কারাজানের কালো ঘোড়া

কারাজানের কালো ঘোড়া

উত্তাল সমুদ্রে জোয়ার এসেছে। গর্জন করতে করতে তীরে এসে আছড়ে পড়ে ভেঙে যাচ্ছে ঢেউ। এখন বিকেলবেলা। সূর্যের তাপ কম, ঝিরঝির করে বাতাস বইছে। দারুন উপভোগ্য একটা পরিবেশ।আমি আর আমার স্কুল জীবনের সবচেয়ে ভালো বন্ধু তন্ময় সী বীচের একটা চেয়ার ভাড়া করে বসে বসে সমুদ্র দেখছি। আমরা এখন আছি পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার এর লাবনী সি পয়েন্টে। পুজোর ছুটি চলছে। সেই ছুটি কাজে লাগিয়ে দুই বন্ধু চলে এসেছি ঘুরতে। মাত্র আধাঘণ্টা আগে চট্টগ্রাম থেকে বাসে করে চারঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছেছি আমাদের আগে থেকে বুকিং দেয়া হোটেলে। শরীর অবসন্ন থাকলেও সমুদ্রের তীরবর্তী হোটেলে এসে তা একদম ফুরফুরে হয়ে গেছে। তাই কোনরকমে হোটেলে ব্যাগপত্র রেখে তড়িঘড়ি চলে এসেছি সী বীচে।এই প্রথম সমুদ্র দেখছি দুই বন্ধু। সী বীচ এর বালি পার হয়ে একদম তীরের কাছাকাছি একটা ইজিচেয়ার ভাড়া করেছি।ঘন্টায় ৩০ টাকা দিতে হবে।সেটা ব্যাপার না। এবারের ট্রিপটা আশা করি নিজেদের জমানো টাকায় ভালোভাবেই চলবে।

অনেকদিন ধরে প্ল্যানিং চলছে কক্সবাজার ট্যুর এর।আজ ভালোয় ভালোয় পৌঁছুতে পেরে অসম্ভব আনন্দিত দুজনেই। টিভিতে সমুদ্র দেখেছি অনেকবার। সমুদ্রের নীলাভ লোনা জল আমাকে টানতো খুব। কিন্তু বাস্তবের সমুদ্র দেখার অনুভূতি লিখে বোঝানো শক্ত। সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জন, তীরে এসে ভেঙে পড়া,ঝিরঝিরে বাতাস এবং মানুষের কোলাহল সব মিলিয়ে অসাধারণ একটা পরিবেশ। এবারের জার্নিটা একটু লং হয়ে গেছে। ময়মনসিংহ থেকে বিজয় এক্সপ্রেস এ রাত আটটায় রওনা দিয়ে চট্টগ্রাম পৌঁছাতে ভোর ৬ টা বেজেছে। তারপর চট্টগ্রামে থেকে কক্সবাজারের পথে চারঘন্টার জার্নি।

তাই বীচে এসে বসে আছি ঠিকই কিন্তু দেহে পর্যাপ্ত শক্তি না থাকায় আর সমুদ্রের জলে নামা হয়নি। অনেককেই দেখছি সমুদ্রে জলকেলি করতে। বীচের চেয়ারগুলো ধরে চা,কফি, পান সিগারেটের ফেরিওয়ালা ঘুরে বেড়াচ্ছে আর তারস্বরে চেঁচাচ্ছে “এই কফি, সিগারেট পান ”
“এই কফি, সিগারেট পান”!

আমি একজন ফেরীওয়ালা কে থামিয়ে দুই বন্ধুর জন্য দুকাপ কফি অর্ডার করলাম। এখানকার সস্তা কফির স্বাদ কেমন হবে জানা নেই তবে শরীর চাঙা করার জন্য কফি দরকার ।

প্রথম চুমুকেই বুঝলাম এরা মোটামুটি ভালো মানের কফি বানায়। তন্ময় কে জিজ্ঞাসা করে দেখলাম ওর ও কফি পছন্দ হয়েছে। কফির দাম মিটিয়ে আবার তাকালাম চারপাশে। তীরের একটা জায়গায় তিন চারটা বাশ লম্বালম্বি পুতে রেখে তার ওপর বড় সাইজের টিউব সারিবদ্ধভাবে সাজানো রয়েছে। সেগুলো ঘন্টা হিসেবে ভাড়া হয়। টিউব ভাড়া করে সাগরে নেমেছে অনেকে। বিশেষ করে যারা সাতার জানেনা। যদিও সমুদ্রে সাতার জানা না জানা একই কথা। কারন যখন লাইফ গার্ডের চেয়ারের ওপরে সবুজ পতাকা ওড়ে তখন জোয়ার চলছে বলে ধরে নিতে হয়, পতাকার রঙ লাল হলেই বুঝতে হবে ভাটা চলছে। জোয়ারের সময় সমুদ্রে নামার নিয়ম। কারন তখন ঢেউয়ের তোড় তীরের দিকে থাকে। ফলে কেউ চাইলেই সেই বিশাল সব ঢেউ অতিক্রম করে গভীরে যেতে পারবেনা। কিন্তু ভাটার সময়টা বিপদজনক। কারন তখন সমুদ্রের ঢেউ থাকে সমুদ্রগামী। অর্থাৎ তীরের দিকে ধাক্কা দেবার বদলে ঢেউ টান দেয় গভীরের দিকে। ফলে কেউ সেই সময় সাগরে নামলে কারো সাধ্য নেই তাকে সমুদ্রের গ্রাস থেকে মুক্ত করার।

একটু দূরে বীচ বাইক আর সী বাইক বা জেট স্কি চোখে পড়লো। তার পাশাপাশি প্যারাগ্লাইডিং এর ব্যবস্থা ও আছে। সাগর তীরে এই ব্যবসাগুলো ভালোই চলছে দেখলাম।

এখন জোয়ার চলছে তাই এত ভীড় বীচে। বেশীরভাগ মানুষ গোসলে নেমেছে। আমরা দুই বন্ধু ভেজার জন্য কাপড় নিয়ে আসিনি। সবার গোসল করার ফুর্তি দেখে টায়ার্ডনেস ভুলে দু একবার নামতে ইচ্ছে করেছিল কিন্তু পকেটে টাকা আর মোবাইল থাকায় তা হয়নি। আরো কয়েকদিন আছি। আজ গোসল নাই বা করলাম। দুপুরে খাওয়াদাওয়া হয়েছে।খিদে লাগলে হালকা খাবারের বন্দোবস্ত আছে বীচে। কাজেই ঠিক করলাম একেবারে সমুদ্রের বুকে সূর্যাস্ত দেখে পরে হোটেলে ফিরবো। এখন হোটেলে ফিরে লাভ নেই। রেস্ট নেয়া ছাড়া কোন কাজ ও নেই। তাছাড়া এখানেও তো ইজিচেয়ারে বসে রেস্ট নিচ্ছি ই।

সমুদ্রের বিশালতা সৃষ্টিকর্তার অসাধারণ সৃষ্টি আর ক্ষমতার কথা মনে করিয়ে দেয়। কথায় আছে দরিয়ার জল মনকে বড় করে। এখানকার মানুষজনের সদাচরণ তা বুঝিয়ে দিচ্ছে।সমুদ্র দেখার আগে নিজেকে এতটা তুচ্ছ মনে হয়নি কোনদিন। আজ অনেক দূরে সমুদ্রে ভাসতে থাকা জেলেদের বিন্দুর মত দেখতে নৌকাগুলো আরো দুটো কথা মনে করিয়ে দিলো। সেগুলো হলো মানুষের অসীম সাহসিকতা আর অদম্য কৌতুহল। যার বলে মানুষ নিজের চেয়ে হাজার হাজার গুন বড় সমুদ্রে ছোট ছোট নৌকো নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে জীবিকার সন্ধানে। প্রকৃত বীর তো এরাই। যারা সমুদ্রের বিশালতা দেখে দমে যায়নি। বরং নিজেদের সপে দিয়েছে তার করতলে।

কখন দে দুপুর গড়িয়ে বিকেল এবং বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে টের ই পাইনি। বাতাসের ঝাপটা এসে মুখে লাগছিলো। এমনিতেই শরীর ক্লান্ত। মৃদুমন্দ বাতাসের ঝাপটায় ঘুম নেমে এলো চোখের পাতায়। কিন্তু চোখ বন্ধ করলে তো সাগরের অপরুপ সৌন্দর্য আর দেখতে পারবোনা। তাই জোর করে জেগে আছি। কিছুক্ষণ আগে বিরাট কমলালেবুর মত সূর্য ডুবে যেতে দেখেছি সমুদ্রে। কি অপরুপ সেই দৃশ্য তা বলে বোঝানো যাবেনা। যেন সূর্যটা সত্যি সত্যিই সাগরের লোনা জলে ডুব দিয়ে হারিয়ে গেলো।

এখনো হলুদাভ ঘোলাটে আবছা আলো আছে আকাশে। আমি আর তন্ময় একদৃষ্টে চেয়ে আছি সমুদ্রের ঢেউয়ের দিকে। ফসফরাস মিশ্রিত ঢেউগুলো এই আবছা আলোতেও রেডিয়ামের মত জ্বলজ্বল করছে। অদ্ভুত সুন্দর সে দৃশ্য।ইতিমধ্যে শরীর জুড়িয়ে গেছে বাতাসে। বেশ কয়েক কাপ কফিও শেষ করেছি আমরা। শরীর চাঙা।
“এখন হোটেলে ফেরা যাক “বলতেই তন্ময় কি যেন দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো। ওর চোখেমুখে অবিশ্বাসের ছাপ,চোয়াল ঝুলে পড়েছে। শুধু সমুদ্রের। দিকে আঙুল তুলে কিছু দেখাতে চাইলো আমায়।

আমি ও তাকালাম। এখন ভাটা শুরু হয়ে গেছে। তীরে লোকজন নেই। তন্ময় যেদিকে আঙুল নির্দেশ করেছে সেদিকে কেউ ই নেই। প্রথমে আবছা আলোয় জ্বলতে থাকা ফেনিল ঢেউ চোখে পড়লো। তারপর চোখে পড়লো তন্ময়ের বিস্মিত হবার কারন। হ্যা! আমি এমন কিছু দেখছি যা এই সমুদ্রে দেখাটা সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক!আমার যদি ভুল না হয় তবে সমুদ্রের তীর থেকে খানিকটা গভীরে একটা বিশাল কালো প্রানী কে নীলতিমির মত পরপর দুবার ভেসে উঠে আবার ডুবে যেতে দেখলাম!প্রথমে ভাবলাম কোন সামুদ্রিক প্রানী হয়তো ঢেউয়ের তোড়ে তীরে চলে এসেছে। কিন্তু তাকিয়ে থাকতে থাকতে ব্যপারটা পরিষ্কার হলো। ওটা নিঃসন্দেহে সামুদ্রিক কোন প্রানী নয়। আমার চোখ যদি আমাকে ধোকা না দিয়ে থাকে তবে দেখতে পাচ্ছি চকচকে কালো চামড়া আচ্ছাদিত একটা বিশালাকার ঘোড়া তীর থেকে একটু দূরে ডুব দিতে দিতে গভীরে চলে গেলো।

সমুদ্রে এরকম কালো ঘোড়া কি শুধু আমরাই দেখতে পেলাম। অন্ধকার ঘনায়মান। হয়তো তাই আশেপাশের লোকেরা খেয়াল করেনি।

নাকি অন্য কোন রহস্য আছে এর পেছনে?কারন আমার ডক্টর গ্রিফিনো লাইফের গাইড ওডিলি মাথার ভেতরে টেলিপ্যাথিক যোগাযোগ স্থাপন করতে চেষ্টা করছে। কি জানাতে চায় ওডিলি?ঐ ঘোড়ার সঙ্গে কি আমার কক্সবাজার আসার কোন সম্পর্ক আছে?

ওডিলি টেলিপ্যাথিক যোগাযোগে সক্ষম হয়েছে। আমি মাথার ভেতর শুনতে পাচ্ছি পুরনো ভাঙা রেকর্ডের মত একটাই কথা।
“কাল সমুদ্রে নামার পর একটু চোখ কান খোলা রাখবেন ডক্টর! ”
আমি জিজ্ঞেস করলাম “কেন?”
উত্তর এলো “কারনটা আপনার চোখের সামনেই আছে! ”
“ঐ বিশাল কালো ঘোড়ার কথা বলছো? ”

“হ্যা,ঐ ঘোড়া কদিন থেকেই বিভিন্ন দেশের সী বিচে দেখা যাচ্ছে। প্রত্যক্ষদর্শী দু থেকে তিনজন মাত্র। ফলে ওদের কথা কেউ বিশ্বাস না করে হেসে উড়িয়ে দিচ্ছে। সমুদ্রে সামুদ্রিক প্রানীর বদলে একটা কালো ঘোড়া সৈকতরেখা ধরে ভেসে বেড়াচ্ছে শুনলে কে বিশ্বাস করবে বলুন?”

“তাও ঠিক। কিন্তু এত কাঠখড় পোড়ানোর পর এই কক্সবাজার ট্রিপে এসেছি। কাল যদি ভয়ে ভয়ে সমুদ্রে নামতে হয় তাহলে তো সমস্যা। মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। ”

তন্ময় হা করে তাকিয়ে আছে আমার মুখের দিকে। আমি একা একা কার সাথে বিড়বিড় করছি সেটা ওর বোধগম্য হচ্ছেনা। আমাকে সজোরে একটা ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করলো

“কি রে হড়বড় করে কি আবোলতাবোল বকছিস?
আশেপাশে আমি ছাড়া তো আর কেউ নেই! তুই কথা বলছিস কার সাথে?”

বুঝলাম ওকে সব খুলে বলতে হবে। নইলে প্রিয় বন্ধুর কাছে পাগল বলে চিহ্নিত হওয়ার একটা প্রবল সম্ভাবনা আছে।
তাই আমার সাথে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা আগাগোড়া খুলে বললাম তন্ময় কে।

কিভাবে আমি বুঝলাম যে আমিই পুনর্জন্ম লাভ করা বালক রাজা তুতানখামেন,পুরোহিত বেন্নেস এবং ওডিলির সাহায্যে পোষা প্রানী গ্রিফিনোর মাধ্যমে কিভাবে ডক্টর গ্রিফিনো তে পরিণত হলাম,কার্থেজের দানব কে কিভাবে খতম করেছি সব খুলে বললাম।

তন্ময়ের মুখের হা বড় হয়ে চোয়াল ঝুলে পড়লো বুক বরাবর।এটাই স্বাভাবিক। এত কাছের বন্ধুর সাথে এতসব ঘটে গেছে তা শুনলে যে কেউ অবাক হবে। তন্ময় ও তার ব্যতিক্রম নয়।
তারপর একটা মজার কাজ করলো ও। আমার পিঠে হাত বুলিয়ে বললো

“দোস্ত তোর পিঠের ডানাদুটো কোথায়? এখন দেখতে পারছিনা যে? তাছাড়া ওডিলির সাথে ফিসফিস করে কি কথা বললি?”

বললাম “ডানাদুটো প্রয়োজন হলেই পিঠ ফুড়ে বেরিয়ে আসবে। আর টেলিপ্যাথি করে ওডিলি অনুরোধ করলো যেন আগামীকাল সমুদ্রে নামার সময় আমরা সতর্ক থাকি। ঐ কালো ঘোড়া নাকি বিপদজনক হতে পারে আমাদের জন্য। যদিও ওটা কি ক্ষতি করে জানা যায়নি। তবুও অত বড় জানোয়ার টা যদি একবার লাফ দিয়ে আমাদের ওপর পড়ে যায় তাহলেই তো কেল্লা ফতে। ”

তন্ময় আমার কথায় হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছেনা। বহু কষ্টে টাকা জমিয়ে জমিয়ে এই ট্যুরে আসা। সেটা একটা প্রানীর ভয়ে ভেস্তে যাবে? এটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে দুজনের।

হোটেলে ফিরতে ফিরতে রাত হলো। রাতের খাবার বাইরে থেকে খেয়ে হোটেলে ঢুকে ক্লান্ত অবসন্ন দু বন্ধু বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। শরীর ক্লান্ত হলেও মন টা অস্থির। তাই ঘুম আসছেনা।

বারবার ঐ বিকটদর্শন কালো ঘোড়ার জলে ঝাপিয়ে পড়ার দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে।আবছা আলোতে ভুল দেখেছি ভেবে চোখ বন্ধ করলাম আবার। কিন্তু ওডিলির বলা সতর্কবাণী মনে পড়তেই আবার চিন্তায় পড়ে যেতে হলো। শেষমেশ এটা ভেবে নিজেদের সান্তনা দিলাম যে যা হবার হবে। কোন ঝামেলায় পড়লে আমার ডক্টর গ্রিফিনো স্বত্তা কাজে লাগবে। শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করে এই ট্যুরের মুড নষ্ট করা ঠিক হবেনা।

কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বলতে পারবোনা। ঘুম ভাঙলো হোটেলবয়ের দরজায় কড়া নাড়ানোর শব্দে। সকালের নাস্তার সময় হয়ে গিয়েছে। এই হোটেলে সকালের নাস্তাটা ফ্রি। কেউ যেন অফার মিস না করে তাই সবাইকে জাগিয়ে দিয়ে যাচ্ছে হোটেলবয়। ভালোই হলো।রাতে সকালে ওঠার জন্য এলার্ম দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। হোটেলবয় ডাক না দিলে ঘুম কখন ভাঙতো কে জানে।

বালিশের নিচ থেকে মোবাইলটা বের করে সময় দেখলাম। আটটা বাজে। তন্ময় কে ডাক দিয়ে তুলে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। তারপর একসাথে হোটেলের ডাইনিং এ ঢুকলাম। ফ্রি খাবার ও যে উন্নতমানের হতে পারে তা হোটেলের খাবার দেখে বোঝা গেলো। নইলে আমরা সারাজীবন সস্তার তিন অবস্থা দেখে এসেছি।

খাওয়াদাওয়া সেরে হোটেল রুমে ফিরে কাপড় পালটে একেবারে সমুদ্রে নামার প্রস্তুতি নিয়ে একটু দূরের সী বিচের দিকে হাটতে থাকলাম। এখন বাতাস বইছে শো শো করে, সমুদ্রে জোয়ার আসতে শুরু করেছে কিছুক্ষণ হলো। শো শো বাতাস আর সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জনের শব্দে অদ্ভুত একটা পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে।

আমরা দেরী না করে চেয়ার ভাড়া করে স্যান্ডেল আর টাকাপয়সা জমা দিয়ে একটা টিউব ভাড়া করে জলে নেমে পড়লাম। গত সন্ধ্যার ঘটনা বেমালুম ভুলে গিয়ে হাটুজল থেকে ক্রমাগত কোমরজল পর্যন্ত চলে গেলাম দুজনেই। দারুন মজা হচ্ছে। গর্জনরত ঢেউ আছড়ে পড়ছে আমাদের ওপর। আমরা লাফ দিয়ে সার্ফারদের মত ঢেউয়ের ওপরের চড়ার চেষ্টা করছি টিউবের সাহায্যে। খানিকটা সফল হচ্ছি আবার মাঝেমধ্যে জলের ভেতর ডিগবাজি খেতে হচ্ছে।

এভাবে প্রায় দু ঘন্টা কখন কেটে গেছে বলতে পারবোনা। বীচের চেয়ারের দায়িত্বে থাকা লোক,আর টিউবের দায়িত্বে থাকা লোক এই দুজন ইশারায় কত ঘন্টা পার হয়ে গিয়েছে তা জানিয়ে দিলো। আমরা মনের আনন্দে জলকেলি করছি। কিন্তু কে জানতো আমাদের এই আনন্দ বেশীক্ষণ টেকবার নয়।

হঠাৎ তীর থেকে লাইফগার্ডের সাইরেন শুনতে পেলাম। সাধারণত ভাটার সময় হলে সমুদ্র থেকে লোকজন কে তীরে তুলে আনতে এই সাইরেন ব্যবহার করা হয়। এখন পরিপূর্ণ জোয়ার। তবে কেন সাইরেন বাজিয়ে ডাকা হচ্ছে সবাইকে?লাইফগার্ডের মুখ শুকনো। পাশে থাকা টুরিস্ট পুলিশের সাথে কি নিয়ে যেন গম্ভীরভাবে আলোচনা করছে সে। যারা গোসল করতে নেমেছিলো তারাও অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছে সাইরেন শুনে।অনেকেই সাইরেনের আওয়াজ কে পাত্তা না দিয়ে সমুদ্রে থেকে গেলো। আমরাও তাদের দলে। ভরা জোয়ারে কি এমন বিপদ হতে পারে?

কিন্তু “সাবধানের মার নেই” কথাটা বোধহয় ভুলে গিয়েছিলাম আমরা। ফলে যা হবার তাই হলো। অকস্মাৎ একটা বিকট শব্দে চিঁহি ডাক শুনতে পেলাম ঠিক আমাদের পেছনের জলে।আর কিছু বুঝে ওঠার আগেই কালো চাদরের মত কিছু আমাদের দুই বন্ধুকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে সমুদ্রের গভীরে নিয়ে যেতে লাগলো? লাইফগার্ডের কথা শোনা উচিত ছিলো আমাদের। না শুনে ভুল করেছি। মহা ভুল!

কালো ঘোড়া অদ্ভুতভাবে আমাদের দুই বন্ধুকে টেনে নিয়ে চলে যাচ্ছে মাঝসমুদ্রে! ওটার কালো শরীরের আচ্ছাদন আর সেটা থেকে বেরুনো বোটকা গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসছে,গা গোলাচ্ছে। তবে আশার কথা হচ্ছে কোন এক অস্বাভাবিক কারনে আমরা দুজন অর্থাৎ আমি আর তন্ময় জলের গভীরে তলিয়ে যাচ্ছিনা। মাঝসমুদ্রে যা অতি স্বাভাবিক। এই ঘোড়া আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কে জানে।

ভাগ্যদেবতা ভাগ্যে কি লিখেছেন তা অস্পষ্ট। এত কষ্টে একটা ভ্যাকেশন প্ল্যান করলাম আর প্রথম দিনেই তা ভেস্তে যাবার পথে!আচ্ছা লাইফগার্ড রা কি আমাদের এই বিপদের কথা জানতে পেরেছে? দিনের ঝকঝকে আলোয় চকচকে চামড়ায় আচ্ছাদিত করে একটা কালো ঘোড়া দুজন টুরিস্ট কে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এটা কি তাদের চোখ এড়িয়ে গেছে? নাকি ওরা খেয়াল করেনি? খেয়াল করলে তো এতক্ষনে সাহায্যের জন্য স্পিডবোট বা জেট স্কি নিয়ে ঐ ঘোড়ার পিছু নিতো ওরা। নাকি ভয়ে সেটা করেনি।

এই ঘোড়া কতটুকু হিংস্র তা তো কারো জানা নেই। আদৌ হিংস্র কিনা তাও অনিশ্চিত। আমি মনে মনে ওডিলির সাথে টেলিপ্যাথিক যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ফল হলো না। পিঠের ডানাগুলো কাজ করে কিনা দেখতে যাবো এমন সময় আচমকা জলের বুদবুদের মারাত্মক শব্দের পরপর আমরা তলিয়ে যেতে লাগলাম নোনা জলের গভীরে। শরীর ভিজে যাচ্ছে, জল ঢুকছে চোখেমুখে এমনকি কানেও। এই ঘোড়া আমাদের ডুবিয়ে মারতে চায় নিশ্চিত।

নইলে স্থলচর প্রানীকে কেউ কখনো জলের তলায় টেনে হিচড়ে নিয়ে যায়?দম বন্ধ হয়ে আসছে। এরকম আর কিছুক্ষণ চললে মারা পড়বো। আমার নিজের জন্য চিন্তা হচ্ছেনা। কিন্তু বন্ধু তন্ময়ের জন্য আফসোস হচ্ছে। কারন আমি এরকম পরিবেশে অভ্যস্ত হলেও তন্ময়ের কাছে এরকম পরিবেশ একেবারে নতুন!
একবার যেন শুনতে পেলাম তন্ময়ের করুন ডাক।
“অন্তু আমাকে বাঁচা” বলে চিৎকার করে ডাকছে ও।

চোখের সামনে সামান্য ঘোলাটে জল। তা ভেদ করে দৃষ্টি খুব বেশীদূর পৌছায় না। তবু আবছা আবছা যা দেখা যাচ্ছে তা থেকে মনে হচ্ছে তন্ময় আমার থেকে হাত দশেক দূরে। দুজনে ঝড়ের বেগে তলিয়ে যাচ্ছি সমুদ্রগর্ভে। কেউ কাউকে সাহায্য করতে পারছিনা। এ এক অসহনীয় পরিস্থিতি। আর এই পরিস্থিতে আমি সম্পূর্ন অসহায়,একদম নিরুপায়। মাথার ওপর যতদূর দৃষ্টি যায় কালো পর্দার মত কিছু দিয়ে ঢাকা।

ছাদের মত মাথার ঠিক ওপরে ওটার অবস্থান। এই ঘোড়া কতটা বড় তা ভাবলেই গা শিউরে ওঠে।অন্তত একটা নীলতিমির সমান তো হবেই!কিন্তু এত বড় ঘোড়া সাগরের তীর থেকে কারো দৃষ্টিগোচর হলোনা কেন? নাকি এই ঘোড়া ডুব দিয়ে ওৎ পেতে ছিলো শিকারের জন্য?মাথায় কিছুই ঢুকছেনা কারন শরীরে অক্সিজেনের কমতি দেখা দিয়েছে। আমি বোধহয় অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছি। তন্ময়ের ও কোন সাড়াশব্দ পাচ্ছিনা। ওকি এরইমধ্যে জ্ঞান হারিয়েছে!
কতক্ষণ অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলাম জানিনা। জ্ঞান ফেরার পর দেখি স্বচ্ছ নীলচে জলের একটা সমুদ্রের তীরে বালির ওপর শুয়ে আছি।মাথার ওপর কালো ছাদের বদলে প্রখর সূর্য।এখন দুপুর বলে মনে হচ্ছে। সূর্যের তাপে শরীর চিড়বিড় করছে। আশেপাশে যতদূর চোখ যায় শুধু ধু ধু সাদা বালির প্রান্তর। জনমানব বা প্রানী নেই কোথাও ।এ কোথায় এলাম রে বাবা?

অনেক কষ্টে উঠে বসলাম। উঠে বসতেই শরীরের প্রত্যেকটা পেশী যন্ত্রনায় আর্তনাদ করে উঠলো।মুখ থেকে আপনা আপনি বেরিয়ে এলো চিৎকার । তন্ময় একটু দূরে বালির ওপর চোখ বুজে পড়ে ছিলো। বুঝলাম অজ্ঞান। আমার চিৎকার শুনে ও ধড়মড় করে উঠে বসে চোখ মেললো।

উঠেই আমার পেছনের দিকে অদ্ভুতভাবে তাকালো তন্ময়। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে পিছে তাকিয়ে দেখি আমার পিঠের ডানাদুটো ক্রমাগত ঝাপটাচ্ছে। অথচ আমি নিজেই বুঝিনি।সম্ভবত অজ্ঞান হবার আগে শেষ চেষ্টা হিসেবে ডানাদুটো উন্মুক্ত করে দিয়েছিলাম। কিন্তু কাজে লাগাতে পারিনি। জলে ভেজা ডানাদুটো নিজে নিজে ঝাপটে শুকিয়ে নিচ্ছে নিজেদের। আমার এই ডানাওয়ালা চেহারা তন্ময় প্রথম দেখলো। এমনিতেই বেচারা অজ্ঞান হয়ে ছিলো।

জ্ঞান ফেরার পর নিজের বন্ধুকে ডানাসমেত দেখাটা আবার অজ্ঞান হবার মতই ব্যপার। তন্ময় উঠে দাঁড়ালো। তারপর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আমার কাছে এসে বসলো। খুব ভয়ে ভয়ে আমার একটা ডানা স্পর্শ করে দেখলো। তারপর বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বললো

“তারমানে তুই সত্যিই উড়তে পারিস? ”
“হ্যা পারি। কেন তোর বুঝি আগে বিশ্বাস হয়নি? ”
“এসব ব্যাপার কি এত সহজে বিশ্বাস করা যায়? ভালোই হলো। এখন কোথায় আছি বলতে পারিস? ”
“না। তবে চিন্তা করিস না।বেরুনোর একটা উপায় বের করবোই। ”
“আমার খুব ক্ষুধা লেগেছে। আশেপাশে সাগরের জল ছাড়া খাওয়ার মত তো কিছুই দেখিনা!”
“ক্ষুধা আমারো লেগেছে! চল তোকে নিয়ে উড়াল দেই। দেখি ওপর থেকে খাবারের কোন উৎস দেখা যায় কিনা।”
“ঐ বজ্জাত ঘোড়াটা কই রে?”

তন্ময়ের প্রশ্নের উত্তর দিতে যাবো এমন সময় আবার সেই চিঁহি ডাক শুনতে পেলাম ধারেকাছে কোথাও। ভয়ে আত্মা শুকিয়ে এলো। তন্ময়ের মুখ ও ফ্যাকাশে। আমি আর দেরী না করে তন্ময় কে সাথে নিয়া উড়ে চললাম খাবারের সন্ধানে। পিছনে তাকিয়ে দেখি সমুদ্র থেকে বালির ওপর খুরের খটাখট শব্দে ঝংকার তুলে আমাদের তাড়া করতে চাইছে বিশালদেহী কালো ঘোড়াটা। আরেকটু হলে আমাদের নাগাল পেয়ে যেত ওটা। কারন দুর্বল শরীরে বেশী উঁচুতে উড়তে পারছিলাম না।তার ওপর আবার তন্ময় কে কোলে নিয়ে উড়তে হচ্ছে। কিন্তু একটা দৃশ্য দেখে প্রানপনে ডানা ঝাপটে যতদূর পারা যায় উপরে উঠে এলাম। যা দেখলাম তা অনেকটা এরকম।

কালো ঘোড়াটা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে আছে একটা সামুদ্রিক সীল কে। ওটার দেহ রক্তাক্ত। তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই হা করে সীলটাকে মুখের ভিতর পুরে দিলো কালো জানোয়ারটা।নিমেষে চিবিয়ে খতম করে ফেললো ওটাকে। একেবারে হাড়সমেত।

তৎক্ষণাৎ ওডিলি টেলিপ্যাথির মাধ্যমে জানিয়ে দিলো আমাদের অবস্থান!
“মাংসাশী ঘোড়াদের শহর কারাজানে আপনাকে স্বাগতম ডক্টর গ্রিফিনো! ”

ওডিলির কথায় আমি যারপরনাই অবাক হয়েছি। ঘোড়া তৃণভোজী প্রানী। সেই ঘোড়া মাংসাশী হবে কেন? এ কেমন জগত? যেখানে নিরীহ প্রানী ঘোড়ার লোলুপ দৃষ্টি ঘাস লতাপাতার বদলে অন্যান্য প্রানীর মাংসের প্রতি?এরকম টা হয় মাছের জগতে। যেখানে বড় মাছ মাঝারী মাছ কে খায় এবং মাঝারী মাছ ছোট মাছ কে খেয়ে বেঁচে থাকে। ঠিক একারনেই সমাজের হর্তাকর্তাদের দ্বারা নিচু শ্রেনীর মানুষদের শোষণ করার আরেক নাম “মাৎস্যন্যায় “!

