“রকি, রকি ওদিকে যাস না এদিকে আয় বললাম”। বিরক্ত হয়ে পকেট থেকে একটা বিস্কুট বের করে ছুড়ে দিলাম ওর দিকে। শুন্যে থাকতেই লাফিয়ে গিয়ে লুফে নিল ও বিস্কুটটা। “এদিকে আয় বললাম।” ওকে আবার ডাকলাম আমি। ল্যাজটা নাড়তে নাড়তে এসে আমার পা চেটে দিল সে। নীচে বসতেই গাল ধরল। “উঁহু ব্যাড বয়। এগুলা ঠিক না। আমি কিন্তু রাগ হব”।
রকি আমার কুকুরের নাম। বেশ! ওকে কুকুর না বলে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড বলাই ভাল। পৃথিবীতে আমার একমাত্র আপনজন। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাগরিবের আজান পড়বে ওকে নিয়ে বাড়ি ফেরা দরকার। আমি ওর গলার বেল্টে চেন বাঁধলাম। বাধ্য ছেলের মত ও পিছে পিছে আসতে শুরু করল আমার। বাড়িতে এনে ওকে খাওয়ালাম। তারপর টেলিভিশন ছেড়ে দিয়ে নিজে খেতে বসলাম। “হুফ! হুফ!” দুবার ডেকে উঠল কুকুরটা। টিভিতে ওর প্রিয় অ্যানিমেটেড সিরিয়াল ১০১ ডালমেশিয়ানস শুরু হয়েছে। রকি এই কার্টুনটা সবসময় খুব মনোযোগ দিয়ে দেখে। কি বোঝে ওই জানে। ভাত তরকারী বেড়ে খেতে শুরু করলাম আমি।
আজ থেকে বছর চারেক আগের কথা। ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন। ঢাকার রাস্তাঘাট পানিতে একাকার। আমি তখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। বন্ধুদের নিয়ে ভিজতে বের হয়েছিলাম। আমার সবচাইতে প্রিয় তিনজন বন্ধু। রাফি, সারা আর সায়েম। ঘুরতে ঘুরতে জিয়া উদ্যানের দিকে যাচ্ছিলাম তখনই কুই কুই ধরণের আওয়াজটা শুনলাম। এড়িয়েই যাচ্ছিলাম তখনই আবার ডাকটা শুনলাম, “কুই! কুই! কুই!” আমার টনক নড়ল। একটু খুজতেই পেয়ে গেলাম শব্দের উৎসটাকে। বাচ্চা একটা কুকুর। প্রচন্ড ভয়ে আর শীতে কাঁপছে। বাদামী কোমল লোমগুলো খাড়া হয়ে গেছে। সাফা দেখেই বলল, “কি কিউট!” সায়েম বলল, “ধুর ব্যাটা বাদ দে তো চল”।আমার ব্যাগে ছাতা ছিল। বের করে খুললাম ওটা। এক হাতে কোলে নিলাম কুকুরটাকে আরেকহাত দিয়ে ছাতা ধরলাম ওর মাথায়। বললাম, “চল”।
তখন এক ছেলের সাথে চরম ক্ল্যাশ ছিল আমার। ছেলেটার নাম ছিল রকি ওর নামেই কুকুরুটার নাম রাখলাম আমি। মা বাবার কুকুর নিয়ে আপত্তি ছিল না। রকি রাজার হালে থাকা শুরু করল আমার বাড়িতে। আমার মায়ের পায়ে পায়ে ঘুরত। বাবার কোলে উঠে বসে থাকত। ওকে নিয়মিত ভাল সাবান দিয়ে গোসল করানো হত। দেশী কুকুর হলে কি হবে। ভাল যত্ন পেয়ে বাঘের মত হয়ে উঠল দিন কে দিন। এলাকার অন্য কুকুরেরা ওর দৌরাত্বে বাসার ত্রিসীমানায় আসতো না।
তারপর বেশ অনেকদিন কেটে গেছে। রকি এখন পূর্ণবয়স্ক। মাবাবার এক্সিডেন্টে হঠাৎ মৃত্যুর পর রকিই এখন আমার একমাত্র আপনজন।
খাওয়া শেষ করে গিয়ে ওর পাশে বসলাম। রিমোটটা নিয়ে নিউজ চ্যানেলে ঢুকলাম। খবরের নীচে হেডলাইন লেখা আর সেই লাইনের ওপরে লাল ব্যাকগ্রাউন্ডে লেখা ব্রেকিং নিউজ। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে এক কয়েদী পালিয়েছে। কয়েদীর ছবি আর কোয়ালিফিকেশন লেখা আছে। নগ্ন জ্ঞা। শুধু একটা ফুলপ্যান্ট পড়া। রোগা মুখে হালকা দাড়ি আছে, গায়ের রং শ্যামলা। একে দেখা মাত্র যেন পুলিশে খবর দেওয়া হয়। কয়েদি রড দিয়ে পিটিয়ে বারো জনকে খুন করেছে। এমনকি পালাবার সময়ও সেন্ট্রাল জেলের এক রক্ষীকে খুন করে পালিয়েছে সে। রকি আমার শর্টসের পায়া কামড়ে ধরে হালকা টান দিল। ওকে বাথরুমে নিতে হবে তার সিগন্যাল। আমি রিমোট রেখে উঠে দাঁড়ালাম।
সকাল বেলা রকিকে আরেকদফা বাথরুম করিয়ে খাওয়াতে হয় তারপর আমি অফিসে যাই। বাথরুম করানোর সময়ই ফোন আসলো। সোনালী ফোন করেছে। আমি ফোন কানে নিলাম।
-কই তুমি?
