পারস্যের ইসপাহান পর্বতমালার পিছনে সবুজ শহর। এখানকার সুলতান সুলেমান শাহ। সারাটা জীবন সে ধর্মকর্ম নিয়েই কাটাতো। তার মতো সৎ প্রজাবৎসল উদার সুলতান বড় একটা দেখা যায় না। সারা সালতানিয়তের কোণে কোণে সে ঘুরে বেড়াতো। উদ্দেশ্য-তার প্রজারা কে কিভাবে দিন গুজরান করছে তাই দেখা। তার নিরপেক্ষ উদারনীতির জয়গান করতো সকলে। ধনী দরিদ্র ভেদাভেদ করতো না। তার চোখে সবাই সমান। সবাই প্রজা। এইভাবে প্রজাদের ভক্তি ভালোবাসা কুড়িয়ে তার জীবনের বেশীরভাগ সময়ই কেটে গেলো। শুধু একটা সাধই তার অপূর্ণ রয়ে গেলো। বেগম আর পুত্র কন্যা। যতই জীবনের সায়াহ্নকোল এগিয়ে আসে সুলতান ষ্ট সুলেমান ক্রমশই নিজেকে বড় একা—অসহায় মনে করতে থাকে। একদিন উজিরকে ডেকে বললো, দেখ, আমার স্বাস্থ্য দিন দিন ভেঙে পড়ছে। উৎসাহ উদ্দীপনা স্তিমিত হয়ে আসছে। শরীরে কোনও বল পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে, দিন শেষ হয়ে এলো। এখন এই বয়সে বুঝতে পারছি, কোন মানুষের একা থাকা উচিত নয়। সঙ্গবিহীন জীবন মরুভূমির মতো। বিশেষ করে সুলতানের পক্ষে তো নয়ই। কারণ সিংহাসনের উত্তরাধিকার একটা বিরাট সমস্যা। তাছাড়া আমাদের পয়গম্বরও বলেছেন শাদী কর এবং সংখ্যা বাড়াও। এখন আমাকে সৎ পরামর্শ দাও, উজির–কি করা বিধেয়।
উজির চিন্তিতভাবে বলে, আপনি বড় কঠিন প্রশ্ন করেছেন হুজুর। এককথায় এর জবাব হয়। না। আমি আমার সাধ্যমতো উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছি। জানি না। আপনাকে সস্তুষ্ট করতে পারবো কি না। এটাও অবশ্য অত্যন্ত দুঃখের হবে, যদি আপনি কোন অজ্ঞাতকুলশীল বাঁদীকে শাদী করেন। বাদীকে শাদী করায় আমার কেন আপত্তি নাই। কিন্তু কথা হচ্ছে, তার বংশ পরিচয় আমাদের অজ্ঞাত। হয়তো এমনও হতে পারে, যে বাদীকে আপনি শাদী করলেন তার বাবা একটা শয়তান বজাৎ বা চোর ডাকাত ছিলো। বাবার রক্ত মেয়ের ধমণীতে প্রবাহিত হয়। আবার সেই রক্ত নাতির দেহে সঞ্চারিত হবে এ আর বিচিত্র কি? আপনার পুত্র যদি বড় হয়ে আপনার সৎ গুণের অধিকারী না হয়ে তার দাদুর স্বৈরাচারের দোষে দুষ্ট হয়, তাহলে? এই কারণে হুজুরের প্রতি বান্দার আর্জি তিনি যেন আমাকে কোন বাঁদী কিনে আনতে না হুকুম করেন। তা সে মেয়ে যদি দুনিয়ার সেরা সুন্দরী হয় তাতেও আমার সায় নাই। সন্তান উৎপাদনই যদি আপনার একমাত্র কাম্য হয়, আমি পরামর্শ দেব, কোনো সুলতান বাদশাহর মেয়েকে বেগম করে আনুন। আপনি চাইলে শাহবংশের সেরা সুন্দরীর অভাব হবে না।
সুলতান বললো, তা যদি পাওয়া যায়, তাই নিয়ে এসো। শাদী করবো। শুধুমাত্র সন্তানের জন্য।
—পাত্রী আমার দেখাই আছে, জাঁহাপনা।
—তাই নাকি! কে, কার মেয়ে?
আমার বিবি বলেছে, সফেদ শহরের সুলতান জহর শাহর এক পরমা সুন্দরী কন্যা আছে। তার রূপের বর্ণনা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে শুনেছি, ইদানীংকালে আমন রূপসী, নিখুঁত সুন্দরী মেয়ে সারা আরবে নাই।
আনন্দে উল্লাসে ফেটে পড়ে সুলতান, ইয়া আল্লাহ!
উজির বলে, আপনি আর বিলম্ব করবেন না হুজুর। দরবারের এক বিচক্ষণ আমিরকে পাঠিয়ে দিন। সুলতান জহর শাহকে সে শুধু এই সংবাদটা দেবে যে সবুজ শহরের সুলতান তার কন্যার পাণিপ্রার্থী। তারপর দেখবেন সুলতান জহর শাহ আপনার কাছে ছুটে আসবে। তার নাতি সবুজ শহরের সিংহাসনে বসবে-এ লোভ কি সে সম্বরণ করতে পারবে!
সুলতান বললো, কাকে পাঠানো যায় বলতে উজির। এমন লোককে পাঠাতে হব যে কায়দা করে সাজিয়ে গুছিয়ে বলতে পারবে। অথচ আমার মান ইজ্জতটাও খোয়া যাবে না।
উজির ভেবে পায় না। কাকে পাঠানো যায়। সুলতান বললো থাক,। অত ভেবে কাজ নাই। এসব কাজ অন্য লোক দিয়ে হয় না। তুমি নিজেই। যাও। তাড়াতাডি কাজ হাসিল করে ফিরে এসো। তুমি না ফেরা পর্যন্ত। খুব চিন্তায় থাকবো।
খুব তাড়াহুড়া করে দরবারের জরুরী কাজকর্ম সমাধা করে উজির সফেদ শহরের সুলতান সকাশে যাত্রার উদ্যোগ করতে লাগলো। উট আর খচ্চরের পিঠে বোঝাই করা হলো নানা উপঢৌকন-হীরে, জহরৎ, স্বৰ্ণালঙ্কার, রেশমের গালিচা, সূক্ষ্ম কারুকার্য করা শাল, সুগন্ধী আন্তর, গোলাপের নির্যাস এবং আরও ছোট ছোট বহু মূল্যবান বিলাসসামগ্ৰী।। তার সঙ্গে নিলো দশটি তাগড়াই আরবের ঘোড়া, একশোটি খোজা, একশোটি নিগ্রো ক্রীতদাস এবং একশোটি দাসী বাদী। লাটবিহার বোঝাই করে। উজির রওনা হওয়ার আগে সুলতানের কাছে বিদায় নিতে এলো। সুলতান বললো, খুব তাড়াতাডি ফিরবে। এবং খালি হাতে আসবে না। পাত্রীকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবে।
উজির বললো। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন জাঁহাপনা, আমি যাবো। আর আসবো। ওখানে দেরি করার কিছু নাই। পাত্রীকে নিয়েই চলে আসবো।
উজির তার দলবল নিয়ে রওনা হয়ে পড়ে। দুৰ্গম গিরি পর্বত ডিঙিয়ে, দুস্তর মরুপ্রান্তর পেরিয়ে এবং বিস্তর খাল বিল নদী অতিক্রম করে একদিন সফেদ শহরের প্রায় কাছাকাছি এসে পৌঁছয়। দ্রুতগামী এক অশ্বারোহীকে দূত করে সুলতান জহর শাহর দরবারে পাঠিয়ে দেয় উজির।
বিকালে সুলতান জহর শাহ মুক্ত বায়ু সেবন করতে বাগানের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। দূরাগত এক অশ্বারোহীকে দেখতে পেয়ে উজিরকে জিজ্ঞেস করে, কে আসছে দেখতে উজির।
ইতিমধ্যে অশ্বারোহী আরও নিকটতর হলে বোঝা গেলো, কোনও বিদেশী দূত। একটু পরে সামনে এসে অভিবাদন জানিয়ে সে বললো, আমি সুলতান সুলেমান শাহর দূত। আপনার শহরের প্রান্ত সীমায় নদীর ওপারে আমাদের উজির তাবু গেড়েছেন।
সুলতান জহর। আনন্দিত হয়ে বললো। তুমি এখন বিশ্রাম করো, খানাপিনা সারো। তারপর সব শুনবো।
একজন আমিরকে বললো, একে খুব খাতির করে খাওয়াও। দেখো, যেন বদনাম না হয়।
