চারদিকে প্রচন্ড ঝড় হচ্ছে।ধূলোর ঝড়। সোনালী ধূলিকণা কান আর মুখে ঢুকে বেশ নাজেহাল অবস্থা হয়েছে আমার। শুধু চোখদুটো দুহাতে ঢেকে কিছুটা নিরাপদে রেখেছি। আমি এখন কোথায় আছি আন্দাজ করতে পারছিনা।শুধু তাইনা,আমি কে সেটাও মনে পড়ছে না!মাথার একপাশ ভারী হয়ে আছে।পুরো শরীরজুড়ে ব্যথা। আশেপাশে বালুকারাশির কুণ্ডলী দেখে মনে হচ্ছে মরুভূমিতে আছি। তাই যদি হয় তবে সাইমুম ঝড়ের কবলে পড়েছি এটা নিশ্চিত। বাতাসের প্রচন্ড শনশন শব্দ ধুলোবালির সাথে কানের একেবারে ভেতরে ঢুকে পড়ছে।গলার ভেতরেও বালি ঢুকেছে বলে মনে হলো।ভেতরটা খচখচ করছে। একইসাথে ক্ষুধা আর পানির তেষ্টা অনুভব করলাম।যদিও এই ধূলোর রাজ্যে এসব ভাবাটাই পাপ।
আচ্ছা এখন কি সন্ধ্যা?কোথাও আলোর ছিটেফোঁটা ও নেই। চোখদুটো সাবধানে খোলার পর বালির ঝড় ছাড়া কিছুই দৃষ্টিগোচর হলোনা।সাবধানে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করলাম।যদি কিছু দেখা যায়।কিন্তু দাঁড়াতেই মনে হলো সমস্ত শরীরের মাংসপেশি গুলো যেন একটানে কেউ ছিঁড়ে নিলো। যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠলাম। আবার বসে পড়তে হলো বালিতে।
মরুঝড় থামার কোন লক্ষণ দেখছিনা।এই প্রচন্ড ঝড়ের তান্ডবে আমি যে এখনো অন্য কোথাও উড়ে চলে যাইনি সেটাই আশ্চর্যের বিষয়। নিজের মনকে অনেক করে বোঝালাম যে বেঁচে থাকতে হলে আমাকে উঠে দাঁড়াতে হবে তারপর নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে বের করতে হবে। নইলে এই ধুলোর আস্তরনের নিচেই কবর হয়ে যাবে আমার।দ্বিতীয়বার দাঁড়ানোর পর মাথাটা একবার চক্কর দিয়ে উঠলো। আমি যেন আমার মাথার ওজন অনুভব করতে পারছি। এই অনুভূতিটা মোটেই সুখকর নয়। আরেকটা ব্যাপার হলো। আমার কাধে যে একটা ঝোলা আছে সেটা বুঝলাম এতক্ষণে।সোজা হয়ে দাঁড়াতেই সেটা পিঠের ওপর ঝুলে পড়েছে।
মোটামুটি ভারী ঝোলাটা। পিঠের ওপর পড়াতে মনে হলো বড় আকারের হাতুড়ী হাতে নিয়ে কেউ শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত করেছে আমায়। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করলাম সেই আঘাত। তবুও আশা হলো ঝোলার মধ্যে হয়তো এমন কিছু আছে যেটা দেখলে আমি কে আর কেনইবা এই মরুভূমিতে অসহায়ের মত পড়ে আছি সেটা জানা যাবে।
এবার সামনে এগিয়ে যেতে হবে। দু একপা এগিয়ে যেতেই ডান পা টা কিসের সঙ্গে যেন আটকে গেলো। তাকিয়ে দেখি ডান পায়ের হাটু অবধি একটা নীল দড়ির মত কিছু একটা পেচানো রয়েছে।সেটার অন্যপ্রান্তে সম্ভবত ভারী কিছু একটা বাঁধা রয়েছে। আমি কয়েকপা এগুতেই দড়িতে টান পড়েছে তাই। পা থেকে দড়ির গিটটা আলগা করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু এই সামান্য শক্তিটুকুও যেন নেই আমার। অনেক চেষ্টা করেও যখন কোন ফল হলোনা তখন অগত্যা দড়িটাকে নিজের কাছে গুটিয়ে নিতে শুরু করলাম। ওপারে বাঁধা জিনিসটা শুকনো বালির ওপর দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো আমার দিকে। যখন একেবারে পায়ের কাছে এসে ঠেকলো তখন আবার বসে পড়লাম বালিতে। হাত বুলিয়ে পরীক্ষা করতে লাগলাম ওটাকে। জিনিসটার ওপরের দিকটা ঢেউখেলানো। হাতে নিয়ে বোঝা গেলো সেটা চামড়ার তৈরি। ওটাকে উল্টিয়ে রাখতেই একটা অদ্ভুত ব্যাপার চোখে পড়লো।
উল্টো করে রাখাতে জিনিসটার ঢেউ খেলানো অংশটা স্বাভাবিকভাবেই উঁচু হয়ে উঠেছে। আর সে জায়গায় খাপের মত একটা অংশে একটা অদ্ভুতভাবে বাঁকানো ছুরির মত দেখতে অস্ত্রজাতীয় কিছু একটা গুঁজে রাখা হয়েছে। বেশ অবাক হলাম যখন দেখলাম সেই ছুরির মত অস্ত্রটা একবার করে জ্বলছে আর নিভছে! আসলে কি ওটা?হাতে ধরে দেখবো নাকি? এমনিতেই ভয়ানক বিপদের মধ্যে আছি। ওটা ধরলে যদি নতুন কোন বিপদ ঘটে যায় তখন কি হবে?তাছাড়া অস্ত্রটার চকচক করতে থাকা সূচালো ডগা দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে মারাত্মক ধারালো ওটা। ধরতে গিয়ে যদি রক্তপাত শুরু হয় তবে ঝড়ের বদলে রক্তক্ষরণেই মারা পড়বো আমি।
কিন্তু নাহ!কৌতুহল দমন করে রাখতে পারলাম না। বিপদের আশঙ্কা ভুলে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলাম অস্ত্রটার দিকে।আর হাতের আঙুলগুলো যখন অস্ত্রটাকে স্পর্শ করলো ঠিক তখুনি যেন আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বজ্রপাত হলো ঠিক আমার ওপর। তড়িতাহত আমি ছিটকে পড়লাম প্রায় একশগজ দূরে। অন্য কেউ হলে হয়তো বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হবার সাথে সাথেই মারা যেত।
কিন্তু কোন এক বিস্ময়কর কারণে আমার জন্য ব্যপারটা উল্টো হয়ে গেছে।তড়িতাহত হবার পর অস্বাভাবিকভাবে শরীরটা ঝরঝরে হয়ে গেছে!মাথার ভারী হয়ে থাকা ভাবটা কমে গেছে।যে ক্ষুধা আর তেষ্টা এতক্ষণ ভোগাচ্ছিল সেটাও এখন নেই বললেই চলে। ধূলোর ঝাপটা আর গায়ে লাগছেনা। যেন কোন অদৃশ্য বলয়ের ভেতরে আটকা পড়ে গেছি আমি। এই মরুঝড় সেই বলয় ভেদ করতে পারছেনা।তখনো বুঝিনি আমার বিপদ সবেমাত্র শুরু হয়েছে!ঐ বলয়টা ছিলো বৈদ্যুতিক বলয়। আর সেটা ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছে আমাকে গ্রাস করে ফেলার জন্য!কে জানাবে সে কথা?
