১৩তম জন্মদিনে

১৩তম জন্মদিনে

রাত বারোটা নাগাদ, ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করছে, শেষবার পেন্ডুলামটি ঢুলে ঘণ্টা বাজাল, জোরে ডিং-ডিং শব্দ করে; সবাইকে জানালো যে এখন মধ্যরাত ১২টা ছুঁইছুঁই।

‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ, হ্যাপি বার্থডে ডিয়ার অপু, মে ইউ লিভ লং, হ্যাপি বার্থডে টু ইউ।’ এক ঝাঁক তালির গুঞ্জন।
অপু চোখ কচলাতে-কচলাতে, নিভু আলোয় অস্পষ্ট ভাবে দেখল, ওর রুমে বেড়ের চারিদিকে সবাই ঘিরে আছে; ওর আব্বু -আম্মু, দাদা, ছোট বোন অর্নি আর সামনে চকো-রেড বেরি ফ্লেভার্ড আইসকেক। তাতে পেঁচার চোখের মতো বড়-বড় করে লেখা, ‘হ্যাপি থার্টিনথ বার্থডে টু অপু। তার উপর ১৩ টি মোমবাতি। সবকটি ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিল সে, কেক কেটে প্রথমে আব্বুকে তারপর আম্মুকে, দাদু, অর্নি সবাইকে খাওয়ালো। অপুর মা অপুর কপালে স্নেহের চিহ্ন এঁকে দিলেন। এরপর সবাই শুভরাত্রি বলে যে যার রুমে চলে গেল।

অপু ওর মায়ের হাত পিছন থেকে টেনে ধরল শক্ত করে, ‘আম্মু আজকে তুমি আমার সাথে ঘুমাও, আমার খুব ভয় করছে।’ অপুর আম্মু ওর পাশে এসে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘বোকা ছেলেটি আমার! কিসের ভয়? তুমি তো কখনো ভয় পাও না, আমার লক্ষ্মী হিরো ছেলেটি, এবার ঘুমিয়ে পড়, হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠায় এমন লাগছে।’
অপু মায়ের স্নেহ-ঝরা কথার উপর আর কিছু বলতে পারল না। অপুর হাত ছাড়িয়ে, মিসেস নিম্মি, অপুর মা, চলে গেলেন রুম থেকে, আর অপু উনার চলে যাওয়া দেখতে লাগল।

অপুর মনে ভীষণ ভয়, এক অদ্ভুত অজানা ভয়, কি যেন এক শঙ্কা, কেমন জানি এক দুর্বলতা, যা ওকে বারবার বারণ করছে ঘুমাতে। বারবার যেন দেয়াল চিরে একটি অট্টহাসি ওর কানে বাজছে, যেটি বলছে, ‘ঘুমিও না, ঘুমিও না।’ অপু ঘেমে যায়। তারপরও কাঁথা মুড়ে শক্ত করে বালিশ জড়িয়ে ঘুমাতে চেষ্টা করে। দুয়েক মিনিট পর ও স্বাভাবিক হয়ে যায়। এক ঘোরলাগা ঘুমে হারিয়ে যায়।

অপু হাঁটতে থাকে, হাঁটতে থাকে অনেকদূর। কুয়াশায় ডাকা অন্ধকার পথ। সামনে একটি অশ্বত্থ গাছ, এমন ঘন কালো রাতে কাক কা-কা করে শোঁ করে মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল। অশুভ সংকেত। বুকে দুরুদুরু করছে, তবুও পা থামছে না অপুর। ঘামে ভিজে গেছে পুরো শরীর, কপালে বারবার করে জমে উঠা বিন্দু-বিন্দু জল সে হাত দিয়ে মুছতে লাগল। কণ্ঠদেশ শুকিয়ে গেছে। খুব পানির তেষ্টা পেয়েছে, সে হন্যে হয়ে পানির সন্ধান করতে লাগল।

এঁকে-বেঁকে যাওয়া পথ, অদ্ভুত বিষয় হলো পথের দুধারে কেবল সাইকাস গাছ। এ গাছ তো বড় দুর্লভ। তারচেয়ে বড় কথা হাজারে দুয়েকটা দেখা যায়, আর সে জায়গায় আধার-কালো জংগলে কেবলই সাইকাস! অপু মনে-মনে ভাবতে লাগল কোন জায়গায় সে এসে পড়ল! না, এটা ওর চির চেনা বাসা নয়, স্কুল নয়, স্কুল থেকে ফেরার পথের আইসক্রিম পার্লার নয়, চিরপরিচিত সেলুন নয়, যেখানে প্রতি শুক্রবার ওর বাবা ওকে নিয়ে যায়। এটি ওর প্রিয় বান্ধবী মিতার বাসাও না, বিকালে ফুটবল খেলার মাঠও না, দাদু বাড়ির সবুজ ঘাস-ওয়ালা ধানক্ষেত না; তাহলে কোথায় সে? চেনার গণ্ডি পেরিয়ে কোন অচিন-পুরে এসে পড়ছে অপু?

