বাংলো বাড়ির লোকটি

বাংলো বাড়ির লোকটি

আজ সকাল থেকে মুষল ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি আমার ভালোই লাগে,কিন্তু আজ বৃষ্টিটা কেমন অসহ্য ঠেকছে। এই বৃষ্টিতে দুপুরবেলা খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজা খেয়ে একপশলা ঘুমিয়ে নেয়াই শ্রেয়।এই কথা ভাবতে ভাবতেই মা আমার জন্য ইলিশ মাছ আর খিচুড়ি নিয়ে হাজির।আমি তো মহা খুশি।মা কিভাবে যেন আমার মনের কথা বুঝতে পেরে যায়। আমি কোন কথা না বলে প্লেটটা নিয়ে চুপচাপ খেতে লাগলাম। কিন্তু বিধিবাম।

হঠাৎ করেই বৃষ্টির জোরালো শব্দকে উপেক্ষা করে আমার মোবাইল ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। এমনিতেও মেজাজ খারাপ।তাই চরম বিরক্তি নিয়েই ফোন রিসিভ করলাম। হ্যালো কে বলছেন? আমার কথার উত্তরে ফোনের ওপার থেকে ভেসে আসলো- স্যার আপনাকে এই মুহূর্তে অফিসে আসতে হবে, বসের জরুরী তলব। যে করেই হোক এক ঘণ্টার মধ্যে অফিসে এসে উপস্থিত হবেন।এসব শুনে আমি কিছু বলতে যাবো,কিন্তু আমার আর বলা হলো না,তার আগেই ফোনের ওপর প্রান্তে থাকা আমার অফিস সহকারী ফোন কেটে দিয়েছে। এরপর আমি কয়েকবার ফোন করেও ব্যস্ত পেলাম। কি আর করা।বড় কর্তার হুকুম বলে কথা।

আমি আর খেলাম না,আমার সাধের খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ টেবিলেই পরে থাকলো। আমি মাকে ডাক দিলাম,বললাম আমার ছাতা আর রেইনকোট নিয়ে আসতে। মা এগুলো নিয়ে আসলো, আর বলতে থাকলো – কোথায় যাবি এই বৃষ্টিতে?আজ না গেলেই নয় রে? আমি বললাম অফিস থেকে জরুরী কাজে আমাকে যেতেই হচ্ছে মা,এক ঘণ্টর মধ্যে হাজির হতে হবে। মায়ের টেবিলের দিকে চোখ পড়তেই বললো – ও কি খোকা!(মা আমাকে এখনো সেই ছোট্টটিই ভাবেন) খাবার অর্ধেক খেয়ে ফেলে রাখতে নেই,খাবারটা শেষ করে যা। খাবার ফেলে উঠে গেলে অমঙ্গল হয়।

ততক্ষণে আমি হাত ধুয়ে ফেলেছি। আমি আবার এসব কুসংস্কারে বিশ্বাসী না। তাই মায়ের কথা অমান্য করে রেইনকোট টা গায়ে চাপিয়ে, ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম রাস্তায়,আমার হাতেও বেশি সময় ছিলো না।পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম মা চিন্তিত মুখে অসংখ্য উদ্বেগ নিয়ে চেয়ে আছে।আমি একটু হেসে বললাম, চিন্তা করো না মা,আমি ঠিক সময়ে চলে আসবো। আমি বের হতেই বৃষ্টির জোর ঝাপটা আমার মুখ ভিজিয়ে দিলো, রেইনকোটের টুপিতে কাজ হচ্ছে না,তাই ছাতাটাও ফোটালাম, মেলে ধরলাম মাথার উপর,যদি মুখটা এবার রেহাই পায়।

আমার চশমার কাচ পুরোটা ভিজে গিয়েছে,দেখতে বেশ সমস্যা হচ্ছে। রাস্তায় একটা গাড়ি অথবা রিকশা কিছুই নেই।আমি হতাশ হলাম, আজ বোধহয় বসের রাগের হাত থেকে আমাকে কেউ উদ্ধার করতে পারবে না। আমার অফিস বাড়ি থেকে বেশ দূরে,তার ওপর এই এলাকায় আমি নতুন, এই এক সপ্তাহ হলো ঢাকা থেকে ট্রান্সফার করে আমাকে এই পাহাড়ি এলাকায় পাঠানো হয়েছে। শত চেষ্টাও আটকানো গেলো না।যাইহোক এমনিতে আমার বাসা থেকে অফিসে পৌঁছাতে ৪৫ মিনিট লাগে,কিন্তু এই বৃষ্টি বাদলার দিনে গাড়ি না পাওয়া গেলে আমি কিভাবে যাবো,কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। আমি তো পথঘাটই ভালো ভাবে চিনি না।

এখন আর কিছুই করার নেই,অগত্যা হাটা দিলাম। হাটতে হাটতে অনেক দূরে চলে এসেছি। পাহাড়ি এলাকা বলে চারিদিকে গাছ আর জংগল। আমি হেটেই চলেছি। এবার মনে হচ্ছে মায়ের কথা না শুনে ভুলই করেছি,কি দরকার ছিলো এই অচেনা জায়গায় এই দূর্যোগের দিনে বের হওয়ার। কিন্তু এখন এসব ভেবে আর কাজ নেই। কথায় আছে-“ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া ভাবিও না”।ভুল তো করেই ফেলেছি, এখন আমার উদ্দেশ্য হলো একটা নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নেয়া। প্রকৃতি যেন আমার মনের কথা শুনেই আরো বৈরী রূপ ধারণ করলো। বৃষ্টি আরো কয়েক গুণ জোরে হতে লাগলো, আর সাথে বজ্র-বিদ্যুতের চমকানি তো আছে।

আমি একটু দ্রুত হাটার চেষ্টা করতে লাগলাম, এদিকে কোন ঘরবাড়ি নেই,বাসায় যে ফিরে যাবো,তারও উপায় নেই,আমি বাসা থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি। আরো কিছুদূর এগিয়ে যেতেই আমার চোখে পড়লো একটা গলির ভেতর গাছপালায় ঘেরা একটা বাড়ির প্রাচীর, এবার কিছুটা আশার সঞ্চার হলো আমার মনে। আমি সেই গলি দিয়ে বাড়িটার কাছে এগুতে লাগলাম। বাড়ির কাছে এসে আমি তো অবাক। এই পাহাড়ি অঞ্চলে যে এমন সুন্দর একটা অভিজাত বাড়ি থাকবে আমি ভাবতেও পারিনি। দেখে ইংরেজ ইংরেজদের বাংলো বাড়ির মতো লাগলো , কারণ হলো বাড়িটা কাঠের তৈরি,পুরনো হওয়ার কারণে এর জৌলুশ কিছুটা কমলেও মানুষকে আকর্ষণ করার ক্ষমতা একটুও কমেনি বাড়িটার।

আমি এই এতো বৃষ্টির মধ্যেও মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছি বাড়িটার দিকে। কেনো যেন এই বাড়িটা আমাকে প্রবল ভাবে আকর্ষণ করছে। আমি এবার বাড়ির ঠিক সামনে। দেখলাম যে বাড়ির সাথে লাগোয়া একটা ফুলের বাগান ছিলো, ফুলের বাগান ছিলো বলছি তার কারণ এই যে এখন আর ফুল বলতে কিছুই নেই।শুধু এই ঘেরা দেয়ার বেড়াটা খেয়াল করলেই বোঝা যাবে এটা ফুলের বাগান। আমি দেখলাম বাড়ির দরজা আটকানো আছে,কিন্তু বাইরে থেকে,এদিকে এই বৃষ্টি আরো বেড়েছে। এখন আকাশটা প্রায় অন্ধকার, আর বিদ্যুতের চমকানিতে কেমন যেন অদ্ভুতুড়ে পরিবেশের সৃষ্টি হচ্ছে।এখন এসব ভাবার সময় নেই, এখন আমার সমস্যা হলো এই মুহূর্তে বৃষ্টিতে বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব হয়ে গেছে আমার কাছে।

হঠাৎ দেখলাম যে এদিকে একটা লোক হেটে আসছে, সাহেবি পোশাক পড়া,চেহারাই বলে দিচ্ছে সে বাঙালী নয়, তারমানে এই বাড়ির মালিক এই লোকই হবে,বয়স কত হবে বুঝলাম না, তবে অদ্ভুত ব্যাপার এই যে এতো বৃষ্টি হচ্ছে তাতে ওনার কোনো খেয়ালই নেই,লোকটা শুধু স্যুট পরে আছে,বৃষ্টিতে ভেজা পুরো শরীর কিন্তু নির্বিকার ভাবে হেটে আসছে। এবার আমি উনার কাছে গিয়ে বললাম জনাব এই বাড়িটা কি আপনার? উত্তরে লোকটা আমার দিকে না তাকিয়ে বেশ সুন্দর করে বাংলাতে বললো-হ্যা আমারই। আমি বললাম আপনি এভাবে বৃষ্টিতে হাটছেন কেন?আপনি একেবারে ভিজে গেছেন? এবার তিনি যেন তার সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বুঝতে পারলেন যে বৃষ্টি হচ্ছে। উনি আমার দিকে তাকিয়ে অবাক করে দিয়ে বললেন আশ্রয় চাই? যেহেতু আমার সত্যি একটা নিরাপদ আশ্রয় দরকার,তাই আমি একবাক্যে স্বীকার করে নিলাম। বললাম – হ্যা। তিনি আমাকে বললেন আসুন আমার সাথে। আমি তাকে অনুসরণ করে চলতে থাকলাম।

ঘর খুলে তিনি আমাকে একটা রুমে নিয়ে আসলেন। তার কথা বলা আর আচরণে একটা বনেদী ভাব রয়েছে। আমাকে একটা সোফায় আসন গ্রহণ করতে বললেন,কিন্তু নিজে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন। আর নিজের হাত গুলো দোলাতে লাগলেন। আমি খেয়াল করলাম যে তার হাত কখনোই স্থির থাকছে না। এটা দেখে আমার কেমন অস্বস্তি হতে থাকলো, কিন্তু আমি প্রকাশ করলাম না। আমি রুমের ভেতরটা চোখ বুলিয়ে নিলাম। দেখলাম ঘরের মধ্যে বসার সোফাসেট ছাড়া আর কিছুই নেই,আমি বেশ অবাক হলাম,এতো সুন্দর বাড়িতে আসবাবপত্র নেই কেন। আর দেখলাম বিশাল জানালা, জানালার পাল্লা গুলো কাচের। মোট ৫ টা পাল্লা,আর সেগুলো আটকানো। সেই জানালা দিয়ে বাইরের বাগানের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়,আর ওই জানালা দিয়ে বাগানের দিকেই চেয়ে আছেন আমার আশ্রয়দাতা।

এবার নীরবতা ভাংতে আমি কথা বলে উঠলাম – জনাব আপনার নামটা কি জানতে পারি? সেই লোকটি বললো আমার নাম টমাস গডউইন।আমার পূর্বপুরুষ ইংল্যান্ড থেকে বাংলাদেশে এসে এই এই বাংলো বাড়িটি তৈরি করে, আমার পরিবারের সবাই বংশানুক্রমে এখানেই থেকেছে। উনি আমার নাম জিজ্ঞেস করলেন। আমি বললাম আমার নাম নাহিয়ান আহমেদ। আমি জিজ্ঞেস করলাম আপনি কি একাই এবাড়িতে থাকেন? তিনি বললেন -হ্যা। আপনি আসাতে আমার ভালই হয়েছে বলে কেমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকে পর্যবেক্ষণ করলেন।তিনি বললেন আমি আপনাকে যথাযথ আপ্যায়ন করতে পারলাম না,কিছু মনে করবেন না।

এবার তাকে আমি আমাকে আশ্রয় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ জানাতে আমার এক হাত তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। তিনিও তার হাত আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। তার হাত স্পর্শ করেই আমার সমস্ত শরীরে শীতল স্রোত বয়ে গেলো,তার হাত ছিলো বরফের মত ঠাণ্ডা। উনি আমার হাত ছাড়ছেন না। আমি হাত ধরে থাকা অবস্থায় বললাম আপনি ভিজে গেছেন, আপনার পোশাক পাল্টানো উচিৎ। উনি বললেন ভিজে গেছি না? মনে হল তিনি কেবল বুঝলেন যে তিনি ভেজা কাপড়ে দাঁড়িয়ে। আমি বললাম -হ্যা,আপনার পোশাক পরির্তন না করলে আপনি অসুস্থ হতে পারেন,কথা গুলো বলতে বলতে আমি হাত ছাড়িয়ে নিলাম। এখন,লোকটার আচরণ অদ্ভুত লাগছে আমার কাছে। লোকটা বললো ঘরে তো বৃষ্টি হচ্ছে না, তাই জামাকাপড় একাই শুকিয়ে যাবে। আমি আর কিছু বললাম না।

উনি হঠাৎ বলে বসলেন – আপনার কাছে কি এই বাড়িটা অদ্ভুত মনে হচ্ছে না? আমি উত্তর দিলাম বাড়িটা আমার কাছে আর পাচ টা ফাকা বাড়ির মতই লাগছে।তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন – আপনি কি বিশ্বাস করেন মৃত্যুর পরে কোনো স্বীকারোক্তি বা দোষ স্বীকার করে নিলে মানুষের পাপ মোচন হয়, আত্মার মুক্তি হয়? কেন এমন প্রশ্ন করলেন বুঝলাম না।আমি অবাক হয়ে গেলাম তার প্রশ্নে ,কারণ মৃত্যুর পরে তো পাপের ফল ভোগ করতেই হবে,আর মৃত্যুর পরে দোষ স্বীকার এটা আবার কেমন কথা, মৃত্যুর পরে তো মানুষ পৃথিবীতে ফিরে আসে না। তিনি করুণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমি তার করুণ মুখ দেখে বলে ফেললাম বিশ্বাস করি,কিন্তু এটা আমার মন থেকে বলা উত্তর ছিলো না,আমি বলতে চেয়েছিলাম করি না। লোকটা বললো আমি আজ আপনার কাছে গোপন একটা কথা বলবো যা কেউ জানে না।আপনি নিশ্চয় আমার কথা ধৈর্য ধরে শুনবেন। বলে তিনি কেমন হাসি দিলেন,আমার অস্বস্তি বেড়ে গেলো।

কিন্তু যতক্ষণ বৃষ্টি না কমে আমাকে এখানেই থাকতে হবে,তাই বাধ্য হয়ে আমি বললাম আপনি বলতে পারেন শুনবো। টমাস বলতে শুরু করলেন – এটা এক ভয়ানক গোপন কথা।আমার বাবা মা মারা যাওয়ার পরে আমার দেখাশোনার ভার আমার দাদু জোনাথন গডউইনের উপরেই পরে। আমার দাদি অনেক আগেই মারা গেছেন। তাই এই বাড়িতে লোক বলতে আমি আর আমার দাদু। আমার দাদু এই রুমে বসেই আহার করতেন। আর ওই যে পাচ পাল্লার বড় জানালা দেখছেন ওটার দিকে তাকাতেন খাওয়ার মাঝেমাঝে, সেখানে ৫ টা পাল্লায় ৫ টি ছায়া ছায়া পড়তো তার। তিনি জানার দিকে তাকিয়ে যা করতেন স্বাভাবিক ভাবে ওই ছায়াগুলোও তাই করতো,আর বিষয় টা দাদু খুব উপভোগ করতো,অনেক ছোট বেলা থেকেই আমার নজরে পড়েছিল বিষয়টা।

এই কথা কেন বলছি তা একটু পরেই বুঝতে পারবেন।দাদু আমার ওপর সন্তুষ্ট ছিলেন না তার ধারণা ছিলো আমার বাবা মায়ের মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী ,আমি তার সামনে গেলেই আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করতেন। প্রতিদিন এই তুচ্ছ তাচ্ছিল সহ্য হত না। তিনি আমার সাথে বাড়ির কাজের লোকের থেকেও খারাপ ব্যবহার করতেন। তাই আমি পারতপক্ষে তার সামনে খুব একটা আসতে চাইতাম না।একদিন আমার মনে হল এটা আর চলতে দেয়া যাবে না। দাদুর হার্টের অসুখ ছিলো। একদিন সন্ধ্যায় আমার দাদু বই পড়ছেন আর মাঝেমাঝে জানালার কাচের দিকে তাকাচ্ছেন। এটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিলো,জানালার সামনে বসে যাই করবেন না কেন, তারই ছায়া জানালার কাচে দেখবেন। তিনি দেখলেন যে জানালার প্রতিটি কাচে তার নিজের প্রতিবিম্ব, তিনি যা করছে সেই ছায়া গুলোও তাই করছে,তিনি বই বন্ধ করে একটা পাইপ ধরালেন আর জানালার দিকে তাকালেন, তিনি দেখলেন যে সব ছায়াগুলো তারমত করলেও একটি ছায়া করছে না। তিনি আতংকিত হলেন। সেই ছায়াটি তারমতোই দেখতে কিন্তু ছায়াটি বই বন্ধ করে পাইপ ধরায়নি বরং বই পড়ে যাচ্ছে মনোযোগ দিয়ে। পর পর ৫ দিন আমার দাদু এটা দেখলেন। একটা ছায়া তার অনুকরণ করে না,কিন্তু বাকি গুলো করে। ৬ষ্ঠ দিন সেই ঘটনা আবার ঘটলো, তিনি ভয়ার্ত ভাবে তার চোখ সরিয়ে নিলেন কাচের জানালা থেকে,আর চোখ সরানোর সময় দেখলেন বাকি চারটি ছায়াও চোখ সরিয়ে নিচ্ছে, ৫ম ছায়াটির দিকে তাকালেন না ভয়ে।

দাদুর নিচের দিকে তাকিয়ে বসে রইলেন, কিন্তু দাদু যদি খেয়াল করতেন তাহলে দেখতে পেতেন যে সব গুলো ছায়া তারমত করেই নিচের দিকে তাকিয়ে বসে আছে,এবার কোন ব্যতিক্রম নেই। হঠাৎ তিনি তার গলায় দুটো হাতের স্পর্শ পেলেন। তিনি ঘার ঘুরিয়ে দেখলেন তারই মতো দেখতে একজন দাঁড়িয়ে আছে।কিন্তু সেই ব্যক্তি দাদুকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দাদুকে গলা টিপে হত্যা করে ফেললো। এবার টমাস থামলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম এই ঘটনা আপনি কিভাবে জানলেন যে আপনার দাদু ছায়া দেখে ভয় পেতো? আপনার সাথে কি আপনার দাদু এই বিষয়ে কথা কথা বলেছিল? টমাস বলল- না বলেনি। দাদু তার কোন ব্যক্তিগত বিষয় আমাকে বলতেন না।কিন্তু আমি জানি। আমি বললাম কিভাবে জানলেন? টমাস বললো- কারণ দাদুকে যে ব্যক্তি খুন করেছে সেই ব্যক্তি টা হলাম আমি।এটাই চরম ভয়ংকর গোপন কথা। আপনাকে বলা হয়নি আমার দাদু আর আমার চেহারা ছিলো হবুহু একই রকম।আমি দাদুর হার্টের অসুখের সুযোগ নেই। দাদুকে ভয় দেখানো শুরু করি। দাদু আর আমি দেখতে একই রকম হওয়ায় দাদুর ছায়া সাজতে আমার কোন অসুবিধা হয়নি। আমি শেষ দিনে দাদু যখন চূড়ান্ত পর্যায়ের ভয় পায় সেইদিন দাদুকে খুন করি।কেউ আমাকে সন্দেহ করবেনা জানতাম।সবাই জানতো আমি ওই সময় কোনদিনই বারিতে থাকি না।

কিন্তু আমি ওই ৬ দিন বাড়িতেই লুকিয়ে ছিলাম।দাদুকে খুন করে আমি বাড়ি থেকে চলে যাই,জায়গাটা নির্জন বলে আমাকে কেউ পালাতে দেখেনি। টমাসের উত্তরে আমি রীতিমত অবাক হলাম কোন কথা বলতে পারলাম না,পিছিয়ে যেতে লাগলাম। টমাস বললো-ভয় পাবেন না,আমি আপনার ক্ষতি করবো না। আমি তো মরে গেছি। আমি মৃত। আমি এতো দিন অপেক্ষায় ছিলাম, এই বাড়িতে কেউ আসবে আমি তার কাছে আমার দোষ স্বীকার করে নেবো, আর আমার আত্মার মুক্তি ঘটবে।আমি সফল,আমর আত্মা মুক্ত। এই কথা বলে মুখে সুন্দর হাসি ফুটিয়ে টমাসের আত্মা হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। টমাসের কাছে আমার একটা প্রশ্ন ছিলো করার আগেই সে চলে গেলো। আমি এখন এই ঘরে একা। আর সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হলো টমাস সাহেবের আত্মা চলে যাওয়ার সাথেসাথে প্রকৃতি শান্ত হয়ে এসেছে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আমি বাংলো থেকে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসলাম। বৃষ্টিও নেই। আমি টমাস গডউইনের আত্মার শান্তি কামনা করতে করতে ওই বাড়ির সীমানা পেরিয়ে রাস্তায় চলে আসলাম। আসার সাথে সাথেই রিক্সা পেলাম। সরাসরি বাড়ি চলে গেলাম। মা দরজা খুলে দিলো, আমার অফিসের কথা মনেই ছিলো না,মায়ের কথায় মনে পড়লো, মা বললো- কি রে খোকা যেতে পেরেছিলি অফিসে?আমি বললাম এসব এখন থাক মা, আমি অফিসের বস কে ফোন করতেই তিনি বললেন অফিসে তো আমাকে ডাকা হয়নি।

শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম,এ কি করে সম্ভব। তবে আজ যা হলো সব টমাস গডউনের আত্মার ইচ্ছেয়?সে মুক্তি পেতে চেয়েছিলো বলেই কি আমাকে ওই বাড়িতে নিয়ে গেছে? এর উত্তর আমার জানা নেই।যে নাম্বার থেকে ফোন এসেছিলো সেই নাম্বারটা অনেক খোজার পরেও ফোনে পেলাম না,একেই কি তাহলে অলৌকিকতা বলে? এসব ভাবছি মা খেতে ডাকলো,কিন্তু রাতে আর খেলাম না। আমার মনে অনেক গুলো প্রশ্ন,আচ্ছা টমাসের কি হয়েছিলো?

ও কি ওর দাদুকে হত্যার পরে বাংলো বাড়িতে এসেছিলো?ও কিভাবে মারা গেল? স্বাভাবিভাবে নাকি অপঘাতে?আমি আর ভাবতে পারলাম না।কখন যেন ঘুমিয়ে গেছি।সকালে ঘুম ভাঙার পরে গেলাম এই এলাকায় আমার একমাত্র পুলিশ বন্ধু অভ্র এর কাছে। ওর কাছে জানতে চাইলাম ওই বাড়ি নিয়ে।সব খুলে বললাম ওকে। ও সব শুনে বললো ওই ঘটনার পরের দিন পুলিশ ওই বাড়িতে জোনাথন নামের এক ব্যক্তির লাশ পায়। কোন এক অজ্ঞাত ব্যক্তি লাশের খবর জানায়। সে কে তা জানা যায়নি।ওই বাড়ি এখন পরিত্যক্ত, ওদিকে কেউ যায় না। আর সবথেকে অদ্ভুত ব্যাপার এই ঘটনার পরে জোনাথন এর নাতি টমাসকে আর কখনো দেখা যায়নি। আমি এখন বসে আছি ওই বাংলোর সেই ঘরে যদি টমাসের আত্মা আবার আসে এই আশায়। আমি যে ওর মৃত্যুর কারণ জানি না।আমাকে জানতেই হবে কারণটা। আমি এই বাড়িতে তাই রোজ একবার আসি টমাসের আত্মার খোঁজে। কিন্তু মুক্ত আত্মা ফিরবে কি?

…………………………………………………………………..সমাপ্ত………………………………………………………….

গল্পের বিষয়:
ফ্যান্টাসি
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত