তানিয়ার প্রিয় পোষা প্রাণী হচ্ছে সাপ!
অনেকেরই অনেক আজব শখ থাকে। আশ্চর্যের কিছুই নেই। তানিয়াও সাপ ভালবাসে। একটা বড় মাপের সাপ পোষার ইচ্ছে তার বহুদিনের। আশটে শীতল প্রাণীটার প্রতি তার একটা ফ্যাসিনেশন আছে। রাজকীয় একটা ভাব। প্রাচীন মিশরে ক্লিওপেট্রাও নাকি সাপ পুষতেন। কাটাবনে রেগুলার ঢু মারে সে। কিন্তু সাপ কে বিক্রি করবে সেখানে? পেট ওয়ার্ল্ড নামের একটা দোকান হয়েছে নতুন একদিন সেখানে ঢু মারল তানিয়া।
“আপা কি লাগবে বলেন। খরগোশ, কচ্ছপ, রঙিণ মাছ, টিয়া, কাকাতুয়া, কবুতর………?” দোকানদার ছেলেটা একগাল হেসে জিজ্ঞেস করল তাকে।
-সাপ আছে?
দোকানদারের হাসি নিভে গেল তার প্রশ্ন শুনে। “আপায় খালি মজা নেন”। সামলে নিল সে মুহুর্তেই।
তানিয়া শ্রাগ করল, “না আমি সিরিয়াস। সাপই লাগবে আমার”।
-আপা সাপ সেল করা তো এইদেশে তাও। একে তো বেআইনি। দ্বিতীয়ত কেউ পালে না। ডিমান্ড নাই।
-আমাকে একটা ম্যানেজ করে দিতে পারবেন?
-আপা অনেক খরচ। আর ঝামেলাও বহুত।
-খরচ নিয়ে চিন্তা নাই আপনি এনে দেবেন।
মাথা চুলকাল ছেলেটা। তারপর বলল, “আইচ্ছা আপা চেষ্টা নিব। আপনের নাম্বার রাইখা যান”।
ছেলেটাকে নাম্বার দিয়ে এল তানিয়া। তারপর রিকশা নিল ধানমন্ডির উদ্দেশ্যে। ছেলেকে ঘুম পারিয়ে রেখে এসেছে সে। তার উঠবার আগেই বাসায় যেতে হবে তার।
তানিয়ার স্বামী রিয়াজ পারভেজ পেশায় মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। বাইরে বাইরে থাকেন। চার পাঁচ ছমাসে একবার দেশে আসেন। সময় কাটাবার জন্য তানিয়াকে নানা আজগুবি কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হয়।
পরের মাসেই ফোন এল পেট ওয়ার্ল্ডের দোকানদার ছেলেটার।
-আপা একটা ম্যানেজ করছি।
-কেমন?
-বার্মিজ জিনিষ। আইসা পড়েন।
তানিয়া তার ছেলে রাফিদকে নিয়ে ছুটে গেল কাঁটাবন। দোকানের পেছনদিকটায় গুদামে নিয়ে গেল ছেলেটা তাকে। নানা ধরণের পোষা প্রাণীর কিচিরমিচিরের জ্বালায় কথা বলাই দায়। বিশাল একটা কাঠের বাক্সের ডালাটা উপর করে ধরল দোকানদার। দাঁত কেলিয়ে বলল, “আপা সাইজ বার ফুট। বার্মিজ পাইথন।” তানিয়া আর রাফিদ দেখল সাপটাকে। রাজকীয় ভঙ্গীতে কুন্ডলি পাকিয়ে আছে সর্পরাজ। খয়েরী আশের ওপর কাল রঙের চতুর্ভুজ আঁকা। রঙিন আর রাজকীয়। প্রথম দর্শনেই ভালবেসে ফেলল তানিয়া সাপটাকে। এটাকে পেতেই হবে তার। হাত বাড়িয়ে মসৃণ ঠান্ডা চামড়া স্পর্শ করল সে সাপটার।
চেক লিখে দিয়ে রাফিদকে নিয়ে বের হয়ে এল তানিয়া। কিছু কেনাকাটা করতে হবে তার। কালই পেট ওয়ার্ল্ডের লোকেরা তার বাসায় গিয়ে ট্যাংক সেট করে দিয়ে আসবে সাপটার জন্য।
রাতটা কাটতে চাইছিল না তানিয়ার। কখন তার সাপ বাসায় আসবে সেই চিন্তায়। ট্যাংক রাখবার জন্য একটা জায়গাও পরিস্কার করে রেখেছে সে বাড়িতে। সকালে কলিংবেলের আওয়াজ শুনে উঠে গিয়ে দরজা খুলল সে। পেট ওয়ার্ল্ডের ছোকড়া দোকানদারটা দাঁড়িয়ে আছে। লিভিংরুমে বিশাল ট্যাংকটা সেট করল তারা। চারকোনা কাচের ট্যাংক। ভেতরে মসৃণ নুড়ি পাথর। তার ভেতরে ভরে দিল তারা বিশাল মাপের রাজকীয় সাপ টাকে। খাবার খাওয়ানর নিয়ম তানিয়াকে পই পই করে বুঝিয়ে দিল দোকানী ছোকড়া।
ওরা চলে গেলে ট্যাংকের কাছে এসে দাড়াল তানিয়া। কি আশ্চর্য! সাপটাও তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
সপ্তাহখানেকের মধ্যে সাপটার সাথে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে এল। রাফিদ পর্যন্ত সাপটার জন্য পাগল। তানিয়া লক্ষ্য করল সাপটা প্রায়ই ট্যাংকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সম্ভবত বাইরে আসতে চায়। আহারে বেচারা! তানিয়া সাপটাকে টেনে বের করল ট্যাংক থেকে। ছেড়ে দিল নীচে। সাপটা কিছুক্ষণ থেমে থেকে একেবেকে চলতে শুরু করল।
রাফিদের সাথে সাপটার খাতির দেখে তানিয়া অবাকই হল। রাফিদ সাপটাকে নিয়ে প্রায়ই বাড়ির পেছনের ছোট্ট উঠানে খেলতে যায়। সাপা এখন খোলাই থাকে বেশীরভাগ সময়। বাড়ির আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ায়।
সপ্তাহখানেক পর তানিয়া অবাক হয়ে লক্ষ্য করল সাপটা খাচ্ছে না। অনেক চেষ্টা করেও কিছু খাওয়ানো গেল না সাপটাকে। এভাবে চারদিন পার হলে আতংকিত তানিয়া ফোন করল পেট ওয়ার্ল্ডের দোকানি ছোকড়াকে।
-হ্যালো আপা? কেমুন আছেন? সাপের কি অবস্থা?
-এইতো ভাল। আমার সাপটাতো তিনদিন ধরে কিছু খাচ্ছে না।
-আপা সাপ তো অনেকদিন পর্যন্ত না খাইয়াও থাকতে পারে। বড় কিছু খাওয়ার ইচ্ছা হইলে এরকম করে সাপেরা। আপনে টেনশন নিয়েন না। আর সাপ ট্যাংকের থিকা বাইর কইরেন না।
-হুম। কি করা যায়?
-আপা আপনারে খাবারের আরেকটা প্যাকেট দিছিলাম না। ওইটা খাইতে দেন। আর টেনশন নিয়েন না। এই পুরা মাসে যদি আর কিছু না খায় তাইলে তিরিশ তারিখে আমাদের এইখানে নিয়া আসবেন।
তানিয়া ফোন রেখে দিল। অন্য প্যাকেটটা খুলে খাবার দিল সাপের সামনে। একভাবে বসে রইল সাপটা। নড়াচড়া করছে না। খাবারের দিকে তাকালো না পর্যন্ত। ত্রিশ তারিখের অপেক্ষায় রইল তানিয়া।
সেদিন রাতে গায়ে এক ধরণের শীতল স্পর্শ পেয়ে ঘুম ভাঙল তানিয়ার। হাত বাড়াতেই পিচ্ছিল একটা কিছু হাতে লাগল তার। লাফিয়ে ঊঠে বসল সে।
তার পাশে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে সাপটা। শক্ত হয়ে আছে। তানিয়া শিউরে উঠল। ঘটনা কি?
তবে আশ্চর্য হলেও ভয় পেল না সে। সাপটাকে নিজের ঘাড়ে জড়িয়ে নিয়ে নীচে নেমে এল। ট্যাংকে ছেড়ে দিল
সেটাকে। ট্যাংকের ভেতর তখনও পড়ে আছে সাপের খাবার। সাপটা ওগুলো ছুয়েও দেখেনি।
দুদিন কেটে গেল আরও। দুপুর বেলায় তানিয়া রান্না করছিল। রাফিদ বার্মিজ পাইথন নিয়ে খেলছিল বাসার পিছনের উঠোনে। তানিয়ার রান্নাঘরটা থেকে পেছনের উঠোনটা দেখা যায়। রান্না করতে করতে ওদের দুজনের ওপরও নজর রাখছিল তানিয়া। ডালে বাগাড় দেওয়া হলে আবার ওদের দিকে তাকাল তানিয়া। রাফিদ সবুজ ঘাসের বুকে সোজা হয়ে শুয়ে আছে। তার পাশে লম্বা হয়ে পড়ে আছে সাপটা। সেদিনকার মত শক্ত আর সোজা হয়ে। তানিয়া ভয় পেয়ে গেল। তার এত সাধের সাপ কি তাহলে মরতে বসেছে? ছুটে গেল সে নিচতলায়। ফোন তুলে ডায়াল করল পেট ওয়ার্ল্ডের ছোকড়াকে।
-হ্যালো সালাম আপা। ভালো আছেন।
-ভাই আমার সাপ তো মনে হয় মারা যাচ্ছে।
-ক্যান? ক্যান?
-কয়েকদিন ধরে কিচ্ছু খাচ্ছে না আর এখন লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। আমার ছেলের সাথে খেলছিল। এখন দেখলাম টানটান হয়ে ওর পাশে শুয়ে আছে।
-বলেন কি?
-হ্যাঁ। কয়েকদিন আগে রাতে আমি ঘুমাচ্ছিলাম সাপটা আমার পাশেও লম্বা টানটান হয়ে শুয়ে ছিল।
-সর্বনাশ!
-কি হয়েছে?
-আপা আপনে এখনই সাপটাকে নিয়া ট্যাংকে ভরেন। হাতে ছুরি বা বন্দুক থাকলে বাসায় হাতে রাইখা নেন। সর্বনাশ হইয়া যাইব। আমি আপনারে নিষেধ করছিলাম সাপ ট্যাংকের ভীতর থিকা বাইর করতে। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আসতেছি।
-কেন কি হয়েছে?
– সাপটা মরতেছে না। ও আপনাদের খাওয়ার তাক করতেছে। বার্মিজ পাইথন বড় কিছু খাবার আগে এভাবেই সেটার পাশে লম্বা হইয়া শুইয়া মাপ দেয়।
তানিয়া এ পর্যন্ত শুনে ছুটে যায় রান্নাঘরে। জানালা দিয়ে উঠানের দিকে তাকাল। এবং সে দেখতে পেল রাফিদের কোমড় পর্যন্ত শরীরের উপরের অংশ ঢুকে রয়েছে তার বার্মিজ পাইথনের বিশাল মুখে।