এক.
“পাছাতে বানরের হাড্ডি না থাকলে এমনটা করে না কেউ,” বিরক্ত হয়ে বলল সাব্বির। চোখ দিয়ে আগুন ঝরছে।
ওর দিকে তাকিয়ে দুঃখের হাসি হাসল মেগান, “ছেড়ে দাও। ছ্যাচড়া লোকে দেশটা ভরে গেছে।”
ছ্যাচড়া লোকদের ওপর ক্ষোভ মেটাতেই কি না কে জানে, গায়ের জোরে সিগারেট টানল সাব্বির। দিনকাল খারাপ। তরুণ প্রজন্মের জন্য দিনকাল আরও বেশি খারাপ। সাথে তরুণী থাকলে দিনকাল এখন শুধু খারাপ না, রীতিমত ভয়ঙ্কর। তাছাড়া মেগান ঠিক বাঙালী পোশাক-আশাকের ধার ধারে না। উটকো লোকজন এরকম মেয়েদের সামনে ঝামেলা করার সুযোগ কোনদিনই ছাড়েনি।
রেস্তোরাঁতে খেয়ে বেরোচ্ছিল তারা। তিনজন পাংকু যুবকের সাথে মেগানের ধাক্কা লেগে গেছিল। ধাক্কা লেগে গেছিল বলার চেয়ে তারা ধাক্কা দিয়েছিল বলাটাই বেশি যৌক্তিক। বেচারি ছিটকে ফুটপাতে পড়ে গিয়েছিল একদম। যে তরুণ ধাক্কা দেওয়ার ছলে ওর শরীরে হাত বুলিয়ে দিয়েছিল, তাকেই দেখা গেল বীরদর্পে ভ্যানিটি ব্যাগটা তুলে আনতে।
বলল, “সরি আপু।”
পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে উঠেছিল সাব্বিরের। সরাসরি গিয়ে চার্জ করেছিল তাকে। কিন্তু তারা তিনজনই বা পিছিয়ে যাবে কেন। রীতিমত হৈ-হট্টগোল লাগিয়ে দিয়েছিল। সবগুলো চুল জেল মেরে ‘খাড়া’ করিয়ে রাখা ছোকরা বলেছিল, “সুন্দরী মেয়ে নিয়ে হাঁটার সময় তো রাস্তা দেখ না। ফিগারের ওপর চোখ থাকলে দেখবেই বা কি করে?”
আরেকজন পাংকু সাথে সাথে বড় ভাইয়ের ভূমিকা নিয়ে ফেলেছিল, “ওই মিয়া, ওই! মাইয়া কি লাগে তোমার? থাকো কোথায় তোমরা? বাসা কোনটা?”
এই পাংকুর হাতে বাঁধা ব্যান্ডেজ। মানুষ পিটিয়ে ভালোই অভ্যস্ত, একনজর দেখেই যে কেউ বলে দেবে।
অবস্থা বোঝা হয়ে গেছিল সাব্বিরের। এলাকার পোলাপান। একদম সিলেবাস মেনে চলছে। প্রথমে ইস্যু বানাবে, তারপর ফাঁপড় নেবে। সবশেষে ছেলে আর মেয়েকে আলাদা করে ফেলবে। ছেলের কপালে রাম-প্যাদানী জুটবে। মেয়ে চলে যাবে হোটেল রুমে। তবে একা নয়। এলাকার ছেলেপুলেদের একটা গ্রুপ যাবে তার সাথে। ভর সন্ধ্যাবেলাতে এরকমটা দেদারসে হচ্ছে।
কথা না বাড়িয়ে ফুঁসতে-ফুঁসতে সরে এসেছে ওরা। কিছুদূর এসেই একটা সিগারেট ধরিয়েছে সাব্বির। মেজাজ খারাপ থাকলে ঘন-ঘন সিগারেট খাওয়া হয় তার।
“প্ল্যান মত সব করেছ তো? হোটেলের ব্যাপারে তো কিছু বললে না ভেতরে।”
মেগানের দিকে তাকিয়ে রাগ অর্ধেক হয়ে গেল সাব্বিরের। সেজেছে মেয়েটা। এমনিতেই ববকাট চুলে অসম্ভব সুন্দর লাগে তাকে। এখন সেই চুলের এক গোছা আবার মুখের ওপর এসে পড়েছে। চোখ ফেরানো যাচ্ছে না।
অজান্তেই এক চিলতে হাসি ফুটল ওর মুখে। “সবকিছু ঠিক আছে। মহেশখালির রিসোর্ট এখন ভর্তি হয়ে আছে। না হলে সরাসরি ওখানেই চলে যেতাম।”
“সেটা আগেই বলেছ। আমি বুঝেছি ঝামেলাটা। কিন্তু হোটেল নিয়ে আবার সমস্যা করে বস না। একেবারেই ভেগে গেছি কিন্তু আমি।”
ওর হাতব্যাগের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মনে পড়ল সাব্বিরের, “দেখেছ? হারামজাদাগুলোর জন্য ভুলতে বসেছিলাম। তোমার তো কেনাকাটা করতে হবে।”
“যাবো। সময়ের খুব অভাব নাকি আমাদের?”
“তা না। তবে সময় নষ্ট করে পরে পস্তাতে চাই না। ভুলে যাচ্ছ, আজকের রাতটা শুধু আমাদের?”
শয়তানি হাসি দিচ্ছে সাব্বির। সেদিকে তাকিয়ে লাজুক হয়ে গেল মেগান। উঠে দাঁড়াল, “হয়েছে। চল তাহলে। তোমার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে একবার ফার্মেসীতেও ঢুঁ মারতে হবে ফেরার পথে।”
জবাব দিল না সাব্বির। তার কোলে ছিটকে পড়েছে একটা কিছু। খুবই ছোট। দুই আঙুলে ধরা যায় এমন। আলতো করে সেটা ধরে তুলল ও। চোখের সামনে এনে দেখল।
“এটা তোমার?”
দুই পাশে মাথা নাড়ল মেগান, “না তো। আমার মেমরি কার্ড আমার ফোনের মধ্যেই আছে।”
কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল সাব্বির ওটার দিকে। ওর কোলে আসলো কোথা থেকে? ওপরে তাকিয়ে রাতের কালো আকাশ ছাড়া আর কিছু দেখতে পেল না। ওপর থেকে পড়ার প্রশ্নই আসে না।
“তোমারই হবে। তোমার তো আবার বুক-পকেটে জিনিসপাতি রাখার অভ্যাস। গোল্ডফিশ একটা!”
হাল্কা হাসল সাব্বির। বুক-পকেটে ঢুকিয়ে রাখল মেমরি কার্ডটাকে। উঠে দাঁড়াল সে। “চলো। আর ফার্মেসীতে যেতে হবে না। ও জিনিস আমার সাথেই আছে।”
দুই.
হোটেল আভাটিয়াতে উঠেছে ওরা দুইজন। শপিং শেষে রুমে ফিরে এসে দুইজনই ক্লান্ত। কফির অর্ডার দিয়েছে নিচে। তারপর কাপড় ছেড়ে মেগান অ্যাটাচড বাথে ঢুকে গেছে। গোসল করবে। পাতলা একটা গেঞ্জি পরে সাব্বির ল্যাপটপের সামনে বসে আছে। ডাটা কেবলের সাথে মোবাইল লাগানো। স্ক্রিনের দিকে মনোযোগ নেই। মনোযোগ পড়ে আছে অ্যাটাচড বাথের ভেতরে।
অন্তর্বাস ছাড়া আর কিছু না পরেই মেগান বাথরুমে গিয়েছে। বের হওয়ার সময় সেটুকুও থাকবে না। তারপর এই ডাবল-রূমের উপযুক্ত ব্যবহার করা হবে। বিছানাপত্র গোছানো হয়ে গেছে। অগোছালো করার কাজটুকু বাকি।
বাসা-বাড়ি ছেড়ে হোটেলবাসী হওয়ার কারণ আছে। সাব্বিরের বাবা ফিরোজ মাহমুদ প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। মেগানের বাবা ধর্মযাজক। ফিরোজ সাহেব ধনাঢ্য এবং সব ধনাঢ্য ব্যক্তিত্বের মতই তিনি উদারমনা। তবে সব ক্ষেত্রে নয়। ছেলের জীবন কতটুকু লাগামছাড়া হতে পারবে তা তিনিই ঠিক করে দেন।
খ্রিস্টান একটা মেয়েকে বিয়ে করা পর্যন্ত লাগামছাড়া হওয়ার দিকে তাঁর অনুমতি নেই। মেয়েকে ছেলের পছন্দ হয়েছে তা বেশ। তিনি তরুণ বয়েসের গরম রক্তের ব্যাপারটা বোঝেন। একুশ বছর বয়েসে ভার্সিটির ম্যামকে বাথরুমে আটকে রেখে কি বলাৎকার তিনি করেননি? করেছেন।
ছেলেকে বাথরুমে যেতে হবে কেন? অসংখ্য হোটেল আছে। একটাতে উঠে পড়লেই তো পারে। কয়েকদিন মৌজমাস্তি করে মেয়েটাকে লাখ-দশেক টাকা ধরিয়ে দিয়ে রাস্তা মাপতে বলবে। কেস খতম। টাকা তো কোন সমস্যা না। তা না, ছেলে হয়েছে মহাপুরুষ। পৌরুষত্ব বাঁচিয়ে চলেছে। তখনই তিনি সন্দেহ করেছিলেন, এ ছেলে বংশের নাম ডোবাবে।
আধ-ন্যাংটো মেয়েকে বউমা হিসেবে মেনে নিতে তাঁর সমস্যা নেই। সমস্যা হল, ছেলের বান্ধবী মেয়েটা আধ-ন্যাংটো খ্রিস্টান। ব্যবসায়িক মহলে এই মেয়েকে পুত্রবধূ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাবে না। লোকজন আড়ালে হাসবে। আড়ালে হাসতেই পারে। নিজের চরিত্র রীতিমত পাখা লাগানো হলেও তাঁর গেটআপ আরব শেখের মত। লোকজন ডাকে সুফী সাহেব। সুফী সাহেবের পুত্রবধু হতে হলে কিছু যোগ্যতা থাকা লাগে। মেগানের মধ্যে ওসব কিছু নেই।
বাবাকে টাইট দেওয়ার উপায় সাব্বির বের করে রেখেছিল। কিন্তু তাতে করে সমস্যার অর্ধেকটা মিটবে। মেগানের বাবার দিকটা দেখা হবে না। নিকোলাস সানতানা পেশাতে পাদ্রী নন শুধু, মনেপ্রাণেও তাই। পাদ্রীর মেয়ে ধর্মের দিকে টুকটাক ঝুঁকবে এটাই বাবারা আশা করে। তা না করে মেয়ে পছন্দ করেছে এক মুসলিম ছেলেকে।
মেয়েরই বা কি দোষ? পোড়া দেশে খ্রিস্টান ছেলের আসলেই আকাল পড়েছে। যেদিকে তাকানো যায় মুসলিম। এর মধ্যে ঝাঁ চকচকে এক মুসলিম যদি বংশমর্যাদা আর টাকার জোর দেখিয়ে মেয়েকে পটিয়ে ফেলে তাতে আশ্চর্যের কি আছে? আজীবনই এদের শত্রুপক্ষ মনে করেছেন নিকোলাস। মহান পিতা জিসাস ক্রাইস্টের সন্তান তারাও, অথচ সেটুকু পর্যন্ত স্বীকার করতে চাইবে না। চার্চ-টার্চকে পাত্তা দেয় না এরা, উপহাস করার বেলাতে আছে। তাদের ঘরে ঢুকবে তাঁর মেয়ে? জীবন থাকতে না।
একই দিনে সাব্বির আর মেগান তাদের বাবাদের সাথে কথা বলেছিল। নিজেদের প্রেমের সম্পর্কটাকে ব্যাখ্যা করতে।
ফিরোজ সাহেব সাথে-সাথে এক প্রাইভেট ইন্সভেসটিগেটরকে ফোন লাগিয়েছেন। নিকোলাস সাহেব ফোন লাগিয়েছেন তাঁর পুলিশ কমিশনার বন্ধুকে।
বাবার স্টাডি রুম ঘেঁটে রাত-বিরেতে প্রাইভেট ইনভেসটিগেটর ব্যাটার ফোন নম্বর উদ্ধার করেছে সাব্বির। তারপর তাকে পাকড়াও করে ডাবল টাকা ঘুষে দিয়েছে। সময় চেয়েছে একদিন। সাবধানের মার না রেখে পাল্টা এক প্রাইভেট ইন্সভেসটিগেটর হায়ার করে বাবার গোয়েন্দার পেছনে তাকে লেলিয়ে দিয়েছে। গোয়েন্দার পেছনে গোয়েন্দা ঘুরবে। করুক এখন গোয়েন্দাগিরি!
মেগানের বাবার সোর্স এত সহজ কিছু না। এদেশের পুলিশ কাজের না হলেও কমিশনার দোস্ত থাকলে তারা কাজের। শত-শত পুলিশকে ঘুষ গেলানো মেগানের কাজ না। কাজেই ওই একদিন সময়টাকে কাজে লাগাচ্ছে তারা। কাল সকাল পর্যন্ত বাইরে পালিয়ে থাকতে হবে। এরপর সোজা মহেশখালী নামক এক দ্বীপে। বঙ্গোপসাগরের বুকে ভেসে থাকা এক দ্বীপ। তার মধ্যে আছে রিসোর্টটা। বন্ধু নাফিস সেখানকার কেয়ারটেকার থেকে মালীর দায়িত্ব পালন করে। একাই একশ। একটা রুম বন্দোবস্ত হয়ে গেল।
পালানোর সময় মেগান আর সাব্বিরকে খালি হাতে পালাতে হল। নাহলে সাব্বিরের দারোয়ান যে ঘুঘু, মিনিট দশেকের মধ্যে বাবার কানে পৌঁছে যেত খবরটা। তারপর আধ-ঘণ্টার মধ্যেই একদল পুলিশ এসে শিল্পপতির ছেলেকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেত। মেগানের ক্ষেত্রেও কথাটা খাটে। কাজেই শপিংমল ঢুঁড়ে-ঢুঁড়ে জামাকাপড় থেকে টুথপেস্টটা পর্যন্ত কিনতে হল ওদের। বড়-বড় ট্রাভেল ব্যাগও।
“অ্যাবোর্ট! অ্যাবোর্ট! অ্যাবোর্ট!”
ভ্রু কুঁচকে ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকাল সাব্বির। ব্যাপারটা আবারও শুরু হয়েছে! এবার তার ল্যাপটপ স্ক্রিনে!
তিন.
আড়চোখে একবার বাথরুমের দরজার দিকে তাকাল সাব্বির। ভেতর থেকে মেগানের নগ্ন শরীরটা যে কোন সময় বের হয়ে আসবে। তবে তা নিয়ে এখন আর ভাবছে না সে। ল্যাপটপের দিকে আবার তাকাল। সরে যায়নি। পুরো স্ক্রিনজুড়ে ক্রস চিহ্নটা থেকে গেছে। স্পীকার থেকে অনবরত একটা শব্দই বের হচ্ছে।
অ্যাবোর্ট! অ্যাবোর্ট!
অদ্ভুত উচ্চারণভঙ্গি। অনেকটা ‘আর্বোট আর্বোট’ জাতীয়।
এমনটাই হয়েছিল মাঝে একবার। অদ্ভুত ধরণের মেমরি কার্ডটা মোবাইলে ঢুকিয়েছিল তখন। শপিং কমপ্লেক্সেই ডিনার সারতে বসেছিল ওরা দুইজন। মেমরি কার্ডটা পরীক্ষা করে দেখার জন্য সেখানেই নিজের ফোনে ঢোকায় সাব্বির। সাথে-সাথে স্ক্রিনে ক্রস চিহ্ন ফুটে ওঠাতে ভয় পেয়ে গেছিল। মোবাইলটা নতুন। ভাইরাসে ধরলে সমস্যা। এমনিতেই গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ভেগে যাচ্ছে, নতুন কোন উৎপাতের দরকার নেই। তাই তখনকার মত মেমরি কার্ডটা খুলে রেখেছিল।
হোটেল রুমে এসেও একই ঘটনা ঘটছে দেখে অবাক না হয়ে পারল না। ক্রস চিহ্নটা পরীক্ষা করে দেখার জন্য মনিটরের কাছে চোখ নিয়ে এসেছে, প্রায় সাথে সাথে কালো হয়ে গেল ল্যাপটপ স্ক্রিন।
তারপর দুপ করে নিভে গেল হোটেল রুমের প্রতিটা আলো। বাথরুমের ভেতরে মেগানের হুম-হাম করে মৃদু কণ্ঠে করা গান বন্ধ হয়ে গেল।
মিষ্টি কণ্ঠটা একবার ডাকল, “সাব্বির?”
তারপর সেদিক থেকেও কোন সাড়াশব্দ নেই। গলা চড়িয়ে জবাব দিল ও, “লোডশেডিং, মেগান। জেনারেটর চালু হয়ে যাবে যে কোন সময়।”
জেনারেটর চালু হয়ে গেছে। মৃদু ঘরঘর শব্দ হচ্ছে নিচের কোথাও থেকে। আলো ফিরে এসেছে ঘরে। আগের মত উজ্জ্বল নয়। কেমন যেন মিটমিটে। ল্যাপটপ এখনও বন্ধ। মনে করার চেষ্টা করতে থাকে সাব্বির, আগে ল্যাপটপ স্ক্রিন বন্ধ হয়েছিল? নাকি লোডশেডিংয়ের সাথে সাথে বন্ধ হয়েছিল ল্যাপটপ? লোডশেডিং হলেই বা ওটা বন্ধ হবে কেন? ব্যাটারিতে ভালোই চার্জ ছিল।
পাওয়ার সুইচ চেপে ওটাকে অন করার চেষ্টা করতে থাকল সাব্বির। কাজ হল না খুব একটা। চার্জার লাগানো আছে। কিন্তু ল্যাপটপ অন হচ্ছে না। ঠিক ভয় না, কিন্তু অদ্ভুত এক ধরণের অস্বস্তি চেপে ধরল ওকে ওখানে। হঠাতই খেয়াল করেছে, বাথরুমের শাওয়ারের শব্দ থেমে গেছে।
“মেগান?”
কোন সাড়া নেই। পুরোনো আমলের একটা করে গ্র্যান্ডফাদার ক্লক থাকে এদের প্রতিটা রুমে। সেটা টিক-টিক শব্দ করছে। ঘরের একমাত্র শব্দ।
খাট থেকে নেমে গেল সাব্বির। বাথরুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, “মেগান!”
বিছানার ওপর থেকে মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। চিৎকার করে বাজছে ওটা। কানে খুব চাপ ফেলছে অদ্ভুত নিস্তব্ধতায়। মোবাইল হাতে নিয়ে থমকে গেল সাব্বির। ডাটা কেবলের সাথে ল্যাপটপে সংযোগ দিয়েছিল ও। এখন সংযোগ নেই। খুলল কিভাবে?
ডিসপ্লেতে ভেসে আছে আননোন নাম্বার। ইতস্তত করে রিসিভ করল ও।
“আর বোট।” পরিচিত একটা কণ্ঠ উচ্চারণ করল অন্যপাশ থেকে। “ফোর সিক্স নাইন জিরো।”
“হোয়াট দ্য…”
“ফোর সিক্স নাইন জিরো?”
“হু দ্য হেল আর ইউ!”
“আর বোট। নাইটস্ট্যান্ডের কাছে যাও।”
বিছানার পাশে ছোট্ট একটা টেবিল। নাইটস্ট্যান্ড। সব হোটেলরুমেই এটা কমন জিনিস। টেলিফোন দেয় অনেকে ওটার ওপর। তাছাড়াও মোবাইল, চাবি, মানিব্যাগ এসব দরকারি জিনিস নাইটস্ট্যান্ডের ড্রয়ারে রেখে দেওয়া যায়। হাতের কাছে থাকে সবকিছু। কাজের আসবাব। সন্দেহের চোখে নাইটস্ট্যান্ডের দিকে তাকিয়ে আছে সাব্বির।
“নিচের ড্রয়ারটা খুলে দেখো। একটা পিস্তল আছে ওখানে।”
“হোয়াট?” এবার রীতিমত আর্তনাদ করে উঠল সাব্বির।
“ওপেন ইট।”
মন্ত্রমুগ্ধের মত ড্রয়ারটা খুলল ও। চকচকে একটা পিস্তল আসলেই শুয়ে আছে সেখানে। কি আশ্চর্য! এটা এল কখন? আগে থেকেই ছিল এমনটা সম্ভব না। এখানে ওর পোর্টেবল হার্ডডিস্কটা রেখেছিল। ভেতরেই আছে ওটা। পিস্তলের পাশে। পোর্টেবলটা রাখার সময় পিস্তল ছিল না, পরিষ্কার মনে আছে ওর। কি হচ্ছে এগুলো ওর সাথে?
“বেরসা থান্ডার। থার্টি এইট ক্যালিবার। বাস্তবই এটা। তুলে নাও দ্রুত।”
পুরো দুই সেকেন্ড পিস্তলটার দিকে তাকিয়ে থাকল সাব্বির। নাক কুঁচকে গেছে, “নো ওয়ে। প্রথমতঃ এরকম ফালতু চেহারার পিস্তল ধরার কোন সখ নাই আমার। দ্বিতীয়তঃ তোমার মার্ডার উইপনে আমার হাতে এভিডেন্স ফেলতে চাইছো তো? তা হবে না। তুমি আমার কোন শালাবাবু লাগো না যে প্রতিটা কথাই আমাকে ‘ইয়েস স্যার’ বলে শুনতে হবে। ফোনটা আমি ছেড়ে দিচ্ছি।”
“ফোনটা ছেড়ে দেওয়ার আগে বাথরুমে মাথাটা সেঁধিয়ে আসার সুমতি হোক তোমার। জন্মদিনের পোশাক পরে তোমার গার্লফ্রেন্ড ওখানে আছে কি?”
থমকে গেল সাব্বির। এই লোক এতকিছু কি করে জানে?
“ভাবছ এত কিছু কি করে জানি? ভেবে দেখো, সবকিছুর ব্যাখ্যা কি আমার গলাই দিচ্ছে না? আমার তো জানার কথা ছিলই। না জানলেই বরং অবাক হওয়া উচিত ছিল তোমার।”
ফোনের অন্যপাশের কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছে না এখন সাব্বির। ছুটে গেছে অ্যাটাচড বাথের দিকে। নব ঘোরাতেই খুলে গেল দরজা। মেগান কি দরজা বন্ধ না করেই ঢুকেছিল? হতে পারে। অ্যাটাচ বাথে ঢোকার দরজা একটাই। সেটা আছে তাদের রুমের ভেতরে। বয়ফ্রেন্ড বসে আছে সেখানে। দরজাতে তালা দেওয়ার কোন কারণ মেগানের ছিল না।
ভেতরে সাদা রঙের ব্রা আর পেন্টি সাজানো আছে দেওয়ালের র্যাকে। শাওয়ার বন্ধ করা। মেগানের শরীরের গন্ধ এখনও ভেসে বেড়াচ্ছে মাঝারি আকারের বাথরুম জুড়ে।
শুধু মেগান নেই এখানে।
“কি চান আপনি আমার কাছে? মেগান কোথায়?” অজান্তেই ছিটকে বাক্য-দুটো বের হয়ে আসল সাব্বিরের গলা থেকে। কানে ফোন চেপে ধরেছে।
“কি চাইছি সেটা তো বোঝা সহজ। নাইটস্ট্যান্ডের ভেতর থেকে পিস্তলটা তুলে এনে তিনজনকে গুলি করবে তুমি। নাহলে মেগানের সাথে দারুণ একটা সময় কাটাবো আমি। সময়টা পুরোপুরি উপভোগ করবে মেয়েটা। নিজে থেকেই সহযোগিতা করবে আমাকে ওসব করতে। কেন, তা তো বুঝতেই পারছ?”
স্তব্ধ হয়ে গেছে সাব্বির। বুঝতে না পারার কোন কারণ নেই। ফোনের অন্যপ্রান্তের গলাটা সাব্বিরের খুব পরিচিত।
ওর নিজের কণ্ঠ ওটা।
চার.
কোমরের কাছে পিস্তল গুঁজে ঘরটা থেকে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে সাব্বির। গত তিন মিনিট ধরে তাকে ফোনের মাধ্যমেই পিস্তলটা চালানো শেখানো হয়েছে। ওপরের ড্রয়ার থেকে চারটা ম্যাগাজিন বের হয়ে এসেছে। ব্যবহৃত ম্যাগাজিন কিভাবে রিলিজ করতে হবে এবং তারপরে সেগুলো কিভাবে ঢোকাতে হবে, পরিষ্কার কণ্ঠে শিখিয়েছে কণ্ঠটা।
“ইউ আর রেডি টু রোল।” অবশেষে বলল কণ্ঠটা।
“ফোনে কথা বলতে বলতেই যাবো?” জানতে চাইল সাব্বির।
“অবশ্যই। তোমাকে কি আমি টার্গেটের নাম ঠিকানা নিয়ে কিছু বলেছি এখনও?”
ঠুক-ঠুক শব্দ হচ্ছে দরজার কাছে। বাতাসের বেগে সেদিকে ঘুরে গেল সাব্বির। কোমর থেকে আরেকটু হলেই বের করে এনেছিল পিস্তল।
“রিল্যাক্স!” মৃদু ধমক দিল ফোনের অন্যপাশের সাব্বিরের কণ্ঠ, যেন দেখতে পাচ্ছে তাকে।
“রুম সার্ভিস।” বাইরে থেকে হেঁড়ে গলাতে চেঁচাল কেউ একজন, “আপনাদের কফি।”
“হি ইজ ওকে।” দ্রুত বলল সাব্বির, “কফি আনতে বলেছিলাম আমি একটু আগে।”
“হি ইজ নট ওকে।” এতটুকুই বলল ফোনের অন্যপাশের লোকটা।
“ভেতরে আসো, রুম সার্ভিস।” চেঁচাল সাব্বিরও।
পুরোনো কায়দার জামা পরেছে লোকটা। ওভারকোট আর সাদা শার্ট। হাতে একটা লম্বা ট্রে। হেহে-জাতীয় ভঙ্গি ধরে আছে মুখে। চিরায়ত আন্তর্জাতিক রুম-সার্ভিস ভঙ্গি। পরিষ্কার মোসায়েবী একটা ছাপ ফুটে আছে তাতে।
“দাঁত না কেলিয়ে টেবিলের ওপর ট্রে-টা নামিয়ে রাখো।” বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল সাব্বির।
“শুট হিম।” ফোনের অন্যপাশ থেকে বলা হল ওকে।
“হোয়াট!” একরকম চেঁচিয়ে উঠেছে এবার সাব্বির।
“জ্বি স্যার?” হাবাগোবার মত চেহারাটা সাব্বিরের দিকে ঘুরিয়ে জানতে চাইল রুম সার্ভিস।
“শাট আপ। টেবিলে ট্রে রাখো তুমি।”
“শুট হিম। কাম অন, রুম সার্ভিসের কণ্ঠ কখনও এত ডাকাত-মার্কা হয় না।”
চাঁদি গরম হয়ে গেল সাব্বিরের, “গ্রেট! এখন কণ্ঠস্বর শুনেই লোকজনকে আমি-” বলতে চাইছিল “গুলি করব?” কিন্তু বলতে পারল না। সামনে রুম সার্ভিস টেবিলে ট্রে রাখছে।
“না, কণ্ঠস্বর শুনে না। রুম সার্ভিসকে তুমি এখন গুলি করবে কারণ আমি করতে বলেছি। ওকে? ট্রাস্ট মি, এর মধ্য দিয়ে তোমাকে যেতেই হবে। আমাকেও যেতে হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, মেগান এখন আমার রুমে। আমার প্রতিটা বাক্য মেনে চললে আনটাচড অবস্থাতে তাকে ফেরত পাবে। নয়ত…ওয়েল, ভোগ করার পর গরম চিমটা দিয়ে ¯পর্শকাতর সবগুলো অঙ্গ আমি ছিঁড়ে নেব মেয়েটার।”
“যদি ওকে টাচ করেছ তুমি-” দাঁতে দাঁতে চিবিয়ে বলতে যাচ্ছিল ও, অন্যপাশ থেকে থামিয়ে দেওয়া হল তাকে।
“ক্লক’স টিকিং।” মোলায়েম কণ্ঠে বলল লোকটা। “এর মধ্য দিয়ে তোমাকে যেতে হবে। আমাকেও যেতে হয়েছে!”
রহস্যময় কথাটার মানে বুঝতে পারল না সাব্বির। কিছু জানতেও চাইল না এ ব্যাপারে। রুম সার্ভিস লোকটা ঘুরে দাঁড়াতে দাঁড়াতে কোটের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিচ্ছিল, সেই মুহূর্তে তাকে গুলি করল সাব্বির। ঝড়ের বেগে কোমর থেকে পিস্তলটা বের করে এনেই টেনে দিল ট্রিগার।
রুম সার্ভিস লোকটার দুই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছিল। একদিকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করেনি সে, দ্রুত হাত তুলছিল লাইন অফ ফায়ারের দিকে। হাতের তালু ফুটো করে গেছে প্রথম বুলেটটা। সাদা কাপড় ভেদ করে সোজা ঢুকে গেছে তার বুকে। তবে হৃদপি-ে নয়। আনাড়ি হাতের অস্ত্র চালনা সাব্বিরের। শতভাগ নিখুঁত হয়নি শটটা।
ছিটকে মাটিতে পড়ার আগে টেবিলটা আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিল মানুষটা, পারেনি। কফির দুটো কাপ মেঝেতে পড়ে ভাঙলো। তার মধ্যে চিত হয়ে শুয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকল আহত লোকটা। বুকের সাদা শার্টের মধ্যে একটা লাল রঙের ফুটো। সেটা থেকে ধীরগতিতে বের হচ্ছে রক্ত। লাল রঙের রক্তগুলো একদম তাজা। চটচটে একটা ভাব আসে তাজা রক্তের প্রবাহ দেখলে।
সাব্বিরের শরীরে চটচটে একটা অনুভূতি হচ্ছে।
“ফিনিশ হিম, ফাক ইট!”
ফোনের ওপারে কণ্ঠটা শোনার সাথে সাথে আরও দুইবার মৃতপ্রায় মানুষটার বুকে গুলি চালালো সাব্বির।
ধরমর করে উঠে বসার একটা ভঙ্গিতে সোজা হয়ে গেল দেহটা। তারপর নিথর হয়ে পড়ে থাকল হোটেলের মেঝেতে।
“বের হও দ্রুত। তোমার শুটিং পারফরম্যান্স দেখতে কেউ এই হোটেলে আসে না। বিশেষ করে পুলিশের গাড়িগুলো।”
“পুলিশ?”
“গানশট শোনা গেছে। ওরা নিঃসন্দেহে রওনা দিয়ে দিয়েছে। দ্রুত বের হও।”
হাত পা ছড়িয়ে পড়ে থাকা রুম সার্ভিসের দিকে একবার তাকিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালো সাব্বির। পিস্তলটা কোমরে গুঁজে রাখতে যাচ্ছিল, ফোনের অন্যপ্রান্তে কণ্ঠটা শোনা গেল আবারও, “মাত্র গুলি করেছ। ওখানে ঢুকিয়ো না। পাছা পুড়ে যাবে।”
পাঁচ.
লম্বা করিডোরে বের হওয়ার সাথে সাথে আবারও অন্ধকার হয়ে গেল চারপাশ। সম্ভবতঃ এবার জেনারেটর ফল করেছে। আশেপাশের দরজাগুলোর কোনটাই খুলে গেল না অবশ্য। অন্য সময় হলে দুই একজন ফ্রন্ট ডেস্কে গিয়ে প্রশ্ন করত, এতবার কারেন্ট যাচ্ছে কেন! তবে আজ কেউ করবে না। একটু আগে আশে পাশে কোথাও থেকে গুলির শব্দ শুনেছে তারা। বের হতে চায় কেউ এই সময়ে?
“এবার?” জানতে চাইল সাব্বির।
“সামনে। ছয় দরজা পর, ডানে।”
“তোমার নেক্সট টার্গেট।”
ফোনের ওইপাশের মানুষটার ওপর মেজাজ খাপ্পা হয়ে গেল সাব্বিরের। ছুটন্ত ছিল ও এতক্ষণ, এখন একেবারে ছয় নম্বর দরজা বরাবরই চলে এসেছে। এখানে তার পরবর্তী শিকার আছে জানানোর জন্য এত সময় লাগিয়েছিল কেন মানুষটা?
