গ্রিফিনো আমার পায়ে মুখ ঘষছে। আমি হাটুগেড়ে বসে পরম যত্নে ওকে কাছে টেনে নিলাম ।ওর গলা থেকে একটা মৃদু ঘড়ঘড় শব্দ বেরিয়ে এলো। ঘাড়ের নরম কেশরগুলো আমার গলার কাছে এসে সুড়সুড়ি দিতে লাগলো।তারপর অকস্মাৎ একধাক্কায় আমায় শুন্যে ছুড়ে দিয়ে নিজের বিশাল ডানাদুটো মেলে ধরলো গ্রিফিনো ।
আমি যখন প্রায় মেঝের কাছাকাছি চলে এলাম তখনি ওর সামনের পা দুটো দিয়ে খপ করে ধরে নিয়ে আমায় পিঠে বসিয়ে শুন্যে উড়াল দিলো আমার পাঁচ হাজার বছর আগের পোষা প্রানীটা। পুরনো বন্ধুকে অনেকদিন পর নতুন করে খুঁজে পেয়ে খেলার শখ জেগেছে ওর।
ওর এই অভ্যাসগুলো পূর্বজন্মের। এর পুনরাবৃত্তি পূর্বজন্মের ঘটনাগুলো কে আবছা অন্ধকার থেকে বের করে নিয়ে এসে আলোকিত করে দিচ্ছে। ধীরেধীরে নিজের হারিয়ে যাওয়া পরিচয় খুঁজে পাচ্ছি যেন।সময়ের স্রোতে ভেসে যাওয়া পুরনো অস্তিত্বহীন আমি আবার ফিরে আসছি একবিংশ শতাব্দীর এই নতুন আমির মধ্যে।
গ্রিফিনোর মাথায় হাত বুলানোর পর থেকেই আমি আমার আগের জীবনের স্মৃতি ফিরে পেতে শুরু করেছি। মনে পড়ছে ফারাওর মুকুট পরিহিত একটা অল্পবয়স্ক কিশোরের মিশরীয় সিংহাসনে বসার অভিজ্ঞতার কথা।উনিশ বছর বয়সী এক কিশোরের মাত্র দশ বছরের রাজত্বের কথা। তার অভিশপ্ত হওয়ার কথা।
সেই ছেলেটা স্বভাবগত কারনেই অনেকটা অবাধ্য, কিছুটা একগুঁয়ে আর খুব বেশী অধার্মিক।তৎকালীন ধর্মীয় রীতিনীতি যার দুরন্ত মস্তিষ্কে ঢুকতোনা। সে জানতোনা এর পরিণাম কতটা ভয়াবহ হতে পারে। মহামারী তে আক্রান্ত ছেলেটার মৃত্যুশয্যায় কত রাজা মহারাজা আর রাজ্যের নৃশংস পুরোহিত রা ব্যাঙ্গের হাসি হেসেছে তার হিসেব নেই।
অবাধ্য এই কিশোরের উচিত শিক্ষা হোক সেটাই ছিলো সবার কাম্য। অথচ পাপপুণ্য বিচার করার ক্ষমতা যে ছেলেটার থাকার কথা না। তাকে সেগুলোর মর্ম বোঝাতে আসেনি কেউ। অথচ তার মৃত্যু দেখে উল্লাস করার মত লোকের অভাব হয়নি।
আমার মমি কফিনে করে পিরামিডের ভেতরে রাখবার সময় তাতে প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী প্রচুর পরিমানে মহামূল্যবান হীরা জহরত মনি মুক্তা রাখা হয়েছিলো। অনেকের তাতেও আপত্তি ছিলো। ওগুলো নাকি স্রেফ নিয়ম রক্ষার জন্য।
লাশ সৎকারের দায়িত্বে থাকা প্রধান পুরোহিত বেন্নেস বলেছিলো,
-শুধুমাত্র প্রথার জোরে এই অভিশপ্ত বালক রাজার কবরে এত দামী সব জিনিস রাখা অপচয় ব্যতীত আর কিছুই নয়। যদিও এখন এই ধনসম্পদ ও এই বেয়াদব কিশোরের মতই অভিশপ্ত। এই অভিশপ্ত ধনরত্ন কেউ ছুঁয়ে ফেললেই তার পরিণাম ও তুতানখামেনের মতই ভয়াবহ হবে।
বলে হেসেছিল বেন্নেস।
ওর ক্রুর হাসিটাও মনে পড়ে গেলো। কি নিষ্ঠুর, পৈশাচিক সেই হাসি।
এসব বিভোর হয়ে ভাবছিলাম। এরইমধ্যে গ্রিফিনো আমায় শুন্যে উড়িয়ে নিয়ে কখন যে পাথুরে মেঝেতে নামিয়ে দিয়েছে টের পাইনি। ভূমির সংস্পর্শে ফিরে এসে চোখে পড়লো মেঝেতে ছড়ানো ছিটানো মূল্যবান পাথর, তৈজসপত্র আর অলঙ্কার গুলো। সেগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকলে যে কোন মানুষের মন লোভাতুর হয়ে উঠবে। কিন্তু আমি তো রাজা। প্রচুর প্রাচুর্যের মধ্যে বেড়ে উঠেছি আমি। এমনকি আমার কবরেও ধনসম্পদের ঘাটতি ছিলোনা। তাই আমার বিন্দুমাত্র লোভ হচ্ছেনা।
বরং যখন থেকে আমার তুতানখামেন হওয়ার ব্যপারটা জানতে পেরেছি তখন থেকেই একটা বিষয় জানার জন্য মনটা ছটফট করছে। আমাকে যেহেতু এই পিরামিডেই নিয়ে আসা হয়েছে তখন নিশ্চই আমার লাশ ও এই পিরামিডেই থাকবে। মমি করা লাশ তো পচে গলে নষ্ট হওয়ার ও কোন সুযোগ নেই। কাজেই আমি নিশ্চই আমার পুরাতন স্বত্তার সাথে নতুন করে পরিচিত হতে পারবো।
এরকম ভাগ্য কজনের হয়?
আমি পাগলের মত সবগুলো কফিন খুলে খুলে দেখতে লাগলাম। যখন প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছি তখন ডালাভাঙা একটা কফিনে খুঁজে পেলাম মমিকৃত নিজেকে।প্রথম দেখায় নিজের চোখকে বিশ্বাস হয়না ।
এখনকার আমার সাথে ঐ মমির পার্থক্য হলো হাজার হাজার বছরের পুরনো আর মলিন ধুলোমাখা ওটার দেহ এবং পোশাক। তবুও মনে হয় যেন মরেনি ঘুমিয়ে আছে। আপনা থেকেই হাতটা চলে গেলো যুগ যুগ ধরে পড়ে থাকা আমার ই লাশের বুকের ওপর ভাজ করে রাখা হাত দুটোর দিকে।
একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিতেই চমকে উঠলাম। আমার হাত রাখাতে যেন ধীরেধীরে প্রাণসঞ্চার
হচ্ছে ওটাতে। শুধু হাত নয় পুরোদেহ সজীব হয়ে উঠলো কিছুক্ষনের মধ্যেই। তারপর বুকের ওপর থেকে ভাজ করা হাতদুটো নামিয়ে বসে পড়লো কফিনের মধ্যেই। চোখদুটো এমনভাবে খুললো যেমন করে দরজার কপাট ঝড়ের তোড়ে আচমকা খুলে যায়।সে চোখে ছলছল করতে থাকা জল আর আশান্বিত দৃষ্টি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম! সজীব ও সতেজ দেহটায় এক অদ্ভুত সোনালী আভা ঝলমল করছে!
অদ্ভুত একটা ব্যাপার যে ঘটে চলেছে সেদিকে তেমন মনোযোগ ই নেই আমার । আমি কিছু বলার বা করার আগেই আরেকটা ঘটনা ঘটলো। মমির গায়ের সোনালী আভা আমার শরীরেও দেখা দিতে লাগলো। একটা সোনালী দ্যুতি আমার সারাদেহের পরিধিরেখা বরাবর ছড়িয়ে পড়লো।
আর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো ভয়ানক যন্ত্রনা। আমায় যেন কেউ তীক্ষ্ণ ধারালো অস্ত্র দিয়ে বারবার আঘাত করছে ।চরম আক্রোশে ফালাফালা করে দিচ্ছে দেহের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ! ব্যথার চোটে তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠলাম!আমার আর্তনাদ শুনে পাশে থাকা পোষা প্রানী গ্রিফিনো দৌড়ে ছুটে এলো। কিন্তু ঐ সোনালী আলোর গন্ডির মাঝে আসতেই ছিটকে সরে গেলো কয়েকহাত দূরে।
আমি মমির মুখের দিকে চাইলাম আবার। কিন্তু একি! আলোকিত এবং আশান্বিত চোখমুখ এমন অস্বাভাবিক রাগান্বিত দেখাচ্ছে কেন? এবার ওর ঠোটদুটো নড়ে উঠলো। আমার সজীব হওয়া মমি আমাকে কিছু বলতে চাইছে। তার ঠোট নড়ছে এবং গলার আওয়াজ ও শুনতে পাচ্ছি কিন্তু ভাষা অচেনা। আমি ব্যথা সহ্য করতে করতেই নিজের ভাষাতেই প্রশ্ন করলাম
-আমায় এই যন্ত্রণা দিয়ে কি লাভ তোমার?কি চাও তুমি?
বলেই নিজের কণ্ঠ আর ভাষা শুনে অবাক হলাম। এমন কর্কশ কণ্ঠস্বর আর অপরিচিত ভাষা আমার মুখ থেকে কিভাবে বেরুলো?ঠিক এই ভাষাটাই আমার মমির মুখ থেকে শোনা যাচ্ছে। হয়তো কিছু সময় গেলে এর মানেও বুঝতে পারবো। কিন্তু ততক্ষণ বেঁচে থাকতে পারবো কিনা কে জানে। নিদারুণ যন্ত্রনায় অবশ হয়ে আসছে শরীর, বোধহয় অজ্ঞান হয়ে যাবো।
জ্ঞান হারাবার আগমুহুর্তে মমির মুখ নিঃসৃত বাক্যগুলোর অর্থ স্পষ্ট হয়ে এলো আমার কাছে । যা শুনলাম তার অর্থ বুঝতে পেরে সমস্ত দেহ শিহরিত হয়ে উঠলো।
আমার এক স্বত্তা মমি আরেক স্বত্তা আমাকে বলছে
-আমি তো অভিশপ্ত রাজা। দেবতাদের অভিশাপে সুখের রাজত্ব ছেড়ে অল্পবয়সে মরেছি। আমাদের দুজনের মধ্যে তো কোন পার্থক্য নেই।তবে তুই কেন মিছেমিছি বেঁচে থাকবি? তোকেও মরতে হবে আমার ই মতন…..এখুনি!
তারপর যন্ত্রনার পরিমান বেড়ে গেলো। আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম !
জ্ঞান ফিরলো গ্রিফিনোর গর্জন শুনে। ও আমার পিঠে ক্রমাগত ধাক্কা দিয়ে শোয়া অবস্থা থেকে বসানোর চেষ্টা করছে।আর বার বার গর্জন করে উঠছে। সেই গর্জন হিংস্র প্রানীর আক্রোশের গর্জন নয় কেমন যেত আকুতি ভরা ঐ গর্জন।
অনেকটা ডুকরে কেঁদে ওঠার মতন। অনেকদিন পর প্রভুকে কাছে পেয়ে এমন বিপদের শিকার হতে দেখে গ্রিফিনো ঘাবড়ে গেছে। ওর গর্জনে সাহায্যের আবেদন স্পষ্ট। আমি ওর সহযোগীতা পেয়ে উঠে বসতে সক্ষম হলাম।
আমি উঠে বসার পর একটু শান্ত হলো প্রানীটা।তারপর আমাকে চারপাশে বৃত্তাকারে চক্কর দিলো একটা। ওর চোখেমুখে হিংস্র ভাবটা ফিরে এসেছে। যেন শত্রুর অপেক্ষা করছে আর সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে তাদের ওপর।
আমি অজ্ঞান হবার আগের ঘটনাটা মনে করার চেষ্টা করছি। আবছা আবছা মনেও পড়ছে। আমার শরীরে প্রচন্ড যন্ত্রণা ছিলো এবং আমার মমি আমাকেই হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিলো।কিন্তু আমি তো এখনো বেঁচে আছি। তাহলে ওর কি হলো? ওর হাত থেকে আমাকে বাঁচিয়েছে কে?নাকি যা দেখেছি সব মনের ভুল।
হতে পারে। হঠাৎ একটা বিষয় মনে পড়লো। আমার মেস থেকে পোর্টাল এর মাধ্যমে এই পিরামিডে আসার কিছুদিন আগে একটা বেশ পুরনো ইংরেজি ম্যাগাজিনে মিশর সংক্রান্ত একটা আর্টিকেল পড়েছিলাম। আমার এক বন্ধুর বাসায়।ওর পুরনো ম্যাগাজিন সংগ্রহ করার বাতিক আছে। এই ম্যাগাজিন নাকি খোদ মিশরে ছাপা হয়েছিল।
কোন এক অদ্ভুত কারনে সেই আর্টিকেল আমার চোখের সামনে সিনেমার পর্দার মত ভাসছে।
আর্টিকেলের শিরোনাম ছিল”Tomb of tutankhamun revealed ” অর্থাৎ তুতানখামেনের কবরের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। আর্টিকেল
অনুযায়ী তুতানখামেন নামের বালক রাজা সম্পর্কে ইতিহাসবিদ দের আগ্রহ ছিলো অনেক বেশী। কিন্তু তারা প্রত্যেকটা পিরামিড তন্নতন্ন করে খুঁজেও তুতানখামেনের মমি পায়নি। তাদের শেষ ভরসা ছিলো “Valley of the kings” অর্থাৎ “রাজরাজড়ার উপত্যকা ” নামের একটি এলাকা। যেখানে মিশরের বিখ্যাত সব রাজাদের কবর ছিলো। অনেক চেষ্টা চালানোর পর ১৯২২ সালে ইংল্যান্ড এর হাউজ অব দি লর্ডস এর সম্মানিত সদস্য লর্ড কার্নারভন এবং অতি উদ্যমী যুবক হাওয়ার্ড কার্টার পরিচালিত একটি দল তুতানখামেনের কবরের দেখা পায়।
মরুভূমির বালির অনেকটা তলে ঢাকা পড়ে গিয়েছিলো সেই কবর। আরেক বিখ্যাত রাজা দ্বিতীয় রামেসিসের কবরের ঠিক পাশেই পাওয়া গেলো বহুল প্রত্যাশিত তুতানখামেনের কবর। কিন্তু সেই কবরের সিঁড়ি ভেঙে নামার পর কার্নারভনের দৃষ্টি যখন তুতানখামেনের সিলমোহর যুক্ত দরজায় পড়লো তখন তিনি অবাক হয়ে গেলেন।
কারন সিলমোহর দ্বিখণ্ডিত। কিন্তু পরে জোড়া দেয়া হয়েছিলো। অর্থাৎ তাদের আগেই কে বা কারা এসেছিল এই কবরের সন্ধানে। ভেতরে প্রচুর অর্থসম্পদ রয়েছে তা প্রায় সবার ই জানা। গবেষনা করে জানা গেলো একদল ডাকাত এসেছিলো এই কবরের ধনরত্ন লুট করতে কিন্তু অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই কি যেন দেখে মারাত্মক ভয় পেয়ে সব রেখে পালিয়ে যায়। ভেতরে ঢুকে অবশ্য তুতানখামেন অর্থাৎ আমার সেই মমি সুরক্ষিত অবস্থাতেই পাওয়া গিয়েছিল। প্রদর্শনীর জন্যে মমির আবরণ খুলে কাঁচের জারে করে বাইরে আনা হয়েছিলো কিছুদিনের জন্য। তারপর কদিন পর আবার আগের মত সোনায় মোড়ানো কফিনে রেখে আসা হয় আগের কবরেই।
আমার এই কবর অনুসন্ধানকারী লর্ড কার্নারভনের দলের কেউই আমার ছোঁয়াচে অভিশাপ থেকে বাঁচতে পারেনি। অস্বাভাবিক রোগে ভুগে অথবা হার্টফেল করে মারা গেছে।
কবরে ধনরাশির লোভে হানা দিতে আসা ডাকাতদের যে গ্রিফিনোই ভয় দেখিয়েছে সেটাও বলে দিতে হয়না।
কিন্তু আমি তো সাধারণ পিরামিডের ভেতরেই ঢুকেছিলাম। আশেপাশে তো রাজা দ্বিতীয় রামেসিস বা অন্যকারো কবর চোখে পড়েনি। আমি ঘটনার আকস্মিকতায় নিশ্চই ভুল দেখেছি। কিন্তু আমার অর্থাৎ তুতানখামেনের কবরে নামতে তো সিড়ি ব্যবহার করতে হবে। আমি তো সোজাসুজি ঢুকেছি।
একটা শব্দে আমার ভাবনায় ছেদ পড়লো। কান খাড়া করলাম। পাথরের ভারী দরজা খোলার শব্দ। আমার কাছ থেকে হাতদশেক দূরে একটা সিঁড়ি আছে। সেটা সোজা উপরের দিকে চলে গেছে। সিঁড়ির উপরের দিকে তাকাতেই আলোর রেখা দেখা গেলো। অর্থার সিঁড়ির শেষপ্রান্তেই কোন দরজা খোলা হয়েছে ফলে বাইরের আলো পিরামিডের ভেতরে ঢুকেছে। আমি গ্রিফিনো কে সাথে নিয়ে ওপরে উঠতে লাগলাম। উড়ে নয় দৌড়ে। মাথা ঠিকমতন কাজ করছিলো না। যেন বহুকাল থেকে বন্দী হয়ে আছি এই পিরামিডের ভেতর। এখন বাইরে বেরুতে না পারলে দম আটকে মারা পড়বো।
সিঁড়ির শেষ প্রান্তে একদল লোক দাঁড়িয়ে আছে।আলোর বিপরীতে দাড়ানোর ফলে চেহারা বোঝা যাচ্ছেনা স্পষ্ট। তবে তাদের হাতে প্রাচীন সব তৈজসপত্র এবং সেগুলো নিঃসন্দেহে মিশরীয় সম্পত্তি। এরা নতুন কোন ডাকাত দল নয়তো?
আমি এগোলাম লোকগুলোর দিকে।আমার নিরাপত্তার জন্য শক্তিশালী গ্রিফিনো আছে। কাজেই ভয় নেই। এবার ওদের পোশাক নজরে পড়লো। পুরোহিতদের পোশাক পরিহিত সবাই। সবার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে সম্ভবত এই দলের প্রধান। আমি এগিয়ে যেতেই নজরে পড়লো ওর চেহারা আর তৎক্ষণাৎ চমকে উঠে পিছিয়ে গেলাম আমি।
আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে এই লোক আমার মমি সৎকারের দায়িত্বে থাকা প্রধান পুরোহিত বেন্নেস। সেই নিষ্ঠুর, গোয়ার, পাষন্ডটা। যে আমার মৃত্যুতে খুশি হয়েছিলো।
অথচ আমার ভয় পাওয়া চেহারার ওপর ঝুকে পড়ে বললো
-কেমন আছেন রাজাধিরাজ?ভয় পাবেন না।আজ থেকে আপনি অভিশাপমুক্ত। ভেতরে আপনাকে একটা ছোট্ট পরীক্ষায় ফেলেছিলাম। আপনি তাতে উত্তীর্ণ হয়েছেন। এক মহান উদ্দেশ্যে আপনাকে এখানে ডেকেছি। প্রথমে আপনার পোষা প্রানীটিকে বাগে আনুন তারপর আমার সাথে চলুন।
পিছে তাকিয়ে দেখি গ্রিফিনো বেন্নেসের ওপর হামলা করার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে স্বাভাবিক করলাম। তারপর পিরামিড থেকে বেরিয়ে এলাম।বেন্নেসের কথা পুরোপুরি বিশ্বাস হয়নি কিন্তু আমার নিজের দেশ থেকে এই দেশে আসার পেছনে নিজের পূর্বজন্মের পরিচয় জানা ছাড়াও যে আরো কিছু উদ্দেশ্য আছে তা ধারনা করেছিলাম।
পিরামিড থেকে বেন্নেসের দলের পিছুপিছু বের হয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। আমার পেছনের পিরামিড পলক ফেলতে না ফেলতেই অদৃশ্য হয়ে গেলো। শুধু পড়ে রইলো একটা সিঁড়ির মুখ। যার পাশে প্রাচীন মিশরীয় ভাষায় লেখা “তুতানখামেন”
তার মানে এই সিঁড়ির নিচেই আমার মমি রাখা ছিলো। তাহলে পিরামিডের ধোকা দেয়ার মানেটা কি?ওটা যে আমার কবরে যাওয়ার রাস্তা সেটা আরো নিশ্চিন্ত হলাম পাশে দ্বিতীয় রামেসিসের কবর দেখে।
আমি আমার মমির আক্রমনের শিকার হওয়ার পর থেকেই মিশরীয় ভাষা বলতে, পড়তে ও বুঝতে পারছি। অবশ্য আগের জন্মের স্মৃতিগুলোর সাথে সাথে ভাষা আর সংস্কৃতি ফিরে আসাটা অস্বাভাবিক নয়।
বেন্নেসের সাথে কথোপকথন টাও মিশরীয় ভাষাতেই হচ্ছে।তাও বেশ সাবলীল ভাবেই।
বেন্নেস আমায় আবার ডাকলো
-দাঁড়িয়ে পড়লেন যে রাজাধিরাজ? আমাদের হাতে কিন্তু সময় নেই। খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে আপনার জন্য। দয়া করে দেরী করবেন না।
আমি বললাম
-হুম।সে তো যাবই কিন্তু কি কাজ বেন্নেস?আর আরেকটা কথা । তুমিও কি আমার মতই আবার জন্মেছ নাকি কালোজাদুর জোরে এখনো বেঁচে আছো?তোমার তো কালোজাদুর ওপর বিশ্বাস ছিলো অনেক। কিছুক্ষেত্রে সফল ও হয়েছিলে।
বেন্নেস লজ্জিতমুখে বললো
-সবার কি আর পুনর্জন্মের সৌভাগ্য হয় রাজাধিরাজ? আপনার ধারনাই ঠিক। এই যে আমার সহচর দের দেখছেন এদের নিয়ে আমি কালোজাদুর বলে বেঁচে আছি গত পাচহাজার বছর ধরে। তবে এর উদ্দেশ্য কিন্তু মহৎ। আপনার সব প্রশ্নের উত্তর কিছুক্ষনের মধ্যেই পাবেন।
আপাতত শুধু মহান ফারাও রাজা “আখেনাতুন” এর অত্যদ্ভুত আবিস্কারের কথা চিন্তা করুন। বাকিটা ধীরেধীরে বুঝতে পারবেন।
পিরামিডের দরজা ভারী পাথরে তৈরি। দুপাশ থেকে শিকল নেমে এসেছে দরজার মাঝামাঝি। সেই শিকলের দুটি প্রান্ত একসাথে করে বেশ বড় একটা তালা দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে।
সেটা খুলতে হলে শক্তি দরকার। বেন্নেস আর দলের বাকিদের সেই শক্তি আছে বলে তো মনে হলোনা। যা লিকলিকে গড়ন সবার। অবশ্য আমার নিজের ও সেই শক্তি আছে বলে দাবী করিনা। শেষ ভরসা হিসেবে হয়তো গ্রিফিনোকে দিয়ে তালা ভাঙার কাজটা সারতে হবে। এছাড়া তো উপায় দেখিনা।কিন্তু গ্রিফিনো তো এখন আহত।ওকে দিয়ে কাজ করানো কি ঠিক হবে?
তালাটা ভালোভাবে দেখবার জন্য কাছে এগিয়ে গেলাম। এই তালা সাধারন তালা নয়। এটাকে প্রাচীন মিশরীয় কায়দায় মন্ত্রপূত করা হয়েছে।মন্ত্রগুলো খোদাই করে বসিয়ে দেয়া হয়েছে স্বর্ন নির্মিত তালার ওপর।
তারওপর বসিয়ে দেয়া হয়েছে আমার বাবা মহান ফারাও আখেনাতুনের সিলমোহর।অর্থাৎ ভেতরের বন্দী যাতে পালিয়ে যেতে না পারে তারজন্য ভালো ব্যবস্থাই করা হয়েছে। ঐ মন্ত্রের গুন আমার অজানা নয়।বাবার রাজত্বের সময় রাজ্যের নৃশংস সব অপরাধীদের কয়েদখানায় আটকে রাখা হতো ঐ মন্ত্রবলে। অপরাধীর কোন ক্ষমতাই ছিলোনা ঐ মন্ত্রচক্র ভেদ করে বাইরে আসার।
কফিনের শেষ পেরেক টা ঠুকেছেন বাবা। তালায় তার সিলমোহর দেখে সেটা বোঝা যাচ্ছে। তিনি তার রাজ্যবাসী কে দেয়া কথা রেখেছেন। ভীনগ্রহের কোন প্রানীর কাছে নিজ রাজ্যের প্রজাদের পরাধীন করে দেন নি তিনি। প্রকৃত রাজার মতই নিজের রাজ্যের সুরক্ষার পরিকল্পনা করেছেন।
যদিও অন্যান্য ভীনগ্রহের প্রানীদের সাথে ফারাও আখেনাতুন কি আচরণ করেছেন তা আমার মনে পড়ছেনা। যেহেতু একজন এই পিরামিডের ভেতর বহুকাল যাবত বন্দী এবং তাকে মুক্ত করার জন্য বাইরের গ্রহ থেকে কোন সাহায্য আসেনি তাহলে নিশ্চই বড় কোন রহস্যের বেড়াজালে আবদ্ধ এই পিরামিড।
পিরামিডের দরজায় সোনায় মোড়ানো তালা দেখে কয়েকটা প্রশ্ন উকি দিলো মনে।নিখাদ স্বর্নে গড়া এই ভারী তালার বর্তমান বাজারমূল্য অনেক বেশী হওয়ার কথা। বর্তমান সময়ের নিয়ম অনুযায়ী সেটা হয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সম্পত্তি হিসেবে গন্য হতে বাধ্য নইলে চোর ডাকাতদের দখলে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।কিন্তু এত বছর পরেও অক্ষত অবস্থায় শিকলে ঝুলছে ওটা! তাহলে কি এই পিরামিড আজ ও লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে গেছে? কিন্তু সেটা কি করে সম্ভব? এত বড় একটা স্থাপত্য মানুষের বিশেষ করে আধুনিক প্রত্নতাত্ত্বিক দের নজর এড়িয়ে যাবে কি করে?
এই পিরামিডের অবস্থান অন্যান্য পিরামিডের তুলনায় এত দূরেই বা কেন?
আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর একমাত্র বেন্নেস ই দিতে পারবে তাই ওকেই জিজ্ঞেস করলাম।
বেন্নেস উত্তরে কিছু না বলে আমার আঙুল ধরে তালার যে অংশে চাবির খাজ থাকে সেখানে ছুঁইয়ে দিলো। আর তৎক্ষণাৎ জাদুর মতন কাজ হলো। ভারী তালাটা ঘটাং শব্দে খুলে গিয়ে শিকল বেয়ে ঝুলতে থাকলো।
এবার বেন্নেস বললো
-দৃশ্যমান বস্তুকে নিজের করায়ত্তে আনতে পারে দূর্বল মানুষেরা কিন্তু অদৃশ্য বস্তুকে কেবল নির্বাচিত ব্যক্তিরাই নিজের দখলে আনতে পারে।
-ঠিক বুঝলাম না। কি বলতে চাইছো তুমি?
-এই পিরামিডের অস্তিত্ব শুধু আপনি, আমি,আপনার পোষা প্রানী আর আমার সহচর রা বুঝতে পারছি। যাদের প্রত্যেকের সাথে মহান রাজা আখেনাতুনের কোন না কোন সম্পর্ক ছিলো। এই যুগের মানুষ এই পিরামিড স্পর্শ করা তো দূরে থাক খালি চোখে দেখতেই পারবেনা।
তালায় যে মন্ত্রখচিত রয়েছে তার প্রভাবে এই পিরামিড অদৃশ্য হয়ে রয়েছে বছরের পর বছর। শুধু আপনার মত বিশেষ ব্যক্তিই এই তালা খোলার অধিকার রাখেন রাজাধিরাজ ।
এমনকি আমার কালো জাদু ও এই তালার ওপর কোন প্রভাব ফেলতে পারবেনা। বরং কালো জাদুর প্রভাব খাটাতে গেলে উলটো অভিশপ্ত হয়ে যেতে হবে আমাকে।
আপনার স্পর্শে যখন পিরামিডের তালা খুলে গেছে তখন নিঃসন্দেহে আপনিই মহান ফারাও আখেনাতুনের পুত্র বালক রাজা তুতানখামেন।
তা না হলে এই তালার সংস্পর্শে আসতেই আপনার মৃত্যু হয়ে যেত।তাছাড়া আপনার কবরে নিজের মমির সাথে টিকে যাওয়ার ব্যপার তো আছেই।
বেন্নেসের কথা শুনে অবাক হলাম। পাশাপাশি রাগ ও হলো। ব্যাটা পুরোহিত আমায় এখনো সন্দেহ করে?
তবে মুখে সেটা প্রকাশ না করে বললাম
-তালা যখন খুলে গেছে আর দেরী না করে ভেতরে ঢোকা যাক।
-অবশ্যই।
ভীনগ্রহের প্রানী নিয়ে বই পুস্তকে পড়েছি। নানান চলচিত্র দেখা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তাদের দেখতে পাইনি কোনদিন। আজ তা সম্ভব হতে চলেছে। সবচেয়ে বড় কথা এই বন্দী জীবটা আমার ই পূর্বপুরুষ । তাই কৌতুহলের মাত্রা দ্বিগুণ।
খুলে যাওয়া তালা শিকল থেকে ছাড়িয়ে হাতে নিলাম তারপর আপনা থেকেই ঘড়ঘড় শব্দ করে খুলে গেলো দরজা। আমি রাজা।তাই নিয়ম অনুযায়ী আমাকেই আগে ঢুকতে হলো।
ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাইরের সূর্যের আলোর কোন প্রভাব নেই এই পিরামিডের ভেতর। থাকার কথাও না। কারন পিরামিডে জানালা দরজা বা ঘুলঘুলি থাকেনা।
বেন্নেস অন্ধকার দূর করার জন্য চমৎকার একটা কাজ করলো। হাতদুটো উপরে তুলে দুই তালু ঘষতে লাগলো। চকমকি পাথরে ঠুকোঠুকি করলে যেমন আগুন ধরে যায় তেমনি আগুন ধরে গেলো ওর দুহাতের তালুতে কিন্তু আশ্চর্য ব্যপার ওর হাত সেই আগুনে একটুও পুড়ে গেলোনা। তারপর সেই আগুন ভাসতে ভাসতে চলে গেলো শুন্যে। আর পিরামিডের বিভিন্ন কোনায় মশালদানীতে যতগুলো মশাল ছিলো সবগুলোকে আলোকিত করতে লাগলো।ঐ আগুনে এমন কিছু আছে যাতে ভেতরটা দিনের আলোর মতই পরিষ্কার দেখাচ্ছে। অন্ধকারের ছিটেফোঁটা ও নেই কোথাও।
এটাই ওর কালো জাদুর ক্ষমতা।
ভেতরটা আলোকিত হতেই চরম বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। বন্দী আমার থেকে দশহাত দূরে একটা উঁচু বেদির মত জায়গার ওপর মাটি থেকে প্রায় সাত ফুট ওপরে হাত পা চারদিকে সরিয়ে ভাসছে। কোন শিকল বা দড়ি দিয়ে ওকে বেধে রাখা হয়নি। ওর ভেসে থাকাটাই যেন একটা শাস্তি। অবশ্য এমন ও হতে পারে এই বাইরের মানুষ যেমন এই পিরামিড দেখতে পারেনা তেমনি ওকে ভাসিয়ে রাখার জন্য সহায়ক বস্তুটাও আমি দেখতে পারছিনা।
হাতের তালাটা নিচে রেখে আমি আরো সামনে এগিয়ে গেলাম। গ্রিফিনো আর বেন্নেস এলো পিছে।বেন্নেসের সহচর রা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো রাজকার্যের সময় ওদের মাথা নিচু করেই রাখতে হয়।
বন্দী ভীনগ্রহবাসী প্রানীর সমস্ত শরীর কাঁচের মত স্বচ্ছ। তার ভেতরে নীল তরল চলাচল করছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সেটা । আমার বাবার হাত থেকে বেরুনো রক্তধারার কথা মনে হতে লাগলো। এদের সবার রক্তই তাহলে গাঢ় নীল!
শরীরের গড়ন দেখে অবাক হয়ে যেতে হয়। আখেনাতুন যে হুবুহু এদের নকল তা বুঝতে কোন অসুবিধেই হয়না। সেই পরিচিত লম্বাটে মাথা, সরু গলা,লিকলিকে হাত পা,স্বাভাবিকের তুলনায় বড় হাত পায়ের আঙুল!
প্রানীটা হাত পা ছড়িয়ে যেভাবে ভাসছে দেখে মনে হবে ঘুমুচ্ছে।
এখন আমার কি করনীয় সেটা বেন্নেস নিজে থেকেই বলে দিলো।
-রাজাধিরাজ। এই পিরামিডের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কিন্তু আখেনাতুনের সীলমোহর অঙ্কিত মন্ত্রপূত তালা ভাঙার পর থেকেই লুপ্ত হয়ে গেছে। তাই যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। এই প্রানী আমাদের সভ্যতা ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল। পারেনি। বরং হাজার হাজার বছর ধরে ওদের পরিকল্পনার শাস্তি ও একা পেয়েছে।
ওর সঙ্গীরা ওকে ছেড়েই আখেনাতুনের ভয়ে এই পৃথিবী ছেড়ে পালিয়েছে।
আখেনাতুন আপনার ভবিষ্যৎ প্রত্যাবর্তনের খবরটা জেনে গিয়েছিলেন। তাই তিনি চেয়েছিলেন আপনাকে এমন কিছু ক্ষমতা দেয়া হোক যেন আপনি তার মতই পৃথিবীবাসির উপকার করতে পারেন। আর এই ক্ষমতা একমাত্র এই ভীনগ্রহ বাসী প্রানীটাই দিতে পারবে। নইলে এই দুনিয়া থেকে ওদের দুনিয়ায় ফিরে যেতে পারবেনা ওরা।
আপনাকে প্রদত্ত ক্ষমতাই ওদের মুক্তির সনদ হবে।
আপনি ঐ বেদির ওপর গিয়ে দাঁড়ান। বাকি কাজ ও নিজেই করবে।
আমি কথামতো এগিয়ে বেদিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। গ্রিফিনো আমার দেখাদেখি লাফিয়ে চড়লো বেদির ওপর।
কিছু সময় যেতে না যেতেই মাথার ওপরে ভাসতে থাকা প্রানীটা নিচে নেমে এলো। আমার একদম কাছে এসে চোখ খুললো। সে চোখে অদ্ভুত চাহনি দেখে ঘাবড়ে গেলাম। পৃথিবীর মানুষের চোখে রাগ অভিমান বা আনন্দের মত অনুভূতি গুলো ফুটে ওঠে। এই প্রানী বাইরের গ্রহের হওয়ায় তার চোখে সেই অভিব্যক্তি নেই।
আমি অপেক্ষা করছি এরপর কি হয় সেটা দেখার জন্য। ক্ষমতার লোভ আমার নেই। এই প্রানী আমায় কি ক্ষমতা দেবে তার কোন ধারনাও নেই। মিশরে রাজতন্ত্র প্রায় উঠেই গেছে ।অন্তত ফারাও রাজাদের মত জাঁকজমক জীবনযাপন করেনা কেউ। আমার মত অথর্ব কে এই প্রানী মানবকল্যানে কিভাবে কাজে লাগাবে তাই ভাবছি।
প্রানীটা এবার কথা বললো। যদিও কথা বললো বলছি কিন্তু ওর ঠোঁট নড়েনি এক চুল পরিমান। আমার সাথে ওর কথোপকথন টা মনে মনে হচ্ছে। এই ব্যপারটাই সম্ভবত টেলিপ্যাথি।
শুরুটা হলো এভাবে
-হে পৃথিবী র মানব, আমার মুক্তিদাতা তোমায় স্বাগতম। হাজার হাজার বছর কেটেছে তোমার প্রতীক্ষায়।লোভী, বিশ্বাসঘাতক সহযোগীদের অন্যায়ের ফল ভোগ করতে হয়েছে আমাকে। সে যাই হোক। তোমার বাবা আমাদের বংশধর ছিলো। অর্থাৎ তুমিও একই বংশোদ্ভূত।আখেনাতুন আমাদের পৃথিবী ধবংসের পরিকল্পনার কথা জেনে মানবজাতির পক্ষ নিলো। তারপর ভয়ানক এক যুদ্ধের পর আমার পরাজিত সাথীরা আমায় ফেলে চলে গেলো। আমি বন্দী হলাম।
রাগান্বিত আখেনাতুন আমায় শর্ত দিলো যদি ভবিষ্যতের তুতামখামেন আমার কাছ থেকে বিশেষ কোন ক্ষমতা না পায় তবে আমার মুক্তি হবেনা।
-আমার কোন ক্ষমতার দরকার নেই। তুমি তো আমায় দেখেছো। তোমায় মুক্ত করে দিলাম। নিজের গ্রহে ফিরে যাও।
-না। তোমার ক্ষমতার দরকার নেই কিন্তু আমি এতবছর পর অপেক্ষার পর আখেনাতুন কে দেয়া কথার বরখেলাপ করবোনা।তাছাড়া তোমার পুনর্জন্মের উদ্দেশ্য তুমি এখনো জানোনা হে যুবক। নইলে ক্ষমতার দরকার টা বুঝতে অসুবিধে হতোনা।
তবে তোমায় বিশেষ শক্তি প্রদানের আগে বলতে চাই
প্রত্যেক ক্ষমতা অর্জনের পেছনেই কিন্তু আপনজনের আত্মত্যাগ থাকে। তুমি সেই জন্য প্রস্তুত থেকো।
বলেই আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে শুন্যে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো।সাথে সাথে শুন্যে ভেসে উঠলো আমার প্রিয় পোষা প্রানী গ্রিফিনো। ভাবলাম হয়তো ওকে ও কোন শক্তি প্রদান করা হবে। কিন্তু আমি ভুল ভেবেছিলাম।
হঠাৎ কোত্থেকে যেন ধুলোমাখা দমকা হাওয়া এসে আমাদের চারপাশে ধুলোর ঝড় তৈরি করে ফেললো। সেই ঝড় কিছুক্ষনের মধ্যেই রুপ নিলো ঘূর্নিঝড়ের। সেই ঘূর্নীপাকে পড়ে অসহায়ের মত পাক খেতে লাগলাম আমি আর গ্রিফিনো।
প্রচন্ড অস্বস্তি লাগছিলো। মাথা চক্কর দিচ্ছে। শরীর দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। ব্যথায় অজ্ঞান হবার মত পরিস্থিতি তৈরি হলো।
গ্রিফিনোর দিকে তাকিয়ে দেখি ওর ও একই অবস্থা।
এই ঘুর্নীঝড় শুধু বেদির ওপরের অংশে হচ্ছে। অর্থাৎ এটা ক্ষমতা প্রদানের অংশ।
কানে ভেসে আসছে মন্ত্রের সুর। বেন্নেস আর তার সহচররা মন্ত্র পড়ছে। আমি একবার গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলাম
-এই যন্ত্রনা আর সহ্য হচ্ছেনা। আমায় ছেড়ে দাও। আমার ক্ষমতা চাই না।
কিন্তু কেউ শুনলোনা। মন্ত্রের সুর আরো বেড়ে গেলো আর সেই ধুলোঝড়ের মধ্যে একটা নীলাভ আলোর সৃষ্টি হলো। সেই আলো বিন্দুর মত আকার থেকে ধীরে ধীরে বড় হতে হতে বিস্ফোরিত হলো।
সেই বিস্ফোরনে ভীনগ্রহবাসী প্রানী বাদে আমরা সবাই পিরামিডের বাইরে ছিটকে এলাম। অথচ সরু দরজা দিয়ে এভাবে ছিটকে না এসে আচমকা পিরামিডের দেয়ালের সাথে ধাক্কা লাগার কথা আমাদের। যেন হাওয়ার তোড়ে ইচ্ছা করেই দরজা দিয়ে বাইরে ফেলা হয়েছে আমাদের। বাইরে বালির ওপর আছড়ে পড়ে আহত হয়েছি সবাই। অনেক কষ্টে উঠে বসলাম।
ঐ ভীনগ্রহের প্রানীটাকে শায়েস্তা করার আগপর্যন্ত আমার শান্তি হবেনা। এভাবে আমাদের বাইরে ছুড়ে ফেলার উদ্দেশ্য কি?
ওকে শাস্তি দেবার জন্য গ্রিফিনোই যথেষ্ট । কিন্তু আশেপাশে তো কোথাও গ্রিফিনো কে দেখছিনা।
হঠাৎ সামনের পিরামিডের দিকে চোখ পড়লো। সেটা মরুভূমির বালি উড়িয়ে শো শো শব্দে উপরে উঠে যাচ্ছে।
গ্রিফিনো ওর ভেতরে নেই তো?ঐ বজ্জাত প্রানীটা প্রতিশোধ নেবার জন্য গ্রিফিনো কেই বলির পাঠা বানাচ্ছে না তো?
ও আপনজনের আত্মত্যাগের কথা বলেছিল। এই মুহুর্তে গ্রিফিনোই ছিলো আমার একমাত্র আপনজন।ওকে অপহরণ করছে ঐ প্রানীটা। পিরামিডরুপী বাহনে করে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে নিজ গ্রহে। এদিকে বেন্নেস আর তার সঙ্গীরা অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। আমি অসহায়ের মত কাঁদছি আর তারস্বরে চেচাচ্ছি গ্রিফিনোর নাম ধরে। যদি ও ঐ প্রানীটার কবল থেকে আমার ডাক শুনে মুক্ত হয়ে আসতে পারে। কিন্তু নাহ।
দেখতে দেখতে পিরামিডের মত বাহনটা আকাশে মিলিয়ে গেলো। আমি বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
ঘটনা হয়তো এখানেই শেষ হয়ে যেতো। আমিও তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু একঘন্টা নিস্তব্ধ অবস্থায় কাটিয়ে গ্রিফিনোকে হারানোর সব কষ্ট ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে খানিকটা ধাতস্থ হবার পর একটা অসাধারণ ব্যাপার ঘটলো।
আমার পিঠে কে যেন সুড়সুড়ি দিচ্ছে। পেছনে তাকিয়ে দেখি কেউ নেই। শুধু দুটো শুভ্র ডানা দেখা যাচ্ছে ঠিক আমার পেছনে। ভাবলাম হয়তো গ্রিফিনো ফিরে এসেছে। কিন্তু আমি যতই ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকাচ্ছি ততই সাদা ডানাদুটো আমার সাথে সাথেই নড়ছে।
এবার নিজের পিঠে হাত বুলিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। ডানাদুটো আর কারো নয় আমার নিজের পিঠ ফুঁড়ে বেরিয়েছে!কিছু সময় যেতেই সেই ডানা দুটো নাড়াতে শিখে গেলাম।চোখের সামনে ডানা দুটোকে আনতেই ফোস্কার দাগ দেখে আবার অবাক হতে হলো। এই ডানা আমার পিঠ থেকে বেরিয়েছে ঠিকই কিন্তু ফোস্কার দাগ থেকে বোঝাই যাচ্ছে এটা গ্রিফিনোর ডানা!
অর্থাৎ গ্রিফিনো অপহরণ করা হয়নি বরং ঐ নীলচে আলোর বিস্ফোরনের প্রভাবে আমি আর গ্রিফিনো একাকার হয়ে মিশে গেছি!
এবার মাথার ভেতরে আবার সেই পলাতক প্রানীটার অবয়ব ফুটে উঠলো। টেলিপ্যাথি করে আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে ও।
-নতুন রুপে এই পৃথিবীতে তোমায় স্বাগতম রাজা। তোমার ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ধীরেধীরে ঘটবে। সেই ক্ষমতা নিয়ন্ত্রনের পদ্ধতি আমি শিখিয়ে দেবো। আপাতত চোখ বন্ধ করে ভাবো তোমার পিঠের ডানাদুটো নেই।
আমি কথামতো তাই ভাবলাম।আর তখুনি পিঠের সাদা ডানাদুটো এমনভাবে অদৃশ্য হয়ে গেলো যেন কোনদিন ছিলোই না।
তারপর ঐ প্রানীটা আবার বলে উঠলো
-তোমার এই রুপান্তর মানবজাতি এবং অসহায় গুপ্ত প্রানীদের সহায়ক হোক। আপাতত বিদায় ডক্টর গ্রিফিনো!
গুপ্ত প্রানী আর ডক্টর গ্রিফিনোর মানেটা পরে বুঝেছিলাম।
মিশরের “ভ্যালী অব দি কিংস “এ তুতানখামেনের কবরের পাশে একটা যুবক তার নতুন স্বত্ত্বার সাথে পরিচিত হতে লাগলো। তার আধা-মানুষ আধা-প্রানী স্বত্তা তাকে বারবার অবাক করে দিচ্ছিলো। অথচ আধুনিক পৃথিবীর মানুষ তার এই রুপান্তর এর ঘটনা জানতেই পারলোনা।কিন্তু জানতে যে হবেনা তার কোন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে কি?
……………………………………………………………(সমাপ্ত)…………………………………………………………..