কারাজানের ঘোড়াদের যে আকার দেখেছি তাতে বোঝা যায় এরা শিকার হিসেবে তাদের চেয়ে আকারে ছোট প্রানীদের ভক্ষণ করে থাকে।
খাবার খোঁজার সময় আমাদের দুজনকেও সাবধান থাকতে হবে। ওডিলি কে খাবার কোথায় পাওয়া যাবে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আরো জিজ্ঞেস করেছিলাম এই শহর থেকে নিজেদের আগের গন্তব্যে কিভাবে ফিরে যাবো। ওডিলি বললো
“কারাজানের বিখ্যাত ফলের বাগান সম্পর্কে আপনার জানার সময় হয়ে এসেছে ডক্টর! আপনার নিয়তি আপনাকে ইচ্ছা করেই এই কারাজান শহরে এনে ফেলেছে। এই শহরের ঘোড়াদের সুস্থ করে তোলবার জন্যই আপনার এখানে আগমন। আর ঐ সুস্থতার চাবিকাঠি কারাজানের বিখ্যাত ফলের বাগান “নোভ্যালি” তে রয়েছে। ”

“কিন্তু এই ঘোড়াগুলোর অসুখটা কি? ”
“এই ঘোড়াদের অসুখ আপনার জানা। এরা আকারে সাধারণ ঘোড়ার চেয়ে কয়েকশ গুন বড় হলেও এদের খাদ্যাভ্যাস ছিলো সাধারণ ঘোড়ার মতই। এরা সাধারণ ঘোড়ার মতই তৃণভোজী ছিলো। কারাজান শহরটা কথা বলা ঘোড়াদের একটা বিশাল শহর। শুধুমাত্র ঘোড়ারা ই এখানকার বাসিন্দা। সবার গায়ের রঙ মিশমিশে কালো। শুধু ঘাড়ের কেশরে বিভিন্ন রঙের উজ্জ্বল আভা দেখে এদের আলাদা করে চেনা যায়। এই বিশাল ঘোড়া বাহিনী গুপ্ত প্রানীদের একটা দল। পৃথিবীর কেউই এদের কথা জানেনা। যেহেতু আপনি ডক্টর গ্রিফিনো সেহেতু আপনাকে সব জানানোর প্রয়োজন বোধ করছি। এদের অসুখ ঐ একটাই। “নোভ্যালী” নামক বিশাল বাগান আছে কারাজান শহরে। সেখানে এক হাজার ফলের গাছ আছে। প্রত্যেক গাছে আলাদ আলাদা ফল ধরে। প্রত্যেক গাছের ফলের স্বাদ ভিন্ন এবং সবগুলোই কমবেশী সুস্বাদু । এই ফলগুলোর মধ্যে একটা ফল আছে যেটা খুবই ভয়ংকর এবং বিষাক্ত। যার নাম “পয়জোবাইট”!

কারাজানের ঘোড়াগুলো সপ্তাহে একবার করে যার যার দল নিয়ে নোভ্যালীতে আসতো। সারাদিন বিভিন্ন গাছ থেকে ফল ছিঁড়ে খেতো। কিন্তু তারা জানতোনা যে বাগানের একমাত্র বিষাক্ত ফল “পয়জোবাইট ” তার রুপ, রস গন্ধ আর স্বাদ নিয়ে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। এই ফলটা বাইরে থেকে দেখতে অত্যন্ত লোভনীয়। এটার গাছে যে পরিমাণ ফল ধরে তা দিয়ে পুরো কারাজানবাসী কমপক্ষে চার সপ্তাহ ভোজ করতে পারবে। কিন্তু সেটার আর দরকার হয়নি। কয়েক ঘন্টার মধ্যে সুমিষ্ট ফলের গাছ সাবাড় হয়ে গেলো। এত সুস্বাদু ফল কারাজানের ঘোড়ার দল কখনোই খায়নি। আর বিপত্তি ঘটলো তার আরো এক দিন পর। সব ঘোড়া ঘাস বা অন্যান্য লতা পাতা ইত্যাদি খেতে পারছেনা। তাদের মুখে রোচেনা ওসব। কেমন যেন একটা রক্তের নেশা চেপে গেছে তাদের মাথায়। মনে হয় গরম রক্ত মাংস ভক্ষণ না করতে পারলে জীবন বৃথা। কিন্তু কারাজানে ওরা ছাড়া তো আর কোন প্রানী নেই। ফলে যেটা হলো সেটা কল্পনার অতীত। ওরা তাজা মাংসের লোভে পাগল হয়ে উঠলো। “পয়জোবাইট” ফলের বিষক্রিয়া এমনি ভয়ানক। এই ফল হজম হয় ঠিকই কিন্তু এর বিষক্রিয়া থেকে যায় অনেক দিন পর্যন্ত।

চুড়ান্ত সীমায় পৌছে গেলো ঘোড়াদের লোভ। আর শেষে লোভ এতটাই বেড়ে গেলো যে রক্ত পিপাসা মেটাতে নিজেদেরকেই খেতে লাগলো নিজেরা। ফলে মারামারি হানাহানি চলতে থাকলো অনেকদিন। ইতিমধ্যে বিষক্রিয়া শেষ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কারাজানের কালো ঘোড়াগুলো সংখ্যায় গিয়েছে কমে। আবার যদি অবুঝ ঘোড়াগুলো নোভ্যালীর ঐ ফল খেয়ে ফেলে তবে আর রক্ষা নেই। আর অবশিষ্ট থাকবেনা বিরাটাকার ঘোড়ার এই দল। কারন ওরা এখনো জানেনা কেন এই অসুখ হয়েছে তাদের। ”

“আচ্ছা ওডিলি সবই বুঝলাম কিন্তু তুমি এতসব কি করে জানলে? আর ঐ কালো ঘোড়া কিভাবে বুঝলো যে আমিই ডক্টর গ্রিফিনো আর আমিই ওদের “পয়জোবাইট” এর কবল থেকে রক্ষা করতে পারি। আমি যে সমুদ্রের তীরে গোসল করতে নামবো সেটাই বা কিভাবে বুঝলো প্রানীটা? ”

আমাকে সব জানিয়েছে আপনার অর্থাৎ পুরাতন তুতানখামেনের প্রধান পুরোহিত বেন্নেস। আর ঐ কালো ঘোড়া কে আমিই জানিয়েছিলাম আপনার সাহায্য আবেদন করার জন্য।”
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বললাম “তুমি জেনেশুনে আমাকে আর আমার বন্ধুকে এভাবে বিপদে ফেলে দিলে? কিভাবে পারলে? আমি নাহয় এসব বিপদের জন্য সদা প্রস্তুত কিন্তু তন্ময় তো এসবের কিছুই বোঝেনা। ”
তন্ময় শুধু ওডিলিকে আমার করা প্রশ্ন গুলো শুনতে পাচ্ছিলো? কারন ওডিলি শুধু আমার সাথেই টেলিপ্যাথির মাধ্যমে কথা বলছে। তন্ময় বুঝতে পেরেছে যে এই এলাকায় পৌছানোর জন্য ওডিলি ই দায়ী। তাই সে ও ওডিলি কে দু একটা গালাগাল দিয়ে বসলো। বেচারা এরকম পরিস্থিতিতে এর আগে পরেনি। তাই ওর দোষ দিচ্ছিনা।
ওডিলি বাইরের গ্রহের প্রানী। ও তন্ময়ের শুদ্ধ বাংলা ভাষায় দেয়া গালাগাল না বুঝে বললো

“আপনার বন্ধু কি আমার প্রশংসা করলেন?”
আমি হাসি চেপে উত্তরে বললাম “হ্যা প্রশংসাই বটে! ”
তারপর ওডিলি আমার আগের প্রশ্নের উত্তরে বললো “আমার কোন দোষ নেই ডক্টর। আপনাদের এখানে না নিয়ে আসলে অসহায় এই গুপ্ত প্রানীর দল বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তাই এই ব্যবস্থা। আমায় ক্ষমা করবেন। ”
“বুঝলাম! কিন্তু আমার ডানহাতের ভায়োলেট হিলিং টাচে কি ঐ ঘোড়ার দল ঠিক হবে? ”
“ঠিক হবে তবে সম্পূর্ন ঠিক হতে আরেকটা জিনিস লাগবে। যা ডানহাতে ভায়োলেট হিলিং টাচের সাথে প্রয়োগ করতে হবে ঘোড়া গুলোর ওপর। তাহলেই পরিপূর্ণ সুস্থ হবে ওরা। ”

“কি সেই জিনিস?
“নোভ্যালী ” নামক বাগান থেকে খুঁজে বের করতে হবে একটা নাম না জানা ফল। ঐ একহাজার ফলের গাছের একটিতে রয়েছে সেই ফল। কিন্তু সেই ফলের সঠিক বর্ননা আমি দিতে পারবোনা। আমার সে সম্বন্ধে জানা নেই। আমি শুধু জানি “পয়জোবাইট “যে বাগানের ফল তার প্রতিষেধক ফলটিও সেই একই বাগানের ফল।”
“ওডিলির কথায় মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। তারমানে প্রায় এক হাজার ফলের গাছ এক এক করে পরীক্ষা করে খুঁজতে হবে বিষাক্ত ফল “পয়জোবাইট” এর প্রতিষেধক ফল?

কিন্তু এটা কি করে সম্ভব?
আকাশ থেকে উড়ন্ত অবস্থায় দেখতে পাচ্ছি একটা বিশাল বনভূমি। বনভূমির ওপারে অসংখ্য কালো ঘোড়া বিচরন করছে। ওদের দেখে আমি ভয়ে ভয়ে নেমে পড়লাম জঙ্গলের মধ্যে।দেখেই বোঝা যাচ্ছে এটাই সেই বিখ্যাত ফলের বাগান “নোভ্যালী”!কারন থোকায় থোকায় রংবেরঙ এর লোভনীয় সব ফল ঝুলে আছে বিভিন্ন গাছে। এদের মধ্যেই রয়েছে বিষাক্ত ফল” পয়জোবাইট” আবার এদের মধ্যেই রয়েছে তার প্রতিষেধক!যা খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব!

নোভ্যালী বাগানটা বিশাল ।একহাজার রকমের ফলের গাছ আছে এতে ।তারমধ্যে একটা গাছের ফল বিষক্রিয়াযুক্ত অন্যটা বিষক্রিয়ানাশক ।আমাদের দুই বন্ধুকে খুঁজে বের করতে হবে বিষক্রিয়ানাশক ফলটি।আর বিষাক্ত ফল “পয়জোবাইট”থেকে দূরে থাকতে হবে। যেখানে ছোটখাটো বাগানের আম জাম বা কাঁঠাল গাছ খুঁজে বের করতে হিমশিম খেয়েছি সেখানে একহাজার গাছের মধ্যে নাম না জানা গাছের ফল খুঁজে বের করা দুঃসাধ্য ই বটে।

তবুও যেহেতু দায়িত্ব পড়েছে সেহেতু আর কোন উপায় ও নেই ।যেদিকে চোখ যায় একটা পরিচিত ফল ও নেই কোথাও ।ইতিমধ্যে তন্ময়কে ওডিলির নির্দেশনার ব্যপারটা খুলে বলেছি। তন্ময় ফল খোঁজার ব্যপারে দারুন আগ্রহ প্রকাশ করলো ।কিন্তু আরেকটা বিষয় আমাদের সমস্যায় ফেলে দিয়েছে ।সেটা হলো ফল খোঁজার জন্য দায়িত্ব ভাগাভাগি করার ব্যপার ।

তন্ময় বলছে
“আমরা আলাদা ভাবে খুঁজতে থাকি তাহলে হয়তো কম সময়ের মধ্যে ফলটা পাওয়া যেতে পারে।সমস্যা হচ্ছে ফল চিনবো কিভাবে?ফলে তো আর লেখা থাকবেনা যে “আমি ই সেই ঔষধি ফল!তাছাড়া যা অন্ধকার চারপাশে! একটু আলোর ব্যবস্থা থাকলে ভালো হতো।”

তন্ময় আলাদা হয়ে একা ফল খুঁজুক সেটা আমি চাচ্ছিলাম না। ওর কোনরকম বিপদ আপদ হোক তা আমার কাম্য নয়। সময় বেশী লাগলে লাগুক তবুও দুইজন একসাথে খুঁজবো সেই আকাঙ্ক্ষিত ফল। বাইরে দিনের আলো থাকলেও বাগানের ভেতরটা প্রায় অন্ধকার। ঘন গাছপালার সারি চারদিক জুড়ে। সেই বিরাট বিরাট সব গাছ ঘিঞ্জি হয়ে প্রায় লেগে আছে একে অপরের সাথে। ফলে তাদের সম্মিলিত ছায়ায় চারদিক থেকে আলো আসবার পথ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। এমন কোন গাছ চোখে পড়ছেনা যাতে কোন ফল নেই।আবছা আলোয় লাল, নীল,বেগুনী সবুজ হরেক রকমের টসটসে পাকা ফল ঝুলতে দেখা যাচ্ছে প্রত্যকটা গাছ থেকে।

নির্দিষ্ট ফল খুঁজতে হলে পরিপূর্ণ নির্দেশনা দরকার। অন্ততপক্ষে আলোর ব্যবস্থা দরকার। ওডিলি কে স্মরণ করছি মনেপ্রানে। ওডিলি সম্ভবত সাহায্যের জন্য প্রস্তুত ছিলো। টেলিপ্যাথিক সংকেতে প্রথমে ওডিলি কথা বলা শুরু করে দিলো।

“ডক্টর গ্রিফিনো দয়া করে আপনার ডানহাত টা উঁচিয়ে ধরুন। ”
আমি কথামতো ডানহাত উঁচিয়ে ধরতেই তাতে ভায়োলেট হিলিং টাচের বদলে লাল রঙের একটা আলো ফুটে উঠলো। আর তৎক্ষণাৎ পুরো নোভ্যালী বাগানের ফলের গাছগুলোর ফলগুলো জ্বলজ্বল করে উঠলো। যেন প্রত্যেকটা ফল একেকটা ২০০ ওয়াটের উজ্জ্বল বাতি। পুরো বাগান আলোকিত হয়ে উঠেছে। আমি আর তন্ময় ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি লাল রঙের আলোসমেত আমার ডানহাতের দিকে। তন্ময় তো অবাক হবেই কিন্তু আমিও আমার নতুন এই ক্ষমতা সম্পর্কে অবহিত ছিলাম না।

যাক!আলোর ব্যবস্থা তো হলো। এখন যদি সেই ওষধি ফল টা সম্পর্কে একটু ধারনা পাওয়া যায় তবে খুঁজে পাওয়াটা সহজ হয়। তন্ময় বললো
“চল!এই আলোকিত বাগানে দুজন একসাথে খুঁজি । ওডিলি ফলের ব্যপারে কিছু জানালো?”
ওডিলি এতক্ষণ চুপচাপ ছিলো। তন্ময়ের কথা শুনে আমাকে বললো

“ডক্টর! ফল খুঁজে বের করার একটা সহজ বুদ্ধি আপনাকে শিখিয়ে দিচ্ছি। আপনি পুরো বাগান হেটে অথবা প্রয়োজন হলে উড়ে উড়ে পর্যবেক্ষণ করুন। যতক্ষন না আপনার ডান হাতের লাল আলো সবুজ আলোয় পরিণত হচ্ছে ততক্ষন পর্যন্ত বুঝবেন ফল আপনার কাছ থেকে দূরে অবস্থান করছে। সবুজ রঙের উজ্জ্বলতা যত বাড়বে ফল ততই কাছে আছে বলে ধরে নিতে হবে। ”

আমি শুকনো মুখে বললাম “আমাকে জলজ্যান্ত ট্রাফিক লাইট বানিয়ে দেবার জন্য তোমায় ধন্যবাদ ওডিলি। ”
ওডিলি উত্তরে কিছু বললোনা। তবে কানে একটা কাশি দেয়ার মতো শব্দ এলো। বুঝলাম ওডিলি মুখ টিপে হাসছে।
এখন আর দেরী করার মত সময় আমাদের হাতে নেই। ওদিকে ক্ষুধায় পেট চো চো করছে। যেহেতু এখনো এখনো হাতের লাল আলো সবুজ হয়ে যায়নি তারমানে আশেপাশে থাকা ফল খাওয়া নিরাপদ। ইশারায় তন্ময়কে দুটো আপেলসদৃশ ফল পাড়তে বললাম। ও খুব সহজেই হাত দিয়ে ছিঁড়ে নিয়ে এলো দুটো ফল। দেরী না করে কামড় বসাতেই সেই ফল মুখের মধ্যে যেন মধু বর্ষণ করতে লাগলো। এসব ফলের স্বাদ নিতে গেলে তৃপ্তিতে চোখ বুজে আসে। কি দারুন রূপ, রস আর গন্ধ ফলটার। কারাজান থেকে ফিরে যাবার সময় কিছু ফল নিয়ে যেতে পারলে ভালো হতো।

একটা ফলের ই এতো স্বাদ না জানি আরো নয়শ নিরানব্বই টা ফলের স্বাদ আরো কত ভিন্ন, কত সুন্দর হবে। ওহ!ভুল বললাম একটা ফল কে তো হিসাব থেকে বাদ দিতে হবে।

যাই হোক!সুস্বাদু ফল চিবুতে চিবুতে আমি তন্ময় কে নিয়ে উড়ন্ত অবস্থায় খুঁজে চলেছি সেই ঔষধি ফল যা দ্বারা কারাজানের বিকৃতমস্তিষ্ক ঘোড়াগুলোকে সুস্থ করে তুলতে হবে। তন্ময় ফলের স্বাদে মজে গেছে। চুপচাপ হয়ে গেছে একদম। আমি ওকে আমার ডানহাতের দিকে নজর রাখতে বলেছি। কারন উড়ন্ত অবস্থায় গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে যাওয়ার সময় আমাকে বারবার সামনের দিকে তাকাতে হচ্ছে। আবার হাতের আলোর দিকেও নজর রাখতে হচ্ছে। তাই চলাচলে সমস্যা হচ্ছিল। তন্ময় কিন্তু ওর দায়িত্ব ভালোভাবেই পালন করছে। ও একদৃষ্টে চেয়ে আছে আমার ডানহাতের দিকে। ওর নাকি খুব ইচ্ছা হচ্ছে লাল আলো কিভাবে ট্রাফিক লাইটের মত বদলে গিয়ে সবুজ হয় সেটা দেখবার।

ভেবেছিলাম দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যাবে কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ফল পাবোনা। আমাদের ধারনা বদলে দিয়ে বিকেলের মধ্যেই হাতের লাল আলো পালটে হয়ে গেলো সবুজ।তন্ময় সেটা দেখেই চিৎকার করে বলে উঠলো “তোর হাতের আলো বদলেছে তারমানে খুব কাছাকাছি আছে ফলটা।”

আমরা ধীরে ধীরে নিচে নেমে এলাম। একটা ব্যপার চোখে পড়াতে বুঝলাম ঠিক জায়গাতেই এসেছি। কারন মাটিতে অসংখ্য খুরের ছাপ। নিঃসন্দেহের ঘোড়ার খুরের দাগ ওগুলো। তাহলে কি ঘোড়াগুলো তাদের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ফল খুঁজে পেয়েছে এরইমধ্যে?নাকি ঐ বিষাক্ত ফল “পয়জোবাইট” ও ধারেকাছে কোথাও আছে? তাই এত পায়ের ছাপ ছড়িয়ে আছে মাটিতে।

চারদিকে আগের মতই ঘন জঙ্গল। মাটিতে নামার পর সবুজ আলোর উজ্জ্বলতা বেড়েছে ।আমরা নিশ্চই খুব কাছাকাছি আছি। আমরা যেখানে নেমেছি তার চারদিকে চারটে গাছ।ঠিক মাঝখানে আমরা।এই চারটে গাছের সবগুলোকেই পরীক্ষা করে দেখতে হবে। প্রথম তিনটে গাছের কাছে যেতেই সবুজ আলোর উজ্জ্বলতা কমে গেলো। শেষের গাছটার কাছে যেতেই আগের উজ্জ্বলতা ফিরে এলো। চতুর্থ গাছটাই তাহলে সেই দরকারি ফলের গাছ!গাছটা খুজে পাওয়াটা এত সহজ হবে তা ভাবতেই পারনি!এখন একটা ফল মুঠোয় নিয়ে ভায়োলেট হিলিং টাচ প্রয়োগ করলেই কারাজানের অসুস্থ ঘোড়াগুলো সুস্থ হবে আর আমরাও তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে পারবো।

লাল রঙের চতুর্ভুজ আকৃতির মাঝারী আকারের ফল ঝুলছে গাছটা থেকে।একটা দুটো নয়। প্রায় শখানেক ফল আছে ওটাতে। আমি আর তন্ময় দুটো ফল ছিঁড়ে নিয়ে নিলাম যার যার পকেটে। এখন কারাজানের মূল শহরে ঢোকার পালা। তন্ময় বেশ উত্তেজিত হয়ে গেছে ফল হাতে পেয়ে। সে উত্তেজনার বশে গাছ থেকে আরেকটা ফল ছিঁড়ে নিয়ে একটা কামড় দিয়ে বসলো ফলটাতে ।

তারপর চিবুতে চিবুতে বললো “আগের ফলটার চাইতে এই ফলের স্বাদ অনেক বেশী ভালো। তুই তোর কাজ সেরে আয়। আমি এখানেই থাকছি। আলো আছে খাবার আছে। তাছাড়া এ ফলের যা স্বাদ তাতে পানির প্রয়োজন হবেনা। আমার দিব্যি সময় কেটে যাবে। তুই ঘোড়াদের সামলে যাওয়ার সময় আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাস। ”

“কিন্তু তোর এখানে একা একা থাকাটা বিপদজনক হতে পারে। যদিও জঙলে কোন বন্যপ্রানী বা সাপ-পোকামাকড় কিছুই চোখে পড়েনি তবুও বিপদের সম্ভাবনা তো একেবারে উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছেনা! চল আমার সাথে। ”
“না যাবনা। আমার এই ফলটা খুব ভালো লেগেছে। আমি আজীবন থেকে যাবো এখানে।”

বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখি ওর চোখেমুখে হিংস্রতা প্রবলভাবে ফুটে উঠেছে। আমার দিকে এগিয়ে এসে সে হঠাৎ ফিসফিস করে

বলে উঠলো “আমায় একটু মাংস জোগাড় করে দিতে পারবি? ঐ ঘোড়াগুলোর একটাকে এদিকে নিয়ে আয়না। দুজন মিলে ওর মাংস চিবিয়ে খাবো। এই ফলগুলোর সাথে নরম মাংস বেশ তৃপ্তি নিয়ে খাওয়া যাবে! ”

আমি ওর কথা শুনে থ বনে গেছি। একটা অদ্ভুত সম্ভাবনার কথা উঁকি দিচ্ছে মাথায়।আর আমার গা টা থেকে থেকে শিউরে উঠছে। কোথাও একটা মারাত্মক ভুল হয়েছে। আমরা আসলে ঔষধি ফল মনে করে যে ফল পকেটে পুরেছি তা আর কোন কিছু নয়, সেই বিষাক্ত ফল “পয়জোবাইট!”

ওডিলির ওপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিলো ।ও যদি ফলের ব্যপারে সঠিক নির্দেশনা নাই দিতে পারবে তাহলে কি দরকার ছিলো ভুয়া নির্দেশনা দিয়ে আমাদের বিপদে ফেলার? আচ্ছা ,আমার কোথাও ভুল হচ্ছেনা তো?কোন কিছুর ব্যপারে ঠিকঠাক অনুসন্ধান না করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যপারটা খুব খারাপ ।সাগরের নির্দিষ্ট গভীরতায় না পৌঁছুলে যেমন আকাঙ্ক্ষিত মাছ জালে উঠবেনা তেমনি একটা বিষয়ের সমাধান একটা নির্দিষ্ট গভীরতায় না পৌঁছালে পাওয়া যাবেনা। আমার হাতের কব্জিতে যে সবুজ আলো দেখতে পাচ্ছি তা সন্দেহাতীতভাবে প্রতিষেধক ফলটির অস্তিত্ব প্রকাশ করছে।

ভুলে “পয়জোবাইট” সংগ্রহ করেছি বটে কিন্তু ঔষধি ফলটাও যে আশেপাশেই আছে তার ব্যপারে মোটামুটি নিশ্চিত আমি। এখন পরিপূর্ণ অনুসন্ধান দরকার এবং এই কাজটা আমাকেই করতে হবে। কারন তন্ময় পয়জোবাইটের বিষক্রিয়ায় মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েছে। ওর হঠাৎ মাংসের প্রতি অতিরিক্ত লোভ এই বিষয়টার জানান দিচ্ছে। ও যে কখন আমার ওপরেই হামলা করে বসে তার জন্য চিন্তায় আছি।

খুব দ্রুত একটা ব্যবস্থা নিতে হবে। নইলে সবচেয়ে কাছের বন্ধুর সাথে লড়াই করতে হতে পারে ।এই ঘোড়ার দুনিয়ায় একমাত্র মানুষ সঙ্গী তন্ময়।আমি ওকে এভাবে অমানুষ হয়ে যেতে দিতে পারিনা।

মনে মনে আমার বিশেষ তলোয়ারটা প্রার্থনা করে চোখ বুজে বাম হাতটার কব্জি মুঠো করে ফেললাম। তাতে কাজ হলো। আমার বিশেষ ক্ষমতাযুক্ত অদৃশ্য তলোয়ারটা ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে। ওটা পুরোপুরি দৃশ্যমান হবার আগেই আমাকে তন্ময়ের নজর বাঁচিয়ে বিষাক্ত পয়জোবাইটের গাছে আঘাত হানতে হবে। সমস্যার গোড়ায় আঘাত হানলে হয়তো সমাধান ও বেরুবো।

তন্ময় কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমি এক কোপে পয়জোবাইটের গাছটা গোড়া থেকে উপড়ে ফেললাম। আর তন্ময় না না বলে চিৎকার করে হিংস্র পশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো আমার ওপর। আর আমার তলোয়ারটা ছিটকে পড়লো একটু দূরে।

গাছের মূল আর শেকড়বাকড়যুক্ত মাটিতে পড়ে গিয়ে ধস্তাধস্তি চলতে লাগলো দুই বন্ধুর মাঝে। তন্ময় একটা শক্ত ঘুষি বসিয়ে দিলো আমার পেটে। আমি ব্যথায় কুকড়ে গেলাম। কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারলাম না। তন্ময়ের ওপর পয়জোবাইটের বিষ ভর করেছে। ও পয়জোবাইট গাছের মূলোৎপাটন করায় অখুশি হবেই।
এ তো আমার চেনা বন্ধু তন্ময় নয়।

প্রচন্ড ধারালো তলোয়ারের আঘাতে পয়জোবাইট গাছ গোড়াসমেত উপড়ে পড়ে আছে পাশে। গাছ মৃত। কারন তার লাল ফলের উজ্জ্বলতা কমে গিয়ে ধীরে ধীরে প্রদীপের মতো নিভে যাচ্ছে।
তন্ময় এখনো আমাকে আঘাতের পর আঘাত করে যাচ্ছে।

আমি আঘাত সহ্য করতে করতে ভাবছি পয়জোবাইটের প্রভাব শেষ হতে আর কত দেরী?হয়তো ফলের লাল আলো সম্পূর্ণ নিভে গেলেই ওটার প্রভাব নষ্ট হয়ে যাবে। আমিও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে পাবো আমার বন্ধুকে।

আমার ধারনা একেবারে ভুল ছিলোনা। গাছের ফলগুলো জীবন্ত প্রানীর মত লাফিয়ে উঠে গাছ থেকে ঝরে পড়ছে তারপর নিস্তেজ হয়ে ছড়িয়েছিটিয়ে পড়ছে আশেপাশে। নোভ্যালী বাগানের বিভীষিকা “পয়জোবাইট” এর খেল খতম হয়েছে!

আর তার কিছুক্ষনের মধ্যেই তন্ময় ফলগুলোর মত নিস্তেজ হয়ে পড়ে গেলো আমার পাশে। বুঝলাম অজ্ঞান হয়ে গেছে। চিন্তায় পড়ে গেলাম। এখন ওর জ্ঞান ফেরাবো কিভাবে?হাতের ভায়োলেট হিলিং টাচ এখনো সবুজ হয়ে আছে। কাজেই ওটা দিয়ে তন্ময় কে সুস্থ করা যাবেনা। তাহলে উপায়?

এসব ভাবছি তখন আচমকা একটা শব্দ শুনতে পেলাম কাছাকাছি। মনোযোগ দিয়ে দেখি পয়জোবাইট এর কেটে দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাওয়া গোড়ার কাছে হচ্ছে শব্দটা। কেমন যেন কড়কড় কড়কড় করে উঠছে গোড়ার কাছের মাটি। যেন ওটার তলায় জীবন্ত কিছু আছে।আগ্নেয়গিরি থেকে লাভা উদগীরনের সময় এমন শব্দ হয়।
হঠাৎ একটা বিস্ফোরনের মত শব্দ হতেই আমি ছিটকে পড়লাম আমার তলোয়ার যেখানে পড়েছিলো সেখানে। ডানহাতের কনুই কেটে গেলো ধারালো তলোয়ারের আঘাতে । ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছে।কিন্তু সেদিকে আমার খেয়াল নেই।

বিপুল বিস্ময়ে সামনে তাকিয়ে দেখি পয়জোবাইটের গোড়ার জায়গা থেকে মাটি ফুড়ে বেরুচ্ছে অন্য একটা গাছ!যার ঘন নীল পাতাযুক্ত ডালে সবুজরঙা ফল ঝুলছে!কি অসাধারণ সৌন্দর্য সে গাছের তা বলে বোঝানো যাবেনা। আর আমার যদি ভুল না হয় তবে এটাই সেই প্রত্যাশিত ঔষধি ফল যা কারাজানের ঘোড়াগুলোর সুস্থতার জন্য অতীব প্রয়োজনীয়।

ওডিলির কোন ভুল ছিলনা।ও সঠিক নির্দেশনাই দিয়েছে। আমরাই ভাবতে পারিনি ফলের গাছটা পয়জোবাইটের গোড়ায় গুপ্ত অবস্থায় আছে।

বাংলায় একটা কথা আছে “প্রদীপের নিচে অন্ধকার!” সেই কথার প্রতিফলন এখানে উল্টোভাবে ঘটেছে। এখানে অন্ধকার ফুঁড়ে আলো বেরিয়েছে। সমস্যার গোড়ায় সমাধান পাওয়া গিয়েছে।

একটা সাধারণ ফলের গাছের মত উচ্চতায় গিয়ে গাছটা থামলো। তারপর নিজে থেকেই বেঁকে ঝুকে এলো একদম আমার হাত বরাবর। তারপর উপহার দেবার মত করে একটা ফল আপনা থেকেই ফেলে দিলো আমার হাতে। আর তৎক্ষণাৎ আমার কনুইয়ের রক্তপাত বন্ধ হয়ে একদম আগের মত হয়ে গেলো। তাছাড়া আগের চেয়ে সতেজ ও বোধ করছি। তন্ময়ের ঘুষিতে ভালোই জোর ছিলো। কিন্তু ফল হাতে পাওয়ার পর সেই ঘুষির আঘাতের জায়গাগুলোও আর ব্যথা করছেনা।

গাছের জীবন আছে জানি। কিন্তু এরকম শরীর দুলিয়ে চলাফেরা করা” হিলিং ট্রি” জীবনে কখনো দেখিনি। গাছটা তখনো ঝুকেই আছে আমার দিকে। আমি কি করবো ভাবছি তখন হঠাৎ ই একটা বুদ্ধি মাথায় এলো। আমি এক দৌড়ে তন্ময়কে কাধে তুলে নিয়ে এলাম গাছটার কাছাকাছি। তারপর ওর একটা হাত তুলে ধরলাম গাছটা দিকে।আগের মত ফল খসে না পড়ে কিছু নীলরঙা পাতা খসে পড়লো ওর ওপর। আর কিছুক্ষনের মধ্যেই ওকে নড়তে চড়তে দেখা গেলো।

ওর জ্ঞান ফিরলো মিনিট পাঁচেক এর মধ্যেই!তন্ময় বোকার মত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। অনেক কষ্টে জিজ্ঞেস করলো “আমার কি হয়েছিলো রে?”

আমি উত্তরে কেবল বললাম “তেমন কিছু হয়নি। শুধু পিছলে পড়ে একটা গাছের সাথে ধাক্কা খেয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলি! এখন সব ঠিক আছে। আরেকটা সুখবর আছে। ঔষধি ফলটা পাওয়া গিয়েছে। একটা গাছের তলা থেকে বেরুলো এইমাত্র। ঐ দেখ!ওর গুনেই তুই জ্ঞান ফিরে পেয়েছিস। তন্ময় অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো হিলিং ট্রির দিকে।
আমিও ওদিকে তাকালাম।

গাছের সাথে কথোপকথন হয়নি কোনদিন। আমি বাংলায় ধন্যবাদ দিলে কারাজানের বিখ্যাত ফলের বাগান নোভ্যালীর “হিলিং ট্রি ” আমার কথা বুঝবে কিনা সন্দেহ আছে!

তাই গাছের মতই ঝুকে কুর্নিশ করে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলাম। গাছটাও আরেকটু ঝুকে আমার মতই কুর্নিশ করে আবার সোজা হয়ে দাঁড়ালো। তারপর সাগরের পানিতে ডলফিন যেভাবে লাফিয়ে উঠে ডুব দেয় ঠিক তেমন করে গোড়ার মাটিতে ডুব দিয়ে মিলিয়ে গেলো ওটা।গোড়ার মাটি এমন ভাবে আগের অবস্থানে ফিরে এলো যেন কোনদিন ই ওখানে কোন গাছ ছিলোনা।

তন্ময়ের ঘোর কাটেনি। তবুও ও যে সুস্থ হয়েছে তারজন্যে আনন্দিত আমি। ওর সাথে যা ঘটেছে সেই সত্য ঘটনাটা কোনদিনই কাউকে বলবোনা। বললে তন্ময় অযথা একটা অপরাধবোধে ভুগবে। যা আমার কাম্য নয়।
ভাবলাম ফল হাতে পেয়েছি এখন কারাজানে উড়ে গিয়ে ঘোড়াগুলোকে সুস্থ করে বাড়ি ফিরবো। কিন্তু উড়তে উড়তে কারাজানে পৌঁছানোর আগে নোভ্যালী বাগানের ভেতরে থাকতেই কানে এলো অস্যংখ্য খুরের খটাখট শব্দ আর বিকট শব্দে চিঁহি ডাক!কি ঘটছে দেখার জন্য ওড়ার গতি কমিয়ে একটু নিচে নামতেই ভয়ে শরীরের রক্ত হিম হয়ে এলো!

দেখলাম অসংখ্য বিশালাকার ভীতসন্ত্রস্ত কালো ঘোড়া একটার পর একটা দৌড়ে এসে একটা ফলের গাছ থেকে ফল কামড়ে খাচ্ছে আর মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ধীরে ধীরে ভেসে উঠছে শূন্যে!
তার পেছনে আরেকদল ঘোড়া ধাওয়া করছিলো। তাদের চোখেমুখে হিংস্রতার ছাপ স্পষ্ট। তারা নিশ্চিতভাবেই মাংসাশী ঘোড়ার দল। কারন তাদের মুখ থেকে রক্ত ঝরছে। হয়তো ধাওয়ার শিকার নিরীহ ঘোড়ার দলের কোন দুর্ভাগা সদস্যকে সদ্য ভক্ষন করে এসেছে তারা। তার ই টাটকা রক্ত লেগে আছে হিংস্র ঘোড়াদের মুখে ।
ভয়ের মাত্রাটা বাড়লো তখুনি যখন দেখলাম হিংস্র ঘোড়ার দল ও ঐ একই ফল খাচ্ছে যে ফল খেয়ে নিরীহ ঘোড়ার দল শুন্যে ভাসছে!

কারাজানের কালো ঘোড়াদের আক্রমণকারী দলটিও আক্রান্ত দলের মতই শুন্যে ভাসছে ধীরে ধীরে। ইতিমধ্যে নিরীহ ঘোড়ার দল বেশ খানিকটা উপরে উঠে গিয়েছে।সমস্ত ঘটনা ঘটেছে খুব বেশী হলে দু থেকে আড়াই মিনিটে। সব আমার সামনে অবস্থিত গাছের ফলের গুন!

নোভ্যালী আসলে জাদুকরী ফলের বাগান। আরো না জানি কত রকমের অদ্ভুত ক্ষমতাযুক্ত ফল আছে এই বাগানে সেটা কেবলমাত্র ঈশ্বর জানেন।ঘোড়াদের এত বিশাল আকারের পেছনেও সম্ভবত নোভ্যালী বাগানের কোন ফলের অবদান আছে।

আমার ওড়ার জন্য পিঠের ডানাই যথেষ্ট ।
তন্ময় কে বললাম” নিজে নিজে ওড়ার মজা নিতে চাইলে ঐ ফলটা খেয়ে দেখতে পারিস। অবশ্য তোর মতো শুকনো ছেলে যদি আবার বেশী দূরে উড়ে যাস সে ভয়টা আছে ।তবে সমস্যা নেই। আমি আছি তোকে রক্ষা করার জন্য ।”
তন্ময় আমার কথায় লাফিয়ে উঠে একটা ফল ছিঁড়ে নিলো গাছ থেকে। তারপর তৎক্ষণাৎ কামড় বসালো হলুদাভ ফলটাতে। আন্দাজ এক মিনিট পর ও সোজা হয়ে ভাসতে লাগলো শুন্যে ।

তারপর আচমকা প্রবল বেগে ছুটে গেলো আকাশের দিকে ।আমি এই ঘটনায় হতবুদ্ধি হয়ে গেছি। তাড়াতাড়ি নিজের ডানাদুটো জোরেশোরে ঝাপটে ওর পিছু নিলাম ।ওদিকে নোভ্যালীর গাছপালা ছাড়িয়ে ওপরে উঠতেই এক দুর্দান্ত দৃশ্য চোখে পড়লো। আকাশপথে ওজনদার ঘোড়াগুলো দুভাগে বিভক্ত হয়ে ভাসছে। তন্ময় তাদের নাগালের মধ্যে এসে পড়েছে। এতে দুদল ঘোড়াই হতভম্ব হয়ে গেছে।ভয় হচ্ছে আক্রমণকারী ঘোড়ার দল কখন তন্ময় কেই আক্রমণ করে বসে। এই ঘোড়াগুলো কখনো মানুষকে দেখেনি। আমি যদি হুট করে উড়ে গিয়ে তন্ময়কে ধরে ফেলি তখন হয়তো এরা ভড়কে গিয়ে হামলা করে বসতে পারে। কি মুশকিল! এখন কি করা যায়?

তন্ময় নির্বিকার। এত বিশাল সব মাংসাশী ঘোড়ার সামনে কাচুমাচু হয়ে ভাসছে বেচারা। ভুলটা আমার।এই চরম সংকটের মুহূর্তে কি দরকার ছিলো ওকে ফল খাওয়ানোর? কিন্তু এখন অন্য উপায় ভাবতে হবে। যাতে ঘোড়াগুলো টের পাওয়ার আগেই কোন একটা পদক্ষেপ নেয়া যায়। আমি দ্রুতবেগে উড়তে পারিনা। ডানার জোর কম। তন্ময়ের কাছে হালকা বেগে উড়ে গেলে হিংস্র ঘোড়াদের চোখে পড়ে যাবো। তাতে বিপদ বাড়বে বৈ কমবেনা।
ওডিলি কি এখন আমায় সাহায্য করবে?

“হ্যা করবো ডক্টর! আমি সর্বদা আপনাকে সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত। ”
হঠাৎ ওডিলির গমগমে আওয়াজ শুনে চমকে উঠেছি। কিন্তু ওর সাথে যোগাযোগ করতে পেরে ভালো লাগছে।
বললাম “কি করা যায় এখন। আমাকে দ্রুত তন্ময়ের কাছে পৌছে দিতে পারবে? ঘোড়াদের ভাবসাব সুবিধের বলে মনে হচ্ছেনা। ”
“এই কাজের জন্য ছোট্ট একটা প্রশিক্ষণ লাগবে আপনার।”
“প্রশিক্ষণ? ”
“হ্যা!আপনি সাবধানে ডানা নেড়ে একটু পিছিয়ে আসুন। ঘোড়াগুলো যেন টের না পায়। তারপর দুবার পিছিয়ে একবার সামনের দিকে ঝুকে ডানা ঝাপটান। দেখবেন আপনার ওড়ার গতি বেড়ে গেছে। ”

আমি সময় নষ্ট না করে ওডিলির কথা মোতাবেক কাজ শুরু করে দিলাম। প্রথমবার ওড়ার ছন্দ বুঝিনি। তারপর পরপর তিনবার চেষ্টা করে কৌশল রপ্ত করলাম। এখন সেই কৌশল কাজে লাগাতে হবে। আমি প্রস্তুত। দুবার পিছিয়ে এসে সোজা সামনের দিকে ঝুকে ডানা ঝাপটে দিলাম। অবাক হয়ে দেখি নিজের ওজন যেন অনেক কমে গিয়েছে।সামনের ঘোড়াগুলোকে প্রায় আলোর গতিতে ভেদ করে তন্ময়ের প্রায় কাছাকাছি পৌছে গিয়েছি। ঘোড়াগুলোর ক্ষতি হয়নি। তাছাড়া এত দ্রুত গতিতে পার হবার পরেও সামান্যতম অস্বস্তি লাগছেনা আমার। সময় যেন প্রায় থেমে গেছে। ঘোড়াগুলো কিছু বুঝে ওঠার আগেই তন্ময়কে আঁকড়ে ধরে আগের মতই গতি নিয়ে ওকে বাগানের মাটিতে পৌঁছে দিলাম। থামার পর একটু হয়রান লাগছে। বড় ঘোড়াগুলোর কাছে আমরা খুবই নগন্য আকৃতির প্রাণী । দাঁত নয় ওরা যদি শুধু খুর দিয়েও আমাদের আঘাত করে তবে ওখানেই আমাদের জীবননাশ হয়ে যাবে।

তন্ময়কে একটা নিরাপদ জায়গায় রেখে আমার অদৃশ্য তলোয়ারটা দৃশ্যমান করে নিলাম। ডানহাতের ভায়োলেট হিলিং টাচ এখন ফিরে এসেছে। সেই হাতে প্রতিষেধক ফল আর বামহাতে তলোয়ার নিয়ে আমি

এক ঝটকায় উপরে উঠে এলাম। তলোয়ার যেকোন অভাবনীয় আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য। আর প্রতিষেধক ফল আর ভায়োলেট হিলিং টাচের মিশেল ঘোড়াগুলোকে আগের মত সুস্থ করে দেবে ।

আকাশপথে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে!আর আমি উড়ে যাচ্ছি সেই যুদ্ধের শেষ দেখতে!

আমি দ্রুতবেগে গাছপালা পেরিয়ে ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছি ।তন্ময় যেন নীচ থেকে আমায় একবার ডাকলো। কিন্তু এখন আর ওর ডাক শোনার সময় নেই। তাড়াতাড়ি ঘোড়াগুলো কে সুস্থ করতে পারলে বাঁচি।কিন্তু একি ?ঘোড়াগুলো গেলো কোথায়?
এইমাত্র যাদের আকাশে ভাসতে দেখেছি তারা হঠাৎ হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো কিভাবে ?ঘোড়াগুলোর যা আকার তাতে তারা ভেসে ভেসে অনেক দূরে চলে গেলেও স্পষ্ট দেখা যাবে এখান থেকে। খোলা আকাশে ওরা হারিয়ে যাবার কোন সুযোগ নেই। তাহলে হলোটা কি?কোন কারনে ওরা আবার নোভ্যালীতে নামেনি তো?হয়তো যে ফল খেয়ে তারা শুন্যে ভাসছিলো সে ফলের কার্যকারীতা শেষ!কারন তন্ময় কেও আর ওপরে ভেসে উঠতে দেখছিনা।

এসব ভাবছি ।হঠাৎ একটা বিকট চিঁহি শব্দ কানে এলো আর মারাত্মক ধাক্কা লাগলো শরীরে !আমি টাল সামলাতে না পেরে হুড়মুড় করে নিচে পড়ে যেতে লাগলাম। হাতের তলোয়ার টা প্রানপনে আকড়ে ধরে আছি। ওটা হাতছাড়া হলেও সমস্যা ।প্রবল বেগে ডানা ঝাপটে কোন কাজ হচ্ছেনা। আর ভেসে থাকতে পারছিনা। কিন্তু আমি পড়ছি তো পড়ছিই। যেন অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছি ।আকাশ থেকে নোভ্যালীর মাটির মধ্যকার দূরত্ব খুব বেশী নয়। এতক্ষনে আমার মাটিতে ধাক্কা খাওয়ার কথা। কারন কারাজানের ঘোড়াগুলো স্বাভাবিকের তুলনায় আকারে বড় হলেও নোভ্যালীর ফলের গাছগুলো স্বাভাবিক ফলের গাছের মতই উঁচু। ফলে মাটির নাগাল পাওয়া সহজ। তবুও কেন জানি আমার ভূমিতে পৌঁছুতে অস্বাভাবিক দেরী লাগছে।
কিন্তু আমায় ধাক্কা দিলো কে?ঘোড়া?

ওদেরকে দেখতে পেলামনা কেন?বড় ঘোড়াগুলো হঠাৎ অদৃশ্য হলো কিভাবে?কিছুই মাথায় ঢুকছেনা।
বহমান সময় যেন আচমকা থমকে গেছে। আর আমি পড়ে গেছি সেই আবদ্ধ সময়ের ফাঁদে!পিঠের ডানাগুলো সমানে ঝাপটাচ্ছি কিন্তু সোজা হতে পারছিনা। আমার পিঠ নোভ্যালীর মাটি বরাবর আর মুখ আকাশমুখী। অর্থাৎ ভূমি স্পর্শ করামাত্র আমার ডানাদুটো তুলনামূলক আগে আঘাতপ্রাপ্ত হবে। এখনো কেন মাটির সংস্পর্শে আসিনি তা বারবার ভাবতে লাগলাম। এই অনন্তকালের পতন আমার চিন্তাশক্তিকে স্তিমিত করে দিচ্ছে। ধীরেধীরে অবশ হয়ে আসছে শরীর। বা হাতের কব্জির বাঁধন থেকে আলগা হচ্ছে তলোয়ার। মাথা ঘুরছে।

সমুদ্রের তীরের অগভীর জলে যেমন অত্যন্ত গভীর লুকানো খাল থাকে তেমনি নোভ্যালীর মাটিতে নিশ্চয় লুকানো খাদ আছে। আর আমি সেই খাদেই পড়ে গেছি বোধহয়। ডুবন্ত মানুষ যেমন খড়কুটো আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করে। আমিও তেমনি আশেপাশের গাছগুলোর ডালপালা ধরে পতন ঠেকানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু কিছুতেই সফল হতে পারছিনা। একবার ভাবলাম হাতের তলোয়ার কোন একটা গাছে বিঁধিয়ে দিলে হয়তো নিচে পড়ার হাত থেকে রক্ষা পাবো। চেষ্টাও করেছিলাম। কিন্তু ফল হয়েছে উলটো।তলোয়ারটা একটা ধারেকাছের একটা গাছে আটকাতেই কিছুক্ষনের জন্য দোদুল্যমান অবস্থায় ঝুলছিলাম গাছে থেকে।

কিন্তু মিনিটখানেক পরেই ধারালো তলোয়ারের আঘাতে গাছটার বুক চিরে দু টুকরো হয়ে যেতে লাগলো আর আমি আবার নিচের দিকে পড়তে লাগলাম। কিছুতেই কিছু হচ্ছেনা। হুট করে এমন ঝামেলায় পড়বো তা বুঝিনি। নোভ্যালীর মাটি কি কোন রহস্যময় কারনে অনেক দূরে চলে গিয়েছে?
এমনটা হলে তার পেছনে একটাই কারন আছে।সেটা হলো নোভ্যালীর ফলের গাছগুলোর উচ্চতা!হঠাৎ করেই তারা স্বাভাবিক গাছের বদলে দীর্ঘাকার গাছে পরিনত হয়েছে। ফলে তাদের উচ্চতা বেড়েছে। কতটুকু বেড়েছে তা আন্দাজ করতেই আমার গা ঘামতে শুরু দিলো। নিচে তন্ময় আছে। ও এর আগেও কিছু অদ্ভুত ঘটনার সসম্মুখীন হয়েছে বটে,কিন্তু সাধারণ ফলের গাছকে হঠাৎ দৈত্যাকৃতি হতে দেখেনি নিশ্চয়।এতক্ষনে একা একা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মনে হয়।

একটা ব্যপারে খটকা লাগছে। গাছগুলোর উচ্চতা বেড়েছে ঠিকই কিন্তু আগার দিকে নয় গোড়ার দিক থেকে। অর্থাৎ কোন কারনে গাছের বর্ধিষ্ণু উচ্চতা মাটিকে নিচের দিকে ঠেলে নেমে গেছে।আমার চারপাশ অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে। গাছে গাছে যে জ্বলজ্বলে ফলগুলো আলো ছড়াচ্ছিলো সেগুলো নিভে গেছে। আমি তলিয়ে যাচ্ছি অতল অন্ধকারে। নিজের চেয়ে বেশী চিন্তা হচ্ছে তন্ময়ের জন্য। তন্ময় এই ঘুটঘুটে অন্ধকারে একা দাঁড়িয়ে আছে নিচে কোথাও।

সমগ্র নোভ্যালী বাগানটা যেন গাছসমেত জেগে উঠেছে। নিচ থেকে ভেসে আসছে ভয়ানক কিছু শব্দ। আমার চারদিকে যেন ঘুরছে অসংখ্য অশরীরী আত্মা। তারা শোরগোল করছে ঠিক আমার কানের কাছে। আমি এই বাগানে প্রবেশ করি সেটা যেন তারা চায়নি। তাই দুর্বল অথচ তীক্ষ্ণ কন্ঠে আমায় অভিশাপ দিচ্ছে, তিরস্কারে মেতে উঠেছে। একটা আবছা আলোর বলয় আমায় ঘিরে চক্রাকারে ঘুরছে যেন। কি ওটা? একটা প্রানীর গলা থেকে বেরুনো ঘড়ঘড়ে গর্জন কানে এলো আচমকা। অশরীরী অথবা শরীরী অনেকগুলো প্রানী আমায় ঘিরে আমার সাথেই নিচে পড়ছে বলে মনে হলো। তারা হয়তো আমার নিচে পড়ার জন্য অপেক্ষা করছে। তারপর নোভ্যালীতে অনুপ্রবেশের দায়ে আমায় শাস্তি দেবে। এসব দেখতে দেখতেই একসময় হাতের কাছে সাপের মত কিছু একটা ঠেকলো। দ্রুত হাতটা নাড়ানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু তার আগেই সেটা আমায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরতে লাগলো।তারপর পা উপরে মাথা নিচে দিয়ে ঝুলতে থাকলাম। বুঝলাম বিশাল কোন সাপ আমায় আক্রমণ করেছে। অন্ধকারের মধ্যে তার ফোঁসফোঁস আওয়াজ পেলাম। দুটো লাল চোখ দৃশ্যমান হলো চোখের সামনে। তারপর একটা নয় জোড়ায় জোড়ায় লাল, নীল, সবুজ হরেক রকমের চোখে পড়তে লাগলো। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই হিংস্র চোখের লোলুপ দৃষ্টি আমার দেহকে আরো দুর্বল করে দিচ্ছে। একদল ভয়ানক প্রানীর হাতে কিছুক্ষনের মধ্যেই মরতে হবে আমাকে। বন্ধু তন্ময়ের সাথে শেষ দেখাটাও আর হবেনা।কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে।

হাতের ভায়োলেট হিলিং টাচ অনেক আগেই আপনা থেকে বন্ধ হয়ে গেছে। ওটা থাকলে তার অল্প আলোয় অন্তত আমার মৃত্যুদূতদের শেষবারের মত দেখে নিতে পারতাম। সেটা আর সম্ভব নয়। চারদিকে যেন প্রানীদের ভীড় বাড়ছে। নানারকম অদ্ভুত আর হাড় হিম করা শব্দ ভেসে আসছে চারদিক থেকে।কিন্তু এ জঙ্গলে তো কোন প্রানী ছিলোনা। থাকলে ওডিলি আমায় সাবধান করে দিতো। অবশ্য ঐ অল্প একটু সময়ে এতবড় জঙ্গলের কতটাই বা আমরা দেখেছি?
এখন আমাকে মরতে হবে অজ্ঞাত একদল প্রানীর হাতে।কিন্তু বেশকিছু সময় কেটে যাবার পরেও তেমন কিছু ঘটছে না।শুধু শব্দ আগের মতই চলছে।

এবার শব্দের ধরন খানিকটা পাল্টালো। এখন শুনতে পাচ্ছি গাছের ভেঙে পড়ার মটমট শব্দ। নোভ্যালীর সব গাছের গোড়া যেন একসাথে কেটে দেয়া হয়েছে। সব গাছ একটা আরেকটার ওপর ভেঙে পড়ছে। হিংস্র প্রানীদের গলা থেকে বেরুনো শব্দ আর গাছপালার মড়মড় শব্দ কানে তালা লাগিয়ে দিচ্ছে। তার ওপর আমি ঝুলছি উলটো হয়ে। মাথায় রক্ত উঠে যাচ্ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে এটা ভেবে যে তন্ময় যদি গাছপালার নিচে পড়ে যায় অথবা আমার মতই হিংস্র প্রানীর কবলে পড়ে তাহলে অন্তিম সময়ে আমায় ক্ষমা করতে পারবে তো?

এভাবে আর কতক্ষণ? ওডিলি এতকিছুর পরেও যোগাযোগ করেনি আমার সাথে। করবে কিনা তাও নিশ্চিত না। এখন আমাকেই কিছু একটা করতে হবে। ভাগ্য ভালো যে এত ঝামেলার পরেও তলোয়ারটা হাতছাড়া হয়নি।আমার মুঠোর মধ্যেই আছে। শুধু ওর চারপাশের সবুজ আলোকিত রেখাটি নেই বলে অন্ধকারে হাতড়ে অনুমান করতে হচ্ছে। কিন্তু এমনভাবে পেঁচিয়ে আছি যে তললোয়ারটা বিন্দুমাত্র নাড়াতে পারছিনা।বামপায়ের হাটুর ওপর তলোয়ারের ধারালো ফলাটা একপাশ হয়ে পড়ে আছে। আমি যদি বেশী নাড়াচাড়া করি তাহলে বাম হাটু তলোয়ারের আঘাতে কেটে যাবে।

আমি বামহাতের মুঠো দিয়ে তলোয়ার টা আরো শক্ত করে ধরলাম।তারপর শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সেটা নাড়াতে চেষ্টা করলাম। হাটু একটু কাটলে কাটবে। নাহ!তবুও লাভ হচ্ছেনা। আমি যত নড়ছি আমার শরীরে তত পেঁচিয়ে যাচ্ছে সাপের মত প্রানীটি।
হাল ছেড়ে দেবার মত অবস্থা হলো। এভাবে উল্টোভাবে ঝুলতে থাকলে এমনিতেই মরে যাবো। কেউ আক্রমন করার দরকার নেই।
বাঁচার আশা যখন প্রায় ছেড়ে দিয়েছি তখন একটা ডাক আমাকে আবার আশান্বিত করে তুললো। হ্যা!তন্ময় চিৎকার করে ডাকছে আমায়।
“অন্তুউউউউ! কোথায় তুই? এই অন্ধকারে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।আমায় বাঁচা।অন্তুউউউ!” বলে কাঁদতে লাগলো তন্ময়।
আমি ভাবলাম ওকে সাহায্য করতে না পারি অন্তত কথা বলে সান্তনা তো দিতে পারি।
তাই শুরু করলাম।

“আমি আছি তন্ময়। তোর খুব কাছেই আছি। তুই ভাবিস না।আমি আসছি তোর কাছে। ”
তন্ময় একটু সাহস পেলো। যেখানে আমিই ভয় পাচ্ছি সেখানে তন্ময়ে ভয় পাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।
তন্ময় কান্না থামিয়ে ভারী গলায় বললো “কোথায় তুই? আমাকে এই অন্ধকার থেকে দূরে নিয়ে চল। আর পারছিনা!”
“তুই ভয় পাসনা বন্ধু। একটু ধৈর্য ধর। ”

এবার আমার শেষ চেষ্টার পালা। প্রানপনে তলোয়ার টা একহাতে চেপে ধরে নাড়াতে চেষ্টা করলাম। অনেক চেষ্টার পর একটু নাড়াতে পারলাম। শরীরের বাঁধন সামান্য আলগা হয়েছে। এই সুযোগে তলোয়ারের ধারালো অংশটা শরীরে পেচানো বস্তুতে আঘাত হানলো। ঘ্যাচঘ্যাচ শব্দে কেটে যাচ্ছে বাঁধন।উষ্ণ আঠালো তরল বেরিয়ে আসছে লতানো যায়গা থেকে। ওটা নিশ্চয় প্রানীটার রক্ত। বামহাত ভিজে গেছে সেই তরল নিঃসরনে।পেচানো বস্তগুলো কাটতে কাটতে তৃতীবারের মত আরেকটা শব্দ কানে এলো। সেটা জলের ছপছপ শব্দ। তারসাথে সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জনের মত গর্জন! আচমকা বিদ্যুৎ চমকে উঠলো নোভ্যালীতে। সেই অল্প আলোয় দেখলাম এক অদ্ভুত দৃশ্য। তন্ময় আমার থেকে অনেক দূরে মাটিতে দাঁড়িয়ে আছে।ওর চারপাশে জল কলকল করে জল বাড়ছে। আসার সময় দেখেছি নোভ্যালী থেকে খুব বেশী দূরে নয় সমুদ্র।সেই সমুদ্রে জোয়ার এসেছে বোধহয়। সেই জোয়ারের জলে ভেসে যাচ্ছে নোভ্যালী!এমন ও হতে পারে জলোচ্ছ্বাস হচ্ছে সমুদ্রে। সমুদ্র ফুঁসে উঠে তার ঢেউয়ের তোড়ে জল ঢুকিয়ে দিচ্ছে বাগানে। তন্ময়ের বিপদ বেড়ে গেছে শতগুনে। কারন ও সাতার জানেনা। জল যত বাড়বে ওর বিপদ তত বেশী।

আমি উপরের দিকে তাকালাম। আবার বিদ্যুৎ চমকালো।কিছুক্ষন পরপর অন্ধকার আকাশ বিদ্যুতের আলোয় ঝলসে উঠছে। সেই আলোয় আরেকটা অবাক করা দৃশ্য আমায় চমকে দিলো। এতক্ষন যে জিনিসটাকে সাপ মনে করে এসেছি সেটা আসলে গাছের লতা।আর আশেপাশের অন্ধকারে জাজ্বল্যমান চোখগুলি আসলে গাছপালার কোটর নির্গত আলো। প্রশ্ন হচ্ছে ভয়াল শব্দগুলোর উৎস কি?গাছগুলোই কি এতক্ষণ ভয়ের মোহে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো আমাকে?কি অসাধারণ সম্মোহনী ক্ষমতা ওদের।,
এখন সেটা ভাবার সময় নয়। দ্রুত লতাটা কেটে সেটা ধরেই গাছ বেয়ে নিচে নামতে লাগলাম। আধো আলো আধো অন্ধকারে নিচে তাকিয়ে দেখি জলের উচ্চতা বাড়ছে ।তন্ময়ের গলার কাছাকাছি চলে এসেছে জল।ও ভয়ে জমে গেছে। চিৎকার পর্যন্ত করতে পারছেনা বেচারা। আমি নামার গতি বাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু ততক্ষনে জলের তলায় চলে গেছে তন্ময়।নিচে জল আছে তাই তন্ময়কে বাঁচাতে গাছ থেকেই লাফ দিলাম জলে।জলের তলায় গাঢ় অন্ধকার। কিছুই দেখা যায়না স্পষ্ট করে। ঠিক এইমূহুর্তে আমার তলোয়ার আমাকে সহায়তা করলো। সবুজ আলোসহ বাতির মত জ্বলে উঠলো ওটা ।তার আলোয় তন্ময়কে দেখতে পেলাম ।একটু দূরে হাচড়পাচড় করে ডুবে যাচ্ছে ও। আমিও হাত পা নেড়ে এগিয়ে গেলাম ওদিকে ।তন্ময়ের মাথাটা তুলে ধরলাম জলের ওপরে।ও কাশতে লাগলো। নাকে মুখে পানি ঢুকে বেশ নাজেহাল অবস্থা হয়েছে ওর ।এখনো বিপদ কাটেনি। বিশাল বনভূমির মাটির ওপর জলের উদ্ভব হয়েছে। সেই জলে হয়রান অবস্থায় তন্ময় কে নিয়ে ভাসছি আমি।ওদিকে আমার দম ও ফুরিয়ে এসেছে ।আর কতক্ষণ সাঁতরাতে পারবো জানিনা।

তন্ময় আমায় পেয়ে খুশি হয়েছে। এই অন্ধকারেও ওর মুখে আশান্বিত হাসি দেখতে পেয়েছি।
এখন এই ভয়াল বন থেকে বেরুবার পালা। জলের উপরিভাগে ভেসে ডানাগুলো ঝাপটাতে থাকলাম ।ডানা ছাড়া এই বাগান ত্যাগ করা অসম্ভব। ছপছপ আওয়াজ করে ডানাগুলো ঝাপটে যাচ্ছে কিন্তু উপরে উঠতে পারছিনা। বহু চেষ্টার পরেও কাজ হচ্ছেনা।এদিকে জল বেড়ে যাচ্ছে। মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে।তলোয়ার টা মাথার কাছের একটা গাছে শক্ত করে বিঁধিয়ে দিয়ে ওটার ওপর তন্ময়কে নিয়ে খুব সাবধানে দাঁড়ালাম। পা রাখার জায়গা হচ্ছেনা।

তবুও ডানাদুটো নাড়ানোর জন্য ফাঁকা জায়গার প্রয়োজন। এবার ডানা ঝাপটাতেই কাজ হলো।উড়তে পারছি। তলোয়ার টা টান দিয়ে খুলে নিলাম গাছ থেকে। তারপর একহাতে তলোয়ার অন্যহাতে তন্ময়কে নিয়ে উড়াল দিলাম আকাশে। তারপর সমুদ্রের দিকে চোখ পড়তেই নোভ্যালীতে জল বাড়ার কারন বুঝতে পারলাম। জোয়ার চলছে সমুদ্রে। সেই জোয়ারের জলের ঢেউকে আরো উত্তাল করে দিয়েছে কারাজানের কালো ঘোড়ার দল। তারা লড়াই করছে তীরের কাছের জলে। ভারী শরীর নিয়ে একজন আরেকজনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এগিয়ে যেতে যেতে দেখলাম ধারালো দাঁত দিয়ে নিরীহ একটা ঘোড়াকে ছিঁড়েখুঁড়ে খাচ্ছে একটা হিংস্র ঘোড়া!
আর দেরী না করে এখুনি ওদের সুস্থ করে তুলতে হবে। কিন্তু তার জন্য ফল দরকার। পকেটে হাত দিয়ে আৎকে উঠলাম। প্রতিষেধক ফলটি নেই। দুই পকেটের একটাতেও নেই। তন্ময়কে বলাতে ও ঘাবড়ে গেলো।

“এখন উপায়? “বলেই ও আমার ডানার একটা অংশের দিকে হাত দিয়ে বললো “ওটা কি? ”
আমি ডানা বললাম “কোনটা”?
তন্ময় হাত দিয়ে জিনিসটা ডানা থেকে তুলে দেখালো। দেখলাম প্রতিষেধক ফলের একটা থেতলে যাওয়া অংশ ওটা।ফলের এই সামান্য অংশ দিয়ে কি ঘোড়াদের সুস্থ করা যাবে নাকি আবার নোভ্যালীতে ফিরে গিয়ে নতুন ফল সংগ্রহ করতে হবে?নোভ্যালীতে আবার ফেরার কথা আমরা চিন্তাই করতে পারছিনা।

রক্তে ভেসে যাচ্ছে সমুদ্রের তীরবর্তী জল। একটা সদ্যমৃত ঘোড়ার খুবলে খাওয়া লাশ পড়ে রয়েছে তীরের কাছেই। হিংস্র ঘোড়াগুলোর লোভ তখনো কমেনি। তারা তাদের স্বজাতি কে দ্বিতীয়বার আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। ওদের ঘাড়ের নানা রঙের কেশর বারবার ফুলে ফেঁপে উঠছে। রক্তের নেশা বড় নেশা।নিরীহ ঘোড়াগুলো সেই নেশার কবলে পড়েছে ।আর তার শিকার হচ্ছে কারাজানের বিশালাকার সাধারন ঘোটক সম্প্রদায় ।আমি আর তন্ময় আকাশে ভাসমান অবস্থায় দেখছি রক্তপাতের এই খেলা। আর সহ্য হচ্ছেনা।

হাতে থেঁতলে যাওয়া প্রতিষেধক ফলের টুকরো । সেটা নিয়েই কাজে নামতে হবে ।তন্ময়কে যে নিরাপদ কোন জায়গায় রেখে যাবো তার উপায় নেই। চারদিকে থইথই করছে জল। তার ওপর ও সাঁঁতার জানেনা ।বিপদ আসার সময় দলবল নিয়েই আসে ।আমাকেও বিপদের মোকাবেলা করতে হবে দলবল নিয়েই। তন্ময়কে সঙ্গে নিয়েই অংশগ্রহণ করতে হবে সম্মুখযুদ্ধে।আর সময় নেই। আরো দুচারটে নিরপরাধ ঘোড়া আক্রমনের শিকার হবার আগেই প্রতিষেধক ফলের টুকরো আর ভায়োলেট হিলিং টাচ মিশিয়ে বুলিয়ে দিতে হবে বিকৃতমস্তিষ্ক ঘোড়াদের কপালে ।তন্ময় কে জিজ্ঞেস করতে হলোনা। ও রাজী। সাহস সঞ্চয় করে ফেলেছে ইতিমধ্যে।

যুদ্ধের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ডানহাতে ভায়োলেট হিলিং টাচ জ্বালিয়ে দিলাম। এখন আমি হিলিং টাচ নিয়ন্ত্রণ করতে শিখে গেছি। তাই অসুবিধে হলোনা।ফলের টুকরো টা হাতে রেখে মুঠো বন্ধ করলাম। তলোয়ারটাকেও একই হাতে নিয়ে অন্যহাতে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরলাম তন্ময় কে। তারপর ডানা মেলে দিলাম সমুদ্রে যেখানে ঘোড়াদের লড়াই হচ্ছে সেইদিকে।

মানুষ দেখে ঘোড়াগুলো কিছুক্ষনের জন্য থামলো। তারপর ক্রোধিত হিংস্র দৃষ্টিতে তাকালো আমাদের দিকে। বুঝলাম এরা আমাদের বোঝানোর সুযোগ দেবেনা। সরাসরি আক্রমণ করবে। আমিও তলোয়ার মুঠ করে প্রস্তুত হয়ে আছি। আহত হবার সম্ভাবনা না থাকলে আঘাত করবোনা। নিরীহ ঘোড়াগুলোর দিকে তাকিয়ে বোঝালাম আমরা সাহায্য করতে এসেছি। ওদের তুলনায় আমরা অনেক ছোট। অনেকটা নীল তিমির তুলনায় সীলমাছ যেমন ছোট হয় তেমন।

আমার ইশারা ওরা বুঝতে পারলো কিনা কে জানে তবে কি যেন মনে করে পিছিয়ে গেলো। হিংস্র ঘোড়ার দল পদভারে জলে আলোড়ন তুলে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে।গুনে দেখলাম চারটে।তাদের চোখ লাল। সেই চোখজোড়া দেখলেই ভয়ে আত্মা শুকিয়ে যায়। বড় বড় ধারালো তীক্ষ্ণ দাঁত দেখলে ভয় বেড়ে যায় দ্বিগুন। তন্ময় ভয়ে কাঁপছে কিন্তু বুঝতে দিচ্ছেনা যে ও ভীত। আমিও ভয় লুকাচ্ছি।

প্রথমেই চারটা ঘোড়ার একটা সামনের পা দুটো তুলে মুখ দিয়ে চিঁহি শব্দ করে একলাফে প্রায় আমাদের ওপরে এসে পড়লো।ওর খুরের তলার জলে আমাদের ডুবিয়ে মারার ইচ্ছা! ঘোড়ার আক্রমণ ঠেকাতে ডানা ঝাপটে সুড়ুত করে এককাত হয়ে সরে এলাম। কিন্তু তন্ময় পিছলে পড়লো জলে। ও সম্পূর্ণ ডুবে যাওয়ার আগেই হাত ধরে তুলতে হলো। তেমন সমস্যা হয়নি। একটুর জন্য বেঁচে গেছি দুজনেই।

বাকি তিনটে ঘোড়াও একইসাথে এগিয়ে এলো আমাদের আহত করবার জন্য। দিশেহারা ভাবে একদিকে ছুটে গেলাম ভেজা তন্ময়কে নিয়ে। ওকে নিয়ে যুদ্ধ করাটা কঠিন। যেখানে নিজেদের বাঁচাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে সেখানে আক্রমণ করবো কিভাবে?

তন্ময় বুঝতে পেরেছিলো ব্যপার টা। ও একটা বুদ্ধি বাতলে দিলো তখন। বললো “আমাকে ঐ অক্ষতিকর ঘোড়াগুলোর পিঠে বসিয়ে দিয়ে আসতে পারবি? আমি ওখানে থাকলে তোর এদিকটা সামলাতে সুবিধা হবে। তাড়াতাড়ি। ”

“তুই ভয় পাবিনা তো? ওদের পিঠে বসালে ওরাই বা মেনে নেবে কেন?তোর ওজন বেশী নয় কিন্তু তোকে বা আমাকে তো ঘোড়াগুলো চেনেনা। যদি শত্রু ভেবে বসে?তখন বিপদ আরো বাড়বে। ”
এই কথোপকথনের সময় ও দু একবার ঘোড়াগুলোর আক্রমনের শিকার হয়েছি। কিন্তু ঈশ্বরের কৃপায় বেঁচেও গেছি।

এই ডক্টর গ্রিফিনো লাইফের বিভিন্ন স্তরে আমাকে বারবার বিস্মিত হতে হয়েছে। হয়তো অদূর ভবিষ্যতেও হতে হবে। কিন্তু এবারের মত অবাক আর হবো কিনা সেই নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। কারন পেছনের নিরীহ ঘোড়াগুলোর মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে কিছু কথা।

তারা কিছু বলতে চাইছে আমাকে। তাদের মুখ নড়ছে, শব্দ বেরুচ্ছে কিন্তু ভাষার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছিনা।

তাদের মুখ নিঃসৃত ভাষার কোন না কোন মানে আছে। সেটা বোঝাটা এই পরিস্থিতিতে খুবই দরকারি। কিন্তু বুঝতে পারছিনা। এই মুহূর্তে একজন দোভাষী দরকার যে আমার আর ঘোড়াগুলোর মধ্যকার ভাব বিনিময় করিয়ে দেবে। ওডিলি কি সেই দায়িত্ব নেবে? কারন ও শুরুতেই বলেছিলো কথা বলা ঘোড়ার শহর এই কারাজান। এতক্ষনে মনে পড়েছে কথাটা।

জোরে চিৎকার দিয়ে ডাকলাম “ওডিলি!আমায় শুনতে পাচ্ছো?তোমার সহায়তা কামনা করছি হে ভীনগ্রহের বন্ধু। ”

কয়েক মুহূর্ত কেটে গেলো। ওডিলির পাত্তা নেই। ইতিমধ্যে আরো বেশ কয়েকবার আক্রান্ত হয়েছি হিংস্র ঘোড়াগুলোর দ্বারা। আর বেশীক্ষণ তাদের আটকে রাখা যাবেনা।পিঠে ডানা থাকায় বারবার বেঁচে যাচ্ছি কিন্তু তন্ময়কে নিয়ে উড়তে গিয়ে কষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া আমি সরে যাওয়া মাত্র সুযোগ বুঝে সাধারণ ঘোড়াদের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে শত্রু ঘোড়ার দল। এরকম দ্বিমুখী সমস্যায় এর আগে পড়িনি। হাল ছেড়ে দেবার কথা ভাবতে পারছিনা। কারাজানে যেহেতু এসেছি ঘোড়াগুলোর সমস্যার সমাধান না করে যাবোনা।ওদিকে নিরীহ ঘোড়াগুলোর পাশাপাশি হিংস্র ঘোড়াগুলোও ক্রমাগত কি যেন বলছে। ভাষার ধরন এক। কিন্তু আগের মতই অর্থ অস্পষ্ট। শুধু বুঝতে পারছি হিংস্র ঘোড়াগুলো নিরীহ ঘোড়াদের শাসাচ্ছে। আর নিরীহ ঘোড়াগুলো আমাদের কিছু বলার চেষ্টা করছে। এই চেষ্টা তখনি সার্থক হবে যখন আমি এর অর্থ বুঝবো। হতাশায় বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। তন্ময় হা করে দুইদল ঘোড়ার অর্থহীন কথোপকথন শুনছে। ব্যপারটা ওর জন্য কেন আমার জন্যেও একেবারেই নতুন।

হঠাৎ মাথার ভেতর একটা ঝনঝনে গলার আওয়াজ আমাকে আশান্বিত করে দিলো।
ওডিলি ফিরেছে। টেলিপ্যাথিক যোগাযোগ স্থাপন করার চেষ্টা করছে আমার সাথে।
“দেরীতে যোগাযোগ করার জন্য ক্ষমা চাচ্ছি ডক্টর। আপনার সমস্যার সমাধান খুঁজতে দেরী হয়ে গেলো। আপনি দ্রুত আপনার ডানা থেকে একটা পালক খুলে নিয়ে হাতে রাখুন। তাহলে ঘোড়াগুলোর কথার মানে বুঝতে পারবেন।ওরা আপনার সাহায্যপ্রার্থী। ”

আর সময় নষ্ট না করে হ্যাচকা টানে পিঠের ডানা থেকে ছিঁড়ে নিলাম একটা পালক।হাতে আসার পর সাদা পালকের রঙ বদলে নীল হয়ে গেলো। আর সঙ্গে সঙ্গে কানে স্পষ্ট বাংলায় ভেসে এলো কিছু কথা।
নিরীহ ঘোড়াটা বলছে” আপনি কি আমার কথা বুঝতে পারছেন? আমি ফ্রিজল বলছি। আপনি আপনার সহযোগীকে আমার দায়িত্বে রেখে যান ডক্টর। নইলে কারাজানের শয়তান রাজা একর্নের সঙ্গে পেরে উঠবেন না। আমরা আপনার বন্ধুর খেয়াল রাখবো। ”

বাহ!চমৎকার। এরা আমার পরিচয় জানে। ওদের পরিচয়টাও জানলাম। সব দুস্কর্মের হোতা তাহলে এই একর্ন ।যে কিনা কারাজানের ঘোড়াদের রাজা। এখন চিনতে পারছি। এই ঘোড়াটাই সমুদ্রপথে আমাদের নিয়ে এসেছে কারাজানে। কিন্তু ও যদি খারাপ ই হবে তাহলে নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনলো কেন?এর পিছে রহস্য কি?

ফ্রিজল বললো “সব ঐ ফলের দোষ ডক্টর ।একর্ন আগে প্রজাবৎসল একজন রাজা ছিলো। কিন্তু ঐ বিষাক্ত ফলের প্রভাবে সব ওলটপালট হয়ে গেছে। ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। নইলে নিজের ভাইয়ের ওপর কেউ আক্রমন করে? আপনি ওকে সুস্থ করে দিন ডক্টর। দয়া করে ওর কোন ক্ষতি করবেন না। ”

“তুমি ওর ভাই?আর তোমাদের দলের বাকি তিনজন কারা?”
“ওরা সাধারণ প্রজা। মৃত্যুভয়ে আমাদের সাথে যোগ দিয়েছে। ডক্টর সাবধান! পিছনে দেখুন!”
বলে লাফ দিয়ে আমার পেছনে এসে দাঁড়ালো। আর একর্নের এক ধাক্কায় মারাত্মক আহত হয়ে জলে পড়ে গেলো।

দেখলাম একর্ন দলবল নিয়ে এগিয়ে আসছে আমাদের ই দিকে।এখন ওদের চোখ আগের চেয়ে বেশী লাল। রাগে ফুঁসছে সবাই।

ক্রোধভরে বলছে “আমার নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই ডক্টর। আমরা বুঝতে পারছি সব ফলের বিষক্রিয়ার পরিণাম। কিন্তু কাচা মাংসের লোভ ছাড়তে পারছিনা। আপনি ভালোয় ভালোয় সরে যান। নইলে মরতে হবে আপনাদের সবাইকে। মানুষের মাংস নিশ্চই আরো সুস্বাদু হবে?নিজের ভাই ফ্রিজলকে ছাড়িনি, আপনিও রেহাই পাবেন না ।”

“তোমাদের সুস্থ করার উদ্দেশে এসেছি একর্ন। আমার কথা শোন। তোমাদের মাথা এগিয়ে নিয়ে এসো আমার ডান হাতের কাছে। দেখবে সব সমস্যা দূর হয়ে গেছে। ফ্রিজল তোমার ভাই ।ওকে মেরে ফেললে তোমার ই কষ্ট হবে ।”
” নাহ!আমি সুস্থ হতে চাইনা ডক্টর। রক্তের এই নেশা আমাদের পেয়ে বসেছে ।এই দুনির্বার লোভাতুর অনুভূতির দাস আমরা। কোনদিন ই আগের মত বিরক্তিকর জীবনে ফিরে যাবোনা আর।হত্যা করার মধ্যেও একটা আকর্ষণ আছে ডক্টর! মৃতপ্রায় ঘোড়াগুলো যখন যন্ত্রনায় ছটফট করে তখন মনটা পৈশাচিক আনন্দে ভরে ওঠে। ”

বলেই আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কামড় বসালো ঘাড়ে। আমি একটু সরে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম।তবুও ওর উপরের পাটির তিনটে দাঁত ছুরির মতো বসে গিয়েছিলো ঘাড়ের মাংসে। প্রচন্ড যন্ত্রনায় মুখ বিকৃত করে আমি পড়ে গেলাম জলে ।তন্ময় ছিটকে পড়লো একপাশে। ঝপাস করে শব্দ হলো।

জলের তলায় ধীরেধীরে ডুবে যাচ্ছি আমি। ঘাড় থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছে ।সেই রক্তে লাল হয়ে উঠছে সমুদ্রের নীলচে জল। আমি হয়তো মরে যাবো। তন্ময়কে একটা মাংসাশী ঘোড়ার কবলে ফেলে আমি মরেও শান্তি পাবোনা ।কিন্তু আর বোধহয় উপায় নেই। জলের উপরিভাগে হুটোপুটি হচ্ছে ।তন্ময়ের চিৎকার শুনতে পেলাম। একর্ন কি এরইমধ্যে ওকে আক্রমণ করে বসেছে ।কিন্তু ওর ও তো ডুবে যাওয়ার কথা। নাকি ফ্রিজল বাঁচিয়েছে ওকে? তাই যেন হয়।ওকে তুমি রক্ষা করো প্রভু।

নিজের শেষ পরিনতি এতো ভয়ানক যন্ত্রণাদায়ক হবে ভাবিনি ।ঘাড়ের রক্ত গলগল করে বেরিয়ে মিশ্রিত হচ্ছে জলে ।কিন্তু একেবারে মিশে যাচ্ছেনা। শরীর অবশ,চোখ বন্ধ হয়ে আসছে আর আমি অচেতনপ্রায় অবস্থায় দেখছি আমার রক্ত জলে না মিশে একটা বড় রক্তপিন্ডের মত আকার নিচ্ছে ।

দম সম্পূর্ন ফুরিয়ে যাবার আগেই দেখলাম অসাধারণ এক দৃশ্য। যা এই চরম দুর্দশার মুহূর্তেও ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা ফুটিয়ে দিলো।

সেই রক্তপিন্ড বড় হতে হতে একটা প্রানীর আকার নিলো ।এই প্রানী আমার পরিচিত। আমার বহু যুগের সঙ্গী, পোষা প্রানী গ্রিফিনো!পরিপূর্ণ আকারে আসতেই ও আমার পিঠে ধাক্কা দিয়ে জলের ওপরে ভাসিয়ে তুললো। ঘাড়ের ব্যথা কমেনি কিন্তু বুকভরে বাতাস নিতে পারছি। চারদিকে তাকিয়ে দেখি ফ্রিজল তন্ময় কে কাধে নিয়ে ওর অনুচরদের নিয়ে প্রানপনে ছুটছে ।একর্ন ওর হিংস্র সাথিদের নিয়ে ধাওয়া করছে ওদের। তন্ময় সুস্থ আছে দেখে নিশ্চিত হলাম। কিন্তু একর্নের হাত থেকে এখনো নিরাপদে যেতে পারেনি ফ্রিজল বাহিনী।

গ্রিফিনো এক ঝটকায় আমাকে জল থেকে শুন্যে ছুড়ে দিলো। তার পর নিজে উড়ে এসে আমায় পিঠের ওপর বসালো। আমার ঘাড়ের সদ্যপ্রাপ্ত ব্যথা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। ডানহাতের দিকে তাকিয়ে দেখি ভায়োলেট হিলিং টাচ কাজ করছে। দ্রুত সেই হাত ঘাড়ে চেপে ধরলাম। ব্যাথায় আড়ষ্ট হয়ে গেলো সমস্ত শরীর। তারপর ধীরে ধীরে কমতে লাগলো ব্যথা। ডানাদুটোও সচল হলো খানিকবাদে।

একর্নের ওপর ভয়াবহ রেগে আছি আমি। ও প্রচন্ড জেদি ।ফলের বিষক্রিয়া ওকে পুরোপুরি পাগল করে দিয়েছে।ওকে সুস্থ করার জন্য ফলের টুকরো আর তলোয়ার আর কথা বলার জন্য ডানার পালক এই তিনটেই হারিয়েছি আমি। হয়তো ডুবে যাওয়ার সময় হাত ফসকে পড়ে গেছে সব। তবুও গ্রিফিনো যখন সাথে আছে তখন ভয় নেই। কোন একটা সমাধান পাবোই। অনেকদিন পর গ্রিফিনোকে সশরীরে পেয়েছি। ও কেন এলো কিভাবে এলো তার কিছুই জানতে চাইনা। পরম স্নেহে ওর ঘাড়ের লোমশ কেশর বুলিয়ে দিয়ে গলাটা জড়িয়ে ধরলাম। ও গলা দিয়ে মৃদু ঘড়ঘড় শব্দ বের করতে লাগলো ।আমি তখনো খেয়াল করিনি ওর আকার ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগে ওর গলা জড়িয়ে ধরতে সমস্যা হতোনা। কিন্তু এখন নাগাল পাচ্ছিনা।

মাথা তুলে অবাক দৃষ্টিতে দেখি গ্রিফিনো বড় হতে হতে কারাজানের ঘোড়াদের সমান আকার নিয়েছে। এবার লড়াই হবে সমানে সমানে।

একর্নকে উচিত শিক্ষা দিতে হবে। তন্ময় আর ফ্রিজল বাহিনীকে রক্ষা করতে হবে। একাজ অল্প সময়ের মধ্যেই সারতে হবে। গ্রিফিনো কে ইশারা দিতেই ঈগলের মত বিকট চিৎকার করে ও ফ্রিজলদের কাছাকাছি চলে এলো। তন্ময় কে নিয়ে দৌড়ানো অবস্থাতেই ফ্রিজল ওপরে তাকিয়ে একবার দেখে নিলো আমায়। তন্ময় ও আওয়াজ শুনে তাকিয়েছে। আর আনন্দে ভরে উঠেছে ওর মুখ। একর্ন ও কর্কশ চিঁহি শব্দ করে তাকিয়ে দেখে নিয়েছে আমাদের। গ্রিফিনোর বিকট রুপ দেখে ওর সঙ্গীরা ভয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু একর্ন থামবার পাত্র নয়। ও ফ্রিজল দের ধাওয়া করেই যাচ্ছে।

তন্ময়ের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখি এক অবাক কান্ড। আমার তলোয়ার আর ফলের টুকরোটা শোভা পাচ্ছে ওর হাতে। ওগুলো হারায়নি তাহলে। আমি ওদের আরো কাছে গিয়ে তন্ময় এর হাত তুলে নিলাম তলোয়ার আর ফলের টুকরো। তারপর একলাফ দিয়ে ডানা মেলে ধরে সোজা চলে গেলাম ভীত থমকে পড়া ঘোড়াদের কাছে। ওরা ভয়ে মাথা নুইয়ে রেখেছে। এই সুযোগে ওদের মাথায় কিছুক্ষনের জন্য ভায়োলেট হিলিং টাচযুক্ত ফল রাখলাম।তারপর ফলের টুকরো নিয়ে আবার ফিরে এলাম গ্রিফিনোর পিঠে।নিচের ঘোড়াগুলো নড়াচড়া করলো না। কয়েক ঘন্টার মধ্যে ওদের রক্তপিপাসা মিটে যাবে আশা করি।

এবার পালের গোদা একর্নের পালা। গ্রিফিনোকে ইশারা দেয়ার সাথে সাথে ও প্রচন্ড বেগে উড়ে গিয়ে একর্নের পেটে একটা জোরসে ধাক্কা মারলো। একর্ন টাল সামলাতে না পেরে ঝপ করে জলের মধ্যে উল্টে পড়লো। আর আমি গ্রিফিনোর পিঠ থেকে তলোয়ারটা নিয়ে একলাফে গিয়ে পড়লাম একর্নের গলার ওপর। তারপর তলোয়ারটা ওর গলায় আমূলে বিদ্ধ করে দিলাম।

একর্নকে মেরে ফেলা আমার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু তলোয়ারের এই আঘাত ওর ঔদ্ধত্য আর বেপরোয়া ভাবটা কমিয়ে দেবে।এখন শান্তিমত ওর চিকিৎসা করা যাবে। ও পরিপূর্ণ সুস্থ হবার আগপর্যন্ত খেয়াল রাখতে হবে।

তারপরের ঘটনা খুবই সংক্ষিপ্ত। প্রায় চার ঘন্টা পর যখন সন্ধ্যা হলো তখন কারাজানে উৎসবের বাতি জ্বলে উঠেছে। কারন আমার হিলিং টাচ আর নোভ্যালীর প্রতিষেধক ফলের গুনে সকল কারজানবাসী মাংসাশী ঘোড়া সুস্থ ও স্বাভাবিক হয়ে গেছে। চারদিকে আনন্দের ছড়াছড়ি। একর্ন আর ফ্রিজল দুই ভাই আমাদের বারবার ধন্যবাদ জানিয়েছে। নিজেদের ভুলের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করেছে। উৎসবমুখর পরিবেশ জমে উঠেছে।

সেই উৎসবের প্রধান অতিথি আমি তন্ময় আর গ্রিফিনো।
গ্রিফিনো আগের ছোট রূপে ফিরে এসেছে। আমার চারপাশে ঘুরঘুর করতে করতে উৎসবের আনন্দ উপভোগ করছে। ওর সাথে তন্ময় এর পরিচয় করিয়ে দিতেই ওকে আকাশে একচক্কর ঘুরিয়ে এনেছে।
আরো একটা মজার কান্ড ঘটেছে। কিছুক্ষন হলো ওডিলি ওর পিরামিডরুপী নভোযান থেকে নেমে উৎসবে যোগ দিয়েছে। অভিমানের সুরে আমায় বললো “এই উৎসব তো আমারো উৎসব তাইনা ডক্টর? ”

আমি আর তন্ময় জবাবে হেসেছি।
তন্ময় এই অভিযানে এসে সব কিছু দেখে নিয়েছে। আমার সম্পর্কে জানার আগ্রহ আর কোনদিন কমবেনা ওর। আমার ডক্টর গ্রিফিনো লাইফের দ্বিতীয় অভিযান অপ্রত্যাশিত হলেও কম রোমাঞ্চকর নয়।

কক্সবাজারে দুই বন্ধু এসেছিলাম ঘুরতে। কারাজানে এসে পড়ায় তারচেয়ে অনেক বেশী আনন্দ পেয়েছি। তন্ময়ের কাছে এই কারাজানের জগত অতি পছন্দনীয় জগতে পরিণত হয়েছে অল্প সময়ের মধ্যেই। ও চাইছে আরো কয়দিন যেন আমরা এখানে থেকে যাই।আমি সানন্দে রাজি হলাম। এখানে কিছুদিন থাকলে সমস্যা নেই। কারন এখানকার সময় পৃথিবীর সময়ের থেকে আলাদা। সাধারণ পৃথিবীতে ফিরে গেলে আমরা ঠিক সেই সময়ে ফিরে যাবো যেসময় কারাজানে এসেছিলাম।

রাত গভীর হতে থাকলো। হঠাৎ কারাজানের রাজা একর্ন আমাদের ডেকে নিয়ে গেলো মূল অনুষ্ঠানের জায়গায়,একটা উঁচু বেদীর ওপর । আমি, তন্ময়, গ্রিফিনো আর ওডিলি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের সামনে খোলা একটা মাঠের মত জায়গা। সেখানে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় শখানেক ঘোড়া।

আমরা গিয়ে দাঁড়াতেই রাজার ভাই ফ্রিজল দু পা সামনে উঁচিয়ে চিঁহি শব্দে ডেকে উঠলো। আর সঙ্গে সঙ্গে মাঠের ঘোড়াগুলো সমস্বরে ডেকে উঠলো আর সশব্দে বলতে লাগলো
“জয় ডক্টর গ্রিফিনোর জয়! ”
ওদের দেখাদেখি তন্ময় আর ওডিলি ও বলে উঠলো
“জয় ডক্টর গ্রিফিনোর জয়! ”

গ্রিফিনোই বা আর বাদ থাকবে কেন?ও উড়ে গিয়ে আকাশ থেকে একটা ঈগলের মত অহংকারী ডাক দিলো। সেই ডাক গুঞ্জরিত হতে লাগলো পুরো কারাজান জুড়ে।
আমি শুধু মুচকি হাসলাম। তৃপ্তির হাসি হাসা দোষের কিছু নয়।

…………………………………………………………………….(সমাপ্ত)………………………………………………………..

গল্পের বিষয়:
ফ্যান্টাসি
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত