে পড়ে। পাঠ শেষ হলে গায়ের একটি মাত্র কামিজ ছাড়া পরনের সব সাজপোশাক খুলে ফেশেয্যায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। আর শোয়ামাত্র গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।

তারপর যেসব ঘটনা ঘটলো সেগুলো স্বপ্ন না। সত্যি তা কে বলতে পারে?

এইসময় রজনী শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

[এর আগের তিনটি রজনী মাত্র কয়েকটি ছত্রে শেষ করেছেন ডঃ মারদ্রুস। এখানে সেই কয়েক ছত্রের জন্য আলাদাভাবে সেই রাজনী-ত্বয়ের উল্লেখ করলাম না। এতে গল্পের গতি ব্যাহত হতো মাত্র। এরপরে এই ধরনের বর্জন উল্লেখ করে জানানো হবে না-অনুবাদক]

এরপর একশো ছিয়াত্তরতম রজনী :

দ্বিতীয় প্রহরে আবার কাহিনীর সূত্রপআত হয়। শাহরাজাদ বলতে থাকে।

যে পোড়ো বাড়িটার চিলেকোঠায় কামার আল-জামান গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলো সেই ধ্বংসস্তুপ সদৃশ জরাজীর্ণ পোড়ো প্রাসাদটা এক সময়ে খুব রমরমা চেহারার ছিলো। সে অতি প্রাচীনকালের কথা। রোম তখন দুনিয়ার সেরা শহর। তখন সব রাস্তাই রোমে গিয়ে মিশেছিলো। সব মানুষই রোম-যাত্রী। এই ভাঙা প্রাসাদ সেই আমলের। তখনকার সুলতান বাদশাহের সুখের আধার ছিলো এই প্রাসাদ। কালের হাতছানিতে আজ শুধু দাঁত বের করাইটের পাজ ছাড়া আর কোন বাহারই অবশিষ্ট নাই।

এই ভাঙা প্রাসাদের পিছনে একটা বিশাল কূপ আছে। সেই কূপে বাস করে এক যুবতী জিনি। ইবলিসের বংশধর মাইমুনাহ। মাইমুনাহর বাবা সাবটেরা নিয়ানের বাদশাহ জিন দিমিরিয়াৎ। তার অমিত শৌর্যবীর্যের অলৌকিক কাহিনী বিশ্ববিশ্রুত।

মাঝরাতে মাইমুনোহ কুপ থেকে বেরিয়ে আকাশে ওড়ে। এই তার প্রতিদিনের অভ্যাস। উড়তে উড়তে সে প্রথমে মহাশূন্যে উঠে যায়। তারপর ঠিক করে কোনদিকে কোথায় যাবে।

সেদিন রাতেও সে যথা নিয়মে কূপ থেকে বেরিয়ে উপরে উঠছে হঠাৎ আশ্চর্য হয়ে দেখলো, চিলেকোঠার ঘরে আলো জুলছে। জন্মাবধি এতকালের মধ্যে এমন অভূতপূর্ব দৃশ্য সে কখনও প্রত্যক্ষ করেনি। এইরকম জনমানব পরিত্যক্ত একটা পোড়ো বাড়িতে কেউ কখনও পদার্পণ করে না। আজ হঠাৎ এখানে মানুষ কি করে এলো? জিনি ভাবলো, এর পিছনে নিশ্চয়ই কোনও গূঢ় রহস্য আছে। ব্যাপারটা কি দেখতে হবে। চিলেকোঠার ঘরের জানোলা দিয়ে সে ভিতরে ঢুকে পড়লো।

চাঁদের মতো ফুটফুটে সুন্দর কামার আল-জামানের অর্ধ উলঙ্গ দেহটার দিকে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থাকে জিনি। এত রূপ কোনও পুরুষ মানুষের হয়। তার দেহমানে এক অজানা আনন্দের শিহরণ লাগে। পা টিপে টিপে সে জামানের পালঙ্কের পাশে যায়। অপলক চোখে তাকে প্ৰাণ ভরে দেখতে থাকে। এইভাবে প্রায় এক ঘণ্টা কেটে যায়। কিন্তু জিনির আর দেখে দেখে আশ মেটে না। আশ মেটে না। আল্লাহর এই অতুলনীয় সৃষ্টির কথা স্মরণ করে শ্রদ্ধার মাথা নত হয়ে আসে। দুচোখ জলে ভরে যায়। ভাবে, এমন খোদার আশীর্বাদকে এইভাবে নির্বািসন দিয়েছে কোন পাষাণ হৃদয় বাবা-মা। কি তার এমন অপরাধ-যার জন্য তাকে বন্দী করে রেখেছে। এই রুদ্ধ কয়েদখানায়? তারা কি জানে না এটা শয়তান আফ্রিদি দানবের আস্তানা? একবার তাদের কারো নজরে পড়লে ছেলেটাকে কি তারা আস্ত রাখবে? যাইহোক, অন্য কোন জিন যাতে এর কোন অনিষ্ট না করতে পারে তা আমাকে দেখতেই হবে।

জামানের কপালে মুখটা নামিয়ে আলতোভাবে একটু চুমু দিলো জিনি। তারপর জানালা দিয়ে বেরিয়ে আকাশের ওপরে উঠে গেলো। যেখানে সাদা মেঘের পেজার হালকা হাওয়ার স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছে সেখানে উঠে গিয়ে ডানা মেলে ভেসে বেড়াতে থাকে সে।

একটুক্ষণ পরে পাখার ঝটপটানি আর বিকট কর্কশ আওয়াজে সে সজাগ হয়ে এদিক ওদিক চায়। একটা বিশাল দৈত্য তার দিকেই উড়ে আসছে। আরও একটু কাছে আসতেই চিনতে পারে-আফ্রিদি দানাশ। একটা শয়তান দৈত্য। ব্যাটা সর্বশক্তিমান শাহেনশাহ সুলেমানের বশ্যতা স্বীকার করে না। পয়লা নম্বরের নাস্তিক। এর বাবা সামহারিস সবচেয়ে দ্রুতগামী জিন বলে। পরিচিত।

মাইমুনাহর আশঙ্কা জাগে, যদি ঐ পোড়ো প্রাসাদের চিলেকোঠার দিকে ওর নজর পড়ে? সুতরাং আর অপেক্ষা না করে শোঁ করে অনেকটা নিচে নেমে এসে একেবারে দানাশের মুখোমুখি থামে। ইচ্ছে ছিলো পাখার একবাড়ি মেয়ে একেবারে ধরাশায়ী করে দেবে তাকে। কিন্তু দানাশ বোধহয় বুঝতে পেরেছিলো। মাথার উপরে মাইমুনাহকে শোঁ শো করে নামতে দেখে চিৎকার করে ওঠে সে।

—শোনো, শাহজাদী মাইমুনাহ, আমি দানাশ! শাহেনশাহ সুলেমান আমার রক্ষা কর্তা, দোহাই তোমরা আমাকে মেরো না। সুলেমান তোমার ভালো করবেন।

মাইমুনাহ মনে মনে হাসে—ভূতের মুখে রাম নাম। এখন ব্যাটা বেকায়দায় পড়েছে আমনি সুলেমান ওর রক্ষা কর্তা হয়ে গেলো। অন্য সময় সে সুলেমানকে মানতেই চায় না। এত বড় আহাম্মক। দানাশ বলে, তুমি আমাকে মেরো না মাইমুন্নাহ। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, তোমার কোনও অনিষ্ট করবো না।

—ঠিক বলেছে, আমি তোমাকে ছেড়ে দিতে পারি, একটা শর্তে। সত্যি করে বলো, তুমি কোথা থেকে আসছে? আর এত দেরিই বা কেন? এখন তোমার মনের মধ্যে কি শয়তানীই বা উকি ঝুঁকি দিচ্ছে। ঠিক ঠিক সাচ্চা বাৎ বলবে। আমার সঙ্গে বেগড়বাই করলে তোমাকে আমি জ্য।অন্ত রাখবো না। পাখা ছিঁড়ে খুঁড়ে দেব। আঁচড়ে গায়ের ছাল চামড়া খুলে নেবো। আর এমন গোত্তা মারবো-পিঠের শিরদাঁড়া ভেঙে গুড়িয়ে যাবে। তোমার কোনও বাবা রক্ষা করতে আসবে না। এখানে।

দানাশ জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে, কি যে বলো সুন্দরী, তোমার কাছে আমি মিথ্যে বলতে পারি। আর বলবো বা কেন? যাক ওসব কথা, তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে বেশ ভালোই হলো। আজ যে কি মজার কাণ্ড কারখানা হয়েছে, বলছি শোনো। কিন্তু তার আগে আমাকে কথা দাও, আমার কিসসা শোনার পর তুমি যদি খুশি হও—আমাকে যেখানে খুশি চলে যেতে দেবে? মাইমুনাহ অধৈর্য হয়ে বলে, আমি সুলেমানের নামে হলফ করে বলছি জলে স্থলে অন্তরীক্ষে যেখানে খুশি তুমি যেও, আমি কোনও বাধা দেব না, নাও এবার তোমার কাহিনী শুরু করে।

আমি সুদূর চীনের পশ্চিম অঞ্চল থেকে উড়ে আসছি। তুমি হয়তো শুনে থাকবে, প্রবল পরাক্রান্ত সম্রাট ঘায়ুরের সাম্রাজ্য সেটা। তার দাপটে কত বড় বড় সাম্রাজ্যের পতন হয়েছে তার ইয়ত্তা নাই। তার সেনাবাহিনীর মেয়েরা সবাই পরমা সুন্দরী-হুরীর মতো। স্নানের পরে তাদের দেহ থেকে ফুলের খুশবু ছড়িয়ে পড়ে সারা ঘরে। সেই সম্রাট ঘায়ুরের একটি মাত্র কন্যা বদর। তার রূপের বর্ণনা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। তবু যদি শুনতে চাও, আমার সাধ্যমতো বর্ণনা দিতে চেষ্টা করবো।

তার আজানুলম্বিত কালো চুলের সঙ্গে বুঝিবা একমাত্র নিরন্তর নির্বান ঝরনারই তুলনা চলে। তার মুখের সৌন্দর্যের বর্ণনা আর কি করে দিই! শুধু বলতে পারি। আশমানের চাঁদ যদি তার মুখের মতো সুন্দর হতে পারতো-ধন্য হতো সে। হরিণীর মতো তার কাজল কালো চোখের তারায় আমি ঘন নীল অতল সমুদ্রের গভীরতা প্রত্যক্ষ করেছি। তার পাকা আঙুরের মতো দুটি ঠোঁট, মর্যালের মতো গ্ৰীবা, সুডৌল স্তন, ক্ষীণ কাটি, ভারি নিতম্ব, নিরাসক্ত পুরুষের বুকেও ঝড় তুলতে পারে।

সম্রাট ঘায়ুর তার মেয়েকে প্ৰাণাধিক ভালোবাসে। তার মুখে হাসি ফোটাবার জন্য ঘায়ুরের চেষ্টার অন্ত নাই। কিছুদিন আগে মেয়ের জন্য সে সাতখানা সাতমহলা আজব প্রাসাদ বানিয়ে দিয়েছে। একখানা প্রাসাদ আগাগোড়া স্ফটিকের তৈরি। দ্বিতীয়খানা দুধের মতো চকমিলানো অ্যালাব্যাসটারের তৈরি। তৃতীয় প্রাসাদ পুরোটাই চীনে মাটিতে গড়া। চতুৰ্থখানা বাহারী রঙের মার্বেল পার্থ দিয়ে তৈরি করেছে সে। পঞ্চমখানা রূপে, ষষ্ঠখানা সোনা আর সপ্তম প্রাসাদখানা তৈরি করা হয়েছে হীরে দিয়ে। প্রত্যেকটি প্রাসাদ দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। কি তাদের গড়ন আর কি তাদের কারুকর্ম। দুনিয়ার সেরা কারিগর দিয়ে বানিয়ে দিয়েছে সম্রাট ঘায়ুর। শুধু মেয়ের মুখে হাসি ফোটাবার জন্য। সম্রাটের ইচ্ছা প্রত্যেকটি প্রাসাদে বদর একটি করে বছর কাটাবে। প্রত্যেক বছরে নতুন নতুন প্রাসাদে বাস করলে তারা মনে একঘেয়েমির ছাপ পড়বে না। সদা সর্বদা হাসি খুশি উৎফুল্ল হয়ে থাকবে সে।

প্রাসাদের ঐ মনোরম পরিবেশে আমি তাকে দেখেছি। তুমি কি বিশ্বাস করবে তাকে দেখার পর থেকেই আমার মাথাটা কেমন বিগড়ে গেছে।

দেশ বিদেশের রাজা বাদশাহরা এসেছিলো তার পাণি প্রার্থনা করতে। সম্রাট ঘায়ুর চেয়েছিলেদা মেয়ে তার পছন্দ মতো পাত্ব বেছে নিক। কিন্তু বদর কারো দিকে ফিরেও তাকায় নি। তার এক কথাঃ আমি নিজেই আমার রানী। ভারতের সূক্ষ্ম মসলিনের স্পর্শেই যে কাতর হয়ে পড়ে সেই কুসুমাদপি কোমল এই তনু কি করে একটা পুরুষের দৌরাত্ম্য সহ্য করবে, বাবা? না, তুমি ওদের বিদেয় করে দাও। আমি কোনও পুরুষের প্রভুত্ব সহ্য করতে পারবো না।

সম্রাট ঘায়ুর মেয়েকে অখুশি করার কথা ভাবতেই পারে না। সে যা পছন্দ করে না তা কিছুতেই তার ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চায় না সে।

একবার এক পরাক্রমশালী সম্রাট লক্ষ লক্ষ মোহরের উপহার উপটৌকন পাঠিয়ে সম্রাট ঘায়ুরের কাছে প্রস্তাব পেশ করলে, সে তার কন্যার পাণিপ্রার্থী।

সম্রাট ঘায়ুর মেয়েকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করলো। এই সম্রাটের রানী হলে তার মর্যাদার হানি হবে না। কারণ ঘামুরের মতো তারও জগৎজোড়া নাম।

কিন্তু এত বোঝানোর ফল হলো উল্টো। বদর রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললো, বাবা তুমি যেভাবে আমাকে নির্যাতন করছে তাতে আর আমি এ জীবন রাখতে চাই না। এক্ষুণি তরবারির এক কোপে নিজেকে আমি শেষ করে দেব।

বাবা শিউড়ে উঠলো। সে কি মা! ও কথা কি মুখে আনতে আছে? থাক, ওসব কথা আর মুখে আনবো না আমি। তোমার যখন একান্তই ইচ্ছা নয়, আমি আর তোমাকে বিরক্ত করবো না, মা। কিন্তু দোহাই বেটা, রাগের মাথায় যা তা কিছু করে বসে না।

আফ্রিদি দানাশ বললো, শুনলে তো মাইমুন্নাহ। আমি নিজের চোখে দেখে এসেছি—সেই মেয়েকে। চলো, তুমিও দেখে আসবে সেই ডানাকাটা হুরীকে।

এই সময় রজনী অতিক্রান্ত হচ্ছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

মাইমুনাহ এতক্ষণ চুপচাপদানাশের কাহিনী শুনছিল। দানাশ থামলে সে হো হো করে হাসতে হাসতে বললো, একটা মেয়ের রূপেই তুমি মজে গেছ! কি করে ভাবলে তার মতো সুন্দর আর হয় না? তুমি দেখোনি বলে? আমি যে শাহজাদাকে ভালোবেসেছি তাকে যদি দেখতে তাহলে আর তোমার এই উচ্ছাসের ফুলঝুরি মুখ দিয়ে বেরুতো না।

দানাশ বললো, তা হতে পারে। কিন্তু তোমার ভালোবাসাকে তো আমি দেখিনি। যাই হোক, তোমার যদি আপত্তি না থাকে চলো তাকে একবার দেখে নয়ন সার্থক করে আসি। তবে নিজে চোখে না দেখলে আমি বিশ্বাস করতে রাজিনই যে, আমার রাজকুমারীর চেয়েও সুন্দর কেউ হতে পারে।

মাইমুনাহ রেগে ওঠে, চুপ করো। যাকে চোখে দেখিনি সে বড় সুন্দরী। অমন চোেখ ঝলসানো রূপ আমি ঢের দেখেছি। আমি বাজি রেখে বলতে পারি, আমার ভালোবাসার নখের যুগ্য হবে না। তোমার সেই রাজকুমারী। তার রূপ দেখেই যদি তোমার মাথা বিগড়ে গিয়ে থাকে। তবে আর আমার ভালোবাসাকে দেখে কাজ নাই। একবার তাকে চোখে দেখলেই তুমি ভিরমি খেয়ে পড়ে যাবে।–আর চৈতন্য ফিরবে না। কেন বেঘোরে প্রাণটা হারাবে, থাক, তাকে আর চোখে দেখে তোমার কাজ নাই।

দানাশ বলে, কিন্তু কে সে? কোথায় থাকে?

মাইমুনাহ বলে, সে এই বাদশাহর ছেলে। আমি যে কুপে বাস করি তার পাশে যে ভাঙা প্রাসাদ–তারই চিলেকোঠার ঘরে সে এখন বন্দী হয়ে আছে। সাবধান, কক্ষণো তুমি এক যাবে না সেখানে। যদি দেখতে চাও আমি তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারি। তোমার মতো শয়তানকে আমি এক ফোঁটা বিশ্বাস করি না। সুন্দর ছেলে দেখলেই তার সর্বনাশ করতে তোমরা ওস্তাদ।

—আহা, অত্য চটছে কেন সুন্দরী। একবার যখন বলেছে সে তোমার ভালোবাসা, আমি তার অনিষ্ট করতে পারি? আমি কসম খেয়ে বলছি, একা সেখানে কখনো যাবো না। তবে তাকে একবার দেখতে চাই-কেমন সে সুন্দর। তা তোমার সঙ্গেই যাবো। দূর থেকে এক পলক দেখবো মাত্র।

মাইমুনাহ বলে, নিয়ে যেতে পারি একটা শর্তে। তাকে দেখে যদি তোমার মনে হয়। সত্যি সে তোমার রাজকুমারীর চেয়ে সুন্দর তা হলে আমাকে পেট পুরে ভালো মন্দ খাওয়াতে হবে। আর তোমার রাজকুমারী যদি আমার শাহজাদার চেয়ে বেশি সুন্দর হয়, আমি তোমাকে খাওয়াবো-যা চাইবে।

দানাশ আনন্দে চিৎকার করে ওঠে, চমৎকার! ঠিক আছে, তাই হবে। তাহলে চলো, আগে আমার রাজকুমারী বন্দরকে দেখিয়ে নিয়ে আসি—

মাইমুনাহ বাধা দিয়ে বলে, আমার শাহজাদা তো ঐ নিচে ভাঙা প্রাসাদের চিলেকোঠার ঘরেই শুয়ে আছে। এখান থেকে সোজা নেমে গেলেই তাকে দেখতে পাবে। এক পলকের ব্যাপার। আগে চলো তাকে দেখিয়ে নিয়ে আসি। তারপর যাওয়া যাবে তোমার রাজকুমারীর দেশে। সেখানে যেতে তো রাত কাবার হয়ে যাবে।

ওরা দুজনে কামার আল-জামানের ঘরে ঢুকে পড়লো।

মাইমুনাহ ফিস ফিস করে দানাশের কানে কানে বলে, খুব সাবধান, কোনও শব্দ করবে না। তোমার যা বাজাখাই স্বভাব, এখুনি হয়তো খ্যা খ্যা করে উঠবে। তা হলে ওর ঘুম ভেঙে যাবে।

দানাশ একভাবে চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকে। এমন নিখুঁত দেহসৌষ্ঠব সে কোন মানুষের কখনও দেখেনি।

মাইমুনাহ বিরক্ত হয়ে বলে, অমন হাঁ করে দেখছ কী?

দানাশের তন্ময়তা কাটে, সত্যি, এমন অপরূপ সুন্দর ছেলে আমি আর কোথাও দেখিনি, মাইমুনাহ। দেখে নয়ন সার্থক হয়ে গেলো। নাঃ, আমি হেরে গেলাম তোমার কাছে। এ রূপের কোনও জুড়ি নাই। বেহেস্তেও আছে কি না সন্দেহ। আমার রাজকুমারী দুনিয়ার সেরা সুন্দরী বলে তোমার কাছে বড়াই করেছিলাম। কিন্তু সে দম্ভ আমার ভেঙে দিলে। কিন্তু এত প্রশংসা করেও একটা কথা ভয়ে ভয়ে বলবো। যাই বলো এত রূপ কোনও পুরুষ মানুষের মানায় না। আল্লাহ বোধ হয় মেয়ে গড়তে গড়তে হঠাৎ ভুল করে ছেলে বানিয়ে দিয়েছেন। দেখছি না, ওর সারা দেহটায় কেমন মেয়েলী ছাপ-একেবারে বদর-এর মতন।

দানাশের মুখের কথা মুখেই রয়ে গেলো, মাইমুনাহ দানাশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রচণ্ড জোরে পাখারবাড়ি মারলো। দানাশের একটা শিং ভেঙে পড়ে গেলো। মাইমুনাহ রাগে থর থর কাঁপতে থাকে, শয়তান বদমাইশ, বেল্লিক, যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা! তুই তো তুই, তোর বাপ-ঠাকুরদা-চোঁদপুরুষের কেউ কখনও দেখেছে এমন রূপবান পুরুষ? ভাগ হতচ্ছাড়া, প্ৰাণে যদি বাঁচতে চাস, এক্ষুণি বেরিয়ে যা এখান থেকে। না হলে তোকে আমি তুলে আছাড় মারবো।

দানাশ ভয়ে জড়সড় হয়ে গেছে। গুটি গুটি জানলার দিকে এগিয়ে যায়। মাইমুনাহ হুকুমের স্বরে বলে, এক্ষুণি সোজা চলে যা তোর রাজকুমার বদর-এর কাছে। আজ রাতেই তাকে এখানে নিয়ে আসা চাই। আমি শাহজাদার সঙ্গে মিলিয়ে দেখবো সে কেমন সুন্দরী? আর তার মেয়েলী শরীরের সঙ্গে শাহজাদার শরীরেরই বা কতটুকু মিল আছে আমার দেখা দরকার। আমার হুকুম তামিল না করিস, এইরাতেই যদি বদরকে এখানে না আনিস তোর কপালে অনেক দুঃখ। তোকে আমি কেটে টুকরো টুকরো করে শেয়াল শকুন দিয়ে খাওয়াবো মনে থাকে যেন!

দানাশ কোনও কথা না বলে ঘাড় নেড়ে জানোলা দিয়ে বেরিয়ে গেলো। প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে সে ফিরে আসে। পিঠের ওপর ঘুমন্ত রাজকুমারী বন্দর। ফিনফিনে পাতলা একটিমাত্র শেমিজ ছাড়া তার পরণে অন্য কোনও পোশাক নাই। প্রায় কঁচের মতো স্বচ্ছ শেমিজটার নিচে ধবধবে ফর্সা দেহখানা আয়নার মতো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। ঘরের মধ্যে ঢুকতেই দানাশকে লক্ষ্য করে মাইমুনাহ কটাক্ষ করে বলে, কি রে হতচ্ছাড়া এত দেরি কেন? এই খালিদান থেকে চীনে যেতে আসতে কতটুকু সময় লাগে? না, রাজকুমারীর ন্যাংটো শরীর দেখে আর ঠিক থাকতে পারিস নি? পথের মাঝে কোথাও ঝোপ জঙ্গলে নামিয়েছিলি বুঝি? যাগ গে, এখন শাহজাদার যেন ঘুম না ভাঙে।

থেকে খুলে নিলো। মাইমুনাহ অপলকভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকলো। নাঃ, কোথাও কোনও খুঁত ধরা গেলো না। বরং দানাশ যা রূপের বর্ণনা দিয়েছিলো আসলে সে তার চেয়ে ঢের-ঢের বেশি সুন্দরী। শাহজাদার সঙ্গে রাজকুমারীর অঙ্গ সৌষ্ঠবের তফাৎ কিছুই নাই। মনে হয়, ওরা যেন একই ছাঁচে গড়া—যমজ। দুজনেরই মুখের সুরৎ একই রকম অনন্যসাধারণঅপূর্ব সুন্দর।

মাইমুনাহ বললো, হাঁ, স্বীকার করতেই হয় তোমার রাজকুমারী কিছু কম সুন্দরী না। দুজনের মধ্যে কে বেশি সুন্দর এ নিয়ে তর্ক করা যেতে পারে। আমি বলবো, আমার শাহজাদা বেশি সুন্দর। আর তুমি বলতে পারো তোমার রাজকুমারীই বেশি সুন্দরী। এ তর্কের মীমাংসা হতে পারে না। কিন্তু তুমি যে একটা ডাহা মিথ্যে কথা বলেছি তা তো প্রমাণ হয়ে গেলো। আমার শাহজাদার শরীরে যে আদৌ মেয়েলী ছাপ নাই। তা তো এখন দেখতে পোচ্ছ? আর তা ছাড়া মেয়েদের সারা শরীর জুড়ে থাকে কামের ছাপ। ওই দেখো, ওর বুক, ওর কোমর, পাছা, যেখানে দেখবে, শরী চনমান করে উঠবে। আপনা থেকেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে ‘বাঃ’। কিন্তু সত্যিই ‘বাঃ’ বলার নিখুঁত কিনা সেটা কেউ খুটিয়ে দেখতে পারে? নিরুত্তাপ নিষ্কাম চিত্তে যদি বিচার করো আমার শাহজাদাই প্রথম পুরস্কার পাবে কি বলো?

—দেখ মাইমুনাহ, এ নিয়ে তোমার সঙ্গে ঝগড়া বিবাদ করতে চাই না। তুমি যদি খুশি হও, আমি মনের কথা চেপে তোমাকে খুশি কোরর জন্যে না হয় মিথ্যেটাই মেনে নিলাম।

—কী, এত বড় কথা, আমি মিথ্যে বলছি।

—আহা-হা অত্য চটছ কেন? আমি তো মেনে নিচ্ছি, তোমার শাহজাদাই বেশি সুন্দর। সে-ই প্রথম, আমার রাজকুমারী দ্বিতীয়। তুমি খুশি তো?

মাইমুন্নাহ আরও চটে ওঠে। অমন ঘুরিয়ে পেচিয়ে বলার কি দরকার? যদি সাহস থাকে তবে বেলা, আমার কথা তুই মানতে রাজিনোস। তুই না পুরুষ মানুষ—একটা নপুংসক কোথাকার।

—এ তোমার ভারি অন্যায়। অমন করে গালাগাল দিচ্ছে কেন? আমি তো তোমার কথা মেনেই নিয়েছি!

এই সময়ে রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

একশো বিরাশিতম রজনীতে আবার গল্প শুরু হয়?

মাইমুনাহ রেগে কাঁই। —তুমি কি আর সত্যি সত্যি মেনে নিয়েছ? মুখে মানছো আমার প্যাদানীর ভয়ে। কিন্তু তাতেও তোমার নিস্তার নাই। তোমার মতো মিচকে শয়তানকে কি করে। শায়েস্তা করতে হয় আমার জানা আছে।

এই বলে মাইমুনাহ একখানা পাখার ঝাপট মারে দীনেশের চোখে। বেচারী, বড়ৎ জোর, তড়াক করে দু’পা পিছিয়ে যেতে পেরেছিলো তাই রক্ষে। না হলে চোখটাই যেত। কিন্তু ততক্ষণে মাইমুনাহ ক্ষেপে উঠেছে। তাক করছে, দীনেশের ঘাড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। দানেশ ওর মতলব বুঝে নিমেষের মধ্যে একটা মাছি হয়ে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে বিছানায়-ওদের দুজনের মাঝখানে। অন্য সময় মাইমুনাহ ছেড়ে কথা কইতো না। যেন তেন প্রকারে ওর পিণ্ডি চটকে দিত। কিন্তু এখন, এই অবস্থায় বিছানার ওপর ধস্তাধস্তি করা সম্ভব না। তাতে ওদের দুজনের ঘুম ভেঙে যাবে। তাই সে নিজেকে সামলে নিলো।

-ঠিক আছে, কিছু বলবো না। বিছানা ছেড়ে বেরিয়ে এসো।

দানাশ বলে, তুমি আমাকে মারবে।

মাইমুনাহ বলে, খোদা কসম, কিছু বলবো না, বেরিয়ে এসো।

এবার দানাশ উড়ে এসে আবার নিজের আসল রূপ ধরলো।

—শোনো দানাশ, মাইমুনাহ বলে, এভাবে এই বিতর্কের নিম্পত্তি হবে না। তার চেয়ে এমন কাউকে সালিশ মানা যাক—যে ব্যাপারটার ফয়সালা করে দিতে পারবে।

দানাশ বললো, সেই ভালো। তোমার যাকে ইচ্ছে ডাকে। মাইমুনাহ মেঝের উপর তিনবার টোকা দিলো। আর সঙ্গে সঙ্গে মেঝেটাি দুভাগ হয়ে নিচে থেকে উঠে এলো বিশাল বিকট কদাকার কুৎসিত এক দৈত্য। মাথায় তার ইয়া বড় বড় ছ’খানা শিং। এক এক খানার মাপ কীটার মতো। তে-ভাগা। পিঠের উপর দুম্বার মতো একটা কুঁজ। আর একটা পা খোড়া। নাক বলে কোন বস্তু নাই। গোলাকার চোখ দুটো নাকের জায়গাটা দখল করে আছে। তার একখানা বাহু লম্বায় পাঁচ হাজার পাঁচশো পঞ্চাশ হাত। আর একখানা মাত্র বিঘৎখানেক লম্বা; এক একখানা হাতের থাবা দেখতে ঠিক জলের ডেকচির মতো। ওর নাম কশকশ ইবন ফকরাশ ইবন আত্রাশ-আবু হানফাশের বংশধর।

ঘরের ভিতরে উঠে দাঁড়াতেই আবার মেঝেটা জোড়া লেগে গেলো। কশকশ আভূমি আনত। হয়ে মাইমুনাহকে কুর্নিশ জানিয়ে বললো, বান্দা হাজির মালকিন।

মাইমুনাহ হাত তুলে আশীর্বাদের ভঙ্গী করে বললো, জিত রহো, বেটা। আমার সঙ্গে হাড়েহারামজাদা এই দানাশের ঝগড়া বেঁধেছে। তোমাকে আমরা সালিশ মানছি। তুমি ফয়সালা করে দাও। ঐ যে দেখছ শাহজাদা আর রাজকুমারী শুয়ে ঘুমাচ্ছে, তোমাকে বলে দিতে হবে কে বেশি খুবসুরৎ। খুব ভালো করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখো! তোমার বিচারে যাকে বেশি সুন্দর মনে হবে আমরা তাকেই সেরা বলে মেনে নেবো। রায় দেবার আগে খুব ভালো করে ভেবে দেখবে–যেন কোনও অবিচার না হয়।

কশকশ এতক্ষণ পালঙ্কের দিকে পিছন করে দাঁড়িয়েছিলো। এবার ফিরে দেখেই আনন্দে উত্তেজনায় ধেই ধেই করে নাচতে লাগলো। ওরেকবাস, একি দেখছি। আশমানের চাঁদ মাটিতে নেমে এসেছে। কিন্তু মালকিন, বড় মুশকিলে ফেললেন, দুজনেই তো দেখি একইতরা খুবসুরৎ। ফারাক তো কিছু বুধি না।

মাইমুনাহ বলে, তা বললে তো হবে না কশকশ, এর মধ্যে একজনকে বাছাই করে বলতেই হবে।

কশকশ বলে, ঠিক আছে ঘাবড়াবেন না, উপায় একটা বাৎলে দিচ্ছি।–কী সে উপায়? কশকশ বললো, প্রথমে আমি এই রাজকুমারীর রূপের গুণগান করে একটা কবিতা শোনাতে চাই।

মাইমুনাহ বাধা দিতে বলে, অত সময় নাই। ওসব কাব্যিটাব্যি রাখো। এখন সোজাসুজি যা বলতে চাও বলো।

কশকশ বললো, তা হলে এক কাজ করুন। আমরা তিনজনই অদূল্য হয়ে হাওয়ায় মিশে থাকি। তারপর সকাল হতে দিন। ওরা ঘুম থেকে জেগে উঠুক। দুজনে দুজনকে দেখুক। তখনই বোঝা যাবে কার রূপে কে বেশি মুগ্ধ হয়। যদি ছেলেটা মেয়েটার জন্যে পাগল হয়ে ওঠে তা হলে বুঝতে হবে মেয়েটাই বেশি সুন্দরী। আর যদি ছেলেটার জন্য মেয়েটার ছটফটানি ধরে তা হলে বুঝবেন ছেলেটার রূপে এমন কোন যাদু আছে যার টানে মেয়েটা আর ঠিক থাকতে পারছে না। সব সমস্যা লহমায় জল হয়ে যাবে মালকিন। খালি অদৃশ্য হয়ে ঘাপটি মেরে দেখতে থাকুন।

এই সময় রাত কাবার হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামায়।

 

পরদিন একশো তিরাশিতম রজনী :

রজনীর মধ্যভাগে আবার কাহিনী শুরু হয়। মাইমুনোহ লাফিয়ে ওঠে, ওঃ, কি চমৎকার বুদ্ধি তোমার কশকশ। দানাশও হেঁড়ে গলায় বাহবা দিতে থাকে, বেড়ে-মজার। এই বলে আবার সে মাছি হয়ে উড়ে গিয়ে বসলো কামার আল-জামানের ঘাড়ে। কুটুস করে দিলো একটা কামড়। কামড়ের যন্ত্রণায় সে সারা শরীর বঁকিয়ে ছটফট করে ওঠে। ঘাড়ের কাছে, যেখানটা জ্বালা করছিলো, হাত বুলিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করে। কিন্তু ততক্ষণে কি দানাশ সেখানে বসে থাকার পাত্র। শাহজাদা উঠে পড়বে আশঙ্কায় মাইমুন্নাহ আর কশকশও অদৃশ্য হয়ে হাওয়ায় মিশে গিয়েছিলো।

এরপরের ঘটনাগুলো বড় মজার :

কামার আল-জামানের চোখে তখন ঢুলু ঢুলু ঘুম। হাতখানা ঘাড়ের কাছে কিছুক্ষণ বুলিয়ে আলতোভাবে নামিয়ে বিছানার ওপর রাখতে যায়। কিন্তু পাশে শূন্য শয্যা ছিলো না। রাজকুমারী বদরের কুসুমাদপি কোমল বিবস্ত্রা দেহখানি এলিয়ে পড়েছিলো সেখানে। হাতখানা নামিয়ে রাখতে গিয়ে রাখলে সে বদরের কবোষ্ণ উরুর খাজে।

এবার তার ঘুম ছুটে গেলো। একবার চোখ মেলে বদরকে দেখেই সঙ্গে সঙ্গে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললো। হয়তো বা সে ভুল দেখলো, কিংবা খোয়াব-এর খোয়াডি কাটছে না! চোখ বন্ধ করেই হাতটা আস্তে আস্তে চালিয়ে অনুভব করতে থাকলো—সত্যিই কোনও রক্তমাংসের কোনও মেয়ে তার পাশে শুয়ে আছে, কিনা। নাঃ, ভুল সে করেনি। খোয়াবও দেখছে না। এই তো মাখনের মতো মোলায়েম কি নরম তার উরুর মাংস। প্ৰাণ ভরে জোরে শ্বাস টানলো সে। আঃ, কী সুন্দর খুশবু? মেয়েটার গা থেকে সেই সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ছিলো ঘরময়। অজানা অপরূপা। তার নিরাবরণ নগ্ন নিরুপম রূপের দিকে চেয়ে চেয়ে এক অভূতপূর্ব অনাস্বাদিত পুলকে জামানের দেহমান শিহরিত হয়ে উঠতে থাকে।

একটি মেয়ে তার পাশে তায় আবার সম্পূর্ণ উলঙ্গ। এ দৃশ্য দেখাও পাপ। কিন্তু কৌতূহল এমনই বস্তু তাকে জোর করে বেশিক্ষণ চেপে রাখা যায় না। তেরছা চোখে চুরিয়ে চুরিয়ে তার সারা শরীর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকলো। যতই দেখে ততই মুগ্ধ হয়। দেহের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেন সুনিপুণ শিল্পীর হাতে গড়া। কোনও খুঁত নাই। সুঠাম সুন্দর এক শিল্প মূর্তি। কামার অল-জামান ভেবে পায় না তার এই রূপ কিসের সঙ্গে তুলনা করা যায়। হীরা চুনি পান্না? না, তারা সবাই এর জেল্লার কাছে ত্ৰিয়মান হয়ে যাবে। তবে কি পারস্যের লালগুলাব-যার সুবাসে দিল মদির হয়ে ওঠে। কিন্তু না, তাও গ্রাহ্য হয় না। এ নারীর রূপেরর আকর্ষণে আশ্যমানের তারা ধরায় ধরা দিতে পারে। পর্বত নতজানু হয়ে বলতে পারে, ওগো, সুন্দরী আমার মাথা নত করে দাও তোমার ঐ পদ্মরাঙা পায়ে। আবার সমুদ্রও হয়তো আছড়ে পড়ে মিনতি জানাবে, ‘গণ্ডুষ ভরিয়া পান কর দেবী, আমি তব অন্তরে লুকায়ে রহিত চিরকাল।’

উত্তেজনায় সারা শরীর ঘেমে ওঠে। জামানের। গা থেকে মাথা অবধি বদরের আগাগোড়া দেহখানার উপরে হাত বুলাতে থাকে সে। কি যে ভালো লাগে তার-কি করে বোঝাবে সে কথা। এ আনন্দ শুধু অনুভবের-প্রকাশের নয়। কামার আল-জামানের জীবনে এ অভিজ্ঞতা এই প্রথম। তাদের সমাজে নারী অসূর্যস্পশ্যা। পরপুরুষ পরনারীর মুখই দেখতে পায় না। তায় আবার নিরাবরণ সারা দেহ। জামানের দেহে সবে যৌবনের জোয়ার আসতে শুরু করেছে কিছুদিন থেকে। এতদিন তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে এডিয়ে চলছিলো, আজ, এই মুহূর্তে, বুঝি সকল বাধা ছাপিয়ে সে উপছে পড়তে চায়। নিজেকে নির্মম নিষ্ঠুর পীড়নে পীডিত করতে থাকলে হয়তো বা বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। তখন হয়তো আর সংযত-সংহত থাকার সব বাঁধই উৎখাত হয়ে যাবে।

তাই আর দেরি নয়। এবার সময় সমাগত। দেহ যা চায় মনও যখন তাই চায় তাতে আর বাধা দিতে নাই। জামান হাত বুলাতে থাকে ওর গালে ঠোঁটে, ওর গ্ৰীবা ঘাড়ে বুকে স্তনে।

অসহ্য এক যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠে জমান। বদরের বুকের সঙ্গে মুখ ঘষকে থাকে। চাঁপাকলির মতো স্তনাধার ঠোঁটের ঘর্ষণেই পলকে রক্তাভ হয়ে ওঠে।

হঠাৎ জামানের খেয়াল হয়, ওর গায়ের শেমিজ গেলো কোথায়। এপোশ ওপোশ ঘুরিয়ে দেখতে থাকে। না, কোথাও নাই। আর মেয়েটাই বা কি রকম! এমন ওলোট পালোট করাতেও তায় ঘুম ভাঙছে না। জামান কি করে জানবে দানাশ তাকে যাদু করে রেখেছে। এখন তার শরীর নিয়ে দলাইমলাই করলেও এ ঘুম তার ভাঙবে না।

কামার আল-জামান বৃথাই চেষ্টা করে তার ঘুম ভাঙানোর। যতই তাকে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকে ততই সে কামনায় উত্তেজিত হয়ে ওঠে। বদরের অধীরে অধর রাখে। দীর্ঘ চুম্বনে চুষতে থাকে। কিন্তু তবু তার সাড়া নাই। পরপর তিনবার চুম্বনে চুম্বনে ঠোঁটে রক্ত ঝরিয়ে দেয়। কিন্তু না, সে জাগে না। এবার জামান ওকে নাড়া দিয়ে ডাকে, সোনা-সোনা, চেয়ে দেখো,  তোমার সামনে কে। ওঠ, সাড়া দাও। তুমি আমার দিল, কলিজা সব কেড়ে নিয়েছে, সুন্দরী। একবার চোখ মেলে তাকাও, দেখো, আমি শাহজাদা কামার আল-জামান-তোমার কাছে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে এসেছি।

কিন্তু কে সাড়া দেবে। দানাশের মায়াবলে সে তখন অসাড়া অচৈতন্য। জামান বলে, আমার গোস্তাকি মাফ করো সুন্দরী। আমি আর নিজেকে রাখতে পারছি না। আমি চেয়েছিলাম, আমার ডাকে তুমি সাড়া দেবে। জেগে উঠবে। আমি বড় তৃষ্ণার্ত, আমার স্বইচ্ছায় সুধা পান করাবে। কিন্তু তুমি ঘুমে বিভোর। আমি তোমার ঘুম ভাঙাতে পারলাম না। এদিকে যৌবন জুরে জরুজর আমি। কামবানে বিদ্ধ এক তৃষ্ণার্ত কপোত। আর তুমি সেই মদালসা নারী ঘুমে অচৈতন্য। ক্ষমা করো সোনা, সাধ্য নাই ধৈর্য ধরি, তাই চুরি করে নিতে হলো তোমার সদ্যাফোটা যৌবনের প্রথম কদম ফুল।

মাইমুনাহ, দানাশ আর কশকশ অলক্ষ্যে সবই প্রত্যক্ষ করছিলো।

এইসময় রাত্ৰি শেষ হয়ে আসতে থাকে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে। শারিয়ার বলে, যাঃ বাকবা, ভালো জায়গায় রাতটা কাবার হয়ে গেলো…

 

পরদিন সন্ধ্যা হতে না হতে বাদশাহ শারিয়ার এসে হাজির হয়। শাহরাজাদ বুঝতে পারে। সুলতান কোন আফিঙের নেশায় ছটফট করছে। শারিয়ার কিছু বলার আগেই সে বলে, জাঁহাপনা আমার শরীরটা এখন ভালো লাগছে না। যদি মঞ্জর করেন। তবে প্রথম রাতটা একটু ঘুমিয়ে শরীরটা একটু চাঙ্গা করে নিই। তারপর আবার শুরু করবো কাহিনী।

শারিয়ার বলে, গল্প তো রোজই শুনছি শাহরাজাদ, শরীরটাই তো আগে। এসো এখন শুয়ে পড়ি। তারপর মেজাজ ভালো লাগলে, সে পরে দেখা যাবে।

শাহরাজাদের শরীর ভালোই ছিলো। শারিয়ারকে একটু বাজিয়ে দেখে নিলো মাত্র। সেই রাতেই দ্বিতীয় প্রহরে আবার সে শুরু করে :

বদর চিৎ হয়ে এলিয়ে শুয়েছিলো। কামকাতর জামান দু’হাত দিয়ে ওর দেহখানা বুকে নিয়ে জাপটে ধরতে যাচ্ছিল। হঠাৎ একটা কথা মনে পড়তেই সে থমকে গেলো। এতক্ষণের সব ধাঁধা নিমেষে জলের মতো সহজ সরল পরিষ্কার হয়ে গেলো। বুঝতে আর তার বাকি রইলো না—এসব তার বাবার কারসাজি। তা না হলে এই কয়েদখানায় এতগুলো পাহারার চোখে ধুলো দিয়ে এই বন্ধ ঘরের মধ্যে এ-মেয়ে এখানে এলো কি করে? বাবা চান, জামান শাদী করে সংসার হোক। কিন্তু জামান নারী বিদ্বেষী। তার মনের এই বিদ্বেষ ভােব কাটাবার জন্যে তিনি এই ফন্দী এটেছেন। কোনও জানলার ফুটোয় চোখ রেখে নিশ্চয়ই সব লক্ষ্য করছেন। কাল সকালে টিটকিরি দিয়ে বলবেন, জামান, মুখে তো অনেক বড় বড় বাত আওড়াও। ‘নারী নরকের দ্বার। স্ত্রীলোকের চরিত্র স্বয়ং খোদাতালাও জানেন না। দুনিয়ার তাবৎ অনিষ্টের মূল এই মেয়ে জাত।’ কিন্তু বাপজান, কাল রাতে সেই দোজকের কীট নিয়ে কি খেলায় মেতেছিলে? তখন সে কথার কী জবাব দেব আমি? বড়মুখ করে আদর্শের কথাবার্তা বলা তো আমার খতম হয়ে যাবে। জীবনে আর তার সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবো না কোনও দিন। না না, এ হতে পারে না। আব্বাজানের এই ফাঁদে আমি কিছুতেই পা দেব না। তিনি আমাকে মিথ্যেবাদী ভণ্ড ভাববেন, এ হতে পারে না।

সাপের উদ্যত ছোবল থেকে আত্মরক্ষার জন্য মানুষ যেভাবে ছিটকে সরে যায় কামার অল-জামানের অবস্থাও ঠিক সেই রকম হলো। এক লাফে সে পালঙ্ক থেকে নেমে ঘরের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালো। আজকের রাতটা সে কোন রকমে সংযম রক্ষা করে চলবে। জামান ভাবে, কাল বাবার কাছে সোজাসুজি প্রস্তাব পেশ করবো, এই মেয়ের সঙ্গে যদি তিনি শাদী দিতে চান আমার কোনও আপত্তি নাই। ছেলের সুমতি হয়েছে দেখে বাবা নিশ্চয়ই খুশি হয়ে শাদী দিয়ে দেবেন। তারপর তো সে আমারই হবে। তখন তাকে নিয়ে আমি যা-ই করি না কেন তিনি আডি পাততে আসবেন না। বরং আহ্লাদে আটখানা হবেন।

এতক্ষণ মাইমুনাহর মুখখানা কালো হয়ে গিয়েছিলো। তার শাহজাদা এত কামকাতর। একটা মেয়ে-চেনা নাই জানা নাই, যেহেতু সে তার পালঙ্কে শুয়ে আছে আমনি সে তার রূপে ঢলে পড়লো? ছি, ছি, লজ্জায় মাথা কাটা গেলো? বাদশাহর ছেলের রুচি প্রবৃত্তি বলে কি কিছু নাই। একটা মেয়ের ন্যাংটো শরীর দেখেই জিভে জল এসে গেলো?

যাই হোক, শেষ মুহূর্তে মাইমুনাহর ইজ্জৎ বাঁচিয়েছে শাহজাদা। এবার সে সম্বিত ফিরে পেয়েছে। বাদশাহ শাহরিমানের একমাত্র পুত্র সে। এই বিশাল সলতানিয়তের সে-ই হবে সুলতান। যে-সে কথা নাকি?

আনন্দে ধেই ধেই করে নাচতে থাকে মাইমুন্নাহ। কামার আল-জামান ধীর পায়ে পালঙ্কের পাশে দাঁড়ায়। আলতোভাবে একটু ছোট্ট চুম্বন একে দেয় বদরের গালে। নিজের হাত থেকে মহামূল্যবান একটা হীরের আংটি খুলে পরিয়ে দেয় বদরের আঙুলে। সেইক্ষণে মনে মনে সে তাকে বেগম বলে গ্রহণ করে নেয়। আজ থেকে সে তার স্ত্রী। সহধর্মিনী। এই আংটি তার সাক্ষী।

এরপর জামান বদর-এর দিকে পিছন ফিরে শুয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমে গলে গেলো। এইবার মাইমুনাহ ধরলো মাছির রূপ। শো করে উড়ে গিয়ে বদরের উরুতে বসিয়ে দিলো এক কামড়। ঘুমের ঘোরেই কঁকিয়ে ওঠে সে। কিন্তু মাইমুনাহ ছাড়বার পাত্রী নয়। রাজকুমারীর ওপর রাগে তার সারা শরীর রিরি করে জুলছে। পায়ের তালুতে, নাভিকুণ্ডলীতে বাহুমূলে কামডিয়ে কামডিয়ে শেষ করতে লাগলো। রাজকুমারী যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে চোখ মেলে তাকালো। কিন্তু একি? নিজের চোখকে নিজেই সে বিশ্বাস করতে পারে না। বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে ওঠে। দুহাত দিয়ে চোখ দুটোরগড়ে নেয়। সে কি স্বপ্ন দেখছে? কিন্তু না, স্বপ্ন তো নয়। তন্ময় হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকে সে জামানের অর্ধনগ্ন দেহ। বাঃ কি সুন্দর! এত রূপ। কখনও পুরুষের হয়? কিন্তু এখানে সে এল কি করে? খোজাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে এই অন্দরমহলে তো পুরুষের প্রবেশ সম্ভব না। তবে কি তার বাবারই এই কারসাজি? বিয়ে করবে না বলে সে পণ করে বসে আছে। সে জন্যেই কি তার বাবা এই রূপবানকে পাঠিয়েছে? তা এমন সুন্দর সুপুরুষ দুনিয়াতে আছে জানলে কি সে না’ করতো। এমন ছেলে পেলে কি কোনও মেয়ে নিজেকে ঠিক রাখতে পারে।

বদর আরও কাছে সরে আসে জামানের। যতই দেখতে থাকে ততই সে বিহ্বল হয়ে পড়ে। মুখখানা নামিয়ে এনে জামানকে একটু চুমু খায়। মনে মনে ঠিক করে, কাল সকালেই সে বাবাকে বলবে, না, তার আর কোনও অমত নাই। এই ছেলেকেই সে বিয়ে করবে। বাবাও খুশি হবে, তারও জীবন আনন্দে ভরে উঠবে। বদর ভাবে, এমন পাত্র থাকবে বাবা কেন ঐ সব হত কুৎসিত বুড়ো-হাবড়া রাজা বাদশাহদের নিয়ে আসতো। বাবা যদি অনেক আগে একে নিয়ে আসতো। তাহলে তো কোনও আপত্তিই করতো না সে! যাইহোক, আর দেরি নয়, কালই সে বিয়েতে মত দেবে।

জামানের একখানা হাত তুলে নিয়ে বুক চেপে ধরে। ফিসফিস করে ডাকে, এই—শুনছো, চোখ মেলে দেখো, আমি বন্দর। তোমার রূপে আমি পাগল হয়ে গেছি। ওঠ, সোনা, আমাকে আদর করো। তোমার বুকে আমি মাথা রেখে আমার দেহমান সঁপে দিয়ে জীবন সার্থক করি। ওঠ, আর ঘুমিও না।

কিন্তু জামানের ঘুম ভাঙবে কি করে? মাইমুনাহ তো তাকে যাদু করে রেখেছে। বদর সে কথা জানে না। এবার বেশ জোরে জোরেই নাড়া দিতে থাকে। ভাবে ঘুম তার ভেঙে গেছে। কিন্তু চোখ মেলে তাকাচ্ছে না, ঘাপটি মেরে পড়ে আছে। পায়ের তলায়, বগলে সুড়সুডি দিতে দিতে ডাকে, আমি যে আর সইতে পারছি না সোনা, এভাবে আর কত কষ্ট দেবে? ওঠ, আমার ঠোঁট শুকিয়ে গেছে, বুকের মধ্যে উথাল পাথাল করছে, আমাকে আদর করো, চুমু খাও! চোখ খোলো, আমার এই ভরা যৌবনের রূপে দেশ-বিদেশের কত রাজা-বাদশাহরা পাগল। আমি তাদের দিকে ফিরেও তাকাইনি। শুধু তোমার জন্যেই অতি সযত্নে সঙ্গোপনে লালন করেছি আমার এই কুমারী দেহখানা। তিল তিল করে আজ সে তিলোত্তম হয়ে উঠেছে। আজ পর্যন্ত কোন পুরুষ আমাকে স্পর্শ করেনি। তোমার জন্যই আমি এতকাল প্রতীক্ষা করেছিলাম। আজ তুমি এসেছে, তোমার হাতেই এই দেহ, মন সপো দিয়ে আমি ধন্য হতে চাই। আমার মল্লিকা বনে যখন প্রথম কলি ধরতে শুরু করেছে তখন থেকেই কত ভ্বমরের আনাগোনা, কিন্তু এ ফুলের মধু শুধুমাত্র তোমার জন্যে সযত্নে রক্ষা করে এসেছি। তুমি গ্রহণ করে তৃপ্ত হলে আমিও তৃপ্তি পাবো। আর দেরি করো না, সোনা, এই মধুযামিনী শেষ হতে চলেছে। ওঠ, আজকে রাতে আমাদের মধুর মিলনস্মৃতির পটে শুকতারা মতো উজ্জ্বল হয়ে জুলবে চিরকাল।

কিন্তু কে সাড়া দেবে? জামান তখন ঘুম অসাড়। এদিকে বদরের দেহে উত্তেজনা ক্রমশই বাড়ে। বাঁ নাকের নিঃশ্বাস প্রশ্বাস দ্রুততর হয়। বুকের মধ্যে সমুদ্রের ঢেউ আছাড়ি খেয়ে পড়তে থাকে। সারা শরীরে সে এক তুফানের তোলপাড়। শান্ত স্নিগ্ধ চোখের তারারা কামবানে হয়ে ওঠে চঞ্চল। আর সারা মুখে কে যেন মাখিয়ে দিয়েছে আবীর। কপালে জমে উঠেছে বিন্দু বিন্দু স্বেদ। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না বন্দর। জামানের বুকের ওপর লুটিয়ে পড়ে। দু’হাতে গলা জড়িয়ে ধরে অধরে দংশন করে। ঠোঁটে রক্ত ঝরে; কিন্তু জামান ঘুমে অচেতন। কোন সাড়া নাই। ওর সারা শরীরের প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গে হাত বুলিয়ে স্পর্শ সুখ অনুভব করতে থাকে বন্দর। এই অনুভবের কি যে আনন্দ, ভাষায় প্রকাশ করা যায় না! ধন-দৌলত দিয়ে অনেক সুখ-সম্পদ কেনা যায় কিন্তু এই মুহূর্তের এই অনুভব কোনও মূল্যের বিনিময়েই আহরণ করা যায় না।

হঠাৎ নতুন এক আবিষ্কারের আনন্দে বদরের বুকে তোলপাড় শুরু হয়। জামানের দেহের জাগ্রত হয়ে ওঠে। বদর ভাবে এবার নিশ্চয়ই সে জেগে উঠবে, চোখ খুলবে। কিন্তু না, জামানের শরীর সাড়া দিলেও ঘুম তার ভাঙে না। বদর ক্ষুব্ধ হয়, নিজের উপরই রাগ হয়। তারই দোষ! এ ব্যাপারে একেবারেই সে আনাড়ী। তাই সে জামানকে জাগাতে পারছে না। অথচ নিজেকেই সে আর ঠিক রাখতে পারছে না। জামানকে জড়িয়ে ধরে সে শুয়ে পড়ে। গালে ঠোঁটে ঘাড়ে বুকে চুমুতে চুমুতে ভরে দিতে থাকে। তারপর কোথা দিয়ে কি হয়ে যায় কিছুই বুঝতে পারে না বদর। কে যেন জোর করে তুলে জামানের দেহের ওপর তাকে বসিয়ে দেয়। দু’হাত দিয়ে জামানের দেহটা জাপটে ধরে। তারপর সে কি ঝড়ের প্রচণ্ড তাণ্ডব। বন্দরের সারা শরীর ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের ঢেউ-এর মতো উত্থাল পাথাল হতে থাকে। অস্ফুট আর্তনাদ করে ওঠে বন্দর, বাঁচাও বাঁচাও, আমি শেষ হয়ে গেলাম

এই সময় রজনী অতিক্রান্ত হতে থাকে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

পরদিন একশো পচাশিতম রজনীতে সে শুরু করে :

ডগমগ হয়ে উঠলো, দানাশের মুখ চুন। বললো, আমি হেরে গেছি, মাইমুনাহ, তোমারই জিৎ হলো। মেয়েদের ধৈর্য বলে কোন পদার্থ নাই, ছোঃ।

মাইমুনাহ হেসে গড়িয়ে পড়ে।–আহা রাজকুমারীর কি দোষ! আমার শাহজাদার মতো অমন সুন্দর সুরৎ দেখলে কোন মেয়ে চরিত্র ঠিক রাখতে পারে, শুনি?

কশাকশকে অনেক সুক্ৰিয়া জানালো মাইমুন্নাহ, তোমার পরামশেই এত বড় তর্কের ফয়সালা হয়ে গেলো। যাক, এবারে তোমরা দুজনে রাজকুমারীকে তার প্রাসাদে আবার শুইয়ে দিয়ে এসো।

দানাশ আর কশকশ পালঙ্কের দিকে এগিয়ে যায়। রাজকুমারী বদর তখন কাম-ক্লেদ মুক্ত জামানের বুকের ওপর দেহখানা এলিয়ে দিয়ে অঘোর ঘুমে অচেতন। দানাশ বন্দরে কাঁধে তুলে নেয়। জানিলা দিয়ে বেরিয়ে নিঃসীম নীল আকাশ পথ ধরে বায়ুবেগে উড়ে চলে তারা চীনের দিকে। অল্পক্ষণের মধ্যে সম্রাট ঘায়ুরে প্রাসাদে যথাস্থানে বদরকে শুইয়ে দিয়ে নিজের নিজের ডেরার পথে পাডি দেয়। তারা।

মাইমুনোহও শাহজাদার গালে একটা চুমু একে দিয়ে নিজের কূপে গিয়ে ঢোকে।

ভোরেই ঘুম ভেঙে যায় কামার আল-জামানের। গত রাতের সব কথাই তার স্মরণে আছে। কিন্তু মেয়েটি কোথায় গেলো। ঘরের এদিক ওদিক সে খুতে থাকে। কিন্তু না, কোথাও নাই। এ-ও কি তার বাবার একটা কৌশল? যাইহোক, আজই আব্বাজনকে শাদীর কথা বলবে সে।

দরজা খুলে দেখে প্রহরীরা নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। জামান রাগে ফেটে পড়ে, এই ব্যাটা বান্দরগুলো, তোদের কি নাক ডাকাবার জন্যে রাখা হয়েছে? পাজী বদমাইশ কোথাকার।

শাহজাদার হুঙ্কারে ধড়মড় করে উঠে বসে সকলে। কেউ জলের গামলা কেউ তোয়ালে নিয়ে এসে দাঁড়ায়। হাত-মুখ ধুয়ে রুজু করে নামাজ সেরে নেয়। তারপর কোরান খুলে পাঠ করতে থাকে।

কোরানের কয়েকটা স্তবক পাঠ করে সে উঠে পড়ে। খানসামা এসে নাস্তা সাজিয়ে দেয়। জামান নির্বিকারভাবে জিজ্ঞেস করে, মেয়েটা কোথায় গেছে, সাব্বাব।

–মেয়েটা? কোন মেয়েটা হুজুর?

সাব্বাব কিছুই আঁচ করতে পারে না। জামান ক্ষেপে যায়, ন্যাক চৈতন, যেন কিছুই জানে না। যা জিজ্ঞেস করছি সাফ সাফ জবাব দাও।

শাহজাদার কণ্ঠ গর্জে ওঠে। সাকবাবা ভয়ে জড়সড় হয়ে কোরবানীর খাসীর মতো একপাশে জোড় হাতে দাঁড়িয়ে থাকে।

–সেই মেয়েটা কোথায়? গতকাল রাতে আমার পালঙ্কে কে তাকে পাঠিয়েছিলো?

সাব্বাব কাঁপতে কাঁপতে বলে, খোদা কসম, আমি কোনও লেড়কীকে এ তল্লাটে দেখিনি, হুজুর। আর তাছাড়া আমি তো দরজার সামনে আড়াআডি হয়ে শুয়েছিলাম। আমাকে ডিঙিয়ে ঘরে ঢুকবে কার সাধ্যি!

জামান এবার ক্ষেপে বোম হয়ে যায়।–দেখো সাব্বাব, তুমি ভুলে যেও না। আমি শাহজাদা কামার আল-জামান, তোমার রসিকতার পাত্র নই। হতে পারো তুমি আমার বাবার বিশ্বস্ত নোকর। কিন্তু তাই বলে আমার সঙ্গে ধোঁকাবাজি করবে। সে আমি বরদাস্ত করবো না। এখন বলছি ভালোয় ভালোয় বলো সে কোথায়। না হলে কিন্তু আমার মাথায় খুন চেপে যাবে। তখন তোমার কোনও বাবা তোমাকে বাঁচাতে পারবে না। আমি বুঝেছি তারা তোমাকে শিখিয়ে পড়িয়ে রেখেছে। কিন্তু তাতে তুমি নিস্তার পাবে না। সাব্বাব। সত্যি কথা তোমাকে বলতেই হবে।

লোকটা এবার দু’হাত উপরে তুলে আল্লাহর উদ্দেশ্যে বলতে থাকে, খোদা, তুমি সাক্ষী, আমি কি শাহজাদার সঙ্গে মস্করা করছি? আপনি বিশ্বাস করুন হুজুর, আপনি কি যে বলছেন আমি কিছুই আন্দাজ করতে পারছি না।

-ওরে ভণ্ড, শয়তান, এ দিকে আয়।

সাব্বাবা ভয়ে ভয়ে শাহজাদার কাছে এগিয়ে যায়। প্রচণ্ড এক ঘুষি মেরে মেঝের ওপর ফেলে দেয়, এখনও বল, নইলে তোকে আস্ত রাখবো না।

সাব্বাব বলে, আমি কিছু জানি না হুজুর, কি করে বলবো? জামান ক্যাঁক করে একটা লাথি বসিয়ে দেয় ওর পেটে। বেচারা। এমনভাবে কঁকিয়ে ওঠে মনে হলো বোধ হয় পিলেটিলে ফেটে গেলো। জামান বলে চলে, তোকে কুয়োর জলে ডোবাবো। এই শীতের ঠাণ্ডা জলে কেমন আরাম বুঝবি।

কোমরে একগাছি রশি বেঁধে কুয়োর নিচে নামিয়ে চুবিয়ে দেয় ওকে। বেচারা সাব্বাব জলের মধ্যে খাবি খেতে থাকে। —দোহাই হুজুর, বাঁচান, মরে যাবো।

কিন্তু জামান-এর অবস্থা তখন ক্ষেপ কুকুরের মতো। বারবার ওকে জলের মধ্যে চুবাতে থাকে। —সে কোথায়। না হলে তোকে আমি আর তুলবো না।

সাকবাব ভাবলো শাহজাদা তাকে মেরেই ফেলবে। মরিয়া হয়ে চিৎকার করতে লাগলো, আপনি আগে আগে আমাকে ওপরে তুলুন, হুজুর, তারপর আমি সব বলছি।

–হুম, সোজা পথে এসো।

এবার জামান ওকে ওপরে তুলে আনলো। বুড়ো সাব্বাব তখন ঠক ঠক করে কাঁপছে। সারা শরীরের এখানে ওখানে ছড়ে গেছে। কুয়োর পাটেবাড়ি খেয়ে দুটো দাঁত ভেঙে গেছে। নাকটা কেটে গিয়ে গলগল করে রক্ত ঝরিছে। কামার আল-জামান কেমন আড়ষ্ট হয়ে যায়। রাগটা কিছুটা প্রশমিত হয়ে আসে।

—যাও, জামাকাপড় ছেড়ে ওষুধপত্র লাগিয়ে এসো।

শাহজাদার সামনে থেকে সে প্রায় ছুটে পালায়। আর কোথাও না গিয়ে সোজা সুলতানের সামনে হাজির হয়। সেই সময় সুলতান শাহরিমান উজিরকে বলছিলেন, কাল সারাটা রাত বড় খারাপ কেটেছে উজির। এক ফোটা ঘুমাতে পারিনি। খালি এদিক থেকে ওদিক পায়চারী করে বেডিয়েছি। বারবার একটা কথাই মনের মধ্যে নাড়া দিয়েছে, আমার কলিজা-জামান, না জানি কত কষ্টে, ঐ পোড়ো প্রাসাদের নোংরা ঘরে রাত কাটাচ্ছে। কিছুতেই মনকে প্রবোধ দিতে পারিনি।

উজির বলে, আপনাকে তো আমি বলে গিয়েছিলাম, জাঁহাপনা, কোনও দুশ্চিন্তা করবেন না। আপনার প্রাসাদে যে সুখে তিনি থাকেন তার চেয়ে কম আরামে তাকে রাখা হয়নি।

এই সময় সাকবাব এসে সুলতানের পায়ের কাছে আছাড় খেয়ে পড়ে। —জাঁহাপনা সর্বনাশ হয়ে গেছে।

সুলতান এবং উজির দুজনেই চমকে ওঠেন। কেন, কী হয়েছে, সাব্বাব?

–জী হুজুর, শাহজাদার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

–মাথা খারাপ হয়ে গেছে? কি করে বুঝলে।

—জাঁহাপনা, সাব্বাব কাঁদতে কাঁদতে  বলে, সকলে ঘুম থেকে উঠেই শাহজাদা হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, কাল রাতে আমার পালঙ্কে যে মেয়েটা শুয়েছিলো সে কোথায় গেলো?’ আমি যতই বলি এখানে কোন মেয়ে আসেনি-আসতে পারে না, ততই তিনি আমার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। আমি জেনেও তার কাছে ছুপিয়ে রাখছি মনে করে আমাকে মেরে পাট পাট করে দিয়েছেন তিনি। কোমরে দড়ি বেঁধে কুয়োর পানিতে নাকানি চোবানি খাইয়েছেন। এই দেখুন হুজুর আমার দু’খানা দাঁত ভেঙে গেছে। নাকটা কেটে চৌচির হয়ে গেছে।

সুলতান ভাবেন, তার আশঙ্কাই ঠিক হয়েছে। না জানি বাছা আমার কত কষ্ট পেয়েছে। উজিরের দিকে তাকিয়ে গর্জে ওঠেন। তিনি, তোমার মৌৎ এগিয়ে আসছে, উজির। তুমি একটা বদমাইশ শয়তান, কুকুর। তোমার দাওয়াই-এর ব্যবস্থা আমি করছি। তোমার বন্দ পরামর্শেই আমি তাকে আজ কয়েদ করেছি। নাও এখন মেহেরবানী করে গতিরখানা নড়াও। দেখো গিয়ে, বাছার আমার কি দশা হলো। চটপট খবর দেবে। আমি-বেশিক্ষণ ধৈর্য রাখতে পারবো না।

উজির আর কোনও কথাটি না বলে হন হন করে পোড়ো-প্রাসাদের চিলেকোঠার ঘরের দিকে ছোটে। পিছনে পিছনে অনুসরণ করে সাব্বাব। কোনও দিকে না তাকিয়ে উজির সোজা গিয়ে ঢোকে জামানের কামরায়। জামান তখন তন্ময় হয়ে কোরান পাঠ করছিলো। চোখ মুখ শান্ত, প্রসন্ন।

এইসময় রাত্রি শেষ হয়ে যাচ্ছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

জামানের পাশে গিয়ে উজির বলে, হতচ্ছাড়া সাব্বাবের কথা শুনে আমাদের প্রাণ তো খাঁচা ছাড়া। শয়তানের জাসু মিথ্যেবাদী কোথাকার! কি সব যা তা কথা বানিয়ে বলে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলো। যাক, বাবা তোমাকে দেখি স্বস্তি পেলাম।

জামান মৃদু মৃদু হাসে। কেন, কি বলেছে সে?

–সে তোমাকে বলতে পারবো না বেটা। বড় খারাপ কথা।

–তা শুনি না, কি এমন খারাপ, কি এমন মিথ্যে কথা সে বলেছে?

—ব্যাটা বলে কি-তোমার নাকি মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তুমি নাকি বলেছে, তোমার ঘরে কে এক মেয়ে এসেছিলো। সকালে তাকে দেখতে না পেয়ে সাব্বাবকে মারধোর করেছে—যত্ত সব আজগুবি কথা?

–আজগুবি হতে যাবে কেন? এ সবই তোমাদের ষড়যন্ত্র। আমি তোমাকে এখনও সাবধান! করে দিচ্ছি উজির, আমার সঙ্গে এইসব চালাকি বন্ধ করো। না হলে খুব খারাপ হবে। মেয়েটাকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছে এখনও সাফসাফ বাতাও না হলে তোমার কপালে অনেক দুখ আছে। আমি বুঝতে পেরেছি, আব্বাজানের সঙ্গে তোমরা স্যাট করে এইসব তামাশা করে যাচ্ছে। কিন্তু আমি আর এক দণ্ডও এসব বরদাস্ত করবো না। সাব্বাব-এর কপালে যা জুটেছে তোমার বরাতে তার চেয়েও খারাপ জুটবে।

উজির হতভম্ব হয়ে যায়। —খোদা হাফেজ, বেটা তুমি এসব কথা বলছ কেন? কি হয়েছে তোমার? আমার মনে হচ্ছে রাতে তোমার ভালো ঘুম হয়নি।–তাই এই সব আজগুবি স্বপ্ন দেখেছে। চারদিকে কড়া পাহারা, এটি কে আসতে পারে তোমার ঘরে—আর যদি এলেই তো সে গেলো : কোথায়? ওসব নিয়ে মাথা খারাপ করো না বাবা, ঘুমের ঘোরে ওরকম খোয়াব দেখা যায়। মাথা ঠাণ্ডা করো, এসব কথা বললে লোকে যে পাগল বলবে?

জামান গর্জে ওঠে, পাগল বলবে, কেন পাগলামীর কি করেছি আমি। পাগল যদি হই, তোমাদের মতো বেল্লিক শয়তানদের কারসাজিতেই হবো। কেন, আমি কি তাকে আমার এই চোখ দিয়ে দেখিনি? এই হাত দিয়ে তার শরীর স্পর্শ করিনি? তার দেহের খুশবু, আমি নাকে শুকিনি? কি—কি বলতে চাও তোমরা? আমি কি বুঝি না, এ সবই তোমাদের ইতরামী।

উজির হাসতে থাকে। কি যেন বলতে যায় কিন্তু তার আগেই জামানের প্রচণ্ড একটা ঘুষি এসে লাগে তার মুখে। বেচারী উজির টাল সামলাতে না পেরেছিটকে গিয়ে পড়ে মেঝের উপর।

–বদমাইশ, নচ্ছার, এখনও যদি জানে বাঁচতে চাস, বল সে কোথায়? উজিরের সাদা দাডির গোছা একহাতে ধরে অন্য হাতে বেদম পেটাতে থাকে জামান। বৃদ্ধ উজির নিজেকে ছাড়াবার বৃথাই চেষ্টা করে।–আমার সঙ্গে শয়তানী করে পর পাবে না। এখনও বলছি কোথায় তাকে লুকিয়ে রেখেছে, বলে? না হলে, ইহজন্মের সাধ তোমার ঘুচিয়ে দেব আজ।

এক নাগাড়ে বেদম প্রহার করতে করতে হাঁপিয়ে ওঠে জামান। বৃদ্ধকে মেঝের ওপর ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। যত্ত সব শয়তানের পাল্লায় পড়েছি। এরা আমাকে পাগল, না করে ছাড়বে না–?

উজির ভাবলো, শাহজাদার হাত থেকে রেহাই পাওয়া দুষ্কর। মাথাটা ওর একদম খারাপ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় কিছু বোঝাতে যাওয়া বোকামি। তাতে আরও সে ক্ষেপে যাবে। শেষে হয়তো বদ্ধ উন্মাদ হয়েও যেতে পারে।

–বাবা, তা হলে তোমাকে সত্যি কথাই বলি, উজির এক ফন্দী এটে বলতে থাকে, আমি তোমার বাবার মাইনে করা নোকর। তার নুন খাই, তাই তার অনুগত হয়ে কাজ করা আমার কর্তব্য। তুমি যে আমার ওপর এত ক্ষিপ্ত হয়েছে তার অবশ্য সঙ্গত কারণ আছে, আমি মানি। কিন্তু বাবা, আমি তো আজ্ঞাবহ দাস মাত্র, তোমার বাবা যা হুকুম করেছেন তার বাইরে আমি কি করতে পারি। যে-মেয়েটিকে কাল রাতে তুমি তোমার ঘরে দেখেছিলে, তোমার বাবার কথামতো, আমিই তাকে তোমার ঘরে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু ব্যাপারটা তিনি গোপন রাখতে বলেছিলেন। তারও অবশ্য কারণ আছে। তিনি বুঝতে চেয়েছিলেন, মেয়েটি তোমাকে কতখানি মুগ্ধ করতে পেরেছে। তোমাকে কষ্ট দেওয়া বা ধোঁকাবাজি করা তার উদ্দেশ্য নয়। তিনি যদি জানয়তে পারেন, মেয়েটিকে তোমার পছন্দ হয়েছে, তা হলে খুশি হয়ে শাদী দিয়ে দেবেন। তুমি শাদী করে সংসারী হও, এই তো তার একান্ত ইচ্ছা। আর সেইটে জানিবার জন্যই তিনি আমাকে তোমার কাছে পাঠিয়েছেন। আমার আর বুঝতে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না বাবা, মেয়েটি তোমাকে মুগ্ধ করেছে। তুমি তাকে আপন করে নিতে চাও। বেশ তো কোনও অসুবিধা নাই, এতো মহা আনন্দের কথা। সুলতানও এই-ই চান, আজই এক্ষুণি আমি তার কাছে সব বিবরণ জানাচ্ছি। তুমি নিশ্চিন্ত থাকে, ঐ মেয়ের সঙ্গেই তিনি তোমার শাদী দিয়ে দেবেন।

এই ওষুধে কাজ হলো। জামান রাগত ভাবেই উজিরকে তাড়া মারে, জলদি যাও আব্বাজানের কাছে। এক্ষুণি তার কাছ থেকে কথা নিয়ে এসো। আমি তোমার জন্যে দাঁড়িয়ে রইলাম।

উজির আর তিলমাত্র অপেক্ষা না করে ঘর থেকে বেরিয়ে সটান সুলতানের প্রাসাদে চলে আসে। আসার আগে সাব্বাবকে ইশারা করে নজরে নজরে রাখতে, যেন ছুটে কোথাও বেরিয়ে না যায়।

মাথার টুপি ছিটকে কোথায় পড়ে গেছে, এলোমেলো, দাডির কিছু ছিড়ে-উপড়ে গেছে, সাজপোশাক দুমড়ে-কুঁচকে একশা। ঝোড়ো কাকের মতো চেহারা নিয়ে উজির গিয়ে হাজির হয় সুলতানের সামনে! সুলতান অবাক হয়ে উজিরের আপাদমস্তক দেখতে থাকেন।—কী ব্যাপার? কী হয়েছে, উজির? তোমার এ দশা কে করলো? মাথার টুপি কোথায়? মনে হচ্ছে, সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটেছে!

-আমার আর এমন কি হয়েছে জাঁহাপনা? এর চেয়ে হাজার গুণ মারাত্মক ব্যাপার হয়েছে আপনার পুত্র জামানের।

—কি রকম?

—একেবারে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে সে।

—উন্মাদ। বলো কি উজির? এই একটা রাতের মধ্যে এমন মারাত্মক ব্যাপার ঘটে গেছে।হায় হায়, একি হলো আমার। কেন, আমি তোমার মতো একটা উলুকের কথায় নেচে উঠলাম। কি করে বুঝলে, সে পাগল হয়ে গেছে?

—তার আবোল-তাবোল কথাবার্তায় হুজুর। তার ধারণা গতকাল রাতে আমি আর আপনি যুক্তি করে তার ঘরে একটা মেয়েকে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। মেয়েটি নাকি সারারাত তার শয্যাতেই ছিলো। তাকে তার বেশ মনেও ধরেছে। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে তাকে ঘরে দেখতে না পেয়ে প্রথমে সাকবাব-এর ওপর হাম্বিতম্বি করে। কিন্তু সে বেচারী কি বলবে, শেষে তাকে বেদম প্রহার করে কুয়োর জলে চুবিয়ে দেয়। তারপর আমি গেলাম। আমাকে দেখেই সে রেগে কঁই। তার ধারণা, নাটের গুরু আমি। আমার পরামর্শেই মেয়েটিকে সকাল হবার আগেই ঘর থেকে সরিয়ে কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়েছে। তাই, আমার বরাতেও কিছু সিন্নি জুটে গেলো।

সুলতান রাগে ফেটে পড়েন, এ আর তোমার কি হয়েছে, উজির, আমি তোমাকে ক্রুশে গেঁথে মিনারের মাথায় ঝুলিয়ে রাখবো। আমার একমাত্র সন্তান, জানের কলিজা, তার যদি কোনও অনিষ্ট হয় তার জন্য তুমিই একমাত্র দায়ী। আমি রেহাই দেব না। এখন চলো, আমি নিজে তাকে একবার দেখি।

হন হন করে পোড়ো প্রাসাদের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন সুলতান। পায়ে পায়ে উজির। কামার আল-জামানের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই অত্যন্ত শান্ত বিনয়ী সুবোধ ছেলের মতো সে এগিয়ে এসে বাবার হাতে চুম্বন করে অবনত মস্তকে করজোড়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

সুলতান সস্নেহে জামানকে বুকে জড়িয়ে ধরে কপালে, চোখে, গালে চুমু খেলেন।

তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে, বেটা, চলো, পালঙ্কে বসা যাক।

সুলতান নিজে বসলেন, জামান বাবার কাছে একাসনে বসতে ইতস্ততঃ করছিলো, হাতে ধরে পুত্রকেও পাশে বসালেন। দাঁত কড়মড় করে উজিরের দিকে অগ্নিবান হেনে বললেন, উজির, তুমি যে কত বড় একটা মিথ্যেবাদী তা নিজের চোখেই একবার দেখো, আমার হীরের টুকরো ছেলে, কত নম্র, কত ভদ্র, বিনয়ী, আর তুমি বলে কিনা—সে যাক তোমার ব্যবস্থা আমি পরে করছি।

জামানের দিকে ফিরে মুখে মধু ঢেলে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা, বেটা, আজ যেন কি বার?

জামান বললো, আজ শনিবার আব্ববাজান?

–কাল কি বার বাবা?

–কেন, কালি রবিবার?

জামান অবাক হয়। হঠাৎ আব্বাজান আজ এই ধরনের প্রশ্ন করছেন কেন? মনে পড়ে খুব ছোটবেলায় যখন সে সবে প্রথম ভাগ পড়ছে, রাতে শুয়ে শুয়ে বাবা তাকে এই ধরনের নানা প্রশ্ন করে বুদ্ধির পরীক্ষা করতেন। কিন্তু আজ কেন এই সব প্রশ্ন? হঠাৎ সে বুঝতে পারে। উজিরটা তাঁকে বুঝিয়েছে, তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। জামানের মুখে মৃদুহাসির রেখা ফুটে ওঠে। বলে, পরশু সোমবার, তরঙ্গু মঙ্গল, তারপর দিন বুধ, তারপর দিন বৃহস্পতিবার। আর তারপর দিন শুক্র, আমাদের নামাজের দিন পবিত্র জুম্মাবার।

সুলতানের মুখে গর্বের হাসি; উজিরের দিকে কটাক্ষ হেনে বলেন, শুনলে উজির, এর পরেও তোমার কোনও সংশয় আছে?

এই সময় রাত্রি শেষ হয়। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

একশো অষ্টাশিতম রজনীতে আবার সে শুরু করে :

সুলতান আবার জামানকে প্রশ্ন করেন, আচ্ছা বেটা, আরবী হিসাবে এটা কোন মাস?

–জেলকদ, পরের মাস জেলহিজ্জা, পরে মহরম, শসার, পরে রবিউল আউয়ল, রবিয়স্বাসি, তারপর জামাদ আউয়ল, জামাদ শ্বাসি, রজব, শ্বাবন, রমজান, শ্বওয়াল।

সুলতান আনন্দের চোটে উজিরের গালে ছোট্ট একটা ঠোনা মারেন, দুনিয়াতে যদি বদ্ধ পাগল কেউ থাকে—সে তুমি নিজে। বাহাত্তর পেরিয়ে গেছে, এবার তোমার ভীমরতি ধরেছে। শাহ-দরবার তোমার জায়গা নয় উজির। এবার মক্কা-মদিনায় গিয়ে আল্লাহর নাম গান করো।

এরপর সুলতান কামার আল-জামানের দিকে চেয়ে বলেন, বেটা তোমার নামে এই বেহেড উজিরটা কি সব যা-তা বলেছে, জানো? তুমি নাকি ঐ বান্দরমুখো কালো কুৎসিত হতচ্ছাড়া সাব্বাব আর এই বাহাতুরে বুড়ো উজিরটাকে বলেছে, গতকাল রাতে তোমার ঘরে নাকি একটা খুবসুরৎ লেড়কী ঢুকেছিলো। এবং তাকে নিয়েই তুমি সারারাত কাটিয়েছে। সকালবেলায় তাকে দেখতে না পেয়ে তুমি নাকি সাব্বাব-এর ওপর চোটপাট করেছে, মারধোর করেছে, কুয়োর জলে চুবিয়েছে। শুধু সাব্বাব নয় উজিরকেও নাকি তুমি এই কারণে পিটিয়েছে। এমন সব ডাহা মিথ্যেবাদী ওরা-আমি ওদের এমন সাজা দেব, বুঝতে পারবে হাড়ে হাড়ে।

কামার আল-জামানের মন বিষিয়ে ওঠে। —আব্বাজান এই ব্যাপারটা নিয়ে অনেক লেবু কচলাকাচলি হয়ে গেছে। এই ধরনের তামাশা আর আমার ভালো লাগছে না। এত দিন। আপনি খারাপ ধারণা ছিলো, সেজন্য আজ আমি লজ্জিত। দোহাই আব্ববাজান, আপনি আমাকে যথেষ্ট শিক্ষা দিয়েছেন, আর কষ্ট দেবেন না। আমি আর আপনার অবাধ্য হবে না। গতকাল রাতে যে মেয়েটিকে আপনি আমার বিছানায় পাঠিয়েছিলেন তাকে দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। আপনি আমাকে ঐ মেয়ের সঙ্গে শাদীর ব্যবস্থা করুন, আমি আজই তাকে শাদী করতে চাই। তাকে দেখা অবধি আমি অস্থির হয়ে পড়েছি। এক মুহূর্ত তার আদর্শন আর সইতে পারছি না। সে আমার সারা দিল জুড়ে বসেছে। তাকে ছাড়া আমি আর একটা দিনও বাঁচতে পারবো না। মেয়েদের সম্বন্ধে যে সব উক্তি আমি করেছি, সেজন্য লজ্জিত, অনুতপ্ত। আপনি আমাকে ক্ষমা করুন আব্ববাজান। আর দেরি করবেন না, আজই শাদীর ব্যবস্থা করুন।

ছেলের এসিব কথা শুনে সুলতান চিৎকার করে ওঠেন, ইয়া আল্লাহ, একি করলে তুমি! আমার একটিামাত্র ছেলে, সবোধন নীলমনি, তার একি দশা করলে? আমি বাঁচবো কি নিয়ে?

ছেলেকে উদ্দেশ্য করে সুলতান বলতে থাকেন, খোদা তোমার মঙ্গল করবেন। বাবা। তিনি তোমার উন্মাদ দশা নিশ্চয়ই কাটিয়ে দেবেন। জীবনে সজ্ঞানে আমি কোনও অন্যায় করিনি। তবে কোন পাপে আমি এত বড় শাস্তি ভোগ করবো? নিশ্চয়ই তোমার ঘাড়ে কোন শয়তান ভর করেছে। তিনি রক্ষা করবেন তা থেকে। কাল রাতে কি তোমার খানাটা খুব বেশি হয়ে গিয়েছিলো। গুরুপাক জিনিস পেটে পড়েছিলো বোধ হয়। তাই হজম হয়নি। রাতে বদহজম হলে এই রকম বিদঘুটে খোয়াব দেখে অনেকে। যাই হোক আমার ধারণা তোমার এই মাথার গোলমালটা নেহাতই সাময়িক। মন থেকে রাতের ঐ স্বপ্নের ব্যাপারটা একেবারে মুছে ফেলো। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। যাই হোক, আমি কথা দিচ্ছি, আর তোমার ওপর কোনও জোর জুলুম করবো না। তোমার ইচ্ছে হয়। বিয়ে শাদী করবে, না ইচ্ছে হয় করবে না। দরকার নাই আমার নাতির মুখ দেখে। ছেলেকে খুইয়ে আমি নাতি পেতে চাই না। ভবিষ্যতে আমি আর নিজে থেকে কখনও শাদীর কথা বলবো না, বাবা। শুধু তুমি নিজেকে একটু শান্ত করো।

কামার আল-জামান প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, আপনাকে আমি দুনিয়ার সব থেকে বেশি ভালোবাসি, ভক্তি করি। আপনিও আমাকে এই কথা বলছেন, আব্বাজান। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। তবুও আপনি আল্লাহর নামে কসম খেয়ে আর একবার বলুন, গতকাল রাতে আমার শয্যায় যে মেয়েটি গিয়েছিলো, সে সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন না। তারপর আমি প্রমাণ দেব, কালরাতে আমার ঘরে কোনও মেয়ে এসেছিলো কি না।

সুলতান বললে, আল্লাহর নামে কসম খেয়ে বলছি, বাবা এ রকম কোনও কাজ আমি করিনি।

জামান তখন বললো, গতকাল শেষরাত্রে যখন আমার ঘুম ভেঙে যায়। সেই দুটি সময় আমি আধা, ঘুমন্ত অবস্থায় বেশ বুঝতে পারছিলাম একটি মেয়ে আমার শরীরের ওপরে উথালি পাথাল করছে। তখন আমার এমন অবস্থা নয় যে ঘুম থেকে উঠে পড়ে। যাই হোক সকাল বেলায় যখন ঘুম ভাঙলো দেখি আমার তলপেটের নিচে বেশ খানিকটা রক্ত জমাট বেঁধে আছে। আপনার বিশ্বাস না হয় হামামে চলুন দেখবেন, আমি পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলেছি। এখনও সেখানে সেই রক্ত দেখতে পাবেন। তা ছাড়াও, এই দেখুন আমার হাতের এই আংটিটা। এটা নিশ্চয়ই আমার হাতে আগে কখনও দেখেন নি। ভালো করে লক্ষ্য করে দেখুন, আংটিটা কোনও মেয়ের হাতের। আর আমার এই আঙুলে যে হীরের আংটিটা ছিলো সেটা নাই।

সুলতান বললেন, তোমার কথা আমি মানছি, কিন্তু এই প্রমাণই তো যথেষ্ট নয়। এতেও যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়।

এই সময় রাত্রি শেষ হতে থাকে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

একশো নব্বইতিম রজনীতে আবার গল্প শুরু হয় :

সুলতান বললেন, ঠিক আছে, দাঁড়াও হামামে গিয়ে আমি নিজের চোখে দেখে আসি। সুলতান হামামে ঢুকে অবাক হয়ে গেলেন। যে জলের গামলায় জামান হাত মুখ ধুয়েছে তার মধ্যে ডেলা ডেলা রক্তের ছিট। সারা জলট রক্তে লাল হয়ে আছে।

–হুম, গভীর ভাবে সুলতান অস্ফুট স্বগতোক্তি করেন, মনে হচ্ছে, লড়াকু মেয়েটা বেশ তাগড়াই। এখন বুঝতে পারছি, ওই উল্লুক উজিরটারই এই কাণ্ড।

ছেলের কাছে ফিরে এসে বলেন, হাঁ, খুব চিন্তার ব্যাপার!

আর একটিও কথা বললেন না। সুলতান। ঠায় বসে বসে ভাবতে লাগলেন। প্রায় ঘণ্টাখানেক এইভাবে কাটে। তারপর উজিরের দিকে তাকিয়ে হুঙ্কার ছাড়েন। তিনি। — এ সব তোমার শয়তানী-উজির। তুমিই কাল রাতে কোনও মেয়েকে পাঠিয়েছিলে এ ঘরে।

উজির সুলতানের পায়ের ওপর আছাড় খেয়ে পড়ে, আপনি বিশ্বাস করুন জাঁহাপনা, আমি এক বিন্দু-বিসর্গ জানিনা। আল্লার নামে কসম খাচ্ছি, পবিত্র কেরাণ ছুঁয়ে হলফ করতে পারি, এ সবের কিছুই আমি জানি না।

সাব্বাবও সেই রকম একইভাবে কসম খেয়ে বললো, সে-ও কিছুই জানে না।

সুলতান এবারে দিশেহারা হয়ে পড়েন।–তা হলে একমাত্র স্বয়ং খোদাতালা ছাড়া এ রহস্যের জাল কেউ ভেদ করতে পারবে না।

জামান এবার সত্যিই প্ৰায় উন্মাদের মতো বললো, কিন্তু আব্ববাজান, সে মেয়েকে না পেলে এ জীবন আমি রাখবো না। যেমন করেই হোক তাকে খুঁজে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করুন। আমি তাকে না দেখে আর এক মুহূর্ত বাঁচবো না।

সুলতান অসহায় ভাবে বলে, কিন্তু বেটা তা কি করে সম্ভব। এত বড় বিশ্বসংসারে সেই অজানা অচেনা মেয়ের সন্ধান কি করে পাবো আমি। তুমি তার নাম জানো না, তার বংশ পরিচয় দিতে পারছে না, আন্দাজে কোথায় খুঁজে বেড়াবো তাকে? এখন একমাত্র আল্লাহ, তিনি সর্বজ্ঞ, একমাত্র ভরসা। তিনি যদি তোমার মনস্কামনা পূর্ণ করেন তবেই সব সমস্যার সমাধান হতে পারে। এখন তার ওপর সব ছেড়ে দিয়ে। হা হুতাশ করা ছাড়া আর আমাদের অন্য কোনও পথ নাই, বাবা। তোমার মনের ব্যথা আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু, এই বিশাল সলতানিয়তের অধিপতি হয়েও আমি আজ নিরুপায়। কি করে তার হদিশ করবো?

ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে সুলতান প্রাসাদে ফিরে আসেন। সারা প্রাসাদে বিষাদের ছায়া নেমে আসে। সুলতান এবং জামান কারো সঙ্গে দেখা করেন না। দরবারে সব কাজ কাম মুলতুবী রাখা হয়। পুত্রের ব্যথায় ব্যথিত সুলতান, কোনও কাজে মন দিতে পারেন না। কোথায় গেলে ছেলের মানসী প্রিয়ার সন্ধান পাওয়া যাবে কিছুই বুঝতে পারেন না।

প্রাসাদে নিজের কক্ষে পুত্র জামানকে নিয়ে তিনি বিষগ্লমানে দিন কাটাতে থাকেন। তার একমাত্র ভাবনা কি করে পুত্র জামানের মুখে হাসি ফোটানো যায়। কিন্তু না, দিন যায় সন্ধ্যা হয়, আবার ফিরে আসে সকাল, জামান বিরহে কাতর হয়ে পড়ে থাকে। শেষে প্রাসাদের পরিবেশও বিষময় মনে হয় তাদের।

দরিয়ার মাঝখানে সুলতানের এক বিলাস ভবন ছিলো। তীর থেকে সেতু বাধা ছিলো সেই প্রাসাদ পর্যন্ত। সুলতান ঠিক করলেন, পুত্রকে নিয়ে সেই নিরালা নির্জন প্রাসাদে গিয়ে দিন কাটাবেন। প্রাসাদের এই কোলাহল আর তার ভালো লাগছিলো না।

কিন্তু সেই অনিন্দ্য সুন্দর প্রমোদ প্রাসাদে গিয়েও জামান এতটুকু সান্ত্বনা পায় না। দিনে দিনে সে আরও বেশি বিষাদগ্বস্ত হয়ে পড়ে।

এ দিকে দানাশ এবং কশকশ রাজকুমারী বন্দরকে তার শয্যায় শুইয়ে রেখে আসার ঘণ্টাদুই বাদে সকাল হয়। বদরের ঘুম ভাঙে। চোখ মেলে তাকায়। দারুণ খুশি খুশি ভাব। মুখে মৃদু হাসি। গত রাতের সুখ-সম্ভোেগ তাকে মোহিত করে রেখেছে। বিছানার পাশে চোখ ফেরালো, ভুরু দুটো কুঁচকে এদিক ওদিক খুঁজতে থাকে—কোথায় গেলো সে। তখনও ভালো করে ঘুমের ঘোর কাটেনি তার। আবার চোখ বন্ধ করে। দু’হাত দিয়ে কি যেন হাতড়াতে থাকে। কিন্তু না, সে তো শয্যায় নেই। তবে, এই ভোরে গেলো কোথায়? এ ঘর থেকে বেরুবার তো কোনও উপায় নাই! অজানা আশঙ্কায় তার অন্তরাত্মা শুকিয়ে যায়। দিশাহারা হয়ে চিৎকার করে ওঠে। প্রধান বাঁদী ছুটে আসে। না জানি রাজকুমারীর কি বা হয়েছে। —কী হলো, মালকিন, আমন করে চেঁচালেন কেন? স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়েছেন?

এই সময় রাত্রি অবসান হয়। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পরদিন একশো একানব্বইতিম রজনী :

আবার সে শুরু করে : বদর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, ন্যাকামি করছো? তুমি জানো না কেন আমি চিৎকার করছি। সাফ সাফ বলো, কাল রাতে আমার পাশে যে ছেলেটা শুয়েছিলো সে কোথায়? ওফ, কী তার রূপ, কী তার পৌরুষ-আমাকে সে একটা রাতে যা দিয়েছে সারা জিন্দগীভর কেউ তার দিতে পারবে না। যাক ওসব কথা শুনে তোমার কাজ নাই। এখন বলে তাকে আবার কোথায় নিয়ে গেছো।

বদরের কথা শুনে বুড়ি বঁর্দীর চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়, কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বলে, ইয়া আল্লা, একি কথা বলছেন, রাজকুমারী? এমন অসৎ আলুক্ষণে কথা মুখে আনা পাপ। এতকাল আমি আপনার বাঁদীগিরি করছি, কোনও দিন তো এ মতিভ্বম আপনার হয়নি রাজকুমারী? না না, আপনি আমার সঙ্গে মস্করা করছেন, তাই না?

বদর বিছানার ওপরে ভর দিয়ে হাতের তালুতে মাথা রেখে আধশোয়া অবস্থায় বুড়ি বঁর্দীর দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি ছুঁড়ে বলে, দেখো বুড়ি, তোমর কপালে আজ অনেক দুঃখ আছে। আমাকে তুমি চেনো না? আমার রাগ কখনও দেখোনি? এখনও লক্ষ্মী মেয়ের মতো সত্যি কথা বলো। কাল রাতে সে আমাকে বেহেস্তের সুখ দিয়েছে। আমি আমার এতকালের যত্ন-ললিত এই দেহ-রূপযৌবন সব তার হাতে তুলে দিয়েছি। সে এখন আমার ভালোবাসা। তাকে ছাড়া মুহূর্ত আমি থাকতে পারবো না। বলে সে কোথায়?

বুড়ি-বাদী চোখে সর্ষে ফুল দেখতে থাকে। মনে হয়। সারা প্রাসাদটা জুলছে। বুঝিবা এখুনি হুড়মুড় করে সব ধসে পড়বে। নিজের কানকে সে বিশ্বাস করতে পারে না। এ সব কী কথা শুনলো সে। আবার নিজের কপাল চাপড়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো, ওগো, আমার কী হলো গো, এমন সব্বোনাশ কে করলো গো। হায় আল্লাহ, একি করলে তুমি!

তার চেঁচামেচি চিৎকারে হারেমের অন্যান্য দাসী বাঁদীরা সব ছুটে আসে। রাজকুমারীর মাথা খারাপ হয়ে গেছে শুনে তারাও হা-হুতাশ করে চোখের জল ফেলতে থাকে।

রাজকুমারী এবার বাঘিনীর মূর্তি ধারণ করে। —দাঁড়াও তোমাদের সন্ট করে শয়তানী আমি ভেঙে দিচ্ছি। সবগুলো এক গোয়ালের গরু। হাড়ে হাড়ে বজাৎ। কিন্তু এখনও শোনো বলছি, আমার মেহেবুবকে এখুনি নিয়ে এসো। না হলে তোমাদের সবাইকে আমি কুকুর দিয়ে খাওয়াবে।

দাসী বাঁদীরা শিউড়ে ওঠে, কিন্তু রাজকুমারী, এ-কথা সম্রাটের কানে গেলে কি কাণ্ড হবে। বলুন, দেখি। আমাদের যেমন গর্দান যাবে, সেই সঙ্গে আপনাকেও কোতল করে ফেলবে।

এ—সব কথা এমন করে চাউর করা কি ভালো হচ্ছে মালকিন?

—ওসব ছেদো কথা আমি শুনতে চাই না, রাজকুমারী বদর কঠিন কণ্ঠে বলতে থাকে, আমার চোখের মণি, দিল-কা-পিয়ারাকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছে বলে। কাল রাতে তার সঙ্গে আমি যে এক বিছানায় রাত কাটিয়েছি তার প্রমাণ আমার শরীরে এখনও জুলজুলি করছে।

বুড়ি বাঁদী হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো, হায় আল্লাহ একি হলো, আমার সোনার বাছার মাথা খারাপ হয়ে গেলো? এযে একেবারে বদ্ধ পাগলের প্রলাপ বকছে সে। এখন আমি কি করি। তখনই বলেছিলাম, মেয়েছেলে সোমখ হলে শাদী দিয়ে দিতে হয়। তা না হলেই যত বিপত্তি। এখন এই ঠ্যােলা কে সামলাবো? সম্রাটের কাছে কে জানাবে এই দুঃসংবাদ। যে বলতে যাবে, তারই তো গর্দান যাবে সঙ্গে সঙ্গে।

বদর এবার ক্ষেপ কুকুরের মতো তেড়ে যায়, তবে রে শয়তানী? আমার সঙ্গে মস্করা করা হচ্ছে। আমি তোর ইয়ার্কির পাত্রী?

ছুটে গিয়ে দেওয়ালে টাঙানো ঢাল-তলোয়ারের একখানা পেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে মারে। দাসী-বাদীরা আঁতকে ওঠে। আর একটু হলেই দু-এক জনের জান খতম হয়ে যেত। ভাগ্যে তারা ছিটকে সরে যেতে পেরেছিলো। তাই রক্ষে।

রাজকুমারী বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে—এই সংবাদ সারা প্রাসাদে মৃত্যু সংবাদের মতোই মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়লো। সম্রাট ঘায়ুরেরও কনে পৌঁছতে বেশি দেরি হলো না। তিনি তৎক্ষণাৎ হারেমের তাবৎ দাসী বঁটী খোজদের তলব করলেন। বুড়ি বাঁদী সাশ্রু নয়নে আদ্যোপোন্ত সবিস্তারে সব বর্ণনা দিল। ঘায়ুর শুনে স্তম্ভিত হলেন। এক রাতের মধ্যে এমন অনাসৃষ্টি কাণ্ড কি করে ঘটতে পারে, তিনি কিছুই ভাবতে পারেন না। শুধু চিন্তিতভাবে একটি কথাই বলতে পারলেন, ভয়ঙ্কর কথা!

বুড়ি-বাদী বললো, সে যে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে তাতে আর কোনও সন্দেহ নাই। তলোয়ার ছুঁড়ে আমাদের খতম করতে চেয়েছিলো, বরাতজোরে বেঁচে গেছি।

ঘায়ুর এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেন না, চিৎকার করে প্রাসাদ ফাটিয়ে দিতে চান। —তুমি যে সব কথা বলছে, তা কি সত্যি?

—এক বৰ্ণও মিথ্যা নয় হুজুর।

–বড় সাংঘাতিক কথা, কিন্তু কি করে হলো? আর বদর যা বলছে তার সবটাই কি পাগলামী?

সম্রাট মহানুভব, প্রথমে আমার তাই মনে হয়েছিলো। কিন্তু পরে যা দেখেছি তাতে আমার মনেও খানিকটা দ্বিধা এসেছে।

সম্রাট উত্তেজিত অধৈৰ্য হয়ে কৈফিয়ত তলব করেন, কি দেখেছে, বলে। হুজুর, আজ সকালে যখন রাজকুমারী ঘুম থেকে জেগেছেন, তার পরেই তার চিৎকারে আমি ঘরে ছুটে যাই। তখন তিনি মাত্র একটি শেমিজ পরেছিলেন। রোজ রাতে শোবার সময় এই পোশাকেই তিনি শুয়ে থাকেন। দেহের নিচের অংশ একেবারে নগ্ন থাকে। আমি দেখেছি, তার জঙ্ঘার দু’পাশে শুকনো রক্তের ছোপ-উরু পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। এ দৃশ্য আমার কাছে নতুন। আপনি সম্রাট, আমার কাছে মেয়েদের এসব ব্যক্তিগত ব্যাপার খুলে বলা সম্ভব না। তবে জেনে রাখুন। এ ধরনের রক্তপাত, স্বাভাবিকভাবে হয় না। কোনও পুরুষ-সঙ্গ ছাড়া হতে পারে না। কিন্তু তাও একেবারে অসম্ভব। প্রাসাদের যা কড়া পাহারা—তাদের চোখে ধুলো দিয়ে কোন কাক-পক্ষীরও হারেমে ঢোকা সম্ভব নয়।

সম্রাট ঘায়ুর উত্তেজনায় কাঁপতে থাকেন, তাজ্জব ব্যাপার! সম্রাট আর তিলমাত্র দেরি না করে কন্যা বদরের মহলে ছুটে এলেন। কন্যাকে সস্নেহ চুম্বন দিয়ে বললেন, মা

জননী, এইসব দাসী-বাদীরা তোমার নামে কী সব বলছে! আমি ওদের সর্প শূলে চাপাবো।

— কেন বাবা, কি বলেছে তারা?

—ওরা বলেছে, কাল রাতে নাকি তোমার ঘরে কোন এক অচেনা অজানা যুবক ঢুকেছিলো! তুমি নাকি তাকে গ্রহণ করেছো, এক বিছানায় রাত্রিবাস করেছো তোমার নামে এ-সব অপবাদ আমি কিছুতেই সহ্য করবো না মা। আমি ওদের শূলে দেব। শুধু একবার বলো, সব মিথ্যে।

—মিথ্যে? মিথ্যে কেন হতে যাবে বাবা। এর চেয়ে বড় সত্যি আজ আর আমার জীবনে কিছু নাই, বাবা! আমি এতকাল পুরুষ বিদ্বেষী ছিলাম। তার কারণ, যে সব পত্র আপনি হাজির করেছিলেন তাদের কাউকেই আমার যোগ্য বলে মনে হয়নি। কিন্তু কাল রাতে যে অপূর্ব সুন্দর ছেলেটিকে আমার ঘরে পাঠিয়েছিলেন, তার জুড়ি বিশ্ব সংসারে নাই। সেদিক থেকে আপনার পছন্দের তারিফ করছি বাবা। আমি কাল রাতেই তাকে আমার দেহ-মন সব সঁপে দিয়েছি। এখন আমার আর কোনও অমত নাই। তার সঙ্গে আমার শাদীর ব্যবস্থা করুন। আমি শাদী করবো। বাবা, তাকে যদি আমার ঘরে পাঠালেন। তবে ভোর না হতেই আবার তাকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন কেন? সে যে আমার, সে যে আমার নয়নমণি-তাকে আমি সব দিয়েছি। সেও আমাকে মনে প্ৰাণে গ্রহণ করেছে। এই দেখুন, তার প্রমাণ। সে আমাকে তার হাতের আংটি পরিয়ে দিয়েছে।

সম্রাট ঘায়ুর মাথায় হাত দিয়ে বসলেন, মা, তুমি সত্যিই উন্মাদ হয়ে গেছে। ওরা ঠিক কথাই বলেছে। কিন্তু কি করবো, ঈশ্বর যা চান তাই হবে। যাক, তুমি আর ওসব নিয়ে মাথা ঘামিও না। আমি তোমার ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা করছি।

বাবার কথা শুনে বদর ক্ৰোধে ফেটে পড়ে। নিজের সাজপোশাক ছিঁড়ে খুঁড়ে টুকরো টুকরো করতে থাকে। ঘায়ুর ভাবলেন, পাগল হলে কোনই কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। হয়তো সে তার প্রাণটাই শেষ করে দিতে পারে। দাসী বাদীদের হুকুম করলেন, রাজকুমারীকে ধরে। জোর করে ওকে শুইয়ে দাও; যেন সেনা ওঠে। লক্ষ্য রাখবে। আর যদি দেখো, তাকে সামলানো যাচ্ছে না, সোনর শিকর দিয়ে তাকে জানলার গরাদের সঙ্গে বেঁধে রাখবে। কোনও ক্রমেই যেন সে ছুটে না যায়।

ঘায়ুর দরবারে ফিরে গেলেন। তার একমাত্র সন্তান, নয়নের আলো—সে আজ পাগল হয়ে গেলো! কি হবে এই সাম্রাজ্যে? কিসের প্রয়োজন এত বিত্ত বৈভবের? কান্নায় রুদ্ধ হয়ে আসে। কণ্ঠ। হায় ঈশ্বর একি ভয়ঙ্কর শাস্তি দিলে তুমি, কি আমার অপরাধ?

দরবারে গণমান্য অমাত্য পরিষদদের ডেকে পাঠালেন। তাদের সঙ্গে একটা পরামর্শ করা দরকার। এই অন্ধকারাচ্ছন্ন বিপদের দিনে কেউ যদি আলোর রেখা দেখাতে পারে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই শহরের গণমান্য সম্রান্ত ব্যক্তি, হেকিম বদ্যি, গণৎকার সব হাজির হলেন। সম্রাট তাদের কাছে সব খুলে বললেন।

—এখন সে বদ্ধ উন্মাদ। তবে আমার বিশ্বাস এ রোগ সারানো সম্ভব। তোমাদের মধ্যে যদি কেউ তার এই ব্যধি সারাতে পারো আমি তার হাতেই তুলে দেব আমার প্রতিমা বদরকে। তার সঙ্গে ছেড়ে দেব আমার এই সিংহাসন-বিশাল সাম্রাজ্য। কিন্তু একটা শর্ত-যদি কেউ সারাতে পারবে বলে এগিয়ে আসে, অথচ সারাতে না পারে, তবে তার গর্দান যাবে।

সম্রাটের এই ঘোষণা নানা দেশের নগরে প্রান্তরে জারি করে দেওয়া হলো। বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক গুণীজ্ঞানী বদ্যি, হেকিম, জ্যোতিষী গণৎকার আসতে লাগলো। সবাই রাজকুমারীকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বললো, নিঃ, এ বড় দুরারোগ্য কঠিন রোগ। সারবে কি সারবে না বলা শক্ত। এ অবস্থায় হাড়ি কাঠে মাথা গলিয়ে দিতে বিশেষ কেউই ভরসা। পেলো না। যারা ধনদৌলত সাম্রাজ্য আর রাজকুমারীর লোভ সামলাতে না পেরে পতঙ্গের মতো উড়ে এলো তাদের ভাগ্যে যা জুটতে পারে তাই জুটলো।

রাজকুমারী বদরের এক পাতানো ভাই ছিলো। বুড়ি বাঁদীের একমাত্র পুত্র, ছোট থেকে একসঙ্গেই তারা হোসে-খেলে মানুষ হয়েছে। ছেলেটি খুব ধর্মবিশ্বাসী। ছোট থেকেই সে তন্ত্রমন্ত্র নিয়ে সাধনা করত। মজার যাদুবিদ্যা দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দিত। হিন্দু এবং মিশরীরীয় তন্ত্রমন্ত্র সম্বন্ধে পড়াশুনাও করেছে সে প্রচুর। এই তার নেশা। দেশে দেশে ঘুরে বেড়ায়। নতুন কোনও যাদু নতুন কোনও মন্ত্র যদি কোথাও শেখা যায়। সারা দুনিয়ার নানা দেশ ঘুরে ঘুরে তার বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়েছে। কত রাজা বাদশাহের দরবারে সে সম্মোহন বিদ্যা দেখিয়ে উপস্থিত। সকলকে অবাক করে দিয়েছে তার ইয়ত্ত নাই।

ছেলেটির নাম মারজাবন। অনেক দিন বাদে, অনেক দেশ ঘুরে সে দেশে ফিরছে। শহরে ঢোকার মুখেই দেখে, প্রবেশ দ্বারের সামনেই গোটা চল্লিশেক নরমুণ্ডু ঝোলানো রয়েছে। কি ব্যাপার, কিছুই ঠাওর করতে পারে না। এক সঙ্গে এতগুলো মানুষ বলি হয়েছে। পথচারীদের জিজ্ঞেস করতে একজন বললো, রাজকুমারী পাগল হয়ে গেছেন। সম্রাট ঘোষণা করেছেন যে সারাতে পারবে তাকে রাজকন্যা ও রাজত্ব দুই-ই হাতে তুলে দেবেন। তিনি। আর যে না পারবে তার গর্দান যাবে। তাই-লোভে পাপ আর পাপে মৃত্যু। বেচারীদের জন্মের সাধ মিটে গেছে। রাজকুমারীকে কেউ সারাতে পারেনি।

এইসময় রাত্রি শেষ হতে থাকে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

একশো চুরানব্বইতম রজনীতে আবার কাহিনী শুরু করে সে :

–আর বলিস নি, বাবা, মেয়েটা পাগল হয়ে গেছে। দেশে বিদেশের কত ডাক্তারবিদ্যি আসছে, কিন্তু কেউ সারাতে পারছে না। সম্রাট ট্যাড়া পিটে দিয়েছেন, যে তার মেয়েকে সারিয়ে তুলতে পারবে তার সঙ্গে মেয়ের শাদী দিয়ে দেবেন। সেই সঙ্গে দেবেন তার গোটা সাম্রাজ্য। কিন্তু যারা লোভে পড়ে এলো কেউই তারা প্ৰাণ নিয়ে দেশে ফিরতে পারলো না।

মারজীবন বুঝলো, পথচারী লোকটা যা বলেছিলো, কথাটা তাহলে ঠিকই। মারজাবনের মনটা ভীষণ খারা হয়ে গেলো। ছোটবেলা থেকে এক সঙ্গে হেসে খেলে তারা ভাইবোনের মতো মানুষ হয়েছে। অনেকক্ষণ চিন্তার করার পর সে মাকে বললো, মা, একবার তুমি তার সঙ্গে আমার দেখা করিয়ে দাও। আমার বিশ্বাস, আমি তাকে সারিয়ে তুলতে পারবো।

মা শঙ্কিত হয়, সে বড় কঠিন ব্যামো, বাবা। দেশে বিদেশের কত নামজাদা হেকিম বদ্যি এলো, কিন্তু কেউ কিছু করতে পারলো না। ওসবের মধ্যে তোমার গিয়ে কাজ নাই।

মারজীবন কিন্তু নাছোড়বান্দা। বললো, তুমি একবার তার সঙ্গে মোলাকাৎ করিয়ে দাওই না। তারপর আমি বুঝবো।

পুত্রের বায়না ঠেলতে পারে না বুড়ি বাদী।—ঠিক আছে, তুমি এক কাজ করো। মেয়েদের সাজপোশাক পরে আজ রাতে তুমি আমার সঙ্গে হারেমে ঢুকবে।

মায়ের কথামতো নারীর ছদ্মবেশ ধরে যথাসময়ে মায়ের কাছে আসে মারজাবন। ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে রাজকুমারী বদরের হারেমে ঢুকতে যায়। প্রথমে খোজারা বাধা দিলো, নতুন কোনও লোকের ঢোকার হুকুম নাই।

বুড়ি বাঁদী বলে, আহা, নতুন লোক আবার কোথায় দেখলে? এ তো আমার লেড়কী।

রাজকুমারী বদরের সঙ্গে এক সঙ্গে মানুষ হয়েছে। ওরা দুজনে বড় পিয়ারের সখী।

খোজা ভাবে, রাজকুমারীর সখী–সে তো সোজা কথা নয়। বাধা দিলে রাজকুমারী হয়তো তার গর্দান নিয়ে নেবে। তাই আর কথাটি না বলে দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়ালো।

হারেমে ঢুকে বদরে দেখে সে বোরখা খুলে ফেলে দিলো। বোরখার মধ্যে সে একখানা জ্যোতিষ দর্পণ লুকিয়ে এনেছিলো। আর এনেছিলো খানকয়েক যাদুমন্ত্রের বই এবং একটি মোমবাতি।

মারজীবনকে দেখে ছুটে আসে বন্দর। ওর ঘাড়ে মাথা রেখে বলে, কোথায় ছিলে ভাই? এরা সবাই আমাকে পাগল বানিয়ে রেখেছে। ওর যাই ভাবুক, তুমি তো আমাকে ভালো করে জানো ভাই। ওদের মতো তুমিও যেন আমাকে ভুল বুঝে না।

মারজীবন বলে, সেইজন্যেই তো নিজের চোখে দেখতে এসেছি বোন। তুমি কিছু ভেবো না, আল্লা ভরসা করো, সব ঠিক হয়ে যাবে। যাক, সে কথা, আমি তোমার একখানা ঠিকুজী বানাতে চাই।

বদর বলে, তোমার যা ইচ্ছা বানাও। আমার কোনও অমত নাই। যে ভাবে চাও আমাকে পরীক্ষা করে দেখো, তাহলেই বুঝবে, সত্যি আমি পাগল, কি সুস্থ মানুষ।

মারজীবন বলে, যারা সুস্থ, জ্ঞানী তাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করলেই পরিষ্কার বোঝা যায়। তাই আগে তোমার কাহিনী শোনাও আগাগোড়া। একটুও বাদসাদ দেবে না।

বদর সব বৃত্তান্ত হুবহু খুলে বললো তাকে। কোনও কিছু গোপন করলো না।

—এখন সারা দিনরাত শুধু আমার কেঁদে কেঁদে কাটে। কোথায় আমার ভালোবাসা, কোথায় গেলে তাকে পাবো জানি না। ভাই মারজাবন, তুমি আমার শুধু পাতানো ভাই না, তুমি আমার বন্ধু। তোমাকে আজ কাছে পেয়েছি, যে কথা কাউকে মুখ ফুটে বলতে পারি না, তবু তোমাকে বলা যায়। আমি ধনদৌলত সাম্রাজ্য কিচ্ছ চাই না, ভাই। শুধু তাকে চাই। তার জন্যে আমাকে যদি ভিক্ষা করেও জীবনধারণ করতে হয় আমি রাজি আছি। দুনিয়াতে চাইবার মতো আর কোনও বস্তুই আমার নাই–শুধু তাকে ছাড়া। সে আমার কলিজা, সে আমার সর্বস্ব।

মারজাবন মাথা নত করে বসে থাকে।—তোমার দুঃখ আমি বুঝি বোন। বিরহের যে কি ব্যথা তা। ওরা বুঝবে কি করে। ওরা জীবনটাকে হীরে জহরৎ আর ধনদৌলত দিয়ে মাপতে শিখেছে। যাই হোক, তোর সব কাহিনীই শুনলাম। সবই আমার কাছে জলের মতো পরিষ্কার। কিন্তু আমি কসুর করবো না। আমার বিশ্বাস আমি তোমাকে সুখী করতে পারবো। কিন্তু বোন, যথেষ্ট ধৈর্য ধরতে হবে। আমি দেশে দেশে ঘুরি, বহু রাজাবাদশাহর দরবারে আমার অবাধ গতি। আর তোমার ‘ভালোবাসা’ সে কোনও সে যে ঘরের ছেলে নয়। তার যা রূপের বর্ণনা দিলে তেমন রূপবান পুরুষ তো আকছাড় পথে-ঘাটে মেলে না। তাছাড়া, এই যে মহামূল্যবান হীরের আংটি-এ-ও যার তার হাতে থাকা সম্ভব না। এর বেশি আর কিছু তোমাকে এখন বলতে পারছি না, বোন। আজই আমি আবার পথে বেরিয়ে পড়বো। পথে প্রবাসে ঘোরাই আমার কাজ। কিন্তু এবার যাবো। শুধু তোমার জন্যে। দেখি চেষ্টা করি, যদি আমার বোনের মুখে আবার হাসি ফোটাতে পারি। মনে একটু বসন্তের রঙ ধরাতে পারি।

সেইদিনই সে মার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার নিরুদেশের পথে বেরিয়ে পড়ে। সারাটা মাস ধরে সে এ শহর থেকে ও শহরে ঘুরে বেড়ায়। যেখানেই যায় বদরের পাগল হওয়ার কাহিনী শোনে।

চলতে চলতে অবশেষে একদিন সে সমুদ্রের ধারের বন্দর শহরে এসে হাজির হয়। শহরটার নাম তারাব। সেখানে কিন্তু কেউ বদরের কাহিনী শোনেনি। কিন্তু তার বদলে সেখানকার শাহজাদা কামার আল-জামানের অদ্ভুত দুরারোগ্য ব্যাধির কথা লোকের মুখে মুখে। কামার আল-জামান সেই দেশের সুলতানের একমাত্র সস্তান। নানা লোককে জিজ্ঞাসাবাদ করে। কামার আল-জামানের আজব কাহিনী সব জেনে নিলো। সব শুনে তার মনে হয়, কোথায় যেন বদরের কাহিনীর সঙ্গে এর একটা যোগসূত্র আছে। একজনকে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা! ভাইসব, কোথায় গেলে সেই শাহজাদার দেখা পাওয়া যাবে?

লোকটি বলে, সুলতান শাহরিমানের সলতানিয়ত কি আর এতটুকু! সাত-সমুদ্র তের নদী পারেও তার শেষ নাই। সুলতান শাহরিমানের দরবার হলো খালিদানে। হাঁটাপথে ছ’মাস লাগে। আর সাগর পাডি দিয়ে গেলে লাগবে পুরো এক মাস।

মারজীবন একখানা নৌক ভাড়া করে যাত্রা করলো। পালের হাওয়া অনুকূলেই ছিলো! তর তর করে বয়ে চলে নৌকা। এইভাবে প্ৰায় একটা মাস কেটে গেছে, খালিদান শহর আর বেশি দূরের পথ নয়। মারজাবনের প্রাণ আশায় দুলে ওঠে।

হঠাৎ ঈশান কোণে মেঘ দেখা গেলো। এখনি ঝড় উঠবে। মারজাবনের মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো। এখন কি হবে উপায়? এই অকুল দরিয়ায় বেঘোরে প্রাণ হারাতে হবে!

কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ঝড়ের তাণ্ডব শুরু হলো। মাঝি হাল ঠিক রাখতে পারলো না। পালের কাছি ছিঁড়ে গেলো। প্রচণ্ড শব্দে নৌকাটা গিয়ে ধাক্কা খেলো এক পাহাড়ের গায়ে। সঙ্গে সঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো।

মারজাবন ভালো সাঁতারু। তা হলেও তাণ্ডবের সঙ্গে লড়াই করা—সে কি চাট্টিখানি কথা। যাইহোক, কোনও রকমে একটা ভাসমান বয়া ধরে সে প্রাণ রক্ষা করতে পারলো। ঢেউ-এর সঙ্গে উথলি পাতাল হতে হতে এক সময় সে সুলতান শাহরিমানের প্রমোদ প্রাসাদের ধারে এসে ভিড়লো।

বরাতের জোরে সে-যাত্রা সেখানে এসেছিলো। ঐ সময় সুলতানের উজির দরবারের দরকারি কাজকর্মে সেখানে এসেছিলো। তারই নজরে পড়ে মারজােবন! প্রাসাদের একটা জানলা দিয়ে সমুদ্রের দিকে চেয়ে চেয়ে তার তাণ্ডবলীলা দেখছিলো। হঠাৎ দেখতে পেলো, একটা বয়া এগিয়ে আসছে প্রাসাদের দিকে। সেই বয়াটা আঁকড়ে ধরে আছে একটি যুবক। তৎক্ষণাৎ নফর চাকরীদের বললো, যা, দেখতো, একটা লোক বোধহয় বয়া ধরে ভাসতে ভাসতে এসে ভিড়েছে। ঘাটের সিঁড়িতে। নিয়ে আয় তাকে।

চাকরবাকররা ছুটে গেলো। একটু পরে প্রায় অচৈতন্য মারজীবনকে ধরাধরি করে নিয়ে এলো তারা উজিরের সামনে। জামাকাপড় বদলে দেওয়া হলো। একজন এক গেলাস সরবৎ এনে ধরলো তার সামনে। সরবৎটুকু খাওয়ার পরে একটু চাঙ্গা হয়ে উঠলো সে।

ছেলেটিকে দেখে উজিরের বেশ ভালো লাগে। চোখে মুখে বুদ্ধিদীপ্ত ছাপ। সুন্দর চেহারা, সুঠাম দেহ। দেখে মনে হয় বহুদূর দেশের মুসাফির।

এই সময় রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

একশো ছিয়ানব্বইতম রজনী :

উজির মারজীবনকে উদ্দেশ করে বলে, এই ঘোর বিপদের দিনে আল্লাহ তোমাকে বোধহয় আমাদের কাছে পাঠিয়েছেন।

মারজীবন একথার অর্থ বুঝতে পারে না, কেন জনাব, একথা বলছেন কেন? আমি নৌকা করে চলছিলাম—উদ্দেশ্য ছিল খালিদানের শাহজাদা কামার আল-জামানের সঙ্গে মোলাকাৎ করবো। কিন্তু আল্লাহর বুঝি তা ইচ্ছা নয়, তাই ঝড়তুফানের মধ্যে পড়ে নৌকাটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো। আমি কোনরকমে এই বয়াটা ধরে আত্মরক্ষা করেছি। তাও আপনারা না থাকলে হয়তো দরিয়ার জলে জান হারাতে হতো।

উজির অবাক হয়ে চেয়ে থাকে।–শাহজাদা কামার আল-জামানের সঙ্গে তোমার কি দরকার?

—না মানে, শুনেছি তিনি খুব অসুস্থ। মানে!—মাথার নাকি—

উজির বলে ঠিকই শুনেছো, শাহজাদা কামার আল-জামান বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে। তাকে সারাবার অনেক চেষ্টাই করা হয়েছে-হচ্ছে, কিন্তু কোনও হেকিম বন্দিাই কিছু করতে পারছে না। তা-তোমার কি করা হয়?

–যে আজ্ঞে আমিও, রোগবালাই-ই সারাই। তবে কোনও দাওয়াই পত্র দিয়ে নয়।

–তবে?

তাবিজ কবজ ঝাড়ফুক মন্তর—এই হচ্ছে আমার তরিকা।

উজিরের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে—আমার মনে হচ্ছে তুমিই পারবে। কারণ এত ঝড় ঝঞার মধ্যেও আল্লাহ তোমাকে ঠিক জায়গাতেই পৌঁছে দিয়েছেন। এ হচ্ছে সুলতান শাহরিমানের বিলাস ভবন। তারই পুত্র কামার আল-জামানকে এখন এই প্রাসাদেই এনে রাখা হয়েছে। তুমি যদি চাও তার সঙ্গে দেখা করতে পারো।

মারজীবন বলে, নিশ্চমই দেখা করবো, জনাব। কিন্তু তার আগে আগাগোড়া বৃত্তান্ত সব একবার শোনা দরকার।

উজির বললো, একবার কেন, একশোবার শোনাবো। আমরা চাই, আমাদের সিংহাসনের একমাত্র উত্তরাধিকারী শাহজাদা জামান সুস্থ হয়ে উঠুক। তার জন্যে যে মূল্য প্রয়োজন আমরা দিতে প্রস্তুত।

এরপরে আগাগোড়া সব কাহিনী তাকে শোনালো উজির। মারজাবনের আর বুঝতে বাকি থাকে না শাহজাদা জামানের সে-রাতের নায়িকা বন্দর ছাড়া আর কেউ-ই নয়। একটা নতুন আবিষ্কারের আনন্দে তার মনে নেচে ওঠে। কিন্তু তখুনি নিজেকে সামলে নেয়। উজিরকে সে বুঝতে দিতে চায় না তার মনের ভাব। বললো, ঠিক আছে, আগে তার সঙ্গে আমার করিয়ে দিন। নিজের চোখে একবার দেখি রুগীকে। তারপর বলবো, পারবো কি পারবো না। তবে খোদা আমার একমাত্র ভরসা, কোনও দাওয়াই পত্রে আমি বিশ্বাস করি না, আশা হয়। পারবো।

আর মুহূর্ত মাত্র বিলম্ব না করে উজির মারজীবনকে শাহজাদা জামানের কক্ষে নিয়ে যায়। প্রথম দর্শনেই সে চমকে ওঠে। এত রূপ কোনও পুরুষের হয়? যেন মনে হয় রাজকুমারী বদরের জুটির জন্যেই সে জন্মেছে। আর বদরের মুখেও তার মেহেবুবের চেহারার যে বর্ণনা সে শুনে এসেছে তার সঙ্গে এই সুরৎ হুবহু মিলে যাচ্ছে।

কামার আল-জামান কৃশ অবসন্ন দেহে বিছানায় শুয়েছিলো। চোখের ইশারায় মারজীবনকে বসতে বললো সে। শাহরিমান ভাবছেন, ছেলে হয়তো কিছু ব্যক্তিগত কথাবার্তা বলতে চায় ছেলেটির সঙ্গে। তাই তিনি উজিরকে নিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে যান।

মারজীবন ফিসফিস করে বলে : আর কোনও ভয় নাই। আল্লাহ আমাকে দূর করে পাঠিয়েছেন। এখানে। আপনারী ভালোবাসার’ খবর বয়ে নিয়ে এসেছি আমি।

জামান সন্দেহাকুল চোখে তাকায়। লোকটা এদেরই চর নয় তো। হয় তো বা কোনও নতুন ফন্দী।–ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। সে মারজীবনের মুখের দিকে।

—কী, বিশ্বাস হচ্ছে না? হবে হব। সব বলছি সব প্রমাণ আছে আমার কাছে। স্বয়ং ইষ্ট রাজকুমারী বদর আমাকে বলেছেন আপনাদের সেই রাতের সাহাগ মিলনরে কাহিনী।

এরপরে মারজীবন যে সব খুঁটিনাটি বিবরণ দিতে থাকলো তাতে সন্দেহের কোনও অবকাশ রইলো না-ছেলেটা আর যাই হোক তার বাবা বা উজিরের কোনও গুপ্তচর নয়।

মারজাবন বললো, রাজকুমারীর নাম বদর। সম্রাট ঘায়ুরের একমাত্র সন্তান। সে আমার পাতানো বোন। ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে আমরা মানুষ হয়েছি।

কামার আল-জামান-এর চোখ দুটো চকচক করে ওঠে। যেন একটা আশার আলো দেখতে পায়।–তা হলে আর দেরি নয় দোস্ত, চল আজই আমরা রওনা হয়ে যাই, সম্রাট ঘায়ুরের দেশে।

মারজীবন বলে, সে দেশ তো অনেক দূরের পথ। তোমার এই শরীরে এখনই রওনা হওয়া ঠিক হবে না। সে ধকল তুমি সহ্য করতে পারবে না। আগে শরীরটাকে সারিয়ে নাও, তারপর যাওয়া যাবে। আমি তোমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলে তবে রাজকুমারী বন্দর সুস্থ হয়ে উঠবেন।

এই সময় রাত্রি শেষ হতে থাকে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

একশো নিরানব্বইতম রজনী :

আবার সে শুরু করে :

কৌতূহল চাপতে না পেরে সুলতান শাহরিমান আবার ঘরে ঢুকেই অবাক হয়ে যান। আনন্দে নেচে ওঠে তার বুক। এতদিন পরে ছেলের মুখে তিনি হাসি দেখলেন। এই মুহূর্তেই তার মুখের বিষণ্ণতা মুছে গেছে। তিনি শুনলেন, জামান বলছে, তুমি বসো, দোস্ত, আমি হামাম থেকে হাতমুখ ধুয়ে, সাজপোশাক পালটে একটু পরিপটি হয়ে আসি।

সুলতান ছুটে এসে মারজাবনকে জড়িয়ে ধরেন। আনন্দে তিনি আজ আত্মহারা। কি যাদু দিয়ে, কেমন করে ছেলেকে সে প্রাণবন্ত করে তুললো সে সব আর জানতে চাইলেন না। তিনি। জামান যে আবার সুস্থ হয়েছে-এই-ই তার কাছে যথেষ্ট।

সবচেয়ে মূল্যবান রত্নাভারণে মারজাবনকে ভূষিত করলেন তিনি। উপহার দিলেন দামী দামী সাজপোশাক। সারা শহরের মানুষ নাচ গান হৈ হল্লায় মেতে উঠলো। আলোয় মালায় সাজানো হলে প্রাসাদ। দু’হাতে বিতরণ করা হতে থাকলো টাকা পয়সা, পোশাক-আশাক খানা-পিন্যা। বন্দীদের মুক্ত করে দেওয়া হলো। আবার দরবারকক্ষ গমগম করে উঠলো।

কয়েকদিন বাদে, শাহজাদা জামান তখন বেশ সুস্থ হয়ে উঠেছে, মারজীবন বললো, এবার যাত্রার আয়োজন করো দোস্ত। আমার বোনের অবস্থা যে কি, তা তো বুঝতে পারছে।

কামার আল-জামান বিমৰ্ষভাবে বলে, কিন্তু, আব্ববাজান আমাকে যেতে দেবেন না, মারজাবন। তিনি আমাকে কাছ ছাড়া করে একটা দিনও থাকতে পারেন না। আমি আবার অসুখে পড়বো, মনে হচ্ছে। তার আদর্শন আমি সইবো কি করে।

মারজাবন তাকে সান্ত্বনা দেয় কিছু ভাবনার নাই, দোস্ত, সব ঠিক হয়ে যাবে। উপায় আমি বাৎলে দিচ্ছি। তবে একটুখানি মিথ্যের আশ্রয় নিতে হবে। তা-শুভ কাজে একটু আধটু মিথ্যে বললে এমন কিছু গোস্তাকি হয় না। তুমি শুধু সুলতানকে বলবে, মারজীবন তোমাকে নিয়ে দিন কয়েকের জন্য শিকারে যেতে চাইছে। দেখবে কোনও অমত করবেন না। আমার ওপর এখন তিনি দারুণ খুশি। তাছাড়া অনেকদিন একটা বদ্ধ ঘরের মধ্যে অসুস্থ হয়ে আটকে ছিলো। খোলামেলা মুক্ত আলো হাওয়া তোমার এখন যথেষ্ট প্রয়োজন।

মারজাবনের বুদ্ধির তারিফ করে জামান। সুলতানের কাছে গিয়ে বলতে তিনি না করতে পারলেন না। বললেন, কিন্তু বাবা, একটা রাতের বেশি তুমি বাইরে কাটাবে না। তা হলে আমি মরে যাবো। তুমি তো জানো, একটা রাত তোমাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারি না।

দু’জনের জন্য দুটো সেরা তাগড়াই ঘোড়া সাজানো হলো। সঙ্গে আরও ছ’জন ঘোড়সওয়ার, লোক লস্কর, উট, খানা পিনা, সাজ পোশাক তাঁবু প্রভৃতির লাট বহর নিয়ে রওনা হলো তারা। শহরের সীমান্ত মুখ পর্যন্ত সঙ্গে সঙ্গে এলেন সুলতান। চোখের জল ফেলতে ফেলতে বিদায় জানালেন।

বেড়াবো। কেন জানো? সঙ্গের লোকজনের মনে কোনও সন্দেহ যাতে না হয়, সেইজন্য একটা দিন আমরা যথার্থ শিকারীই না হয় হলাম। তারপরের ফন্দী আমি ভেবেই রেখেছি।

সারাদিন ধরে খুব হৈ হল্লা দৌড় ঝাপ করে শিকার সমাধা করা হলো। সন্ধ্যাবেলা একটা বাগানের মধ্য তাঁবু ফেলে খানাপিনা শেষ করে শুয়ে পড়লো সকলে।

রাত্রি তখন তৃতীয় প্রহর। সঙ্গের লোকজন সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো। সবাই তখন বেঘোরে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। মারজাবন জামানকে জাগালো। ফিসফিস করে ওর কানে কানে বললো, এই রাতে এখুনি আমাদের পালাতে হবে। সবাই ঘুমে অচেতন কেউ টের পাবে না। নাও, ওঠ, দুজনে দুটো ঘোড়ায় চেপে কেটে পড়ি।

তখুনি, আর কাল বিলম্ব না করে, জামান আর মারজীবন অতি সন্তৰ্পণে সেখান থেকে সরে পড়লো। কিছুদূর ধীরে ধীরে চলার পর জোর কদমে ঘোড়া চালিয়ে ভোর না হতেই বহু যোজন পথ পার হয়ে গেলো তারা। আসার সময় তারা সঙ্গে এনেছিলো একটা তোরঙ্গ! তার মধ্যে ছিলো কিছু সাজপোশাক, এক বাক্স সোনার মোহর আর খানিকটা খানাপিনী। এছাড়া এনেছিলো একটা বাড়তি ঘোড়া।

সকাল হয়ে গেলো। একটা চৌরাস্তার মোড়ে এসে থামলো ওরা। মারজীবন বললো, দোস্ত, তোমার জামা আর পাতলুন খুলে আমার হাতে দাও। আর তোরঙ্গ থেকে একটা সাধারণ সাজ পোশাক বের করে পরে।

জামান বুঝতে পারে না কিছুই শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।

–কী ব্যাপার? কেন?

–যা বলছি করো, কোনও প্রশ্ন করো না।

জামান আর কথা না বাড়িয়ে সাজপোশাক বদলে জামা পাতলুন তুলে দেয় মারজাবনের হাতে। মারজীবন বলে, এবার তুমি এখানে অপেক্ষা করো, আমি আসছি।

এই বলে সে জামানের জামা পাতলুন কাঁধে ফেলে সেই ফালতু ঘোড়াটাকে নিয়ে পাশের জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ে।

একটু পরে সে ফিরে এলো। জামান অবাক হয়ে দেখলো, তার সাধের সৌখিন জামা পাতলুন রক্তে রাঙা। মারজীবন বলে ঘোড়াটাকে জবাই করে খুনে মাখিয়ে নিলাম তোমার সাজপোশাক। এবার দেখো, এ গুলোকে এই চৌমাথার এক পাশে ফেলে রেখে আমরা উধাও হয়ে যাবো।

জামান হাসে। সব তার কাছে জলের মতো পরিষ্কার হলো এতক্ষণে। কি অসাধারণ বুদ্ধি মারিজীবনের।

মারজীবন বলে, এসো এবার নাস্তা সেরে নিই! আবার কখন কোথায় থামবো, তার তো ঠিক নাই।

দু’জনে বসে পেট ভরে খানাপিনা করলো। মারজীবন বললো, আর দেরি নয়। এবার ঘোড়ার পিঠে ওঠে। টগবগিয়ে ছুটািবো। দুপুর হওয়ার আগেই আমাদের অনেক দূর চলে যেতে হবে। এতক্ষণে তোমার শিকারের সঙ্গী নফর চাকররা ঘুম থেকে উঠে আমাদের নিশ্চয়ই খোঁজাখুঁজি করছে। এরপর তারা অনেক খোঁজাখুজি করেও যখন কোনও হদিশ করতে পারবে না, সুলতানের কাছে গিয়ে জানাতেই হবে। সে ধরে, আজ দুপুর নাগাদ সুলতান খবর পাবেন। তারপর কি হবে বুঝতেই পারছে, তার হুকুমে একদল সৈন্যসামন্ত ছুটাছুটি শুরু করে দেবে। এক সময় তাদের কেউ চৌরাস্তার মোড়েও আসবে। দেখবে, তোমার সাজপোশাক রক্তে রাঙা-পড়ে আছে পথের ধারে। জঙ্গলটার মধ্যে ঢুকবে তারা। দেখবে, তোমার ঘোড়াটা মরে পড়ে আছে। ভাববে কোনও ভয়ঙ্কর জানোয়ারের মুখে পড়ে ঘোড়াটা ঘায়েল হয়েছে! তোমাকে সে খাবার করে নিয়ে চলে গেছে। এই সাংঘাতিক বিবরণ যখন সুলতান শুনবেন, সুলতানের সে যে কি নিদারুণ অবস্থা হবে আমার বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। কিন্তু কি করা যাবে, এছাড়া সহজ উপায়ে তোমাকে তার কাছ থেকে নিয়ে আসা যেত না। তবে এও ভাবো। বিষম শোকতাপে দগ্ধ হতে হতে একদিন যখন তোমাকে আবার ফিরে পাবেন তখন তিনি কত আনন্দ পাবেন? সে আনন্দের কোনও তুলনা নাই। জানি তো, সব ভালো, যার শেষ ভালো।

জামান বলে, তোমার মতো বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের কথা। তোমার উপস্থিত বুদ্ধি, বিচক্ষণতার কোনও তুলনা নাই। ধন্যবাদ জানিয়ে তোমাকে ছোট করবো না। কিন্তু চলার পথে তো আমাদের অনেক খরচ হবে। সে পয়সাকডি তো আমার সঙ্গে নাই। তবে আমার হাতে মহামূল্যবান কয়েকটা আংটি আছে। বিক্রি করলে লাখখানেক মোহর দাম হতে পারে। এগুলো কোথাও বেচে রাহাখরচ চালাবার ব্যবস্থা করো।

মারজীবন বলে, ও নিয়ে তোমাকে কিছু ভাবতে হবে না, চাঁদ। আমি সব ব্যবস্থা পাকা করেই এসেছি। আমার ওপর খুশি হয়ে তোমার বাবা আমাকে বহু ধনরত্ন এবং নগদ এক লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কার দিয়েছেন। সেগুলে সব এই তোরঙ্গের মধ্যে একটা বাক্সে নিয়ে এসেছি আমি। সম্রাট ঘায়ুরের সাম্রাজ্যে পৌঁছতে আমাদের এত পয়সার দরকারই হবে না; জামান। আর তাছাড়া তোমার হাতের ঐ অমূল্য রত্নগুলো বেচিতে গেলেই ধরা পড়ে যেতে হবে। জহুরীর হাতে পড়লেই তার সন্দেহ হবে। এসব বস্তু তো ইতর সাধারণের কাছে থাকতে পারে না। এদিকে তোমার বাবা সুলতান শাহরিমানও নিশ্চয়ই চুপ করে বসে থাকবেন না। তার নিজের দেশ ছাড়াও আশেপাশের আর পাঁচটা দেশেও হুলিয়া জারি করে দেবেন। একটা সামান্য জহুরী মোটা পুরস্কারের লোভে তোমাকে ধরিয়ে দেবে না, সে কি হতে পারে। সুতরাং ওগুলো বরং খুলে জেবের ভেতরে রেখে দাও।

একনাগাড়ে মাসখানেক চলার পর একদিন সকালে তারা সম্রাট ঘায়ুরের রাজধানীর উপান্তে এসে পৌঁছল। কামার আল-জামানের আর ধৈর্য মানে না, তখনি সে সম্রাট ঘায়রের সঙ্গে দেখা করতে চায়। কিন্তু মারজীবন বলে, ধৈৰ্যং কুরু, বন্ধু, এখানে তিষ্ঠ ক্ষণকাল।

শহরের প্রান্তমুখে একটা বনেদী সরাইখানা। মারজীবন বলে, এখানে উঠবো আমরা। দিন তিনেক বিশ্রাম করবো আগে। বাকবা, একটানা একমাস ঘোড়ার পিঠে-গায়ের হাড়মাংস আর নাই। বেদনায় টনটন করছে। টানটান হয়ে আগে শুয়ে কাটাবো তিনটে দিন। তারপর অন্যকথা।

সরাইখানার একটা ঘরে পাশাপাশি দুটো পালঙ্কে দুই বন্ধু তিন দিন তিন রাত্রি শুয়ে শুয়ে কাটালো। পথের ক্লান্তি কেটে গিয়ে ফোটাফুলের স্নিগ্ধতা ফুটে ওঠে। জামানের মুখে। দেহমান বেশ ঝরঝরে। মনে হয়। মারজাবন বলে, নাও, এবার হামামে চলো, তোমাকে আমি নিজে হাতে ঘষে মোজে সাফ করে গোসল করাবো।

স্নানাদি শেষ করে এক জ্যোতিষের বেশ ধারণ করল জামান। মারজীবন তাকে সুন্দর করে সাজালো। জামানের যা রূপ তাতে ওকে যে সাজেই সাজানো যাক, অপরূপ লাগবে।

সম্রাট ঘায়ুরের প্রাসাদের পথে পা বাড়াতেই শহরের আবালবৃদ্ধবনিতা এসে ভিড় জমাতে থাকলো; এমন রূপের হাট তারা আগে কখনও দেখেনি। পথচারীদের কেউ কেউ জানতে চাইলো, কী অভিপ্ৰায়ে যাওয়া হচ্ছে রাজদরবারে।

জামান গর্বভরে ঘোষণা করে, আমি ত্ৰিভুবন জয়ী জ্যোতিষ। আমার অসাধ্য কিছুই নাই। রাজকুমারী বদর-এর দুরারোগ্য ব্যাধির কথা শুনে বহু দূর দেশ থেকে আসছি। তার সব রোগ আমি সারিয়ে দেব।

জনতার মধ্যে গুঞ্জন ওঠে। লোকটা বলে কি? সে কি জানে না, আজ পর্যন্ত যত গুণীজ্ঞানী হেকিম বিদ্যি এসেছে, তাদের কি দশা হয়েছে।

কে একজন বলে, তা মরার জন্য যদি পাখা গজায়, কে আর আটকাতে পারে বলে। ঐ যে ওখানে যাদের কাটা মুণ্ডু, ঝুলছে ওখানে গুণতিতে আর একটা মুণ্ডু বাড়বে—এই আর কি

মেয়েরা চুকচুক করে, আহা রে, চাঁদের মতো সুরৎ, মনে হয় বড়ঘরের ছেলে। এমন রূপ এমন যৌবন-সব শেষ হয়ে যাবে।

অনেকে বারণ করে, দেখো বাপু, আমন কাজটি করতে যেও না। যা কেউ পারলো না, তা যে তুমিও পারবে না তা জানি। পাতালপুরীর রাজপুত্ত্বরের মতো তোমান মন ভোলানো রূপ আছে তাও মানছি—কিন্তু ওতে তো ভাবি ভুলবে না। আমাদের সম্রাটের প্রতিজ্ঞা বড় সাংঘাতিক। মুখ দিয়ে একবার যা বের করবে তার আর নড়াচড় হবে না। রাজকুমারীর রোগ যদি সারাতে না পারো বাছা, তা সে তোমার যত রূপ-গুণাই থাক, গর্দান তোমাকে দিতেই হবে। তাই বলছি, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও! কি দরকার অত লোভে। জানেই যদি না বাঁচলে কি হবে রাজত্ব আর রাজকন্যা দিয়ে?

কামার আল-জামান সে-সব কথায় কৰ্ণপাত করে না।-মুডিমিছরি এক করে দেখো না তোমরা, এই আমার অনুরোধ। আমার পীরের কাছ থেকে যে বিদ্যা আমি আহরণ করেছি, তাতে মরা মানুষকে আবার বাঁচিয়ে দিতে পারি—পাগল তো কোন ছার।

এই কথা শুনে চমকে ওঠে সকলে। মরা মানুষকে জীয়ন্ত করতে পারে।

মুহূর্তে লোকের মুখে মুখে সারা শহর ছড়িয়ে পড়ে এই অদ্ভুত জ্যোতিষীর কথা। শহর ভেঙে পড়ে তাকে দেখতে।

মারজীবন বলে, প্রাসাদের ফটকে গিয়েই আমি কিন্তু কেটে পড়বো। তোমাকে আমার সঙ্গে দেখলে সম্রাট ঘায়ুর অন্যরকম ভাবতে পারেন। আমি প্রাসাদের অন্দরেই থাকবো। লক্ষ্য করবো তোমার কীর্তিকলাপ। কিন্তু সাবধান, যা শিখিয়ে দিয়েছি, সেইভাবে ঠিক ঠিক করে যাবে।

হুহু করে জনস্রোত বাড়তে থাকে। সবাই দেখতে ব্যাকুল জামানকে। নতুন চিড়িয়া ফাদে ধরা দিতে এসেছে। প্রধান ফটকের প্রহরী পথ রুখে দাঁড়ায়।

–আপ কৌন হ্যায়? কাকে চান?

জামান বলে, আমি এক বিদেশী জ্যোতিষী। এসেছি। রাজকুমারীর ব্যাধি সারাতে। তুমি মহামান্য সম্রাটকে খবর দাও। আমি তার সঙ্গে দেখা করতে চাই।

প্রহরীরা অবাক হয়। সব জেনে শুনে এমন সোনার চাঁদ ছেলেটি হাড়ি কাঠে মাথা দিতে চায়। প্রধান প্রহরী এগিয়ে এসে বলে, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যান মালিক, এখানে একবার যে ঢুকেছে, প্ৰাণ নিয়ে আর ফিরে যেতে পারেনি।

জামান বিরক্ত হয়।–আমি কারো উপদেশ শুনতে আসিনি। রাজকুমারীর দুরারোগ্য রোগ সারাতে এসেছি। তুমি সম্রাটকে সংবাদ দাও। আমি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাই।

বাইরে কোলাহল শুনে সম্রাট উজিরকে পাঠালেন। —যাও দেখতে বাইরে কোনও বিদেশী মুসাফীর এসেছে মনে হচ্ছে, নিয়ে এসো তাকে।

দরবারে প্রবেশ করে আভুমি আনত হয়ে সম্রাট ঘায়ুরকে কুর্নিশ জানায় জামান।

কামার আল-জামানের মুখের দিকে তাকিয়েই সম্রাট চোখ বন্ধ করে ফেলেন। একি অপরূপ সুন্দর চেহারা। এমন রূপবান মানুষ তো কোথাও দেখেন নি। কেমন যেন সব তালগোল পাকিয়ে যায়।

— শোনো বাবা, সম্রাট ঘায়ুর বলেন, চাঁদের মতো তোমার এই রূপ, আর এমন কচি বয়সী। পাত্র হিসাবে তুমি আমার পরমাসুন্দরী কন্যা বদরের আদর্শ জুটি হতে পারো সন্দেহ নাই। কিন্তু জানো তো আমার শর্ত, তাকে যদি সারাতে না পারো-আমি তোমাকে কোনও ভাবেই রেহাই দিতে পারবো না। তাই এখনও বলছি, নিজের প্রাণ নিয়ে ছিনিমিনি না খেলে ফিরে যাও। অবশ্য তুমি এসেছে, আমার মেয়ের রোগ সারাতে। তোমাকে নিরস্ত করলে আমার লাভ কি! বরং একটা আশা নিয়ে কিছু সময় কাটাতে পারবো–যদি আমার নয়নমণিকে তুমি সারিয়ে তুলতে পারো। কিন্তু তা যে অসম্ভব। কত দেশের কত ডাকসাইটে ডাক্তার, কবরেজ, হেকিম উনানী এলো, তাদের কেউই প্ৰাণে বেঁচে ফিরে যেতে পারে নি। তা তোমার যদি শখ হয়, চেষ্টা করে দেখতে পারো। তবে আমার ঐ এক শর্ত বাবা, না পারলে তোমার মুণ্ডু কেটে ঝুলিয়ে রাখা হবে।

—আমি রাজি আছি মহামান্য সম্রাট। আপনার সব শর্ত জেনেই আমি এসেছি।

সম্রাট ঘায়ুর প্রধান খোজাকে বললেন, একে অন্দর মহলে নিয়ে যা। রাজকুমারীর ব্যামো সারাতে এসেছে। যা বলবে শুনবি।

জামানকে সঙ্গে নিয়ে খোজা রাজকুমারী বন্দরের হারেমে যেতে যেতে বলে, তা সাহেবের, জামাই সাজার শখ হয়েছে বুঝি। এমন আহম্মক আর কতজন আছে কে জানে?

–আমি আহাম্মক নই। জেনেশনে কেউ জান খোয়াতে আসে না—আসা উচিত না। অন্ততঃ আমি আসিনি। তোমাদের রাজকুমারীকে আমি সারিয়ে তুলবোই। আর এ-ও আমার ক্ষমতা আছে তাকে চোখে না দেখেই আমি তার সব রোগ সারিয়ে দেব। দেখবে?

খোজাটা এবার ভ্যাবাচ্যাক খেয়ে যায়। —সে কি? রুগীকে না দেখেই রোগ সারবেন! তা যদি পারেন, আমরা আপনার কেনা গোলাম হয়ে থাকবো, মালিক। আমাদের সম্রাট আপনাকে মাথায় করে রাখবেন। রাজকুমারী আপনার হবে।

—দেখা পারি কি না, জামান দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে বলে, আমাকে শুধু একবার রাজকুমারী বদর-এর দরজার সামনে নিয়ে চলো। আমি ভিতরে ঢুকবে না। পর্দার এপারে থেকেই তার সব রোগ সারিয়ে দেব।

জামান আর খোজা রাজকুমারীর দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। বলে, একখানা কুর্শি নিয়ে এসো। এখানে আমি বসবো।

সঙ্গে সঙ্গে একখানা আরামকেদারা এনে দেওয়া হলো। জামান জেব থেকে কাগজ কলম বের করে একখানা চিঠি লিখলো।

এই সময় রাত্রি শেষ হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

দুশো চারতম রজনী :

আবার সে শুরু করে : চিঠির বয়ান এই রকম : খালিদানের বাদশাহ শাহরিমানের পুত্র কামার আল-জামান-এর এই পত্র মহামান্য সম্রাট ঘায়ুরের কন্যা রাজকুমারী বদর-এর উদ্দেশ্যে লিখিত হচ্ছে :

তুমি তো জানো না প্রিয়া, কী ব্যথা মরমে নিয়া আমি দিন কটাইতেছি। প্রতিনিয়ত তুষানলে দগ্ধ হইতেছি। তোমার আদর্শন আমাকে উন্মাদ করিয়াছে। আমার কলমে এমন কোন ভাষা নাই তোমার বিরহে আমি কাতর-লোকে বলে আমার মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটিয়াছে। কিন্তু কি করিয়া তাঁহাদের বুঝাই, জীবনে ইহার চাইতে বড় সত্য আর কিছুই নাই। সেই রাত্রে তোমার হাতে আমি একটি হীরার আংটি পরাইয়া দিয়াছিলাম। এবং তুমিও আমার হাতে পরাইয়া দিয়াছিল এই পান্নার আংটিটাি। দেখো, চিনিতে পারো কি না। আমার হৃদয় অশান্ত সমুদ্রের মতো অস্থির হইয়া উঠিয়াছে। কবে দেখা পাইবো। কবে হইবে আমাদের মধুর মিলন।

ইতি–
কামার আল-জামান

পুনঃ—শহরের প্রবেশদ্বারের পাশে বড় সরাইখানায় আমি উঠিয়াছি। আংটিটা পুরে খোজার হাতে দিয়ে বললো, তোমার রাজকুমারীকে দিয়ে এসো।

বাইরে পর্দার এপারে দাঁড়িয়ে জামান শুনতে পেলো, খোজাটা বলছে, মালকিন, পর্দার এপারে দাঁড়িয়ে আছেন এক জ্যোতিষী। তিনি বলেছেন, আপনাকে সামনে না দেখেই তিনি আপনার ব্যামো সারিয়ে পারবেন। এই নিন, উনি আপনাকে খুলে দেখতে বলেছেন।

বদর-এর আর তাঁর সয় না। ক্ষিপ্রহাতে চিঠিখানা খুলে ফেলে। আংটিটা দেখেই সে চমকে ওঠে। এই তো সেই আংটি। —তার ভালোবাসার হাতে সে পরিয়েছিলো। বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস করতে থাকে। তবে কি আল্লাহ এতদিনে মুখ তুলে চাইলেন। চিঠিখানা পড়তে থাকে। হঠাৎ সে আনন্দে চিৎকার করে ওঠে। এবার বুঝি সে সব সত্যি সত্যিই পাগল হয়ে যাবে। পর্দা ঠেলে সে বাইরে আসে। সামনেই দাঁড়িয়েছিলো জামান। এক মুহূর্তে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে-তারপরই কাঁপিয়ে পড়ে ওর বুকে। দু’হাতে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। এতকাল কোথায় ছিলে, সোনা। এত কষ্ট কি করে দিতে পারলে।

জামানের চোখ দুটিও জলে ভরে আসে। বদরের মাথায় কপালে হাত বুলাতে থাকে। —আমিও তো সেই একই কথা বলতে পারি সোনা। তুমিই সেই রাতে কোথায় উধাও হয়ে গেলে?

গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে দুজনে দু’জনকে চুম্বন করতে থাকে। কোন দিকে ভ্রূক্ষেপ নাই। যেন সব বাধাবন্ধনহীন এক জোড়া কপোত-কপোতী। .

খোজা ছুটে গিয়ে সম্রাটকে খবর দেয়, রাজকুমারী সাফসম্রাট ঘায়ুর অজানা আশঙ্কায় সিংহাসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়েন।

—কী, কী হয়েছে? রাজকুমারী সাফ কি রে?

—আজ্ঞে রাজকুমারীর মাথাটা সাফ হয়ে গেছে। আর কোনও অসুখ নাই। সব সেরে গেছে।

ঘায়ুর বিশ্বাস করতে পারে না। —কী সব যা তা বলছিস?

–না-আজ্ঞে, নিজে চোখে দেখে এলাম। রাজকুমারী জ্যোতিষী সাহেবকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছেন।

—বলিস কি রে?

–হ্যাঁ, হুজুর, সত্যি সত্যিই। বিশ্বাস না হয় চলুন, নিজের চোখেই দেখবেন।

সম্রাট আর তিলমাত্র ধৈর্য ধরতে পারেন না। মাথার মুকুট পরতে ভুলে গেলেন। পায়ের জুতা ওখানেই পড়ে রইলো। খালি পায়ে খালি মাথায় ছুটলেন হারেমে। দেখলেন, সত্যিই বদর, আগের মতো হাসি খুশি সুস্থ হয়ে গেছে। মেয়ের কপালে চুম্বন করে বললেন, যাক, এতদিনে আমার দুঃখের দিন শেষ হলো।

কামার আল-জামানকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তুমি অসাধ্য সাধন করেছ বাবা। আমার সব দিয়েও তোমার ঋণ শোধ করতে পারবো না। এখন বলে কে তুমি?

জামান বলে, খালিদানের বাদশাহ শাহরিমান আমার বাবা। আমার নাম কামার আল-জামান। এরপর আদ্যোপোন্ত সমস্ত কাহিনী শোনালো তাকে।

সম্রাট বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে শুনলেন সেই অদ্ভূত কাহিনী। শুধু মুখে বলতে পারলেন, তাজ্জব ব্যাপার! এ কাহিনী সোনার অক্ষরে লিখে রাখা দরকার।

দরবারের সেরা কলমচীকে ডেকে বললেন, শাহজাদার এই কাহিনী যত্ন করে লিখে রেখে দাও। আগামী দিনের মানুষ এ কাহিনী পাঠ করে অনেক শিক্ষা লাভ করতে পারবে।

শহরের প্রধান কাজীকে ডাকা হলো। খাঁটি মুসলমান প্রথায় শাদীনামা তৈরি হয়ে গেলো। আনন্দ উৎসবমুখর হয়ে উঠলো সারা প্রাসাদ, সারা শহর। আলোর মালায় সাজানো হলো প্রাসাদ, ইমারৎ। খানাপিনা, নাচ গান হৈ-হাল্লায় মাতোয়ারা হয়ে উঠলো সকলে। লাহরের এবং দরবারে সম্রান্ত আমির ওমরাহ সওদাগর সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা এসে নব দম্পতির সুখ সুনিবিড় দীর্ঘ দাম্পত্য জীবন কামনা করে শুভেচ্ছা জানিয়ে গেলো।

দীর্ঘকালের প্রতীক্ষার অবসান হলো, আবার ফিরে এলো সেই মধুযামিনী। বদর আর কামার অল-জামান সুখের সায়রে গা ভাসিয়ে দিলো। এতদিন পরে তারা প্ৰাণ ভরে হাসলো, গাইলো, খানা পিনা করলো, আর গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে নিশ্চিন্ত আরামে ঘুমালো।

ভোরের দিকে জামান স্বপ্ন দেখলো, তা বাবা সুলতান শাহরিমান সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। কেঁদে কেঁদে তার দু’চোখ অন্ধ হয়ে গেছে। বলছেন, জামান, বেটা, তোমার শোকে আমি আজ মৃত্যুপথ যাত্রী। একটি বার এসো বাবা, যাবার আগে একবার প্রাণ ভরে দেখে যাই। তুমি ছাড়া জীবন আমার মরুভূমি হয়ে গেছে। কি হবে আমার এই অতুল ঐশ্বর্য, এই বিশাল সলতানিয়ত দিয়ে? একটি বার এসো বাবা।

হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো। বাবার বিষাদ বিষণ্ণ করুন মুখখানাই বারবার চোখের সামনে ভূক্ত থাকলো। এক অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করে ওঠে জামান। তার আর্তনাদ বদর জোগে \3CQ

—কী হলো, সোনা? শরীর খারাপ করছে? মাথা ধরেছে? টিপে দেব। ভিনিগার লাগিয়ে বেঁধে দেব? এক্ষুণি কমে যাবে।

জামান কঁকিয়ে ওঠে, না।

—তবে? তবে কি তোমার পেটে দরদ হচ্ছে? মৌরির তেল মালিশ করে দেব পেটে?

জামান ছটফট করে ওঠে, না না ওসব কিছু না।

—তবে কি তোমার বদহজম হয়েছে। একটু জোয়ানের আরেক খাবে? কিংবা এক গেলাস গোলাপ জলের শরবৎ?

জামান বলে, না, সোনা সে জন্যেও না।

এই সময় রাত্রি শেষ হতে চলেছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিমে চুপ করে বসে থাকে।

 

দুশো ছয়তম রজনীতে আবার সে গল্প শুরু করে :

কামার আল-জামান বলে, কালই আমরা দেশে রওনা হয়ে যাবো। খুব একটা খারাপ স্বপ্ন দেখলাম। বাবা শোকে তাপে একেবারে শুকিয়ে গেছেন। আমার শিয়রে দাঁড়িয়ে বললেন, জামান, একটিবার আমার কাছে এসো। তোমাকে না দেখে আমি মরতেও পারছি না। তার চোখে দেখলাম জল! আমি আর কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছি না, সোনা। কালই আমাদের রওনা হতে হবে। তোমার কি মাত?

—আমার আবার কি মত? তোমার মতই আমার মত। তোমার পথই আমার পথ। তুমি যা বলবে তাই হবে। চলো, দেশেই যাই। তোমাকে না দেখে বাবার অবস্থা যে কি-তা তো আমিও বুঝতে পারছি। কাল সকলে আমি বাবাকে বলবো, তিনি সানন্দে সব ব্যবস্থা করে দেবেন।

খুব ভোরো বদর প্রধান খোজাকে পাঠালো সম্রাটের কাছে। ঘায়ুর তাকে দেখেই শঙ্কিত হলেন, আবার এই সক্কালবেলায় কী দুঃসংবাদ বয়ে নিয়ে এলি বাঁদর।

-আজ্ঞে রাজকুমারী আপনার সঙ্গে দুটো কথা কইতে চান। খুব দরকারী।

—দাঁড়া, আমি আমার মুকুট আর জুতো পরে নিই।

বদরের হারেমে এসে ঘায়ুর বললেন, কাল রাতে কি এক গাদা লঙ্কার ঝাল খেয়েছিলি, মা? এই সাত সকলে তোমাদের ঘুম ভাঙলো কি করে? কী ব্যাপার? কেন ডেকেছো?

—না বাবা, ওসব কিছু না, বদর বলে, আজ আমরা দেশে রওনা হয়ে যাবো। তাই তোমার অনুমতি চাই।

—এ তো বড় সুখের কথা, মা। স্বামীর সঙ্গে শ্বশুর ঘরে যাবে, এর চেয়ে আনন্দের কথা আর কি হতে পারে? তবে একটা কথা মা, তুমিও তো আমার একমাত্র সন্তান, জীবনে কোনও একটা দিন চোখের আড়াল করিনি। আমার কষ্টটাও নিশ্চয়ই বুঝবে। তাই বলছি, একটা বছর পরে একবার আমার কাছে ফিরে এসো।

বদর বাবার হাতে চুমু খেয়ে বলে, এ তুমি কি বলছে, বাবা, তোমাকে না দেখে কি আমিই থাকতে পারবো? যত তাড়াতাডি হয় আমি তোমাকে দেখতে আসবো।

সকাল থেকে সাজ সাজ রাব পড়ে গেলো। রাজকুমারী বদর যাবে শ্বশুরবাড়ি। গাধা খচ্চর উটের পিঠে বোঝাই হতে থাকলো সাজ-সামগ্ৰী। সম্রাট ঘায়ুর নানা মূল্যবান দুষ্প্রাপ্য উপহার উপটৌকনে ভরে দিলেন। সেই সঙ্গে দিলেন অমূল্য ধন-দৌলত হীরা-জহরৎ। জিনিস পত্র বাঁধা ছাঁদা করতেই দুপুর গড়িয়ে গেলো। সম্রাট সাশ্রনয়নে বিদায় দিলেন কন্যা জামাতাকে। কামার অল-জামান আর বদর-এর চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়লো।

কিন্তু শহর ছাড়িয়ে প্রান্তরের পথে যেতে না যেতেই চোখের জল শুকিয়ে গেলো। আনন্দে উদ্দাম হয়ে উঠলো দুজনে। তারপর চলা আর চলা।

এইভাবে তিরিশটা দিন পথ চলার পর একটা ঘন সবুজ শস্যক্ষেত্রের পাশে এসে ওরা আস্তানা গাড়লো। এইখানে কয়েকটা দিন বিশ্রাম করবে তারা। কাছেই নদী আছে, সুতরাং জলের কষ্ট হবে না। খুঁজে পেতে খেজুর গাছের ছায়ায় তাঁবু গাড়া হলো! বন্দরের শরীরে এত ধকল হইবে কি করে। ফুলের ঘায়ে যে মেয়ে মূৰ্ছা যায়, সে কি না একটানা এতটা পথ উটের পিঠে এসেছে। যদিও হাওদায় মখমলের গদি ছিলো। তবুও উটের দুলকি চালের দুলনিতে সারা শরীর ব্যথায় টন টন করছে। সামান্য একটু কিছু মুখে দিয়ে তীবুর ভিতরে সে টান ট্রান হয়ে শুয়ে পড়লো। শোয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমে গলে গেলো বন্দর। কামার আল-জামান সঙ্গের অনুচরদের বললো, তোমাদের তীবুগুলো একটু দূরে খাটাও। রাজকুমারী বড় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়েছেন। তোমাদের হট্টগোলে তার নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটতে পারে।

তাঁবুর ভিতরে ঢুকে জামান দেখে, একটা কঁচুলী আর পাতলা ফিনফিনে একটা মসুল-এর তৈরি রেশমী-সেমিজ পরে বদর ঘুমে অচেতন। মাঝে মাঝে একটা হালকা হাওয়া এসে সেমিজটা ওপরের দিকে উড়িয়ে দিয়ে পালাচ্ছে। জামানের চিত্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে। একটি মাসের অতৃপ্ত কামনা দেহ কুরে কুরে খেতে থাকে। পাশে বসে বদরের সারা দেহে হাত বুলাতে থাকে জামান। দেহ, মন উত্তপ হতে থাকে। হঠাৎ কোমরে শক্ত মতো কি একটা হাতে ঠেকে। একটা অচেনা পাথর। নিশ্চয়ই মহামূল্যবান। তা না হলে বদর কেন শরীরে ধারণ করবে। হয়তো এর কোনও দৈব ক্ষমতা আছে। তার পাতানো ভাই মারজাবন দিয়ে থাকবে হয়তো বা। হয়তো এর গুণে অনেক বিপদ আপদ কেটে যায়—

আলগোছে পাথরটাকো খুলে নিয়ে তীবুর বাইরে চলে এলো জামান। পরীক্ষা করে দেখবে, চিনতে পারে কি না। পাথরটার চারটে মুখ। কি সব আঁকিবুকি কাটা আছে চারপাশে। কিছুই বোধগম্য হয় না। তবে দেখে বোঝা যায়, পাথরটা কোনও মন্ত্রপুত।

পাথরটা হাতে নিয়ে একমনে নিরীক্ষণ করছিলো সে। এমন সময় একটা পাখি শো করে নেমে এসে, ছোঁ। মেরে ছিনিয়ে নিয়ে নিমেষে উধাও হয়ে গেলো।

এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

দুশো সাততম রজনীতে আবার শুরু করে :

পাখিটা উড়তে উড়তে গিয়ে বসে অনেক দূরের এক বিশাল ঝাঁকড়া গাছের ডালে। দূরে হলেও জামান দেখতে পায়, শয়তান পাখিটা তারই দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ঘাড় দোলাচ্ছে।

কিছুক্ষণের জন্য সে হতভম্ব হয়ে পড়ে। এমন যে একটা দুর্ঘটনা ঘটতে পারে তার মাথাতেই আসেনি। কিন্তু এখন উপায় কি হবে। রাজকুমারী জেগে যখন দেখতে তার পাথরটা নাই তখন সে তাকে কি বলে সান্ত্বনা দেবে। পাথরটা নিশ্চয়ই তার প্রাণাধিক প্রিয়।

একটা পাথরের ঢ়িল কুড়িয়ে নিয়ে ছুটে যায় গাছটার দিকে। প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে ছুঁড়ে মারে। কিন্তু তার আগেই পাখিটা উড়ে পালায়। পালিয়ে কিন্তু বেশি দূর যায় না। আর একটু দূরের একটা গাছের ডালে গিয়ে বসে। আর একটা ঢ়িল নিয়ে জামান ওকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। কিন্তু পাখিটা মহা ধডিবাজ। ঢ়িল মারার মুহূর্তেই সে শো করে উড়ে যায়। গিয়ে বসে আর একটা গাছের ডালে। জামানের মাথায় খুন চেপে যায়। যে ভাবেই হোক, পাখিটাকে মেরে ফিরে পেতেই হবে পাথরটা। পাখিটাও বড় সেয়ানা। বারবারই এমন একটা দূরত্ব রেখে কোনও একটা গাছের ডালে বসছে, যেখান থেকে পাথরটা স্পষ্ট দেখা যায়—এবং জামানের মনে আশা জাগে, হয়তো সে এবার তাকে ধরাশায়ী করতে পারবে। কিন্তু না, তাড়া করতে করতে অনেক বাগ বাগিচা পার হয়ে যায়। মারতে আর পারে না কিছুতেই।

গাছপালা ছাড়িয়ে পাখিটা গিয়ে বসে কাছেরই একটা পাহাড়ের চূড়ায়। জামান মরিয়া হয়ে উঠেছে। কোনও দিকে তার ভ্রূক্ষেপ নাই। পাহাড়ের গা বেয়ে উপরে উঠে যায়। পাথর ছুঁড়ে মারে পাখিটাকে। পাখিটাও টুক করে উড়ে গিয়ে বসে আর একটা চূড়ায়। এইভাবে পাহাড়ের কন্দরে উপত্যকায় পাখিটার পিছনে পিছনে ছুটে হয়রান হয়ে পড়ে।

কয়েক ঘণ্টা কেটে গেলো। সূর্য গেলো পাটে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এলো। ঘেমে নেয়ে একশা হয়ে গেছে সে। এখন কি করে বদরের সামনে দাঁড়াবে। কী জবাবদিহি সে করবে? হয়তো এমনও হতে পারে, তার এই অমূল্য রত্নটার শোকে সে অসুস্থও হয়ে পড়তে পারে।

ক্রমশঃ অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে থাকে। কামার আল-জামান ভাবে, এই অবস্থায় এই দুৰ্গম গিরি পর্বত অতিক্রম করে তাঁবুতে ফেরা সঙ্গত হবে না। অন্ধকারে পথ হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনাই বেশি। তা ছাড়া হিংস্ব জন্তু জানোয়ারদের ভয়ও তাকে শঙ্কিত করে তোলে।

সামনের একটা গাছের ডালে বসে পাখিটা পাখা ঝাপটায়। সেই অন্ধকুরেও জামান দেখতে পায় পাখির ঠোঁটে পাথরটা ধক ধিক করে জুলছে। দারুণ আক্ৰোশে ফেটে পড়ে সে। পাথরের টুকরো কুড়িয়ে নিয়ে ছুঁড়ে মারে। পাখিটা বিশ্ৰী বিদঘুটে একটা আওয়াজ তুলে উড়ে গিয়ে আর একটা গাছের ডালে বসে। জামান তখন উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন দুৰ্গম গিরি পথ ভেঙে পাখিটাকে তাড়া করতে থাকে। কিন্তু বৃথাই সে চেষ্টা। এক সময় ক্লান্ত অবসন্ন দেহটাকে আর টানতে পারে না। একটা পাথরের টিলার উপর বসে পড়ে। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে।

পরদিন সকালে ঘুম ভেঙে দেখে সেই টিলোটার উপরই শুয়ে তার অঘোর ঘুমে রাত কেটে গেছে। পাখিটার ডানা ঝাপটানিতে আবার সে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। মরিয়া হয়ে জামান ওর পিছু পিছু ধাওয়া করে। পাথর ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারতে থাকে। কিন্তু পাখিটা তার নাগালের বাইরে অথচ আশেপাশেই এগাছ ও গাছ লাফিয়ে উড়ে বসে।

জামানের তখন রোখি চেপে বসেছে। যে ভাবেই হোক পাখিটাকে ঘায়েল করে পাথরটা পেতে হবে। কিন্তু সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। পাখিটা একটু একটু করে উড়তে উড়তে আরও অনেকটা পথ তাকে প্রলুব্ধ করে নিয়ে যায়।

সারাটা দিন পাখিটার পিছনে ধাওয়া করতে করতে আবার সন্ধ্যা নেমে আসতে থাকে। জামান ক্লান্ত দেহে বসে পড়ে। দুটো দিন দানা পানি পেটে পড়েনি। তৃষ্ণায় ছাতি ২ ফেটে যাচ্ছে। ক্ষিদেয় পেট জুলছে। এবার সে এদিক ওদিক এগোতেই দেখতে থাকে, কোথাও খাবার কিছু সংগ্বহ করা যায়। কিনা। একটু এগোতেই কয়েকটা আপেল আর চেরী গাছ দেখতে পেলো। সামনে একটা ঝরনা। গোটাকয়েক আপেল আর চেরী ফল পেড়ে গোগ্রাসে খেলো। তারপর আঁজলা করে ঝরনার জল খেয়ে পাশেই একটা জায়গায় শুয়ে পড়লো। আর সঙ্গে সঙ্গে ঘুম।

দুটো দিন দুটো রাত পার হয়ে গেছে। তিন দিনের দিন সকাল বেলায় চোখ খুলেই আবার সেই দৃশ্য। সামনের একটা চেরী গাছের ডালে পাখিটা বসে ডানা ঝাপটাচ্ছে। আবার শুরু হলো পাখি সংহারের প্রচেষ্টা। সে দিনও জামান-এর সব চেষ্টা বিফল হলো। কোনও ক্রমেই সে তাকে কব্জা করতে পারে না। অথচ তারই নাকের ডগা দিয়ে শো করে উড়ে গিয়ে অন্য এক গাছের ডালে অথবা গিরিচূড়ায় বসে। জামানও নাছোড়বান্দা-পাখিটাকে তাক করে করে অজস্র অগুন্তি ঢিল ছুঁড়তে থাকে। কিন্তু পাখিটা এমনই ওস্তাদ তার সব নিশানাকেই অবলীলাক্রমে পাশ কাটিয়ে দিতে পারে। দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতে থাকে। গিরি পর্বতমালা পেরিয়ে এবার সে সমতলভূমিতে এসে পড়ে। চাষীরা যাব। ভুট্টার ক্ষেতে কাজ করে চলেছে। পাখিটা উড়তে গিয়ে বসে কোনও খেজুর গাছের মাথায়। জামান মাটির ঢ়িল তুলে তাক করে মারে। কিন্তু পাখিটা টুক করে উড়ে গিয়ে আরও একটু দূরে আর একটা গাছের ডালে বসে।

জামানের মাথায় তখন খুন চেপে গেছে। ঐটুকু পাখির এই রকম বেয়াদপি সুলতান শাহরিমানের পুত্র হয়ে কিছুতেই সে বরদাস্ত করতে পারে না। মনে হয়, একবার যদি তাকে হাতের মুঠোয় পায়, তাহলে ওর এই ফাজিল চালাকি হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দেবে। কিন্তু হাতের মুঠোয় সে আর এলো না। বরং শাহজাদা জামানকে নাকে দড়ি দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে এসে ফেলল, এক সমুদ্রের ধারে। একটা আখরোটের গাছের ডালে বসে অদ্ভুত উল্লাসের আওয়াজ করতে লাগলো। সে। জামানের সারা শরীর খর রৌদ্রতাপে ঝলসে গেছে। দরদরি করে ঘাম ঝরছে। দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁফ ধরে গেছে। তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে। চোখে সর্ষে ফুল দেখতে। তবু ক্ষোভ আক্ৰোশে জুলতেই থাকে। প্রায় অবসন্ন দেহে একটা মাটির ডেলা তুলে ঈশুনিয়ে প্রাণপণে ছুঁড়ে মারে। পাখিটা ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে আকাশে ওড়ে। জামানের মাথার ওপরে চক্রাকারে কয়েকটা পাক দেয়। জামান আর একটা ঢ়িল হাতে তুলে নেয়। কিন্তু ততক্ষণে পাখিটা অদৃশ্য হয়ে যায়।

জামানের সব আশা ভরসার ইতি হয়ে গেলো। এবার সে মাটির ওপরে থাপ করে বসে পড়ে। চোখে ফেলে জল আসে। এত প্রচেষ্টা সব ব্যর্থ হয়ে গেলো। এখন সে কি করবে? কিছুই ভাবতে পারে না।

অবসাদে দেহ এলিয়ে পড়ে জমানের। সেখানেই ঘাসের উপর গা ঢেলে দিয়ে শুয়ে পড়ে। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে।

ঘণ্টা দুই বাদে ঘুম থেকে জেগে উঠে জামান ভাবতে এখন সে কোথায় যাবে। অচেনা অজানা বিদেশ বিভূঁই। পথ ঘাট কিছুই জানা নাই। একজন পথচারীকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে সামনে এগোলেই কিছুদূরে একটা শহর। জামান সেই দিকে চলতে থাকে। মনে মনে ভাবে, তাঁবু থেকে কত দূর সে চলে এসেছে কে জানে। না জানি তার অদর্শনে বদর-এর কি দশা হয়েছে এ ক’দিনে।

শহরের প্রবেশ দ্বারে এসে হাজির হয় জামান। সড়ক ধরে সোজা ঢুকে পড়ে শহরের অভ্যন্তরে। কেউই তাকে বাধা দেয় না। কোনও প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে না। চারিদিকের ঘরবাড়ি দেখে মনে হয়, শহরটা মুসলমান জনবসতি বহুল। আরও খানিকটা এগাতে একটা বিরাট বাগিচার ফটকের সামনে এসে হাজির হয়। বাগানের মালী সাচ্চ মুসলমান। জামানকে সালাম আলেকুম বলে স্বাগত জানায়। জামানও যথারীতি আলেকুম সালাম জানায়। জামান জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা! জনাব, আমি যখন পথ ধরে আসছিলাম, রাস্তায় যাদের দেখলাম, কেউই আমার সঙ্গে কোনও কথাবার্তা বললো না কেন? সবারই চোখে মুখে, লক্ষ্য করলাম অদ্ভুত এক ঠাণ্ডা কৌতূহল। কী ব্যাপার?

বৃদ্ধ মালী জবাব দেয়, খোদা মেহেরবান, তাই আপনি রেহাই পেয়ে গেছেন, সাহেব। যাদের দেখলেন, ওরা সবাই শত্রু পক্ষের লোক। কিছুদিন হলো শহরটা আক্রমণ করে অধিকার করে নিয়েছে ওরা। ও-ই শয়তান কাফেরগুলো দরিয়ার ওপার থেকে এসে আচমকা আক্রমণ করে এখানকার শান্ত নিরীহ মুসলমানদের খুন জখম করে শহরটা তছনছ করে ফেলেছে। তারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে না। শয়তান তাদের একমাত্র একমাত্র উপাস্য। তারা অসভ্য অশিক্ষিত জংলী ভূত। ওদের প্রিয়খাদ্য পূতিগন্ধময় পচা মাংস আর চর্বি। ওরা কখনও গোসল করে না বা রুজু করে না। শুনেছি, জন্মের সময় বাচ্চার মাথায় এক কলসী জল দেয়। তারা। ব্যস, সারা জিন্দগীভর আর তারা পানি স্পর্শ করে না। তাই এ শহরে ঢুকেই প্রথমে তারা সব হামাম, পানির ফোয়ারা, ঝরনাগুলো ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে। আপনি হয়তো লক্ষ্য করে থাকবেন, মালিক, রাস্তার ধারে দোকানপাটে পসরা সাজিয়ে বসে যারা সবাই মেয়েমানুষ। ওরা সবাই বেবুস্যা। দোকানে ঢুকলে আপনাকে গেলাসে ঢেলে দেবেহাল্কা হলদে রঙের এক ধরনের চিরতা ভিজানো পানি। দেখবেন, ফেনায় ভরে গেছে গেলাসের মাথা। ওরা পানির বদলে ওই জিনিসই খায়। ওকে ওরা বলে ‘পিনেক পানি’। আমার মনে কি হয় জানেন সাহেব, ও জিনিসটা গরু ছাগলের মুত ছাড়া আর কিছু না। কিংবা তার চাইতেও খারাপ কিছু হতে পারে। ওদের মেয়েরা গোসল করে না বটে। কিন্তু এক ধরনের লেবুর রস দিয়ে হাত মুখ সাফা রাখে। ফালা ফালা করে লেবু কেটে তার টুকরোগুলো ঘাড়ে মুখে গলায় ঘসে ফিসে সব ময়লা সাফ করে। ডিমের খোলা গুড়িয়ে ময়দার মতো করে মুখে মাখে ওরা। ওরা একেবারে বেআব্রু। বোরখা পরে না। এ শহরে আমিই বোধহয় একমাত্র জীবিত মুসলমান। ওরা আমাকে মারেনি।

এইসব ভয়ঙ্কর তাজ্জব কথাবার্তা শুনতে শুনতে জমানের মাথা ঘুরতে থাকে। মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। নিজেকে আর সে ধরে রাখতে পারে না। কোনও রকমে ঘাসের উপর বসে পড়তে পারে।

মালী বুঝতে পারে, ছেলেটি অনাহারে অনিদ্রায় কাহিল হয়ে পড়েছে। জামানকে সঙ্গে করে সে তার বাড়িতে নিয়ে যায়। ছোট্ট সুন্দর বাড়িখানা বাগানেরই লাগোয়া। কিছু খানা, খানিকটা শরবৎ তাকে খেতে দেয়। ক্ষুধার্তা জামান তৃপ্তি করে খায়। বৃদ্ধ মালি প্রশ্ন করে, কে বাবা, আপনি? কেন এসেছেন এই সর্বনাশা দেশে?

এই সময় রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

দু’শো আটতম রজনীতে আবার সে শুরু করে :

বৃদ্ধ মালীর সহায়তায় জামান-এর মন ভরে যায়। এমন অচেনা অজানা দেশে এসে এমন একটি দরদী মানুষের সন্ধান পাওয়া ভাগ্যের কথা। জামান তার দুঃখের কাহিনী খুলে বললো তাকে। বলতে বলতে চোখের জলে বুক ভেসে যায়। বৃদ্ধ বুঝতে পারে জামানের মর্মবেদনা। নানাভাবে সাত্মনা দেবার চেষ্টা করে সে।

-কী করবেন। বাবা, সবই খোদাতালার ইচ্ছা। তিনি যা করান। তাই আমরা করি, তিনি যা বলান তাই আমরা বলি। ও নিয়ে দুঃখ করে লাভ নাই। নিয়তির লেখা খণ্ডাতে পারে না কেউ। প্ৰাণ ভরে শুধু তীকে ডাকুন, তিনিই সব সমস্যার সুরাহা করে দেবেন। তবে আমার কি মনে হয় বাবা, জানেন? রাজকুমারী এখন আর ওখানে নাই। একদিন দেখার পরই তারা খালিদানে রওনা হয়ে গেছে। ভেবেছে, আপনার সন্ধান করতে হলে, সুলতান শাহরিমানকে খবর দেওয়া দেওয়া দরকার। তাহলে তিনি চারদিকে লোকলিস্কর পাঠিয়ে তল্লাস করতে পারবেন। আমার এই ছোট্ট গরীবখানায় আপনি কয়েকটা দিন বিশ্রাম করুন। তারপর আমি আপনার দেশে ফেরার ব্যবস্থা করে দেব। এখানকার বন্দরে মাঝে মাঝে খালিদানের সওদাগরি জাহাজ এসে ভেড়ে। কাজকাম শেষ করে আবার তারা ফিরে যায়। ওই রকম যে কোনও একটা জাহাজে চেপে দিব্যি আপনি দেশে চলে যেতে পারবেন। আমি রোজই একবার বন্দরে গিয়ে খোজ নিয়ে আসবো। খালিদানের জাহাজ এলেই আপনি চলে যাবেন। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, কখনও বা দেখা যায় হামেশাই জাহাজ আসছে যাচ্ছে। আবার কখনও বা বছর ঘুরে যায়। তবুও একখানার পাত্তা মেলে না।

বৃদ্ধ মালী তার কথা রাখে। প্রতিদিন সে বন্দরে খোঁজখবর নিতে যায়। কিন্তু দিনের পর দিন কেটে থাকে, জামান জামাই-আদরে তার বাড়িতে দিন কাটাতে থাকে।

আসুন এবার আমরা রাজকুমারী বদর-এর দিকে চোখ ফেরাই। তাঁবুর ভিতরে বদরের ঘুম ভেঙে যায়। এদিক ওদিক তাকিয়ে কামার অল-জামানকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু এদিক ওদিক কোথাও না দেখতে পেয়ে উঠে বসে। হঠাৎ সে বুঝতে পারে তার কোমরের পাথরটা নাই। বদর ভাবে হয়তো তার স্বামী দেখার জন্যে খুলে নিয়ে গেছে। এখুনি এসে পড়বে।

কিন্তু ঘণ্টাখানেক পরেও যখন পর সে ফিরে আসে না বদর চিন্তিত হয়ে। ওঠে। উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। আরও অনেক সময় কেটে যায়, কিন্তু জামান ফিরে আসে না। ক্রমে সন্ধ্যা নেমে আসে, অজানা আশঙ্কায় বদর-এর বুক কেঁপে ওঠে। ঐ মন্ত্রপূত পাথরটার উপরেই তার রাগ হতে থাকে। রাগ হয় তার পাতানো ভাই মারজাবনের ওপর। কেন সে ঐ হতচ্ছাড়া পাথরটা তাকে পরতে দিয়েছিলো? হয়তো। ওরা হাতে ধরাতেই জামানের কোনও বিপদ আপদ ঘটেছে।

সারাটা রাত বিনিদ্র ভাবে কাটে। তারপর দিনও সে দারুণ উৎকণ্ঠা নিয়ে কাটায়। কিন্তু জামান ফিরে আসে না। ভয়ে কাউকে কিছু বলতে সাহস করে না। সঙ্গের চাকর নফররা যদি শোনে, শাহজাদা নাই তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে তাদের মনে বদ মতলব মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। এই চরম সংকটের সময়ে নিজেকে খুব শক্ত সহজ করে রাখার চেষ্টা করে, বদর তার বাঁদীকে বলে, খু হুঁশিয়ার, শাহজাদা তাঁবুতে নাই, একথা যেন ঘুণাক্ষরেও কেউ টের না পায়।

আর মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করে সে তার আশু কর্তব্য ঠিক করে ফেলে। নিজের সাজপোশাক ছেড়ে ফেলে বদর পরে নেয় জামানের সাজপোশাক। মাথায় পরে একটা বাহারী রেশমী টুপী। কোমরে বেঁধে নেয় একখানা ইয়াবড় তলোয়ার। আর বাঁদীটাকে পরিয়ে দেয় তার নিজের পোশাক। এমনভাবে সাজিয়ে তোলে, দেখলে কে বলবে সে-ই বদর নয়।

দুজনে তাঁবু ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। আগে আগে বদর আর পিছন পিছন বাঁদী। সকলে দেখলে, শাহজাদা জামান তার বেগম বদরকে নিয়ে বেরিয়েছেন। আভুমি আনত হয়ে সকলে কুর্নিশ জানিয়ে নতমুখে দাঁড়িয়ে থাকে। বদর বলে, এবার আমরা রওনা হবো, আজই, এখুনি। সবাই তৈরি হয়ে নাও।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বাঁধোচাঁদা শেষ করে আবার, তারা যাত্রা শরু করে। সমুদ্রতীরে এসে একখানা জাহাজ ভাড়া করা হলো। সাগর। পাডি দিয়ে যেতে হবে এবার।

একটানা প্ৰায় দশ দিন চলার পর এবনি দ্বীপের বন্দরে এসে জাহাজ নোঙর করা হলো। শহরের প্রধান প্রবেশদ্বারের মুখে তাঁবু গাড়ার হুকুম দিলো বন্দর। সেখানকার লোকের কাছ থেকে জেনে নিলো, সেই দ্বীপটার নাম-এ বনি দ্বীপ।

-এখানকার অধিপতির কি নাম?

লোকটি জানালো, আমাদের সম্রাট আরমাসুস। তার একটিমাত্র পরমাসুন্দরী কন্যা-ৰ্তার নাম হায়ৎ-আল-নাফুস।

এই সময়ে রাত্ৰি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামায়।

 

পরদিন দুশো নয়তম রজনী :

গল্প শুরু হয় : বদর সেখানকার সম্রাটের কাছে একখানা চিঠি পাঠায়। নিজেকে পরিচয় দেয়-সে খালিদানের সুলতান শাহরিমানের পুত্র কামার আল-জামান।

সম্রাট আরমানুসের সঙ্গে সুলতান শাহরিমানের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ। তাঁর পুত্র এসেছে তার রাজধানীতে, সুতরাং যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে তাকে আদর অভ্যর্থনা করে রাজধানীতে নিয়ে যাওয়া হলো। শহরের গণ্যমান্য সম্রান্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করিয়ে দিলেন সম্রাট। জামানের সম্মানে বিরাট এক ভোজসভার আয়োজন করা হলো। সারা শহর সুন্দর করে সাজানো হলো। তিন দিন ধরে নানা মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানে তাকে বিস্তর আদর অভ্যর্থনা জানানো হলো।

চতুর্থ দিন সকালে উঠে। বদর একাই হামামে চলে গেলো। সঙ্গে কোনও গোসল করাবার লোক নিলো না। নিজেকে ভাল করে ঘষেমেজে নতুন সাজপোশাক পরে তৈরি হয়ে নিয়ে সম্রাট আরমানুসের পাশে এসে বসলো। সম্রাট জিজ্ঞেস করলেন, বাবা, এখন তোমার কি অভিপ্রায় বলো। এখান থেকে কোথায় যাবে?

বদর বলে, তেমন কোনও হিসেব করে বেরুই নি। দেখি, যে দিকে যেতে ইচ্ছে হয়, যাবো। সম্রাট আরমানুস বলেন, তোমার বাবার সঙ্গে আমার বহুকালের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব। তোমার কথাও তার মুখে অনেক শুনেছি। রূপে গুণে তুমি সেরা, শুনেছিলাম। এখন তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ আলাপ করে মুগ্ধ হয়েছি, বাবা। আমার ইচ্ছা, আমার একমাত্র কন্যা হায়াৎ-অল-নাফুসকে তুমি শাদী শাদী করো। তার মতো সুলক্ষণা সুন্দরী মেয়ে বড় একটা হয় না। আমি বাবা, মেয়ের গুণের কথা বড়াই করে বলতে নাই, কিন্তু সত্যিই বলছি বাবা, তার মতো গুণবতী কন্যা—সে একমাত্র তোমারই যোগ্য। নানা দেশের নানা শাহজাদা রাজকুমাররা তাকে বিয়ে করার জন্য পাগল। কিন্তু কাউকেই আমার মনে ধরেনি। তোমাকে দেখার পর, তোমার সঙ্গে আলাপ পরিচয় করার পর আমি মনে মনে ভেবেছি, তোমার জন্যেই সে বুঝি জন্মেছে। এই সবে সে পনেরোয় পা দিয়েছে। আমি বৃদ্ধ হয়েছি, আর ভোগবিলাস ভালো লাগে না, তুমি যদি রাজি হও বাবা, তবে তোমার হাতে মেয়েটাকে তুলে দিয়ে তোমাকে আমার সিংহাসনে বসিয়ে আমি বাণপ্রস্থ নিতে চা।

রাজকুমারী বন্দর সম্রাটের কথায় বিচলিত বোধ করে। অনেকক্ষণ মুখে কোনও কথা সরে না। হাত পা হিম হয়ে আসতে থাকে। বুকের মধ্যে ঢ়িব ঢ়িব করতে থাকে। তখনকার সেই শীতশীত হিমেল হাওয়ার দিনেও সে ঘেমে নেয়ে ওঠে। হাড়ে কাঁপুনি ধরে। মনে মনে ভাবে, এখন যদি তাকে বলি, আমি রাজকুমারী বন্দরকে শাদী করেছি, আমার পক্ষে তার এ প্রস্তাব আর গ্রহণ করা সম্ভব না, তখন তিনি নিশ্চয়ই বলবেন, মুসলমান ধর্মশাস্ত্রে নির্দেশ আছে—একজন পুরুষ এক সঙ্গে চারটি বিবি রাখতে পারে। বদর যদি তার প্রথমা হয়, হায়াৎ না হয় হবে দ্বিতীয়া বেগম। তাতে কি অসুবিধা? আর যদি আসল কথা তাকে খুলে বলা যায়, আমি ছদ্মবেশী কামার। অল-জামান। আসলে আমিই রাজকুমারী বন্দর। তখন এই বৃদ্ধ বয়সেও সম্রাটের কামনা বাসনা চেগে উঠবে। তিনি বলবেন, তাহলে আর তোমাকে ছাড়িছি না, সুন্দরী। তুমি হবে আমার পিয়ারের বেগম। আমি হবো তব মালঞ্চের মালাকির। কামের ব্যাপারে বুড়োদের ঘাড়ে ভীমরতি চেপে বসে। আর আমি যদি কামার আল-জামানের ছদ্মবেশেই তার কন্যার পাণিগ্রহণে অক্ষমতা জানিয়ে তাকে প্রত্যাখান করে চলে যাই তবে, এই মুহূর্তেই যত সব স্নেহ ভালোবাসা পলকে প্রচণ্ড আক্ৰোশে ফেটে পড়বে। হয়তো বা এমনও হতে পারে, তার রাজধানী ত্যাগ করার সঙ্গেই সঙ্গেই তিনি আমাকে হত্যা করার জন্য ষড়যন্ত্র করবেন। সুতরাং নানা পস্থা, এই অবস্থায় তার প্রসত আবে আপাতত রাজি হওয়া ছাড়া উপায় নাই। এরপর নিয়তি আমাকে নিয়ে যে-খেলা খেলবে তাই খেলতে হবে। কে বলতে পারে! কারভাগ্যে কি লেখা আছে। সেই বিধি লিপি কেউ কি খণ্ডাতে পারে! সুতরাং ও নিয়ে আর দুর্ভাবনা করে কোনও লাভ নাই। যা হবার তাই ঘটবে। এতে মানুষের কোনও হাত নেই।

বদর মাথা তুলে সম্রাট আরমানুসের দিকে তাকালো। মুখে সলজ্জ স্নিগ্ধ হাসির আভাস। সম্রাট বুঝলেন, শাহজাদা স্বভাবসুলভ ভব্যতায় এই কথার সোজাসুজি জবাব দিতে কুষ্ঠাবোধ করছে। বিনয় বিনম্র কণ্ঠে সে বলতে পারে, এসব ব্যাপারে আমার আর নিজের কি মতামত থাকতে পারে। তাছাড়া, আপনি আমার বাবার পরম বন্ধু। আপনার ইচ্ছা আমার পিতার আদেশতুল্য। আমি তা অপূর্ণ রাখতে পারি না।

বদরের কথায় আনন্দে নেচে ওঠেন আরমানুসু, এই তো সুলতান শাহরিমানের পুত্রের মতো কথা। তাঁর শিক্ষাদীক্ষার কায়দাই আলাদা। তোমাকে যেভাবে তিনি গড়ে তুলেছেন তার নজির মেলা ভার। আজকালিকার দিনে তোমার মতো আচার ব্যবহার আদব কায়দা আমি খুব কম ছেলের মধ্যেই দেখছি, বাবা।

সম্রাট আর ধৈর্য ধরতে পারেন না। তৎক্ষণাৎ দরবার-এ সভা ডাকা হলো। শহরের গণ্যমান্যরা এসে জড়ো হলো। মন্ত্রী, পারিষদ এবং সেনাপতিদের সামনে তিনি ঘোষণা করলেন, খালিদানের বাদশাহ শাহরিমানের একমাত্র পুত্র কামার আল-জামানের সঙ্গে আমার একমাত্র কন্যা হায়াৎ আল নাফুসের বিবাহ আজ সন্ধ্যায় সম্পন্ন হবে। এই দরবারের উপস্থিত নাফুসের বিবাহ আজ সন্ধ্যায় সম্পন্ন হবে। এই দরবারের উপস্থিত থেকে পাত্বপাত্রীর শুভকামনা করতে আহ্বান জানাচ্ছি।

দরবারকক্ষ করতালি-মুখরিত হয়ে উঠলো, সম্রাট আরমানুসের দ্বিতীয় ঘোষণা : আমি বৃদ্ধ হয়েছি, এখন অবসর গ্রহণ করে ঈশ্বরের উপাসনা করে দিন কাটাতে চাই। তাই মনস্থ করেছি, এখন থেকে এই সিংহাসনের অধিকারী হবে। আমার জামাতা কামার আল-জামান। আপনারা আমার প্রতি এতকাল যে আনুগত্য দেখিয়েছেন, আমি আশা করবো, আমাদের এই নতুন সম্রাট-এর প্রতি সেরূপ আনুগত্য এবং মর্যাদা প্রদৰ্শন করবেন।

এবার ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ হলো দরবার মহল। সবারই চোখে বিস্ময়—মুহূর্তে আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠলো অভ্যাগতরা। করতালী ধ্বনিতে ফেটে পড়লো দরবার কক্ষ। জনে জনে এসে শাহজাদাকে আতর গোলাপ জল আর ফুল মালা দিয়ে বরণ করতে লাগলো।

রাজধানীতে সেদিন সে কি সমারোহ। খানাপিনা, নাচ গান হৈ হাল্লায় সবাই মাতোয়ারা হয়ে উঠলো। ধনী দরিদ্র সবার কাছেই সেদিন রাজপ্রাসাদের দ্বার উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিলো। যে যা পারলো-খেলো। সবাই মুগ্ধ। দু’হাত তুলে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানাতে থাকে সকলে—তারা যেন সুখে থাকে, শতায় হয়। শহরের সেরা কাজীকে ডেকে শাদীনামা লেখানো হলো। সেইদিন সন্ধ্যাবেলায় যথারীতি আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দুজনের শাদী হয়ে গেলো। কামার আল-জামানের ছদ্মবেশে বদর হলো হায়াৎ অল নাফুসের নকল স্বামী।

হায়াৎ অল নাফুসকে বদরের শয্যাকক্ষে পৌঁছে দিয়ে এলেন। এ দেশের এ-ই প্রচলিত রীতি। বদর এগিয়ে এসে পাত্রীকে সাদরে বরণ করে নিলো। তার কুসুমের মতো পেলাব একখানা হাত ধরে নিয়ে গিয়ে বসালো পুস্পপালঙ্কে-নিজেও বসলো তার পাশে। মুখের নাকাবি উঠিয়ে শুভদৃষ্টি বিনিময় করে নিলো। এ-ও প্রচলিত রীতি।

মেয়েটির মুখ আনত, চোখ নিমীলিত। বদর দেখলো, মেয়েটির মুখে এক অজানা আশঙ্কা। চোখে মুখে কোনও হাসি আনন্দের ছাপ নাই, —যেন পাণ্ডু বিবর্ণ। বদর মৃদু কণ্ঠে সোহাগ মাখিয়ে বলে, কই, মুখ তোলো, চেয়ে দেখো—আমি তোমার মতো এত রূপসী না হতে পারি। তবে হত-কুৎসিত নই।

এবার হায়াৎ চোখ মেলে তাকায়। বদরের রূপের তুলনায় তার নিজের রূপ নগণ্য মনে হয়। এমন বেহেস্তের রূপে সে রূপবান, অথচ কত বিনয়—বলে কিনা, তার মতে রূপ নাকি তার নাই? খুশিতে ডগমগ হয়ে ওঠে সে। আনন্দে নেচে ওঠে। হৃদয়। মনে মনে তার শঙ্কা ছিলো, না জানি তার স্বামী দেখতে কেমন হবে। হয়তো কোনও বুড়ো হাবড়ার হাতেই তুলে দেবেন তার বাবা। কিন্তু না, সে আশঙ্কা তার কেটে গেছে। এরকম সুন্দর স্বামী সে পাবে তাও অবশ্য আশা করতে পারেনি।

এমন সময় রাত্রি শেষ হয়ে যাচ্ছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পরদিন দুশো দশতম রজনীর মধ্যভাগে আবার সে শুরু করে :

বদর তার সারা দেহ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে থাকে। তার টানা টানা কাজল কালো আয়ত চোখ, টিকলো নাক, আপেলের মতো গাল, পাকা আঙুরের মতো ঠোঁট, সুগঠিত স্তন, ভারী নিতম্ব বড় সুন্দর। এককথায় হায়াৎ-অল নাফুসকে তার পরমাসুন্দরী বলে মনে ধরে। ক্ষণিকের জন্য মনের নিভৃত কোণে একটুকরো হিংসার কালো মেঘ উকি মেরে অদৃশ্য হয়ে যায়।

বদর তার একখানা হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে আদর করে। এতক্ষণ ভীত চকিত হরিণীর মতো গুটিয়ে রেখেছিলো। না জানি তাকে তার স্বামীর পছন্দ হয়েছে কিনা। এবার সে কিছুটা সাহস পায়। বদর আরও কাছে সরে এসে হায়াৎকে চুমু খায়। হায়াতের সারা দেহ পুলকে রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে। এক অভূতপূর্ব উত্তেজনায় চঞ্চল হয়ে ওঠে দেহমন। চুম্বনের স্বাদ যে-এমন সে এই প্রথম বুঝলো। খুব ভালো লাগলো। সে ভালোলাগা কোনও ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। একতরফা বদরের চুম্বন সে প্রাণভরে আস্বাদ করলো। কিন্তু প্রতিদানে সে তাকে ফিরিয়ে দিতে পারলো না একটা। ইচ্ছে হয়েছিলো, কিন্তু দুস্তর লজ্জা এসে তাকে নিরস্ত করে দিলো।

আলতো করে দু’হাত ধরে হায়াৎকে সে বিছানায় শুইয়ে দিলো। কপালে ঠোঁটে, গালে, গ্ৰীবায় স্তনে চুমুতে চুমুতে ভরে দিলো বন্দর। সারা গায়ে হাত বুলিয়ে আদর-সোহাগ করতে থাকলো। এক সময়ে সে দেখলো, হায়াৎ ঘুমিয়ে পড়েছে। মুখে তার পরম প্রশান্তি। বদরও এক পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।

সকালে ঘুম ভাঙতেই হামামে ঢুকে নিজেকে তৈরি করে নিলো বন্দর। আজ থেকে তার দরবারে বসতে হবে। তার হাতেই শাসন দণ্ড তুলে দিয়েছেন সম্রাট আরমানুস। যথাসময়ে সে সুলতানি গান্তীর্য নিয়ে দরবারে আসে। মন্ত্রী ছুটে এসে তাকে অভ্যর্থনা করে নিয়ে গিয়ে সিংহাসনে বসায়। দরবারে উপস্থিত আমীর অমাত্য সেনাপতিরা আভূমি আনত হয়ে তাকে অভিবাদন জানায়। বদর সকলকে নিজের নিজের আসন গ্রহণ করতে বলে। তারপর শুরু হয়। দরবারের কাজকর্ম।

দরবারের মন্ত্রী আমীর অমোত্যরা দেখে মুগ্ধ হয়, শাহজাদা কি অদ্ভুত দক্ষতার সঙ্গে সব কাজ কত স্বল্প সময়ে চটপট সমাধা করে দিলো। বদর বললো, আদালতের বিচার পদ্ধতির সংস্কার করতে হবে। অপরাধীকে শুধুমাত্র শাস্তি দিলেই সব দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। কেন মানুষ অপরাধ করে, কারণ অনুসন্ধান করে তার প্রতিকার করতে হবে। অপরাধীকে শাস্তি অবশ্যই দিতে হবে। কিন্তু সেই শাস্তির বিধান দেওয়ার সময় বিচারকের হৃদয় ব্যথায় মথিত হবে-এই-ই হওয়া উচিৎ। বিচারে সন্দেহের অবকাশ থাকলে কারো প্ৰাণদণ্ড হবে না। মনে রাখতে হবে, দেশের প্রতিটি মানুষ তার প্রজা। প্রজা যদি অবিনয়ী, উদ্ধত, স্বৈরাচারী হয়ে পড়ে তার জন্য মূলত প্রশাসনই দায়ী।

এদিকে আরমানুস তার মহারানীকে সঙ্গে নিয়ে কন্যা হায়াৎ আল-নাফুসের মহলে এসে উপস্থিত হন। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে আদর করে মা জিজ্ঞেস করেন, হ্যারে বর পছন্দ হয়েছে তো?

হায়াৎ সলজ্জভাবে সাড়া দেয়, খু-ব পছন্দ হয়েছে মা! আমাকে কত আদর করেছে। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাডিয়ে দিয়েছে।

মা জিজ্ঞেস করেন, শুধু এই! আর কিছু করেনি?

–আর আবার কী করবে? বললাম তো খুব আদর করেছে।

—দূর বোকা মেয়ে, সে কথা জিজ্ঞেস করিনি!

–তবে?

ঘুমুবার আগে সে তোকে গ্রহণ করেনি?

হায়াৎ বুঝতে পারে না মা তাকে কী বোঝাতে চাইছেন।–গ্রহণ মানে কী মা?

মা বুঝলেন মেয়ে একেবারে অর্বাচীন। সোজাসুজি কিভাবে তাকে সে-কথা জিজ্ঞেস করবেন। বুঝতে পারেন না। শোবার আগে সাজপোশাক খুলেছিলি?

মেয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। একটু পরে বলে, না। কিন্তু মা, কেন একথা জিজ্ঞেস করছে?

মহারানী গভীরভাবে বলে, ও কিছু না। ঠিক আছে, তুমি বিশ্রাম করো। আমরা আবার পরে আসবো।

মা-বাবা দুজনে চোখে চোখে কি যেন কথা বলে? হায়াৎ বুঝতে পারে না। চিন্তিত মুখে তারা দুজনে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

দরবারের কাজকর্ম সেরে বদর হায়াতের কাছে আসে। হায়াৎ-এর মনে তখন মা-এর ঐসব হেঁয়ালিভরা প্রশ্নগুলো তোলপাড় করছিলো। বদর কাছে এসে হায়াতের ঘাড়ে হাত রাখে, কী ভাবছো, হায়াৎ?

–না-না, কিছু না তো

হায়াতের অন্যমনস্কতা কেটে যায়। বদর জিজ্ঞেস করে, বাবা মা দেখা করতে এসেছিলেন?

হায়াৎ ঘাড় নাড়ে, হ্যাঁ।

-কী জিজ্ঞেস করলেন তারা?

হায়াৎ বললো, রাতে শোবার আগে তুমি আমার সাজপোশাক খুলে দিয়েছিলে কিনা? কিন্তু ওকথা তারা কেন জানতে চাইলো, বলতো?

বদর মুচকি হাসে, ওই রকমই রীতি। শাদীর পরে বাসর ঘরে পাত্র নিজে হাতে খুলে দেয়। পাত্রীর সাজপোশাক। তারপর তারা একসঙ্গে শোয়। কিন্তু কাল রাতে তুমি বড় ক্লান্ত ছিলে। শোবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়লে। তাই আর তোমাকে বিরক্ত করিনি। তা এসো, আজ তোমাকে সেইভাবে শুইয়ে দিই।

বদর এক এক করে হায়াতের সব সাজপোশাক খুলে দু’হাতে চ্যাংদোলা করে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিলো। খুব আলতো ভাবে সে তার গালে একটা ছোট্ট চুমু একে দেয়। জিজ্ঞেস করে পুরুষ মানুষকে খুব ভালো লাগে তোমার?

হায়াৎ জবাব দেয়, জীবনে হারেমের খোজা ছাড়া অন্য কারো মুখ দেখিনি আমি। কিন্তু তাদের দেখে কি পুরুষ বলা যায়? মনে হয় তারা পুরোপুরি মানুষই না। একটা পুরুষ বা নারীর যা যা দরকার তার কোনওটাই তাদের নাই। আচ্ছা বলতো, সাবই ওদের আধা মানুষ বলে কেন? কী তাদের নাই?

বদর হাসে, কেন, জানো না? তোমার যা নাই-তাদেরও তা নাই।

-সে আবার কী?

–বোকা মেয়ে, সে তুমি পরে ধীরে ধীরে বুঝবে।

হায়াৎকে জড়িয়ে ধরে চুমায় চুমায় ভরে দেয়। হায়াৎ সারা দেহে কি এক রোমাঞ্চ অনুভব করে। উত্তেজনায় কেঁপে উঠতে থাকে। বদর তার গায়ে মাথায় আদর করে হাত বুলিয়ে দেয়।

একসময় তারা দুজনেই কখন ঘুমিয়ে পড়ে।

প্রভাত সমাগত দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

দুশো এগারতম রাত্রে আবার কাহিনী শুরু হয় :

সকালে উঠে নিজেকে তৈরি করে বদর দরবারে চলে যায়। সম্রাট আরমানুস মহারানীকে সঙ্গে নিয়ে হায়াতের মহলে আসেন। আজ রাত কেমন কাটলো মা?

হায়াৎ বলে, খুব ভালো, বাবা, খুব সুন্দর।

আরমানুস বলে, এখনও তুমি শুয়ে আছে—দেখছি, মা। সারা রাতে কি অনেক ধকল হইতে হয়েছে?

—না বাবা, মোটেও না। বড় আরামে ঘুমিয়েছি। সে আমাকে খুব আদর সোহাগ করেছে। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাডিয়ে দিয়েছে। কাল সে নিজে হাতে আমার সব সাজপোশাক খুলে দিয়েছিলো। সারা শরীর চুমায় চুমায় ভরে দিয়েছিলো। কি যে ভালো লেগেছিলো, তোমায় কি করে বোঝাবো বাবা। মনে হচ্ছিল, আমি স্বগে চলে যাচ্ছি।

মহারানী জিজ্ঞেস করলেন, কিন্তু তোমার রাতের সেই তোয়ালেটা কোথায়, দেখি। খুব কি রক্ত করেছিলো?

হায়াৎ। অবাক হয়ে বলে, তোয়ালে তো নিইনি, মা। আর রক্ত ঝরবে কেন?

মেয়ের এই কথা শুনে মা-বাবা দুজনেই কপাল চাপড়াতে লাগলেন, হায় আমার কপাল, তোমার স্বামী এভাবে তোমাকে বঞ্চিত করছে কেন, মা?

সম্রাট আরমানুসের মুখের পেশী কঠিন হতে কঠিনতর হয়ে ওঠে। মহারানীকে উদ্দেশ করে বলেন এতো খুব খারাপ কথা মহারানী। সে যদি তার কর্তব্য না করে, আমাকে তো অন্যরকম ভাবতে হবে। স্বামী-স্ত্রীর স্বাভাবিক সম্পর্কই যদি তৈরি না হয়, এ বিয়ে দিয়ে কি ফয়দা হলো? কাল সকাল যদি শুনি, হায়াৎ তখনও কুমারীই রয়ে গেছে তাহলে আমি কিন্তু আর চুপ করে থাকবো না, মহারানী। কামার আল-জামানের হাত থেকে কেড়ে নেবো আমার সিংহাসন। আমার মেয়েকে সে বঞ্চিত করবে। আর আমি তাকে মাথায় করে নাচবো, তা হতে পারে না।

মহারানী বলেন, অতি উত্তেজিত হও না। ঠাণ্ডা মাথায় ভালো করে আগে ভেবে দেখো সব। তার হাত থেকে সিংহাসন কেড়ে নিয়ে দেশ থেকে তাডিয়ে দিলে তার পরিণাম কি হবে ভেবে দেখেছি?

—কী আবার হাতি ঘোড়া হবে। হায়াতের আবার আমি বিয়ে দেব। একটা মাত্র মেয়ে আমার। একটা অপদার্থ রাঙামূলোর সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে সারাটা জীবন তো সে বরবাদ করে দিতে পারে না!

–কিন্তু মহারানী বলেন, এতে জামানের বাবা সুলতান শাহরিমান যদি ক্রুদ্ধ হন?

সম্রাট আরমানুস উত্তেজিত কণ্ঠে বলে, ওসবে আমি ভয় করি না। যা হবার তা হবে।

দরবারের কাজ শেষ করে রাত্রে আবার হায়াতের কাছে আসে বদর। গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ রেখে হায়াৎকে সে আদর সোহাগ করতে থাকে। হায়াতের চোখে জল দেখে সে অবাক হয়, কী ব্যাপার, কাঁদছো কেন হায়াৎ? আসতে আমার দেরি হয়েছে বলে?

হায়াৎ ঘাড় নাড়ে, না। আজ সকালে মা বাবা এসেছিলেন। বাবা খুব রেগে গেছেন। তিনি বললেন, তোমার হাত থেকে সিংহাসন তিনি কেড়ে নেবেন।

বদর হাসে, কী আমার গোস্তাকি?

হায়াৎ বলে, বিয়ের পর দুটো রাত কেটে গেলো, এখনও তুমি আমাকে কুমারী করেই রেখেছ, তাই তারা ভীষণ রেগে গেছেন। বাবা বলে গেছেন, আজ রাতে যদি তুমি আমার দেহ গ্রহণ না কর, শুধু সিংহাসনই তিনি কেড়ে নেবেন না, আরও মারাত্মক ঘটনা ঘটতে পারে। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। শাহজাদা। বাবার রাগ তো আমি জানি, রেগে গেলে তাঁর আর কোনও কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। তোমার যদি কোনও অনিষ্ট হয়–

—আমার অনিষ্ট হলে তোমার খুব কষ্ট হবে?

—বারে, কি যে বলো?

বদর মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করে, তুমি আমাকে ভালোবাসো, না? হায়াৎ বদরের বুকে মুখ লুকায়, তুমি যে খু-ব ভালো, তোমাকে পেলে কেউ ভালো না বেসে থাকতে পারে? সারাদিন আমি তোমার বিপদের আশঙ্কায় কেঁদেছি। যাইহোক, আমার একটা কথা শোনো, সোনা। বাবা-মা যা চান তুমি সেই ভাবেই চলো। আমার কুমারীত্ব খোয়া গেলে যদি তাদের মুখে হাসি ফোটে, তাই না হয় করলে! কাল সকালে মা এসে আগে আমার তোয়ালে দেখতে চাইবেন। রক্তের দাগ যদি না দেখতে পান তা হলে আর রক্ষা থাকবে না তোমার। সেই ভেবেই আমার বুক কাঁপছে। আমি আর ভাবতে পারছি না, প্রিয়তম। এই দেহ মন প্ৰাণ-আমার বলতে যা সবই তোমার হাতে তুলে দিয়েছি। তুমি যা ভালো বোঝ, তাই কর। আমার নিজের মত বলতে আলাদা কিছু নাই। তোমার মতই আমার মত, তোমার পথই আমার পথ।

বদর মনে মনে বলে, এই মওক, এখন হায়াৎকে যা বোঝানো যাবে তাই বুঝবে, যা বলা যাবে। তাই সে করবে। মহব্বতের মায়া জালে সে এখন আবদ্ধ। হায়াৎকে আরও নিবিড়ভাবে কাছে টেনে নিয়ে বদর বলে, শোনো, নয়ন তারা, তুমি যেমন আমাকে ভালোবাস, আমি তার কিছু অধিক তোমাকে ভালোবেসেছি। এ ভালোবাসার মধ্যে কোনও গলদ নাই, এ-কথা তো মান?

হায়াৎ বলে, একশোবার। ফুলের নির্যাসের মত নিখাদ আমাদের মহব্বৎ।

বদর বলে, আমি একটা কথা বলবো হায়াৎ?

হরিণীর মতো কাজল কালো ডাগর চোখ মেলে তাকায় হায়াৎ-কী? কী এমন কথা?

—ধর যদি আমাদের সম্পর্কের মধ্যে কামনা বাসনার কোনও গন্ধ না-ই থাকে?

–খু-ব ভালো হয়। আমি বুঝতে পারি না, মা-বাবা কি সব বলছেন। তোমার আমার সম্পর্ক তো সুন্দর, ভালোবাসায় কোনও খাদ নাই।

বদর বলে তোমার সঙ্গে যদি আমার ভাই-বোনের সম্পর্ক হয়—তুমি কি দুঃখ পাবে?

—মোটেই না। খুব ভালো হবে। একসাথে হেসে খেলে আমাদের দিন কাটবে। তুমি আমাকে তোমার মনের কথা বলবে। আমি খুলে দেব আমার মনের দরজা। আমার নিঃসঙ্গ জীবন ফিরে পাবে এক অন্তরঙ্গ দোসর।

বদর এবার আরও এক ধাপ এগোয়, আচ্ছা, হায়াৎ সুন্দরী, ধর, আমি যদি তোমার ভাই না। হয়ে বোন হই? তখন তুমি আমাকে কিভাবে নেবে? তখনও কি তুমি আমাকে এমনিভাবেই ভালোবাসতে পারবে?

হায়াৎ উচ্ছল। আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে, আরও মজা হবে, আরও বেশি করে তোমাকে ভালোবাসবো তাহলে। তুমি হবে আমার সব সময়ের সখী! কেউ আমাদের ভালোবাসায় চিড় খাওয়াতে পারবে না। কোনওদিন আমরা ছাড়াছডি হবো না।

বদর ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে বলে, হায়াৎ, তোমাকে একটা মজার জিনিস দেখাবো। কিন্তু তার আগে তোমাকে কসম খেয়ে বলতে হবে, কাউকে সে-কথা বলবে না।

হায়াৎ অবাক হয়, ওমা, এতে সন্দেহ অবিশ্বাসের কি আছে। আমি তো আগেই বলেছি, তোমার ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা। তুমি যা বলবে তাই আমি করবো। তুমি যা বারণ করবে তা আমি বলবো কেন? তবু যখন বলছো, কসম খেয়েই বলছি, কাউকে বলবো না-হলো তো।

বদর আর একটা দীর্ঘ চুম্বন একে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। এক এক করে নিজের দেহ থেকে সব সাজ-পোশাক খুলতে থাকে। হায়াৎ বিস্ময় বিস্ফারিত চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে। নিজের সুডৌল স্তন দুটি দু’হাতের থাকায় পুরে বদর হাসতে হাসতে বলে, কী, কী দেখছে? ভাবছো, আমি কি মহা ধড়িবাজ শয়তান? না?

হায়াৎ বলে, ধুৎ, কি যে যা তা বলো। কিন্তু কেন তুমি এখানে পুরুষের বেশে এসেছিলে দিদি? কিসের জন্য এই রকম মারাত্মক ছদ্মবেশ ধারণ করতে হয়েছে তোমায়?

বদর বললো, বলবো, সবই বলবো তমাকে বোন, একবার যখন আমরা ভালোবেসেছি, অন্তরের কোনও গোপন কথাই আর লুকিয়ে রাখা সম্ভব না। তবে সে দুঃখের কাহিনী শুনলে তুমিও কাঁদবে। তা কাঁদো, আমি আর কোন কথা লুকাবো না। আজ সারা রাত ধরে আমার কাহিনী শোনো তুমি।

পালঙ্কে উঠে এসে হায়াতের পাশে বসে কামার আল-জামানের সঙ্গে তার প্রথম রাত্রির মিলন থেকে শুরু করে তাঁবু থেকে রহস্যজনক অন্তর্ধান পর্যন্ত আদ্যোপোন্ত সব কাহিনীই সবিস্তারে বলে গেলো।

কিশোরী হায়াৎ মুগ্ধ বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে বদরের বুকে মাথা রাখে। বদর ওর কপালে হাত বুলাতে বুলাতে বলে, নিয়তির কি নির্মম পরিহাস, বোন। আবার কবে–কামার আল-জামানকে ফিরে পাবো, কে জানে। তবে এ বিশ্বাস আছে, আমাদের অন্তরের বন্ধন কেউ ছিঁড়তে পারবে না। একদিন না একদিন তার সঙ্গে আমাদের মিলন হবেই। তাঁর কাছে সদাসর্বদা প্রার্থনা জানাচ্ছি। সে যেন সত্বর। ফিরে আসে। আমার মনের কি বাসনা জান বোন? জামান-এর হবে তুমি দ্বিতীয়া বেগম। আমরা দুই বোন এক সাথে সারাটা জীবন কাটাবো, এই আমার  একান্ত ইচ্ছা!

হায়াৎ বলে, কিন্তু তিনি যদি আমাকে গ্রহণ না করেন।

–সে ভার আমার। আমার কথা সে ফেলতে পারবে না। তাছাড়া তোমার মতো রূপসী মেয়েই বা কটা মেলে। তোমাকে পেলে সে খুব খুশিই হবে।

আহ্লাদে আটখানা হয়ে পড়ে হায়াৎ। বদরের নগ্ন দেহখানা নিয়ে খেলা শুরু করে। এবার আর কোনও জড়তা নাই, নিজেই বদরকে চুমু খায়। হাতের মুঠিতে তার সুগঠিত স্তন দুটি পিষ্ট হতে থাকে। হায়াৎ বলে, আচ্ছা দিদি তোমার দুটো তো বেশ বড় বড়। আমার দুটো এত ছোট ছোট কেন?

বদরের চোখে দুষ্টু হাসি, সবুর কর, সময়ে ওরাও এই রকম ডাঁসা হয়ে উঠবে।

বদরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঙ্গে সে তার নিজের দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মিলিয়ে মিলিয়ে দেখতে থাকে। হায়াৎ বলে, জান দিদি, আমি আমার দাসীবাদীদের কাছে অনেকবার জানতে চেয়েছি, শরীরের কোন অঙ্গটা কী জন্যে তৈরি, তা সে বেটিরা আমার কথার সোজাসুজি কোনও জবাব দেয়নি। সব সময়ই আকারে ইঙ্গিতে কি সব বোঝাতে চেয়েছে। সেগুলো আমার মাথায় ঢোকেনি। তুমি আমাকে সব বুঝিয়ে দাও তো, কোন অঙ্গটা কি দরকারে লাগে? একদিন একটা মজার ঘটনা ঘটেছিলো। আমি হামামে গোসল করছি, গায়ে সাবান মাখিয়ে দিচ্ছে আমার এক বাদী। তাকে আমি চেপে ধরলাম, আজ তোমাকে বলতেই হবে, আমার শরীরের এই সব অঙ্গগুলো, কী দরকারে লাগে। তা সে বেচারী ভয়ে লজ্জায় কোনও জবাব দিতে পারে না। রাগি না রাগি না, কিন্তু রাগলে আমি আর মানুষ থাকি না। বাঁদরী আমার কথার জবাব দিচ্ছে না দেখে আমার জেদ চেপে গেলো। দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে চিৎকার করতে লাগলাম, বল শিগ্‌গির, বলতেই হবে তোকে। চুপ করে থাকলে আমি ছাড়বো না।

আমার চিৎকারে সারা মহলে তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো। মা ছুটে এলেন, কী? কী হয়েছে? আমন চেঁচাচ্ছো কেন?

আমি তো চুপ। বাঁদীর মুখেও কথা নাই। মা কিন্তু ছাড়বার পাত্রী নন। বাঁদীকে প্রশ্ন করতে সে বললো, রাজকুমারী জানতে চাইছেন, শরীরের এই সব অঙ্গ দিয়ে কি হয়?

মা-র মুখ গম্ভীর হয়ে গেলো। আর একটিও কথা বললেন না। ঠাস করে আমার গালে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন, বাঁদর মেয়ে কোথাকার। ফের যদি শুনি তুমি এই সব নিয়ে দাসী বাঁদীদের সঙ্গে আলোচনা করেছ, কেটে ফেলবো।

তারপর থেকে আমি আর কখনও কাউকে জিজ্ঞেস করতে সাহস করিনি।

বদর বললো, ঠিক আছে, তোমাকে আমি সব শিখিয়ে দিচ্ছি, কোনটা কি কাজে দরকার হয়।

বাকী রাতটুকু বন্দর তাকে কামসূত্রের প্রতিটি স্তর বিষদভাবে বুঝিয়ে দিতে থাকে। এক সময়ে ভোর হয়ে আসে। হায়াৎ উৎকণ্ঠিতভাবে বলে, কিন্তু দিদি সকাল হলে মা বাবা আসবেন। মা আমার তোয়ালে দেখতে চাইবেন। কি হবে?

বদর বললো, কিছু ভেবো না, আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

মহলের এক পাশে পাখীর খাঁচা ছিলো। বদর উঠে গিয়ে একটা পাখী বের করে নিয়ে এসে হামামে গেলো। একটুক্ষণ পরে খানিকটা খুন এনে বললো, এসো, তোমার দুই জংঘায় খানিকটা লাগিয়ে দিই। আর একটা তোয়ালে দাও। মাখিয়ে রাখি। কাল সকালে যখন মা দেখতে চাইবেন। এই রক্তমাখা তোয়ালেটা তাকে বের করে দেখিয়ে দিও! তোমাকে যদি পরীক্ষা করতে চান, দেখতে পাবেন তোমার জংঘায় শুকনো রক্তের ছোপ। বাস, কেল্লা ফতে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়বেন তিনি। খুব বেশি আনন্দ বা দুঃখ হলে মানুষ তার বিচক্ষণতা হারিয়ে ফেলে। এ ক্ষেত্রেও তাই হবে। তোমার জংঘায় রক্তের দাগ দেখার সঙ্গে সঙ্গে তিনি খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠবেন। আর তোমাকে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে দেখবেন না।

হায়াৎ বলে, কিন্তু এ সবের কি দরকার? পাখীর রক্ত না লাগিয়ে আমার শরীরের রক্ত তো তুমিই বের করে দিতে পোর, দিদি।

–পারি, কিন্তু দেব না। ওটা কামার আল-জামানের সম্পত্তি। ওখানে আমি হাত লাগাবো না।

পরদিন সকালে বদর যথারীতি কামার আল-জামানের ছদ্মবেশে আবার দরবারে চলে যায়। সম্রাট আরমানুস আর মহারানী এসে হাজির হন হায়াতের মহলে। রাগে ক্ষোভে সাপের মত ফুঁসতে থাকেন সম্রাট। আজ একটা হেস্তনেস্ত তিনি করবেনই। এভাবে মেয়ের জীবনটা তিনি নষ্ট হতে দেবেন না। কিন্তু পলকেই সব রাগ জল হয়ে গেলো। তাঁর। হায়াৎ রক্তমাখা তোয়ালেখানা বের করে মা-কে দেখালো। মা দেখলেন, মেয়ের জংঘায় উরুতে শুকনো রক্তের দাগ।

-ওগো শুনছো, মহারানী আনন্দে চিৎকার করে ওঠেন, আমাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়েছে। জামাই আজ মেয়েকে গ্রহণ করেছে।

সারা প্রাসাদে আনন্দের হিল্লোল বইতে লাগলো। শুভ সংবাদ মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়লো শহরময়। নাচ-গান হৈ-হাল্লায় মেতে উঠলো সকলে। সম্রাট ঘোষণা করলেন, আজ ছুটির দিন, দরবার দপ্তর সব বন্ধ থাকবে। আজ শুধু খানাপিনা আর আমোদ-আহাদ করে কাটাবে সকলে।

রাজকুমারীর রক্তমাখা তোয়ালে নিয়ে জাঁকজমক করে শোভাযাত্রা বেরুলো। শহরের নানা পথ-পরিক্রম করে বিকেল নাগাদ আবার প্রাসাদে এলো। উটের বাচ্চ কাটা হলো, অসংখ্য ভেড়া পোড়ানো হলো। ইতির জনের আজ অবাধ নিমন্ত্রণ। গরীব দুঃখীরা পেটপুরে খেয়ে দুহাত তুলে প্রার্থনা জানিয়ে গেলো, রাজকুমারী যেন চাঁদের মতো সুন্দর পুত্র লাভ করে।

প্রতিদিন যথাসময়ে দরবারে গিয়ে বসে বন্দর। দারুণ বিচক্ষণতার সঙ্গে শাসন কাজ চালাতে থাকে। তার ন্যায়বিচারে প্রজারা খুব খুশি। প্রজাদের শুভেচ্ছা আর ভালোবাসায় তার মন ভরে ওঠে। কিন্তু এত উল্লাস আনন্দের মধ্যেও একটি চিন্তাই তাকে কুরে কুরে খেতে থাকে। কামার অলজামান কবে আসবে? তার নয়নের মণি, তার বুকের কলিজা কোথায় চলে গেলো। সকলের অলক্ষ্যে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

খালিদানে ফিরতে হলে জাহাজ পথে যেতে হবে। আর সব জাহাজই এই এবানী দ্বীপে নোঙর করে। বদর বন্দর সর্দারকে জানিয়ে রেখেছে, যদি কোনও জাহাজ খালিদানের দিকে যেতে থাকে; খুব ভালো করে খোঁজখবর নিয়ে সে যেন তাকে জানায়।

এদিকে শাহজাদা কামার আল-জামান সেই বৃদ্ধ মালীর ছোট্ট বাড়িতে বসে বসে দিন গোনে। কবে খালিদানের জাহাজ আসবে। কবে সে দেশে পৌঁছবে, তার প্রাণপ্রতিমা বদরকে বুকে পাবে।

আর খালিদানে-শোকার্ত সুলতান শাহরিমান তখন মৃত্যু পথযাত্রী। এবার তিনি সব আশা পরিত্যাগ করেছেন। তার পুত্র কামার-আল-জামান আর বেঁচে নাই। সমস্ত আরব দুনিয়ার প্রতিটি সালতানিয়তে-প্রতিটি শহরে বন্দরে, গঞ্জে গ্রামে তিনি লোক পাঠিয়েছেন। কিন্তু কেউই কোনও খবর আনতে পারেনি। তাই অবশেষে সুলতান শাহরিমানের হুকুমে সারা দেশব্যাপী শোকদিবস পালন করা হলো। পুত্রের স্মৃতির উদ্দেশে তৈরি করা হলো একটা সুউচ্চ মিনার। এই মিনারের একটি স্বল্পপরিসর কামরায় কাটতে লাগলো তার বিষাদ বিষণ্ণ জীবনের শেষের দিনগুলো।

বৃদ্ধ মালীর অন্তরঙ্গ সাহচর্য সত্ত্বেও কামার আল-জামান বিষাদে দিন কাটায়। মালী রোজই সমুদ্র তীরে যায়। যদি কোনও খালিদানের জাহাজ এসে ভিড়ে। কিন্তু শহরটা পশ্চিমীর আক্রমণে বিধ্বংস্ত হওয়ার পর থেকে ভয়ে আর এপথ মাড়ায় না কেউ। তবুমালী আশা ছাড়ে না। নিশ্চয়ই কোনও না কোনও জাহাজ একদিন আসবেই।

একদিন বিকালে, মালী তখন সমুদ্র তীরে গেছে, কামার আল-জামান জানলার ধারে বসে বাগানের দিকে তাকিয়ে নিবিষ্ট মনে তার অতীতের সুখস্মৃতি রোমন্থন করছিলো। এমন সময় পাখীর ঝটপটানীতে সে সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখলো, দুটো পাখীতে প্রচণ্ড লড়াই বেঁধেছে। একটি আর একটিকে পাখারবাড়ি মেরে ঘায়েল করার চেষ্টা করছে। ঠোঁট দিয়ে ঠুকরে গায়ের পালক ছিঁড়ে খুঁড়ে দিচ্ছে। এই ভাবে কিছুক্ষণ লড়াই চলার পর একটি পাখী ঝুপ করে নিচে পড়ে গেলো। জামান ছুটে গিয়ে পাখীটাকে হাতে তুলে নেয়। কিন্তু না, সব শেষ হয়ে গেছে। ওপরে তাকিয়ে দেখলো, অন্য পাখীটা উড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। পাখীটাকে মাটিতে নামিয়ে রেখে আবার সে এসে জানলার ধারে বসে। একটু পরে দেখলো, আরও দুটো পাখী উড়ে এসে মৃত পাখীটার পাশে বসলো। ওদের ভাষা বুঝতে পারে না জামান, তবে এটা বেশ পরিষ্কার বুঝতে পারলো, শোকে তারা মুহ্যমান। অনেকক্ষণ ধরে তারা পাখীটার পাশে চুপচাপ বসে রইলো। তারপর ঠোঁট দিয়ে মাটি ঠুকরে ঠুকরে একটা গর্ত খুঁড়লো। মরা পাখীটাকে টেনে এনে গর্তের মধ্যে রেখে মাটি চাপা দিয়ে আবার তারা উড়ে চলে গেলো।

কিছুক্ষণ কেটে গেছে। আবার একটা বিকট চেঁচামেচির শব্দে জামানের তন্ময়ত কেটে যায়। সেই পাখী দুটা ঐ খুনী পাখীটাকে তাড়া করতে করতে বাগানের ভিতরে নিয়ে এসেছে। পাখীটা পালাতে চেষ্টা করছে, কিন্তু ওদের দুজনের সাড়াশী আক্রমণে তা সম্ভব হচ্ছে না। একটি সামনে থেকে অন্যটি পিছন থেকে পাখার ঝাপটা মারতে মারতে এক সময় মাটিতে ফেলে দিলো তাকে। তারপর খুনী পাখীটার মৃতদেহটা টানতে টানতে নিয়ে এলো তারা সেই নিহত পাখীটার কবরের পাশে। দুটিতে মিলে ধারালো ঠোঁট দিয়ে চিলে ফেললো তার পেট।

বেরিয়ে পড়লো নাডিভুড়ি। তারপর ওরা উড়ে চলে গেলো।

এই সময় রাত্ৰি শেষ হয়ে আসছে দেখে শাহবাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

দুশো ষোলতম রজনী :

আবার সে গল্প শুরু করে :

এতক্ষণ অবাক বিস্ময়ে এই দৃশ্য সে প্রত্যক্ষ করছিলো। এবার সে উঠে দাঁড়ালো। আবার বাগানের ভিতরে এসে দাঁড়ালো। ঐ খুনী পাখীটার কাছে। পেটের নাডিতুডি সব বেরিয়ে পড়েছে। কি বীভৎস দৃশ্য। চোখে দেখা যায় না। হঠাৎ কামার-আল-জামানের বুক দুলে ওঠে। পাখীটার পেটের নাডির্ভুডির মধ্যে লাল রঙের কি যেন একটা বস্তু ঝকমক করছে। আরও একটু কাছে আসতেই পরিষ্কার দেখতে পায়, বন্দরের সেই গ্বহরত্ন পাথরখানা। কামার-আল-জামানের মাথাটা বৌ করে ঘুরে ওঠে। কোনও রকমে বসে পড়ে সে পাথরখানা তুলে নিয়ে শক্ত মুঠিতে চেপে ধরে। ভাবখানা, আবার যদি কেউ ছিনিয়ে নিয়ে পালায়। কোন রকমে টলতে টলতে দেহখানা টেনে নিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়ে।

বেশ কিছুক্ষণ পরে নিজেকে সহজ স্বাভাবিক করতে পারে কামার আল-জামান। নতুন একটা কার বেঁধে নিজের গলায় পরে নেয় পাথরখানা। আল্লাহ আমার দুঃখ ব্যথা বুঝেছেন। তাই তিনিই আমাকে ফেরৎ দিয়ে দিলেন। আর আমার কোনও দ্বিধা নাই। এবার আমি বদরের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারবো। বদর-আমার চোখের মণি—আমার কলিজা।

কামার-আল জামানের চোখ বেয়ে নামে জলের ধারা। পাথরখানায় বার বার চুমু খায় সে। ভাবে, না, এভাবে গলায় ঝুলিয়ে রাখা ঠিক হবে না। তাতে লোকের নজর লাগবে। গলা থেকে খুলে একখানা রেশমী রুমালে ভালো করে জড়িয়ে বাঁ হাতের বাহুতে তাগার মতো করে বাঁধে।

বৃদ্ধ মালী বলেছিলো, জ্বালানীর কাঠ নাই। বাগানের মধ্যে একটা মারা গাছ আছে। ওটা কাটা দরকার। তার গায়ে এখন তেমন শক্তি নাই, কুড়ুল চালাতে পারে। অথচ শহরের সব মানুষ কোথায় ছন্নছাড়া হয়ে পালিয়েছে। একটা জনমজুরও পাওয়া যায় না।

জামান বলেছিলো, তার জন্যে আপনি কেন চিন্তা করছেন, চাচা। আমি তো আছি, হতে পারি। সুলতানের ছেলে, তা বলে কি শরীরে তাগদ নাই? নিজেদের কাজ নিজেরা করবো তাতে লজ্জা কিসের। আপনি কিছু ভাববেন না, বিকেলে আমি কেটে দেবো আপনার গাছ।

জামান একখানা কুঠার হাতে নিয়ে আবার বাগানের ভিতরে আসে। মরা গাছটার গোড়ায় কুঠারের কয়েক ঘা মারতেই ঝন ঝন করে একটা আওয়াজ বাজে। ঠিক যেন—কোনও লোহার পাতের উপর আঘাত করলে যেমন শব্দ হয়, তেমনি। মাটি আর পাথরের টুকরো সরাতেই চোখে ফেললো সে। একটা সিডি নেমে গেছে মাটির নিচে। শাহজাদা জামান-এর আর তাঁর সয় না। সিডি বেয়ে নিচে নেমে যায় সে। দশটা ধাপ নামার পর সে দেখতে পায়, একটা বিরাট পাতালপুরীর গুহা। গুহার সামনে খোদাই করে লেখা আছে আদি এবং থামুদের নাম আর সোল তারিখ। জামান ঝুকে পড়ে দেখলো, গোটা কুড়ি ইয়া বড় বড় তামার জ্বালা। ভিতরে ঢুকে একটা জ্বালার ঢাকনা তুলে দেখতে পেলো, সোনার মোহরে ঠাসা। আর একটার ঢাকনা খুললো। সেটাতে সোনার তাল। এইভাবে সব কটা জালারই সে মুখ খুলে দেখলো, দশটায় মোহর আর দশটায় সোনার তাল-এ ভর্তি।

শাহজাদা অবাক হয়ে ভাবে। এত বিশাল ধন-দৌলত মাটির তলায় গচ্ছিত রেখে এখানকার সুলতানরা দেহ রেখেছে। এখন এ শহর বিদেশী ম্লেচ্ছদের কবলে। তারা সন্ধান পেলে এখুনি ছিনিয়ে নিয়ে চলে যাবে। জামান উপরে উঠে এসে গর্তটার মুখ ব্রোঞ্জের পাতখানা দিয়ে ঢেকে মাটি চাপা দিয়ে বাগানের এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে ফুলের গাছে জল দিতে থাকে।

সন্ধ্যার প্রাক্কালে মালী ফিরে আসে। আজ তার মুখ হাসিতে ভরা। —সুখবর আছে বাপজান, খুব শিগ্‌গিরই আপনি দেশে ফিরে যেতে পারবেন। আমি একটা জাহাজের কাপ্তেনের সঙ্গে কথা বলে এলাম। তিনি আপনাকে এবনী দ্বীপ অবধি নিয়ে যেতে পারেন। সেখান থেকে হামেশাই খালিদানের জাহাজ ছাড়ে। এবনী পৌঁছতে তিন দিন লাগবে। তারপর ওখান থেকে খালিদানের জাহাজে চেপে বসবেন। বাস, একেবারে দেশে পৌঁছে যাবেন।

জামান আনন্দে লাফিয়ে ওঠে, চমৎকার। এদিকেও একটা সুখবর আছে, চাচা। অবশ্য আপনি এখন এই দুনিয়ার ভোগ লালসার অনেক ঊর্ধ্বে চলে গেছেন। এ সংবাদ আপনাকে হয়তো পুলকিত করবে না। আসুন আমার সঙ্গে।

জামান বৃদ্ধকে সঙ্গে নিয়ে সেই মরা গাছতলায় এসে দাঁড়ায়। মাটি সরিয়ে ব্রোঞ্জের পাতখানা সরিয়ে গর্তের নিচে নেমে গেলো দুজনে।

এই সময় রজনী অতিক্রান্ত হতে থাকে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

দুশো উনিশতম রজনীর দ্বিতীয় প্রহরে আবার সে গল্প শুরু করে :

কুড়িটা জালা ভর্তি সোনার মোহর আর সোনার তাল দেখে বৃদ্ধের চোখ ছানাবড়া হয়ে ওঠে। —কী সর্বনাশ! এত ধনদৌলত দিয়ে মানুষ কি করে বাবা?

জামান বলে, কেন, ভোগ করে। এগুলো সব আপনার। যে কটা দিন বাঁচেন দু’হাতে দেদার খরচাপাতি করে ওড়ান।

–না। বাবা, এসবে আমার কোনও লোভ নাই। এ জঞ্জাল অশান্তিই বাড়ায়। আজ বাদে কাল মরে যাবো। এখন আর ভোগবাসনার দরকার নাই আমার। আপনার এখনও কচি বয়স। অনন্ত ভবিষ্যৎ পড়ে রয়েছে সামনে। আপনি ওগুলো নিয়ে যাবেন, বাবা। আমার অভাব আছে সত্যি, কিন্তু দৌলতের দেমোক আমার সহ্য হয় না। আপনি বরং যাবার আগে গোটা কয়েক পয়সা দিয়ে যাবেন। একখানা কফিন কিনে রাখবো। আমার মরার পরে যাতে ওরা ওই কাপড়ে জড়িয়ে কবর দেয়। সেই আমার যথেষ্ট পাওয়া হবে।

জামান বলে, কিন্তু অর্ধেকটাও যদি আপনি না নেন, আমিও কিছু নেব না। বৃদ্ধ বলে, যা ভালো বোঝেন করুন।

কামার আল-জামান সারা রাত ধরে গোটা কুড়ি কাঠের বাক্স বানায়। হাতে বাঁধা বদরের গ্বহরত্নটার দিকে তাকায়। নাঃ, এই অমূল্য রত্ন এমন ভাবে হাতে বেঁধে রাখা ঠিক না। একটা বাক্সের নিচে পাথরটা সযত্নে রেখে তার উপর সোনার মোহর ঢেলে দেয়। প্রায় ভর্তি হয়ে এলে উপরে কতক গুলো জলপাই দিয়ে ডালা এটে দেয়। লোকে ভাববে। ফলের বাক্স। এই ভাবে সব বাক্স গুলো সোনার তাল আর মোহরে ভর্তি করে ডালা এটে দেয়। প্রথম বাক্সটার ওপরে এক টুকরো চামড়া এঁটে দিয়ে চিহ্ন রাখে—এইটায় আছে সেই গ্বহরত্ন পাথর খানা। তারপর প্রতিটি বাক্সের গায়ে স্পষ্টাক্ষরে লিখে দেয় জামানের নাম-ধাম। বৃদ্ধ মালীকে বলে, চাচা, খুব ভোরে আপনি জাহাজের খালাসীদের কয়েকজনকে ডেকে নিয়ে আসবেন। তারা না এলে এই ভারি বাক্স নিয়ে যাবে কে?

বৃদ্ধ বলে, আপনি কিছু ভাববেন না, মালিক। আমি ভোরেই তাদের ডেকে আনবো।

জামান তখন যাত্রার আয়োজনে ব্যস্ত। বৃদ্ধ মালীর জ্বর এসেছে তা সে বুঝতেই পারলো না। মালীও কিছু বললো না। সারারাতে জ্বর আরও বাড়তে থাকে। মালী। কিন্তু জামানকে কিছু বলে না। আহা বেচারী, কতকাল দেশ ছাড়া, এতদিন বাদে একটা আশার আলো দেখা গেছে, এই শুভ সময়ে নিজের অসুখের কথা বলে তার মন খারাপ করে দিতে চায় না সে। জীবনে তার কবে অসুখ করেছিলো মনে পড়ে না। আজ সে বুঝতে পারে, যাবার ডাক পড়েছে।

খুব ভোরে উঠে বৃদ্ধ চলে যায় বন্দরে। কুড়িজন খালাসীকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে আসে। জামান ওদের বাক্সগুলো দেখিয়ে বলে, ভালো জাতের দামী জলপাই আছে বাক্সগুলোয়। দেখ, ভাই, একটু যত্ন করে নিয়ে গিয়ে জাহাজে নামাবে। আছড়ে দিয়ে ফেলো না, তা হলে সব যাবে। তোমাদের যা ন্যায্য ইনাম তার চেয়ে অনেক বেশিই দেব আমি।

খালাসীদের সর্দার সেলাম ঠুকে বললো, ঠিক আছে, হুজুর। আপনি বেশি দেরি করবেন না। তাড়াতাডি জাহাজে চলে আসুন। মনে হচ্ছে, কাল সকাল নাগাদ হাওয়ার নিশানা আমাদের পথের দিকে ঘুরে যাবে। হাওয়া পেলে আমরা আর অপেক্ষা করবো না। সঙ্গে সঙ্গে পাল তুলে দেব, হুজুর। তাই বলছি, আপনি তাড়াতাডি জাহাজে চলে আসুন।

জামান বললো আমার জন্য তোমাদের জাহাজ ছাড়তে এক পলকও দেরি হবে না। সর্দার। আমি একটু বাদেই আসছি, তোমরা যাও।

খালাসীরা বাক্সগুলো মাথায় নিয়ে চলে গেলো।

এই সময় রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

দুশো বাইশতম রজনী :

আবার কাহিনী বলতে থাকে সে। বৃদ্ধ মালীর ঘরে ঢুকে দেখে জুরে ঠক ঠক করে কাঁপছে সে। চোখ মুখ কেমন পাণ্ডুর হয়ে গেছে। জামান কাছে এসে মাথায় হাত রাখে, সেকি, আপনার এত জুর-কখন এলো।

—ও কিছু না বাবা, আপনি তৈরি হয়ে জাহাজে চলে যান।

–আপনি এই জ্বর গায়ে খালাসী ডাকতে গিয়েছিলেন অতটা পথ হেঁটে?

–তাতে কি হয়েছে বাবা। এতদিন বাদে একটা জাহাজ পাওয়া গেলো, কত আনন্দের কথা। তার জন্য আমার কী কষ্ট। আপনি রওনা হয়ে যান বাবা। আমার কোনও অসুবিধে হবে না। আর তা ছাড়া আজ বাদে কাল তো তার কাছে যেতেই হবে। এ ডাক যত তাড়াতাডি আসে ততই उछव्।

জামান বলে, আপনি ও সব কথা ভাববেন না। আমি কিছু টোটকা জানি! গাছগাছড়ার রস করে আপনাকে খাইয়ে দিচ্ছি। আজ রাতেই আপনার জ্বর ছেড়ে যাবে।

কিন্তু কিছুতেই কিছু ফল হলো না। রাত যত বাড়ে জুরও তত বাড়তে থাকে। সারারাত ধরে জামান বৃদ্ধের পাশে বসে শুশ্রুষা করে। কিন্তু নিয়তির লেখা কেউ এড়াতে পারে না। ভোর হতে না হতেই বৃদ্ধ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলো।

কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো জামান। এতদিন তার স্নেহছায়ায় সে কাটিয়েছে। আজ দেশে ফিরে যাওয়ার সময় সে-ই আগে চলে গেলো।

নিজে হাতে কবর খুঁড়ে জামান তাকে যথাবিহিত রীতি অনুসারে সমাহিত করলো। বেলা তখন অনেক। সূর্য মাথার উপরে এসে পড়েছে। এতক্ষণ জামানের অন্য কোনও দিকে খেয়াল ছিলো না। আজ সকালে যে তার জাহাজজছাড়ার কথা, তাও তার মনে ছিলো না। এবার খেয়াল হলো সময় উৎরে গেছে। হাওয়ার নিশানা ফিরেছে। হয়তো বা জাহাজটা ছেড়েই চলে গেছে।

হন হন করে সে হেঁটে চলে সমুদ্রের ধারে। কিন্তু হায়, বড় দেরি হয়ে গেছে। সমুদ্র-সৈকতে সে যখন পৌঁছল জাহাজ তখন মোঝ দরিয়ায় পাল তুলে দিয়ে তাঁর তরী করে বয়ে চলেছে।

একরাশ হতাশা আর দুঃখ চেপে বসলো তার বুকে। ক্লান্ত-অবসন্ন দেহখানা টেনে নিয়ে ফিরে এলো সে বাগানে। এখন এই বাগিচা এই ছোট্ট বাড়িখানা সবই তার দখলে। ঘরে গিয়ে বিছানায় পড়ে অঝোর নয়নে কাঁদতে থাকে জামান, এমনই তার দুর্ভাগ্য, বদরকে সে আর ফিরে পাবে না। বন্দরের পাথরখানা পেয়েও সে আবার হারালো।

কামার আল-জামান বুঝতে পারে, এই অজানা অচেনা বিদেশে বেঘোরে তাকে প্রাণ হারাতে হবে। অথবা কতকাল এই নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে হবে কে জানে। জামান মনে মনে ভাবে, ঐ পাথরটা হারাবার সঙ্গে সঙ্গেই দুৰ্ভাগ্যও তার পিছনে লেগেছে। যখন ওটা ফিরে পাওয়া গেলো, ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়ে উঠলো। কিন্তু আবার সে হাতের নাগালের বাইরে চলে গেলো। না জানি এখন তার ভাগ্যে কি বিপদের খাড়া ঝুলছে। এখন মেহেরবান আল্লাহর দেয়া ছাড়া কোনও ভরসা নাই।

বাজারে গিয়ে কুড়িটা বাক্স কিনে আনলো জামান। জালার অর্ধেকটা সোনা সে বৃদ্ধিমালীর জন্য সেই গুহার মধ্যেই রেখে দিয়েছিলো। প্রতিটি বাক্সের অর্ধেকটা মোহর আর সোনার তাল-এ ভর্তি করে, বাকী অর্ধেক জলপাই সাজিয়ে ডালা এটে দিলো।

মনে মনে আশা করতে থাকলো, নিশ্চয়ই আল্লাহ মুখ তুলে চাইবেন! দু-একদিনের মধ্যেই একটা জাহাজ তিনি পাঠাবেন।

এরপর আবার সে আগের মতো বাগানের টুকিটাকী কাজকর্ম ফুলের গাছে জল দেওয়ার কাজে নিজেকে ডুবিয়ে দিলো। বাকী সময় বদর-এর বিরহে গান গেয়ে গেয়ে কাটায়।

পালের হাওয়া অনুকূলে ছিলো। জাহাজখানা তার তর করে বয়ে এবনী দ্বীপের বন্দরে এসে ভিড়ে নোঙর ফেলা হলো।

বন্দর-সর্দার বদরকে খবর পৌঁছে দিলো, একটা জাহাজ এসে ভিড়েছে। জাহাজে কুড়িটা বাক্স আছে—প্রতিটি বাক্সে কামার আল-জামানের নাম লেখা!

আনন্দে বদর-এর বুক দুরু দুরু করে। এতদিন পরে তাঁর প্রিয়তম স্বামী ফিরে এসেছে! দরবারের পদস্থ কর্মচারীদের সঙ্গে নিয়ে সে জাহাজে এলো। কাপ্তেনকে একান্তে ডেকে মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, কামার আল-জামান কোথায়?

কাপ্তেন বললো, তিনি জাহাজে নেই। তার আসার কথা ছিলো, কিন্তু কেন জানি না, আসেন নি। আমরা তার জন্য—অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিলাম। জাহাজ ছাড়ার কথা ছিলো খুব সকলে, শুধু তীর জন্যেই আমরা অনেক দেরিতে ছেড়েছি।

বদর জিজ্ঞেস করে কী ধরনের সওদা আছে জাহাজে?

কাপ্তেন বলে, নানা দেশের সুন্দর সুন্দর সূতী আর রেশমী কাপড়, কাজ করা মখমল, চমৎকার সব দেখতে সেকেলে এবং আধুনিক ঢংএর ছবি আঁকা কাপড়। চীনা এবং ভারতীয় দাওয়াই পত্র, হীরা, মুক্তা, নানা জাতের সুগন্ধী আন্তর, নানা রকম ফুলের নির্যাস, কপূর আর আছে কয়েক বাক্স উৎকৃষ্ট জাতের জলপাই, -ভারি সুন্দর খেতে।

রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

দুশো পাঁচশতম রজনী :

আবার সে বলতে শুরু করে।

বদর কাপ্তেনের ফর্দ শুনতে শুনতে বাধা দিয়ে বলে, আমি ঐ জলপাই-ই কিনতে চাই কিছুটা। কতটা আছে।

কাপ্তেন বলে, কুড়িটা বাক্স।

—সবগুলো বাক্সতেই কি একই ধরনের জলপাই আছে।

—তা বলতে পারবো না। তবে মনে হয়, ভিন্ন ভিন্ন বাক্সে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের জলপাই-ই থাকতে পারে।

বদরের জিভে জল এসে যায়। বলে, আমি একটা বাক্স কিনতে চাই। ஜி হুজুর। যে মালিকুসু জাহাজ ধরতে পারেনি। অবশ্য জীহাপনা যদি ইচ্ছে প্ৰািজ করেন তবে যা খুশি নিয়ে যেতে পারেন।

খালাসীদের সে হুকুম করলো, এই—জলপাই-এর বাক্সগুলো সব এদিকে নিয়ে আয়।

তৎক্ষণাৎ বাক্সগুলো সামনে এনে রাখা হলো। কপ্তেন একটা বাক্সের ডালা খুলে জলপাই-এর চেহারা দেখালো।

বদর আনন্দে লাফিয়ে ওঠে, আমি সবগুলো বাক্সই কিনবো। বাজারে কি দাম হতে পারে?

–আপনার দেশে জলপাই-এর খুব চাহিদা, জাঁহাপনা। আমার মনে হয় এক একটা বাক্স একশো দিরহাম হবে।

বদর তার এক কর্মচারীকে বললো, প্রত্যেকটা বাক্সের জন্য এক হাজার দিরহাম করে ইনাম দিয়ে দাও কাপ্তেনকে।

বদরের পিছনে পিছনে খালাসীরা বাক্সগুলো মাথায় নিয়ে জাহাজ থেকে নামে। বদর কাপ্তেনকে উদ্দেশ্য করে বলে, ফলের মালিক এর সঙ্গে দেখা হলে দামটা তাকে দিয়ে দিও।

প্রায় ছুটতে ছুটতে বদর হায়াতের কাছে আসে। বাক্সগুলো সব নিয়ে আসা হলো হারেমে।

দু’খানা রেকবী। এনে দিলো বাদীরা। একটা বাক্সের ডালা খোলা হলো। টসটসে পাকা জলপাই। পাকা সোনার মত রং।দাসীরা খোস ছিলে ছিলে রেকবী সাজিয়ে দিতে থাকে। কিন্তু কি অবাক কান্ড, জলপাই গুলোর গায়ে সোনার গুড়ো মাখামাখি হয়ে আছে। মুখে দিতে গিয়েও নামিয়ে রাখে বন্দর। বলে, অন্য দু’খানা রেকবী নিয়ে এসো। আর একটা বাক্স খোলো।

সে বাক্সটাও খুলে দেখা গেলো। সেই একই অবস্থা। তখন বন্দর হুকুম দেয়, সব বাক্স খুলে সব জলপাই ঢেলে দেখ।

এক এক করে সবগুলো উপুড় করে ঢালা হতে থাকে। সোনার তাল আর সোনার মোহর গুলো দেখে তো সবারই চোখ ছানাবড়া! একি তাজ্জব কান্ড। সব শেষের বাক্সটা যখন উপুড় করা হলো, বদর চিৎকার করে ওঠে, একি ব্যাপার! আমার এই দৈব পাথরখানা। এর মধ্যে এলো কি করে?

হলুদবৰ্ণ জলপাইগুলোর মধ্যে লাল রঙের গ্বহরত্নখানা জুলজুল করে জুলছে। হাঁয়া, হ্যাঁ, এই পাথরখানাই একটা করে বাধা ছিলো তার কোমরে। বদর নির্ভুলভাবে চিনতে পারে। আর সে ভাবতে পারে না। মাথাটা কেমন ঘুরে ওঠে। হায়াতের কাঁধে মাথা রেখে বদর চোখ বন্ধ করে থাকে।

কিছুক্ষণ পরে নিজেকে সামলে নিয়ে মাথা তুলে দাসী বাঁদীদের চলে যেতেইশারা করে। দৈব পাথরখানা তুলে নিয়ে চুমু খেয়ে হায়াৎকে বলে, জািন হায়াৎ, এটা কী?

হায়াৎ কিছুই বুঝতে পারে না। বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। বদর বলে, মন্ত্রপুতঃ দৈব পাথর। এই পাথরখানা যেদিন খোয়া যায়। সেই দিনই আমার স্বামীকেও হারিয়েছি আমি। আজ আবার ফিরে পেলাম। তুমি দেখে নিও, সে-ও এবার ফিরে আসবে আমার কাছে। আবার আমাদের জীবনে বসন্তের ফুল ফুটবে, হায়াৎ।

জাহাজের কাপ্তেনকে ডেকে পাঠালো বন্দর। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে এসে কুর্নিশ জানালো, বদর জিজ্ঞেস করে, এই ফলের মালিককে তুমি চেন? সে কোথায় থাকে? কী করে। সে কি এখানকার আদি বাসিন্দা?

কাপ্তেন বলে, তা তো বলতে পারবো না, হুজুর। তবে এটুকু জানি তিনি ওখানকার একটা বাগানের বৃদ্ধমালীর সঙ্গে থাকেন। আমার জাহাজে তার আসার কথা ছিলো। কিন্তু সময়মতো তিনি এসে পৌঁছতে পারেন নি। আমি জাহাজ ছেড়ে চলে এসেছি।

বদর বললো, বেশির ভাগ জলপাইই বেশ টসটসে পাকা। খেয়ে দেখেছি, ভারি মিষ্টি। কিন্তু মুসকিল হয়েছে, আমার বাবুৰ্চিটা কদিন হলো বেপাত্তা হয়ে গেছে। লোকটা কাজ জানে ভালো, কিন্তু বড় কামাই করে। এখন এমন সুন্দর জলপাইগুলো ভালো করে বানানোর মতো লোক নাই। বদমাইশটা ফিরে আসুক, তারপর তাকে এমন শায়েস্তা করবো, বাছাধন জীবনে বদমাইশটা ফিরে আসুক, তারপর তাকে এমন শায়েস্তা করবো, বাছাধন জীবনে ভুলতে পারবে না। কিন্তু সে তো পরের কথা, এখন লোক অভাবে এই সুন্দর জলপাইগুলো সব নষ্ট হয়ে যাবে যে। তুমি এক কাজ কর, আজই জাহাজ ছেড়ে চলে যাও। যে-ভাবে পার ফলওয়ালাকে এখানে ধরে নিয়ে এসো। যদি আমাকে খুশি করতে পোর, অনেক ইনাম পাবে, আর যদি না পোর তবে আর কোনও দিন আমার বন্দরে জাহাজ ভেড়াতে পারবে না; এই বলে দিলাম। আর যদি আমার কথা গ্রাহ্য না করে জাহাজ ভেড়াও, তোমার গর্দান যাবে। শুধু তোমার না তোমার জাহাজের সঙ্গী-সাথী সক্কলের।

 

দুশো আটাশতম রজনীতে আবার কাহিনী শুরু হয় :

বদরের এই হুকুম কাপ্তেনকে শিরোধার্য করে নিতে হলো। এ ছাড়া উপায় নাই। সম্রাটের আদেশ অমান্য করলে নির্ঘাৎ প্ৰাণদণ্ড।

আল্লাহর দোয়ায় হাওয়া অনুকূলে ছিলো। জাহাজে পাল তুলে কাপ্তেন আবার সেই ম্লেচ্ছাক্রান্ত শহরটার দিকে যাত্রা করলো। কয়েকদিন পরেই জাহাজ গিয়ে ভিড়লো। কাপ্তেনের আর তাঁর সয় না। প্রায় দৌড়তে দৌড়তে চলে গেলো। সেই বাগিচায়। বৃদ্ধমালীর বাড়ির দরজায় কড়া নাড়তে থাকে। চিস্তায় ভাবনায় কামার আল-জামানের চোখের কোণে কালী পড়েছে। নাওয়া খাওয়া প্রায় করে না বললেই চলে। দেহ কৃশ হয়েছে। সারা মুখে বিষাদের ছায়া। ঘরের একপাশে চুপচাপ বসে নিজের নসীবের কথা ভাবছিলো সে। কড়া নাড়ার শব্দে, বসে থেকেই সে হাঁক দেয়, কে?

কাপ্তেনের মনে আশা হয়। বোধ হয় এখনও সে আছে। এখানে। ক্ষীণ স্বরে জবাব দেয়, আমি এক দীন ভিখারী, জনাব।

গলার স্বর কেমন যেন চেনা চেনা ঠেকে! কথার টানে মনে হয়, এ যেন তার নিজের দেশের কেউ? জামান উঠে এসে দরজা খোলে। অবাক হয়ে তাকায়।

কাপ্তেন বলে, আমার জাহাজে আপনার যাওয়ার কথা ছিলো সেদিন। আমরা অপেক্ষাও করেছিলাম অনেক বোলা অবধি। কিন্তু আপনি আর এলেন না দেখে আমরা জাহাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলাম, জনাব। আমার কোন অপরাধ নেবেন না।

জামান খুব খুশি হয়, না না, তোমাদের কি দোষ। আমিই সময় মতো পৌঁছতে পারলাম না।

কাপ্তেন বলে, আপনি যেতে পারলেন না, তাই আবার নিতে এসেছি আজ।

জামান বলে, খুব আনন্দ পেলাম। ঠিক আছে চলো। হ্যাঁ, আরও কুড়িটা বাক্স জলপাই আছে আমার ঘরে; ও গুলোও নিয়ে যাবো।

কাপ্তেনের ইশারায় খালাসীরা বাক্সগুলো মাথায় তুলে নিলো।

জাহাজে বসে কাপ্তেন বললো, এবনি দ্বীপের সম্রাটের রসুইখানার বাবুর্চি ভোগে গেছে। আপনার জলপাইগুলো বানাবার লোক মিলছে না। সেখানে। অথচ সম্রাটের ভারি পছন্দ হয়েছে। ফলগুলো। ভালো দাম দিয়ে কিনেছে সে সবগুলো। এই নিন, প্রতিটা বাক্সের জন্য এক হাজার দিরহাম দাম দিয়েছে সে। আপনাকে সঙ্গে নিয়ে যাবার হুকুম হয়েছে। ওখানকার রসুইখানার প্রধান বাবুর্চির কাজ পেয়ে যাবেন আপনি।

এমন একটা সুখবর দিয়ে কপ্তেন গর্বের সঙ্গে জামানের মুখের দিকে তাকায়। ভাবে, নিশ্চয়ই সে খুসিতে গদগদ হয়ে উঠবে। কিন্তু জামানের কোনও ভাব-বৈলক্ষণ্য না দেখে সে যেন চুপসে যায়। জামান কোনও জবাব দিলো না।

একটু পরে জাহাজ ছাড়া হলো। কাপ্তেন আবার তার কাছে এসে বলে, প্রাসাদের রসুইখানার মালিক হবেন আপনি, আপনার তো পোয়া বারো। এতক্ষণ জামান কোনও কথা বলেনি, এবার সে আর থাকতে পারলো না।–আমি নেবো না ও চাকরী। আর এ সব কথা বলতে তোমার একটুও বাধ্যছে না কপ্তেন? এখন দরিয়ায় তোমার জাহাজ, আল্লাহর নাম কর।

কাপ্তেন বলে, অনেক আগেই আমি তার দেয়া মেঙেছি, সাহেব। তিনি যেন আমাদের যাত্রা পথ শুভ করেন। আপনার যেন প্রাসাদের রসুইখানার চাকরীটাি হয়ে যায়।

জামান কোনও জবাব দেয় না। নির্বিকার ভাবে দূরে সমুদ্রের নীল জলরাশির দিকে চেয়ে থাকে। কাপ্তেন আরও কাছে এসে বলে, মনে হচ্ছে, আপনি এই চাকরীটা নিতে খুব ইচ্ছক না। তবে কি সম্রাটের ধারণা ভুল! আপনি কি রসুইখানার কাজ কাম জানেন না?

জামান বলে, আমি এখন আল্লার পায়ে নিজেকে সঁপে দিয়েছি। তোমাদের কোনও কথা আমি শুনবো না। এর বেশি কিছু বলবোও না।

কাপ্তেন বলে, সে আপনার যা অভিরুচি। আমার কর্তব্য সম্রাটের সামনে হাজির করা-তা করতে পারলেই রেহাই পেয়ে যাবো আমি।

এবনি বন্দরের এলাকার মধ্যে জাহাজ ঢুকছে। কাপ্তেন বৃলিলো, নিন সাহেব, নিজেকে ঠিক ঠাক করে নিন, এবার আপনাকে সম্রাটের কাছে নিয়ে যাবো। এখুনি জাহাজ বন্দরে ভিড়বে।

জাহাজ ভিড়ার সঙ্গে সঙ্গে জামানকে সঙ্গে নিয়ে সে প্রাসাদে এসে সম্রাট সমীপে হাজির হলো। বদরের মাথায় একটা বদ বুদ্ধি চেগে উঠেছিলো। কাপ্তেনের সঙ্গে কামার আল-জামানকে দেখামাত্র বদর-এর চিনতে কোনও অসুবিধা হয় না—এই তার প্রাণেশ্বর। জামানের পরণে ছিলো বৃদ্ধমালীর দেওয়া সাধারণ সাজ-পোশাক। তার এই দীন ভিখারীর দশা দেখে বন্দরের বুক ব্যথায় টন টন করে ওঠে। জামান কিন্তু বদরকে একদম চিনতে পারে না। এই তার প্রাণ প্রতিমা-এরই জন্যে সে দিন রজনী চোখের জল ফেলছে।

নিমেষে নিজেকে সহজ করে নিতে পারে বন্দর। কাপ্তেনকে বলে, ওকে ফলের দাম বুঝিয়ে দিয়েছ?

–জী হুজুর। জাহাজে আরও কুড়িটা জলপাইএর বাক্স আনা হয়েছে।

বদর বলে, ঠিক আছে, ওগুলো প্রাসাদে নিয়ে এসো। একহাজার সোনার দিনার দাম পাবে।

কাপ্তেন কুর্নিশ করে চলে যায়।

এই সময়ে রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

দুশো তিরিশতম রজনী :

আবার সে শুরু করে।

জামান মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিলো। বদর তার একজন কর্মচারীকে বললো, একে হামামে নিয়ে যাও। ভালো করে গোসল করাও। কাল সকলে আমার সামনে হাজির করবে।

বদর হায়াতের কাছে গিয়ে বলে, এই—সে এসেছে। আমি কিন্তু তার কাছে পরিচয় দিচ্ছি না। কিছুতেই।

হায়াৎ খুশিতে উপছে পড়ে। বদরকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায়। সে রাত্রে তারা দুজন আর জড়ােজডি করে শোয় না। সহজভাবে পাশাপাশি শুয়ে সুখস্বপ্ন দেখে দেখে রাত কাটায়।

পরদিন সকালে দামী সাজপোশাক পরে কামার অল-জামান দরবারে এসে হাজির হয়। চোখে মুখে ফোটা ফুলের প্রসন্নতা। বদর উজিরকে বলে, এই যুবকের জন্য একখানা বড় ইমারৎ, একশোটা নফার চাকর এবং উজিরের যোগ্য মাসোহরার বন্দোবস্ত করে দিন। আজ থেকে সে হবে। আমার দরবারের আর একজন উজির। তার জন্যে দামী দামী ঘোড়া, খচ্চর, উট প্রভৃতি যা যা দরকার সব ব্যবস্থা করে দিন।

এই কথা বলে সেদিনের মতো দরবার ছেড়ে চলে গেলো বন্দর। পরদিন যথা সময়ে আবার সে কামার আল-জামানের ছদ্মবেশে দরবারে আসে। জামানকে কাছে ডাকে। সিংহাসনের পাশে যেখানে রাজকুমারদের বসার আসন সেখানে তাকে বসায়। জামান অবাক হয়ে ভাবে, হঠাৎ তাকে সম্রাট এত সম্মান দেখাচ্ছে কেন? নিশ্চয়ই এর পিছনে কোনও মতলব আছে। কিন্তু বুঝে উঠতে পারে না-কী সে মৎলব? কাপ্তেনের কথাবার্তা শুনে তো এরকম কিছু মনে হয়নি! মনে হচ্ছে, এর পিছনে গূঢ় কোনও রহস্য আছে। খোদা ভরসা, কারণটা আমাকে খুঁজে বের করতেই হবে। ভাবতে ভাবতে কারণও একটা খুঁজে পায়। সম্রাট বয়সে নেহাৎই কচি; একেবারে তরুণ বলা যায়। এই বয়সে সুঠাম সুন্দর যুবকদের সাহচর্য খুব ভালো লাগে। তাই কি সে আমাকে তার পাশে পাশে রাখতে চায়? ওর কি ধারণা হয়েছে কচি বয়সের লালটুস ছেলে দেখলেই আমার জিভে জল ঝরবে? আর এই জন্যেই কি সে আমাকে হুট করে এমন উঁচু আসনে বসালো? তা যদি ভেবে থাকে সে, খুব ভুল। ওসব বিকৃতির মধ্যে আমি নাই। আমাকে কলের পুতুল বানিয়ে যা খুশি করাবে সে-টি হচ্ছে না। ওর মতলবটা কি, আগে আমাকে জানতে হবে। তারপর যদি বুঝি ব্যাপারটা গোলমেলে, আমি কিন্তু ঐসব ধন-দৌলত ইনাম সম্মানের পরোয়া করি না। লাথি মেরে সব ফেলে রেখে আবার আমার সেই বাগানে ফিরে যাবো।

জামান বদরকে উদ্দেশ করে বলে, জাঁহাপনা অনেক দামী দামী জিনিসপত্রে আমার বাড়ি ভরে দিয়েছেন। ধন-দৌলত এবং প্রয়োজনের সামগ্রী এত দিয়েছেন, অত আমার কোনও কাজে আসবে না। আর তাছাড়া আপনার দরবারে আমাকে যে আসনে বসিয়েছেন তাতে আমি অত্যন্ত কুষ্ঠা বোধ করছি। কারণ এ আসনে কেবলমাত্র আপনার একান্ত বিশ্বাসভাজন প্রাজ্ঞ, প্রবীণ ও বিচক্ষণ ব্যক্তিরাই বসতে পারেন। বয়সে আমি নিতান্তই যুবক। সাদা দাড়ি গোঁফওয়ালা জ্ঞানী-গুণী উজিরের যোগ্যতা আমি পাবো কোথায়? এসব জেনে শুনেই আপনি আমাকে এই আসনে বসিয়েছেন। এর পিছনে যদি অন্য কোনও উদ্দেশ্য আপনার না থাকে তাহলে তো ব্যাপারটা আরও তলিয়ে ভেবে দেখতে হয়।

বদর মৃদু মুচকী হাসে। বলোল কটাক্ষ হেনে জামানের দিকে তাকায়। বলে, শোনো, প্রিয়দর্শন উজির, তুমি যা বললে তা খুব সত্যি, এর পিছনে কারণ একটা অবশ্যই আছে। তোমার রূপের আগুনের ঝলকানীতে আমার হৃদয় দগ্ধ হয়েছে? তোমার লাল টুকটুকে গাল দুটো দেখে, বলতে লজ্জা নাই, আমি মুগ্ধ হয়ে পড়েছি।

জামান বলে, আল্লা আপনাকে শতায় করুন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আপনি এই সিংহাসনে আসীন থাকুন। কিন্তু আমাকে ছেড়ে দিন সম্রাট, আমার একটি বিবি আছে। তঁকে আমি প্ৰাণাধিক ভালোবাসি। আজ আমি ভাগ্য বিড়ম্বিত। তার সঙ্গে আমার আপাত-বিচ্ছেদ ঘটেছে। কিন্তু প্রতিটি দিন রজনীর প্রতিটি মুহূর্ত তার বিরহেই আমি আকুল। অধীর প্রতীক্ষায় দিন গুণছি। আবার কবে তার সঙ্গে দেখা হবে—তাকে আমার বুকে পাবো। আপনার এই হতভাগ্য দাসানুদাসকে অব্যাহতি দিন। আমি আবার সাগর পেরিয়ে সেই শহরেই চলে যেতে চাই। আপনি আমার ভোগ বিলাসের জন্য যে-সব বিধিব্যবস্থা করেছিলেন, তার জন্যে আমি ধন্য। যাবার আগে আপনার যাবতীয় দান সামগ্ৰী আপনাকে আমি ফিরিয়ে দিয়ে যাবো, সম্রাট।

বদর জামানের একখানা হাত নিজের হাতের মধ্যে টেনে নেয়। অধীর হয়ে না, উজির, শান্ত হয়ে বসে। যাবার কথা মুখে আনতে নাই। বরং এখানেই থোক। তুমি তো বুঝতে পারছে, তোমার ঐ সুন্দর চোখের তারায় যে নিরুত্তাপ আগুন তার দহনে দগ্ধ হচ্ছে একটি অশান্ত হৃদয়। তাই বলছি, তার পাশে বসেই না হয় কিছু সময় তোমার কাটলো। তোমার এই বাহুলতা যদি তাকে দু-দণ্ডের শান্তি দিতে পারে, দেবে না তুমি?

বদরের এবম্বিধ প্রেমালাপ শুনে জামানের গা রি রি করে ওঠে। মহানুভব সম্রাট, আমি আপনার দাস, আপনার মুখে এসব কথা শোনাও আমার পাপ। আপনি আমাকে মাফ করবেন, আমার দ্বারা এসব কাজ হবে না।

জামানের কথা শুনে বদর হাসে, কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, এতে ঘাবড়াবার কি আছে। তোমার মতো এমন খুব সুরৎ নওজোয়ান ভয় পাচ্ছে কেন? আচ্ছা শোনো, তুমি কি এখনও নাবালক? যদি নাবালকই হও, তোমার নিজের কোনও দায়-দায়িত্ব থাকছে না। আর যদি শক্ত সমর্থ সাবালক হও (আমার ধারণা তুমি তাই) তাহলে পিছপা হচ্ছে কেন? তোমার ইচ্ছে মতো তুমি যা খুশি করতে পোর। একটা কথা তো মান, কপালে যা লেখা থাকে না তার কিছুই ঘটতে পারে না জীবনে। পিছতে হলে বরং আমারই পিছনো উচিৎ। কারণ আমি তোমার থেকে অনেক ছোট।

কামার আল-জামানের মুখ কালো হয়ে ওঠে। মিনতি করে বলে, আপনি মহামান্য সম্রাট। আপনার হারেমে অনেক সুন্দরী মেয়েছেলে আছে। কুমারী দাসী বাঁদীর অভাব নাই। তাদের সকলকে ছেড়ে আমার দিকেই আপনার নজর পড়লো কেন? আপনি তো জানেন, প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার জন্য যেকোন মেয়েকে যেমন ইচ্ছা তেমনি ভাবে গ্রহণ করা আইন সম্মত। তাকে নিয়ে আপনি নানা রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে পারেন। অজানা কৌতূহল মেটাতে পারেন। তাতে কোনও দোষ হয় না।

বদর মুচকী হেসে চোখ মারলো। —তুমি যা ভাবছো, তার কোনওটাই ঠিক নয় গো প্রিয়দর্শন, কোনওটা ঠিক নয়। ভিন্ন ভিন্ন মানুষ ভিন্ন ভিন্ন রুচির। রুচির সঙ্গে সঙ্গে প্রবৃত্তি-ও পালটায়। যখন মানুষের অনুভূতি সূক্ষ্মতর হয় তখন রসবোধেরও অনেক তারতম্য ঘটে। সে ক্ষেত্রে কি উপায়?

কামার আল-জামান ভাবলো, সম্রাটের মতি গতি খারাপ। এখন তাকে কিছু বোঝাতে যাওয়া নিরর্থক। অবশ্য তার কথায় সে যে কিছুমাত্র বিচলিত হয়নি—তাও বলা ঠিক না। নতুন কোনও বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করুক-কে না চায়!

রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

দুশো চৌত্রিশতম রজনীর মধ্যভাগে আবার সে শুরু করে :

সুতরাং জামান বলে, মহামতি সম্রাট, আপনার প্রস্তাবে আমি রাজি হতে পারি একটা শর্তে। আপনি আমাকে কথা দিন, আমাকে নিয়ে আপনি যে খেলাই খেলতে চান আমার কোনও আপত্তি নাই, কিন্তু শুধু একটি বারের জন্য। দ্বিতীবার আমি আপনার প্রবৃত্তি মেটাতে পারবো না।

বদর স্মিত হেসে বলে, কথা দিলাম।

জামান বলে, আমি তার কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন আমাদের আলোর পথ দেখান। হারেমের নিরালা নিভৃত কক্ষ। জামানকে সঙ্গে করে নিয়ে আসে বন্দর। এক ঝটিকায় মখমলের শয্যায় ফেলে দেয় জামানকে। বদরের এই অতর্কিত আক্রমণে হ’কচাকিয়ে যায় জামান। নিজেকে রক্ষা করার জন্য বাধা দিতে গিয়ে কি মনে হতেই হাত সরিয়ে নেয়, নাঃ, ঠিক আছে, কথা যখন দিয়েছি, বাধা দেব না। খোদা ভরসা, যা হয় হবে। তার ইচ্ছাতেই এ-সব হচ্ছে। তিনিই করাচ্ছেন।

গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে বদর জামানকে চুমায় চুমায় ভরে দিতে থাকে। এতক্ষণে জামানের সন্দেহ হয়, সম্রাট-এর শরীরে খুঁৎ আছে। যতই সে তাকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে ততই তার সন্দেহ আরও ঘনীভূত হতে থাকে। নাঃ, এতো কোনও পুরুষের দেহ নয়। বিস্ময়ে অবাক হয়ে চেয়ে থাকে জামান। তখন বদর উত্তেজনায় উন্মত্ত।–সোনা, আমাকে তুমি এখনও চিনতে পারছে না? আমি যে তোমার বন্দর। আমাদের সেই শাদীর রাত তারও আগে আর একটি রাতের স্মৃতি কি তোমার মন থেকে মুছে গেছে?

বদর এবার তার ছদ্মবেশের সকল সাজ খুলে ফেলতে থাকে।

কামার অল-জামান দেখলো, ছদ্মবেশের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এলো সম্রাট ঘায়ুরের কন্যা বদর। তার নয়নের মণি, বুকের কলিজা।

বহুদিন বাদে আবার তাদের এই মিলনে আনন্দের বন্যা বয়ে যেতে থাকলো। বদর তার কাহিনী বললো জামানকে। জামান শোনালো, তার দুঃখের কিসসা।

জামান বললো, কিন্তু আজ যা করলে তার কিন্তু জবাব নাই বন্দর।

দেহ, মন একাকার করে আনন্দে বিভোর হয়ে সারাটা রাত সুখ শয্যায় কাটিয়ে দিলো ওরা।

খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে বন্দর এলো আরমানুসের কাছে। অকপটে সমস্ত কাহিনী সবিস্তারে বললো তাকে। আর এও বললো, আপনার কন্যা হায়াৎ এখনও কুমারী। কামার অল-জামানকে আপনি জামাই করতে চেয়েছিলেন। সেই জামান আপনার প্রাসাদেই অপেক্ষা করছে। আপনি ইচ্ছা করলে তার সঙ্গে হায়াতের শাদীর ব্যবস্থা করতে পারেন।

—কিন্তু মা, তুমি, আরামানুস, আকুলভাবে প্রশ্ন করে, তোমার কোনও অমত নাই?

—আমার মত আছে বলেই বলছি। হায়াৎকে আমি ছোট বোনের মতো, বন্ধুর মতো ভালোবেসে ফেলেছি। ওকে ছাড়া আমি আর বঁচিতে পারবো না’। জামানের সঙ্গে তার শাদী হলে আমরা দুই বোন সব সময় একসঙ্গেই থাকতে পারবো। এতে আমার চেয়ে আর কেউই বেশি খুশি হবে না।

এই সময় কামার আল-জামানকে নিয়ে হায়াৎ এলো সেখানে। আরমানুস বললেন, বাবা, জামান, তুমি আমার মেয়েটিকে গ্রহণ করে আমার এই সাম্রাজ্যের অধিকারী হও। সে তোমার দ্বিতীয় বেগম হয়েই সুখে থোক।

জামান বললো, আপনার ইচ্ছা আমি অপূর্ণ রাখবো না, সম্রাট। তাছাড়া আমার বদরও যখন চায়, আমার কোনও অমত থাকতে পারে না।

এই বলে সে বদরের দিকে তাকায়। বদর বলে, আমি এতকাল এখানে পড়ে আছি শুধু এই জনাই। তুমি আসবে, তোমার সঙ্গে হায়াতের শাদী হবে। সে হবে তোমার খাস বেগম। আমি দ্বিতীয়া–তার সেবা দাসী।

আরমানুসের দিকে ফিরে কামার আল-জামান বলে, আপনি তো নিজের কানেই শুনলেন, বদর বলছে, আপনার মেয়েই হবে প্রধান বেগম, সে হবে তার বাঁদী।

বৃদ্ধ সম্রাট আনন্দে উৎফুল্প হয়ে উঠলেন। অনেকদিন পরে আবার একবার তিনি সিংহাসনে গিয়ে বসলেন। উজির আমীর। ওমরাহদের উদ্দেশ করে বলতে লাগলেন, কামার আল-জামান আর বদরের বিচিত্র কাহিনী।

দরবারে উপস্থিত সকলে সেই পরমাশ্চর্য কাহিনী শুনে তাজ্জব হয়ে গেলো। সম্রাট ঘোষণা করলেন, আমার একমাত্র কন্যা হায়াৎ আল-নাফুস-এর পাণি গ্রহণ করবে। শাহজাদা কামার অল-জামান। এবং আজ থেকে জামান এই এবানী দ্বীপের অধিপতি হচ্ছে।

সম্রাট আরমানুসের ঘোষণা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সকলে আভুমি আনত হয়ে কুর্নিশ জানালো। এবং সমস্বরে শপথ উচ্চারণ করলো, আজ থেকে কামার আল-জামান আমাদের সম্রাট—আমরা তার একান্ত অনুগত ভৃত্য। তাঁর আজ্ঞাবহ দাস।

সম্রাট আরমানুস সন্তুষ্ট হয়ে সবাইকে আসন গ্রহণ করতে বললেন। তার নির্দেশে শহরের প্রধান কাজী এসে শাদীনামা তৈরি করলেন। গণ্যমান্য ব্যক্তিরা সাক্ষী হিসাবে স্বাক্ষর করলেন সেই শাদীিনামায়। এ সবই কামার আল-জামান এবং হায়াৎ আল-নাফুসের সম্মতিক্রমে তাদের সমক্ষেই সমাধা করা হলো। ‘

সম্রাট আরমানুসের আদেশে দরবার দপ্তর সব বন্ধ রাখা হলো। আজ কোনও কাজ নয়। শুধু আমোদ-আহ্লাদের দিন। খানা-পিনা নাচ-গান বাজনায় মুখর হয়ে উঠলো সারা এবনী দ্বীপ। হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষের আজ অবাধ নিমন্ত্রণ। হাজার হাজার জন্তু-জানোয়ার জবাই করা হলো। দেশের যত মানুষ আছে, সকলকে আজ পেটপুরে খাওয়াতে হবে। এই-ই সম্রাটের হুকুম। গরীবজনে অর্থ পোশাক বিতরণ করা হতে লাগলো। সেনাবাহিনীর মধ্যেও নানা উপহার উপটৌকন এবং নগদ অর্থ বন্টন করা হলো।

আপামর জনসাধারণ ধন্য ধন্য করতে লাগলো। নতুন সম্রাটের শতায় কামনা করে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানাতে থাকলো।

কামার আল-জামান দুই বেগম নিয়ে সুখে-সচ্ছন্দে ঘর করতে লাগলো। তার ন্যায় বিচার এবং অনুশাসনে প্রজারা মহা খুশি হলো।

কামার অল-জামান তার বাবা শাহরিমানের কাছে দূত পাঠিয়ে জানালো, এবনি দ্বীপের সুলতান হয়ে সে বেশ বহাল তবিয়তেই আছে। খুব শিগ্‌গিরই সে তাকে দেখতে যাবে। তার আগে সে একবার যুদ্ধ যাত্রা করবে। এখানকার সমুদ্রতীরের এক শহর পশ্চিমী বর্বর ম্লেচ্ছারা আক্রমণ করে তছনছ করে দিয়েছে। তাদের সে শায়েস্তা করতে যাবে।

বছর খানেক বাদে বদর এবং হায়াৎ একটি করে পুত্র লাভ করলো। দুটি শিশুই দেখতে হলো চাঁদের মতো ফুটফুটে সুন্দর। একই সঙ্গে হেসে খেলে তারা মানুষ হত্বে থাকলো। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তাদের আর কেউ বিচ্ছেদ ঘটাতে পারেনি।

এই হলো কামার আল-জামান আর বদরের কাহিনী।

শাহরাজাদ স্মিত হেসে চুপ করলো।

কাহিনী শুনতে শুনতে দুনিয়াজাদের ধবধবে সাদা চাঁদের মতো মুখে আবীরের ছোঁয়া লেগেছে। চোখে মুখে খুশির বন্যা।

গল্পের বিষয়:
ফ্যান্টাসি
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত