পূর্বকথা
ঈশ্বর সর্বপ্রথম মানুষ হিসেবে সমুদ্রতলের মাটি হতে অ্যাডামকে সৃষ্টি করলেন। তারপর স্বর্গের সব অ্যাঞ্জেলদের ডেকে তার কাছে নত হতে বললেন। সবাই অ্যাডামের কাছে নত হলেও লুসিফার হল না। সে বলল, “অ্যাডাম মাটির তৈরি আর আমি আগুনের। তবে আমি কেন অ্যাডামের কাছে নত হব?” এই বলে সে স্বর্গ থেকে বেরিয়ে গেল। ওদিকে স্বর্গের একাকিত্ব অ্যাডামের ভালো না লাগায় ঈশ্বর তার জন্য একই মাটি হতে তৈরি করলেন লিলিথ’কে। সঙ্গী পেয়ে অ্যাডাম প্রথমে সুখী হলেও সেই সুখ বেশীদিন টিকল না। কারণ সঙ্গমের সময় লিলিথ নিচে থাকতে চায় না। অ্যাডাম যে মাটির সৃষ্টি সেই একই মাটির সৃষ্টি লিলিথ, তবে লিলিথ কেন সঙ্গমের সময় নিচে থাকবে? এ নিয়ে অ্যাডাম এবং লিলিথের মধ্যে প্রচন্ড ঝগড়া চলল। এক পর্যায়ে রাগ করে লুসিফারের মতো লিলিথও স্বর্গ থেকে বেরিয়ে গেল। এসময় লুসিফারের মাঝেও প্রতিশোধ পরায়ণতা এসে ভর করল। সে ভাবল এই সুযোগ অ্যাডামকে বধ করবার, একমাত্র লিলিথকে দিয়েই যাবে অ্যাডামকে স্বর্গচ্যুত করা। কাজেই সে প্রেমের ফাঁদে আটকালো লিলিথকে। লিলিথও সেই ফাঁদে পা দিয়ে স্বর্গ থেকে বেরিয়ে লুসিফারের কাছেই গেল।
লিলিথকে হারিয়ে অ্যাডাম বিষণ্ন হয়ে পড়েছিল। ঈশ্বর বুঝলেন লিলিথকে ফেরত আনতে হবে। তিনি তিন জন অ্যাঞ্জেলকে এক এক করে পাঠালেন লিলিথের কাছে। কিন্তু লিলিথ তিন জন অ্যাঞ্জেলকেই ফিরিয়ে দিল। এতে তিন অ্যাঞ্জেল লিলিথকে দিল তিন অভিশাপ। আগুনের প্রতি দুর্বলতা, সূর্যালোক সহ্য করতে না পারা আর ভয়াবহ রক্তপিপাসা। এদিকে যখন তিন অ্যাঞ্জেল ব্যার্থ হয়ে ফিরে আসল তখন ঈশ্বর অ্যাডামের জন্য সৃষ্টি করলেন ইভাকে, অ্যাডমেরই পাঁজরের হাড় থেকে। ইভাকে পেয়ে অ্যাডাম লিলিথের কথা পুরোপুরি ভুলে গেল। লুসিফার দেখল লিলিথকে দিয়ে এখন আর অ্যাডামের ক্ষতি করা সম্ভব নয়। তাছাড়া লিলিথ মানুষ থেকে ভ্যাম্পায়ারে পরিণত হয়ে গেছে, তখন লুসিফারও লিলিথকে ত্যাগ করল।
লিলিথের অন্তর্ধানের পর কয়েক সহস্র বছর পেরিয়ে গেল। এই সময়টাতে লুসিফারের প্ররোচনায় ইভার ভুলের কারণে স্বর্গচ্যুত হয়েছে অ্যাডাম-ইভা। পৃথিবীতে তাদের বংশ বৃদ্ধি করেছে, আর তাদের বংশধরেরা গড়ে তুলেছে সাম্রাজ্যের পর সাম্রাজ্য। এমনই একটি সাম্রাজ্য নেফারজান। নেফারজানের রাজা ছিল আর্কিমিস। কোনভাবে এই আর্কিমিস ছিল কেইনের বংশধর। সেই কেইনের বংশধর যে হিংসাবশত নিজের আপন ছোটভাই এবেলের হত্যাকান্ড ঘটায়, যা ছিল অ্যাডাম পুত্রদের মধ্যে প্রথম কোন হত্যাকান্ড। আর
কেইনের বংশধর হিসেবে আর্কিমিসের মধ্যে কিছু কু-প্রবৃত্তি থাকবে তা জানা কথা। একবার তার খেয়াল হল সে কেন শুধু অ্যাডাম পুত্রদের শাসন করবে? যেহেতু স্বর্গের সব অ্যাঞ্জেল অ্যাডামের কাছে নত হয়েছিল সেহেতু তাদের তার কাছেও নত হতে হবে। কিন্তু ঈশ্বর তার এ ইচ্ছার কথা এক কথায় নাকচ করে দিল। এবারে আর্কিমিস নতুন ফন্দি আঁটল। সে লিলিথের উপাসনা করা শুরু করে দিল। যদিও সে নিশ্চিত ছিল না লিলিথ ফিরে আসবে কিনা তবুও সে লুসিফারের চেয়ে লিলিথের উপাসনা করাই শ্রেয় মনে করেছিল। কেননা স্বর্গের অ্যাঞ্জেলদের বধ করার ক্ষমতা লুসিফারের কাছে থাকলেও তাদের শাসন করার ক্ষমতা লুসিফারের ছিল না।
আর্কিমিসের উপাসনার জোরে লিলিথ অন্তর্ধান থেকে ফিরে এসেছিল। ফিরে আসলেও পূর্বের অভিশাপগুলোর জন্য সে তার পুরো ক্ষমতা ফিরে পাচ্ছিল না। এসময় লিলিথ নতুন বুদ্ধি করল। সে নিজেকে একটি ক্রাউনের (মুকুট) খুপুড়িতে আবদ্ধ করল। তারপর সেই ক্রাউন তুলে দিল আর্কেমিসের মাথায়। এতে করে সে আর্কিমিসের দেহ নিয়ে চলাফেরা করতে পারত। আর আর্কিমিসের উপর অভিশাপ না থাকায় দিনের আলোয় বের হওয়াটাও তার জন্য কোন সমস্যা ছিল না। এরপর পার হয়ে গেল আরও লক্ষ বছর। আর্কিমিস অ্যাঞ্জেলদের শাসন করতে সফল হয়েছিল নাকি ব্যার্থ হয়েছিল, সেটি অন্য ঘটনা কিন্তু আর্কিমিস মারা যাবার পর লিলিথ সেই ক্রাউনেই আটকা পড়ে রইল আর লুসিফার ছাড়া এসব আর কেউ জানতে পারল না। লুসিফার ভাবল লিলিথ যদি কোনভাবে ওই ক্রাউন থেকে বের হয়ে আসে তবে লুসিফারের সাথে লিলিথের যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। প্রকৃত অর্থে আর্কিমিসের উপর ভর করে লিলিথ যখন অ্যাঞ্জেলদের সাথে যুদ্ধ করছিল সেসময় লুসিফার লিলিথের ক্ষমতা দেখেই ভীত হয়েছিল এবং সেসময়ই সে বুঝতে পারে লিলিথকে তাড়িয়ে দিয়ে কী ভুলটা সে করেছিল। কিন্তু একবার যখন ভুল করেছেই দ্বিতীয়বার যেন কোন ভুল না হয় সেজন্য খুব সাবধানে সে লিলিথের ক্রাউনটি আগলে রাখতে লাগল। বিভিন্ন হাত ঘুরে ষোড়শ শতাব্দীতে এসে সেই ক্রাউন গেল বৃটিশদের দখলে। তারও অনেক পর সেই ক্রাউনে স্থান হল বিশ্বের সবচেয়ে বড় হীরকখন্ড কোহিনূরের। আর ক্রাউনটির স্থান হল রাণী ভিক্টোরিয়ার মাথায়। কিন্তু লিলিথ পূজারী না হওয়ায় ক্রাউন মাথায় দিয়ে রাজত্ব চালাতে থাকলেও তিনি কিছুই বুঝতে পারলেন না, লিলিথও পারল না রাণী ভিক্টোরিয়ার শরীরের দখল নিতে। অবশেষে বিংশ শতাব্দীতে এসে ক্রাউনটির স্থান হল টাওয়ার অব লন্ডনে।
এক
টাওয়ার অব লন্ডন
স্কুলের বাচ্চাদের নিয়ে মিউজিয়ামের ভেতরে ঢুকল রিচার্ড হ্যামিল্টন। মাস ছয়েক আগে স্কুলের চাকরিটা নিয়েছে সে, ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে। বাচ্চাদের গতকালই রাণী ভিক্টোরিয়া’কে নিয়ে পড়িয়েছে আর আজই সবাইকে নিয়ে এসেছে ক্রাউন অব ভিক্টোরিয়া দেখাতে। লম্বা করিডোর পেরিয়ে যে রুমে ক্রাউনটি রাখা আছে সে রুমে প্রবেশ করতেই শিহরণবোধ করল সে। ক্রাউন অব ভিক্টোরিয়ার জন্য নয়, ক্রাউনটিতে লাগানো হীরকখন্ড কোহিনূরের জন্য। যদিও তার মূল লক্ষ্য কোহিনূর নয় কোহিনূর লাগানো ক্রাউনটিই।
কোহিনূরকে ঘিরে রাখা কাঁচের চেম্বারের চার ধারে চারজন গার্ড দাঁড়িয়ে আছে, এছাড়া রুমের দুই প্রবেশ পথে দুইজন। আসবার সময় করিডোরে দেখে এসেছে আরও দুইজন, ঠিক যেমনটি থাকার কথা। স্কুলের বাচ্চাগুলোর দিকে একবার তাকায় রিচার্ড, সিক্সথ গ্রেডের ছাত্রছাত্রী সবাই। এদের ছাড়া রুমে দর্শনার্থী আছে আরও ছয়জন। এমনটাই চাইছিল সে, সন্দেহটা যেন তার একার উপর না আসে। বাচ্চাদের ক্রাউন অব ভিক্টোরিয়া আর কোহিনূরের ইতিহাস নিয়ে বলতে বলতেই পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা ট্রান্সমিটারের বোতাম চেপে দিল। এর ঠিক দুই সেকেন্ডের মাথায় ঘরটা হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেল। সাথে সাথেই বিদ্যুৎ খেলে গেল
রিচার্ডের শরীরে। ব্যাকআপ জেনারেটর চালু হতে আরও দশ সেকেন্ড লাগবে জানা আছে ওর। এর মাঝেই যা করার করতে হবে। নিজের ব্যাগে হাত দিয়ে দ্রুত হাতে দু’টি ক্লোরোফোর্ম মেশানো স্মোক বম্ব বের করে একটা দরজা দিয়ে বাইরে করিডোরে ছুঁড়ে দিয়ে আরেকটি রুমের ভেতরে ফাটিয়ে দিয়ে দম আটকে ফেলল। তার সাথে সাথেই বিদ্যুত চলে এল কিন্তু ধোঁয়ার জন্য সিসি ক্যামের তখনও অচল। কাঁচ ভেঙে কোহিনূরসহ ক্রাউন অব ভিক্টোরিয়া বের করতেই অ্যালার্ম বেজে উঠল কিন্তু ওকে বাঁধা দেবার জন্য কোন গার্ড এগিয়ে আসল না। ক্লোরোফর্মের কারণে ততোক্ষণে সবাই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। দ্রুত করিডোরে গিয়ে একটা জানালা খুলে নিচের ডাস্টবিন লক্ষ্য করে ক্রাউনটা ছুড়ে দিল সে। তারপর যেখানে দাঁড়িয়ে বাচ্চদের কোহিনূরের ইতিহাস বলছিল সেখানে এসে চেপে রাখা নি:শ্বাস ছেড়ে বড় করে একটা শ্বাস নিল এবং সাথে সাথেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল ।
দশ মিনিট আগে
অভিজ্ঞ হাতে সি-ফোর চার্জারটি ট্রান্সফরমারের নিচে লাগিয়ে দিল রবিন ওয়ার্ডন। তারপর ছুটে এসে রাস্তায় পার্ক করা রাখা সিটি কর্পোরেশনের ভ্যানের ড্রাইভিং সিটে এসে বসল। চাবি ঘুরিয়ে টাওয়ার অব লন্ডনের পাশে নিয়ে পার্ক করতে সময় লাগল নয় মিনিট সাত সেকেন্ড। আসবার সাথে সাথেই জ্যাকেটের বুক পকেটে রাখা এফএম ট্রান্সমিশন রিসিভার ব্লিপ করে উঠল। এক মুহুর্ত দ্বিধা করে রিমোট বের করে সিফোরটি ডেটোনেট করে দিল সে। সাথে সাথেই গত এক যুগে প্রথমবারের মতো একসাথে গোটা লন্ডনের বিদ্যুত সংযোগ বন্ধ হয়ে গেল। এর ঠিক সতেরো সেকেন্ডের মাথায় রাস্তার পাশের ডাস্টবিনে উপর থেকে কিছু একটা এসে পড়ল। দ্রুত ভ্যানের দরজা খুলে সেটা কুড়িয়ে নিয়ে বেমালুম হাওয়া হয়ে গেল সে।
দুই
ইনকামিং কল এ কলারের নাম সোহেল খান দেখে অবাক হল স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের বাংলাদেশি বংশদ্ভূত ডিটেক্টিভ আসিফ রায়হান। ভদ্রলোক ওর মতোই বাংলাদেশি বংশদ্ভূত, কাজ করেন ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসে। ফোন রিসিভ করে কানে লাগাল সে,
“হ্যালো! মাই বয়”
“কেমন আছেন স্যার?”
“থাকতে তো চাই ভালোই কিন্তু তা আর থাকা গেল কই?”
“কেন স্যার? কী হয়েছে?”
“কী হয়নি তাই বল? টাওয়ার অব লন্ডনে চুরি হয়েছে। তাও যে সে চুরি নয়, কোহিনূর।”
“বলেন কী!”
“যা শুনেছ, ঠিক তাই বলেছি। হেলিকপ্টার পাঠিয়ে দিয়েছি, এতক্ষণে বোধহয় তোমার অফিসের ছাদে ল্যান্ডও করে ফেলেছে। চলে এসো জলদি। কোহিনূর উদ্ধারের ক্রেডিট কিন্তু বাঙালিরই হওয়া চাই।”
“ইয়েস স্যার!”
ফোন রেখে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকল আসিফ। তারপর রুম থেকে বের হয়ে ছাদের দিকে পা বাড়াল। ফোনে কথা বলতে বলতেই হেলিকপ্টারের শব্দ পেয়েছে।
স্পটে গিয়ে টাওয়ার অব লন্ডনের সিকিউরিটি ইনচার্জের কাছ থেকে চুরির ডিটেইলস জেনে নিল আসিফ। এর বাইরে, পাহাড়ায় থাকা গার্ডদের কাছে তেমন কিছু জানতে পারল না ও। স্পটে থাকা ছয়জন দর্শনার্থী আর একজন স্কুল টিচার আর তিরিশ জন স্কুল ছাত্রকে হালকা জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেয়া হয়েছে আগেই। ওদের জানানো হয়েছে এয়ার কন্ডিশনিংয়ে সমস্যা থাকায় দূর্ঘটনাটি ঘটেছে। মূল ঘটনা আগেই কাউকে জানাতে চায় না ব্রিটিশ সরকার, কাজেই খুব বেশী জিজ্ঞাসাবাদ করাও সম্ভব হয়নি। স্কুল ছাত্র তিরিশ জনকে বাদ দিয়ে বাকি সাতজনের উপর নজর রাখতে বলে সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে বসল আসিফ। সিসিটিভি ফুটেজ থেকে কিছুই প্রমাণ করা যায় না, কারণ মুল ঘটনার সময় স্মোকবম্ব ব্যাবহার করা হয়েছে তাছাড়া বিদ্যুত চলে যাবার আগমুহুর্তে যে যেখানে ছিল ধোঁয়া সরে যাবার পর সবাই সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে ছিল। তবে একটা নতুন জিনিস আসিফ আবিস্কার করল যা অন্যদের চোখ এড়িয়ে গিয়েছে। করিডোরের জানালাগুলো সবসময় বন্ধ রাখা হলেও ধোঁয়া সরে যাবার পর একটা জানালা খোলা। সিকিউরিটি রুম থেকে এক দৌঁড়ে বের হয়ে করিডরে হাজির হল আসিফ। জানালা দিয়ে নিচে তাকিয়ে যা বোঝার বুঝে নিল।
তারপর ট্রাফিক কন্ট্রোল অফিসে ফোন করে আসেপাশের সবগুলো স্ট্রিটে লাগানো ট্রাফিক ক্যামেরাগুলোর ওই সময়ের ফুটেজ চেয়ে পাঠাল। সব ফুটেজ পাওয়া গেলেও একটা ক্যামেরার ফুটেজ পাওয়া গেল না। টাওয়ার অব লন্ডনের ওই করিডোরের ঠিক নিচের রাস্তার মোড়ের ক্যামেরার ফুটেজ। দু’দিন থেকে ক্যামেরাটা নষ্ট হয়ে আছে। তবে অন্য ফুটেজগুলো থেকে ওই রাস্তায় ওই সময়ে ছয়টা গাড়ি ছিল বলে শিওর হওয়া গেল। তারপর ফোন লাগাল বিদ্যুত সরবরাহ কেন্দ্রে হওয়া বোমা বিস্ফোরণের তদন্তের দায়িত্বে থাকা পুলিশ অফিসারকে। মূলত ঘটনা দু’টো একই সূত্রে গাঁথা হলেও গোপনীয়তার স্বার্থে সেখানে আরেকজন পুলিশ অফিসারকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তার কাছ থেকে বিস্ফোরণের আগের মুহুর্তে সেখানে থাকা তিনটি গাড়ির খোঁজ পাওয়া গেল। এরমধ্যে একটি গাড়ি চুরির সময়টাতে টাওয়ার অব লন্ডনের নিচে ছিল। সিটি কর্পোরেশনের একটি ভ্যান। ভ্যানটাকে বের করার নির্দেশ দিয়ে গোটা বিষয়টা মাথায় সাজিয়ে নিতে লাগল ও।
ভ্যানটাকে পাওয়া গেল সেদিন মধ্যরাতে। টেমস নদীর পাড়ে, লন্ডন শহরের বাইরে। ভ্যানের ভেতর লাশ হয়ে পড়ে আছে ইউনিফর্ম পড়া ড্রাইভার। মাথায় গুলি করা হয়েছে। পেশাদার কারও কাজ, একদম কপালে গুলি করা হয়েছে। গোটা ভ্যান তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আর কোন সূত্র এমনকি হাতের ছাপও পাওয়া গেল না।
আসিফও অবশ্য খুব বেশী আশা করেনি এখানে। সে খুব ভালো করেই জানে, যে অপরাধী কোহিনূর চুরি করতে পারে সে অপরাধী এতো সহজে কোন সূত্র ফেলে যেতে পারে না। ড্রাইভারের লাশটাকে পোস্ট মর্টেম করতে পাঠিয়ে দিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে গেল সে।
তিন
মিউজিয়াম থেকে ছাড়া পেয়ে সোজা বাসায় এসে ঢুকল রিচার্ড। ভালোভাবেই জানে তার উপর কড়া নজর রাখছে পুলিশ। অবশ্য ক্রাউনটা পেয়ে গেলেই সে পেয়ে যাবে লিলিথের শক্তি, তখন তাকে চুরির দায়ে ফাঁসালেও শাস্তি তো দূরের কথা এমনকি ফুলের টোকাও কেউ দিতে পারবে না। দশ বছর, হ্যাঁ দশ বছর ধরে সে এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করে আসছিল। প্রথম পাঁচ বছর কেটেছে তার লিলিথের অবস্থান জানতেই, তাও হাজার রকমভাবে উপাসনা করার পর প্রথম যখন মানুষের বলি দিতে সক্ষম হয় সে তখন স্বপ্নে এসে ধরা দেয় লিলিথ, জানায় তার অবস্থানের কথা।
তারপর আরও পাঁচ বছর লেগেছে তার এই ক্রাউন চুরির প্ল্যান করতে। যদিও সবাই কোহিনূর নিয়ে ব্যাস্ত কিন্তু সে তো শিহরিত ক্রাউনটির কথা ভেবে যার দিকে কেউ মুখ ফিরিয়েও তাকাবে না এখন। এই কোহিনূরের জন্য ক্রাউনটি চুরি করা আরও কঠিন হয়ে উঠলেও শেষ পর্যন্ত এই কোহিনূরের লোভ দেখিয়েই সে রবিন ওয়ার্ডনকে চুরি করবার জন্য রাজি করাতে পেরেছে। বারে মদ খাওয়ার সময় রবিনকে দেখেই সে চিনেছিল আন্ডারওয়ার্ল্ডের দুর্ধর্ষ অপরাধী হিসেবে। বলা যায় লিলিথই তাকে চিনিয়েছিল, স্বপ্নে নির্দেশ দিয়েছিল বারে যাবার। রবিনের সাথে ভাব জমাতে নিয়েছে সে বেশ কয়েক সপ্তাহ্ তারপর পুরো পরিকল্পনা করেছে চুরির। রবিনকে লোভ দেখিয়েছে, চুরির পর কোহিনূর রবিনই পাবে সে শুধু ক্রাউনটা পেলেই খুশি। অবশেষে সেই শুভদিন এসে গেছে, সে হাতে পেতে যাচ্ছে ক্রাউন অব ভিক্টোরিয়া যার ছোট্ট খুপড়িতে ঘুমিয়ে আছে নরকের রাজকুমারী লিলিথ। চাইলে মিউজিয়ামেই ক্রাউনটি মাথায় পড়ে নিয়ে লিলিথের ক্ষমতার অধিকারী হতে পারত সে কিন্তু লক্ষ বছর ধরে কারও রক্ত পায়নি লিলিথ। লক্ষ বছরের এ অসীম পিপাসা কোন সাধারণ মানুষের রক্তে মিটবে না তার। ওর প্রয়োজন হবে কোন শয়তান পূজারীর রক্ত। আর রবিনের হাতে সে লুসিফারের উল্কি আঁকা দেখেছে। রবিনের রক্ত দিয়েই সে লুসিফারের পিপাসা মেটাবে।
অবশ্য রবিনের হাতে প্রথমবার ওই উল্কি দেখে সে প্রচন্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিল। পরবর্তী বেশ কয়েক মাস সে রবিনের হাতে মারা পরবার ভয়ে আতংকিত থেকেছে। কিন্তু যখন দেখতে পেল রবিন কোন সন্দেহই করছে না তখনই পুরো ছকটা সে মনে মনে কষে ফেলল। রবিনকে দিয়ে যেমন একদিকে লিলিথের পিপাসা মিটবে তেমনি নেয়া হয়ে যাবে তাকে এতদিন আতঙ্কগ্রস্ত রাখবার প্রতিশোধও।
প্রচন্ড হাসিতে ফেটে পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে রিচার্ডের কিন্তু একদম শান্ত থাকল সে।
চার
পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট পেয়ে তাজ্জব হয়ে গেল আসিফ। স্নাইপার রাইফেল দিয়ে গুলিটা করা হয়েছিল। সমস্যাটা সেখানে না, সমস্যা হলো বুলেটের কারণে মাথায় গর্তের আকার আর ক্ষত থেকে মনে হচ্ছে গুলিটা অন্তত নয়শো গজ দূর থেকে করা হয়েছে। হঠাৎই পুরো কেসটা পানির মতো সহজ মনে হতে লাগল ওর। নয়শো গজ থেকে হেডশুট করতে পারে এমন স্নাইপার লন্ডন তো দূর গোটা ইংল্যান্ডেও খুব বেশী নেই।
ল্যাপটপ অন করে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ডাটাবেজ চেক করতে শুরু করে দিল ও। সারাদিন পার করার পর এমন হাই স্কিলড সাতজন স্নাইপারকে খুঁজে পেল ও। এদের মধ্যে দু’জন জেলের ঘানি টানছে তাদেরকে বাদ দিয়ে থাকল আর পাঁচজন। এবার এই পাঁচজনের তালিকা নিয়ে সে হাজির হলো সোহেল খানের কাছে।
আসিফকে দেখেই ভদ্রলোকের দাঁত বেরিয়ে পড়ল।
“এসো আসিফ, এসো। কেস সলভড নিশ্চয়ই?”
“ছোট্ট সাহায্যের জন্য এলাম। সাহায্যটুকু করলে সলভ হতে আর বেশী দেরী নেই।”
“নিশ্চয়ই..নিশ্চয়ই। কী সাহায্য চাও বলে ফেল”
“পাঁচজন স্নাইপারের ডিটেইলস লাগবে। স্পেশালী এখন কোথায় আছে সে বিষয়ে।”
“চুরির সাথে স্নাইপারের সম্পর্ক বের করে ফেলেছ। বড়ই আচানক বিষয়।”
“আছে স্যার। বড় গভীর সম্পর্ক আছে। এতোই গভীর সম্পর্ক যে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ডাটাবেজে কুলাল না, সিক্রেট সার্ভিসের দ্বারস্থ হতে হল।”
“তা, সিক্রেট সার্ভিস যদি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের দ্বারস্থ হয় তো ওদের এখানে আসতে দোষ কী?”
কথা আর না বাড়িয়ে ডেস্কে রাখা কম্পিউটারের কী বোর্ডের উপর ঝড় তুললেন তিনি। তারপর পাঁচজনের সম্পর্কে যা যা পেয়েছেন বলে গেলেন।
“প্রথমজন, বহিনস্কি জাহদভ। এক্স কেজিবি, তিন সপ্তাহ যাবত গুলি খেয়ে হাসপাতালে। দ্বিতীয়জন, উইলিয়াম ব্রুস, মাফিয়া ডন। কলাম্বিয়া গেছে দু’মাস হল। তৃতীয় আর চতুর্থজনকেও স্কিপ করে যেতে পার, গত এক সপ্তাহে এরা লন্ডনের আশেপাশেও ছিল না। কিন্তু পঞ্চমজন, রবিন; গত দু’দিন আগে শেষবার দেখা গেছে সিটি কর্পোরেশনের পাশের মেট্রোরেলে। তারপর থেকে নি:খোঁজ। হি ইজ ইয়োর ম্যান, আই অ্যাম ড্যাম শিওর।”
“আই হোপ সো।” হাসি ফুটল আসিফের মুখে। “এবার এই রবিনের সাথে এ সাতজনের যে কারও সম্পর্ক বের করুন তো।” চুরির সময় টাওয়ার অব লন্ডনের ভেতরে থাকা দর্শনার্থীদের নামগুলো বলে গেল ও।
আবার কাজে লেগে পড়লেন সোহেল খান। এবার অনেক বেশী সময় লাগল। সাড়ে তিন ঘন্টা। এর মাঝে কারও কোন কথা হল না। খুঁজে পেতে নামটা আসিফকে জানালেন তিনি, রিচার্ড হ্যামিল্টন। ওর সাথে বেশ কয়েকদিন রবিনকে বারে দেখা গেছে। ধন্যবাদ বলে আসিফ বের হয়ে আসল সোহেল খানের অফিস থেকে।
মাঝরাত হয়ে গেছে, এখনই একবার রিচার্ডের সাথে দেখা করে যাবে কি না ভাবতে না ভাবতেই ফোন বেজে উঠল আসিফের। রিচার্ডের উপর যে পুলিশ ইনফর্মারের নজর রাখার কথা ছিল তার। কিন্তু রিসিভ করে কোন কথা শুনতে পেল না আসিফ তারপর হঠাৎ দুপ করে একটি শব্দ করে ফোন কেটে গেল।
এক মুহুর্ত দেরী না করে নিজের সেডানে চেপে বসে রিচার্ডের বাসা লক্ষ করে ঝড়ের গতিতে ড্রাইভ করে গেল ও। ডাউনটাউনে একদম নিরিবিলি একটি জায়গায় রিচার্ডের বাসা। বাসাটা থেকে এক ব্লক দূরে গাড়ি থামিয়ে বাসার পেছন ঘুরে এগুতে লাগল ও। কয়েক কদম এগিয়েই ইনফর্মার লোকটির লাশ দেখতে পেল ও। সেই স্নাইপার হেডশুট। মোবাইলটা একটু দূরে পাথরের উপর পড়ে কয়েক টুকরো হয়ে আছে।
জ্যাকেটের ভেতর হাত ঢুকিয়ে নিজের গ্লক সেভেন্টিন পিস্তলটা বের করে কয়েক প্যাঁচ দিয়ে সাইলেন্সার লাগিয়ে অন্ধকার হয়ে থাকা রিচার্ডের বাসার ভেতর একটা জানালা দিয়ে ঢুকে পড়ল ও। কিন্ত সবগুলো রুম খুঁজেও কাউকে দেখতে না পেয়ে শেষে গ্যারেজে এসে উঁকি দিল। কিন্তু যা দেখতে পেল তা কখনোই আশা করেনি ও। গ্যারেজের ফ্লোরে লিলিথের চিহ্ন অর্ধচন্দ্রের নিচে ক্রুশ আঁকা। তার ঠিক উপরেই রাখা আছে কোহিনূর লাগানো ক্রাউন অব ভিক্টোরিয়া। পাশেই হাত পা বেঁধে রবিনকে ফেলে রাখা হয়েছে।
পরপর দু’টি গুলি করা হল। প্রথমটি রিচার্ডের রিভলভার থেকে বের হয়ে রবিনের প্রাণবায়ু নিয়ে বেরিয়ে গেল। দ্বিতীয়টি বের হল আসিফের গ্লক থেকে, পেছন থেকে ছিন্নভিন্ন করে দিল রিচার্ডের মগজকে।
পরিশিষ্ট
তিনদিন পর সোহেল খানের কাছে একটি পার্সেল আসল, সাথে একটি চিরকুট।
স্যার,
বাঙালি হিসেবে যে প্রত্যাশাটা আপনার ছিল সেটা আপনাকে দিয়েই পূরণ হোক। কোহিনূর খুঁজে পাবার ক্রেডিটটা আপনারই হওয়া উচিত। ক্রাউন অব ভিক্টোরিয়া ফেরত দিতে পারলাম না বলে দু:খিত।
শ্রদ্ধা
আসিফ রায়হান
ডিটেক্টিভ
স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড
স্মৃতিতে হাজারবার হাতড়েও আসিফ রায়হান নামে কাওকে চেনেন বলে মনে করতে পারলেন না সোহেল খান। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড খোঁজ নিয়ে সেখানেও আসিফ রায়হান নামে কোন ডিটেক্টিভ নেই এবং কখনও ছিল না শুনে শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়ে বাড়ি ফিরে পার্সেলটা মিউজিয়ামে ফেরত পাঠাবার সময় হঠাৎ আবার চিরকুটটার উপর নজর পড়ল তার। সেখানে আসিফ রায়হানের নাম কেটে অন্য একটা নাম লেখা হয়েছে – লুসিফার।
……………………………………………………………….(সমাপ্ত)………………………………………………………