আমার সাথে সাথে চামড়ার বস্তু আর তাতে গুঁজে রাখা অস্ত্রটাও ছিটকে এসেছে । আমার কাছ থেকে তিন চার হাত দূরে পড়ে আছে ওগুলো। আমি শরীরের ধূলো ঝাড়তে ঝাড়তে আবার এগিয়ে গেলাম সেগুলোর দিকে । আর তখুনি বিদ্যুতের একটা ঝলকের মত সব মনে পড়ে যেতে লাগলো। নিজেকে চিনতে পেরেছি এতক্ষনে। আর কেন এই মরুভূমি তে পড়ে ছিলাম তাও স্পষ্ট মনে পড়ে যাচ্ছে। আমার সামনের ঐ জিনিসটা আসলে ঘোড়ার পিঠে পড়ানোর জিন।আর যতটুকু মনে পড়েছে এটা যেনতেন কোন ঘোড়ার জিন নয়। এটা ইতিহাসখ্যাত উড়ন্ত ঘোড়া পেগাসাস এর পিঠে স্থাপন করা জিন। জিনের নিচে রাখা ছুরিসদৃশ ঐ বস্তুগুলো আসলে বজ্র নিক্ষেপ করার ফলা। বজ্রদেবতা জিউস এই পেগাসাসের মাধ্যমেই বজ্রের ফলাগুলি বহন করতেন।
ব্যাপারটা খুলেই বলি। প্রথমে আমার পরিচয় দিয়েই শুরু করছি। আমার নাম এরোস। গ্রীক ভালোবাসার দেবতা এরোস এর নামে আমার নাম রেখেছিলেন বাবা মা।কারণ আমি ছিলাম তাদের অতি আদরের একমাত্র সন্তান। গ্রীসের অলিম্পাস পর্বতের পাদদেশে একটা গুপ্ত গ্রাম পেগাসোনিয়ায় থাকতাম আমরা। আমাদের গ্রাম টা ছিল আমার চোখে দেখা সবচেয়ে সুন্দর জায়গা। এই অলিম্পাসেই একসময় ১২ জন দেবতা বসবাস করতেন। তারাই আশীর্বাদ হিসেবে আমাদের এই গ্রামে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। নাম দেন পেগাসোনিয়া।পেগাসোনিয়া নামটা বোধহয় এসেছে পেগাসাস থেকে। কারণ অলিম্পাসে রাজত্ব করার সময় একদিন গ্রামের ঠিক মাঝামাঝি একটা বড় মাঠের মধ্যে বজ্রদেবতা জিউস স্থাপন করেছিলেন তার বজ্রফলা বহনকারী ডানাযুক্ত ঘোড়া পেগাসাসের বিশাল মূর্তি। অনেকেই বলে জিউসের কথা অমান্য করার জন্য নাকি অভিশপ্ত হয়েছিল পেগাসাস । তাই জিউস তাকে শাস্তিস্বরুপ পাথরে পরিণত করে দেয়। গ্রামের মাঝখানে স্থাপন করা পেগাসাসের মূর্তিটাই নাকি শাস্তিপ্রাপ্ত আসল পেগাসাস।শাস্তির মেয়াদ শেষ হলে নাকি আবার জেগে উঠবে সে। আমি ছোটকাল থেকেই আশায় আছি কবে পেগাসাস আবার আগের রুপ ফিরে পাবে।
স্বর্গে ফিরে যাবার আগে দেবতারা আমাদের সতর্ক করে দেন যে কয়েকহাজার বছর পর অলিম্পাসের বাইরের পৃথিবী তে “মানুষ “নামের এক প্রানীর আধিপত্য বেড়ে যাবে। যারা আমাদের মত প্রাণীদের হাতের নাগালে পেলেই বন্দী করে আটকে রাখবে খাঁচায়। অসহায় পাখির মতো করে। তাই এই গ্রামের বাইরে কোথাও যেন না যাই আমরা। দেবতারা স্বর্গে চলে গেছেন অনেক আগেই।
গ্রামের প্রবীণদের কাছে শুনেছি দেবতাদের প্রস্থানের পর দুহাজার বছরের মধ্যেই তাদের করা ভবিষৎবাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে।” মানুষ” নামক প্রাণী নাকি পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। একজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম মানুষ আসলে দেখতে কেমন? উত্তরে তিনি নরম মাটিতে রঙের গুঁড়ো ছড়িয়ে মানুষের একটা প্রতিকৃতি এঁকে দেখিয়েছিলেন আমায়।তারপর চমৎকার একটা বর্নণা দিয়েছিলেন মানুষের।আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলেছিলেন যে তিনি নাকি সব নিষেধ অমান্য করে গ্রামের বাইরে গিয়েছিলেন। আর তখনি দেখতে পান সত্যিকারের মানুষকে!বেশ অবাক হয়েছিলাম সেটা শুনে।প্রতিকৃতি দেখে বুঝেছিলাম আমাদের আর মানুষের মধ্যে বলতে গেলে তেমন কোন পার্থক্যই নেই।শুধু দুটো জায়গায় ভিন্নতা আছে। সেটা হলো আমাদের কাঁধ আর পিঠের মাঝামাঝি জায়গায় বসানো দুটো বিশাল ডানা আর উজ্জ্বল সবুজ বর্নের চোখের মণি।
ডানাদুটো এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় উড়ে যাবার জন্য ব্যবহার করি আমরা।আর সবুজ চোখ থাকায় নিশুতি রাতেও স্পষ্ট দেখতে পাই সবকিছু। এই স্বাভাবিক ক্ষমতা নাকি নেই মানুষের।মানুষের জগতে আসার পরেও ওদের সম্পর্কে বেশী কিছু জানতে পারিনি। শুধু এটুকু বুঝেছি যে চরম স্বার্থপর আর নিষ্ঠুর ওরা।
একসময় বাবার মুখে শুনেছিলাম অলিম্পাসের বাইরের দুনিয়ার মানুষের আনাগোনা হয় এমন অদ্ভুত সব জায়গার কথা। পাহাড় চিনতাম কারণ আমাদের গ্রামের ওপরেই মাথার কাছেই অলিম্পাসের চূড়া ছিলো। কিন্তু গ্রামের আশেপাশে কোথাও মরুভূমি বা সমুদ্র ছিলনা।এই দুটো জায়গা যে থাকতে পারে তাও জানতাম না। আমাদের গ্রামে পুকুর ছিলো অনেক। রংবেরং এর জল ছিলো সেগুলো তে। একেকটার জল একেকরকম ঠান্ডা,কি মিষ্টি তার স্বাদ ।সবচেয়ে বড় পুকুরটা দেখিয়ে বাবাকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম এর চেয়ে বড় জলাধার আর কোথাও আছে কিনা। বাবা তখন গল্পের ছলে জানিয়েছিলেন মানুষের দুনিয়ার সমুদ্রের কথা যার জল নাকি লবণাক্ত।যাতে ভয়ংকর সব প্রাণীর বাস। আরো বলেছিলেন বালির সমুদ্র মরুভূমির কথা যেখানে সাইমুম নামক ভয়ানক ঝড় হয়। যার কবলে পড়লে কেউ বাঁচতে পারেনা।
যে গল্পগুলো শুনলে একসময় রোমাঞ্চিত হতাম আজ সেই গল্পের জায়গায় আমি আটকা পড়ে আছি। পিঠের ঝোলা খুলে ফেলেছি এতক্ষনে।তার ভেতরে আমার পিঠের ডানাদুটো খুঁজে পেলাম। নিষ্ঠুর মানুষগুলো নির্মমভাবে আমার পিঠ থেকে কেটে নিয়েছিল ওগুলো। কিভাবে তা বলছি। মানুষের জগতে আমি এসেছিলাম ভাগ্যের ফেরে।আমার ইচ্ছে যে একেবারে ছিলনা তা নয় কিন্তু সুযোগটা তৈরি হয়েছিল পেগাসোনিয়ার মাঠে স্থাপন করা ঐ পেগাসাসের মূর্তিটার পাশে বসে থাকার ফলে।প্রায়ই বসে থাকতাম নির্জন ঐ জায়গাটাতে।হাতে থাকতো পালকের কলম,কালি আর কাগজ। বসে বসে পেগাসাসের ছবি আঁকতাম আপনমনে। মাঝে মাঝে মূর্তিটায় হাত বুলিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতাম আর ভাবতাম কবে আবার জেগে উঠবে পেগাসাস!
কোন এক সন্ধ্যায় পেগাসাসের মূর্তির পাশে বসে ছিলাম একা।সেদিন কেন জানি পেগাসাসের বদলে তার উলটো দিকে থাকা গ্রামের ছবি আঁকছিলাম। হঠাৎ ঘোড়ার চিঁহি ডাক শুনতে পেলাম পেছন থেকে। অবাক হয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখি পেগাসাসের পাথুরে মূর্তিটার পাথরের আস্তরণ আস্তে আস্তে ভেঙে যাচ্ছে আর বেরিয়ে আসছে অভিশাপ মুক্ত হওয়া উড়ন্ত ঘোড়া পেগাসাস। পাথরের আবরণ থেকে বেরিয়ে আসতেই পেগাসাস তার বিশাল ডানাদুটো মেলে একপাক ঘুরে এলো আকাশে তারপর বলা নেই কওয়া নেই আমায় এক ঝটকায় পিঠে তুলে নিয়ে ছুটলো অলিম্পাসের চূড়ার দিকে। আমার কোলে থাকা কাগজ,কলম আর কালির দোয়াত উঠে এলো আমার সাথেই। ওগুলো কে কোনমতে জামার ভেতরে ঢুকিয়ে রাখলাম। চোখমুখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে বসে রইলাম পেগাসাসের পিঠে। কিন্তু ও যখন আমায় নিয়ে উড়তে উড়তে পেগাসোনিয়ার বাইরে নিয়ে এলো তখন ভয় করতে শুরু করলো। নিজের ডানাদুটো শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ঝাপটানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোন লাভ হলো না।
পেগাসাসের পিঠে বসার কারনেই কিনা জানিনা,ভয়ার্ত চোখে দেখলাম আমার ডানাগুলো অকেজো হয়ে গেছে।
এখন ও যেখানে যাবে আমাকেও সেখানেই যেতে হবে। নিজের মত করে পেগাসোনিয়ায় উড়ে চলে যেতে পারবোনা আমি। ভয়টা ক্রমশ বাড়তে থাকলো। আমি যতটুকু উচ্চতায় উড়তে পারি পেগাসাস তার দ্বিগুন উচ্চতায় আমায় নিয়ে উড়ে চলেছে। যখন দেখলাম যে আমার আর কোন উপায় নেই তখন ধীরেধীরে ভয়টাও কেটে যেতে লাগলো। মেঘের ভেলার কাছ দিয়ে উড়ে যাবার সময় ঝিরঝিরে বাতাসে মনটা প্রফুল্ল হয়ে গেলো। সমুদ্রের ওপরে উড়ে চলল পেগাসাস। কতবড় জলাধার! না দেখলে বিশ্বাস ই হতো না।তারপর হুট করে নিচের দিকে মুখ করে নামতে শুরু করলো ওটা।
ভাবলাম সমুদ্রের ভেতরে ঢুকে যাবে নাকি? পরে দেখলাম জলের ওপর খুর দিয়ে আলতো ছোঁয়া দিয়ে আবার উড়ে চললো সে। তারপর বাক নিলো স্থলভূমির দিকে। এবার ওর ওড়ার উচ্চতা কমে এসেছে।আর এটাই ছিলো ওর মারাত্মক ভুল। চারদিকে অন্ধকার নেমে এসেছিল তাই সামনের কালো উঁচু দেয়াল সে দেখতে পায়নি। ফলে অল্পের জন্য আমরা দেয়ালের সাথে মুখোমুখি ধাক্কা খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়লাম দেয়ালের ওপারে।
কোথায় এসে পড়লাম বুঝতে পারিনি।পড়ে গিয়ে প্রচুর ব্যথা পেয়েছি দুজনেই। উঠে বসতে পর্যন্ত পারছিনা। শুয়ে শুয়েই দেখতে লাগলাম
কোত্থেকে যেন কিম্ভুত পোষাক পড়া কিছু আমাদের মতই দেখতে প্রাণী হুড়মুড় করে এগিয়ে এসে ঘিরে দাঁড়ালো। কাছে আসতেই বুঝলাম এরা মানুষ। পিঠে ডানা নেই। চোখে কি যেন একটা আবরণ থাকায় মনি দুটো দেখা যাচ্ছেনা। মানুষ বলতে আমরা অতটুকুই চিনি। ওরা আমাদের ঘিরে নির্বাক হয়ে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর ওদের একজন দুর্বোধ্য ভাষায় কি যেন বলল। দেখলাম ওদের মধ্যে দুজন সেই কথা শুনে দৌড়ে চলে গেলো কোথায় জানি তারপর হাতে একটা দড়ি দিয়ে তৈরি জিনিস নিয়ে ফিরলো কিছুক্ষনের মধ্যেই। তারপর আচমকা সেটা ছুড়ে দিলো আমাদের ওপর। সেই বস্তু গায়ে পড়া মাত্র শরীর অবশ হয়ে গেলো। জ্ঞান হারালাম তৎক্ষণাৎ।
যখন জ্ঞান ফিরলো তখন দেখলাম একটা খাঁচায় বন্দি করা হয়েছে পেগাসাস কে। ও ক্রমাগত খাঁচার দরজায় খুর দিয়ে আঘাত করছে ছটফট করে যাচ্ছে। আমাকে বেঁধে রাখা হয়েছে। পিঠে মারাত্মক যন্ত্রনা হচ্ছে । প্রথমে ভেবেছিলাম ওপর থেকে আছড়ে পড়ায় ব্যথাটা এখনো রয়ে গেছে। কিন্তু আমার দৃষ্টি যখন সামনে বসে থাকা মানুষটার দিকে গেলো তখন প্রচন্ড ঘৃণা আর বিতৃষ্ণায় মনটা বিষিয়ে উঠলো । ঐ লোকটার এক হাতে আমার পিঠ থেকে কেটে নেওয়া ডানাদুটো রাখা আছে ।আমার দিকে নিষ্ঠুরভাবে তাকিয়ে আরেক হাত দিয়ে সেগুলোতে হাত বুলাচ্ছে জানোয়ার টা।আমি আর কোনদিন উড়তে পারবোনা তাহলে?
পেগাসোনিয়ায় ফিরে যেতে পারবো কি কোনদিন? আজ রাতে যখন বাবা মা আমাকে খুঁজে পাবেননা তখন তাদের মনের অবস্থাটা কি হবে?তারা তো চিন্তাই করতে পারবেনা যে তাদের সন্তান কোথায় হারিয়ে গেছে! ওরা আমায় মেরে ফেললেও বোধহয় এত আফসোস হতোনা। নিজের ভাগ্যকেই দোষ দিতে লাগলাম। কেন যে পেগাসাসের মূর্তির কাছে বসে ছিলাম।
হঠাৎ চারপাশে হইচই শোনা গেলো। কি হয়েছে বোঝা যাচ্ছেনা। পেগাসাসের খাঁচার দিকে তাকাতেই দেখি সেটা খালি। চোখের পলকে উধাও হয়ে গেছে ও।আর মানুষগুলো এই নিয়েই ছুটোছুটি শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু কোথায় গেলো পেগাসাস?ও কি আমাকে ছেড়েই পালালো। না এরকম তো হওয়ার কথা নয়। আমার ধারনাই সত্যি। মানুষগুলো যখন পেগাসাস কে খুঁজতে আমার ঘর থেকে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলো তখন খাঁচার ভেতরেই দৃশ্যমান হলো পেগাসাস।তারমানে এতক্ষণ অদৃশ্য হয়ে ছিল! এবার ওর জিনের নিচে রাখা বজ্রফলা দিয়ে বিদ্যুতস্ফুলিঙ্গ তৈরি করে খাঁচা টাকে দু ভাগ করে ফেলে বেরিয়ে এলো। তারপর দাঁত দিয়ে আমার বাঁধন খুলে দিলো। আমার ডানাগুলো সামনের বসার জায়গাটাতে রাখা ছিলো। পাশে পড়ে ছিলো একটা ঝোলার মত জিনিস। তার ভেতর ঝটপট তুলে ফেললাম ওগুলো।তার চেপে বসলাম পেগাসাসের পিঠের ওপর।
পেগাসাস সঙ্গে সঙ্গে উড়ে চললো আমায় নিয়ে। ঐ এলাকা ছেড়ে বেরুবার সময় মানুষের দলের চোখে পড়ে গেলাম। ওরা কি যেন একটা উড়ন্ত বাহনে করে আমাদের পিছু নিলো।পেগাসাস প্রানপনে ডানা ঝাপটে উড়ে চললো সামনের দিকে। কিন্তু কিছুদূর যেতেই প্রবল মরুঝড় সাইমুমের কবলে পড়ে গেলাম আমরা। পিছে থাকা মানুষের দলে আর এগুতে পারলো না। কিছুক্ষণ পর তাদের সাড়াশব্দ পেলাম না আর।শুধু মরুঝড়ের শোঁ শোঁ শব্দ পাচ্ছি। আচমকা ওদের দিক থেকে আগুনের গোলার মত কিছু একটা উড়ে এলো আমাদের লক্ষ্য করে। সেটা আঘাত হানলো পেগাসাসের একটা ডানায়। ফলে ও হেলে পড়লো আর আমি ওর পিঠ থেকে সোজা পড়ে গেলাম বালিতে । এরপর আর একবারের জন্যেও দেখা পাইনি পেগাসাসের।
সেই থেকে পড়ে আছি এই মরুভূমি তে। বজ্রফলা ধরার পর আমার আশেপাশে যে বলয় তৈরী হয়েছিল সেটা বৈদ্যুতিক বলয় সেটা আগেই বলেছি। সেই বলয় এখন আমাকে প্রায় ঘিরে ফেলেছে। ওটা দেহের সংস্পর্শে আসামাত্র আমি মারা পড়বো। যদিনা পেগাসাস বাইরে থেকে অন্য একটা ফলা নিয়ে বলয়টাকে আঘাত করে। ধীরে ধীরে মৃত্যুর প্রহর গুনছি। শরীরটা আবার অবশ হয়ে এসেছে । আমি কান পেতে আছি পেগাসাসের কন্ঠে শেষ চিঁহি ডাকটা শোনার জন্য!
এতটুকু পড়ার পর বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক জ্যাক মার্টিনের বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। ডানাওয়ালা একটা অজানা প্রাণীর শেষ সময়টা কতইনা কষ্টে কেটেছে।অল্প যেটুকু সময় সে মানুষের সংস্পর্শে ছিলো সেসময় সে মানুষের নিষ্ঠুরতাই দেখতে পেয়েছে শুধু ।মানুষের ভালো রুপটা সে আর কোনদিন ই জানতে পারবে না।প্রানীটা তার জামার ভেতরে রাখা পালকের কলম দিয়ে অগোছালো ভাবে লিখে ফেলেছিল পুরো ঘটনা টা।সেই লেখা মার্টিন কুড়িয়ে পেয়েছিলেন সাহারা মরুভূমিতে অভিযানের সময় । তারপর পুরো পাঁচ বছর গ্রীক মিথলজী নিয়ে ঘাটাঘাটি করার পর লেখার অর্থ বের করতে পেরেছেন। তার মনে এখনো প্রশ্ন জাগে
পেগাসাস কি শেষপর্যন্ত ফিরে এসেছিল এরোস এর কাছে? নাকি কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে এরোসের মতই?
……………………………………………………….. (সমাপ্ত) ………………………………………………………