আকাশটা প্রায় ফাকা। অল্প কিছু সাদা মেঘের খন্ড আকাশে ভেসে ভেসে তাদের উপস্থিতির প্রমান দিচ্ছে।মধ্য দুপুর এখন।আমার মাথায় রোদ সরাসরি তাপ দিচ্ছে। তাপটা প্রথমে কষ্ট দিলেও এখন ভালোই লাগছে।পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেয়া মানুষের অভ্যাস।একবার মানিয়ে নিতে পারলে তখন একটা কষ্টদায়ক বিষয়ও আরামদায়ক হয়ে যায়।কিন্তু একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে।মানুষেরা পরিবেশ অনুযায়ী মানিয়ে নিতে পারে।কিন্তু আমি তো মানুষ না।আমি কীভাবে পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিচ্ছি।উত্তর খুজে পেলাম না।হয়তো আমার লেখক আমাকে অনেক আবেগ দিয়ে লিখেছেন।তাই আমি মানুষের মতোই মানিয়ে নিতে পারছি।মানুষ সাধারনত কোনো উত্তর খুজে না পেলে নিজের পছন্দ মতো একটা উত্তর বানিয়ে নেয়।আমিও পছন্দের একটা উত্তর বানিয়ে নিয়েছি আমার প্রশ্নের।এ দ্বারা
বোঝা যায় লেখক আমাকে অনেক আবেগ দিয়ে লিখেছেন।কারন আমাদের জগতে যাদের খুব আবেগ দিয়ে লেখা হয় একমাত্র তারাই মানুষের মতো আচরন করতে পারে।আর বইয়ের জগত থেকে বেড় হওয়ার ক্ষমতাও শুধু আবেগ থেকে সৃষ্টি চরিত্রগুলোরই থাকে।কিন্তু সব চরিত্র সে আবেগের মূল্য দিতে পারে না।আমি পেরেছি কিনা জানি না।হয়তো পারিনি।অথবা প্রমান দেবার সুযোগ পাই নি।আমার বয়স বেশি না।অনেক চরিত্র আছে যাদের বয়স একশত বছরেরও বেশি। তারাও অনেকে লেখকের আবেগের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রমানের সুযোগ পায়নি।তার আগেই লেখক মারা গেছেন।আর আমার জন্ম তো কাল রাতে।আমি কীভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো? শতবর্ষি চরিত্র গুলোর সাথে আমার একটাই মিল রয়েছে।তাদের লেখক যেমন মৃত তেমনি আমার লেখকও মৃত।তাদের সাথে আমার যেমন মিল রয়েছে তেমন পার্থক্যও রয়েছে।তাদের কেউই নিজের চোখের সামনে নিজেদের লেখককে মৃত্যুর কোলে ঢুলে পড়তে দেখেনি।আমি দেখেছি।
লেখক আমার পিতা।তিনি আমার জগতটাকে নিজের মতো করে তৈরী করে দিয়েছেন।যেমন একজন পিতা তার সন্তানের জগতটাকে তৈরী করে দেন।আমার জগতে আমার একটা নদী রয়েছে।খব সুন্দর নদীটা।কাল রাতে আমার জন্মটা নদীটার তীরেই।প্রথম দৃশ্যে আমি নদীর ধারেই বসে ছিলাম।নদীর দিকে ইটের টুকরো ছুড়ে মেরে একটা খেলা খেলছিলাম।আমার মনে হয় ওই খেলাটা লেখকের অনেক প্রিয়।কারন তিনি অনেক আনন্দের সাথে খেলাটার কথা লিখেছেন।আমি আনন্দের কথা বুঝতে পারছি।কারণ আনন্দটার বহিঃপ্রকাশ আমার মাধ্যমেই হয়েছে।আমার জগতটা সম্পুর্ন ভাবে তৈরী হয়নি।লেখক কাল আমার গল্পটা লিখতে লিখতেই ঘুমিয়ে গেছন।আজ সকাল হতেই বেড়িয়ে পড়েছেন।তাই আমি সম্পুর্ন ভাবে বেড়ে উঠতে পারিনি।অসম্পূর্ন হলেও আমার জগতটা সুন্দর।সেখান
থেকে বেড়িয়ে আসার কোনো কারণ আমার ছিলনা।কিন্তু হঠাত এলোনাস বুড়োটা এসে হাজির হলো।এলোনাস হলো বইয়ের জগতের হিসাব রক্ষক।সে সকল চরিত্রের হিসাব রাখে। ও এসেই আমার নাম জিজ্ঞেস করছিলো।কিন্তু লেখক কালকে আমার নাম ঠিক করে দেন নি।তাই আমি নাম বলতে অপরাগ।কিন্তু এলোনাস বুড়ো নাছড়বান্দা।সে হুমকি দিলো যে নাম না বললে আমাকে শাস্তি দিবে।আমার গল্পটা পুরো হতে দিবেনা।অগত্যা আমাকে বেড়িয়ে আসতে হলো আমার জগত থেকে।কিন্তু খুব একটা লাভ হলো না। কারণ লেখক মারা যাওয়ায় আমার গল্পটা এমনিতেই লেখা হবে না।তার উপর এখন আবার আমি বইয়ের জগতে আর ফেরত যেতে পারবো না।আমাদের জগতের নিয়ম হলো লেখক মারা যাওয়ার পরে কেও যদি লেখকের জগতে থাকে সে আর বইয়ের জগতে ঢুকতে পারে না।একটা উপায় অবশ্য আছে।তা হলো তার গল্পের অন্য একটা চরিত্র এসে তাকে নিয়ে যাবে।কিন্তু আমার অবস্থা এমন যে “ওয়ান পিস মেড,মেকার ইজ ডেড”,আক্ষরিক অর্থেই আমি ওয়ান পিস।আমার গল্পে আর কোনো চরিত্র নেই।জগতে এখন আমি একাই!
আমার দেখা সবচাইতে অকৃতজ্ঞ চরিত্রটার নাম হলো কালু।তাকে আমি আজ সকালেই দেখেছি।সে সম্পর্কে আমার জাত ভাই।আমার লেখকের হাতেই জন্ম তার।লেখক তাকেও আবেগ দিয়ে লিখেছেন।সে ছিলো লেখকের সবচাইতে বড় মারনাস্ত্র।তাকে নিয়ে লেখক বহু গল্প লিখেছেন।প্রতিটা গল্পেই কালু হলো ভয়ঙ্কর খুনি।আর গল্পের শেষে সবসময়ই সে রয়ে যায় ধরা ছোয়ার একেবারে বাইরে! আজ সকালে এলোনাসের তাড়া খেয়ে আমি বেড়িয়ে এলাম আমার জগত থেকে।লেখক সম্পর্কে সব না জানলেও এলোনাস তার কর্মস্থলের ঠিকানা দিয়েছিলো আমাকে।বের হয়ে অল্পকিছুক্ষনের মাঝেই আমি লেখকের কর্মস্থলে উপস্থিত হয়ে গেলাম।বিশাল এক ভবনে কাজ করতো আমার লেখক।তার কেবিনের সামনে সোনালী অক্ষরে তার নাম দেখে গর্বে বুকটা ফুলে উঠেছিলো।আমি দরজা হালকা ফাকা করতেই আমাকে ধাক্কা দিয়ে একজন ভিতরে ঢুকে গেলো। চেহারা হালকা দেখেই বুঝে ফেলেছিলাম এ আমার জাত ভাই কালু।ভাবলাম লেখকের সাথে দেখা করতে এসেছে।ভালোই তো।কিন্তু আমার ধারনাকে ভুল প্রমান করে
কালু ঢুকেই হুঙ্কার ছাড়তে লাগলো, “ আমারে দিয়া খুন করাস ব্যাটা।লজ্জা করে না।নিজে বাস্তবে যেই গুলারে খুন করবার পারস না সেইগুলারে আমারে দিয়া গল্পে খুন করাস।আমারে দিয়া খুন করাইলি কতো মানুষরে আর ভাবছোস তুই শাস্তি পাবি না? অবশ্যই পাবি।আমি আজ তোরে শাস্তি দিবার আইছি।আইছি নিজেরে মুক্ত করবার।হে হে ” পেছনে দাঁড়িয়ে আমি কথা গুলো এক নাগাড়ে শুনে গেলাম।কালু দাড়ালো না বেশিক্ষন।সে একটা বড় ছুড়ি বের করে লেখকের পেট বরাবর ঢুকিয়ে দিয়েই বেড়িয়ে গেলো। আমি বোকার মতো তা দেখলাম।আসলে আমিও অকৃতজ্ঞ।আমি লেখকের সাহায্য না করে বেড়িয়ে এলাম।কাজটা ঠিক করি নি।কিন্তু ঠিক বেঠিকের চিন্তা যখন মানুষ করে না তখন আমি করবো কেনো? আমি মানুষ না হলেও তাদের মতোই তো।
রাস্তায় উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘোরাঘোরি ঠিক না।একটা উদ্দেশ্য থাকা উচিত।হুমায়ুন সাহেবের চরিত্র হিমু উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘোরে। আমি হুমায়ুন আহমেদের চরিত্র না।তাই উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘোরা উচিৎ হবে না।উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘোরা যেমন উচিৎ না তেমনি নাম ছাড়া ঘোরাও উচিৎ নয়।তাই এখন আমার উদ্দেশ্য নিজের নাম খোজা।নামের কথা মনে পড়তেই মনে পড়লো লেখকের কথা।আমার লেখক ছিলেন আকাশের মতো।তাই নামটাও সেরকম হওয়া উচিত।
কিন্তু আমি লেখক নই।তাই আমার নাম আকাশ হওয়া উচিৎ না।কিন্তু আমি লেখকের আকাশের একটা রং।আকাশের রঙের নামে আমার নাম রাখা যায়।কিন্তু আকাশের রঙের নামটা আমি জানি না।পাশে টেকো মাথার একটা লোককে আকাশের রঙের নামটা জিজ্ঞেস করলাম,সে এমন ভাবে তাকালো যেনো আমি তাকে তার শরীরের অর্ধেক আমাকে দিয়ে দিতে বলেছি।সে উত্তর না দিলেও তার সাথে থাকা বাচ্চা মেয়েটা বলে দিলো আকাশের রঙ নীল।তাহলে আমার নামও নীল।আমি ছোট্ট করে মেয়েটাকে বললাম রঙের নামটা তার সাথে থাকা টেকো লোকটাকে শিখিয়ে দিতে।ছোট্ট বাচ্চাকে রঙ শিখাতে বলার কারনেই হোক আর টেকো বলার কারনেই হোক লোকটা
আমাকে ধরার জন্য আমার পিছে ছুট দিলো।আর আম তার সামনে নিজেকে বাচাতে ছুট দিলাম।নাম খোজার উদ্দেশ্য সফল।এখন আমার উদ্দেশ্য দৌড়ানো।উদ্দেশ্যহীন থাকার চেয়ে দৌড়ানো ভালো।কিন্তু কেনো যেনো মনে হচ্ছে এ জগতে টিকে থাকাটা কঠিন হবে।এখানে একটা কথা আছে অনলি দ্যা ফিটেস্ট সার্ভাইভস।এখন কথা হচ্ছে আমি ফিট হিসেবে বিবেচিতো হবো কিনা।কিন্তু সেটা বিবেচনার সময় এখন নয়।এখন সময় দৌড়ানোর!
……………………………………………………………………….সমাপ্ত…………………………………………………………..