প্রচ- শব্দ করে দরজা খুলে গেছে। বিশাল শরীরের এক মহিলা বের হয়ে এসেছে সেখান থেকে। বয়েসের ছাপ পড়েছে মুখে, চুলগুলো খয়েরী বর্ণ ধারণ করেছে। হাঁটুর একটু নিচে গিয়ে শেষ হয়ে যাওয়া স্কার্ট পড়েছেন তিনি। হাতে একটা তোয়ালে।
“কি বিচ্ছিরি একটা হোটেল। আলো নেই কেন এখানে? বাবা, তুমি জানো কি হয়েছে? আলো নেই কেন?”
“শুট হার।”
“কাম অন! নিরীহ একজন-” বাম হাতে ফোন কানে চেপে ধরে বলল সাব্বির। ভদ্রমহিলা বের হওয়ার সাথে সাথে শরীরের পেছনে লুকিয়েছে পিস্তল। অন্ধকার ফাঁকা করিডোর। ডান হাতে পিস্তল ধরে থাকার দৃশ্যটা কারও চোখে পড়ার কথা না।
“গুডবাই।” মৃদু কণ্ঠে বললেন ‘ভদ্রমহিলা’।
সাব্বির নিজেই চমকে গেল নিজের বিদ্যুৎগতি দেখে। পেছন থেকে পিস্তলটা চোখের পলকে সামনে এনেছে সে। কিন্তু এক্ষেত্রে এগিয়ে ছিল মহিলা। তোয়ালে সরিয়ে ফেলতেই বিশাল মাজলবিশিষ্ট পিস্তলটা বের হয়ে এসেছে। তখনও মহিলার দিকে নিজের পিস্তল সরিয়ে আনতে পারেনি সাব্বির। অগত্যা বাম পা দিয়ে জোরে মাটিতে লাথি মেরে শুন্যে উঠে গেল ও। লাইন অফ ফায়ার থেকে ধীরে ধীরে বাম দিয়ে সরে যাচ্ছে সাব্বিরের উড়ন্ত দেহটা। সেই সাথে সামনে চলে আসছে পিস্তল ধরা হাতটা।
প্রায় একই সাথে গুলি চালাল দুইজন। মহিলা একটি মাত্র গুলি করেছে। মাপা শট। প্রফেশনাল হাত। প্রায় আট ইঞ্চি পেছনে ভেসে গেল সাব্বির। শুন্যেই। তারপর আছড়ে পড়ল মাটিতে।
মহিলাকে প্রায় একটা সেকেন্ড দেওয়ালের সাথে সেঁটে থাকতে দেখা গেল। তারপর অবসন্ন ভঙ্গিতে করিডোরের মেঝেতে পিছলে নেমে এল তাঁর দেহ। শুন্যে ভেসে থাকার সময়টুকুতেই নিজের ম্যাগাজিন খালি করে ফেলেছে সাব্বির।
মহিলার বিশাল দেহে ছয়টি ফুটো হয়েছে। কুল কুল করে সেপথে বের হয়ে আসছে রক্ত। করিডোরের মেঝে ভিজিয়ে ফেলতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে। সাব্বিরের মোবাইলের দিকে গড়িয়ে গড়িয়ে আসছে সে রক্ত। মেঝেতে ছিটকে পড়েছিল ওটা। মহিলার পিস্তল দেখার সাথে সাথে মোবাইল ছেড়ে ঝাঁপ দিয়েছিল ও।
পায়ে-পায়ে গিয়ে ওটা তুলে নিল সাব্বির। বুকের ডানদিকটা জ্বলছে খুব। ব্যথা হচ্ছে ওখানে।
কানে ধরল না ফোনটা। শান্ত ভঙ্গিতে পিস্তলের ম্যাগাজিন পাল্টাতে-পাল্টাতে লিফটের দিকে এগিয়ে গেল। লিফটের বিশ ফিট সামনে সার্ভিস ডোর আছে একটা। সেটা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল সাব্বির। তারপর সামনে এনে দেখল, এখনও ‘ইন-কল’ হয়ে আছে আননোন নাম্বারের কলটা।
“উই নীড টু টক।” ফোনের অন্যপাশের মানুষটাকে দ্রুত বলল ও।
“তোমাকে বেঁধে রেখেছে কে কথা বলতে? তবে ওই গর্তটা থেকে বের হও হে। গুলি খেয়েছ তুমি, সময় নষ্ট করলে তোমারই ক্ষতি।”
“আমাকে দেখতে পাচ্ছ কি করে তুমি?”
“দেখতে পাচ্ছি কি করে! মাই গড, এত ফালতু একটা প্রশ্ন করলে কি করে তুমি? আমি তোমাকে আরও ব্রাইট বলে জানতাম।”
“মানে কি? আমি তোমাকে ধরতে পারছি না ঠিক। কি বলতে চাইছ?”
“ওহ, এখনও তুমি মনে করছ এর কোন আলাদা ব্যাখ্যা আছে? আমার আর তোমার কণ্ঠ যে একই রকম, সেটার? তুমি মনে করছ, তোমার হোটেল রুমের বাথরুম থেকে মেগান উধাও হয়ে যাওয়ার কোন স্বাভাবিক ব্যাখ্যা আছে? মনে করছ, তোমার প্রতিটা পদক্ষেপ আমি তোমার পৃথিবীর কোন পরিচিত পদ্ধতিতে দেখতে পাচ্ছি?”
“অবশ্যই সবকিছু আমার পৃথিবীর পরিচিত কোন পদ্ধতিতেই হচ্ছে। এর বাইরে কিছুই নেই আর।”
“তাহলে আমি কিভাবে জানলাম, কলেজে পড়ার সময় স্কুলের এক মেয়ের মুখে এসিড ছুঁড়ে মেরেছিলে তুমি? মেয়েটির নাম ছিল ঋতু। খুব সুন্দর ছিল দেখতে। কিন্তু কাওকে পাত্তা দিত না। তোমার স্ট্যাটাস আর তোমার চেহারা–দুটো নিয়েই কটাক্ষ করেছিল ঋতু, মনে পড়ে?”
“ওয়েট আ সেকেন্ড! তুমি কিভাবে-”
“খুব জঘন্যভাবে তোমাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল মেয়েটি। ওর স্কুলের সামনে গাড়ি নিজে ড্রাইভ করে গেছিলে তুমি সেদিন। তোমার ডাক শুনে গাড়িতে উঠে বসেছিল ঋতু। তারপর, যখন ড্রাইভ করছ, তোমার গাড়িতে বসেই তোমাকে প্রত্যাখ্যান করে মেয়েটা। তোমার পৌরষ আর তোমার টাকার গরমের প্রতি খুবই বাজেভাবে মন্তব্য করে। তোমার নিজেকে সে রাতে পুরুষ বলে মনে হচ্ছিল না। পাবলিক একটা স্কুলে পড়ত ঋতু। তার বাবার তো ছনের ঘরও নাই। তোমাকে কথা শোনাতে সাহস হল কি করে তার?”
“কিন্তু এসব তো তোমার জানার কথা না…”
“পরের দিন গাড়ি না, পায়ে হেঁটে এসেছিলে তুমি। ওর বাসার কাছে গ্যারাজে দাঁড়িয়ে ছিলে। সিকিউরিটি ছিল না, এসব মিডল ক্লাস এলাকাতে সিকিউরিটি থাকেও না। গ্যারাজে পা রাখতেই অ্যাসিড মারলে তুমি মেয়েটার মুখে। ফুটফুটে সুন্দর একটা মুখ ঝলসে দিলে।”
বুকের ব্যথাটা বেড়ে গেছে। তাও নড়ল না সাব্বির। ঘাম হচ্ছে খুব তার। গাড়ির ভেতরে ঋতুর সাথে সেদিন কি নিয়ে কথা হয়েছিল তা কারও জানার কথা না। এ কিভাবে জানল? অ্যাসিড মারার কথাও জানার কথা না তার। কোন সহযোগীকে নিয়ে কাজ করেনি ও। সব একা করেছিল। জানত আর কেউ সাথে থাকলে ফেঁসে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। সে ঝুঁকি নেয়নি সাব্বির। কলেজে পড়লেও সাবধানী ছিল সে।
“বুঝতে পারছ তো আমি কিভাবে জেনেছি সবকিছু? তুমি আমার কথামত দুটো খুন করেছ।”
“নাহলে মহিলা আমাকেই মেরে ফেলত।” সাথে সাথে নিজেকে ডিফেন্ড করল সাব্বির।
“রুম সার্ভিসকে গুলি না করলে মহিলা বের হয়ে আসত না।”
“রুম সার্ভিস কোমর থেকে অস্ত্র বের করতে যাচ্ছিল।”
“তা তুমি নিশ্চিত করে জানো না। আগেই গুলি করেছিলে তুমি তাকে। কেন?”
“নাহলে মেগান তোমার কাছে নিরাপদে থাকবে না। সেজন্য।” ফিসফিস করে বলল সাব্বির।
“না, সাব্বির। স্বীকার করছ না কেন? উপভোগ করছ তুমি এই ব্যাপারটা। মেগানের অন্তর্ধান থেকে শুরু করে এই ভায়োলেন্স। সবই উপভোগ করছ তুমি। আমিও জানতাম না একটা সময়, বিষয়গুলো উপভোগ করি আমি। এরকম একটা স্টেজ পার করেই জানতে হয়েছে। তুমি এখন জানলে।”
কিছু বলল না এবার সাব্বির। শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছে হাতের পিস্তল।
“তোমাকে আমি এতটা চিনি, ব্যাখ্যাটা সহজ। আমিই সাব্বির, সাব্বির। তোমাদের প্যারালাল ওয়ার্ল্ডে আছি আমি। তোমার প্রতিবিম্ব আমি। আমার প্রতিবিম্ব তুমি।”
ছয়.
“বুলশিট!” সার্ভিস স্টোরের দরজা ঠেলে বের হয়ে এল সাব্বির।
“কাম অন! আর কোন প্রমাণ দিতে হবে? আমি আর তুমি একই ব্যক্তিত্ব।”
“সেক্ষেত্রে তুমি মিস্টার হাইড। আমি ডক্টর জেকিল। ইউ আর দ্য ইভল ওয়ান।” ঝাঁঝিয়ে উঠল সাব্বির।
“তোমার ডানে!”
ঘুরেই লোকটাকে দেখতে পেল ও। দরজা খুলে বের হয়ে আসছে। বিন্দু মাত্র দেরী না করে মাথা বরাবর গুলি করল তাকে। আনাড়ি হাতে লাগল না ঠিক। গলাতে বিঁধেছে বুলেট। গরু জবাই করলে যেমনটা হয়, তেমন শব্দে করিডোর ভরে গেল। বদ্ধ জায়গাতে বিকট শব্দ হয়েছে গুলির।
“হোটেল সিকিউরিটি দল বেঁধে ছুটে আসছে সিঁড়ি বেয়ে। টেক দ্য লিফট।”
“কারেন্ট নাই। ভুলে গেছ?” বিরক্ত হয়ে বলল সাব্বির।
“ম্যাটার না। টবের নিচে হাত দাও, ছয় ইঞ্চির একটা ছুরি পাবে। দরজা সামান্য ফাঁক করে ভেতরে ঢুকে পড়। লিফটা আছে ঠিক এক ফ্লোর নিচে। অনায়াসে দাঁড়াতে পারবে ওটার ওপর।”
টবের নিচে ছুরিটা পাওয়া গেল। দরজা ফাঁক করে হাঁটু উচ্চতাতে থেমে থাকতে দেখল ও লিফটের ছাত। লাফিয়ে চড়ে বসল ওটাতে। ছুরি ফেলে দিয়েছে ফোকর দিয়ে। দরজা আবারও হাত দিয়ে আটকে দিতে হল কসরত করে।
“মেইনটেন্যান্স লাডার আছে। বেয়ে-বেয়ে নিচতলা পর্যন্ত নেমে পড়।”
নিস্তব্ধ লৌহঘরের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলল সাব্বির। এর চারপাশে ক্লিয়ারেন্স ভলিউম আছে। সেদিকেই মেইনটেন্যান্স ল্যাডার। কোমরে পিস্তল গুঁজে মই আঁকড়ে ধরল ও। ফোনটা পকেটে রেখে দিয়েছে। হ্যাং আপ করেনি। দুই হাতে নিজের ওজন ছেড়ে দিতে তীব্র ব্যথার একটা ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে গেল ওকে। বুক থেকে আসছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে ক্ষতস্থান।
কিছুটা নেমে আসার পর ওপরের লিফটের দিকে ভয়ে ভয়ে তাকাল সাব্বির। ক্লস্ট্রোফোবিয়া তার নেই, কিন্তু যে কোন মুহূর্তে কারেন্ট চলে আসতে পারে। তখন নিচতলা থেকে কোন একজন লিফটা ডেকে নেওয়ার জন্য সুইচ চাপলে নেমে আসবে লিফট। তখন যদি ও মেইনটেন্যান্স ক্লিয়ারেন্সের বাইরে থাকে তাহলে কি হবে তা নিয়ে ভাবতে চাইল না আর।
নিচতলাতে নেমে এসে মোবাইলের আলোতে ছুরিটা খুঁজে বের করল আবার। তারপর হাল্কা চাড় দিয়ে দরজা ফাঁকা করে হাত দিয়ে টেনে খুলে ফেলল ওটা। বের হয়ে এসেছে নিচতলার লবিতে। মেইনগেটের ওদিকে বেশ কয়েকজন মানুষের উদ্বিগ্ন চিৎকার শোনা যাচ্ছে। ওদিকে যাওয়া যাবে না। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করল সাব্বির।
“নাও হোয়াট? আ’ম ট্র্যাপড।”
“শান্ত হও। রান্নাঘরটা কোনদিকে জানা আছে তোমার?”
“হুঁ।”
“ওদিকে চলে যাও। কুইক।”
পেছন দিয়ে ছুটল সাব্বির। কোমরে গুঁজে নিয়েছে পিস্তল। মাজল ঠা-া হয়ে গেছে ওটার।
“ভেরি নাইস। প্যারালাল ইউনিভার্স, না? আমার সাথে কনট্যাক্ট করছ কি করে ওপার থেকে?”
“মাইক্রোসেলুলার চিপস দিয়ে। তোমার মোবাইলে ঢুকিয়েছ যেটা।”
“একেবারে গাঞ্জা। এই আইডিয়া দিয়ে সিনেমা বানালে ফ্লপ খাবে প্রোডিউসার।”
“কারণ লোকে জানে না একেকটা সেলফোন দিয়ে কি করা সম্ভব। শুধু দরকার কম্প্যাটিবল একটা মডিউল।”
“আর একটা নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকটর। ম্যাগনেটিজমকে কাজে না লাগালে প্যারালাল ওয়ার্ল্ডের সাথে কানেক্ট হওয়া যায় না। প্রচুর বিদ্যুৎশক্তি দরকার সেজন্য।”
“তোমার কি ধারণা সিক্সটি ওয়াটের একটা লাইট জ্বালাতে সিক্সটি ওয়াট পাওয়ার লাগে? গ্রো আপ। তোমাদের ওয়ার্ল্ড অনেক পিছিয়ে।”
“তার অর্থটা কি?”
“প্রতিটি ডিভাইস, যা তোমরা ব্যবহার কর, তোমাদের ধারণার চেয়েও কম কারেন্ট নিয়ে চলতে পারে। পুরো পৃথিবীতে পঞ্চম এক ধরণের ম্যাগনেটিজম আছে। নিক্সন ম্যাগনেটিজম। এটার কথা তোমরা জানো না দেখেই হাজার বছর পিছিয়ে আছো। সরকার সব পণ্যের ভ্যাট বসায়, তাই না? এই নিক্সন ম্যাগনেটিজমকে বলতে পারো কারেন্টের ভ্যাট। তোমার যখন লাগবে মাত্র এক ওয়াট পাওয়ার, সেখানে তোমাদের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে ছয়শ থেকে সাতশ ওয়াট। প্যারালাল ওয়ার্ল্ড তোমাদের থেকে কখনই বিচ্ছিন্ন না।”
“তাহলে তো ইলেকট্রিক্যাল আর ইলেক্ট্রনিক্সের সব সূত্র ভুল প্রমাণিত হয়ে যাবে।”
“ছাগলের মত কথা বল না। আরেকবারের মত বলতে বাধ্য হচ্ছি, তোমাকে আরও ব্রাইট ভেবেছিলাম আমি। সূত্রগুলো ঠিকই আছে। পার্সেন্টিজ হারে কিছু বাড়লে বা কমলে কোন সূত্রতেই ইফেক্ট পড়ছে না। তোমরাও সে অনুপাতেই সবকিছুর হিসেব করছ। অজান্তেই।”
“তারমানে, বাকি বিদ্যুতশক্তি সম্পূর্ণ অপচয় হচ্ছে?”
“না। নিক্সন ম্যাগনেটিজমের ধাক্কাতে উধাও হয়ে যাচ্ছে। এখন তোমাকে পুরো বিষয়টা কিভাবে কাজ করে তা বলতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে। এত সহজ জিনিস না। এই একটা জিনিস আবিষ্কার করার জন্যই বিজ্ঞানী নিক্সন একটা অস্কার পেয়েছিলেন।”
“ফাক অফ। বিজ্ঞানী আবার অস্কার পায় কি করে? নোবেল পেলে একটা কথা ছিল।”
“উনি কি ডেট্রয়েটে অভিনয় করেন, যে নোবেল পাবেন? অস্কার প্রাইজ দেওয়া হয় শান্তির জন্য যে কোন কৃতিত্বপূর্ণ কাজ করার জন্য। এদেশ থেকে সত্যজিত রায় অস্কার পেয়েছিলেন সাহিত্যে।” প্যারালাল সাব্বির বলে যাচ্ছে ফোনের ওপাশ থেকে, “কিছুই জানো না দেখছি!”
“আমাদের এখানে হলিউড মুভি বানানোর জন্য বিখ্যাত। ডেট্রয়েট না। আর নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।”
“হলিউডে জাহাজ আর অটোমোবাইল নির্মান কারখানা আছে এখানে। যাই হোক, একটু ওলট পালোট হতেই পারে। আমি এখানে এজেন্সীতে কাজ করি আর তুমি ওই জগতে এক ভ্যাগাবন্ড প্রেমিক। লজ্জার ব্যাপার।”
রান্নাঘরের দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেলল সাব্বির, “আমি এখানে।”
“জানি, আমিও রান্নাঘরে। একটু আগে লিফটে করে নামছিলাম তোমার সাথে।” একটু থেমে ওপাশের কণ্ঠটা যোগ করল, “আমার ওয়ার্ল্ডে।”
“গুড। কোনদিকে এবার?”
“পেছনে দেখ। হ্যাঁ, বামের দরজাটা। খুলে বেরিয়ে যাও।”
দরজাটা দেখতে পেল সাব্বির। নব ধরে ঝাঁকালেও নড়ল না, “ক্র্যাপ। লকড।”
“ইউ নো হোয়াট টু ডু।”
“আপনি এখানে কি করছেন?” স্টোররুম থেকে বের হয়ে এসে অবাক হয়ে প্রশ্ন করল একজন শেফ।
ঝটকা দিয়ে কোমর থেকে পিস্তল বের করল সাব্বির। দুই চোখের মাঝে তাক করেছে তার। ভয়ে ওখানেই কাঠ হয়ে গেল লোকটা।
“বানচোতটাকে গুলি করার কোন দরকার দেখছি না।” ফোনের অন্যপাশ থেকে বলল কণ্ঠটা।
“জানি আমি।” নিচু কণ্ঠে তাকে উত্তর দিল সাব্বির। তারপর হাঁক ছাড়ল বাবুর্চির দিকে, “ঢুকে পড়ুন। কুইক!”
“কো-কোথায়?”
“যে ফুটো থেকে বের হয়েছেন, সেখানেই… আহ, তাড়াতাড়ি করুন!”
সেকেন্ড দুয়েক ভেবে আস্তে করে আবারও স্টোররুমে ঢুকে পড়ল লোকটা। বাইরে থেকে ছিটকিনি তুলে দিল সাব্বির। তারপর ফিরে এল সেই আগের দরজাটার কাছে। দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কোন কারণ নেই, প্রকা- এক লাথিতে নব সহ ছিটকে খুলে ফেলল দরজা। পিস্তল আবারও কোমরে ফিরে গেছে। বাইরের জনগণের মনোযোগ আকৃষ্ট করতে চায় না। দ্রুত হেঁটে হোটেলটা থেকে সরে যেতে থাকল ও। দূরে পুলিশের সাইরেন শোনা যাচ্ছে।
বড় রাস্তাতে উঠে এসে হাঁটা দিল রাতের অন্ধকার লক্ষ্য করে।
“ট্রেল ফলো করবে না পুলিশ?”
“ফেলে এসেছ কিছু?”
“হাজারটা জিনিস, থ্যাংকস টু ইউ। হাতের ছাপ, ডিএনএ স্যা¤পল সহ।”
“বাবার ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারো। নাহলে দাঁত মুখ খিঁচে লুকিয়ে থাকো। কিডন্যাপের পাল্টা কেস দিয়ে দেবে তোমার বাবাই। ভাবার কিছু নেই। এছাড়াও একটা বেটার অপশন আছে অবশ্য…”
“মেগানকে পাচ্ছি কোথায়?” মাঝপথেই বাঁধা দিল সাব্বির, “তোমার কথা মত চলেছি, মেগানকে ফিরিয়ে দাও।”
“ডানে তাকাও।”
ল্যাম্পপোস্টের নিচে অবসন্নভাবে একটা মেয়েকে বসে থাকতে দেখল ও। ফোন পকেটে পুড়তে পুড়তে ছুটে গেল ওদিকে। ওকে দেখে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল মেয়েটা। পারল না। সামান্যতেই পা হড়কেছে। আবারও ফুটপাথে বসে পড়ল ও।
দুই হাতে জড়িয়ে ধরল ওকে সাব্বির। তারপর দাঁড় করালো শক্ত করে। নিজের বুকের কাছ থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে এখনও। অবশ হয়ে আসছে জায়গাটা। খেয়ালই হচ্ছে না এখন তার।
“মেগান, তুমি ঠিক আছো?”
“আমরা হোটেল থেকে বের হলাম কখন, বেবি?” আবারও নেতিয়ে পড়তে শুরু করেছে মেয়েটা।
বিস্ফোরিত চোখে সাব্বির দেখল মেগানের গলার চামড়া লালচে হয়ে আছে।
সাত.
“তারমানে বলতে চাইছিস, হোটেল আভাটিয়ার ম্যাস মার্ডারারটা তুই ছিলি?” তৃতীয়বারের মত প্রশ্ন করল তামিম ইকবাল।
“আরে বাল, তোর কি আমাকে তোতা পাখি লাগতেছে? একটা কথা হাজারবার জিজ্ঞাসা করিস না।”
তরুণ সাইকিয়াট্রিস্ট তামিম ইকবালের চেম্বারে বসে আছে সাব্বির। হোটেলের সেই হত্যাযজ্ঞের তিন মাসে পেরিয়ে গেছে। সব কথা প্রথমবারের মত কাওকে খুলে বলেছে সে। তার আগে অবশ্যই, রেকর্ডার অফ করে নিতে বাধ্য করেছে বন্ধুকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল তামিম। চমৎকার রেজাল্ট করে বের হয়েছিল মনোবিজ্ঞান থেকে। তার সাথে কথা বলতে আসার পেছনে একাধিক কারণ আছে। তার মধ্যে একটা কারণ, তামিম সাব্বিরের বন্ধু। একদম স্কুলজীবনের বন্ধু।
“ফাইন। তারমানে, তুই কাজটা করেছিলি তোর প্যারালাল ইউনিভার্স ভার্সনের কথা অনুযায়ী?” হেসে উঠল না তামিম। সাব্বিরকে একজন পেশেন্ট হিসেবেই নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে, “তাহলে খবরে তোর নাম কেউ লিখল না কেন? তোর প্রিন্ট ছিল এমন অনেক কিছুই ছিল তোর রুমে। সবচেয়ে বড় কথা নিজের ল্যাপটপটা ফেলে এসেছিলি সেখানে। এতবড় প্রমাণ পেলে পুলিশ ডিপার্টমেন্টের জন্য আনসলভড কেস হয়ে থাকার কিছু তো ছিল না এটা।”
“বাবার কানে গেছিল খবরটা। কলকাঠি নেড়েছিলেন। পুলিশ আমাকে খুঁজেছিল হয়ত, তবে মিডিয়াতে আসতে দেয়নি সে খবর। খবরের কাগজগুলো কি বলেছিল মনে আছে তোর?”
“মব হিট। ওখানে দুইজন মারা যায়। দুইজনই ডন রাবেকের লোক ছিল। ঢাকার সব শপিং কমপ্লেক্সগুলো নিয়ন্ত্রণ করে মাফিয়া। তাদের লোক ছিল তারা। ধারণা করেছে আন্ডারওয়ার্ল্ডে কোন ঝামেলা হয়েছিল। ফলাফল, ঢাঁচিয়া। তুই কি আন্ডারওয়ার্ল্ডে ঢুকেছিস নাকি?”
“ঠাট্টা করিস না।” বিরক্ত মুখে বলল সাব্বির, “আমাকে তোর পাগল বলে মনে হচ্ছে?”
“ঠিক তা না। তবে এটা কি জানিস, প্যারালাল ইউনিভার্স থিওরি প্রমাণ করা যায়নি। এটা শুধুমাত্র একটা থিওরি। কেউ চাইলে বিশ্বাস করতে পারে। কেউ চাইলে এটাকে গালগল্প বলে উড়িয়ে দিতে পারে।”
“বিশ্বাস অবিশ্বাস চুলোতে যাক। আই হ্যাড বিন গন থ্রু ইট।”
“তুই কি শিওর?”
“কি শিওর?” প্রায় গর্জে উঠল সাব্বির, “আমি রাতটা পার করেছি। ফোনের ওপাশের ভয়েস ঋতুর কথা জানত। এটার কথা আর কারও জানার কথা না।”
“একজনের জানার কথা। ঋতুর। অ্যাসিড মারার পর থেকে ঋতু তোর জন্য নিশ্চয় পাগলপারা না? তারমানে, সে এই কথাগুলো কাওকে লিক করতেই পারে। খুনগুলো কেন করতে হয়েছে তোকে বলেছে তোর প্যারালাল ভার্সন?”
“শিওর। প্যারালাল ইউনিভার্সের আমি যাদের হয়ে কাজ করছি, তাদের বলা হয় প্যারালাল সেভার এজেন্সি। আমাদের এদিকেও একটা গড়ে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমেরিকান জঙ্গী গোষ্ঠীর নেতৃত্ব দিচ্ছিল একজন বাংলাদেশী খ্রিস্টান। স্টুয়ার্ট প্যাটেল। তার ডানহাত রোজি। দুইজনই অস্পৃশ্য ওদের ওয়ার্ল্ডে। চাইলেই কি আর ওসামা-বিন-লাদেনকে ধরতে পারবি তুই?”
“না। তা পারব না। তবে থিওরিটা কি? তুই কি টেররিজম ঠেকালি মাত্র? ইন্টারন্যাশনাল টেররিজন? দুইজন মাফিয়া মেম্বারকে খুন করে?”
“এই ওয়ার্ল্ডে তারা শুধুই মাফিয়া মেম্বার। কিন্তু ওই ওয়ার্ল্ডে তা না। ওখানে তারা একটা ক্রাইম অর্গানাইজেশনের হেড।”
“এখানে তাদের খুন করার পর কি হয়েছে ওদের ওয়ার্ল্ডে?”
“পরদিন ফোন করেছিল আমাকে ওই ওয়ার্ল্ডের … আমি। বলল, ওদের ইনসাইড সোর্স জানিয়েছে, কার ক্র্যাশে মারা গেছে ওদের দুই লিডার। নিছকই দুর্ঘটনা। জঙ্গিগোষ্ঠী শোকাহত। কেউ কেউ কন্সপিরেসি থিওরিও দাঁড় করিয়েছে। এইসব হাবিজাবি। বুঝতে পারছিস, কত বড় ঝামেলা কত সহজে সরিয়ে দেওয়া হয় এভাবে?”
“ওই নাম্বারে কল ব্যাক করার চেষ্টা করেছিস?”
“কলব্যাক করলে ওই প্যারালালের আমিই ফোন ধরি। যতক্ষণ পর্যন্ত মডিউলটা আমার কাছে আছে, এটা করতে পারব আমি।”
“আমাকে দেখা।” চ্যালেঞ্জ করল তামিম।
“ওই ফোন সাথে নিয়ে বের হইনি। সেফ জায়গাতে রেখে এসেছি।”
“তাই তো করবি!” তিক্ত কণ্ঠে বলল সাইকিয়াট্রিস্ট।
“আমার ভয়েস। আমার মত থিংকিং। তুই বলতে চাস এগুলো আমার পাগলামী? পিস্তলটা এলো কোথা থেকে? খুনগুলো তো হয়েছে সত্যি। লাশগুলো পুলিশ পেয়েছে। এগুলো সব আমার কল্পনা?”
“মোটেও তা বলছি না আমি। আমার সাজেশন আলাদা রকমের। তাতে তুই পাগল না, আবার প্যারালাল ইউনিভার্সের বাল-ছালও সত্য না।”
বিভ্রান্ত দেখালো সাব্বিরকে, “কিভাবে সেটা?”
থমথমে মুখে বলল তামিম, “প্যাসিভ ক্রাইম।”
“প্যাসিভ … হাউ!”
“রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করি। ব্যাখ্যা পেয়ে যাবি। বের হওয়ার সাথে সাথে লোকাল তিন ছেলের সাথে ঝামেলা লেগে গেল তোর। তাদের কেউ আলগোছে মেগানের হাতব্যাগে আধ-খসন্ত ভাবে রেখে দিল মেমরি কার্ড। গার্লফ্রেন্ডের দিকে তোর শকুনি চোখের ব্যাপারে খ্যাতি আছে। জানত, ব্যাগ থেকে একটা সুতো খসে পড়লেও চোখে পড়বে তোর। তাই ঘটল।”
কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল সাব্বির, তাকে এক হাত তুলে থামিয়ে দিল তামিম, “বলতে দে আগে। জানি, তুই কি বলবি। ওই তিনজন এই ইউনিভার্সের তিন মডিউলার। কানেকশনটা প্রথমে এরাই করতে পেরেছিল। তোর মতে, ওই প্যারালালে নিক্সন যে সূত্রটা আবিষ্কার করেছিল সেটাই আবিষ্কার করেছিল এরা। পরবর্তীতে প্রথমবারের মত প্যারালাল মডিউল ব্যবহার করে ওই দিকের সাথে তারা যোগাযোগ করে। তাদের সাথে পরিচয় হয় আরবোটের। প্যারালাল এজেন্সির পক্ষ থেকে তুই, মানে ওই ইউনিভার্সের সাব্বির নিয়ন্ত্রণ করে কে কখন খুন হবে। অ্যাসাসিন ডিপার্টমেন্টের নাম আর-বোট। তাই তো? ওই ইউনিভার্সের তুই এই তিনজনকে ব্যবহার করে তোর কাছে পৌঁছে দিলি মডিউল। এটা হল তোর স্টোরি। আমাকে বলতে পারিস, কেন নিজের সাথেই যোগাযোগ করল ওই ইউনিভার্সের সাব্বির? আরও যোগ্য লোক ছিল না এই কাজটা করার জন্য? তুই একজন সিভিলিয়ান।”
“ট্রাস্ট ইস্যু। এরকম একটা সিরিয়াস কাজ আমাকে দিয়েই করিয়েছি আমি। জানি, নিজেকে বিশ্বাস করতে হবে।”
“বালটা তোমার। মাফিয়ার সদস্য ছিল খুন হয়ে যাওয়া দুইজনই। তাদের বিরুদ্ধে কেউ লেগেছিল এটা আমি বাজি ধরে বলতে পারি। তাদের পরিচয় হয়ত ডন রাবেকের অজানা নয়। সেজন্যই প্যাসিভ ক্রাইমের মাধ্যমে ডন রাবেকের কাছের কেউই হয়ত ব্যক্তিগত স্বার্থে সরিয়েছে তাদের। ব্যবহার করেছে তোকে। মেমরি কার্ডে বাগ বসিয়েছে। ছোট্ট কোন ভাইরাস হয়ত। তোর গার্লফ্রেন্ডের ব্যাগে সেঁধিয়েছে সেটা। তারপর তুই মোবাইলে ঢুকিয়েই দেখলি আর-বোট আর-বোট বলে চেঁচাচ্ছে সেটা। মেগান গোসলে গেল। বাথরুমেই উধাও হয়ে গেল সে। এটা কিভাবে করা হল, আমাকে বোঝা।”
“মডিউল যেখানে থাকে তার পঞ্চাশ ফিট রেডিয়াসে একটা উইন্ডো হয়ে যায়। দুই ওয়ার্ল্ডের মধ্যে ফিজিক্যাল ট্রান্সফার সম্ভব তখন। আমার ফোনে মডিউল অ্যাক্টিভেট করার সাথে সাথে বাথরুমের দরজাটাকে ট্রান্সফার করেছে ওখানকার সাব্বির। নাথিং এলস। দরজা খুলে বের হয়ে আমাকেই পেয়েছে সেখানে মেগান। সন্দেহ করেইনি। একইভাবে আবার মেগানকে ফিরিয়ে দেয় ওরা। আমার থেকে ল্যাম্পপোস্টটা মোটেও পঞ্চাশ ফিট দূরে ছিল না। তবে মানুষ আনা-নেওয়া করলে বহিত্বঃকের ক্ষতি হয়। রেডিয়েশনের মত। মেগানেরও হয়েছে। দুই মাস হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল ওকে।”
মাথা নাড়ল তামিম, “তুই একটা ইডিয়েট! মনিটর দেখার জন্য কাছে গেছিলি যখন, তোকে অটোসাজেশনে আটকে ফেলেছিল স্ক্রিন। তুই দেখেছিলি কারেন্ট চলে গেছে। আসলেই গেছিল বলে আমার বিশ্বাস। তবে মাঝে তোকে মিনিট দুয়েক মোহাবিষ্ট করে রেখেছিল স্ক্রিনের অটোসাজেশন। এটা পসিবল। হিপনোটিজমের কাছাকাছি একটা ব্যাপার। কিছু প্যাটার্ন কাজে লাগিয়ে চোখে ধাঁধা দিলে তুই এমনভাবে আবিষ্ট হয়ে যাবি, তোকে থাপ্পড় দিলেও নড়বি না। আমেরিকার ডিফেন্স সাইটে আছে এমন কিছু ডিজাইন। টেম্পরারি হিপনোটিজমও বলা হয় এটাকে। সাইকোলজির ব্যাপার এটা। সেজন্য আমাদের পড়তে হয়েছে এই প্রযুক্তি নিয়ে।”
“ফাইন। আমি নাহয় টেম্পরারি হিপনোটাইজড হলাম। প্যাসিভ ক্রাইম অনুযায়ী কেউ আমাকে হিপনোটাইজ করেছে নিজেদের সুবিধার্থে। তাই না? তারপর মেগানকে সরালো কি করে?”
“ইজি। বলেছিলি বাথরুমের দরজা না লাগিয়ে ঢুকেছিল মেগান। বয়ফ্রেন্ডের সাথে হোটেলে থাকলে কোন মেয়ে তালা লাগানোর ঝামেলাতে যায়ও না। এটা তাদেরও জানা থাকার কথা। আর প্রতিটা রুমেই ডুপ্লিকেট কী থাকে। কাজেই, অনায়াসে ডুপ্লিকেট কী দিয়ে তোর রুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢোকে ওরা। তারপর বাথরুমে ঢুকে মেগানের মুখে ক্লোরোফর্ম চেপে ধরে। একবার চেঁচিয়ে উঠেছিল মেয়েটা। তোর কানে এসেছিল সেটা। তবে মোহাবিষ্টতা কেটে যাওয়ার আগে ব্রেন কাজই করেনি। দুই মিনিট অনেক সময়। মেয়েটাকে অজ্ঞান করে আশেপাশের কোন ঘরে সরিয়ে ফেলেছিল তারা। তোর নাইটস্ট্যান্ডে রেখেছিল পিস্তল আর এক্সট্রা ম্যাগাজিন। তুই চটকা ভাঙ্গতেই দেখলি ফোন বাজছে। সেটা রিসিভ করে দেখা গেল কলার তোর নিজেরই কণ্ঠের কেউ। সে বলল মেগান নেই। তোকে যা বলবে তাই করতে হবে। পর পর এরকম ঘটনাপ্রবাহ অনেক শক্ত মনকেও নড়বড়ে করে দিবে। বাধ্য হলি তুই পিস্তল নিয়ে বের হতে। গলার স্বর নকল করা কোন ব্যাপার না। অসংখ্য সফটওয়ার আছে। তোকে নিয়ে কেউ ভালো মত স্টাডি করেছে এটা শিওর থাক। ভাল কথা, রুম সার্ভিসকে খুন করতে বলল কেন? এই লোকটা ওদের ইউনিভার্সের কে?”
“বাংলাদেশের স্বৈরাচারী সরকার প্রধান। একঢিলে তিন পাখি মারার মত গুরুÍ¡পূর্ণ কাজ ছিল এটা। আমাদের ইউনিভার্সের একই হোটেলে তিনজনকে পেয়ে গেছিল ওরা। আমার নিজেকে এই অ্যাসাইনমেন্টে পাঠানোর এই একটাই ব্যাখ্যা। মানে, ওই ইউনিভার্স থেকে। আর-বোটের জন্য এতটা গুরুÍ¡পূর্ণ মিশন আগে কখনও আসেনি।”
“বালের থিওরি না কপচায়ে আগে আমারটা শোন।” ক্ষেপে উঠল তামিম ইকবাল।
বাধা দিল সাব্বির। “দুই সেকেন্ড। আগে তোর থিওরি অনুযায়ী আমাকে বোঝা, মেগানকে যদি প্যারালাল ইউনিভার্সের থিওরি দিয়ে এই ভাবে বের করেও নেয়, টেম্পরারিলি হিপনোটিজমের প্রোগ্রাম তারা পেল কি করে?”
“এটাও ইজি। পোড়খাওয়া কোন হ্যাকারের কাজ। এটা টাকা দিয়েও পাওয়া যায়। মানে, টাকা দিয়ে হ্যাকার হায়ার করতে হবে জাস্ট। যা করার ওরাই করে দেবে।”
“গুড। তারপর, তোর থিওরিটা শেষ কর।” তামিককে উৎসাহই দিল সাব্বির।
“তুই গুলি করে দুনিয়া কাঁপিয়ে দিলি। উসাইন বোল্টের রেকর্ড ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে দৌড়ালি সামনের দিকে। গুলির শব্দ শুনেই মাফিয়া সদস্য রোজি যা বোঝার বুঝে নিয়েছিল। অস্ত্র নিয়ে করিডোরে বের হয়ে আসে সে। রোজি-ই যেহেতু তোকে নিয়ে খেলানো লোকটার টার্গেট, জীবন বিপন্ন হতে পারে এটুকু তার বোঝার কথা। কিন্তু অ্যামেচার মানুষ না চেনার মত নয় রোজি। তোকে আশা করেনি সে। মানে, তোর মত অ্যামেচার কাওকে। তবে তোর হাত দেখে পিস্তলের ব্যাপারটা টের পেয়ে যায় সে, শুট করে। জন্মের কপাল তোর, একটা বুলেট নিয়ে সরে পড়লি তুই। দ্বিতীয়জন অবস্থা খারাপ দেখে দ্রুত বের হয়ে দেখতে চেয়েছিল পরিস্থিতি। তাকে সে সুযোগ না দিয়ে গলাতে গুলি করেছিলি। তারপর ঢুকে গেছিলি লিফটে। কত অল্প সময় লেগেছিল বুঝতে পারছিস? প্রথম গুলিটা থেকে হিসেব করলে ষাট সেকেন্ডেরও কম সময়ে তিনটা মার্ডার করে লিফট বেয়ে লুকিয়ে বের হয়ে গেছিলি তুই।”
“সাবাশ শার্লক হোমস! এবার বল আমার প্রতিটা স্টেপ দেখতে পাচ্ছিল কিভাবে সে?”
“হোটেল আভাটিয়াতে প্রত্যেকের ঘরে ঘরে পর্যন্ত সিক্রেট ক্যামেরা আছে। তোর জানা নেই হয়ত। তবে ম্যাস মার্ডার কেসটার পর থেকে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। সেরাতের একটা ভিডিও-ও পাওয়া যায়নি। সব ডিলেট করে দিয়েছিল কেউ।”
“কারেন্ট ছিল না। ভিডিও আসবে কোথা থেকে?”
“ইনফ্রারেড ক্যামেরা এগুলো। কারেন্ট গেলে ব্যাকআপে চলে। কোন উপায়ই নেই ফীড মিস করার। অথচ সব ডিলেটেড। মানে তো বুঝতে পারছিস? কেউ একজন সশরীরে অথবা, কাস্টম সার্ভার বানিয়ে দূর থেকে দেখছিল ওদের ক্যামেরাতে। নিয়ন্ত্রণ করছিল। তোর প্রত্যেক মুভমেন্টকে ফলো করা কঠিন কিছু না তেমন। বের হওয়ার পর তো আরও সহজ হয়ে গেল কাজটা। খোলা আকাশের নিচে যে কাওকে ফলো করা যায়।”
“বলতে চাইছিস, এই পক্ষটা আমাকে ক্যামেরাতে দেখে দেখে ডিরেকশন দিচ্ছিল? পুরো হোটেলের কারেন্ট চলে যাওয়ার পেছনেও আছে এদের হাত?”
“অবশ্যই।”
“তাহলে কিভাবে মেগানকে আমার পঞ্চাশ ফিটের মধ্যেই ছেড়ে দিল ওরা? মেগান কিছু মনে রাখতে পারল না কেন?”
“সাম কাইন্ড অফ সাজেশন অবশ্যই। আর একটা গাড়িতে করে এনে রাস্তার পাশে নামিয়ে দেওয়া কঠিন কিছু না। কেউ লক্ষ্য করবে না সেটা। ইভেন তুইও না। রাস্তার অন্যপাশে যদি নামিয়ে দেয়, গাড়িটার আড়ালেই ঢাকা পড়ে যাবে তোর দৃষ্টি। এমন হতে পারে, তোর সাথে ফোনে যে ছিল সে ওই গাড়িতে বসেই কথা বলছিল। গাড়িটা যখন ওখান থেকে সরে যাচ্ছে, জানত ঠিক কোথায় আছিস তুই, কখন ডানে তাকাতে হবে তোকে। একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে নির্দেশ দিয়েছে তোকে ডানে তাকাতে। তুই নিশ্চয় মেগানকে রেখে সামনের দিকে ছুটতে থাকা রাস্তার কোন গাড়ির দিকে নজর দিবি না। তোর পুরো মনোযোগ পাবে মেয়েটা। এই সুযোগই নিয়েছে সে।”
কোমর থেকে একটা পিস্তল বের করে তামিমের সামনে রাখল সাব্বির। নাক-বোঁচা, জঘন্য চেহারার একটা পিস্তল। এক নজর দেখেই যে কেউ বলে দেবে দশ হাজার টাকার বেশি হবে না এটার দাম। অসম্ভব সস্তা।
“এই ফকিরা পিস্তলটা দিয়েছিল তোকে প্যারালাল ইউনিভার্সের সাব্বির?” এবার হেসেই ফেলল তামিম, “কাম অন, ওরা হাজার কোটি টাকার প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছে। তোর জন্য ছুরি রেখে দিতে পারে, পিস্তল রেখে দিতে পারে, আর একটা ভালো মানের পিস্তল দিতে পারল না? এই অস্ত্রটার দাম তো মনে হয় সাত হাজার টাকাও না।”
“ইউজার ফ্রেন্ডলি এটা। প্রথমবার পিস্তল চালিয়েছি, মনে পড়ে?” ক্লান্তভঙ্গিতে হেলান দিল সাব্বির, “তোর কাছে এসবই প্যাসিভ ক্রাইম বলে মনে হচ্ছে?”
“নিশ্চয়। তোর কয়েকটা দিন নিশ্চয় খুব রাফ গেছে? মনের ওপর প্রচুর চাপ ফেলার কথা এসব ঘটনাপ্রবাহ। সাইকোলজিকাল ট্রমাকে এদেশের লোকজন গুরুÍ¡ দেয় না। এটা একটা অশিক্ষা। ফিজিকাল ট্রমা, যেমন ইঞ্জুরির মতই গুরুÍ¡পূর্ণ একটা ইস্যু হওয়া উচিত সাইকোলজিকাল ট্রমা। তোর আসলে এখন হেল্প দরকার। আমার সাথে থেরাপি সেশন শুরু করতে পারিস।”
“আমি পাগল না।”
“আমি বলিনি যে তুই পাগল। বলেছি, তোর সাথে খেলেছে ওরা। তোর মনকে বিভ্রান্ত করেছে। এ থেকে বের হওয়ার জন্য প্রফেশনাল হেল্প দরকার। আমি সেটা দিতে পারব। কেউ জানবে না, স¤পূর্ণ গোপন থাকবে ব্যাপারটা। আর তোর থেকে টাকাও আমি নেব না। জাস্ট আমার থেকে থেরাপি নে।”
“আমি এখন যাবো।” পিস্তলটা টেবিল থেকে তুলে নিতে নিতে বলল সাব্বির।
“শুধু তোর গল্পটা বলতেই এসেছিস আমাকে? আমার মতামত শুনতে এসেছিলি এখানে তুই, রাইট?” উঠে দাঁড়াল তামিম, “প্যাসিভ ক্রাইম থিওরিতে বিশ্বাস করে থাকলে তোর উচিত ঋতুকে খুঁজে বের করে চেপে ধরা।”
“আমি প্যাসিভ ক্রাইম থিওরি শোনার জন্য তোর কাছে আসিনি। অনেকদিন কথা হয় না, তাই এসেছিলাম।”
সাব্বিরের ঠা-া চোখের দিকে তাকিয়ে থমকে গেল তামিম। ধীরে ধীরে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেল তার কাছে। ধপ করে আবারও বসে পড়ল চেয়ারে। হঠাৎ যেন বয়েস বেড়ে গেছে দশ বছর।
“প্যারালাল ইউনিভার্সে আমি কি ভূমিকা পালন করছি বলে তোকে বলা হয়েছে?”
পিস্তলটা আলগোছে ধরে আছে সাব্বির। তামিমের দিকে তাক করেনি। “সুইসাইড বম্বার। আজ রাতেই অ্যাটাক করতে যাচ্ছিস পিলখানা সিটিতে। আমাদের বসুন্ধরা সিটির নাম ওখানে এটাই। তোর হোয়্যারঅ্যাবাউটস জানে না ওদের কেউ। তবে ইনসাইড সোর্স এতটুকু বের করতে পেরেছে, আজকের বম্বার তুই।”
“তোর কথা সত্য হলে, আমার বেঁচে থাকা শত মানুষের মৃত্যুর কারণ হবে?”
“হাজার। পুরো বিল্ডিংটা উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা আছে তোদের। টেররিজম খুব ভয়ঙ্কর একটি বিষয়। যত উন্নত বিশ্ব, ততই ভয়ঙ্করভাবে ছড়িয়ে পড়ে এটা। আমেরিকাতে টেররিস্ট অ্যাটাক বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। আমাদের ওয়ার্ল্ডের চেয়ে ওদের ওয়ার্ল্ডে অ্যাটাক একারণেই বেশি হয়।”
“আমাকে যেতে হবে সেজন্য।” মন্তব্য করার ভঙ্গিতে বলল তামিম।
“ইয়েপ। সরি, দোস্ত। তোর সাথে পার্সোনাল কোন সমস্যা আমার নেই। ভাবছিস, এতক্ষণ কেন কথা বললাম? এটাই আমাদের শেষবার দেখা হওয়া। অনেকদিন কথা হয়নি তোর সাথে, দিনগুলো মিস করছিলাম।”
সাব্বিরের পিস্তল ধরা হাতটা উঠে যাচ্ছিল, হঠাৎ নড়ে উঠল তামিম। এক লাথিতে সামনের ডেস্কটা উল্টে দিয়েছে। তারপর ছুটতে শুরু করেছে জানালার দিকে। গ্রিল নেই ওখানে। নিজের অফিসের জানালা বন্ধনমুক্ত হবে এমনটা চেয়েছিল সে। এজন্য জানালা গরাদবিহীন। তিন তলা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়লে বেঁচে যাওয়ার একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা থেকে যায়। ঠিক নিচেই এক হকার ছাউনি ফেলে বসত না? তাতে লাফিয়ে পড়লে উচ্চতা কমে আসবে বিশ ফিটে। কোনভাবে বেঁচে যেতেই পারে তামিম!
মনোবিজ্ঞানী তামিম ইকবালের জীবনের ওটাই ছিল শেষ চিন্তা। জানালার কাছে শরীরটা পৌঁছানোর আগেই হাত তুলেছে সাব্বির। দুইবার গুলির শব্দ হয়েছে শুধু ঘরে। হুড়মুড় করে জানালার সামনেই পড়ে গেল ছোটবেলার বন্ধু। মেঝেতে রক্ত ছড়িয়ে যাচ্ছে ধীরে-ধীরে।
দেহটার কাছে এসে দাঁড়াল সাব্বির। হাতের আঙুল সামান্য নড়ছে এখন শরীরটার। কানের একটু নিচ দিয়ে একটা গুলি ঢুকেছে। পাশ থেকে। বুলেটগুলো হলোপয়েন্ট নয়। ডানহাতের আঙুল দুটো নড়ছে এখনও। প্যারালাল ওয়ার্ল্ডের সুইসাইড বম্বারের জন্য এটা বোলতার কামড়ও হতে পারে। কারণ, বেঁচে আছে তামিম। ভরের নিত্যতার সূত্র মেনে ওপাশের তামিমও বেঁচে থাকবে।
শরীরটা থেকে মাত্র ছয় ইঞ্চি দূরে দাঁড়িয়ে আরও দুইবার গুলি করল সাব্বির।
পরিশিষ্ট
কোন তাড়াহুড়ো নেই। ঠা-া একটা ভঙ্গিতে এসে গাড়িতে ঢুকল সাব্বির। ড্রাইভিং সীটে বসে ছিল মেগান। সাব্বির উঠে বসতেই ওর দিকে এগিয়ে এসে চুমু খেল মেয়েটা। সে রাতের পর থেকে এই কাজে একসাথেই আছে ওরা। গাড়ি ছেড়ে দিল মেগান।
“ঠিকমত শেষ হয়েছে সব কিছু?” জানতে চাইল সে।
“হুঁ।”
“তোমাকে বিষণ্ণ মনে হচ্ছে।”
“হওয়াটা স্বাভাবিক না? তামিম আমার পুরোনো বন্ধু ছিল।”
“ওটা ছাড়াও আর কিছু ভাবাচ্ছে তোমাকে।” পাশ ফিরে তাকাল মেগান, “মন থেকে বের করে দাও তো। খুলে বল আমাকে। অযথা ভেতরে জমিয়ে রাখার কিছু নাই। পর না আমি তোমার।”
একটা সিগারেট ধরিয়েছে সাব্বির। জোরে জোরে টানছে শলাকাটা। তীব্র কটু গন্ধে ভরে গেছে গাড়ির ভেতরটা।
“ওই ইউনিভার্সের সাব্বির আমাকে ভাবাচ্ছে।”
এক হাতে স্টিয়ারিং হুইল ধরে গাল চুলকালো মেগান। “কেমন ভাবাচ্ছে?”
“আমি খুব একটা নীতিবাদী মানুষ না। তোমাকে সবকিছু খুলে বলেছি। ছোটতেও অন্যায় করেছি আমি। আমার বাবার চরিত্রও খুব একটা সুবিধের না। আমার মনে হয়, ভবিষ্যতেও অন্যায় করতে পারি আমি। এই নেশাটা খুবই খারাপ। দুর্নীতির নেশা। আমার মধ্যে আছে বিষয়টা। এর অর্থ, ওই প্যারালালের সাব্বিরকেও ধরতে পারে সেটা।”
“তুমি এখন আগের মত নেই, সাব্বির। নিজেকে ন্যায়ের সৈনিক ভেবেই কাজগুলো করছ। এটা অবশ্যই তোমার ভালো একটা গুণ। আমি বলব, আগে যাই থেকে থাকো না কেন, দিন দিন ইম্প্রুভ হচ্ছে তোমার। ওই জগতের সাব্বিরের ক্ষেত্রেও হয়েছে নিশ্চয়?”
“তাও। ধরা যাক, ওই ইউনিভার্সের সাব্বিরকে দুর্নীতি গ্রাস করে নিল। তাহলে কি দাঁড়াবে ব্যাপারটা বুঝতে পারছ তো? নিজের মন মত টার্গেট দেবে সে। মনগড়া কাহিনী বানিয়ে শোনাবে। আমি সেটাই বিশ্বাস করব। পরীক্ষা করে দেখার তো উপায় নেই আমার। তার কথামত খুন করব মানুষগুলোকে। এই ফাঁকে নিজের আখের গোছাবে ওই ইউনিভার্সের সাব্বির।”
“সেটা যে হবেই, তা তুমি জানো না।” নরম কণ্ঠে বলল মেগান, “অযথা প্যারানয়েডের মত আচরণ করছ। একজন আর-বোটের দায়িত্ব এত সহজ না। চারিত্রিক গুণ না থাকলে তাকে আর-বোট বানানো হত না।”
“সেটাও আমি নিশ্চিত করে জানি না।”
ওর কাঁধে আলতো ঘুষি মারল মেগান। “বাদ দাও। যখনকারটা তখন দেখা যাবে। এখন কোথায় যাচ্ছি আমরা? লাঞ্চ করবে না? সামনে একটা কেএফসি আছে।”
বাইরের দিকে তাকাল সাব্বির। আরেকটা ভয়ঙ্কর সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে হঠাৎ করেই। মেগানকে বলল, “মগবাজার চলো।”
“মগবাজার?”
“ঋতুরা থাকে ওখানে। মেয়েটার সাথে কথা আছে আমার।”
অবাক হলেও আর কোন প্রশ্ন করল না মেগান। এই ছেলেটাকে বিশ্বাস করে সে। তার যে কোন কথা বিনা প্রশ্নে মেনে নিতে মেগানের আপত্তি নেই।
…………………………………………………………………(সমাপ্ত)………………………………………………………….