নদীর ওপারে তাঁবু গেড়ে উজির প্রত্যাশা করে বসে থাকে। তার দূত কখন ফিরে আসবে, কি সংবাদ বহন করে আনবে সে চিন্তায় অধীর হয়ে পথের দিকে চেয়ে থাকে। ধীরে ধীরে রাত বাড়ে, দূত ফিরে আসে না। উজিরের চিন্তা ক্রমশ দুশ্চিন্তায় রূপান্তরিত হতে থাকে। এমন সময় দেখা গেলো, সুলতান জহর শাহর উজির আমির ওমরাহদের নিয়ে তার সামনে এসে হাজির হলো।
যথাযোগ্য বাদশাহী কেতায় পরস্পরের মধ্যে আলাপ পরিচয় পর্বশেষ হলো। সুলতান শাহর উজির করজোড়ে আমন্ত্রণ জানালো, আপনি যদি অনুগ্রহ করে আমাদের শহরে পায়ের ধুলো দেন, ধন্য হবো।
সুলতান সুলেমানের উজির বলে, চলুন, সুলতানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবো বলেই তো এসেছি।
বিরাট একটা দরবার কক্ষে প্রবেশ করলো তারা। দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে আমির ওমরাহরা উপবিষ্ট ও প্রান্তের ঠিক মাঝখানে এক শ্বেতপাথরের সিংহাসনে সুলতান জহর শাহ। পিছনে সুলতানের দেহরক্ষী এবং প্রধান সেনাপতি। সারা দরবার কক্ষ পারস্য-গালিচায় মোড়া। মাথার উপরে ঝুলন্ত ঝাড়বাতি।
এই সময়ে রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।
পরবর্তী রজনীতে আবার কাহিনী শুরু হয়।
সুলতান সুলেমানের উজিরকে সাদর অভ্যর্থনা করে বসানো হলো। সুলতান জহর শাহ উজিরের সম্মানে এক ভোজসভার আয়োজন করলো। নানারকম বাদশাহী খানাপিনীয় আপ্যায়িত করা হলো তাকে।
এর পর দরবার থেকে সবাই একে একে বিদায় নিয়ে চলে যায়। শুধু সুলতান, তার উজির এবং সুলতান সুলেমানের উজির বসে রইলো।
সুলেমানের উজির উঠে দাঁড়িয়ে কুর্নিশ জানিয়ে বললো, আপনি মহানুভব সুলতান। আপনার দরবারে আমার সুলতানের তরফ থেকে একটি আর্জি পেশ করছি। আমাদের সুলতান আপনার কন্যার পাণি প্রার্থী। আমি তার কাছ থেকে যে সব উপহার উপটৌকন নিয়ে এসেছি, আপনি গ্রহণ করে। ধন্য করুন।
সুলতান জহর শাহ উঠে দাঁড়িয়ে কুর্নিশ জানালো। দরবারের সকলে অবাক! একি কাণ্ড, সুলতান স্বয়ং উঠে দাঁড়িয়ে কুর্নিশ জানালেন সামান্য এক উজিরকে। সুলতান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই বললো, আপনি প্রবীণ প্রাজ্ঞ উজির। আপনার প্রস্তাব আমি সর্বান্তিঃকরণে গ্রহণ করলাম। আমার কন্যা আপনার সুলতানের কেনা বাদী হয়ে থাকবে। আমি নিজেও তীর একান্ত অনুগত প্রজাতুল্য। আমার কন্যার পাণি প্রার্থনা করে যে প্রস্তাব তিনি পাঠিয়েছেন সে জন্য আমি তার কাছে চিরঋণী। হয়ে রইলাম!
সুলতান কাজীদের ডেকে পাঠায়। কাজীরা এসে তার কন্যার সঙ্গে সুলতান সুলেমানের শাদীনামা তৈরি করে দিলো। সুলতান জহর কাগজখানা হাতে নিয়ে কপালে ঠেকিয়ে সম্মান জানালো।
সুলতান উপস্থিত সকলকে মূল্যবান পোশাক এবং প্রচুর ধনরত্ন উপহার দিয়ে খুশি করলো। কন্যার সহচরী হয়ে যাবে যারা, সেই সব দাসী-বাদী বাছাই করা হলো। দশটা খচ্চরের পিঠে উপহার সামগ্রী বোঝাই করে, পরদিন প্রত্যূষে সুলতান জহর শাসীর সাজে সাজিয়ে কন্যাকে নিয়ে রওনা হয়ে, তিন দিনের পথ অতিক্রম করার পর উজির এবং কন্যাকে বিদায় জানিয়ে আবার নিজের শহরে ফিরে এলো।
আরও তিনদিন চলার পর সবুজ শহরের এলাকায় পৌঁছে উজির এক অশ্বারোহীকে পাঠিয়ে সুলতান সুলেমানকে খবর পাঠালো : সংবাদ শুভ। পাত্রীকে সঙ্গে নিয়ে এসেছি।
সুলতান সুলেমান উত্তেজনায়, আনন্দে অধীর হয়ে নিজের গায়ের মহামূল্যবান শালখানাই দূতের হাতে তুলে দেয়।
সারা শহরে আনন্দের হিল্লোল জাগে। তাদের সুলতান শাদী করছেন। এবার সিংহাসনের নতুন উত্তরাধিকারীর সম্ভাবনা উজ্জ্বল হলো। শহরবাসীরা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে নিজেরা এসে মনোহারী সাজে প্রাসাদ সাজাতে থাকে। আলোয় আলোয় ভরে ওঠে শহরের পথঘাট।
সেদিন রাতে সুলতান মধুযামিনী যাপন করে। প্রথম রাতেই বেগম অন্তঃসত্তা হয়। সুলতান নতুন জীবন ফিরে পায়! তার সিংহাসনের উত্তরাধিকারী আসবে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে।
দশ মাস পরে বেগম এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিলো। চাঁদের মতো ফুটফুটে সুন্দর ছেলে। আদর করে সুলতান তার নাম রাখে তাজ অল মুলুক।
ছেলের যখন সাত বছর বয়স সেই সময় থেকে তার লেখাপড়া শিক্ষা-দীক্ষার জন্য শহরের প্রাচীন জ্ঞানীগুণী শিক্ষক নিযুক্ত করা হয়। তাজ অল মুলুক লেখাপড়ায় বেশ মেধাবী। অল্পকালের মধ্যেই সে নানা বিষয়ে পারদর্শী হয়ে ওঠে। লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকে দেহচর্চা। ঘোড়ায় চড়া এবং অস্ত্রবিদ্যা আয়ত্ত করে ফেলে।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দক্ষতাও বাড়তে থাকে। আঠারো বছর বয়সে তাজ অল মুলুক সর্বশাস্ত্ব বিশারদ এক পরিপূর্ণ যুবক হিসাবে খ্যাতিমান হয়ে ওঠে। সে যখন ঘোড়ায় চেপে শিকারে বেরুতে রাস্তার দু-ধারে আবালবৃদ্ধবনিতা জড়ো হয়ে তার রূপের প্রশংসায় উচ্ছসিত হয়ে উঠতো। শিকার তার বড় প্রিয় ছিলো। সঙ্গী সাখী নিয়ে মাঝে মাঝেই জঙ্গলে চলে যেত।
একদিন নদীর ধারে তাজ অল মুলুক পাখি শিকারে বেরিয়েছে। এমন সময় দেখলো একদল সওদাগর তাদের উট খচ্চরগুলোকে ছেড়ে দিয়ে নদীর ওপারে তাবু গেড়েছে। সওদাগররা নদীর জলে নেমে রুজু করছে। শাহজাদা তাজ অল মুলুক। একজন নফরকে পাঠিয়ে ওদের খবরাখবর জেনে আসতে বলে।
চাকরিটা এসে জিজ্ঞাসা করায় ওদের একজন বলে, আমরা বিদেশী বণিক। চলতে চলতে পরিশ্রান্ত হয়ে এই নদীর ধারে তাঁবু গেড়েছি। এখানে দু’একদিন বিশ্রাম করে আবার রওনা হবো। এখানকার শস্যশ্যামল প্রান্তর আমাদের বড় ভালো লেগেছে।
চাকরাটা প্রশ্ন করে, তোমরা যে এই অজানা অচেনা দেশে তাবু ফেলেছে, ভয় করে না? যদি চোর ডাকাত-এর উপদ্রব হয়?
ওরা বলে, আমরা জানি সুলতান সুলেমান শাহর দেশে চুরি রাহাজানি হয় না। এখানকার মানুষ সুলতানের মতোই সৎ এবং ধাৰ্মিক। সুলতান সুলেমান শাহর সত্যনিষ্ঠার খ্যাতি সর্বত্র। আর তা ছাড়া, আমরা শাহজাদা তাজ অল মুলুকের কাছে ভেট নিয়ে যাচ্ছি। আমাদের ভয় কী?