লাফিয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়ছে সে। ঢকঢক করে পাশের টেবিলে গ্লাসে রাখা পানি সবটুকু খেয়ে ফেলল। জোরে নিশ্বাস নিতে থাকল। বুঝল আজও আবার সে ওই স্বপ্নটি দেখেছে। অপুর চেতন-অচেতন জগতে ভয়ের সাড়া জাগানো দুঃস্বপ্নটি যেটা ও প্রতি জন্মদিনে মধ্যরাতে দেখে। হ্যাঁ, বছরের ৩৬৫ দিনের এই দিনে অর্থাৎ ২৯ শে আগস্ট সে দুঃস্বপ্নটি দেখে মধ্যরাতে ঠিক বারোটার পরে। অপু ওর চিরচেনা এদিনে এক অচেনা জায়গা দেখে। সে আঁতকে উঠে ঐ স্বপ্নটি, ঐ স্থানের কথা ভেবে- কি ভয়ংকর, এঁকে-বেঁকে চলা অনুন্নত মেঠো পথ, তার দুদিকে সাইকাস গাছের সারি, সামনে ঘন কালো অন্ধকার কুয়াশার চাঁদর লেপটানো। বাঁকা চাঁদ মুখ বাঁকা করে অশুভ কিছুর জানান দিচ্ছে। তারপর, সে মরণোত্তর তৃষ্ণার কথা ভেবে আঁতকে উঠে। তৃষ্ণার্ত হয়ে চারিদিকে পানি খুঁজে, কিন্তু পানির ঠিকানা কোথাও পায় না।

‘অপু, এই অপু, উঠ ঘুম থেকে ফ্লোরে শুয়েছিস কেন?’
অপু ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভাংতে-ভাংতে দেখে সে ফ্লোরে বসে আছে। কালো রাতের কথা ভাবতে লাগল, হয়ত স্বপ্নের ঘোরেই সে এখানে এসে পড়েছে, হয়ত বা অন্য কিছু!

অপু ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং রুমে আসল। আজ নাস্তায় মিসেস নিম্মি অপুর সব প্রিয় খাবার তৈরি করেছেন। মেনুতে আছে, চিংড়ির চিজি মোমো, টক দই আর পুদিনার সস, নারকেল এর চিড়া আর দুধের ফিরনি। এর থেকে ভালো দিন আর কখন হতে পারে! অপু মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আম্মু তুমি প্রতিদিন এগুলা তৈরি করতে পারো না?’
মা ছেলের কপালে চুমু খেয়ে বললেন, ‘প্রতিদিন যদি তৈরি করতাম তবে আমার ছেলেটি এভাবে জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ জানাত না।’ অপু অভিমানী চোখে মায়ের দিকে তাকাল। এরপর সবাই নাস্তা সেরে যে যার কাজে চলে গেল। অপুর আব্বু অপু আর অর্নিকে নিয়ে স্কুলে যাবে, ঠিক ঔই মুহূর্তে দাদু অপুকে বুকের কাছে টেনে এনে বলল, ‘বাবা, সাবধানে থাকিস, তোকে নিয়ে আজ বড় একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি।’
‘কি দুঃস্বপ্ন দেখেছ দাদু?’
‘দেখলাম, তুই হারিয়ে গেছিস।’

‘রাখো তো তুমি বাবা, ও ভয় পাবে। এতটুকু বাচ্চা ছেলেকে এগুলো বোলো না,’ অপুর আম্মু মাঝখানে রাগতস্বরে বললেন। অপু অসহায়ভাবে ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে ভাবে, ‘মা, তুমি তো আর জান না যে, আমি কতবার এমন দুঃস্বপ্ন দেখেছি। তোমাকে তো আর বলা হলো না আমার মনের কথা।’

অপু দাদু আর আম্মুকে বাই বলে গাড়িতে চলে আসলো। অপুর বাবা রতন সিদ্দিক নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করেন। অপু বিষন্নভাবে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে। ও দেখতে লাগল একের পর এক ফেলে আসা ঘর, একটার পর একটা উঁচু-উঁচু এপার্টমেন্ট বিল্ডিং কিন্তু মাঝে-মাঝে দুয়েকটা সবুজের চিহ্ন! আর ষ্টেশনারী দোকানগুলো, কই কোথাও তো সাইকাস নেই, কোথাও তো একটুও ফাঁক নেই, রাস্তাও পিচ-ঢালা; তাহলে স্বপ্নে কি সে অন্য-ভুবনে চলে যায়?
গাড়ি ব্র্যাক করল। অপু আর অর্নির স্কুল এসে পড়েছে, তাই দুজনেই গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। ইতিমধ্যে স্কুলের ঘণ্টা বেজে গেছে, ১ম পিরিয়ড শুরু হওয়ার প্রারম্ভে। ক্লাস নিচ্ছেন, মিসেস পামেলা রয়। যেমন নাম তেমনি ভাব। উনি পড়ানোর সময় খোলা পেট আর বুক দেখা যায়। সবাই সেদিক চেয়ে হাসাহাসি করে। একদিন উনি ক্লাসের একজনকে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিরে, কি ব্যাপার? এত হাসি কেন? পড়া মনে হয় বেশি পারিস? দেখি বল, ১৫৪৩ এর চেয়ে ৫০০ গুন বড় সংখ্যা কোনটি? উনি ইচ্ছাকৃত এত কঠিন প্রশ্ন করলেন। গো বেচারা রিদম ফাঁসলো ভালো করে, এর উত্তর ওর জানা নেই। কাঁদো-কাঁদো মুখ করে বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।
‘পড়া পারিস না আর বই খোলা রেখে দাঁত কেলিয়ে হাসছিস স্টুপিড (সবাইকে স্টুপিড বলা উনার হবি)? কি দেখে এত হাসছিস, শুনি?’
রিদম নিচুস্বরে বলল, ‘ম্যাডাম, বুক খোলা (মার ছুট)।’
ম্যাডাম তাচ্ছিল্যে ভরে বললেন, ‘হ্যাঁ জানি, বুক খোলা! বুকস শুড বি ওপেন্ড ইন মাই ক্লাস।’
ক্লাসে হাসির রোল পড়ে গেল, সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।

