অদ্ভুত এক দৃশ্যে চোখ আটকে গেছে লিলি’র। জানালার গ্রিল ছুঁয়ে ঢুকছে চাঁদের আলো। সেই স্নিগ্ধ আলো মায়াময় করে রেখেছে সমস্ত ঘর। লিলি তাকিয়ে আছে তাকে পান করতে দেয়া মাটির জারে রাখা পানির মধ্যে। চাঁদটা ঢেউ
খেলিয়ে ঠিক ওখানটাতেই খেলা করছে। কি সুন্দর দৃশ্য! অন্য যে কোন সময় হলে একটি কবিতা লিখে ফেলা যেত। কিন্তু এখনকার দৃশ্যপট ভিন্য। হতাশা আর ভয় তার মনকে জড় বস্তুতে পরিণত করছে। গত দু-দিন ধরে তাকে আটকে রাখা হয়েছে। এক বুড়ো মতন লোক এসে খাবার দিয়ে যাচ্ছে, ব্যাস! মানুষের আনাগোনা বলতে অতটুকুই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে লিলি। মেঝেতে রাখা মাদুরে বসে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে বাইরে তাকায়। সম্ভবত একটি জংগলে আনা হয়েছে তাকে। বাইরের ঘন গাছ-গাছলা তারই প্রমাণ দেয়। মাঝেমাঝে ঝিঁঝিঁ পোকার ঝংকার ছাড়িয়ে বন্য শেয়ালের ডাক কান এড়ায় না। আর গাছের পাতায় বাতাসের শন শন শব্দ তো আছেই। উফ! সব কিছুর মাঝেই ভয় যেন লেপটে আছে! আজ বিকেলে সে অনেক ক্ষণ চিৎকার করল, দরজা ধরে বেশ কিছুক্ষণ ধাক্কাধাক্কি করল, কিন্তু কারও সারা শব্দ পেল না। লোকালয় থেকে এত দূরে বলেই বোধয় তার হাত, পা এবং মুখ খুলে দিয়েছে। এরা জানে, যত খুশি ডাকাডাকি করুক না কেন, কেউ আসবে না বাঁচাতে। খুট করে একটা শব্দ হতেই দৌড়ে জানালার কাছে ছোটে লিলি,
কপাল ঠেকায় গ্রিলে। তীব্র বাতাসের বেগে গাছের ডাল এসে জানালার কাছটায় বারি খাচ্ছে বলেই শব্দটা হচ্ছে। ব্যাটারি চালিত টর্চ লাইট জ্বালিয়ে জানালা বন্ধ করে পায়চারি করতে থাকে সে। আসবাব পত্র বলতে ছোট্ট এই টর্চ লাইট-ই, আর কিছুই নেই ঘড়টায়। পাশেই একটি লাগোয়া শ্যাওলাটে বাথরুম। সেই বাথরুমে কোন আয়না নেই, একটা বালতি আর জগ পড়ে আছে। ব্যাপারটা নিশ্চয় ইচ্ছাকৃত। বন্দিনী আয়না ভেঙ্গে অঘটন ঘটিয়ে বসতে পারে, এই ভেবেই হয়ত এরা এরকম কিছু রাখেনি। অসুস্থ বাবা আর ছোট বোন বাবলির কথা ভীষণ মনে পড়ছে। এমন কি তাদের পোষা বিড়াল গাবু’র ছবিটাও ভেসে উঠছে। কে জানে বাবা ঠিক মতন ঔষধ খেল কিনা… বাবলিটা স্কুলের পড়া সেরেছে কিনা… অলস গাবুটা পাড়া বেড়িয়ে ঘরে ফিরল কিনা…
কি করছে তারা এখন…?! মনটা বিষাদে ভরে উঠলো লিলি’র।
বাবা’র পেনশনের অল্প কিছু টাকায় এবং টিউশনি করে তাদের ৩ জনের সংসার সেই টেনে আসছিল এতদিন। যত সমস্যা তার এই শারীরিক সৌন্দর্য। এই রূপের কারনেই আজ সে এই ভয়ঙ্কর বিপদের সম্মুখীন হয়েছে। সব কিছু কেমন অবিশ্বাস্যকর মনে হচ্ছে! এইতো সেদিনেরই কথা, চাকরির সন্ধানে একটি প্রাইভেট কম্পানিতে যেতেই বেড়াজালে আটকে গেল। কম্পানির বস এর খারাপ ইঙ্গিতে সায় দিতে অস্বীকার করে বেড়িয়ে আসে সেখান থেকে। এরপরই আসতে থাকে নানান রকম হুমকি। থানায় একটি সাধারণ ডায়রিও করেছিল। কিন্তু ওই শয়তান ব্যক্তির প্রভাব এর কাছে থানা পুলিশ খেলা ঘর মাত্র। অবশেষে এই পরিনতি। শয়তানের চ্যালাগুলো উঠিয়ে এনে এখানটায় আটকে রেখেছে তাকে। যতদূর বোঝা যায় তারা তাকে নিশিদ্ধ পল্লীতে পাচার করতে চায়। কি আশ্চর্য, মানুষ রূপের মুখোশের ভেতর এমন কুৎছিৎ নোংরা একটি অমানুষও থাকতে পারে! ঘৃণা আর ভয়ে লিলি’র গা গুলিয়ে আসতেই তাড়াতাড়ি বাথরুমে যেয়ে হরবরিয়ে বমি করে। ফিরে এসে হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে মেঝেতে বসে। শরীর হালকা লাগলেও মন ভীষণ অস্থির। হঠাৎ লিলি’র খেয়াল হল চারপাশ বড় বেশী নিঃশব্দময়.. শব্দ বলতে শুধু তার নিঃশ্বাস
প্রশ্বাসের। ঝিঁঝিঁ পোকাগুলোও আর ডাকছে না। এমন কেন হচ্ছে !? গুটিগুটি পা ফেলে টর্চ লাইটের পাশে যেয়ে ওটাকে হাতে নিয়ে বসে রইল সে। আলোটাই যেন ভরসা। তারপর হাত পা গুটিয়ে নিজেকে দেয়ালের সাথে মিশিয়ে ফেলল। বাথরুমের দরজা খোলা, ওদিকে চোখ যেতেই মনে হল, অন্ধকার থেকে কেউ একজন তার দিকে তাকিয়ে আছে। লিলি সাথে সাথে দৌড়ে যেয়ে স্বশব্দে ওটা বন্ধ করে দিল। ঘামছে সে। বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে নিজেকে। যখনি ভাবছে এই জনমানব হীন জঙ্গলে একা একটি ঘড়ে আটকা পড়ে আছে, তখনি ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। চারিদিকের নৈশব্দতা আর সহ্য হচ্ছে না। হেঁচকি তুলে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। সেই কান্না প্রতিশব্দ হয়ে তার কাছেই ফিরে আসে। অন্ধকার নিশুতি রাতের রহস্যময় জগৎ এ সেই কান্নাও অতিপ্রাকৃত ঠেকে। মানুষ কী করে এত নিষ্ঠুর হয় ! কিভাবে তারা একা আরেকজন মানুষকে এমন একটি জায়গায় বন্দি করে রাখতে পারে !!
একসময় ফুঁপাতে ফুঁপাতে ঠিক মায়ের গর্ভে থাকা শিশুর মতন দেয়াল ঘেঁষে শুয়ে পরে লিলি। চোখ বন্ধ করে ওড়না দিয়ে ঢেকে নেয় সমস্ত মুখ। নিজেকে লুকাতে চায় এই ভয়ানক রাত্রি থেকে। ঠিক তখনই টর্চ লাইটের আলো কেঁপে কেঁপে ওটা বন্ধ হবার পূর্বাভাস দিল। একসময় বন্ধও হয়ে গেল। ব্যাটারির চার্জ শেষ। পিটপিট করে চোখ মেলেই আবার বন্ধ করে ফেলে লিলি। আল্লাহ্র নাম নিতে নিতে ঘুমিয়ে পড়তে চায়। কিন্তু ঘুম তো আসে না কবরের মতন নিখুঁত এই অন্ধকারে…! বাবা আর বাবলির কথা ভাবতে থাকে সে। বাবা যেন তাকে বলছে, “সাবধানে যাস মা।” অথবা, “ইয়ে, মানে মা লিলি, বাজারে কি কম দামে আপেল পাওয়া যায়রে… ?”
বাবাটা ওমনই… সরাসরি বলবে না, “লিলি, আপেল খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। ক’টা আপেল কিনে আনিস।“
হয়তো ভাবে, আর কত জ্বালাবে মেয়েকে…
এরপরই ভেসে উঠে ছোট্ট বাবলির মিষ্টি মুখখানা… কানে বেজে উঠে তার কলরব… সবে ক্লাস টু-তে উঠেছে সে, এতে করে সেকি উচ্ছ্বাস! “এই লিলিবু… আমার জন্য পেন্সিল আনোনি যে…? লিলিবু দেখ, একটা ছড়া লিখেছি… লিলিবু, আমাকে একটা মাছ এঁকে দাও না, আমি আঁকতে পারছি না তোঁ…“ আরও কত্ত কথা যে বলে এই মেয়েটা… সে মৃদু ধমক দিয়েও থামাতে পারে না। পকপক চলতেই থাকে…লিলি তাকে ডাকে করকরি বেগম।
এখন বড্ড ইচ্ছে হচ্ছে বাবলির অবিরত কথাগুলো শুনতে। বড্ড ইচ্ছে হচ্ছে বাবলি তাকে প্রশ্ন করে করে কান ঝালাপালা করে দিক। কিন্তু কোথায় কী !? চারিপাশের থমকে যাওয়া নীরবতা যেন তার গলা চেপে ধরতে চায়।
এগুলো ভাবতে ভাবতেই এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে লিলি। সে জানে না আগামী কাল তার জন্য কি বয়ে আনছে। তবে ধারনা করতে পারে, কোন সুখবর নয়, দুঃসংবাদ এর বার্তাই নিয়ে আসবে… আধো ঘুমেও বুক চিঁরে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এল…
ভোরের আলতো আলোর রেখা পৃথিবীকে ছুঁতেই জঙ্গলে তুলকালাম কাণ্ড শুরু হল! লিলি জেগে ধড়ফড় করে উঠে বসে। প্রথমে কিছু বুঝতে না পারলেও পরে ঘটনা পরিষ্কার হয়। বাইরে পাখির কিচিরমিচিঁর শব্দে কানে তালা লাগার অবস্থা। তারাতারি জানালার কপাট খুলে দেয় সে। সাথে সাথেই এক মুঠো শীতল বাতাস ছুঁয়ে যায়। সূর্য উঠি উঠি করছে। গাছের ফাঁক ফোঁকর ভেদ করে সেই আলো গলে গলে বেড়িয়ে এসেছে তার জানালা অব্দি। বাহ! কি সুন্দর… এক মুহূর্তের জন্য লিলি তার বর্তমান ভুলে প্রকৃতির সৌন্দর্যে হারিয়ে যায়। ভুলে যায় গত রাতের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা। মনে মনে ভাবে, যেই স্রষ্টা এত সুন্দর করে এই পৃথিবীটাকে গড়েছেন। তিনি না জানি কত সুন্দর…!
ভাবনায় ছেদ পড়ল পায়ের গোড়ালিতে পিঁপড়ার কামড়ে। গতকাল সকালে দিয়ে যাওয়া খাবারে পিঁপড়া সৈনিক আক্রমণ করেছে। গোড়ালিতে হাত দিতেই ডান পায়ের নূপুরটায় চোখ আটকে যায়। বাবলি টাকা জমিয়ে গেল মেলায় কিনে দিয়েছিল। তারপর আদুরে কণ্ঠে বলেছিল, ”নূপুর তো কিনে দিলাম, এবার তুমি আমায় একটা লাল ফ্রক বানিয়ে দিবেই দিবে কিন্তু…”
এক জোড়ার মধ্যে একটি অনেক আগেই হাড়িয়ে গেছে। এখন বাকি আছে এটি। লিলি পরম মমতায় নূপুরে হাত বুলায়। তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে…
ফ্রেশ হয়ে চুপচাপ বসে রইল সে। একটু পরই বোধহয় কাশিরাম না যেন কী নাম, খাবার দিতে আসবে। বুড়োটে লোকটা কিছুক্ষণ থেকে টুকিটাকি কথা বলে তারপর তাকে এই নির্জনে একা ফেলে চলে যাবে। এই দিনদুপুরেই ভয়ে সমস্ত শরীর শিরশির করে উঠে তার। আরেকটি রাত যদি এখানে থাকতে হয়, নির্ঘাত মারা পরবে।
বাইরে মৃদু কাশির শব্দ সহ দরজার তালা খোলার আওয়াজ পাওয়া গেল। লিলি একটু নড়েচরে বসল। হ্যাঁ, কাশিরাম-ই। এক হাতে বিড়ি আরেক হাতে দুটো প্যাকেট, ওখান থেকেই মৌ মৌ করে খাবারের গন্ধ আসছে। কিন্তু তার
একদমই ক্ষুধা নেই। পেট গুলাচ্ছে দু-দিন ধরে। কাশিরাম পুরোপুরি ঘরের ভেতর না ঢুকে বিড়ি ধরা হাতটি বাইরে রেখেই অন্য হাতের প্যাকেট দুটো সযত্নে মেঝেতে রেখে বেরিয়ে যায়। তারপর ফুসফাস করে বিড়ি শেষ করে ভেতরে আসে। লিলি মনে মনে লোকটাকে ধন্যবাদ জানায়। বিড়ির গন্ধ তার একদমই সহ্য হয় না। যদিও এই বুড়ো এটা জানে না, তবুও তার ভদ্রতা ভাল লেগেছে। হঠাৎ লিলি’র মাথায় একটা চিন্তা খেলে গেল। এই বুড়োটাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দৌড়ে পালালে কেমন হয়? পরক্ষণই সেই আশা বাদ দিল। নিশ্চয় বুড়ো একা আসেনি, হয়তো ওই শয়তানের আরও চ্যালা প্যালা আসে পাশেই আছে। খচখচ শব্দে ফিরে তাকায় লিলি। কাশিরাম প্যাকেটগুলো খুলছে। একটি থেকে খাবার বের করে এগিয়ে দিল। আরেকটি তার হাতে ধড়িয়ে দিয়ে বলল,
“এইটায় আপনার জন্যে একটা নতুন জামা আছে, পইরে নিয়েন।“
বলেই হাতের নখ খুটতে থাকে। লোকটি যখনি আসে একবারও তার দিকে ঠিক ভাবে তাকায় না। কী সেই রহস্য কে জানে। হয়তো তার বস এর হুকুম। তার একান্ত শিকারের উপর কেউ তাকাতেও পারবে না। লিলি বলবে না বলবে না করেও জিজ্ঞেস করে ফেলল,
“আমাকে কবে পাচার করা হবে ?”
কাশিরাম বেশ অবাক হয়ে তাকাল। তারপর আবার হাতের নখ পরোখ করতে করতে জবাব দেয়,
“হয় আইজকে রাইতে, আর নাহয় আগামীকাইল রাইতে… “
“ওহ আচ্ছা, নতুন জামা কেন এনেছেন? আপনার বস কি আমাকে পাচার করার আগে ভোগ করতে চায়?”
কাশিরাম থমকে গেল। কি বলবে বুঝতে পারে না। মেয়েটা ঠিকই ধারনা করেছে। তাদের বস আজ রাতে আসবে বলেই তাকে দিয়ে নতুন জামাটা পাঠিয়েছে। বস এর অনুগত চ্যালা সে। বহুবছর ধরে এই কাজ করে যাচ্ছে। জংলার ঠিক পাশেই তাকে ঘর তুলে দিয়েছে বস। কত মেয়েকে আনল এই বাড়িতে সে। কত মেয়ের চিৎকার চাপা পরে আছে এই দেয়ালের ইটে। কিছু আবার পালাতে যেয়ে জঙ্গলে ব্যাঘাতে প্রাণটা দিয়েছে।
“কি হল, কথা বলছেন না কেন ?”
“ইয়ে…আমি বলতে পারতেছি না সঠিক…”
“ওহ… “ লিলি চাপা নিঃশ্বাস ফেলল।
কাশিরাম আড়চোখে মেয়েটার দিকে তাকাল। জীবনে এই প্রথম বারের মতো তাদের বন্দী শিকারের জন্য মায়া হচ্ছে। এর পেছনে একটা কারন অবশ্য আছে। এই মেয়েটার চেহারার মধ্যে তার কন্যা মন্দিরার সূক্ষ্ম ছাপ রয়েছে। মন্দিরার চোখগুলোও এমন ডাগর ডাগর ছিল। নাকটা ঠিক এমনি চাপা। চুলগুলোও হাঁটু ছুঁই ছুঁই করত। প্রায় এক যুগেরও বেশি হয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে মেয়েটা । এই সর্বনাশা জঙ্গলই তার তাকে খেল। জুয়ার নেশায় ৫ রাত বাড়িতে ফিরেনি কাশিরাম। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মন্দিরা বাবাকে খুঁজতে আসে এখানে। সে জানতো এটাই তাদের গুপ্ত আস্তানা। কিন্তু এরপর কাশিরাম বাড়িতে ফিরলেও মন্দিরা আর ফিরেনি। পাশের বাড়ির পিসি মুখ ঝামটে বলেছিল, “কে জানে তোকে খুঁজতে যেয়ে কোন নরকে আটকা পরেছে তোর মাইয়া। কমতো জ্বালাসনি মা মরা মাইয়াটারে, নে… এইবার নিজে জ্বল। তোর চিন্তায় শেষটায় আর ঘরে থাকতি পারল না সে।“
পিসির কথা সত্য হয়ে গেল। মন্দিরা ফিরল না। সেই থেকে কাশিরাম শুধু জ্বলছে আর জ্বলছে…
চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসতেই জানালার কাছে চলে গেল কাশিরাম। মন্দিরা তার বিড়ি খাওয়া একদম সহ্য করতে পারত না। তার নাকি দম বন্ধ হয়ে আসত। অনেক বকাঝকা করত এ নিয়ে। আজ বিড়ি খাওয়ার সময় মনে হল লিলি নয়, মন্দিরাই তার সামনে বসে আছে। তাইতো সে ভেতরে বিড়ি নিয়ে ঢুকল না। নাহ, মা মরা মেয়েটাকে সে বড় বেশীই দুঃখ দিয়ে ফেলেছে। কোথায় এতদিনে তার বিয়েটা দিয়ে সংসার সাজিয়ে দিত, দুই, তিনটে নাতি নাতনীর মুখ দেখত, তা না করে আইবুড়ো বানিয়ে তার জ্বালাতন সহ্য করিয়েছে। পিতার কোন দায়িত্বই কাশিরাম পালন করতে পারল না। এখন ভগবানের কাছে একটাই প্রার্থনা, যেখানেই থাকুক মেয়েটা ভাল থাকুক। নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এল…
“দুটো ব্যাটারি কিনে দিয়ে যাবেন? গতকাল থেকে টর্চ লাইটটা আর জ্বলছে না। অন্ধকারে বড্ড ভয় লাগে”
কাশিরাম এবার সরাসরি লিলি’র দিকে তাকাল। আহারে মেয়েটা, একা এই জঙ্গলে নিশ্চয় তার ভয় করে।
“আচ্ছা, বৈকালে কিনে দিয়া যাব নে।“
“আচ্ছা… “ বলেই লিলি উদাস হয়ে বাইরে চোখ ফেরায়।
“এইখানে খাবার আছে, খাইয়া নেন…”
“হুম …“
কাশিরাম বুঝল লিলি তার কথা খেয়াল করছে না। আর দাড়িয়ে না থেকে বেরিয়ে গেল সে। মায়া লাগছে মেয়েটার জন্য। আরও কিছুক্ষণ থাকলে সেই মায়া দ্বিগুণ হবে। এটা করা যাবে না।
কাশিরাম চলে যেতেই লিলি দু-হাঁটুর মাঝে মাথা গুঁজে ডুকরে কেঁদে উঠল। তার জীবনটা হঠাৎ করে এমন ওলট পালট হয়ে যাবে কে জানতো? নাহ, প্রয়োজনে মরে যাবে তবুও কিছু নরপশুর লালসার শিকার হয়ে নিজেকে বিলিয়ে দিবে না। এখন কথা হচ্ছে কিভাবে মরবে সে ?! কোন উপায় কি আছে ?!পরক্ষণই ভাবল, উপায় একটা বের করতেই হবে, যেভাবেই হোক।
লিলি উঠে দাঁড়াল। তারপর জানালার কাছে গিয়ে গ্রিলে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বুঝল। আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিতেই নিজেকে বেশ হালকা লাগছে। সে জানে, এটা মহা পাপ। কিন্তু আর কোন রাস্তা যে দেখছে না। হঠাৎ কোত্থেকে শীতল বাতাস এসে সমস্ত ঘরে বইতে লাগল। লিলি কেঁপে উঠে জানালা বন্ধ করে দেয়। বাথরুমের ভেন্টিলেটর দিয়ে আসা আলোর নকশা ঘরের মাঝামাঝি এসে পড়েছে। সেখানটায় বসে রইল। মনে মনে আল্লাহ্ কে স্মরণ করছে। হতাশা, গ্লানি, ভয় আর বিপদ… এই সকল কিছু থেকে ওই একজনই তাকে মুক্তি দিতে পারে।
এভাবে কতক্ষণ পার হল ঠিক নেই। দরজায় শব্দ পেতেই লিলি ধড়ফড় করে উঠে দাড়ায়। ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। খুশখুশ কাশির শব্দ তাকে আশ্বস্ত করে। কাশিরাম-ই। হয়তো ব্যাটারি নিয়ে ফিরে এসেছে। তবে এত তাড়াতাড়ি জংগলের বাইরে যেয়ে আবার ফিরেও আসল সে!
কাশিরাম চুপচাপ ঘরে ঢুকল। তারপর মৃদু কণ্ঠে বলল, “এদিকে আসেন একটু…“
লিলি ধীরে ধীরে এগিয়ে হাত বাড়াল। সে ধরেই নিয়েছে কাশিরাম ব্যাটারি দিতে এসেছে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে কাশিরাম দরজা থেকে সরে দাড়ায়। তারপর দৃঢ় কণ্ঠে বলে, “ তাড়াতাড়ি চইলা যান এইখান থাইকা। ঘর থাইকা বাইর হইয়া ডাইনে গেলেই একটা খাল পাইবেন, সেই খাল পার হইয়া সোজা দৌড়াই চলে যাবেন। একটু দূরের পথ। কিন্তু আর কোন উপায় নাই।”
লিলি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কথাগুলো যেন সে বুঝতে পারছে না। তার ডাগর চোখ আরও বড় দেখাচ্ছে।
কাশিরাম এবার তাড়া দিল, “দেরী করতেছেন কেন?! জলদি করেন! “
লিলি কি বলবে ভেবে পায় না। সে কি সত্যি মুক্তি পাচ্ছে এই নরক থেকে ?! নাকি কোন সুন্দর স্বপ্ন দেখছে ?! হয়তো ঘুম ভাঙতেই দেখবে দেয়াল ঘেঁষে পড়ে আছে।
“আম্মাজান, আপনে তাড়াতাড়ি ভাগেন। সময় নষ্ট কইরেন না।“
লিলি’র হুস ফিরল। সে দ্রুত বেগে বাইরে পা বাড়িয়ে কিছুদূর যেয়ে ফিরে তাকাল। বুড়োটে লোকটা চোখ মুছছে। কৃতজ্ঞতায় লিলি’র ও চোখ ভিজে উঠে। কিন্তু সময় বড় অল্প। সন্ধ্যার আগেই এই জংগল থেকে বেরুতে হবে। আর দাড়িয়ে না থেকে দৌড় শুরু করল সে।
কাশিরাম ঘোলা চোখে তাকিয়ে আছে। ঐ তো, লিলি নামের মেয়েটা ছুটছে। এক সময় দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেল, মিলিয়ে গেল সবুজের মাঝে।
কাশিরামের বেশ ভাল অনুভূত হচ্ছে। যেন তার মন্দিরাকেই মুক্ত করল। মন্দিরাকে ছাড়া এই প্রথম অন্য কোন মেয়েকে আম্মাজান ডাকল। সে মনে মনে শপথ করে ফেলল, পাপের জীবনে সমাপ্তি ঘটাবে। এই পাপের জন্যই হয়তো তার মা মরা মেয়েটাকে হারিয়েছে। অনেক হয়েছে! কী জবাব দিবে ঈশ্বরের কাছে!? আহ… বড্ড দেরীতে বুঝল। সে জানে বস জানলে তাকে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে হবে। তাতে কী, মৃত্যু’র আগে অন্তত একটা ভাল কাজ তো করতে পারল। এই বা কম কিসে…
ওখানেই চুপচাপ গালে হাত দিয়ে বসে রইল কাশিরাম। কি হবে পালানোর বৃথা চেষ্টা করে, বস তাকে খুঁজে বের করবেই। বয়সও কম হল না। দৌড়ানোর মতো শক্তি আর অবশিষ্ট নেই এই শরীরে। এরচেয়ে বরং এখানেই বসে থাকা যাক। যা হবার হবে……
লিলি প্রাণপণ দৌড়ে যাচ্ছে। গায়ের জামার রং সবুজ হওয়াতে সহজে কারও চোখে পড়বে না ভেবে ভাল লাগছে। কাশিরামের কথা অনুযায়ী যতক্ষণ না একটা খাল সামনে পরবে ততক্ষণ সোজা দৌড়ে যেতে হবে। সে তাই করছে… প্রশারিত ডাল পালা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে, শুকনো পাতা মারিয়ে ছুটে চলছে। একসময় ক্লান্ত হয়ে বসে পরে। দুই দিন ঠিকমতো দানাপানি পড়েনি পেটে। তবুও বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষায় এতক্ষণ এভাবে ছুটে এসেছে। কিন্তু শরীর আর সায় দিচ্ছে না। কখন পাবে সেই খালের দেখা!? এদিকে খালি পায়ে দৌড়ানোর কারনে পায়ের চামরা অনেক জায়গায় ছিলে গেছে। কাপড়ে বুনো কাঁটা আটকে আছে। ওগুলো ছাড়াতে চাইতেই হাতে বিঁধল। হালকা আর্তনাদ করে আঙ্গুল মুখে পুরে ভয়ার্ত চোখে এদিক ওদিক তাকায় সে। কত্ত নাম না জানা গাছ যে এখানটায়। এই দিন দুপুরেই চারপাশে কেমন থমথমে অন্ধকার। মাথার উপর গাছ-গাছলা ছাড়িয়ে এক খণ্ড আলোকিত আকাশই আশার পিদিমটাকে জ্বালিয়ে রাখে। শান্তনা দেয়, এখানেই শেষ নয়, এর বাইরেও সুন্দর সুস্থ পৃথিবী তার জন্য অপেক্ষা করছে। চিন্তার মাঝেই চোখ বুঝে আসে। তন্দ্রায় হারিয়েই যাচ্ছিল, তখনি দূর থেকে খস খস মৃদু শব্দ আসল… অলসতায় চোখ মেলতে যেয়েও পারল না লিলি। শব্দটা অবিরত নিকট থেকে নিকটবর্তি হচ্ছে…
হঠাৎ সব কিছু মনে পড়তেই চমকে চোখ মেলে সে। ভুল নয়, পেছন থেকে সত্যিই একটা শব্দ আসছে। পাতার মড়মড় শব্দ… শয়তানগুলোর কেউ কি তার পিছু নিল?! লিলি আর এক মুহূর্ত দেরি না করে উঠে দাঁড়ায়। শরীর অসাড় হয়ে আছে। পা দুটোও চলতে চাইছে না। কিন্তু কিচ্ছু করার নাই। তাকে যেভাবেই হোক সন্ধ্যার আগে এই জংগল থেকে বেরুতে হবে। নাহলে শয়তানগুলোর হাত থেকে রক্ষা পেলেও, বন্য জানোয়ারের হাতে প্রাণটা দিতে হবে।
কতক্ষণ পার হল কে জানে! দিনের আলো ক্ষীণ হয়ে আসছে। কই! খালের দেখা তো এখনও পেল না সে! সম্ভবত রাস্তা ভুল করেছে। এমন ভাবনা আসতেই হতাশা মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। ক্ষত বিক্ষত পা দুটোকে টেনে কপালের ঘাম মুছে নেয় লিলি। এখন কী হবে!! ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, সেই সাথে ক্লান্তি আর ভয় তো আছেই। পেটের তৃষ্ণা, ক্ষুধাও মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। কি করবে ভাবতে ভাবতে বিশাল এক নাম না জানা গাছের নিচে দাড়িয়ে পড়ল। ছাতার মত বৃত্ত এঁকে ছায়া দিয়ে যাচ্ছে ওটা। শেষ বিকেলের সোনালী রোদের টুকরো জ্বল জ্বল করছে গাছের উপরের দিকের পাতায়। ওখানটায় কোমল উষ্ণ আলোয় মাখামাখি। কিন্তু এত সৌন্দর্যের মধ্যেও হিংস্রতার আঁচড়
টের পাওয়া যায়। আনমনে পা বাড়াতেই মাথার উপর চুল ছুঁয়ে কিছু উড়ে গেল। আঁতকে চিৎকার করে উঠে লিলি। উপরে তাকাতেই এক অদ্ভুত পাখি চোখে পড়ে। জংলী কোন পাখি। বুকের মাঝে ৩ বার থুথু ছুঁড়ে লিলি। ছোটবেলার কুসংস্কার। তারপরই বিরবির করে আল্লাহ্কে স্মরণ করে। ধুকপুকানি কমছে না। অজানা আশংখায় মন অস্থির হচ্ছে। ইশ! ভুল হয়ে গেছে, কেন যে কাশিরামকে বলল না, তাকে এগিয়ে দিতে। পরক্ষণই মনে হল, পালাতে সাহায্য করেছে সেই তো অনেক! ওখান থেকে মুক্তি পাবে এটা সে আশাই করেনি। আর দাড়িয়ে না থেকে আবার বিদ্ধস্ত পায়ে এগোয় লিলি। হোক যন্ত্রণা, তবু থেমে গেলে চলবে না। কিন্তু কিছুতেই যে খালের দেখা পাচ্ছে না সে। মনে হচ্ছে অগ্রসর হওয়া তো দূরের, ঘুরে ফিরে যেন একই জায়গায় চলে আসছে। হতাশা এবং ক্লান্তিতে যখন প্রায় মূর্ছা যাবার
অবস্থা হল, ঠিক তখনি একটি অদ্ভুত জিনিস চোখে পড়ল। সামনেই বেশ কিছুটা দূরে গাছ-গাছলার আড়াল থেকে একটি ঘরের বিধ্বস্ত চালা দেখা যাচ্ছে। লিলি’র হৃদপিণ্ডে ঝড় শুরু হল। এমন গভীর জঙ্গলে কে থাকতে পারে? ওই শয়তানগুলো না তো ? কিন্তু তা কী করে সম্ভব ?! সেই কত্ত পেছনে ফেলে এসেছে ওদের। আর এ ঘরটা একদমই অন্যরকম। কুঁড়ে ঘর। কি করবে ভেবে না পেয়ে আনমনে পা বাড়ায় সে। দুই কদম এগিয়ে আবার পেছনে ফিরে আসে। কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে মনে। ইচ্ছে হচ্ছে ওখানটায় যেতে, আবার পরক্ষণই মনে হচ্ছে, কী প্রয়োজন শুধুশুধু যাবার?! কে না কে আছে। ঠিক তখন সামনের গাছের ডালে চোখ গেল লিলি’র। কিছুক্ষণ আগের সেই ভয়ঙ্কর পাখিটা বসে আছে। মনের ভুল কিনা জানে না, ওটি যেন এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আবছা অন্ধকারে ব্যাপারটিকে এতটাই অতিপ্রাকৃত লাগছে যে, গা শিউরে উঠছে। আর এক মুহূর্ত দাড়িয়ে না থেকে সেই রহস্যময় ঘর বরাবর হাটা দেয় সে। ঘর থাকলে মানুষও থাকবে। অন্তত এই রাত্রিটা আশ্রয় পাবে। এই জঙ্গলে ভয় পেয়ে মরার চেয়ে এটাকেই সঠিক সিদ্ধান্ত বলে মনে হচ্ছে।
যতই ঘরটির কাছাকাছি যাচ্ছে ততোই একটি শীতল উতলা বাতাস লিলি’র পথকে বাঁধা গ্রস্ত করছে। একসময় বাতাসের গতি এতোটাই বেড়ে গেল যে, রীতিমতো একটি ছোট্ট ঝড় তৈরি হল তাকে ঘিরে। গাছের ডালপালা একটির সাথে আরেকটির সংঘর্ষণ হচ্ছে। শুকনো পাতা এলোমেলো উড়ছে আর ঠিক ঝুম বৃষ্টির মতো অদ্ভুত শব্দ তৈরি করছে চারপাশে। এরই মাঝে চোখ দুটো পিটপিট করে এগোয় সে। পেছনে তাকাবার সাহস হয় না। যে করেই হোক একটি নিরাপদ আশ্রয় দরকার। আজ রাতে এখান থেকে বেরুনো কোনভাবেই সম্ভব হবে না। ভাগ্যিস ওই বাড়িটি চোখে পড়েছে।
লিলি যখন বাড়িটির সামনে পৌঁছুলো, তখন সূর্যটা প্রায় ডুবি ডুবি করছে। আবছা আলোয় গা ছমছম করা পরিবেশ। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে হেলে পরা কুঁড়ে ঘরটির দিকে… কে জানে কি বিস্ময় অপেক্ষা করছে তার জন্য…!
গোলাকার একটি উঠান। সেই উঠান নানান রকম লতাপাতা পেঁচিয়ে থাকা ছোট ডাল পালা মাটিতে পূতে ঘেরাও করা হয়েছে। শুকনো পাতার আবরণ সবখানে। অনেকদিন কারও হাতের ছোঁয়া পড়েনি যেন। ঘরের পেছনে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়ানো করুই গাছটা বেশ লক্ষণীয়। মিষ্টি গোলাপি রঙা ফুলের এই গাছ তাদের বাড়িতেও আছে। ঘরটি দেখে মনে হচ্ছে ভেতরে জনমানব বলতে কেউ নেই। দরজা হালকা খোলা। ছোট্ট একটি জানালা থাকলেও সেটা বন্ধ। ভাঙ্গা ভাঙ্গা কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে লিলি,
“ভেতরে কেউ আছেন …?”
কোন জবাব এল না।
এবার আরেকটু জোরে হাঁক ছাড়ল,
“কেউ আছেন কি এখানে …? দেখুন, আমি বিপদগ্রস্ত একজন মানুষ। সাহায্য প্রয়োজন। কেউ থেকে থাকলে সাড়া দিন দয়া করে… ।”
এবারও কোন জবাব নেই। লিলি আশাহত হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপরই চিন্তা করে, হয়ত অনেক কাল আগে কেউ থাকতো এখানটায়, এখন নেই। তাতে কী, শূন্য ওই ঘরে অন্তত এই রাত্রিটা তো পার করে দিতে পারবে। জংগলের এই অনিশ্চয়তা থেকে ওই ভূতুড়ে ঘরের অন্ধকার ঢের ভাল। ভাবনার মাঝে এতটাই মগ্ন ছিল যে, কখন ঘরের ভেতর এক চিলতে আলোর বিন্দু জ্বলে উঠে খেয়াল করে না লিলি। চোখ যেতেই বুকে আশার উদয় হল। হাপ ছেড়ে বাঁচল। যাক, এই রহস্যময় ভয়ঙ্কর জায়গায় সে তাহলে একা নয়। অন্য কেউও আছে।
লিলি এগিয়ে দরজার সামনে দাড়ায়। ঢুকতে কেমন সংকোচ বোধ হচ্ছে। দরজায় মৃদু টোকা দিবে সেই উপায়ও নেই। ছন দিয়ে বানানো এই দরজায় শব্দ হবে না। অনেক ভেবে চিন্তে ঠিক করল, সোজা ভেতরেই ঢুকবে সে। তারপর যা হবার হবে। যেই চিন্তা সেই কাজ। ভেতরে পা বাড়াতে যাবে, তখনই পূর্বের সেই ঝড় শুরু হল। বাতাসের ঝাট এতোই প্রকট যেন তাকে ফেলেই দিবে। মনে হচ্ছে কেউ ফিস ফিস করে কথা বলছে, সেই কথা চারপাশে ভেসে বেড়াচ্ছে! লিলি কেঁপে উঠে। যতই ভেতরে যেতে চায় বাতাস ততোই ক্ষিপ্র হচ্ছে, বাঁধা দিতে চাচ্ছে। সবকিছু উপেক্ষা করে ঘরের ভেতর ঢুকলো সে।
লিলি অবাক হয়ে লক্ষ্য করছে ঘরের ভেতরটা। বাইরের জগৎ এর সাথে কোন প্রকার সম্পর্ক নেই। একদম শান্ত, নিরালা। এখানে সময় থমকে আছে। ঐ তো, দরজার বাইরে অন্ধকারেও ধুলোবালি আর শুকনো পাতার উড়োউড়ি চোখ এড়ায় না। কিন্তু ওগুলোর কিছুই ছুঁতে পারেনি এই ঘরটিকে। আশ্চর্য হয়ে এগুলো ভাবতে ভাবতে, চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নেয় লিলি। আসবাব পত্র বলতে কিছুই নেই। এক কোণে বড় একটি মাটির মটকা জাতিও কিছু। ওটির পাশেই একটি হারিকেন স্থির আলোয় জ্বলছে। আরেক কোণে একটি ছোট্ট দরজা। আরেকটি রুম আছে নাকি ?! লিলি ধীর পায়ে ওদিকে এগুতেই চমকে দাড়িয়ে পড়ে। দরজাটা হালকা খুলে গেছে এবং ভেতর থেকে এই ঘরে কারও ছোট্ট ছায়া পড়েছে। লিলি চাপা কণ্ঠে বলল,
“কেউ কি আছেন… ??!”
ছায়াটা নড়ে উঠল।
লিলি আবার জিজ্ঞেস করল,
“কে ওখানটায়… ?!!”
এবার হালকা খুক খুক কাশির শব্দ হতেই সে শান্তি পেল। নিশ্চয়ই কোন মানুষ। কিন্তু তার ডাকে সাড়া দিচ্ছে না কেন?!
লিলি’র এই প্রশ্নের জবাবেই বোধহয় ভেতরে থাকা রহস্যময় সেই জন বেড়িয়ে এল। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া কুঁজো এক বৃদ্ধা। পুরো মাথা জুড়ে তুলোর মতো ধবধবে সাদা চুল। চোখা নাক টিয়া পাখির ঠোটের কথা মনে করিয়ে দেয়। হাড় জিরজিরে শরীরের বটে যাওয়া চামরা এই আধো আলোতেও কেমন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। চোখ দুটো বেশ লক্ষণীয়, অস্থির মণি দুটো সারাক্ষণ এদিক ওদিক নড়ছে। অদ্ভুত হলেও সত্যি, এর চেহারায় বন্য ছাপ পাওয়া যায়। বৃদ্ধা এক দৃষ্টিতে লিলি’র দিকে তাকিয়ে আছে। সেই চাহনিতে রহস্যময় আলোর ঝিলিক খেলা করছে, ঠোটের ফাঁকে বাঁকানো সূক্ষ্ম হাসির রেখা সুস্পষ্ট। চিড়িয়াখানায় মানুষ যেভাবে জন্তু দেখে ঠিক তেমন। লিলি বিরক্ত হলেও তা চেপে রাখে। একা থাকার কারনে হয়ত অনেক দিন কোন মানুষকে না দেখতে পেয়ে এমন আচরণ করছে বুড়ি। হ্যাঁ , এটাই একমাত্র কারণ হতে পারে।
“ভালো আছ …বাছা?”
জিজ্ঞেস করে বৃদ্ধা। চিঁ চিঁ করে বল্লেও কণ্ঠে ধাতব ছোঁয়া টের পাওয়া যায়।
লিলি প্রতিউত্তরে মাথা নাড়িয়ে ভাল আছে জানায়।
বৃদ্ধা এবার মাটির দিক চোখ নামিয়ে বলে ,
“একটু প্রার্থনায় বসেছিলাম। তাই তোমার ডাকে সাড়া দিতে পারিনি।”
“না, না ঠিক আছে। কোন ব্যাপার না। আমি তো ভেবেছিলাম কোন মানুষ জন-ই নাই এই বাড়িতে। এখন আপনাকে দেখে শান্তি লাগছে। আমি আসলে একটা বিপদে……”
কথা শেষ করার আগেই বৃদ্ধা বলল,
“তুমি অনেক ক্লান্ত বাছা… মাটিতে বিছানা করে দিচ্ছি। শুয়ে আরাম কর। আমি একটু বাইরে যাচ্ছি, দেখি তোমার জন্য কোন খাবারের ব্যাবস্থা করতে পারি কিনা…। ঘরে কোন খাবার নেই আজ…। এসে নাহয় তোমার কথা শুনব।”
লিলি অবাক হয়ে বলল,
“রাত্রি নেমেছে। এই অন্ধকারে কোথায় যাবেন আপনি!!”
বৃদ্ধা অদ্ভুত ভাবে হাসল। তারপর বাইরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
“এই অন্ধকারে চলাফেরা করে আমি অভ্যস্ত। এই অরণ্য হচ্ছে আমার ঘর। সেই কবে এখানটায় নির্বাসনে এলাম। এর নারী-নক্ষত্র আমার চেনা হয়ে গেছে। পুরোটা বন ঘুরে আবার এখানটায় ফিরে আসতে পারব আমি…”
“আপনি কেন নির্বাসনে এলেন!”
লিলি’র এই প্রশ্নের জবাব দিল না বৃদ্ধা। শুধু ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস কানে এল। হবে হয়তো করুন কোন কাহিনী। সে কথা আর না বাড়িয়ে লিলি এবার বলল,
“দেখুন, এখন কোথাও যাবার দরকার নেই। না খেয়ে আমার অভ্যাস আছে। আপনি বরঞ্চ এখানেই থাকুন।”
“না বাছা, তুমি অত্যন্ত ক্ষুধার্ত। তোমাকে দেখেই মনে হচ্ছে বেশ কয়েক দিন ঠিক ভাবে খাচ্ছ না। এখন এই বুড়ির কাজ হচ্ছে তোমাকে খাইয়ে স্বাস্থ্য, শক্তিটা ফিরিয়ে আনা। এই বয়সে এমন শুকনো থাকলে হয় বল।”
লিলি মৃদু হাসে। কি বলবে এই পাগল বুড়িকে? এমন ভাবে কথা বলছে যেন সে সারা জীবনের জন্য এখানে থাকতে এসেছে। বুড়ি হয়ত জানে না, আগামীকাল সকালেই এখান থেকে ও বেড়িয়ে যাবে। তবে হ্যাঁ, পেটের ভেতর ইদুর দৌড়াচ্ছে তা সত্যি কথা। বুড়ি কিভাবে টের পেল, কে জানে! যদি রাতের খাবারের ব্যাবস্থা করতে পারে, তবে মন্দ হয় না।
খ্যাঁক খ্যাঁক হাসির শব্দ ভেসে আসে। বৃদ্ধা অবশিষ্ট কালচে দাঁত বের করে হাসছে। এই যা, বুড়ি কি তার মনের খবর টের পেল নাকি? পরক্ষণই লিলি’র মনে হল, ধ্যাত, এটা কিভাবে সম্ভব!?
“আমি যাচ্ছি বাছা। তুমি ঘুমিয়ে নাও একটু। আমি খাবারের ব্যাবস্থা হলেই চলে আসছি। ভয় নেই, এখানে আমার পোষা পাখি ছাড়া অন্য কোন বন্য প্রাণী আসবে না।”
এ কথা বলে পাশের রুম থেকে একটি মাদুর এবং চাদর এনে মেঝেতে বিছিয়ে দিয়ে বৃদ্ধা বেড়িয়ে পড়ল খাবারের
সন্ধানে।
একটা ব্যাপার বেশ অদ্ভুত এবং লক্ষণীয়। বৃদ্ধা এই বয়সেও কোন লাঠি বা এ জাতিও কিছু ব্যাবহার করছে না। শুধু তাই নয়, এই শরীর নিয়ে পাঁচ কদম অগ্রসর হলে, ছয় বার জিরিয়ে নেবার কথা। অথচ তার চলা ফেরা কি সাবলীল। যেন শক্তিতে ভরপুর ওই অপুষ্ট দেহখানা। এগুলো ভাবতে ভাবতেই পাশের ঘরে চোখ গেল লিলি’র। মনে কৌতূহল জাগে, কি আছে দেখার। কিন্তু অনুমতি ছাড়া যাবে কি যাবে না সেই দ্বিধায় পড়ল। একসময় কৌতূহলের-ই জয় হল। বৃদ্ধা গেছে খাবারের সন্ধানে। নিশ্চয় আসতে কিছুটা দেরি হবে। লিলি সামনে এগোয়……
আহামরি কিছুই নেই ঘরটায়। তবে যা কিনা লক্ষণীয় এবং এমন জঙ্গলে একেবারেই কল্পনাতীত, তা হচ্ছে বাশের কঞ্চিতে ঝুলে থাকা কারুকাজ করা সুবিশাল কাঠের তৈরি একটি আয়না। বুড়ি এমন জিনিস পেল কোথায়! দেখেই মনে হচ্ছে বেশ ভারি ওটি। বাশের কঞ্চি যে কোন মুহূর্তে ধসে পরবে। ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। কে জানে কতোকাল পুরোনো এই আয়না। বেশ আকর্ষণীয়। চোখ পিটপিট করে সামনে এগোয় লিলি, তারপর আলতো হাত বুলাতে থাকে আয়নার চারপাশের কারুকাজে। কাঁচের ডান পাশে উপরের দিকে অদ্ভুত জিনিস চোখে পড়ল। অনেকগুলো লাল বিন্দু আঁকা সেখানে। লাল রঙা নেইল পলিশ দিয়ে আঁকলে যেমন হবে কিছুটা তেমন। নখ দিয়ে খুটে দেখে চোখ পিটপিট করে গুনতে থাকে ওগুলো… ৯৯ টা বিন্দু । কে জানে, হবে হয়তো বুড়ির বয়স এর সমান সংখ্যা এঁকে রেখেছে। তাকে দেখলে তো এরচেয়েও বেশী বয়স্কা মনে হয়। ৯৯ সেখানে কম-ই।
আয়না দেখা শেষে লিলি হাত সরাতে যেতেই চমকে গেল। চুম্বুকের মতো ওটা হাতটাকে টেনে ধরে রাখছে। ভয় পেয়ে আঁচমকা সরে এল সে। মনের ভুল হয়তো, এই মাত্র যেন একটি কালো ধোঁয়ার মতো কিছু আয়নায় দেখতে পেল। আর এক মুহূর্ত দাড়িয়ে না থেকে পাশের ঘরে চলে আসে লিলি। ভীত চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে মাদুরে বসে পড়ে । ঠিক তখনই মনে হল শরীরটা বুঝি বড্ড বেশী ক্লান্ত। গা এলিয়ে চোখ বুঝল সে। একটু আগের ভয়টা কাজ করছে না। এক রাজ্য ঘুম তার চোখ দুটোকে বুঝিয়ে দিয়ে গভীর নিদ্রায় নিয়ে গেল…
একসময় পোড়া গন্ধে ঘুম ভাঙে। চোখ মেলতেই বিস্মিত চোখে সামনে তাকায় লিলি। কিছুক্ষণ ঠিক বুঝতে পারে না কোথায় আছে। এক বৃদ্ধাকে তার দিকে ঝুঁকে থাকতে দেখে সব মনে পড়ে গেল। বৃদ্ধার হাতের পাত্র থেকে ধোঁয়া উড়ছে আর মৌ মৌ করে খাবারের গন্ধ আসছে।
“নাও বাছা… তেমন কিছু পাইনি। আজ রাত টুকু এটা খেয়েই পার করে দাও…”
বলেই বৃদ্ধা তার দিকে মাটির পাত্র এগিয়ে দিল। লিলি দু-হাত বাড়িয়ে ওটা নিল। খাবারের দিক তাকাতেই জিভে জল চলে আসে। এক টুকরো ঝলসানো মাংস। তাড়াতাড়ি একটা অংশ ছিঁড়ে মুখে পুরে নিল। আহ… এক টুকরো পোড়া মাংস এত সুস্বাদু হতে পারে এটা তার জানা ছিল না।
“খেতে কেমন, বাছা…?”
“খুবই সুস্বাদু… এমন খাবার আমি এর আগে খাইনি…”
চিবুতে চিবুতে বলে লিলি।
“কচি হরিণ ওটা বুঝলে…খুব সহজে পাওয়া যায় না। তোমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলতেই হবে…”
হরিণের মাংস শুনে শুরুতে একটু কেমন লাগলেও পরক্ষণে আবার খাবারে মনোযোগ দেয় লিলি।
বৃদ্ধা এবার বলল,
“আগামীকাল তোমাকে বুনো হাস খাওয়াব। বেশী কিছু না, বন্য কিছু পাতা দিয়ে মুরিয়ে ওটাকে আগুনে ঝলসে উপরে লেবুর রস ছিটিয়ে দেব। দেখবে কি রকম খেতে… অল্প ক’দিনেই তোমার দেহে শক্তি ফিরে আসবে…”
বলেই খ্যাঁক খ্যাঁক হাসতে লাগল।
লিলি কি বলবে খুঁজে পায় না। বুড়িটা তার সাস্থ নিয়ে চিন্তিত কেন কে জানে! যাক সে কথা, খাবারের পর এখন পানি পান করতে ইচ্ছে হচ্ছে। বুড়ি যেন মনের কথা টের পেল। আরেকটি পাত্র এগিয়ে ধরল। ওটার মধ্যে লালচে তরল জাতিও কিছু। প্রশ্নত্তুর চোখে তাকাতেই বৃদ্ধা বলল,
“এটা ৩ বুনো ফলের মিসৃত রস… বেশ উপকারী। পান করে নাও… দেখবে কি সুন্দর সুনিদ্রা হয়…”
লিলি হালকা চুমুক দিল। একটু ঝাঁঝালো বটে, তবে বেশ খেতে… কয়েক ঢোক গিলতেই কেমন নেশার মত হচ্ছে। সবকিছু ঘোল পাকিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে সে শূন্যে ভেসে আছে। ধীরে ধীরে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসে… শুধু টের পায়, বৃদ্ধা তাকে ধরে মাদুরে শুইয়ে দিল। চোখ বুঝতেই আবারও নিখুঁত নিদ্রায় ডুবে যায় লিলি। তার ঘুমন্ত অবয়বের দিকে ললাভু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বৃদ্ধা। এত দিনের সাধনা পূরণ হতে যাচ্ছে তাহলে… এগুলো চিন্তা করতে করতে গুটি পায়ে নিজের ঘরে চলে যায় সে। সকালের আগে এই মেয়ের ঘুম ভাঙবে না। ওহ ভাল কথা, এর নামটা তো জানা হল না। কাল-ই জিজ্ঞেস করে জেনে নিবে। এ তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। একবার যখন তার মায়াজালে এসে পরেছে, তখন…..
খ্যাঁক খ্যাঁক শব্দে হেসে ঘরের আয়নাটির দিকে এগিয়ে যায় বৃদ্ধা। তারপর সুচালো নাক নিকটে নিয়ে কুকুর ছানার মতো ওটার ঘ্রাণ নিতে থাকে। ঠোটে পরিতৃপ্ত হাসি। শিকারি’র স্পর্শের গন্ধ পাচ্ছে আয়নায়। সে রাতে যদি লিলি জেগে থাকত, তাহলে শুনতে পেত রাতের আঁধার দ্বিখণ্ডিত করে শিহরণ জাগানো ভয়ঙ্কর এক রাক্ষুসে হাসি ছড়িয়ে পড়েছে সমস্ত বনে…
মুখের উপর রোদের আঁচ পড়তেই লিলি’র ঘুম ভাঙে। মাথার ভেতর সব কেমন ফাঁকা লাগছে। শরীরটাও হালকা অনুভূত হচ্ছে। দু-হাত তুলে টানা দিয়ে উঠে দাড়াতেই খুটুর খুটুর একটা শব্দ কানে এসে আঘাত করে। হামান দিস্তায় কিছু গুড়ো করলে যেমন শব্দ হয় ঠিক তেমন। বাইরে উঠানে উঁকি দিতেই বৃদ্ধাকে দেখা গেল মনোযোগ দিয়ে কিছু করছে। কাছে যেতেই ফোকলা দাঁতে হেসে বলল,
“ঘুম হয়েছে, বাছা?”
“জ্বী… কি করেন?”
“বুনো হাসে দিব বলে কিছু মসলা পিসে নিচ্ছি। তুমি জরুরি কাজগুলো সেরে নাও। ঐ যে, ওখানটায় সব পাবে…” বলেই বাড়ির পেছনটা উদ্দেশ্য করে ইঙ্গিত করে।
“আমার গোসল করা দরকার। জঙ্গলে দৌড়ে এসে……”
“হ্যাঁ, ওটা হবে ক্ষণ বাছা। এখানে একটি দিঘী আছে। তবে এখন ওখানে গেলে দেরি হয়ে যাবে। আপাতত তুলে রাখা জল দিয়ে হাত মুখ ধুয়ে নাও।“
লিলিকে কথা শেষ করতে না দিয়েই তাড়াতাড়ি বলে বৃদ্ধা। কি আর করা… এখানখার কিছুই তো চিনে না লিলি। তাই ঘাড় কাত করে সম্মতি জানিয়ে বৃদ্ধার দেখিয়ে দেয়া রাস্তায় পা বাড়ায়। যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে রওয়ানা দিতে হবে। কেন যেন মন ছটফট করছে। বুড়িটার আচরণও কেমন রহস্যময়! নাহ, আর বসে থাকলে চলবে না।
ফ্রেস হয়ে ফিরে আসতেই দেখা গেল বৃদ্ধার রান্না বান্না শেষ। দারুন সুঘ্রাণ আসছে। লিলিকে বসতে বলেই বাসনে করে আস্ত ঝোলসানো হাঁস এনে দেয় সে। তারপর ওটার উপর লেবু চিপে দিয়ে বলল,
”অসাধারণ খাদ্য। খেয়ে নাও, বাছা।“
লিলি মাংস ছিঁড়ে মুখে পুরল। বাহ! কি সুস্বাদু খাবার! বুড়ির হাতে জাদু আছে নাকি?!
খাওয়ার মাঝেই লিলি বলল,
“আমি এবার যেতে চাচ্ছিলাম।“
বৃদ্ধা যেন আকাশ থেকে পড়ল,
”যাবেই তো! আজকের দিনটা থেকে যাও । একা একা থাকি, সচারাচার তো কেউ আসে না… কাল সকালেই তুমি মুক্ত।“
“না আসলে, বাড়িতে বাবা আর…”
“ও কোন ব্যাপার না। ২ দিন যা ৩ দিনও তা।
লিলি কিছু বলতে যেয়েও চুপ করে থাকল। ঘুম ঘুম পাচ্ছে। কি আশ্চর্য! এখন ঘুম পাচ্ছে কেন?!
যখন ঘুম ভাঙ্গল তখন চারপাশে অন্ধকার। ধরফরিয়ে উঠে বসে লিলি। এ কী…! রাত্রি নেমে গেছে! তারপরই সামনে তাকিয়ে চমকে উঠে লিলি!
কি অদ্ভুত বেশে বসে আছে বৃদ্ধা। চুল গুলো যে এতো দীর্ঘ তার, আগে খেয়াল করেনি। গায়ের রংটাও খুলেছে। বটে যাওয়া কলাপে লাল বিন্দু। শরীরে সাদা শিফন কাপড় জড়ানো। রহস্য ভরা দৃষ্টি নিয়ে সে তাকিয়ে আছে লিলি’র দিকে।
“চলো বাছা…”
লিলি অবাক হয়ে বলল,
”কোথায় যাব!?”
“চন্দ্রস্নান এর সাথে জলস্নান সেরে নেবে…“
“এই নিশুতি রাতে গোসলে যাব! আপনি না বললেন, দীঘি অনেক দূরে!?”
বিস্ফোরিত কণ্ঠে বলে লিলি।
বৃদ্ধা শান্ত স্বরে বলল,
”এই দীঘিতে রাত্রিতেই স্নান সারতে হয়। সে এক অপূর্ব অনুভূতি।“
“ইয়ে… না থাক। কাল বাড়িতে গিয়েই বরং…”
“আচ্ছা ঠিক আছে। নাও ফলের রসটুকু খেয়ে নাও…”
লিলি’র কাছে সব তালঘোল পাকিয়ে গেলেও বৃদ্ধার এই আব্দার ফিরাতে পারল না। ঠিকই যেন তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে! ডগডগ করে রসটা গিলে নিতেই কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হল। সবকিছু একটু ঘোলাটে হয়ে আবার ঠিক হয়ে গেল।
“লিলি…”
আলতো ডাকলেন বৃদ্ধা।
“হু… “
ঘোর লাগা নিয়ে জবাব দেয় লিলি।
বৃদ্ধা এবার প্রায় ফিসফিস করে বলতে লাগল,
“মায়া দিঘীর জল…
মায়ায় টলমল…
মধ্যি খানে থাকে চন্দ্র,
তারে বশ করতে লাগে মন্ত্র…“
লিলি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বৃদ্ধার কথা শুনে। এবার গানের মতো সুর করে গাইছে সে।
“লিলি…”
“হু…”
“চল… “
“হু…”
ঘোর নিয়ে উঠে দাড়ায় লিলি। অচেনা শিকলের টানে বৃদ্ধার পিছু পিছু হেটে চলে। তাকে নিয়ে ফোঁড়ন কাটতে কাটতে জঙ্গলের ভেতর মিলিয়ে যায় বৃদ্ধা।
চাপা নীল আলোয় মিশ্রিত অন্ধকারের রহস্যময়তায় ছেয়ে আছে সবকিছু। মাঝে মাঝে চাঁদের স্বচ্ছ আলো গাছের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে ঢোকার বৃথা চেষ্টা করে মুখ থুবড়ে পরেছে। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ছাড়িয়ে ভেসে আসে বন্য শেয়ালের হুংকার। আর আছে অবিরত পাতার মরমর শব্দ। লিলি যদি সম্মোহিত না হতো তাহলে দেখত তার সামনেই হেটে চলছে বৃদ্ধা বেশে এক পিশাচিনি। যার চুল মাটিতে নেমে এসে তাকে পথ নির্দেশনা দিচ্ছে। চোখ দুটো উপচে লালাভ আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। দু-হাতের চোখা নখ গাছের শিকরের রুপ ধারণ করেছে। নাগিনীর মতো হিসহিসিয়ে ভয়ংকর এক প্রতিক্ষার অবসান ঘটাতে যাচ্ছে এই পিশাচিনি। শত বছরের সাধনা আজই পূর্ণতা পাবে।
পিশাচ সাধনায় এই গহীন অরণ্যে কাটিয়ে দিয়েছে শত শত বছর সে। মোট একশোটি কুমারি কন্যার জীবনি শক্তি নিজের শরীরের মধ্যে বন্দী করতে হবে তাকে। এবং তার বার্ধক্য দিয়ে দিবে তাদের। পিশাচ চর্চা করতে এই গহীন বনকেই যথাযথ স্থান মনে করেছে সে। কালো বিদ্যার বদৌলতে তৈরী করেছে মায়া দিঘী। ওই দিঘীতেই তার সাধনার কার্যক্রম সমপন্ন করা হয়। এই নিয়ে মোট নিরানব্বইটি কন্যার দেখা পেয়েছে। এদের কেউ নানা কারনে জঙ্গলে এসে হারিয়ে গেছে, কাউকে আবার লোকালয় থেকে ছলনা করে নিয়ে আসা হয়েছে। তবে ছলনা করে আনাটা একটু কঠিন। আহা, ভাগ্য কি সুপ্রসন্ন তার। না চাইতেই বৃষ্টি’র মতো লিলিকে পেয়ে গেল। আর মাত্র একটা মেয়ের-ই দরকার ছিল। এর আগের মেয়েটির নাম ছিল মন্দিরা। বাপকে খুঁজতে এসে তার মায়াজালে আটকে গিয়েছিল। এ সকল কন্যারা খুব সহজেই যে তার মায়াজালে আটকেছে, তা কিন্তু নয়। অপেক্ষার তিক্ততা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে সে। অবশেষে প্রতিক্ষার অবসান ঘটলো…
খুব বেশী কিছু করতে হবে না তাকে। তার তৈরি মায়া দীঘিতে অন্যান্যদের মতো সম্মোহিত লিলিকেও নামিয়ে দিতে হবে। দিঘীর ঠিক মাঝখানে থাকবে বৃত্তাকার চন্দ্ররুপে মায়া জালের প্রতিচ্ছবি। কোনভাবে ওই বৃত্তের সন্নিকটে গেলেই ওটা লিলিকে টেনে নিয়ে বন্দী করে ফেলবে। তখন ওর সম্মোহনকে আরও প্রভাবিত করে জলে ডুব দেয়াতে হবে। সাথে সেও দেবে। ব্যাস… এরপরই তার জরজীর্ণ শরীরে চলে আসবে লিলির জীবনি শক্তি। আর লিলির সতেজ দেহে আটকা পড়বে তার বার্ধক্য। বৃদ্ধা না হয়েও বার্ধক্যের জীবন যাপন করবে লিলি। ধুকে ধুকে মরবে এই গহীন বনে। আর সে হবে চির অমর… পৃথিবীটা নিয়ন্ত্রণ করা হবে তার কাছে ছেলে খেলা মাত্র। ব্যাপারটা চিন্তা করতেই বৃদ্ধা খলখল করে হেসে উঠে। সেই হাসি ছড়িয়ে পড়তেই নিস্তব্দ হয়ে যায় পুরোটা বন। যেন অশুভ কিছুর আভাসে থমকে গেছে সব কিছু।
হেটে হেটে দীর্ঘাকার কাশফুল ঘেরা একটি ছোট্ট দিঘীর সামনে এসে দাড়ায় তারা। লিলি বোধহীন চোখে তাকায় চারপাশে। ছোট্ট দিঘীর টলমল পানির উপর রুপোর চাঁদ ঢেউ খেলিয়ে ঠিক মাঝখানটা আলোকিত করে রেখেছে। কি সুন্দর! ফকফকা জোৎস্নায় ইচ্চে হচ্ছে জলে নেমে সাঁতার কাটতে। এ যেন রূপকথা থেকে সদ্য উঠে আসা কোন দীঘি!
“লিলি…”
“হু…”
“তুমি কি তৈরী…?”
“হু……”
“এস, এই বস্ত্রটি পরে নাও…”
বলেই বৃদ্ধা তার গায়ের পোশাক খুলে লিলিকে দিয়ে দিল। আর তার দীর্ঘ চুল পেঁচিয়ে পোশাকের মতো লেপটে থাকল স্বশরীরে। লিলি বাধ্য মেয়ের মতো পোশাকটি পরে নিতেই সাথে সাথে বাতাসের বেগ বেড়ে শো শো শব্দে পরিণত হল। ঝড়ের পূর্বাভাস। লিলি একটু কেঁপে উঠতেই বৃদ্ধা বিড়বিড় করে কিছু আউরাতে থাকে। তারপর লিলি কে হাত দিয়ে দিঘীতে নামার ইঙ্গিত করে নিজেও নেমে পড়ে। লিলি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পা বাড়াতেই ঝোরোয়া বাতাস আরও ক্ষিপ্র হল। যেন উড়িয়ে নিয়ে যাবে। লিলিকে থেমে যেতে দেখে বৃদ্ধা চিৎকার করে উঠল,
“দেরি কর না লিলি…! চন্দ্র সড়ে গেলে স্নান এ পূর্ণতা আসবে না। এস… এস…”
লিলি দু-হাতে কাশফুল বিভক্ত করে জলে পা ডুবাল। কেমন অদ্ভুত অনুভূতির আলোড়ন তার মধ্যে। সব কিছু স্বপ্ন মনে হচ্ছে। এক সূক্ষ্ম মায়ায় টেনে নিচ্ছে মায়া দিঘী তাকে।
“এস… লিলি… এস…”
ধীরে ধীরে লিলি হাঁটু, তারপর কোমর জলে নেমে গেল। বৃদ্ধা এরমধ্যে মাঝ দিঘীতে চলে গেছে। লিলি সাঁতার কেটে ভাসতে ভাসতে এগুতে থাকে। একসময় চন্দ্র বৃত্তের খুব কাছাকাছি চলে যেতেই কিছু একটা তাকে চুম্বুকের ন্যায় টেনে ওটার মাঝামাঝি নিয়ে গেল। তারপরই বৃত্তে একটি ঘূর্ণি পাক খেতে থাকল এবং তার সাথে সাথে তারা দু-জনও ঘুরতে থাকল। বৃদ্ধা ফিসফিসিয়ে মন্ত্র পড়া শুরু করলেও তা এক ধরনের উচ্চস্বরে প্রলাপে পরিণত হয়। লিলি চোখ বুঝে মাথা দুলাতে থাকে। সে অন্য এক জগৎ এ আছে। ঘুরপাক খাওয়ার মাঝে বৃদ্ধা ডুব দিতেই লিলিও তাকে অনুসরন করে ডুব দিল। এভাবে ডুব দিয়ে ভেসে উঠতেই পুরোটা দৃশ্যপট পাল্টে গেল। লিলি যেন সদ্য ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। একে একে সব মনে পড়লেও এখানে সে কি করে এল তা বুঝে উঠতে পারল না। নিজেকে এই মাঝ রাতে দিঘীর জলে আবিষ্কার করা সুখকর কিছু নয়। ঘাবড়ে গিয়ে সাঁতার দিতে চাইতেই শরীরটা কেমন করে উঠল। সামনে এগুবার চেষ্টা করে আতকে ওঠে। বিন্দু পরিমাণ শক্তি নেই দেহে। হাত পা ছেড়ে দিচ্ছে, যে কোন মুহূর্তে টুপ করে ডুবে যেতে পারে সে। আশ্চর্য! কেন এমন হচ্ছে তার?! তখনি চাঁদের স্পষ্ট আলোয় দিঘীর জল দু-ভাগ করে ভেসে উঠে বৃদ্ধার অবয়ব। বিস্ফোরিত চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে লিলি। বৃদ্ধার দু-চোখে লালাভ আলো খেলা করছে। লকলকে জীভটা বের করে লিলির উদ্দেশে বলল,
”লিলি… তোমাকে ধন্যবাদ… তোমার দেয়া জীবনী শক্তি দিয়েই সমাপ্তি ঘটবে মায়া দিঘীর সাধনার। হি হি হি হিহ…। আমি হব অমর, তুমি আমার বার্ধক্য সঙ্গী করে পচে মরবে এই গহীন অরণ্যে। আমি ভীষণ দুঃখিত বাছা। ভীষণ… হি হি হি হিহ…“
লিলি কেঁপে উঠলো কথাগুলো শুনে। বৃদ্ধা এবার ঘাড় বাঁকিয়ে বলল,
“বাহ। বুড়ো বয়সে কেমন অনুভূতি হয় তা নিশ্চয়ই টের পাচ্ছ তুমি? চু চু চু… আফসোস, সময়ের আগেই এর সম্মুখীন হতে হল তোমায়। তুবুও তুমি সৌভাগ্যবতী বাছা, শুধু যৌবন নিয়েছি, শরীর তোমারই আছে। হি হি হিহ…।“
লিলি এবার চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠে। এ কী করে সম্ভব! কোন দুস্বপ্ন দেখছে কি?! নাকি সত্যি কোন পিশাচিনির কবলে পড়েছে সে?! সত্যি কি বুড়িটা তার বার্ধক্য তাকে দিয়ে দিয়েছে?! হু হু করে কান্না থামতে চায় না তার। পানিতেও আর ভেসে থাকতে পারছে না। শরীর ক্লান্ত। এর মানে সময়ের অনেক আগেই সে বুড়ো হয়ে গেল!! আর কিছু ভাবতে পারছে না লিলি। বুক চিঁরে গভীর থেকে চিৎকার বেড়িয়ে আসে… বাতাসে প্রবল ঝড়টা আবার শুরু হয়
লিলির কান্নার সাথে পিশাচিনির খলখল হাসির শব্দ মিশে অদ্ভুত পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। হঠাৎ হাসি থামিয়ে পিশাচিনি পাড়ের দিক যেতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। ঠিক তখনি লিলি লক্ষ্য করল, দিঘীর এপার থেকে ওপারে সাদা বস্ত্র পরা কিছু একটা উড়ে গেল এবং কিছু বুঝে উঠার আগেই তীর গতিতে ওটা ঠিক লিলির পেছনেই জল কাঁপিয়ে থামল। হকচকিত লিলি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ফ্যাকাসে ঠোট কামড়ে চোখের মণি এদিক ওদিক নাড়ায়। পেছন থেকে ভেসে এল ফিসফিসিয়ে বলা একটি অচেনা কণ্ঠস্বর,
”লিলিই… ওকে পাড়ে উঠতে দিও না লিলিই… যাও ধর ওকে। আবার বৃত্তে আনো। নাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে… ছুটে যাও লিলিই… ছুটে যাওহহহ…”
শেষ বাক্যটা যেন লিলির মস্তিস্ক ফুঁড়ে ভেতরে ঢুকে গেল। সে জানে না তার পেছনে কে। শুধু জানে বৃদ্ধাকে থামাতে হবে, যেভাবেই হোক। আর এক মুহূর্ত নষ্ট না করে ছুটে যায় লিলি।
বৃত্ত থেকে বেরুতে চাইতেই জলের নিচে থাকা বুনো লতাপাতা লিলির পায়ের পাতা আঁকড়ে ধরে তাকে টেনে দিঘীর গভীরে নিয়ে যেতে চাইল। লিলি হাবুডুবু খেতে খেতেই দেখল, বৃদ্ধা ঘাড় কাত করে ভয়ঙ্কর হিংস্রতায় তার দিকে তাকিয়ে আছে। জলন্ত চোখ দুটো যেন এক্ষুনি অগ্নি কুণ্ড নিক্ষেপ করবে। কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি করে পা থেকে লতানো গাছগুলো ছাড়াতে চাইতেই ডান পায়ের গোড়ালিতে কাঁটার মতো ফুটে কিছু একটা চামরা চিঁরে নেমে গেল। পানিতে বুর বুর ছড়িয়ে ভেসে উঠে চিৎকার দেয় লিলি। ততক্ষণে সব অন্ধকার এবং অসাড় হয়ে আসছিল। হঠাৎ কি যেন হল, এক আশ্চর্য অনুভূতি নিয়ে শরীরটা ঝাঁকি দিয়ে উঠল। ঐশ্বরিক শক্তি অনুভূত হয় স্বশরীরে। কানের কাছে আবার আগের সেই কণ্ঠধ্বনি,
”বের হও বৃত্ত থেকে… দ্রুত লিলি দ্রুত…“
বিদ্যুৎপৃষ্টের মতো লিলি বৃত্ত থেকে বেড়িয়েই দিঘীর জলে ভেসে থাকা বৃদ্ধার দীর্ঘ চুল টেনে ধরল। তীব্র আক্রোশে সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করে ঘুরে তাকায় বৃদ্ধা। ঠিক তখনি কোথাও বজ্রপাত হল। লিলি তাড়াতাড়ি ওর চুল টেনে ধরে বৃত্তের দিকে এগুতে থাকে। কোন এক রহস্যময় কারনে তার শরীরে শক্তি অনুভব হয়। কি সেই রহস্য জানা নেই। বৃদ্ধা এবার ক্রোধের সাথে তার হাতের নখগুলো উঁচিয়ে ধরতেই ওগুলো লিলির দিকে সাপের মতো একে বেঁকে তীর গতিতে ছুটে এল। লিলি আতকে উঠতেই আবারও সেই কণ্ঠস্বর বলে উঠে,
“ভয় পেওনা। এগুলো তোমাকে থামিয়ে দেবার প্রচেষ্টা। সময় কম। টেনে ওকে বৃত্তে আন। এক্ষুনি!!”
লিলি এবার শরীরের সবটুকু শক্তি একত্রিত করে, যতটা বেগে সম্ভব বৃদ্ধার চুল টানতে লাগল। একসময় বৃত্তের ঠিক মাঝ বরাবর এনে ফেলল। তখন অদ্ভুত ভাবে দিঘীর জল কেঁপে উঠে। বৃত্তের মাঝে আবারও সেই ঘূর্ণি তৈরী হয়। বৃদ্ধা থমকে ভয়ার্ত চোখে এদিক ওদিক তাকায়। ঘূর্ণিটা দ্রুত থেকে দ্রুতরত হতেই বৃদ্ধাকে টেনে নিল। তার পৈশাচিক চিৎকারে জেগে উঠতে চাইল সমস্ত বন। গোঙানির মতো শব্দ করে নিজের চুল আঁকড়ে ধরে সে। একসময় ঘূর্ণির ঠিক মধ্যখানে চরকির মতো পাক খেতে থাকে। আর ওখান থেকে ছিটে ছিটে আসতে থাকে জল। সেই জলেই নিজের ভেতরের সূক্ষ্ম পরিবর্তন খেয়াল করে লিলি। ঠিক আগের সতেজ সেই অনুভূতি। অবিশ্বাস্য চোখে সব কিছু পরোখ করে সে। বৃদ্ধা ততক্ষণে ডুবে গেছে দিঘীর গভীরে। এবার পারে যেতে ব্যস্ত হয় সে। সাঁতরে যেই ঘাটে উঠবে, শক্ত একটি হাত তার পায়ের গোড়ালি চেপে ধরল। ভয়ঙ্কর আক্রোশে চিৎকার দিয়ে পা’টি ছাড়িয়ে নিতে চায় লিলি। উদ্ভ্রান্তের মতো কিছুক্ষণ দাপাদাপির পরই লক্ষ্য করে হাতটি সিথিল হয়ে গেছে। হাপরের মতো হাঁপাতে হাঁপাতে অবশেষে পারে উঠে সে। তারপর আর এক মুহূর্ত ওখানে না দাড়িয়ে দৌড়াতে থাকে জঙ্গল বরাবর। কিছুদূর গিয়ে ফিরে তাকাতেই দেখতে পায় দিঘীর জলে ঝড় শুরু হয়েছে। উত্তাল ঢেউএর উঁচুতে পিশাচিনির হাহাকার! উফ, কি ভয়ঙ্কর!! একটু উপরেই কোথা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে কালো পাখি চক্রাকারে ঘুরছে। খেয়াল করতেই বুঝল, ওগুলো বৃদ্ধার শরীর ফুঁড়ে বেড়িয়ে আসছে। লিলি শিউরে উঠে দ্রুত পা চালায়। দৌড়াতে দৌড়াতে একসময় অন্ধকারে কোথাও আছড়ে পরে জ্ঞান হারায়।
যখন জ্ঞান ফিরল তখন সূর্যটা পুব আকাশে উঁকি দিয়েছে। প্রসস্ত একটি করুই গাছের নিচে নিজেকে আবিষ্কার করতেই ভয়ের শীতল স্রোত নেমে যায় ঘাড় বেয়ে। আবারও কি পিশাচিনির ওখানে চলে এল! চারপাশে তাকিয়ে বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করে তাদের বাড়ির পেছনেই করুই গাছের নিচে আছে সে। এখানে কিভাবে এল!? চোখ বুঝে ঘটে যাওয়া সবকিছু মনে করার চেষ্টা করতেই কেঁপে উঠে লিলি। কি ভয়ঙ্কর এক অভিজ্ঞতা!! এ যেন দীর্ঘ কোন দুঃস্বপ্ন। এই দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি পেতে কেউ একজন তাকে সাহায্য করেছে। কে সে??!!! হঠাৎ কারও উপস্থিথিতে চোখ তুলে তাকায় লিলি। লাল ফ্রক পরা বাবলি চোখ ফালা ফালা করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। লিলি ছলছল চোখ নিয়ে বলে,
”কেমন আছিসরে করকরি বেগম…?”
বাবলি এ কথার জবাব না দিয়ে চিৎকার দিয়ে বাড়ির ভেতর ছুটে,
”বাবা……!! লিলিবু এসেছে…!!!! বাবা…!!!!”
বাড়িতে হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে। পুরো এলাকার লোক যেন চলে এসেছে। অনেক কষ্টে তাদের বিদায় দিয়ে বিছানায় গা এলায় লিলি। বাবা চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর বাবলি তার পায়ের পাতায় ছিলে যাওয়া ক্ষততে ঔষধ মাখিয়ে দিচ্ছে।
“লিলিবু, তোমার নূপুরটা কই ?!যাহ! এটাও হাড়িয়ে ফেলেছ?!”
গাল ফুলিয়ে বলে বাবলি।
লিলি মনে করার চেষ্টা করে শেষ কবে ওটা পায়ে ছিল। আচ্ছা, দিঘীর বুনো লতায় আটকে ছিঁড়ে গেলো নাকি? হতে পারে। পায়ের পাতায় ক্ষত সৃষ্টির এটাই কারণ। তবে এসব কিছু না বলে চুপ করে রইল সে।
সবার নানান প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিতে পারেনি লিলি। কি ই বা বলবে! ওগুলো কি বিশ্বাস করার মতো কিছু?! তার নিজের-ই তো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে! শুধু বাবাকে কিডন্যাপকারি এবং ওখান থেকে পালিয়ে আসার কথা বলেছে।
চুলে হাত বুলাবার কারনে চোখ দুটো ভার হয়ে আসে লিলির। তন্দ্রার মাঝেও কপালে উষ্ণ বিন্দু অনুভব করে। বাবা কি কাঁদছে?! হবে হয়ত। এ ক’টা দিন তাদের কিভাবে গেছে কে জানে! ভাবনার মাঝেই গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় সে। রাতে খাবারের জন্যে ডেকেও তুলতে পারেনি বাবা আর বাবলি। হয়ত বড্ড ক্লান্ত মেয়েটা, সে কারনে ডাকাডাকি ক্ষান্ত দিয়ে শুয়ে পড়লো ওরা।
গভীর রাতে লিলির ঘুম ভেঙ্গে গেল। প্রথমে বুঝতে পারল না কোথায় আছে। অশান্ত হয়ে এদিক ওদিক তাকাতেই বিছানার পাশে বাবলি কে দেখতে পেয়ে সব মনে পড়ল। হঠাৎ ভীষণ কান্না পেতেই ওকে জড়িয়ে কিছুক্ষণ কেঁদে নেয়। অবশেষে কাছের মানুষগুলোকে, নিজের স্বাভাবিক জীবনটাকে ফিরে পেল সে। এ কোন সুন্দর স্বপ্ন না তো?! চোখ মেলেই দেখবে না তো, বৃদ্ধা তার সামনে দাড়িয়ে? ব্যাপারটা চিন্তা করতেই গা শিউরে উঠে। বাবলিকে আরও জোরে জড়িয়ে ধরে। চারপাশ নিস্তব্দ, হঠাৎ লিলি’র খেয়াল হয় বাবলির হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি ছাড়িয়ে আরেকটা শব্দ হচ্ছে ঘরে। কেউ যেন সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস নিল। লিলি সাবধানে খাট থেকে নেমে লাইট জ্বালিয়ে ভয়ে ভয়ে ঘরে চোখ বুলায়। এরপর দরজা খুলে বারান্দায় আসতেই রুম থেকে আসা স্বল্প আলোতে তাদের বিড়াল গাবুকে দেখতে পায়, ঝিমুচ্ছে ওটা। এক গাল হেসে এগিয়ে গিয়ে ওর সামনে বসে হাত বাড়াতেই একটা অপ্রত্যাশিত ব্যাপার ঘটল। গাবু আচমকা চোখ মেলে ভয়ঙ্কর ভাবে মিউ মিউ করতে করতে লাফিয়ে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বাইরে পালিয়ে গেল। লিলি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। আশ্চর্য! এমন করল কেন বিড়ালটা?! লিলিকে তো ভীষণ পছন্দ করে গাবু! হয়ত অনেক দিন না দেখায় চিনতে পারেনি। নিজের মনকে বুঝায় সে। এরপর ওখান থেকে উঠে ঘরের দিকে পা বাড়ায়। পেছনে ফিরলে লিলি দেখত। তার বসে থাকা কালীন ছায়াটা ওখানেই রয়ে গেছে। তাকে অনুসরণ করছে না!
এভাবেই বেশ কিছুদিন কেটে যায়।
মোটামোটি সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসলেও লিলির ভেতর আশ্চর্য পরিবর্তন লক্ষণীয়। কথাবার্তা আগের তুলনায় বলেই না। নিজের ঘরে চুপচাপ সময় কাটাতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। বাবা অনেক ভাবে প্রশ্ন করেও কিছু জানতে পারেননি। আর বাবলি তো আছেই। সারাক্ষণ পক পক করেই যাচ্ছে। কিন্তু তার আগের লিলিবুকে খুজে পায় না। সব কিছুই লিলি উপলব্ধি করে। কিন্তু এক অজানা অনুভূতি তাকে গ্রাস করছে প্রতিনিয়ত। ভয়ঙ্কর সব দুঃস্বপ্ন দেখছে প্রতিরাতে। না পারছে কাউকে বলতে, না পারছে নিজেকে নিজে শান্তনা দিতে।
এক রাতের কথা। সামান্য পড়া না পাড়ায় বাবলিকে চড় মারে লিলি। বাবলি পুরো বাড়ি মাথায় তুলে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। লিলিবু এর আগে কখনই তার গায়ে হাত তোলেনি। লিলির বাবাও বিস্মিত হয়ে মেয়ের কাণ্ড দেখেন। তার মানসিক কষ্টের কথা ভেবে কিছু বলেন না। কে জানে এ ক’টা দিন কি গেছে মেয়েটার উপর দিয়ে।
কিন্তু বাবলিটা ছোট। ওর কান্না কিছুতেই থামেনা। লিলির হঠাৎ রেগে যাওয়ার কারণ সে নিজেও খুঁজে পায় না। এমন তো না, বাবলি এই প্রথম পড়া পারল না। আরও কতো হয়েছে এরকম! তাহলে সে কেন এভাবে রেগে গেল?! কোন উত্তর না পেয়ে আরও অশান্ত হয়ে উঠে লিলি। বাথরুমে ঢুকে দু-হাত ভরে পানি ছিটাতে থাকে সারা মুখ এবং মাথার তালুতে। ঠিক তখনি অনাকাঙ্ক্ষিত একটি শব্দে চমকে উঠে সে। বাথরুমের দরজা আপনা আপনি বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ এক চিলতে বাতাসের আনাগোনা নেই! একটা ফিসফিসানি ভেসে আসে ওপাশ থেকে। লিলি নিঃশব্দে দরজায় কান পাতে…
অনেক দূর থেকে কেউ দৌড়ে এসে যেন হাঁপিয়ে উঠেছে। দ্রুত নিঃশ্বাস আর ফিসফিস কথাগুলো অস্পষ্ট। লিলি তার সমস্ত ইন্দ্রিয় এক করে মনোযোগ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে। হঠাৎ সব নিশ্চুপ। বাবলির কান্না ও থেমে গেছে। ঘোর কাটিয়ে দরজা থেকে যেই সরে আসবে অমনি ঠাস ঠাস করে ওটাকে কেউ ধাক্কাতে লাগল। ভুমিকম্পের মতো কাঁপতে থাকে দরজা। সাথে ভেসে আসে হিসহিসে কণ্ঠস্বর,
“লিলিহ! লিলিহ…!”
চাপা চিৎকার দিয়ে মেঝেতে বসে পরে লিলি। চোখের মনি দুটো উল্টে প্রায় ভেতরের দিকে চলে যায়। দু-হাতে ব্যাথা অনুভব হতেই ওগুলো চোখের সামনে মেলে ধরে। তার নিজের নখ ফুঁড়ে নতুন সূচালো নখ বেরুচ্ছে ওখান থেকে। গোঙাতে গোঙাতে উঠে দাড়ায় সে। চেষ্টা করেও ঘাড় সোজা করতে পারে না। আয়নার সামনে দাড়াতেই ছিটকে পেছনে আছড়ে পড়ে। পৈশাচিক রূপে ওটা সে নয়। অন্য কেউ !!
দাঁতে দাঁত চেপে দেয়াল ঘেঁষে দাড়ায় লিলি। তীব্র ব্যথা সারা শরীর জুরে। তখনি সাদা বস্ত্র পরিহিতা ধোঁয়াটে একটি ছায়া মূর্তি দৃশ্যমান হয়। লিলি’র দিকে পেছন দেয়া তাই অবয়ব দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ হিংস্র হয়ে মূর্তিটির উপর ঝাপিয়ে পরে লিলি। খিপ্রতা আর আক্রোশে নখ বসাতে চায় ওর শরীরে। কিন্তু ধোঁয়া ছাড়া ওখানে কিছুই নেই। ফিসফিস আলতো স্বরে ভেসে আসে…
“লিলিই… এটা তুমি নও…ফিরে এসো… লিলিই!!!”
খিঁচুনি দিয়ে লুটিয়ে পরে লিলি। জ্ঞান হারাবার কিছু মুহূর্ত আগে তার মনে হয়, এই ছায়া মূর্তিটিকে সে আগেও দেখেছে। কিন্তু কোথায় মনে করতে পারেনা।
স্বাভাবিক হয়ে উঠে ঘটনাটি চেপে যায় লিলি। আর বলবে ই বা কি? সে হুট করে ভূতে পরিণত হয়েছে এ কথা ?! এসব কি বিশ্বাস যোগ্য? শেষে দেখা যাবে পাগল বানিয়ে তাকে পাগলা গারদে রাখা হচ্ছে। অসম্ভব! বাবা আর বাবলিকে ছেড়ে আর কোথাও যেতে রাজি নয় সে। কোত্থাও না।
বাবলির গায়ে হাত তোলার কারনে সে রাগ করে আছে। অনেক চেষ্টা করেও মান ভাঙ্গানো যায়নি। রাতের খাবার ও খেল না মেয়েটা। কি আর করা, লিলি ঘোষণা করল সেও কিছু খাবে না। না খেয়েই দু-বোন শুয়ে পড়ল। তাদের মানাতে না পেরে বাবাও কিঞ্চিৎ রাগ করে না খেয়ে শুয়ে পড়লেন।
মাঝরাতে লিলির ঘুম ভেঙে গেল। প্রচণ্ড ক্ষুধা অনুভব হচ্ছে। পাশেই বাবলি হাপুস হুপুস নিঃশ্বাস ফেলে ঘুমুচ্ছে। ওকে না জাগিয়ে সাবধানে খাট থেকে নেমে রান্নাঘর বরাবর যায় লিলি। ডান পাশের টেবিলেই হাড়ির ভেতর ভাত, তরকারি। কিন্তু ওদিকে না গিয়ে চুলার কিনারায় কিছু খোঁজে ও। কাঙ্ক্ষিত জিনিস না পেয়ে টেবিলের নিচে, মিটসেফ এ পাগলের মতো হাতড়াতে থাকে। অবশেষে ফ্রিজের কোণে পেয়ে যায়। স্থির হয়ে বসে আছে একটি তেলাপোকা। দেখেই লিলির ঠোটের কোনে হিংস্র হাসির রেখা ফোটে। তারপর খপ করে ওটাকে মুখে পুরে চিবিয়ে গিলে ফেলে। কালচে ঠোটের হাসি বিস্তৃত করে এবার বাথরুমে যেয়ে হরবরিয়ে বমি করে দেয়। বিশ্রী গন্ধে চোখ মুখ উল্টে আসতে চাইছে। শব্দ পেয়ে বাবলি যেগে ওঠে। অবাক হয়ে বোনের দিকে তাকিয়ে বলে, “কি হয়েছে লিলিবু??! কি হয়েছে তোমার ??! বমি করছ কেন ??! দাড়াও বাবাকে ডেকে আনছি! “
ওকে হাত দিয়ে থামিয়ে দেয় লিলি। ফিসফিস করে বলে,
“লাগবে না। তুই চিন্তা করিস না। ঠিক হয়ে গেছে।”
বলেই কুলি করে মুখে পানি ছিটিয়ে বেড়িয়ে এল। বাবলি তাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইল। নিশ্চয়ই রাতে কিছু খায়নি বলে লিলিবুর এমন হয়েছে। সব তার দোষ। গাল ভার করে নিজের উপর রাগ নিয়ে আবার ঘুমিয়ে পরে ছোট্ট বাবলি। লিলির রাত কাটে নানান রকম দুশ্চিন্তায়। এসব কী হচ্ছে তার সাথে বুঝে উঠতে পারে না। তার ভেতর অন্য এক অস্তিত্বের টের পায়। সেই অস্তিত্ব কোন মানুষের নয়, ভয়ঙ্কর কোন পিশাচের। শরীর কেঁপে জ্বর আসে লিলি’র। ঘোরের ভেতর চলে যায়। একসময় প্রচণ্ড জ্বরে হ্যালুসিনেশন এর মতো হয়। ওর মনে হয়, রুমের ঠিক মধ্যখানে সাদা পোশাকধারী একটি নারীমূর্তি তার দিকে পেছন ফিরে বসে আছে। ঠিক ওরই মতো দীঘল চুল। মূর্তিটি এবার কেঁপে কেঁপে কাঁদতে লাগল। লিলি উঠে ধীর পায়ে ওর দিকে এগিয়ে গেল। তারপর কাঁধে হাত রাখতেই মূর্তিটি ফিরে তাকাল। এত মায়াবী চেহারা! চোখ দুটো ঠিক লিলি’র মতো ডাগর ডাগর। কিন্তু ও কাঁদছে কেন ?!”
লিলি ফিসফিস করে বলল,
“কে তুমি? কাঁদছ কেন ?!”
সাথে সাথে মূর্তিটি ধোঁয়া হয়ে তীব্র গতিতে বেড়িয়ে যেতেই উত্তাল বাতাসে ফিসফিস শব্দে একটি নাম ভেসে এল,
“মন্দিরা……”
চমকে উঠে চোখ মেলে লিলি। দরদর করে ঘামছে। এতক্ষণ তাহলে স্বপ্ন দেখছিল ! এতোটা জীবন্ত হতে পারে স্বপ্ন! হাত পা গুটিয়ে আবার চোখ বুঝে শুয়ে পরে সে। কানের কাছে প্রতিশব্দ হয়ে বার বার একটা কথা-ই ভেসে আসছে, মন্দিরা…!
দিঘীতে সে যখন ঘোর বিপদের ছিল কেউ একজন এগিয়ে এসেছিলো সাহায্যে। সেই কণ্ঠ আর এই কণ্ঠ একদম এক।
কে এই মন্দিরা ?! হুট হাট এসে দেখা দিয়েই উধাও হয়ে যাচ্ছে!!
এভাবে ১ মাস অতিবাহিত হল।
মেয়ের হঠাৎ বদলে যাওয়ার রহস্যের কোন কুলকিনারা করতে পারেন না লিলি’র বাবা। অনেক বলে কয়ে সেদিন ঘুরতে পাঠাল। কিন্তু ফিরে আসতেই দরজায় খিল দেয় লিলি। কোথায় সেই আগের হাস্যজ্জল মেয়েটা?! বাবলির সাথেও স্বাভাবিক এর চেয়ে কম কথা বলে। আহারে… না জানি কি ঝড় ঝাপটা গেছে মেয়েটার উপর দিয়ে। হয়ত কাউকে বলতে পারছে না। অনেক চেষ্টা করেও একটা কথা বলাতে পারেন নি তিনি। শেষ বিকেলের আলোয় বিষণ্ণ বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন লিলি’র বাবা।
এক রাতের কথা…
অজানা কারনে আবারও ঘুম ভাঙে লিলি’র। নিঃশব্দতা ফালা ফালা করে দেয়াল ঘড়িতে বেজে চলে, টিকটিক… টিকটিক…
উঠে বসে দরজা বরাবর তাকায় লিলি। বারান্দার আলো আজকাল ইচ্ছে করেই জ্বালিয়ে রাখা হয়। সেই আলোর রেখা দরজার নিচ কিছুটা আলোকিত করে রেখেছে। লিলি খাট থেকে নামে। ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছে। কি যে এক যন্ত্রনা শুরু হয়েছে ইদানিং! যখন তখন ক্ষিধে পায়।
লিলি সতর্ক চোখে বাবলিকে দেখল। এপাশ থেকে ওপাশ হয়েই আবার গভীর নিঃশ্বাস ফেলল বাবলি। নিঃশব্দের বেরুতে চাইলেও কাঠের ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে প্রচণ্ড রাগ হয় ওর। ভাগ্যিস বাবলি জাগেনি। সতর্কতার সাথে বেড়িয়ে পড়ে সে। লিলি পেছন ফিরলেই দেখত, বাবলি জেগে উঠে চোখ কচলে অন্ধকারটা চোখে সোয়াতে চাইছে।
পা টিপে টিপে বারান্দায় আসে লিলি। এক কোণেই তাদের পোষা বিড়াল গাবু ঝিমুচ্ছে। ওর দিকে এগুতে থাকে সে। পৈশাচিক হাসির রেখা ঠোটে। হঠাৎ একটা ঝড় বাতাস শুরু হতেই কিছুটা ঘাবড়ে যেয়ে আবার এগোয়। শরীরটা থেমে থেমে কেঁপে উঠে। নখের গোঁড়ায় তীক্ষ্ণ ব্যথা হতে থাকে। ঠোট গড়িয়ে লালা পড়ে গাবুর দিক দৃষ্টি যেতেই। তখনি ধোঁয়ার মতো উদয় হয় সেই ছায়া মূর্তি, মন্দিরা…
ফিস ফিস করে কিছু বলে ও। এর কিছুই বুঝতে পারে না লিলি। ততক্ষণে ওর চোখ দুটো লালাভ আলোয় ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। চুলগুলো সাপের ফণার মতো উড়ে উড়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। চামরা ফুঁড়ে রগগুলো যেন বেড়িয়ে আসতে চায়। ছায়া মূর্তিটি আপ্রাণ থামাতে চেষ্টা করে,
“লিলিই… এ তুমি নাও। ফিরে যাও। লিলিই…”
বাঁকানো নখগুলো দিয়ে ওর দিকে খামচি ছুরতে চায় লিলি। কিন্তু পারে না। ধোঁয়া হয়ে উড়ে যায়। তবে ফিসফিসানি ভেসে আসতেই থাকে…
গাবুর ঠিক সামনেই বসে লিলি। ঘাড় বাঁকিয়ে ওর দিক তাকিয়ে চিঁ চিঁ জাতিও শব্দ করে। গাবু ধক করে চোখ খুলে তীব্র স্বরে মিউ মিউ ডাকতে যেয়েও পারল না। পালাবার চেষ্টা করার আগেই ওটি হাতে নিয়ে ক্যাঁট করে ঘাড়টা মটকে দেয় লিলি’র ভেতর থাকা পিশাচিনি। তারপর ভয়ঙ্কর আক্রোশে সূচালো দাঁত দিয়ে কামড়াতে থাকে ওটাকে। ছিন্নভিন্ন করে চুষে নিতে থাকে রক্ত। চিবুতে থাকে গাবুর মাংস টুকরো। তাকে ঘিরে তীর গতিতে ঘোরপাক খেতে থাকে মন্দিরার ধোঁয়াটে অবয়ব। সেখানে বিষাদ এর ছোঁয়া।
লিলি’র সমস্ত মনোযোগ গাবুর ঝাঝরানো শরীরে। ওকে খেতেই ব্যাস্ত সে।
এদিকে বাবলি বাথরুম আর রান্নাঘরে লিলিবুকে না পেয়ে বারান্দা বরাবর হাটা ধরে। দরজার পাশে আসতেই অদ্ভুত শব্দে অবাক হয়ে তাড়াতাড়ি ওটা খুলে সে। তার লিলিবুর কিছু হল না তো? বারান্দায় পা দিতেই অস্বাভাবিক ভাবে আঁতকে পিছিয়ে যায় বাবলি। বিস্ফোরিত চোখদুটো কোঠর থেকে বেড়িয়ে আসতে চায় ওর! লিলিবুর মতো দেখতে একটা ডাইনী ওদের গাবুটাকে চিবিয়ে খাচ্ছে!! চিৎকার দিতে চাইতেই কণ্ঠ ছাড়িয়ে ঘো ঘো শব্দ হল, তার সাথে ঠোটের কোন দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ল। কিছু বুঝে উঠার আগেই মেঝেতে আছড়ে পড়ে বাবলি।
ওদিকে গাবুকে খাওয়া শেষ হলে সব চেটে পুটে পরিষ্কার করে ফেলে লিলি। এক বিন্দু রক্তের দাগ নেই কোথাও। এর পরপরই শরীর কাঁপুনি দিয়ে ওখানেই জ্ঞান হারায়।
পরদিন লিলি’র বাবা তার দুই মেয়েকে বারান্দার মেঝেতে আবিষ্কার করেন। লিলির জ্ঞান ফিরলেও বাবলির শরীরে হাত রেখে চমকে উঠেন তিনি। নীলচে দেহটা অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা। তাড়াতাড়ি ডাক্তার আনালেও কোন কাজ হল না। ডাক্তার ওকে মৃত ঘোষণা করলেন। যে কোন কারনেই ভয় পেয়ে হার্ট অ্যাটাক করেছে বাবলি। লিলি এবং তার বাবা’র চিৎকারে এক হয়ে গেল পুরোটা পাড়া। কেউ কিছু না বুঝলেও গতরাতের কথা মনে পড়ে লিলি’র। নিশ্চয় বাবলি ওকে দেখে ফেলেছিল। লোমহর্ষক পৈশাচিক দৃশ্যটি সইতে না পেয়েই অকালে প্রাণ হারালো তার আদরের ছোট বোন!
সব তার দোষ!! সব…!! চিৎকার করে নিজের চুল ছিঁড়ে লিলি। বোনটাকে যে ভীষণ ভালবাসে ও। কেন এমন হয়! কেন!! এগুলো ভাবতে ভাবতেই ঘরে ঢুকে দরজায় খিল দেয়। বাবা অনেক ডেকেও কোন জবাব পেলেন না। ডুকরে কাঁদতে কাঁদতে বিড়বিড় করে মন্দিরাকে ডাকে লিলি। একমাত্র সেই পারবে এই রহস্যের জট খুলে তাকে উদ্ধারের পথ দেখাতে। একসময় তন্দ্রা মতো আসতেই কারু নিঃশ্বাসের শব্দ তার কানে আঘাত করে। পিটপিট করে চোখদুটোকে খুলতেই সামনে মন্দিরা কে দেখতে পায়। পেছন ফিরে বসে আছে। লিলি ধড়ফড় করে উঠে বসে।
“মন্দিরা…”
মন্দিরা প্রতিউত্তরে মাথা দুলায়।
“তুমি কে?!
এবার দীর্ঘশ্বাসের শব্দ এল। তারপর ভেঙে ভেঙে ভেসে আসে,
”…আমি বন্ধু…”
লিলি এবার আকুল কণ্ঠে বলল,
”আমি ভীষণ বিপদে পড়েছি। তুমি আমায় সাহায্য কর মন্দিরা। দোহাই লাগে।“
“…হু…আমি তোমায় বলি। মন দিয়ে শোন…” বলেই দীর্ঘ কথপকথনের প্রস্তুতি নেয় মন্দিরা। লিলি তার সমস্ত মনোযোগ সেদিকে কেন্দ্রিভুত করে।
মন্দিরা বলতে শুরু করে…
“…তুমি যেই পিশাচিনির কবলে পড়েছ, তার কারনেই আমি প্রাণ হারিয়েছি। জঙ্গলে বাবাকে খুঁজতে যেয়ে আটকে পড়েছিলাম ওর মায়া জালে। এরপর ঠিক তোমার মতো মায়া দিঘীতে ও আমার জীবনি শক্তি হরণ করে আমায় দিয়েছিল কয়েক দিনের বার্ধক্য। জঙ্গলের মধ্যেই ধুঁকে ধুঁকে মরেছি আমি। তোমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন। ঈশ্বর আমার মাধ্যমে তোমায় সাহায্য পাঠিয়েছেন। আমার বেলায় অমন হয়নি, কেউ সাহায্য নিয়ে আসেনি।
এবার বলি তোমার সাথে ঘটে যওয়া ঘটনাগুলোর ব্যাখ্যা। সেই রাতে মায়া দিঘীতে বুনো লতাপাতা তোমার পা আঁকড়ে ধরেছিল। ওগুলোর টানেই তোমার পায়ে থাকা নূপুরটা ওখানে রয়ে গেছে। পিশাচিনি তার কালো যাদূ বিদ্যার প্রভাবে নূপুরটি দ্বারা তোমাকে পরিচালনা করছে। তবে এটা সে সবসময় পারে না। যেমন আমি পারি না যখন তখন তোমায় সাহায্য করতে।
পিশাচিনির প্রভাব মাঝ রাতের পর থেকে শুরু হতে থাকে। তখন চাইলেও আমার কোন সাহায্য তোমার কর্ণপাত হয় না।
“কিন্তু সেদিন দিঘীতে তো তুমি সাহায্য করেছিলে! নিজের ভেতর প্রবল শক্তি অনুভব করেছিলাম আমি।”
অবাক হয়ে বলে লিলি।
মন্দিরা আবার বলতে শুরু করে…
“…হ্যাঁ। কারণ মায়া দিঘীতে থাকা কালীন পিশাচিনি প্রবল ভাবে তার শক্তি ব্যাবহার করতে পারে না। তখন কালো বিদ্যার সাধনায় নিমগ্ন থাকে সে। জীবনী শক্তি হরণ করার পক্রিয়ার কারনে তার ভেতর ঘোর সৃষ্টি হয়। তবে এখন দিঘীর চক্রাকারে বন্দী হয়েও তার অবশিষ্ট পৈশাচিক শক্তি দিয়ে প্রতিশোধ নিতে ব্যাস্ত সে। এ কারনেই এমন হচ্ছে। জাগতিক সংসারে কালো বিদ্যা প্রভাবের জন্যে তোমার নূপুরটাই তার একমাত্র অবলম্বন। এখন তোমাকেই এর শেষ করতে হবে।“
“আমি…!!”অবাক হয়ে বলে লিলি।
“…হ্যাঁ, তুমি। তোমাকে আবার ফিরে যেতে হবে সেই মায়া দিঘীতে। তবে এর আগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি করনীয়, তা হচ্ছে পিশাচিনির কুঁড়ে বাড়ি যেয়ে ওর ঘর থেকে পীতল কাঠের সেই মায়াকরী আয়নাটি নিতে হবে। ওটাই ওর মরণ ফাঁদ। এ ছাড়া ওকে বিনাশ করার দ্বিতীয় কোন উপায় নেই। ওটা নিয়ে মায়া দিঘীর ঠিক মধ্যখানে যেতে হবে তোমায়। তারপর ওর নিজের মায়াবী আয়নাতেই বন্দী করতে হবে ওকে। আর হ্যাঁ, মনে রেখ, বন্দী করার পর সাথেসাথেই আয়নাটি চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলতে হবে। কাজটা কঠিন হলেও আর কোন পথ খোলা নেই। একমাত্র এভাবেই নিঃশেষ হতে পারে পিশাচিনি এবং তার কালো যাদু বিদ্যা। না হলে তোমাকে দিয়ে তার মনোবাসনার কিছুটা হলেও মিটিয়ে নেবে সে। তুমি দিন দিন পরিণত হবে হিংস্র রাক্ষুসিতে।”
কথাগুলো শুনে লিলি কেঁপে উঠলো। আবার সেই ভয়ঙ্কর অতীত !!?
“আ…মি কি… পারবো ?!কিছুই যে চিনিনা ওই অরণ্যে। আবার যদি হাড়িয়ে যাই?!”
“…হারাবে না। আমি থাকব তোমার পাশে, অদৃশ্য হয়ে। তবে যা করার খুব ধ্রুত করতে হবে। পারলে আজ-ই। মধ্য রাতের আগে পিশাচিনি কিছুই করতে পারবে না। এই সুযোগের সৎ ব্যাবহার করতে হবে আমাদের। তোমার মধ্যে ওর প্রভাব চলে আসলে চাইলেও কিছু করতে পারবোনা আমি। সুতরাং আর দেরী নয়। ওঠো লিলিই… ওঠো!!!
চমকে উঠে চোখ মেলে লিলি। যেন দীর্ঘ কোন স্বপ্ন দেখার পর জাগলো। নাহ, আর সময় নষ্ট না করে, পা টিপে টিপে দরজা খুলে সে। যেভাবেই হোক এখনি বেরুতে হবে। অনেক কষ্টে সবার দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেইট খুলে বেড়িয়ে আসে। তারপর ছুটে রাস্তা বরাবর। জঙ্গলটা কোন দিনে সঠিক ধারণা নেই, তবু দৌড়ে চলে… এক সময় শরীরে ঝাঁকি দিয়ে অদ্ভুত শক্তি অনুভব করে। মনে হচ্ছে দৌড়ে নয়, ভেসে ভেসে যাচ্ছে। ঠোটের কোনে আলতো হাসি ফুটিয়ে ফিস ফিস করে বলে লিলি,
“মন্দিরা…”
প্রতিউত্তরেই যেন আশে পাশের শুকনো পাতার কিছু উড়ে এসে তাকে ছুঁয়ে গেল…
ঝড়ের গতিতে ছুটতে ছুটতে পিশাচিনির কুঁড়ে ঘরে চলে আসে লিলি। সবকিছুর মাঝে অবহেলার ছোঁয়া। বিষণ্ণ বাতাসের আনাগোনায় শিশের মতো শব্দ হচ্ছে। কিছুক্ষণ সব পরোখ করে ঘরে ঢুকে পরে সে। সব আগের মতই আছে। ওই তো, মাটির পাত্রে তাকে পান করতে দেয়া ফলের রস শুকিয়ে আছে। ওটার কাছে যেতেই নাক কুঁচকে নেয় । ওটা কী বুনো ফলের রস নাকি কোন বন্য পশুর রক্ত ছিল! জমাট বাঁধা কালচে রংটাকে ওমন-ই লাগছে। ব্যাপারটা চিন্তা করতেই গা গুলিয়ে আসে। তখনি বাতাসের প্রবল ধাক্কায় নরে উঠে লিলি। নিশ্চয় এটা মন্দিরা, তাড়া দিচ্ছে। নাহ, দেরি করলে চলবে না। পাশের ঘরে ঢুকেই আয়নাটার সামনে যায়। ইচ্ছে করে এক্ষুনি ওটা ভেঙে ফেলতে। দাঁতে দাঁত ঘষে রাগ প্রতিহত করে। ওর কারনেই তার আদরের ছোট বোনটা প্রাণ হারাল। ডুকরে কেঁদে উঠে লিলি। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে আয়নাটা সাবধানে বাশের কঞ্চি থেকে খুলে নিল। দু-হাতে ওটি আঁকড়ে ধরে বেড়িয়ে পথ ধরে মায়া দিঘীর উদ্দেশে…
লিলি ঠিক মায়া দিঘীর সামনে দাড়িয়ে। মেঘের আড়াল থেকে বেরুনো সূর্যের আলোয় চিকচিক করছে দিঘীর জল। কে বলবে এক ভয়ঙ্কর পিশাচিনি ঘাপটি মেরে আছে ওর নিচে। চোখ দুটো বন্ধ করে বাবলির কথা ভাবতেই দু-বিন্দু জল গড়িয়ে পড়ে। ফিস ফিস কণ্ঠ ভেসে আসে…
“জলে নেমে পড় লিলি… দেরি কর না…”
লিলি আল্লাহ্কে স্মরণ করে ডান পা বাড়িয়ে দেয়। তারপর ধীরে ধীরে এগোয়। কি হিম শীতল জল! হাত পা অবশ হয়ে আসতে চাইছে। চাপা আতংক নিয়ে একদম মাঝ বরাবর আসতেই এপার থেকে ওপার অব্দি অদ্ভুত ভাবে ঢেউ খেলে গেল। লিলিকে কেন্দ্র করে একটি ছোট ঘূর্ণি তৈরি হতেই সে ঘাবড়ে যায়। কিন্তু ভয় পেলে চলবে না। এক হাতে নাক চেপে আরেক হাতে আয়নাটা জরিয়ে ডুব দেয় লিলি। সূর্যের আলোর রেখা কিছুটা পথ যেয়ে থেমে গেছে। গভীরে পাথর খণ্ড আর বুনো লতায় ঘেরা রহস্যময় আলো-আঁধারের খেলা। চারপাশে চোখ বুলিয়ে কোথাও বৃদ্ধা পিশাচিনিকে নজরে এল না। ও কী এখানেই আটকা পরে আছে নাকি বেড়িয়ে গেছে?! দম ফুরিয়ে আসতেই ভেসে উঠে নিঃশ্বাস নেয় লিলি। তারপর আবার ডুব দিয়ে লতাপাতার ফাঁকে নূপুরের আশায় হাতড়াতে থাকে। পাশাচিনি বাঁচুক আর মরুক, নূপুরটা নিয়ে নিলে সব সমস্যার অবসান ঘটবে। কিছুক্ষণ খোঁজার পরই লতানো একটি ডালে নূপুরটিকে ঝুলে থাকতে দেখা গেল। ম্যাড়ম্যাড়ে রঙটায় শ্যাওলা জড়িয়ে গেছে। আর দেরী না করে ওটাকে বুনো লতার কিছু পাতা সহ-ই টেনে আনে লিলি। এরপর দ্রুত ভেসে উঠে দম নেয় আবার। তখনি পানির একপাশে বুর বুর উঠতে থাকে। লিলি বুর বুর লক্ষ্য করে সাঁতরে কাছে গিয়ে ডুব দেয়। কিন্তু কিছুই নেই সেখানে!
দম নিয়ে নিয়ে পুরোটা দিঘী তল্লাশি করেও কিছু পেল না। এদিকে সন্ধ্যা নেমে আসছে। বাতাসে বৃষ্টির ভেঝা গন্ধ ছিল কখন থেকেই। লালচে আকাশের কোনে বিদ্যুৎ খেলে ঝুম বৃষ্টি নামল। হতাশায় লিলি’র কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। আর কতক্ষণ ভেসে থাকবে এভাবে? এর কি শেষ নেই?! ঠিক তখনি কিছু একটা লিলির পা জড়িয়ে আকস্মিক ভাবে টেনে জলের গভীরে নিয়ে গেল। চোখ ফালাফালা করে তাকিয়ে থাকে সে। কিচ্ছু নেই, কেউ নেই! উপরের দিক উঠতে চাইতেই আবার কিছুর স্পর্শ পায়।
তখনি জলের রেখা কাঁপিয়ে অবয়বটি স্পষ্ট হল। সেই বৃদ্ধা পিশাচিনি!! পানির মধ্যেই অদ্ভুত ভাবে হামাগুড়ি দিয়ে হা হয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে। ওর চারপাশে লালাভ আলো বৃত্তাকারে ঘুরপাক খাচ্ছে।
লিলি দু-পা সামনে দিয়ে কিছু সময়ের জন্য ভেসে দম নিয়ে সাথে সাথেই আবার ডুব দিল। পিশাচিনি তার দু-হাতের নখ বাড়িয়ে দিতেই ওগুলো এসে লিলির গলা পেঁচিয়ে চামড়ায় সেঁটে যেতে থাকে। লাল হয়ে যাওয়া মুখ আর নাক দিয়ে পানি যেতে থাকে ওর। নিজের দিকে ফেরানো আয়নাটা এবার পিশাচিনির দিকে বহুকষ্টে ঘুড়িয়ে ধরে লিলি। আর তখনি বিস্ফোরণের মতো ছিটকে পড়ে পিশাচিনি। লিলি কাঁপা হাত থেকে ওটি খসেই পড়ছিল, হঠাৎ শরীরে অদ্ভুত শক্তি অনুভব করে, ঠিক সে রাতের মতন।
‘মন্দিরা’…
নামটা ভাবতেই ভাল লাগে লিলি’র।
আয়নাটা নিয়ে যতই সে এগোয়, ততোই পিশাচিনি লতাপাতা আঁকড়ে , নিজেকে কুঁকড়ে লুকোতে চায়। কি আশ্চর্য রকমের ভয় ওর চোখে। গোঙাতে গোঙাতে মাথা দিয়ে বারন করছে লিলিকে এগুতে।
লিলি এবার ঠিক পিশাচিনির সন্নিকটে এসে আয়নাটা ধরতেই ওটা থেকে লালচে আলো বিচ্চুরিত হতে লাগল। ওগুলো যেন পিশাচিনির গায়ে বিঁধছে। ভয়ঙ্কর যন্ত্রনায় ছটফট করতে থাকে সে। ধীরে ধীরে আয়নাটি চুম্বুকের মতো টেনে ওকে খুব কাছাকাছি নিয়ে আসে। আয়নার ফ্রেমের কারুকাজে দু-হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে নিজেকে থামাতে চায় পিশাচিনি। ভেতরে না যাবার তীব্র প্রচেষ্টা। কিন্তু মন্দিরা বলেছিল ওটাই ওর মরণ ফাঁদ, সুতারাং কে বাঁচাবে ওকে? মায়াকরী আয়না ঠিকই ওকে নিজের ভেতর বন্দী করে ফেলল। লিলি আর দেরী না করে জলের নিচ থেকে একটি পাথর খণ্ড নিয়ে আয়নাটি চুরমার করে ফেলল। এরপর ভেসে উঠে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল। পারে আসতেই দিঘীর ভেতর থেকে আসতে থাকে পৈশাচিক গর্জন। পুরোটা বন যেন ভেঙে পড়বে। লিলি অবাক হয়ে লক্ষ্য করে, দিঘীর চারপাশের কাশফুলগুলো শিকড় উপড়ে নুয়ে পড়ে টুপ করে ডুবে যাচ্ছে। ঝড়ের গতিতে বিশাল ঢেউ গ্রাস করছে ওগুলোকে। লিলি দৌড়াতে শুরু করে। পেছনে তাণ্ডব লীলা তখনও বিদ্যমান। জঙ্গলে মিলিয়ে যাবার আগ মুহূর্তে পেছন ফিরে সে। সব কিছু ততক্ষণে শান্ত…
অবিরত বৃষ্টি পড়ছে, গাছের শুকনো পাতা লেপটে থাকা ভেজা মাটির উপর দিয়ে লিলি ছুটে চলছে… তার আর্তনাদ আর চিৎকারে থমকে আছে প্রকৃতি। শুধু সঙ্গী হিসেবে বৃষ্টির ঝুমঝুম শব্দ অবিরত বেজে চলছে। অপ্রিয় দুঃস্বপ্ন তার আদরের বোনকে গ্রাস করেছে ভাবতেই হাঁটু গেড়ে বসে দু হাত মাটিতে চাপরাতে চাপরাতে ভেতরের সব হাহাকার ছড়িয়ে দেয় সমস্ত বনে… প্রতিশব্দ হয়ে দূর থেকে ভেসে আসে একই দুঃখ…
প্রায় ১ বছর পরের কথা।
লিলি একটি প্রাইভেট ফার্মে জব করছে। জীবন যাপন বেশ স্বাভাবিক হয়ে উঠলেও বাবলিকে হারানোর বেদনা এখনও কুঁড়ে কুঁড়ে খায় তাকে। তবুও বৃদ্ধ বাবার ভালবাসাকে অবলম্বন করে এগিয়ে চলে।
মন্দিরা আর দেখা দেয়নি এর মাঝে। হয়তো পিশাচিনির মৃত্যুর সাথে তার আত্মাও মুক্ত হয়ে গেছে। মেয়েটির প্রতি কৃতজ্ঞতায় চোখ ছলছল করে উঠে লিলির। আফসোস, জানা হল না, কে এই মন্দিরা…?!
বাতাসের ঝাপটায় জানালাটা খুলে যেতেই খুক খুক করে কাশতে কাশতে উঠে বসে কাশিরাম।
”আহ! কাশিরাম নাম বলেই কি কাশতে হবে নাকি হ্যাঁ …!”
ভ্রু কুঁচকে বিড়বিড় করে বলে জানালা বন্ধ করে কাশিরাম। টেবিলের উপর রাখা বিড়ি ধরাতে যেয়ে রেখে দিল। এমনিতেই শরীর ভাল যাচ্ছে না।
পুড়নো ট্রাংকের ভেতর থেকে মন্দিরা’র ঘোলাটে ছবিটা বের করল। অনেক দিন মেয়েটার সাথে কথা হয়না। সেই কবে হারিয়ে গেছে। কাশিরাম ভেবেছিল, হয়ত ছবির সাথেও আর কথা বলা হবে না তার। সেদিন যখন বসকে বলেছিল, লিলি নামের মেয়েটা তাকে ধাক্কা দিয়ে পালিয়েছে, অদ্ভুত হলেও সত্যি, বস বিশ্বাস করেছিল। হয়ত সে এতদিনের অনুগত চ্যালা ছিল বলেই সন্দেহ করেনি। এরপর অসুস্থতার অযুহাতে পাপের পথ ছেড়ে দিল। এখন শারীরিক অবস্থা বেহাল হলেও মনের দিক দিয়ে সুখে আছে সে। অন্তত আরেকটি মেয়ের সর্বনাশ হতে রক্ষা পেল।
মন্দিরার ছবিটা সামনে তুলে ধরে কাশিরাম। অবাক চোখে চেয়ে আছে মেয়েটা। আদর করার মতো ছবির ধুলোবালি মুছে দিল। এরপর পরাজীত কণ্ঠে বলল,
”আমাকে ক্ষমা করে দিস রে মা। তোর কাছে আমি অপরাধী।“
বলেই হু হু করে কাঁদতে লাগল। বন্ধ করা জানালা আবার খুলে গেছে। বাহির থেকে সা সা করে বাতাস এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে তাকে। কাশিরামের ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে, যেন মন্দিরাই তার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ঠিক আগের মতো…… শুধু অভিমানি কণ্ঠে কেউ বলছে না,
“আর কত ওই অন্ধকারে থাকবে বাবা ! এবার তো চোখ মেল…!”
বাতাসের শব্দে কান পেতে রয় কাশিরাম। ভুল করেও যদি আবার সেই কণ্ঠ ভেসে আসে…!
………………………………………………………….(সমাপ্ত)………………………………………………………..