-রেডি হচ্ছি।
-আচ্ছা আমিও হচ্ছি। যাবার সময় আমাকে পিক করে নিয়ে যাবা।
-ওকে।
সোনালী আর আমি একই অফিসে চাকরি করি। ও অবশ্য জুনিয়র আমার। আমাদের বিয়ের কথাবার্তা চলছে। সামনের জানুয়ারীতেই আমরা বিয়ে করছি। ওর ফ্যামিলি থেকে কোন আপত্তি নেই। আর ও ও রকিকে খুব পছন্দ করে। ছোটবেলা থেকেই নাকি ওর কুকুরের অনেক শখ ছিল। মা বাবার আপত্তির কারণে সে কুকুর রাখতে পারেনি বাড়িতে। যাই হোক। রকির মাথায় হাট বুলিয়ে গাড়ির চাবি নিয়ে বের হয়ে গেলাম আমি। বললাম, “খেয়াল রাখিস। কোন জেলপলাতক কয়েদি যেন বাসায় না ঢোকে”।
হুফ! হুফ! জবাব দিল সে। রকিকে এড়িয়ে বাসায় একটা মশাও ঢুকতে পারবে না।
সেদিন অফিসের কাজ শেষ করে সোনালিকে নিয়ে ডিনারে গেলাম আমি।
“মা বাবা বলছিলেন বিয়ের কার্ড ছাপানো শুরু করিয়ে দিতে”। বলল সে। কাধ ঝাঁকালাম আমি, “হুম করা তো দরকারই কিন্তু আমি ছাপিয়ে দিব কাকে?”
মেয়েটা আমার হাতটা ধরলো। সে জানে এমনটা করলে আমি ভরসা পাই। বলল, “সেটা নিয়ে চিন্তা কর না তো। আমি দেখব। কার্ড অলরেডি ছাপাতে দিয়েছি”।
-বাব্বাহ! বাঁচালে!
-রকি কেমন আছে?
-ভালই।
-জেল থেকে এক কয়েদি পালিয়েছে শুনেছো?
-হ্যাঁ।
-একা বাসায় থাকো সাবধানে থেকো। তোমার কুকুর আছে বলেই ভরসা নাহলে ভয়ই লাগে।
-রকি আছে। চিন্তার কিছু নাই।
টুকটাক আরও কিছু কথাবার্তা সেরে উঠে পড়লাম আমরা। সোনালীকে ওর বাসায় ড্রপ করে নিজের বাসায় ফিরে এলাম। দরজা খুলে ঢুকলাম। রকি শুয়ে আছে কার্পেটে। “কি রে কি অবস্থা তোর?”
ওর শুয়ে থাকার ভঙ্গিটা ঠিক স্বাভাবিক লাগলো না আমার কাছে। গোঙানোর মত শব্দ বের করল গলা দিয়ে। নিঃশ্বাস নিতে পারছে না যেন। আমি ওর ঘাড়ে গলায় মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। পানি সাধলাম। বিস্কুট সাধলাম। কিছুতেই কিছু হল না। ছটফট করছে রকি। পকেট থেকে ফোন বের করে দ্রুত ফোন করলাম লোকাল ভেটেরেনারি ডক্টরকে। উনার নাম আকমল হুদা। কাছেই বাসা।
-হ্যালো আকমল সাহেব?
-আরে রাজীব সাহেব। হঠাত! আপনার রকির কি কোন সমস্যা নাকি?
-হ্যাঁ। অফিস থেকে ফিরে দেখি কি যেন হয়েছে। দম নিতে পারছে না। কিছু খাচ্ছেও না ছটফট করছে।
-আচ্ছা আপনি ওকে এখনই আমার বাসায় নিয়ে আসুন। চেম্বারতো বন্ধ বাসাতেই আনুন।
-আমি এখনি আসছি।
ফোন পকেটে রেখে রকির বিশাল শরীরটা পাজাকোলা করে তুললাম। তীব্র আপত্তি জানাল সে। লাভ হল না। গাড়ির পেছনের সিটে ওকে শুইয়ে দিয়ে গাড়ি স্টার্ট করলাম। একব্লক সামনে আকমল সাহেবের বাসা গাড়ি থামিয়ে ওকে নিয়েই ঢুকে গেলাম বাড়িতে। আকমল সাহেব অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করলেন। তারপর বললেন, “কিছু খেতে নিয়ে গলায় আটকে গেছে সম্ভবত। অপারেশন লাগবে ছোট একটা। চিন্তা করবেন না। কাল সকালে এসে ওকে নিয়ে যাবেন”।
দুশ্চিন্তা হচ্ছিল প্রচন্ড। আর কোন উপায়ওনেই। আমি ক্লান্ত পায়ে বাসা থেকে বের হয়ে এলাম। গাড়ি ডক্টর আকমলের গ্যারেজেই থাকল। হেঁটে চলে গেলাম বাসায়। রকি বেচারার জন্য খারাপই লাগছে। মোবাইল বেজে উঠল পকেটে। পকেট থেকে বের করে কানে নিলাম। সোনালীর ফোন। ওকে ঘটনাটা বললাম। ও বলল, “চিন্তা কর না। কাল আসবো তোমার ওখানে। ওকে দেখতে”।
-হুম।
-আচ্ছা রাতে খেয়ে নিয়ো। বাই
আমি ফোন রেখে দিলাম। জুতা মোজা খুলে বেডরুমের দিকে যাচ্ছিলাম এমন সময় আবার বেজে উঠল মোবাইল। ডক্টর আকমল ফোন করেছেন।
-হ্যালো ডক্টর।
-রাজীব সাহেব এখন কোথায় আপনি?
-বাসায় এসেছি।
-আপনি এই মুহুর্তে ভালো করে দরজায় তালা মেরে বের হয়ে আসুন। আমার বাসায় চলে আসবেন। এক মুহুর্ত দেরী করবেন না।
-রকি ঠিক আছে তো?
-নিজের চোখেই দেখবেন।
ফোন কেটে যেতেই আমি দরজার দিকে ছুটে গেলাম। রকির অমঙ্গল চিন্তায় মন আচ্ছন্ন হয়ে ছিল। দরজায় তালা মেরে ছুটে গেলাম। ব্লক পার হতেই একটা পুলিশের গাড়ি হুশ করে চলে গেল আমার পাশ দিয়ে। আকমল সাহেব বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমাকে বললেন, “ভেতরে আসেন”।
আমি বললাম, “রকি?”
-রকি ভাল আছে। এদিকে আসেন।
-কি হয়েছিল ওর?
-ও এগুলো গিলে ফেলেছিল। ওর গলায় আটকে গিয়েছিল এগুলো।
আকমল সাহেব আমার আমার সামনে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ ধরলেন ওর ভেতরের পদার্থটা দেখে নাড়ি উল্টিয়ে এল আমার।
প্লাস্টিকের ব্যাগের ভেতর মানুষের তিনটা বিচ্ছিন্ন আঙুল।
পুলিশ আকমল সাহেবই ডেকে এনেছিলেন। সেদিন রাতেই আমার বাসা থেকে আহত অবস্থায় জেলপলাতক সেই খুনে কয়েদিকে উদ্ধার করা হয়। হারামজাদা আমার ফেভারিট বাদামী মোজা দিয়ে নিজের হাতের ক্ষতস্থান বেধে রেখেছিল। রকির অহেতুক ডাকাডাকির অভ্যাস নেই। খুনী জানত না যে বাড়িতে কুকুর আছে। ক্লিপ দিয়ে তালা খুলে ভেতরে ঢোকামাত্রই রকি তাকে আক্রমণ করে। হাত কামড়ে ধরে। তিনটা আঙুল রকির মুখেই রয়ে যায় যা তার গলায় আটকে যায়। এই সুযোগে সে গিয়ে আমার বেডরুমে লুকিয়ে পড়ে। তার কাছে একটা লোহার মোটা আর ভারী রড পেয়েছিল পুলিশ।
আকমল সাহেব যদি সেদিন আরেকটু পর ফোন করতেন?
নাহ সে কথা আমি কল্পনাও করতে চাই না।