চাকরাটা ফিরে এসে তাজ অল মুলুককে এ কথা জানাতেই সে ওদের কাছে এগিয়ে যায়। তার কাছেই ওরা যাচ্ছে! সঙ্গে উপহার সামগ্ৰী।। তাজ অল মুলুক কিছুই বুঝতে পারে না।
শাহজাদাকে আসতে দেখে সওদাগররা এগিয়ে এসে সাদর অভ্যর্থনা করে তীবুর ভিতরে নিয়ে যায়। নানারকম বাহারী জিনিসের সে কি বিচিত্র মেলা। তাজ অল মুলুক যা দেখে তাই পছন্দ করে বসে। এক এক করে অনেকগুলো সৌখিন জিনিস তার পছন্দ হয়। সওদাগররা সেগুলো একত্র করে বাঁধাৰ্ছদা করে শাহজাদার হাতে তুলে দেয়। তাজ অলমুলুক জিজ্ঞেস করে, কত দাম? ‘
সওদাগররা নাক কান মলে জিভ কেটে বলে, ও কথা বলবেন না, হুজুর। আমরা আপনার গোলামের গোলাম। এই সামান্য কাঁটা জিনিস পছন্দ করে নিয়ে আমাদের ধন্য করেছেন। আমরা কি দাম নিতে পারি?
চাকরের হাতে জিনিসগুলো নিজের তাঁবুতে পাঠিয়ে দিয়ে সওদাগরদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঘোড়ার পিঠে চাপতে যাবে, এমন সময় এক বিষাদ বিষণ্ণ যুবকের দিকে তাজ অল মুলুকের নজর পড়ে। ছেলেটি দেখতে বড় সুন্দর। কিন্তু কিসের যেন ব্যথা, কিসের যেন দুঃখ তাকে মুহ্যমান করে রেখেছে। তাজ অল মুলুক-এর আর চলে যাওয়া হয় না। ছেলেটির কাছে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে, তোমার চোখে জল কেন ভাই, কি নাম তোমার?
ছেলেটি শান্ত গলায় জবাব দেয়, আমার নাম আজিজ।
আর কিছু বলতে পারে না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।
তাজ অল মুলুক সান্ত্বনা দিয়ে বলে, কেঁদ না, বন্ধু চুপ কর। দুঃখ সকলের জীবনেই আসে। তাই বলে তার কাছে নিজেকে বিকিয়ে দেওয়া ঠিক না। বলো, তোমার কি দুঃখ। আমি যদি কাটাতে পারি, কথা দিচ্ছি, প্ৰাণ দিয়েও তা করবো।
ছেলেটি শান্তভাবে বলে, সে কথা শুনে আপনার কি ফয়দা হবে? থাক।
তাজ রাগ করে, তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না। আমাকে? কিন্তু সত্যি বলছি, তোমাকে দেখামাত্র আমার অন্তর কেঁদে উঠেছে। বলো বন্ধু, অসঙ্কোচে বলো, তোমার কাহিনী। তোমার দুঃখের কিছু ভাগ নিতে চাই।
ছেলেটি বলে, ঠিক আছে বলবো, চলুন আপনার তাঁবুতে গিয়েই বলবো। এখানে অনেক লোকের ভিডি।
ছেলেটিকে সঙ্গে নিয়ে তাজ তার তাঁবুতে ফিরে আসে। দুজনে মিলে খানাপিনা করে। তারপর ছেলেটি বলতে থাকে? আমি আমার বাবার একমাত্র সন্তান। ধনী সওদাগর হিসাবে বাবার বেশ নামডাক ছিলো। আমার কাক মারা যাওয়ার সময় তার একমাত্র মা-হারা মেয়েকে আমার বাবার হাতে তুলে দিয়ে যান। আমরা দুই ভাইবোন এক সঙ্গেই মানুষ হতে থাকি। ওঃ বলতে ভুলে গেছি, আমার নাম আজিজ আর আমার কাকার মেয়ের নাম আজিজ। আজিজার শাদির বয়স হলো। বাবা বললেন, ভাই মারা যাওয়ার সময় হাতে ধরে বলে গিয়েছিলো, টিউ আজিজের সঙ্গে আজিজার যেন শাদী দিই।
আজিজের মা বলে, তা তো বেশ ভালোই হবে। মানাবেও ভালো। তা ছাড়া ছোট থেকে ওরা এক সঙ্গে হেসে খেলে মানুষ হয়েছে, এখন মেয়েটা পরের ঘরে পাঠাবে নাকি?
একদিন রাতে খান খেতে বসে বাবা বললেন, তোমাকে শাদী করতে হবে।
আমি তো আশমান থেকে পড়ি। হঠাৎ বলা নাই কওয়া নাই শাদী করতে হবে? আর তা ছাড়া পাত্রীই বা কোথায়? কাকে শাদী করবো! ঘরেই যে পাত্রী বাড়ছে সে কথা কিন্তু একবারও আমার মনে হয়নি। কিন্তু তা বলে আজিজা আর আমার মধ্যে ভালোবাসা যে কিছু কম ছিলো তা নয়। দুজন দু’জনকে ছেড়ে একটা দিন কাটাতে পারতাম না। কোনও একটা ভালো জিনিস দেখলে সব আগে আজিজার কথাই আমার মনে পড়তো! তেমনি আজিজাও আমাকে প্ৰাণ দিয়ে ভালোবাসতো। কোথাও কোনও ভালো খাবারদাবার পেলে আমার জন্যে তুলে রাখতো। বলতো, খাও, তুমি খেলেই আমার খাওয়া হবে।
এহেন যে সম্পর্ক-ত যে একদিন স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসায় আবদ্ধ হয়ে যাবে তা কিন্তু আমি ভাবতেই পারিনি। বাবা একটু কৰ্কশভাবেই আবার বললেন, আগামী জুম্মাবার সন্ধ্যায় তোমাদের শাদীর দিন ঠিক করা হয়েছে। তোমার বন্ধুবান্ধবদের—যাদের ডাকতে চাও নিমন্ত্রণ করে এসো।
বাবার ওপরে কথা বলার সাহস আমার ছিলো না। মাথা গুজে খেয়ে দেয়ে উঠে পড়লাম।
শুক্রবার দিন নামাজ শেষ করেবাড়ি ফিরবো হঠাৎ মনে পড়লো, এক বন্ধুকে এখনও বলা হয়নি। ওর বাড়ির দিকে হেঁটে চললাম। দুপুরের বাঁঝা করা রোদ। একেবারে লু বইছে। চোখমুখ ঝলসে যাবার দাখিল। আমি আর চলতে পারি না। সামনেই একটা বাগিচা। ভিতরে ঢুকে পড়লাম। একটা গাছের ছায়ায় শান বাঁধানো চকুতরায় বসে একটু জিরিয়ে নেবো। তারপর রোদের ঝাঁঝাঁটা একটু কমলে আবার বেরিয়ে পড়বে—এইরকম ইচ্ছা!
ঝির ঝির করে হাওয়া দিচ্ছে। একটা রুমাল বিছিয়ে চাবুতরার উপরে শুয়ে পড়ি।
একটু বোধ হয় তন্দ্ৰা লেগেছিলো। হঠাৎ খট করে একটা শব্দ হতেই কেটে গেলো। চেয়ে দেখি একখানা লাল রঙের রুমালে কি যেন একটা বস্তু পড়ে আছে আমার কাছেই। তুলে নিয়ে খুলে দেখি, রুমালে বাঁধা এক টুকরো পাথর। এদিক ওদিক চাইলাম! দেখি, সামনের বাড়ির দোতলার একটি জানোলা খোলা। তার পাশে বসে এক পরমা সুন্দরী কন্যা। বুঝলাম রুমালখানা সে-ই ছুঁড়েছে।
সেই মুহুর্তে আমার মনের মধ্যে কি যে ঘটে গেলো বোঝাতে পারবো। না। মনে হলো, যাকে প্রণয় বলে, প্রেম বলে—তার প্রথম আস্বাদ পেলাম। নারী আমার শৈশবকালের সঙ্গী। কিন্তু এই উন্মাদনা সে আমার অন্তরে জাগাতে পারেনি।
রুমালখানার এক কোণে কয়েকটা কথা লেখা ছিলো : পথিক, তুমি কি পথ হারাতে চাও না? যে পথে চলেছে তার বাইরে তো আরও অনেক অচেনা অজানা দুৰ্গম পথ আছে। সেই পথে পাডি দেবার মজা কি পেয়েছে কখনও?
সেই মুহুর্তে ভালোবেসে ফেললাম সেই অজানা অচেনা সুন্দরীকে। আমার চিত্ত বিহ্বল হলো। ভুলে গেলাম সেই দিন সন্ধ্যায় আমার শাদী।
মেয়েটি আমাকে অনেক রকম ইশারা করে কি সব বোঝাতে চাইলো। প্রথমে তর্জনী ঠোঁটে রাখলো। পরে দু’হাত দিয়ে বুকটা চেপে ধরলো। কিন্তু আমি তার একবৰ্ণও বুঝতে পারলাম না। একটু পরে জানালা বন্ধ করে দিলো।
আমি তবু ঠাঁয় বসে থাকি। আশা, আবার যদি খোলে, আবার যদি কিছু বলে! আবার যদি তার দেখা পাই। সেই আশায় একদূদ্ষ্টে চেয়ে রইলাম সেই রুদ্ধ কপাট জানালার দিকে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। সন্ধ্যাও কখন রাত্রির রূপ ধারণ করে। কিন্তু বসে থাকি সেই চবুতরায়। আশা, যদি আবার সে জানালা খোলে!
কিন্তু না, জানালা আর খুললো না, ব্যর্থ মনে ঘরে ফিরে চলি! বাবা ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন, এই তোমার আক্কেল। আজ তোমার শাদী, আর তুমি কিনা দুপুর রাতেবাড়ি ফিরলে। এমন যার দায়িত্ব বোধ তার হাতে মেয়ে দেওয়া নিবুদ্ধিতা। এ শাদী হবে না। আমি বাতিল করে দিলাম।
মা কান্নাকাটি করলেন। কিন্তু তিনি বাবাকে ভালো করেই জানতেন। বাবার রাগ বড় চণ্ডাল। একবার না’ বললে, ‘হ্যা’ করানো শক্ত!
আজিজা এলো। আমার হাত দু’টো ধরে পাশে বসালে, কি হয়েছে বলতো ভাই। আমার কাছে লুকিয়ো না, খুলে বলো।
জীবনে কখনও কোনও কথা আজিজার কাছে আমি গোপন করিনি। আজও পারলাম না। সব বললাম।
-প্রথম দৰ্শনেই ভালোবাসা কাকে বলে আমি জানি না। আজিজ, কিন্তু আজ ঐ মেয়েটিকে দেখার পর থেকে সারা দেহমানে আমার ঝড় উঠেছে। কিছুতেই মন শান্ত করতে পারছি না। কিছুতেই তার মুখচ্ছবি মুছে ফেলতে পারছি না। তুমি বলতে পারো আজিজ, এমন কেন হলো! এর কি নাম?
আজিজা বলে, এরই নাম ভালোবাসা। তুমি ওকে ভালোবেসে ফেলেছে।
আমি বাধা দিয়ে বলি, না না, আজিজ, সে কি করে হয়? আমি তো তোমাকে ভালোবাসি।
–না। আজিজ। তোমার আমার সম্পর্ক যে ভালোবাসার, এ ভালোবাসা সে ভালোবাসা নয়। একে বলে প্ৰেম।
আমি চমকে উঠি। প্ৰেম!
আজিজা আমাকে সোহাগ জানিয়ে বলে, তুমি কিছু ভেবো না। আজিজ, আমি তোমাকে সাহায্য করবো। তুমি জীবনে সুখী হবে। তোমার মুখে হাসি দেখবো, এর চেয়ে বড় কিছু নেই আমার কাছে। তোমার জন্যে আমার বুকের কলিজাও ছিঁড়ে দিতে পারি। শুধু আমার একমাত্র কামনা তোমাকে খুশি করা। এখন বলো তো মেয়েটা তোমাকে কিছু বলেছে কিনা।
আমি বললাম, অত দূর থেকে কথা বলবে কি করে! এই রুমালখানা সে ছুঁড়ে দিয়েছে। আর হাতের ইশারা করে কি সব বোঝাতে চেয়েছে—আমি কিছুই বুঝতে পারিনি।
—কী ইশারা করেছে।
—প্রথমে হাতের একটা আঙুল ঠোঁটে রাখলো। পরে হাত দু’টো বুকে চেপে ধরলো।
আজিজ বলে, বুঝেছি, ও তোমাকে চুম্বন জানিয়েছে। আর তার হৃদয় তোমাকে সমর্পণ করতে চেয়েছে। তুমি নিশ্চিত থাক, আজিজ আমি তোমাদের দু’জনের মিলন ঘটিয়ে দেব। এখন দিন দুই তুমি বিশ্রাম করো। তারপর আবার তোমাকে আমি পাঠাবো সেখানে।
আজিজার কোলে মাথা রেখে আমি তার অনেক আদর সোহাগ খেলাম। নানাভাবে প্রবোধ দিয়ে সে আমাকে আশ্বস্ত করতে থাকলো। দুদিন পরে বিকেলে সে নিজে হাতে আমাকে সাজালো। দামী পোশাক পরলো। আন্তর ছড়ালো শরীরে।
বললো, যাও। কিন্তু তাড়াতাডি ফিরবে। আমি তোমার পথ চেয়ে বসে থাকবো।
বাগিচায় ঢুকে সেই চবুতরায় বসে অধীর আগ্রহে বন্ধ জানালার দিকে তাকিয়ে থাকি। এক এক মুহূর্ত মনে হয় এক এক যুগ। একটু পরে জানোলা খুলে যায়। সেই মৃগনয়না ষোড়শী। এক হাতে আয়না আর অন্য হাতে একখানা রুমাল। রুমালখানা তিনবার ভাঁজ করলো আবার খুললো। রুমাল সুদ্ধ হাতখানা একবার উপরে একবার নিচে উঠাতে নামাতে থাকে। আয়না দিয়ে তিনবার আমার মুখে আলো ফেলে। এর পর গায়ের জামাটার অস্তিন গুটাতে গুটাতে ধবধবে ফর্সা বাহুমূল পর্যন্ত উন্মুক্ত করে দেখায়। সব শেষে ডান হাতের পাঁচটা আঙুল প্রসারিত করে বুকের ওপর চেপে ধরে। এর পর জানালা বন্ধ করে দেয়।
আমি কিছুই বুঝতে পারি না। ছুটেবাড়ি আসি। আজিজকে সব ইশারাগুলো দেখাই।
আজিজা বললো, এর অর্থ হলো, পাঁচদিন পরে সে তোমাকে তার হৃদয়ের কথা বলবে। ওদের বাড়ির কাছাকাছি একটা কাপড় রং করার দোকান আছে, সেখানে তুমি অপেক্ষা করবে।
আমি আনন্দে লাফিয়ে উঠি, তুমি ঠিকই বলেছ। আজিজ। ওদের বাড়ির কাছেই একটা জহুরীর দোকান আছে। জামাকাপড় রং করে। কিন্তু আজিজ, পাঁচটা দিন তাকে না দেখে আমি বাঁচবো কি করে?
আজিজ বলে, ভালোবাসা বড় বিষম বস্তু। কোনও কোনও সময় বছরের পর বছর তার জন্যে অপেক্ষা করে বসে থাকতে হয়। তবে দেখা মেলে। তোমাকে মাত্র পাঁচটা দিন অপেক্ষা করতে হবে, পারবে না? মনটা একটু শক্ত কর, সোনা, অত অধৈর্য হলে কি চলে? ওঠ, একটু কিছু মুখে দাও। শরীরে বল পাবে।
কিন্তু আমার মুখে কিছু রুচে না। কিছুই খেতে পারি না। সারা রাত এক ফোটা ঘুমাতে পারি না। এই প্রথম অনুভব করতে থাকলাম ভালোবাসার কি বিষম জ্বালা।
এই পাঁচটা দিনের অসহনীয় প্রতিটি মুহূর্ত আমার পাশে পাশে থেকে আজিজা আমাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করেছে। সে ঋণ আমি কোনওদিন ভুলবো না।
পাঁচদিন পরে সে আমাকে গরম জল করে দিলো, আমি হামামে গিয়ে ভালো করে গোসল করলাম। নিজে হাতে আমাকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিলো সে।
—যাও আর দেরি করো না। সে হয়তো এসে ফিরে যেতে পারে। তার চাঁদ মুখ দেখে নয়ন সার্থক করে এসো। রাতে ঘুমিয়ে তাকে স্বপ্ন দেখতে পারবে।
আমি হন হন করে হেঁটে চললাম। কিন্তু গিয়ে দেখি দোকানটা বন্ধ। খেয়াল হলো, আজ শনিবার-বন্ধের দিন। যাই হোক, বন্ধ দরজার সামনে রোয়াকের উপর বসে রইলাম। সন্ধ্যাবেলার নামাজের সময় হয়ে গেলো। কিন্তু তার দেখা নাই। একটু পরেই রাতের অন্ধকার নেমে আসবে। ভাবলাম, আর বিলম্ব করা সমীচীন হবে না। উঠে দাঁড়িয়ে মদ্যপ মাতালের মতো প্রায় টলতে টলতে ঘরে ফিরে আসি। আজিজকে কোনরকমে বলতে পারি, আসেনি। দেখা হয়নি।
তারপর আমার আর চৈতন্য ছিলো না। পরদিন সকালে চোখ মেলে দেখলাম, আজিজার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, সারা রাত তুমি ঘুমাওনি?
—কি করে আর ঘুমাই বলো! তুমি যা ভুল বকেছো, আমার তো ভয়ই লেগে গিয়েছিলো। আমি বললাম, কিন্তু সে এলো না কেন আজিজা?
–এও ভালোবাসার একরকম পরীক্ষা। সত্যিই তুমি তাকে ভালোবাস কিনা এবং তার জন্যে কতটা ধৈর্য তোমার আছে সে পরীক্ষাও সে করে নিলো। যাই হোক, আজি বিকেলে আবার তুমি বাগিচায় গিয়ে বসে। দেখবে, নতুন কোনও ইশারা জানাবে।
বিকেলে যথারীতি আজিজা আমাকে সাজিয়ে গুছিয়ে রওনা করে দিলো। বাগিচার চবুতরায় এসে বসে রইলাম। একটু পরে জানালা খুলে গেলো। এবার দেখলাম তার এক হাতে একটা বঁটুয়া এবং একখানা আয়না অন্য হাতে একটা লণ্ঠন এবং একটা ফুলদানী।
প্রথমে আয়নাখানা বটুয়ায় ভরলো। বটুয়ার দডিটা এঁটে বন্ধ করে পিছনের দিকে ছুঁড়ে দিলো। তারপর মাথার চুলগুলো খুলে আলুথালু করে মুখটা ঢেকে ফেললো। এরপর সে ফুলগুলোর মধ্যে ঢুকিয়ে রাখলো লণ্ঠনটা। এর একটুক্ষণ পরেই জানালা বন্ধ করে দিলো।
আমি কিছুই বুঝলাম না। হাহাকার করা রিক্ত হৃদয় তুষানলে জ্বলতে থাকলো।বাড়ি ফিরে এসে আজিজকে বললাম।
আজিজ ব্যাখ্যা করে জানালো, আয়নাটা বটুয়ার মধ্যে ভরে পিছনে ফেলে দেওয়ার অর্থ—দিন শেষ হলে যখন রাত্রি নেমে আসবে। কালো চুলগুলো এলোমেলো করে ফর্স মুখটা ঢাকার অর্থও ঐ একই। সূর্যের আলো যখন অন্ধকারে ঢেকে যাবে। ফুল—অর্থাৎ ফুলবাগানে মানে ঐ বাগিচায় যাবে তুমি। আর লণ্ঠন দিয়ে বোঝাতে চেয়েছে, একটা আলো দেখতে পাবে। সেই আলো অনুসরণ করে গেলেই তুমি তোমার ভালোবাসার দেখা পাবে।
এবার আর আজিজর কথা আমার বিশ্বাস হয় না।–তোমার কথা মতো যাচ্ছি, কিন্তু দেখা তো হচ্ছে না।
আজিজ বললো, ধৈর্য ধরো, আবার যাও। দেখবে এবার তুমি ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসবে না।
সত্যিই সেদিন তার দেখা পাওয়া গেলো। সন্ধ্যার অন্ধকার সবে ঘনিয়ে এসেছে। বাহারী সাজে। সেজেগুজে বাগিচার সামনে আসতেই দেখি সদর ফটকটা খোলা। ভিতরে ঢুকলাম। অদূরে একটা ঝাপড়া গাছের নিচে একটা চিরাগ জুলছিলো। আলোটা লক্ষ্য করে চলতে থাকি। আলোটাও চলতে থাকে। এইভাবে এক সময় এসে ঢুকলাম এক বিশাল জলসাঘরে।
দরজা জানালায় দামী রেশমী পর্দাঁ। মেজেয় পারস্য গালিচা। উপর থেকে ঝুলছে বিরাট বিরাট ঝাড়বাতি। টেবিলে নানারকমের বাদশাহী খানাপিনী। একপাশে ফরাশের ওপর রাখা নানা দেশের নানা জাতের বাদ্যযন্ত্র। কিন্তু ঘরে কেউ নাই। একেবারে জনমানবশূন্য। ফাঁকা। শুধু আমি একা বসে রইলাম। ভাবছি, এই বুঝি সে আসবে, এই বুঝি তার পায়ের শব্দ শুনলাম। কিন্তু না। পুরো তিনঘণ্টা কেটে গেলো। খিদেয় পেট জুলছে। সামনে লোভনীয় খানাপিনা। আমার প্রিয় আঙুর। কিন্তু খাই কি করে। যার আমন্ত্রণে এসেছি, তারই দেখা নাই। কিন্তু কতক্ষণ আর অপেক্ষা করা যায়। পেটে ক্ষিদে আর সামনে খাবার রেখে বসে থাকার কোনও মানে হয় না। খান কয়েক পিস্তার বরফঁী তুলে নিয়ে খেতে থাকলাম। ওফ, কি অপূর্ব স্বাদ! এমন জিনিস তো আগে কখনও খাইনি। কতগুলো খেয়ে ফেলেছিলাম বলতে পারবো না। এক সময় দেখলাম রেকবীখানা খালি হয়ে গেছে। কিন্তু খিদে একটুও কমলো না। এর পর রসালো ‘বাককালাবাহ’ গুলো একে একে সব গলাধঃকরণ করে নিলাম। তখন আমাকে খাওয়ার নেশায় পেয়ে গেছে। সফেদ হালওয়ার রেকবীও শূন্য হয়ে গেলো। এর পর আমি মোরগ-মোসল্লাম-এর দিকে নজর দিলাম। এক এক করে চারটেই সাবাড় করে ফেললাম। সবগুলো খাবারই অপূর্ব স্বাদের। যেখানে যা ছিলো সব চেটেপুটে খেয়ে পেটটা বেশ ভরে গেলো। ঝারি থেকে পেয়ালা পেয়ালা সরাব ঢেলে নিয়ে এক এক চুমুকে নিঃশেষ করে দিতে থাকলাম। ধীরে ধীরে মাথাটা ভারি হয়ে আসতে থাকে। চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসে। জোর করে জেগে থাকার চেষ্টা করি। কিন্তু ঘুম আমাকে রেহাই দিলো ঈষত না। কার্পেটের উপর অঘোরে ঘুমিয়ে পড়লাম।
এর পর আর বলতে পারবো না, সারা রাতে কিছু ঘটেছে কি না। যখন ঘুম ভাঙ্গলো, দেখলাম জানোলা দিয়ে সোনালী রোদ এসে পড়েছে আমার মুখে। হঠাৎ অনুভব করলাম, আমি রিক্ত মেজের উপরে শুয়ে আছি। সারা মেজেয় নুন ছড়ানো। কীটার মতো বিধছে। কে যেন পেটের উপর রেখে গেছে এক রাশ কয়লায় গুড়ো। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। এদিক ওদিক ভালো করে দেখলাম। নাঃ, কেউ কোথাও নাই। সারা শরীর রীরী করতে লাগলো। নিজের নিবুদ্ধিতার জন্যে নিজের হাত কামড়াতে লাগলাম।। প্রায় দৌড়তে দৌড়তেবাড়ি ফিরে এসে আজিজার কাছে আছাড় খেয়ে পড়ি।
আমার ঐ কিন্তুত কিমাকার চেহারা দেখে ভীতচকিত আজিজা আমাকে টেনে তোলে, কী সোনা, একি দশা হয়েছে তোমার! কেউ কী মারধোর করেছে?
–না।
–তবে?
—জানি না। আমি ঘুমিয়েছিলাম। সকালে উঠে দেখি কে বা কারা আমার সর্বাঙ্গে কয়লার গুড়ে ঢেলে দিয়ে গেছে।
আজিজা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, মেয়েটা বলতে পারলো না?
–মেয়েটার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি।
—সে কি, তোমার ঘুম ভাঙ্গার আগেই কেটে পড়েছে?
আমি অধৈর্য হয়ে উঠি।—আসলে তো কেটে পড়বে। আদপেই সে আসেনি।
আজিজা আরও অবাক হয়। মেয়েটা এলো না। অথচ তুমি তার ঘরে গেলে কি করে?
আমি সব বললাম। আজিজা হতভম্ব হয়ে বসে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর বললো, ভয়ে আমার আত্মা শুকিয়ে যাচ্ছে আজিজ। মেয়েটার হাতে তোমার অনেক দুঃখ আছে। নুনের অর্থ হলো—তোমার দেহের যৌবন অপুষ্ট। যে কারণে নারী সম্ভোগের কামনার চেয়ে আহার এবং নিদ্ৰাই তোমার কাছে প্রধান মনে হয়। আর কয়লার গুড়োর মানে হচ্ছে-তার চোখে তুমি অতি ঘূণ্য। মেয়েটার ধারণা, তুমি সেখানে শুধু খাওয়া আর ঘুমানোর জন্যেই যাও। তার দেহ যৌবন বা ভালোবাসা তোমার কাছে তেমন কোনও লোভনীয় ব্যাপার নয়। সেই কারণে আমার মনে হয়, তোমার সেখানে আর না যাওয়াই উচিৎ।
আজিজার কথা শুনে আমি বুক চাপড়াতে লাগলাম।–ইয়া আল্লাহ, সব দোষ তো আমার। বুকে যদি ভালোবাসার আগুন জ্বলতে থাকে। তবে কি আর নাওয়া খাওয়ার কথা মনে আসে। প্রেম এমনই বস্তু যা চোখের ঘুম কেড়ে নেয়। কিন্তু আমি তো সেই তুচ্ছ রসনা তৃপ্ত করতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। এইভাবে প্রেমের অপমান করলে কোন প্রেমিকাই সহ্য করে না। সেদিক থেকে ওর তো কোনও দোষ দিতে পারি না। এখন আমার কী হবে। আজিজ, সে যদি আমাকে প্রত্যাখান করে আমি বাঁচবো না। একটা কিছু উপায় বাৎলে দাও, সোনা।
আমার দুঃখ দেখে আজিজও ব্যথিত হয়। এ জীবনে আমাকে ছাড়া আর কিছুই সে জানে না। আমিই তার ধ্যান জ্ঞান। আমার সুখেই তার সুখ। আমার দুঃখে সে কাতর হয়। আমাকে কী ভাবে হাসিখুশি রাখবে তার চিন্তাতেই সে পাগল। তা না হলে কোনও মেয়ে তার ভালোবাসার ধন অন্য মেয়ের হাতে তুলে দিতে পারে? আমি বুঝতে পারি, আজিজার অন্তরে তুষের আগুন জুলছে। কিন্তু কী অসাধারণ চাপা মেয়ে, মুখে তার বিন্দুমাত্র প্রকাশ নাই।
—শোনো, আজিজ, আমার তরফে যতটা করা দরকার আমি করবো। কিন্তু তাতেই কী তুমি সুখী হবে? তাকে পাবে? তুমি তো জানি সোনা, তোমার বাবা আমার চাচা আমার শাদীর জন্যে চেষ্টা করছেন। শুনেছি পাত্বও নাকি ঠিক করে ফেলেছেন। তাই এখন আমাকে তারা ঘরের বাইরে বেরুতে দেবে না। তাছাড়া তোমাদের দু’জনের ভালোবাসার মধ্যে, আমি একটা ফালতু মেয়ে, আমার যাওয়াও ঠিক হবে না। আজ রাতে তুমি আবার যাও। কিন্তু সাবধান, ঘুমিয়ে পড়বে না। যদি খানাপিনার লোভ সামলাতে পারো তা হলে চোখের ঘুম ঠেকাতে পারবে। পেট ভরা থাকলে চোখে ঘুম আসেই। তাই বলছি, জিভ দিয়ে জল গড়ালেও খানাপিনা একদম ছোবে না। আল্লাহর উপর ভরসা রেখে যাও, আমার মনে হয়, আজ রাতে সে দেখা দেবে। সারাটা দিন ছটফট করে কাটালাম। সূর্য যখন পাটে বসলো আমি ততক্ষণে সেজেগুজে তৈরি। আমার পোশাকে আতর ছড়িয়ে দিতে দিতে আজিজা বললো, আমার কথা মনে আছে তো?
–কি কথা?
—বাঃ রে, তোমাকে বলেছিলাম না, যখন তোমার ‘ভালোবাসা’ তোমায় সোহাগ করবে, তখন একটা প্রেমের গান শোনাবে তাকে
আমার মনে পড়ে। আজিজা আমাকে একটা ভালোবাসার গান শিখিয়ে দিয়েছিলো।
ওগো আমার ভালোবাসা
ওগো আমার প্রাণ,
আমার যাহা-সকল তোমায়
করেছি তো, দান।
(আর) দেবার মতো নেইকো কিছু—
রেখে গেলাম ঋণ,
তোমার আমার মিলন হবে
শেষ বিচারের দিন।
আজিজা বলতো, গানের গলা নাকি আমার চমৎকার।
দেখলাম, ওরা দু’গাল বেয়ে জলের ধারা নেমেছে।
—আজিজ তুমি কাঁদছো।
–না না, কই না তো।
ওড়নার আঁচল দিয়ে চোখ দু’টো মুছে ফেলে বলে, ও কিছু না। চোখে একটা কুটো পড়েছে।
আমার তখন ভালোবাসার ভীমরতি ধরেছে। আজিজার অন্তরের ব্যথা তলিয়ে দেখার ফুরসৎ নাই।
আজিজ আমাকে বিদায় দিতে দিতে বলে, দেখে শুনে যেও। আর যা যা বলে দিয়েছি মনে থাকে যেন।
সেদিনও গিয়ে দেখি, সাজানো গোছানো আগের দিনের মতোই করা হয়েছে। কিন্তু কোথাও কোনও জন প্রাণী নাই। শূন্য ঘরে একা বসে রইলাম। প্রত্যাশা আজ সে আসবে। দেখা হবে। আমায় ভালোবাসায় ভরিয়ে দেবে। কিন্তু কেউ এলো না। অনেক রাত অবধি একা একা বসে রইলাম। খুব খিদে পেয়ে গেলো। আর থাকতে পারলাম না। ভাবলাম খেয়ে নিই। ঘুম যদি আসে জোর করে জেগে থাকবো। এক এক করে সব খানা পিনা চেটে পুটে খেলাম। আজ আমি খুব হাঁশিয়ার আছি ঘুম এড়াতেই হবে। চোখ দু’টো বুজে আসতে চায়। কিন্তু উঠে দাঁড়িয়ে, পায়চারী করে জেগে থাকার চেষ্টা করতে থাকলাম। কিন্তু বৃথাই চেষ্টা। কখন যে ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম, বুঝতেই পারিনি। ঘুম ভাঙতে দেখি সকাল হয়ে গেছে। কিন্তু একি! আমি তো জলসাঘরে ছিলাম, এই ঘোড়ার আস্তাবলে এলাম কি করে? সারা শরীর কাদা-চোনায় মাখমাখি হয়ে গেছে। আমার পেটের ওপর কতকগুলো মাংসের হাড় আর একটা গোলাকৃতি বল। কিছু তরকারীর খোসা, কিছু শুকনো শুটি, দু’টো দিরহাম আর একখানা ছুরি। ঝেড়ে ঝুড়ে উঠে দাঁড়ালাম। শুধু ছুরিখানা হাতে নিয়ে বাড়ির পথে ছুটে চললাম।
আমার সেই উদ্রান্ত চেহারা দেখে আজিজা বুঝলো, আজও কোনও অঘটন ঘটে গেছে।
—তোমাকে পইপই করে বারণ করলাম, তবু ঘুমিয়ে পড়েছিলে?
আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি। কোন জবাব দিতে পারি না। আজিজা আমাকে অনেক করেই বলেছিলো, খানাপিনার লোভ করলে ঘুম এড়াতে পারবে না। আমার নিজের সর্বনাশ। আমি নিজেই করছি। তার জন্যে কাকে দোষ দেব। আজিজা আমাকে ভালো পরামর্শই দিয়েছিলো। কিন্তু আমি তা মানিনি। তার অবশ্যম্ভাবী ফল যা হবার তা-ই হয়েছে।
আজিজা আমার কাছে এসে পাখা দিয়ে হাওয়া করতে থাকে। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বলে, তুমি ভীষণ বোকা। এখনও বুঝতে পারছে না মেয়েটা কি বোঝাতে চায়?
আজিজার প্রশ্নের জবাবে গতরাতের সবই খুলে বলতে হলো।
আজিজা শুনে কপাল চাপড়াতে থাকলো—তোমাকে তো আমি তোতাপাখির মতো পড়িয়ে দিলাম, সোনা, যত লোভই হোক, খানা খাবে না, মদ ছোবে না। তা আমার বারণ শুনলে না কেন?
আমি চিৎকার দিয়ে উঠি।-যা হবার তো হয়ে গেছে। এবার বলো, কি করবো? তাকে না। পেলে আমি মরে যাবো।
আজিজা বলে, ঐ গোল বলটার মানে হচ্ছে-তোমার ভেতরটা ফাঁপা বেলুনের মতো, অন্তঃসারশূন্য। শুধু হাওয়া ভরা। না আছে কোনও কামনা, না আছে কোন বাসনা। ঐ শব্জীর খোসাগুলো তোমার অপদার্থতার প্রতীক। আর ঐ শুকনো শুটিগুলো দিয়ে বোঝাতে চেয়েছে-তোমার প্রাণের সব রং রস শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ভালোবাসার নাম গন্ধ নাই। আর ঐ মাংসের হাড়গুলো দেখে আমি ভয় পেয়েছি—বলতে আমার গা শিউড়ে উঠছে।
আমি অধৈর্য হয়ে চিৎকার করি, কিন্তু ঐ ছুরিটা। তার কথাতো বললে না? তাছাড়া ঐ দুটো দিরহামই বা কী?
আজিজা এক মুহূর্ত চুপ করে কি যেন ভাবে। তারপর বলে, শোনো, সোনা, ছুরিটার ইঙ্গিত বড় মারাত্মক। ঐ দু’টো রূপের দিরহাম তার দু’টো চোখের প্রতীক। ওটা দিয়ে বোঝাতে চেয়েছে, চোখের কসম খেয়ে সে বলছে ফের যদি তুমি ওখানে গিয়ে খানাপিনা করে নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে তোমার গলা সে কেটে দেবে।
আজিজার কথা শুনে অঝোরে কাঁদতে থাকি। —আমার কোনও পথ নাই। কিন্তু তাকে না। পেলে আমি বাঁচবো কি করে?
আজিজা বললো, যা হয়ে গেছে তার তো আর চারা নাই। এবার নিজেকে একটু শক্ত করা। যা বলি মন দিয়ে শোনো। আজ সারাটা দুপুর তুমি ঘুমাও। তারপর বিকালে উঠে গোসল করে খানাপিনা করে নেবে পেট ভরে। আমি নিজে হাতে খানা পাকাচ্ছি। তুমি যা যা খেতে ভালোবাসে সেই সব খানা তৈরি করবো খেতে রুচি হবে। পেট ভরে খেয়ে গেলে খিদেও পাবে। না। আর পেটে খাবার না পড়লে ঘুম আসবে না। তাছাড়া দুপুরে যা ঘুমাবে। তারপর বড় একটা ঘুম পাবেও না।
আজিজার কথায় অনেকটা ভরসা হলো। বললাম, আমার মাথার কসম খেয়ে বলছি, এবার আর কোনও নড়াচড় হবে না। যা যা বলবে, দেখে নিও, অক্ষরে অক্ষরে মানবো।
সারাটা দুপুর খুব ঘুমালাম। আমার শিয়রে বসে আজিজা হাওয়া করতে থাকলো। মাথায় কপালে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। আমি আরামে ঘুমিয়ে পড়লাম।
বিকেলে ঘুম থেকে উঠে শরীরটা বেশ ঝরঝরে মনে হতে থাকে। হামামে গিয়ে গোসল করে নিই। আজিজ নতুন সাজ-পোশাক এনে দেয়। এই পোশাক পরে আজিজার সঙ্গে আমার শাদী হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু ঘটনাচক্রে সে বিয়ে ভেঙে গেছে।
আমি বললাম, এ পোশাক কেন আনলে আজিজা? এতো আমার শাদীর পোশাক?
—কিন্তু শাদী তো আর হলো না!
–হ’লো না মানে—আর কি হবে না?
আজিজা মাথা নত করে মৃদু কণ্ঠে বলে, হবে না কেন? কিন্তু তখন কি আর এই পোশাকের দরকার হবে? শাহজাদীর সঙ্গে শাদী হবে, সাজপোশাকও বাদশাহী বাহারী হতে হবে।
আমি বলি, কেন তোমার সঙ্গে হবে না?
—আমার শাদী অন্য পাত্রের সঙ্গে ঠিক করছেন চাচা! তোমার সঙ্গেই তো একবার ঠিক হয়েছিলো। কিন্তু তুমি তো করছে না। চাচা আর কি করবেন। বাধ্য হয়েই অন্য পাত্রের সন্ধান করেছেন।
আমি আর কোনও জবাব দিতে পারি না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকি। আজিজা আমাকে আদর করে বলে, তাতে কি হয়েছে আজিজ। শাদী যার সঙ্গেই হোক, আমি তোমারই ছিলাম, তোমারই আছি, তোমারই থাকবো। আর তুমিও যাকেই চাও আমার তাতে কিছু যায় আসে না। এ জীবনে তোমাকে না পেলেও শেষ বিচারের দিন মিলন আমাদের হবেই।
টস টস করে দু-ফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে পড়ে। আজিজা বলতে থাকে, আজ তোমার পরম লগ্নের দিন। চোখের জল ফেলে তোমার অভিসারের পথ পিছল করে দেব না। যাও, আজ তোমার মনস্কামনা পূর্ণ হবে। প্রিয়ার আদর সোহাগে ভরে যাবে তোমার দেহ-মন। এতদিনের সাধ তোমার পূর্ণ হবে আজ। কিন্তু আজিজ সেই ভালোবাসার গানটা তাকে শোনাতে ভুলো না! তোমার মতো গানের গলা ক’জনের হয়। দেখবে, গানের সুরে মুগ্ধ হয়ে আরও কত আদর সোহাগ করবে তোমায়। আমি আল্লাহর কাছে দেয়া মাঙছি, সোনা তোমরা যেন ক্ৰৌঞ্চ মিথুন হয়ে সারাজীবন এক হয়ে থাকতে পোর।
আজিজার মতো প্রেমিক। এ সংসারে হয় না। নিজের ভালোবাসার পাত্রকে সাজিয়ে গুছিয়ে অন্য মেয়ের বাসরশয্যায় পাঠাতে পারে কাটা মেয়ে? আমি তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে
সেই গান।
সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে। বাগিচার সদর ফটকের সামনে এসে দাঁড়াতেই চোখে পড়লো সেই আলো। নিশানা ধরে এগিয়ে যেতেই পৌঁছে গেলো। সেই সাজানো গোছানো জলসা ঘরে। সেই একই দৃশ্য। খান পিনা সব যথাযথ রাখা আছে। নাই শুধু কোন জনপ্রাণী। আজ আমি আটঘাট বেঁধে এসেছি। কিছুতেই খাবার-দাবার স্পর্শ করবো না। আর ঘুম আজ আমার ধারে কাছেও ঘেঁসিতে পারবে না।
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত্রি গম্ভীর হতে থাকে। আমি ঠায় চুপচাপ বসে কডি কাঠ গুনছি। পাশের টেবিলে খানাপিনা সাজানো আছে। ভুলেও ওদিকে নজর দিচ্ছি না। যদিও আজ আমি খেয়েই এসেছি, পেট বেশ ভর্তিই আছে। তবু বলা যায় না, বাদশাহী খানাপিনা, লোভ যদি না সামলাতে পারি। ধীরে ধীরে চারদিক নিঝুম নিশুতি নিস্তব্ধ হয়ে আসে। আমি গুন গুন করে গান গাই। মাঝে মাঝে রাত জাগা পাখির কর্কশ আওয়াজে চমকে উঠি। বাগিচার কোথাও হয়তো কোনও জানোয়ার-এর পায়ের শব্দ কান পেতে শুনি।
এইভাবে রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরও কেটে যায়। এবার ধীরে ধীরে হতাশা গ্রাস করতে থাকে। না, সে বুঝি আর আসবে না। আমার এত তোড় জোড় এত আশা আকাঙ্ক্ষা সব বুঝি ভেস্তে গেলো। প্রিয়া আমার প্রতি বিরূপ হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
এই সময়ে কিছু নারী কণ্ঠের কলহাস্যে চকিত হয়ে তাকিয়ে দেখি দশটি সুদর্শনা সখী পরিবৃতা হয়ে সে ঘরের ভিতরে এসে দাঁড়িয়েছে। মনে হলো, দশটি উজ্জ্বল তারার মাঝখানে সে এক আসমানের চাঁদ। গাঢ় নীল রঙের রেশমী শাড়ি পরেছে। সারা অঙ্গ তার জহরতের গহনায় মোড়া। আরো কাছে এসে সে মুচকি হেসে বললো, বাঃ, চমৎকার। কিন্তু আজ তোমার ঘুম গেলো কোথায়, সাহেব। দিব্যি তো জেগে আছো দেখছি।
তোমার আগমনের খবর পেয়ে সে পালিয়েছে, সুন্দরী।
সখীদের ইশারা করতেই তারা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। সে আমার পাশে এসে বসলো। দু’হাতে আমাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলো। গভীর আশ্লেষে চুম্বন করলাম তাকে। সেও প্রতিদান দিলো। তারপর কাপেটের উপর শুয়ে পড়লাম দুজনে। সারাটা রাত ধরে সে আমাকে আদর সোহাগ করতে থাকলো। আমার এত দিনের কামনা বাসনা আজ চরিতার্থ হলো। দুজনে দু’জনকে জড়িয়ে ধরে সুখ নিদ্রায় ডুবে গেলাম।
সকালবেলা ঘুম ভাঙতেই চেয়ে দেখি, অনেক বেলা হয়ে গেছে। আমি বললাম, আজ চলি।
সে বললো, দাঁড়াও দু’টো কথা বলি। সারা রাত তো মত্ত হয়েই কেটেছে। কি আলাপ পরিচয় কিছুই হয়নি। তা সাহেবের নাম কি?
-আমার নাম আজিজ। তোমার?
—আমার নাম দুনিয়া। আমার বাবা কপূর আর প্রবাল দ্বীপের সুলতান। আজ তোমাকে একটা জিনিস উপহার দেব। ভালো করে রেখো। আমাদের প্রথম মিলনের স্মৃতি চিহ্ন। আমি যখন তোমার কাছে থাকবে না, এই রুমালখানা আমার কথা মনে করিয়ে দেবে তোমায়। সূক্ষ্ম কাজ করা আছে এক কোণায়। আমার নিজের হাতের কাজ।
এই বলে সে একখানা রেশমী রুমাল আমার হাতে তুলে দিলো।
আমি বাড়ি ফিরে এসে দেখি আজিজা কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়েছে। আমাকে দেখে সে হাসলো।
—একি তোমার চেহারা হয়েছে, আজিজ।
–ও কিছু নয়, আজিজ। আমি বেশ আছি। তোমার খবর কি বলো? গত রাতের সব ঘটনাই যথাযথ খুলে বললাম তাকে। রুমালখানা ওর হাতে দিয়ে বললাম, প্রথম মিলনের প্রীতি উপহার।
আজিজ। উৎফুল্ল হলো না। কোন উপদেশ দিলো না। শুধু বলতে পারলো, তুমি সুখী হয়েছ। আজিজ? তোমার মুখে হাসি দেখে যেতে পারলেই আমার অনেক পাওয়া হবে।
আমি উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করি, কোথায় যাবে, আজিজা?
–না মানে, চিরকালই তোমাদের এখানে থাকবো নাকি? বিয়ে শাদী করবো না? শ্বশুরঘর যাবো না?
–ওঃ, এই কথা।
–আমি হতাশ বলি, আমাকে ছেড়ে থাকতে তোমার কষ্ট হবে না, আজিজা?
—আমি যেখানে যাবো সেখানে কষ্ট বলে কিছু নাই।
আজিজার এই হেঁয়ালী ভরা কথার কোন অর্থ করতে পারলাম না। চেষ্টা করলাম না। কারণ তখন আমি সুখ, স্বপ্নে বিভোর।
আজিজ বললো, আমার সেই গানটা ওকে গেয়ে শুনিয়েছিলে?
—ও—ই-যাঃ! একদম ভুলে গেছি।
—ভুলে যাওয়াই স্বাভাবিক, আজিজ। যাক, আজ যদি মনে থাকে, গেয়ে শুনিও। ভালোবাসার মন্ত্র দিয়ে গড়া ঐ গানখানা। শুনলে, সে গুণী মেয়ে, নিশ্চয়ই তারিফ করবে।
বুঝলাম আমার এই ভুলে যাওয়ায় আজিজ আহত হয়েছে! স্বাভাবিক ভালোবাসার পাত্র যদি কোনও অনুরোধ রাখতে ভুলে যায় তা আমাৰ্জনীয় অপরাধ! আজিজার সঙ্গে আমার যা সম্পর্ক তা তো ভালোবাসা ছাড়া আর কোনও নামেই ব্যাখ্যা করা যায় না। আমি ওর হাত দুটো ধরে কাছে টেনে নিলাম। বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে আদর করে চুমু খেয়ে বললাম, আমাকে মাফ করো সোনা, আজই তাকে শোনাবো তোমার গান।
সেইদিন সন্ধ্যাবেলায় বাগিচায় ঢুকতেই দেখি দুনিয়া নিজে দাঁড়িয়ে আছে, আমার হাত ধরে জলসাঘরে নিয়ে গিয়ে বসালো। সেদিন রাতে আমরা একসঙ্গে বসে খানাপিনা করলাম। আদর সোহাগে আমার হৃদয় মন সে ভরিয়ে দিতে থাকলো। আমার জীবনে তখন যৌবনের ঢল। নেমেছে। সেই অবিশ্রান্ত বর্ষণে সব ভেসে একাকার হয়ে গেলো। সে রাতে আর আমরা ঘুমালাম না। একে অন্যের দেহ আশ্রয় করে সারাটা রাত মধুর করে কাটিয়ে দিলাম।
ভোরবেলা বিদায়ের পালা। হঠাৎ আমার মনে পড়লো আজিজার সেই ছলছল চোখ। আমার গানটা তাকে শুনিও। আমি বললাম, বিদায় নেবার আগে তোমাকে একটা গান শোনাবো। এই আমার স্মৃতি উপহার। যদি কোনওদিন তোমার কাছে নাই থাকতে পারি, তবে কখনও বৃষ্টিঝরা দিনে বাতায়ন পাশে বসে আমার কথা ভেবো।–আর আমার এই গানখানি গুণগুণ করে গোঁও, প্রিয়তমা।
ওগো আমার ভালোবাসা,
ওগো আমার প্রাণ,
আমার যাহা-সকল তোমায়
করেছি যে দান।
(আর) দেবার মতো নেইতো কিছু—
রেখে গেলাম ঋণ
তোমার আমার মিলন হবে
‘শেষ বিচারের দিন।’
গান শেষ হতে না হতেই দুনিয়া চিৎকার করে ওঠে, থামো। এ গান তুমি কোথায় পেলে? কে শিখিয়েছে তোমাকে?
আমি হতবাক। নিছকই একটা প্রেম-সঙ্গীত। তা শুনে দুনিয়া কেন এত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলো। বললাম, গানটা আমার চাচার মেয়ে আজিজা আমাকে শিখিয়েছে।
-সে তোমাকে ভালোবাসে?
আমি চুপ করে থাকি। কিন্তু সে আরও জোরে চিৎকার করে ওঠে, বলো, চুপ করে থেক না।
আমি ঘাড় নাড়লাম।-হ্যাঁ সে আমাকে প্ৰাণাধিক ভালোবাসে।
—তবে আমার সঙ্গে ঢং করতে এসেছে। কেন? একটা মেয়ের জীবন বরবাদ করে দিয়ে আর একটা মেয়েকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে এসেছো?
—আমি ছিনিমিনি খেলতে আসিনি সোনা, আমি তোমাকে প্ৰাণ দিয়ে ভালোবেসেছি।
–ছাই করেছো। সে-ও তোমাকে প্ৰাণ দিয়েই ভালোবাসে। তার জীবনটা নিয়েই বা এই রকম জুয়া খেললে কেন? বেচারী বোধ হয়। আর এতক্ষণে বেঁচে নাই।
আমি শিউড়ে উঠি, বেঁচে নাই? কে বলেছে তোমাকে?
—কে আবার বলবে। আমি লিখে দিতে পারি। সে আর জীবিত নাই! তুমি কি কিছুই বোঝা না, হাঁদা? গানটার মধ্যেই তো তা পরিষ্কার বলা আছে। যাও,বাড়ি যাও। দেখগে, সে আর এতক্ষণে এ জগতে নাই। ছিঃ ছিঃ আজিজ, একটা মেয়ের নিষ্পাপ ভালোবাসা পায়ে দলে কি করে পারলে তুমি আমার কাছে আসতে?
আমি মাথা নিচু করে বসে থাকি। তুমি প্রেমের অযোগ্য পাত্ব। তোমার সঙ্গে আর আমার কোনও সম্পর্ক নাই। তুমি নিজে হাতে তোমার প্ৰেমাস্পদকে খুন করেছে। প্রেমের যে মর্যাদা দিতে পারে না, তার কাছ থেকেই আমিই বা কি পাবো। তুমি যাও, বিদায় হও। তার কবরে একটা ফুলের তোড়া দিয়েও অন্তত তোমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত কর গে।
আমি ধীর বিষণ্ণ পায়ে বাড়ি ফিরি। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই চমকে উঠি। একটু করুণ কান্নার রোল উঠেছে। অনেক লোকজন জড় হয়েছে।
দুনিয়া ঠিকই বলেছিলো। আজিজা আর ইহজগতে নাই। আজ ভোরেই সে মারা গেছে। জহর খেয়েছিলো।
আমার সারা শরীর অবশ অসাড় হয়ে আসে। কান্নায় মুখ ঢেকে বসে পড়ি। একি করলাম আমি। সাব-সব আমার দোষী!
সারাটা বছর ধরে শুধু কাঁদলাম। সেই প্রথম অনুভব করলাম, আমিও আজিজাকে ভালোবাসতাম। সে-ভালোবাসার আগুনের শিখা কোনদিনই লেলিহান ছিলো না। মৃদু মিষ্টি মোমের আলোর মতো সে প্রেম ছিলো স্নিগ্ধ-সুরভিত। সে যতদিন ছিলো—তার অভাব অনুভব করতে পারিনি। আজ তার অভাবে বিশ্ব সংসার আমার কাছে বিষবৎ মনে হতে থাকে—জীবনের আর কোনও দাম নাই-বাঁচার আরও কোনও মানে নাই।
তবু বাঁচতে হয়। তাই আবার রোজগারের ধান্দায় বেরিয়ে পড়ি। দেশে দেশে ঘুরি। মন ভোলানো হরেক রকম বাহারী জিনিস ফিরি করে ফিরি। কিন্তু আমরা মন কিছুতে ভোলে না। অহরহ সেই এক চিন্তা-আজিজ। আমার নয়নের মণি-আমার কলিজা।