আজও যথারীতি ম্যাডামের নাভির নিচে শাড়ি আর বুকের একপাশ খালি, কোনোরকম শাড়ি ঝুলিয়েছেন তার হট বডিতে। স্টুডেন্টদের অভ্যাস হয়ে গেছে ম্যাডামকে এমন দেখতে-দেখতে। আর পিচ্চি বাচ্চাগুলো এগুলোর বুঝেই বা কি! এখানে তো ম্যাডাম শাড়ি একপাশে ঝুলিয়ে রাখলেও সমস্যা নেই, কিন্তু নবম-দশম শ্রেণির ছাত্রদের কাছে যে এটি ব্যাপক বিনোদন, বিনা টিকিটের সিনেমা, তা ওরা আরেকটু বড় হলেই বুঝতে পারত।
চশমা নাকের ডগায় এনে কটাক্ষ দৃষ্টিতে ম্যাডাম অপুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আজকে এত লেট কেন হলো, ৫ মিনিট ৫ সেকেন্ড লেট, কেন জানতে পারি?’
পামেলা মিস বিলেত রিটার্ন্ড, তাই ইংলিশ এক্সেন্টে কথা বলেন, মধুর ভাষা বাংলার রেইপ করে উনি জিহ্বা পেঁচিয়ে, জড়িয়ে কথা বলেন। আর এমন করার সময় তার মুখ থেকে থুতু ছিটকে পড়ে, ঐ দিকে তার খেয়াল নেই। উনার খেয়াল বাংলা সংস্কৃতির গলা টিপে খুন করা।
‘আই আসকড ইউ এ কোয়েশ্চান, মাই ডিয়ার।’
অপু আমতা-আমতা করতে লাগল। এমনিতেও রাতের দুঃস্বপ্ন নিয়ে সে ভীতসন্ত্রস্ত, তার উপর দাদুর ভবিষ্যৎ বানী আর এখন ম্যাডামের ঝাড়ি। যেন তেলের কড়াইতে আরও তেল দেওয়া। এরই বাকি ছিল। ‘মিস, আমি…আজ…’
‘হয়েছে আর বলা লাগবে না, গো টু ইউর সিট।’

সেই চির ভালো লাগা সিট, যেখানে অপু আর মিতা বসে পাশাপাশি। ওরা দুজন বেস্ট-ফ্রেন্ড। ওরা একসাথে টিফিন শেয়ার করে, বই পড়ে আর খেলে। মিতা অনেক সুন্দর করে কথা বলতে পারে, একটির পর একটি সাজিয়ে, অপুকে ডাকে পু, পু থেকে পাপোষ! ওর কাছে ভালো লাগে উদ্ভট নামে ডাকতে। তবে তা, অপুর কাছেও অনেক কিউট লাগে।
অপুর নিষ্পাপ মনে মিতার হাসিটা বারবার ভেসে আসে। কি সুন্দর করে হাসতে পারে মিতা! ওর এই হাসিটা দেখার জন্যই সে গেমে আউট হয়ে যায় আর মিতা ওর জয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে হাসে। অপুকে বলে, ‘পাপোষ, ইউ আর আউট, তুই আবারো হেরে গেছিস।’
মিতা আজকে হলুদ ফিতা দিয়ে দু ঝুটি করেছে আর মুখে স্নিগ্ধ হাসি। অপু জানে কেন এ হাসি, এখনি মিতা ওকে উইশ করবে, কিন্তু অপু আজ খুশি না, কারণ ও দুঃখী। মিতা ওকে হাগ করে বলল, হ্যাপি বার্থডে ডিয়ার পাপোষ! জন্মদিনে রইল অনেক বদ-দোয়া! মিতা সবসময় এমন দুষ্টামি করে আর অপু সে দুষ্টামিতে পাল্টা দুষ্টামি করে। ওর কাছে মিতার এসব খুনসুটি অনেক ভালো লাগে। এক বেস্ট-ফ্রেন্ডের কাছে আরেক বেস্ট-ফ্রেন্ডের সবকিছু ভালো লাগাটা স্বাভাবিক।
কিন্তু আজ, অপু মিতার এ দুষ্টামিকে
লাইটলি নিতে পারল না, মিতাকে বলল, ‘প্লিজ, আজকে বদ-দোয়া দিস না, আজ আমার দোয়ার খুব প্রয়োজন।’
মিতা জোরে জোরে হেসে বলল, ‘তুই আজকে এত সিরিয়াস মুডে কেন? বেশি ধুলো জমেছে পাপোষের উপর?’ মিতা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল।

অপু ওর হাসির দিকে চেয়ে রইল আর মনে-মনে আফসোস করতে লাগল, ঈশ যদি সেও মিতার সাথে হাসতে পারত!
পামেলা মিস, অপুকে দাঁড় করায়।
‘স্টুপিড, হয়্যার ইজ ইওর হোমওয়ার্ক? শো মি ইট, রাইট নাও!’
‘মিস আজকে হোমওয়ার্ক করিনি।’
‘কিহ, হলিশিট! গো আউট। অপু ম্যাডামের পানিশমেন্ট মাথা পেতে নিলো। ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে ভাবল, আজ বড় অলুক্ষুনে দিন।
হঠাতই ওর চোখে পড়ল সাইকাস! ঠিক ওর সামনের ক্লাসের বাইরে রাখা। টবের উপর মিনিয়েচার করা সাইকাসের বনসাই।
এটা এখানে রাখা কেন, এর আগে তো দেখেনি সে! তখনই রাজু পিয়ন হেঁটে যাচ্ছিল, সে রাজু কাকাকে ডাকল। রাজু কাকা মাঝে-মাঝে অপুর টিফিন এনে দিত, শিঙ্গাড়া সমুচা, স্নেক্স যাই চাইত ক্যান্টিন হতে এনে দিত।

‘কি হলো বাবা?’
‘সাইকাসের টবটি এখানে যে?’
‘দশম শ্রেণির আজ প্র্যাক্টিকাল হবে, তাই এখানে রাখা হয়েছে।’
‘ওহ, আচ্ছা!’ অপু ভাবতে লাগল। কি অদ্ভুত, যেখানে সাইকাসের বনসাই পাওয়া যায়, সেখানে ও এত সাইকাস কিভাবে দেখতে পায়! ও তো জীবনে খুব বেশি সাইকাস দেখেনি, আরো ছোট থাকতে একবার দেখেছিল…কোথায় যেন দেখেছিল মনে পড়ছে না। আর দেখেছে ওর স্বপ্ন-ভুবনে। এসব ভাবতে-ভাবতে, ক্লাসের ঘণ্টা পড়ে গেল। পামেলা মিস তুফানের গতিতে বেরিয়ে গেলেন, উনার সাথে লম্বা শাড়ির আঁচলও হাওয়ায় দুলছিল।

অপু ক্লাসে ঢুকে পড়ল। কোনোরকম আজকের দিনটি স্কুলে কাটিয়ে দিল। খুব বোরিং কাটল সময়।
বাসায় ফেরার পথে, অর্নি বায়না ধরলো আইসক্রিম খাওয়ার। অপু কিছু বলল না। রতন সাহেব অর্নিকে নিয়ে আইসক্রিম পার্লারে চলে গেলেন। অপুর অনেক টায়ার্ড লাগছে। সে হেলান দিয়ে কারের সিটে পিঠ ঠেকিয়ে মাথা এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমের মধ্যে আবার দেখল স্বপ্নটি।
একে-বেঁকে চলা মেঠো পথ। কালো ঘন আঁধার। বাঁকা চাঁদ। সাইকাস। ছুটতে থাকা অপু আর পানির তৃষ্ণা। সে ছুটতে লাগল বহু দুর, তবুও এ পথের কখনো শেষ হয় না। হঠাৎ সামনে অনতি দুরে দেখতে পায় একটি কুয়া। কুয়োর সামনে এসে পড়ল সে। নিচে তাকিয়ে সে কিছুই দেখতে পায় না; কেবল ঘুটঘুটে অন্ধকার।
ওখানে একটি ছোট বালতি ছিল; অপু লক্ষ্য করল বালতিটি রুপোর তৈরি। সে বালতিটি কুয়োয় ফেলল। মোটা দড়িটা দিয়ে সে বালতি টানতে লাগল, ঘণ্টাখানেক পর সেটি উপরে চলে আসে। কিন্তু, একি! এতো পানি নয়, রক্ত!
অপু চিৎকার করে ঘুম থেকে হাল দিয়ে উঠল। ততক্ষণে ওর বাবা আর অর্নিও চলে এসেছিল। অর্নির একহাতে স্ট্রবেরি আর অন্য হাতে বাটারস্কোচ আইসক্রিম। অপু কাঁদতে লাগল। রতœ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হয়েছে? কেন কাঁদছিস?’
অপু ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

অর্নি বলল, ‘ভাইয়া, তোমাকে আইসক্রিম দেইনি বলে কাঁদছ না? এই নাও আমার আইসক্রিমটি তুমি খাও।’
অপু মুখে খানিকটা হাসি টানার বৃথা চেষ্টা করে বলল, ‘না, আমার লক্ষ্মীটি, তুমি খাও, তোমরা ছিলে নাতো তাই ভাইয়া ভয় পেয়ে গেছি।’
অর্নি হাসতে লাগল আর বলতে লাগল, ‘ভাইয়া ভীতু!’
‘হুম, তোমরা যখন পাশে থাকো না তখন ভাইয়া ভয় পেয়ে যাই। কখনো আমাকে ছেড়ে যেও না।’
‘তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না ভাইয়া, নাহয় আমি পুতুল খেলব কিভাবে!’
ছোটবোনের এমন মায়াবী কথায় মন গলে যায় অপুর, সে ভাবে, সে কী পরিমাণ লাকি যে এমন কিউট একটা আদুরে বোন পেয়েছে! আর তাই আদর করে অপু অর্নিকে ইঁদুর ডাকে। অর্নি এতে খুব রাগ করে।
বাসায় গিয়ে কিছু না খেয়েই অপু কাঁথা মুড়ে শুয়ে থাকে। কিন্তু, চোখ এক করার ভুল, ভুলেও করেনি। আজ কিছু ভালো লাগছে না, কিছুক্ষণ পর পার্টি শুরু হবে। ও এখনো রেড়ি হয়নি। সবকিছু কেমনযেন ওলট-পালট। কিছু একটা ঠিক নেই। কিন্তু কি সেই কিছু একটা? কেন এত অস্থিরতা? স্মৃতির পাতায় অপু চোখ মেলে ধরে।

বিগত দু বছর ধরে প্রতি বার্থডেতে ওর এমন কাটে। আগে কত খুশি থাকত ও জন্মদিনে। কত আড়ম্বর করে সবার সাথে পালন করতো বার্থডে। তখন কোন দুঃস্বপ্ন ওকে হানা দিত না। তাহলে আনলাকি ২০১৩ টুয়েন্টি থার্টিনে কি এমন হল যা আজও ওকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে? তেমন কিছুই তো না, আজকের দিনের মতো সোনালী শুভ্র দিন। সবাই বার্থডে উইশ করল, সন্ধ্যে বেলায় পার্টি হলো, পার্টিতে কাছের দুরের সবাই আসলো। ওর ফ্রেন্ডরা, মামা-মামি, অর্নির কিছু ফ্রেন্ড আর কিছু প্রতিবেশীরা। সবাই অনেক কিছু গিফট করল। সেবার গিফটের ভা-ারও জমেছিল বেশ। মা-বাবা দিল একটি রিমোট কন্ট্রোলের স্পোর্টস কার, অর্নি দিল ওর হাতে আঁকা একটি কার্ড, যেটাতে বড়-বড় করে

লেখাঃ ‘বেস্ট ব্রাদার অফ দি ওয়ার্ল্ড।’

মিতা একটি পেন্সিল বক্স দিল আর মামুনি একটা টেডি দিয়েছিলেন যেটা ও অর্নিকে দিয়ে দিয়েছে। ওর খুব পছন্দ হয়েছিল তাই। এরকম অনেক গিফট পেয়েছিল।

তবে শেষ রাতে গিফট আন-প্যাক করার সময়, সে একটি বক্স পেয়েছিল যেটিতে কোন নাম ঠিকানা কিছুই লেখা ছিল না। কেমন যেন অদ্ভুত ভাবে প্যাক করা। ধুলোবালি জমা পুরাতন একটি গিফট। ধুসর রঙা কাপড় নাকি চামড়ার আবরণ দেওয়া, বোঝা যাচ্ছিল না। এর কিছু অংশ ছেঁড়া, তার উপর বড় পালক দ্বারা আটকানো। কোন পাখির পালক হবে কে জানে, অপু তো আর পাখি বিশারদ না যে এত অদ্ভুত পালক দেখেই চিনে ফেলবে কোন পাখি। তবে দেখতে অনেকটা কমিক্সের ফিনিক্স পাখির মতো।

বক্সটির উপর কৌতূহল অনুভব করল অপু। না, ফিনিক্সের হোক বা ড্রাগনের হোক, সে এটা খুলে দেখবেই। তবে কোনোভাবে সেটা খোলা যাচ্ছিল না। চামড়া ছেঁড়ার অনেক চেষ্টা করল ওর বাবার সুলতানি ছোরা দিয়ে, তাও পারল না। পালকটিকে নাড়িয়ে-চাড়িয়ে দেখল তাতেও কিছু হলো না। ওর সমস্ত প্রচেষ্টা এক যোগ এক শূন্যে ফল দিল। ভাবতে লাগল, ঈশ দেখতে পারলাম না,

‘তাহার মাঝে রয়েছে কি
রহস্যের মাঝে রহস্যটা কি
তালার উপর তালা-বদ্ধ
কোন সে চাবি দিয়ে বুঝাই
চঞ্চল মন আমার।

অপু বক্সটি রেখে দিতে যাচ্ছিল, তখন ঘড়িতে ১২টা বেজে উঠল, ডিং করে ঘণ্টা বেজে উঠল, প্লাস্টিকের সুইট নাইটিংগেল পাখিটি ঘড়ির জিহ্বা হতে বেরিয়ে সময়ের জানান দিল, আবার সেটি অতি দক্ষতার সাথে ঘড়ির মুখে ঢুকে গেল। সময়ের সাথে পাখিটিও অতলে অচিন-পুরে হারিয়ে যায়। ঠিক ঐ সময়ে পালকটি নড়ে উঠল। পালকটির ধারগুলো হঠাৎ ধারাল হয়ে গেল। অপু ভয়ে সেটি দূরে ছিটকে ফেলে দিল, এতে পালকের ধারগুলোর সাথে হাত লেগে কেটে গেল। রক্ত ঝরে পড়তে লাগল, রক্তাক্ত হাতেই সে বক্সটি নিলো আর দেখল, কয়েক ফোটা রক্ত পড়তেই ওটা খুলে গেল।

খুশিতে অপুর আর তর সইল না। সে ভুলে বসল হাতের ব্যথা সেই সাথে বক্সটির রহস্যময়তা। বক্সটির ভিতরে একটি চমৎকার ঘড়ি পেল। ভালো করে এদিক-ওদিক করে দেখল যে ঘড়িটি ডিজিটাল নয় আবার সিম্পল ও নয়, কেমন যেন বুনো একটা ভাব আছে। আদিম টাইপ মনে হচ্ছে। সাধারণত ঘড়ি হয় লেদারের বা মেটালের কিন্তু এ ঘড়িটি সাপের চামড়া দিয়ে তৈরি। ডিজাইনটিও সাপময়। ঘড়িকে বেষ্টন করে আছে দুটি ক্ষুদ্র সাপ, একটি উত্তরমুখী আরেকটি দক্ষিনমুখী। একটি সাপ গোল্ডেন আরেকটি সিলভার এর। তবে আশ্চর্যজনক জিনিসটি হলো, এতে ১২টি দাগের বদলে ১৩টি কাঁটা রয়েছে, তাও সাধারণ ঘড়ির মত না আর দুটি কাটা সমান দৈর্ঘ্যের। একটি শুরু হয়েছে গোল্ডেন সাপটির উপর থেকে উত্তরদিকে আর আরেকটি শুরু হয়েছে সিলভার সাপটির নিচ থেকে দক্ষিণ দিকে, আর ঐ কাঁটা বরাবর ১৩তম দাগ কাটা। অপু কৌতূহল বশত ঘড়িটি দেখতে লাগল।

ওর বাবার দেয়া ডিজিটাল ঘড়ির সাথে মিলিয়ে দেখতে লাগল, এ ঘড়িতে তো ১২টি তবে ঐটিতে ১৩টি দাগ কাটা কেন? ও ঘড়িটি হাতে পরলো। ঘড়ির টাইম আগ্রহভরে ১৩টায় ঠিক করল। এরপর ঘড়িটি ওর হাত টানতে আরম্ভ করল, এমনভাবে চাপতে লাগল যে, হাত রক্ত জমে ফুলে উঠল। ও ঘড়িটি এক ঝটকায় ফেলে দিল। এরপর থেকে আর কোনদিন অলুক্ষুনে ঘড়িটি ধরেনি।
আজকে কেন জানি ঘড়িটির কথা বারবার মনে পড়ছে। অপু কাবার্ড থেকে সেটি বের করল, সাপ দুটিকে জ্যান্ত মনে হলো, অপু অনেক ভয় পেল। ওর চোখ পড়ল সিলভার সাপটির দিকে; সাপটির জ্বলন্ত চোখ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ঘড়ির কাঁটা ১৩ থেকে সামনের দিকে চলতে থাকে অন্তহীন, কোন এক অনন্তে। সে ঘড়িটি রেখে দিল, পুনঃ-পুনঃ ওর মনে আশংকা জাগতে লাগল সব সমস্যার মূলে ঘড়িটি নয়ত?

সন্ধ্যে বেলায় সাজ-সাজ রব। মেহমান আসা শুরু করে দিয়েছে। মায়ের বকুনি খেয়ে ঠিকই পার্টিতে শরীক হতে হলো অপুর। টিয়া রঙের পাঞ্জাবিতে হাস্যকর লাগছিল তবুও পড়তে হল অর্নি পছন্দ করে দিয়েছে বলে। মিতা তো হেসে বলেই ফেলল; বার্থডে টিয়াপাখিটি এখনো লাজুক, হাসতেও কিপটামি করছে! অপু ফিকে হাসি হাসল।
ঠিক সন্ধ্যে ৭ টা বেজে ৫ মিনিটে অপু অনেক করতালি, হ্যাপি বার্থডে গান আর এক ঝাঁক মোমবাতির আলোর মাঝে কেক কাটল। মোমবাতিগুলা নিভানোর সময় মনে হলো একটি একটি করে ওর জীবনের বাতি নিভে যাচ্ছে। এই ওর শেষ বার্থডে। আনলাকি থার্টিনই কি ওর শেষ তবে?

হই-হুল্লোড়ে সন্ধ্যাটি কেটে গেল। সারাদিনের তিক্ত অভিজ্ঞতার পর অপুর মন দুরুদুরু করছে। মনকে সে সান্ত¡না দেয়, অল ইজ ওয়েল বলে।
নাহ, কিছুই হবে না, এর আগের দুটি বার্থডেতে কিছু হয়নি, অতএব এবারও কিছু হবে না। অশুভ কিছু ওকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছে, ঠিক কাছে টানতে পারেনি। কি সে-কিছুই না-না তাকে দেখা যায়, না ধরা যায়। সে অদৃশ্য রবাহূত। অপু মনে-মনে বলে, অলৌকিক সত্তা ওর কিছুই করতে পারবে না…হি ইজ মামাজ বয়…স্ট্রং বয়।

***

রুমে দরজা ভেজিয়ে, জানালার পাশে দাড়িয়ে রইল ও। আজ পূর্ণিমা তিথি। অপু স্বস্তি পায়, বাঁকা চাঁদ ওর কাছে ভালো লাগে না। ওর কাছে পেয়ারার মতো গোল চাঁদ ভালো লাগে। বাগানের টিউলিপ ফুলগুলো চাঁদের আলোয় ঝিকিমিকি করছে। শীতল বাতাস কিছুক্ষণ জোরে কিছুক্ষণ আস্তে বইছে। এমন মোহ-লাগা পরিবেশে অপু বুক খুলে শ্বাস নেয়। খুব সতেজ একটা অনুভূতি হচ্ছে যেন সারাদিনের ক্লান্তি মিটে গেল। এমন সময়ে গান শুনতে মন চায়।
অপু কাবার্ড হতে যেই না ওর মাইক্রোফোন নিতে যাচ্ছিল অলুক্ষুনে ঘড়িটি আবারও ওর সামনে এসে পড়ল। পায়ের বৃদ্ধা আঙুলের সামনে এসে পরা ঘড়িকে এক রাস অভিমানে তুলে জানালা দিয়ে ফেলে দিতে চাইল। কিন্তু চাঁদের আলোয় সাপগুলো জ্যান্ত হয়ে গেল। দুই সাপ অপুর দুবাহু পেঁচিয়ে আঁকড়ে ধরলো। হিসহিস করে পেঁচিয়ে এগুতে লাগল।

এ ভয়ংকর দৃশ্য দেখে অপু ভয়ে হিম হয়ে যায়। স্কুলে শিখিয়েছিল সাপ দেখলে চিৎকার করতে নেই, নড়াচড়াও করা যায় না। তার কাছে মনে হল সে যেন নির্বাক দর্শক। সাপগুলো ধীরে-ধীরে লম্বা হচ্ছে, তারপর ওর পুরো শরীর, মুখ ঢেকে দিচ্ছে, ও শ্বাস নিতে পারছে না। সাপগুলো ওকে কামড়াচ্ছে না; পাইথনের মতো আলিঙ্গন করে মৃত্যু স্বাদ দিচ্ছে। তারপর…১…২…৩…

‘অপু…এই অপু…কি করছিস তুই? ওরে কে কোথায় আছো, কেউ ধরো, আমার ছেলেকে বাঁচাও!’
অপুর বাবা, দাদু, অর্নি সবাই এসে দেখল, অপু মাইক্রোফোনের তারটি দিয়ে হাতমুখ গলা পেঁচিয়ে ফাঁস খাচ্ছে। সে আত্মহত্যা করছে। অপুর মা শক্ত করে মাইক্রোফোনের তারটি খুলতে লাগলেন, অপু কোনোভাবে ছাড়ছে না। অনেক ধস্তাধস্তির পর সে ছাড়ল ও বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেল।

অপুর বাবা অ্যাম্বুলেন্স ডাকলেন, অর্নি ভাইয়ের চুল ধরে কান্না করছে, অপুর মা অপুর বাবার কাঁধে মাথা গুঁজিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে-কাঁদতে বললেন, অপু কেন এমন করল? সে ভেতরে-ভেতরে এভাবে কুঁকড়ে মরছিল, আমরা জানলাম না কি করে? আজকে আমার ছেলে হারিয়ে যেত।
অপুর দাদু আয়াতুল কুরসি দোয়াদরুদ পড়ে অপুর গায়ে ফুঁ দিতে লাগলেন। নার্স বলল, পেশেন্টের বেশি কাছে না আসতে, হি ম্যায় ফিল সাফোকেটেড। দাদু সরে গিয়ে নীরবে কাঁদতে লাগলেন আর অস্ফুট গলায় বলতে লাগলেন, ফজরের স্বপ্ন সত্য হয়, ফেরেশতারা তখন বার্তা পাঠায়, এ সময়ের স্বপ্ন কখনও মিথ্যে হয় না।
অপুর বাবা বললেন, ‘বাবা,তুমি এগুলো নিয়ে ভেবো না, এসব মিথ্যে, বি প্র্যাক্টিকাল।’

অপুকে আইসিইউ তে নিয়ে যাওয়া হলো। দু’ঘণ্টার অবজারভেশনে রাখার পর, ড.জাহান অপুর মা-বাবাকে জরুরি ভিত্তিতে চেম্বারে ডেকে পাঠালেন।

মিসেস নিম্মি আর রতন সাহেব কাঁচুমাচু হয়ে ডাক্তারের সামনে বসে রইলেন। ড.জাহান কিছু রিপোর্ট চেক করে গম্ভীর ভাবে উনাদের দিকে তাকালেন। তার ঈগল চক্ষু দেখে তারা পরস্পরের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে চোখাচোখি করতে লাগলেন। রতন সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ‘এনিথিং সিরিয়াস, ডক? ইজ মাই সন ওকে?’
ড.জাহান এবার মুখ খুললেন, ‘আপনারা কি জানতেন, আপনার ছেলের সমস্যা কি?’
‘না, ও ১৩ বছরের একটি ছেলে, ওর তো গুরুতর কিছু হওয়ার কথা না, ফিজিক্যালি হি ইজ ইমিউন্ড।’

‘এটাই তো, আপনাদের মতো অধিকাংশ মা-বাবার সমস্যা। আপনারা শিশুদের দৈহিক অবস্থা দেখেন, কিন্তু মানসিক অবস্থা বিচার করেন না। আপনার ছেলে ভয়ংকর সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। হি ইজ সিজোফ্রেনিক।’
‘হোয়াট ননসেন্স! আমার ছেলের আবার সিজোফ্রেনিয়া, ইম্পসিবল।’
‘হ্যাঁ, আপনার ছেলে ফ্যান্টাসি সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। ও নিজেকে অন্য-ভুবনের সাথে আত্মস্থ করার চেষ্টা করছে। সে কল্পনায় এক কাল্পনিক রাজ্য গড়ে তুলেছে, যা ধীরে-ধীরে ওর মনোজগতকে গ্রাস করে ফেলেছে। অতিমাত্রায় ফ্যান্টাসি ওকে বিষিয়ে তুলছে। আজ সে নিজের ক্ষতি করেছে, কাল অন্যের করতে পারে। হি ইজ রেইজিং ইন ক্রিমিনাল ম্যান্টালিটি নাও।’

‘এসব কিছু কি করে সম্ভব?’
‘হ্যাঁ, এটাই সত্য, কোন একটা ঘটনা ওকে অনেক নাড়া দিয়েছে।’
‘এমন তো কিছু ঘটেছে বলে মনে হয় না!’
‘হ্যাঁ, ঘটেছে,’ এতক্ষণে মুখ খুললেন মিসেস নিম্মি। চোখ বিস্ফারিত করে হাহাকার করে বলে উঠলেন, ‘অপু, ওর দাদির সাথে খুব ক্লোজ ছিল। ছোটবেলায় ও দাদিকে ছাড়া কিছুই বুঝত না। ওর দাদিই ওকে খাওয়াতো, পরাতো, খেলতো। প্রকৃত অর্থে, ওর দাদি ওর মা ছিল। তাদের মধ্যে এক অটুট বন্ধন ছিল। ২০১০ সালে আমরা সবাই বান্দরবনে পিকনিকে গিয়েছিলাম। ওখানে, টিলার ওপরে হঠাৎ করে একটি হলুদ গোখরো সাপ দাদুকে কামড় দেয়, এতে ওর দাদু টিলা থেকে পড়ে যান আর অন দা স্পট মারা যান। আমরা ঘণ্টাখানেক পরে নিচে গিয়ে দেখি, রক্তের ছড়াছড়ি আর ওর দাদু আর বেঁচে নেই।’

‘আচ্ছা, জায়গাটা কেমন ছিল?’
‘আঁকা-বাঁকা পাহাড়ি অঞ্চল, যেখানে অনেক গাছের সারি।’

‘নাও আই গোট ইট। অপু কখনও ওর দাদুকে ভুলতে পারে নি, ঐ ঘটনাটিকেও ভুলেনি। যে কারণে চেতন অবস্থায় না হলেও অবচেতন মনে সে ঘটনাটির পট এঁকে ফেলে। তবে সেদিন কয় তারিখ ছিল?’

২৯ শে আগস্ট!

‘আর তাই তো, প্রতি জন্মদিনে সে এমন অভিজ্ঞতার শিকার হয়। শিশুদের কখনও বিরূপ ঘটনা দেখতে নেই।’

‘আর, আরেকটি কথা। ওর থেকে কিছু জিনিস সরিয়ে রাখবেন যেগুলো সন্দেহজনক মনে হয়। কারণ, অধিকাংশ রোগীরা নিজেদের কল্পনাকে বস্তুর উপর আশ্রয় করে নেয়। যেমন, আজ ও সাপ মনে করে মাইক্রোফোনের তার জড়িয়ে নিয়েছিল, তেমনি ওর সমস্ত কল্পনার উৎস হলো, ঘড়িটি।’ ড.জাহান তার ড্রয়ার থেকে একটি ঘড়ি বের করলেন, বেশ পুরনো ৭০ দশকের ডিজাইন। কেবল দুটি কাঁটা ওটাতে। চামড়া জরা-কীর্ণ।

‘এ ঘড়িটা তো অপুকে ওর দাদি ষষ্ট জন্মদিনে উপহার দিয়েছিল; উনার হাত ঘড়ি। দেওয়ার সময় বলেছিলে, ‘টিয়াপাখিটি আমার, সর্বদা সময়ের কদর করবে, কখনো এক কে দুই আর দুই কে তিন বানিয়ো না, ঘড়ির বারোটা যেন কখনো তেরটা না বাজায়।’

‘হুম, ভীষণ বুদ্ধিমতী ছিলেন উনি। তবে অবচেতন মনে ওর দাদুর স্মৃতি ওকে এমনভাবে আঁকড়ে ধরেছে যে ও একের পর এক ইমেজিনেশন গড়ে তুলেছে দীর্ঘ দু’বছর ধরে। অনেকসময়, শিশুরা তাদের ভেতরের কষ্ট ভিতরে চেপে রাখে, কাউকে বলে না, এমনকি তার খুব কাছের বন্ধুকেও না। কিন্তু একসময় এ দুখ-ভারাক্রান্ত মন পাহাড়ের মত ভারী হয়ে সিজোফ্রেনিয়ার মতো রোগের জন্য বাসা করে দেয়। অপুর দাদির বিয়োগের পর, এ পাঁচটি বছর খুব কষ্টে কেটেছে ওর। অপুকে যতœ আর ভালোবাসা দিয়ে সুস্থ করে তুলুন, এটাই ওর ঔষধ।’

অপু হসপিটাল বেড়ে ঘুমিয়ে আছে। ওর মাথার দু’পাশে ওর মা-বাবা বসে। অপুর মা, কমল হাতে ওর মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন। দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ার আগেই মুছে ফেলেন। অপু ঘুমিয়ে আছে। ওকে, বৃষ্টির দিনে সদ্য ফোটা শুভ্র কদম ফুলের মতই নিষ্পাপ লাগছে।

………………………………………………………………..(সমাপ্ত)…………………………………………………………

গল্পের বিষয়:
ফ্যান্টাসি
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত