জানালা দিয়ে রুপোলি চাঁদটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চিলেকোঠায় মেসের রুম হলে যা হয়। মনে হচ্ছে এই বুঝি হাত বাড়ালেই রুপোর দলার মত চাঁদের আলো হাতে এসে ঠেকবে। হাত ভিজে যাবে চাঁদের নরম আলোয়। অপার্থিব একটা মায়ায় ভরে গেছে ছাদের চারপাশ। আজ বোধহয় পূর্নিমা। এরকম পরিবেশে হাজারটা রাত বিনা কাজে পার হয়ে গেলেও আমার আপত্তি নেই। কিন্তু তার আর উপায় নেই। কাল থেকে লাগাতার ক্লাসটেস্ট চলবে। ঘুমানোর বদলে চাঁদের সৌন্দর্য দেখতে গেলে সকালের টেস্টটাই মিস হয়ে যাবে। তাই জালানাটাকে একটু ভেজিয়ে দিয়ে দিয়ে কাথাটা জড়িয়ে শুয়ে পড়লাম। যেকোন পরীক্ষার আগে আমার ঘুমের পরিমাণ কমার বদলে উলটে বেড়ে যায়। আজও কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বলতে পারবোনা। শুধু এটুকু বলবো যে মাঝরাতে ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো একটা অস্বাভাবিক কারণে। স্বপ্নে দেখছিলাম কেউ একজন আকুল কন্ঠে আমায় ডেকে চলেছে।
“ডক্টর আপনি কি আমার কথা শুনতে পারছেন? জলদি উঠে পড়ুন। আপনার সামনে অনেক বড় বিপদ। তাড়াতাড়ি না করলে ডুবে মরবেন এখনি।”
কন্ঠটা খুব পরিচিত লাগছিলো। ভাবলাম স্বপ্নে ডুবে মরার কথা বলে কে আমায় সতর্ক করে দিচ্ছে। আমি তো কোন নৌকা বা জাহাজে শুয়ে নেই। আমার মেসের কয়েকশ কিলোমিটারের ভেতরে তো কোন জলাশয় নেই। অবশ্য স্বপ্নে তো কতকিছুই ঘটা সম্ভব। যে স্বপ্ন দেখার সময় স্পষ্ট বোঝা যায় যে সেটা স্বপ্নই বাস্তব নয় সেধরনের স্বপ্ন দেখাকে লুসিড ড্রিমিং বলে। আমি এর আগেও অনেকবার লুসিড ড্রিমিং এর চক্করে পড়েছি। তবে কোনটাই এতটা জীবন্ত মনে হয়নি। এই স্বপ্ন এতটা সত্যি মনে হচ্ছে কেন কে জানে। নাকি সত্যিই কেউ আমায় জাগানোর চেষ্টা করছে?
এর আগেও তো আমার ভীনগ্রহবাসী বন্ধু ওডিলি আমায় স্বপ্নে অনেক পরামর্শ দিয়েছে। ওর কাছে বিপদের সংকেত পেয়েছি আমি। তাহলে কি এবারের স্বপ্নটাও ওরকম কিছু। ধোঁয়াশা কাটছিলোনা কিছুতেই। কিছু একটা ঘটতে চলেছে আর আমি নির্বিকারভাবে শুয়ে থাকবো? এসব ভাবতে ভাবতেই ঘুম কখন যেন ভেঙে গেছে। ধড়মড় করে বিছানা থেকে উঠে বসলাম। ধাতস্থ হতে খানিকটা সময় লেগে গেলো। নিজের মেসের ঘরটাকে কেমন অচেনা বলে মনে হচ্ছে। যেন ঘুমাবার আগে যেমনটা দেখেছিলাম তেমনটা আর নেই। সব যেন এই কিছুক্ষনের ঘুমে ওলটপালট হয়ে গেছে।
ঘুমের ঘোরটা ঠিকমতো কাটছেনা। ভাবলাম বোতল থেকে একঢোক জল খেয়ে নিলে কিছুটা আরাম পাবো। কিন্তু না । বোতলটা যেখানে রাখা ছিলো সেখানে নেই। এমন সময় একটা আশ্চর্য বিষয় লক্ষ্য করলাম। আমি যে বিছানায় শুয়ে ছিলাম সেটা আর তার নিজের জায়গায় নেই। বেমালুম গায়েব হয়ে গেছে। খাটটাও লাপাত্তা। আমি বসে আছি শক্ত একটা মেঝের ওপর। আমার আশেপাশের পরিবেশে সত্যিই পরিবর্তন এসেছে। ঘরের একটা আসবাবপত্রও নেই যার যার জায়গায়। কোন এক উপায়ে একদম অদৃশ্য হয়ে গেছে। আর আমি যে ঘরে বসে আছি তাতে আগের ঘরের কোন বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান নেই। শুধু কোন একটা উৎস থেকে ঝকঝকে উজ্জল চাঁদের আলো ঢুকছে ঘরে। সেই আলো আধারির খেলায় আমি দেখতে পাচ্ছি অসম্ভব সুন্দর একটা ঘর ।যাতে কোন আসবাবপত্র না থাকলেও দেয়ালে ঝুলছে নানান চিত্রকর্ম। চাঁদের স্বল্প আলোতেও যেগুলো চকচক করছে। যেন ওগুলো থেকেই রেডিয়ামের
মতন ঠিকরে বেরুচ্ছে আলো। আমি কি সত্যি দেখছি! কেন হচ্ছে এসব? আমাকে যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তার কোন আধিভৌতিক প্বার্শপ্রতিক্রিয়া এটা! এবার আরেকটা ব্যাপার ঘটলো। পুরো ঘরটা একবার প্রবলবেগে দুলে উঠলো। সাথে জলের ঢেউ ভাঙার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ! ভূমিকম্প হচ্ছে নাকি? আমি এতক্ষন বিমোহিত হয়ে সব দেখছিলাম। এটা স্বপ্ন না সত্যি সেটা যাচাই করতে হলে আমাকে উঠে দাঁড়াতে হবে। ঘর দুলে ওঠার কারনটাও হয়তো বুঝতে পারবো। কিন্তু দাঁড়িয়ে উঠতেই আরেক দফা অবাক হলাম। পায়ের নিচের মেঝে শক্ত হলেও সেটা কংক্রিটের নয়। কাঠের! আমার প্রতিটি পদক্ষেপে মচমচ করে আর্তনাদ করে উঠছে মেঝের কাঠ। আমি নিশ্চয় কোন পুরনো আমলের জাহাজের কামরায় অবস্থান করছি। কিন্তু প্রশ্ন হলো আমায় এখানে নিয়ে এলো কে? আমার পরম আদরের পোষা প্রানী গ্রিফিনো? ও কি আমায় কিছু দেখাতে চায়? জানিনা। হয়তো।
দেয়ালের চিত্রকর্মগুলো যেন একেকটা সম্মোহন করে চলেছে আমায়। সম্পুর্ন নতুন একটা অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি অথচ আমার সেই পুরনো অভ্যাস আমার পুরনো সঙ্গী কৌতূহল আমার পিছু ছাড়ছেনা। একটা গোটা ঘর যে কাঠের কামরায় পরিণত হয়েছে তা নিয়ে খুব একটা ভাবতে ইচ্ছা করছেনা। হয়তো এটা আমার নিয়তি। আমার অদৃষ্ট। হয়তো আবার কোন অভিযানের আভাস দেওয়া হচ্ছে আমাকে। হয়তো কোন সাধারণ পৃথিবীর বাইরের কোন গুপ্ত প্রানী বিপদে পড়েছে। তাদের সাহায্য করতে যেতে হবে আমাকে। এখন মনে পরছে আমায় কে জাগিয়ে তুলেছে। ওটা আর কেউ নয়। ওডিলি। আমায় টেলিপ্যাথিক যোগাযোগের মাধ্যমে জাগিয়েছে ও। বলেছে ডুবতে না চাইলে যেন ঘুম থেকে জলদি উঠে পড়ি। এই ঘরটার সাথে নিশ্চিত কোন জলাশয়ের সম্পর্ক আছে। জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দটা শুনে আন্দাজ করছি।
আমি চোখ বন্ধ করলাম। তারপর আলতো স্বরে ডাকলাম ওডিলিকে। মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগলো। কড়া সিগারেটের একটা লম্বা সুখটান যেমন মাথার ভেতরের সবকিছুকে অগোছালো করে দেয় ঠিক তেমন একটা অনুভূতি কাজ করছে। বুঝলাম আমার দূরগ্রহের ভবিষ্যৎ বলা সহচর আমার টেলিপ্যাথিক আহ্বানে সাড়া দিতে চলেছে। কতক্ষন এভাবেই কেটে গেলো। তারপর শুরু হলো আলাপ। ওডিলির স্বভাবসুলভ ভারী কন্ঠস্বর কেন জানি মোলায়েম মনে হচ্ছে। তবে এটা বুঝতে কোন অসুবিধা হচ্ছেনা যে ও ওডিলি।
ওডিলি বললো” ডক্টর গ্রিফিনো, আপনি কি আমার কথা শুনতে পারছেন?”
“হ্যা, ওডিলি । তুমি বলো। আমি শুনছি। আমি এই কাঠের বাক্সে কিভাবে এলাম?”
“আপনার কৌতূহল আমি বুঝতে পারছি ডক্টর। তাই প্রতিবারের মতন এবারও বলবো শান্ত হয়ে আমার কথা শুনুন। আপনার সামনে অনেক বড় বিপদ। মানুষ আর সাধারণ পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন প্রানীদের ত্রানকর্তা বানিয়ে আপনাকে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলেন আপনার বাবা মহান ফারাও সম্রাট আখেনাতুন। তার অবর্তমানে আপনিই হবেন তার দায়িত্ব বহনকারী। যাদের ওপর তার অধিকার ছিলো আপনারও তাদের ওপর অধিকার তৈরী হবে। আবার যাদের সাথে আখেনাতুনের শত্রুতা ছিলো তাদের চরম শত্রু হয়ে উঠবেন আপনি। আজ আপনাকে ঠিক এমনি একটি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। আপনার বাবার এক চরম শত্রু এপোফিস আপনাকে মারার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছিলো এতোদিন। সে আপনার খোঁজ পেয়েছে আজ। যদিও আপনাকে এখানে আনার উদ্দেশ্যটা ভিন্ন।”
আমি ভয়ার্ত গলায় বললাম ” কে এই এপোফিস? সে আমার খোঁজ পেয়েছে মানে?”
ওডিলি জবাব দিলো আপনি একটু কষ্ট করে ” জানালা দিয়ে বাইরে দেখুন। বাকিটা এমনি বুঝতে পারবেন। ”
আমি তড়িঘড়ি জানালা খুঁজতে লাগলাম। আমার নিজের ঘরের জানালা হলে এই কষ্টটুকু করতে হতোনা। কিন্তু এই কাঠের ঘরে জানালা কোথায়? অনেকক্ষণ খোঁজার পর খেয়াল করলাম দেয়ালে যে ছবিগুলো আছে তাদের প্রতি দুই ছবির মাঝখানে একটা করে ছোট জানালা রয়েছে। বাইরে বাইরের চাঁদের আলো কমে যাওয়ায় অন্ধকারে সেগুলোকে কালো পর্দার মতন দেখাচ্ছিলো। আমি লাফিয়ে গিয়ে একটা জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। জানালার বাইরে যা দেখলাম তা কল্পনাতীত। আমি কোন কাঠের জাহাজে নয় একটা মস্ত বড় দোতালা কাঠের বাড়িতে করে ভেসে চলেছি এক বিশাল জলাশয়ের মাঝ দিয়ে। দৈত্যাকার ঢেউ আর বহমান স্রোত দুটোই আছে সেই জলাশয়ে।
ঢেউয়ের ধাক্কায় আর স্রোতের টানেই একটা নির্দিষ্ট দিকে ভেসে চলেছে আমার এই ঘর। ভুমিকম্পের মতন কাঁপনের কারনটা বুঝতে পারলাম। কিন্তু এই ঘর কিভাবে ভেসে আছে তার সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। এখানেই শেষ নয়। আমার ভাসমান বাড়ির চারপাশে অতিকায় কিছু একটা কিছুক্ষণ পরপর চক্কর লাগাচ্ছে। তারসাথে একটা উজ্জ্বল আলোর রেখাও বৃত্তের পরিধি ঘিরে ঘুরছে। কিছ একটা বৃত্তাকারে প্রদক্ষিন করছে এই অদ্ভুতুড়ে বাড়িকে। কি ওটা! কোন বিশাল প্রানী?
প্রানী বললাম কারণ ইতিমধ্যে একবারের জন্য ও ওর মাথাটা জলের উপরে তুলেছিলো। দেখতেই শরীরের পশমগুলো একসাথে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। কি ভয়ানক সেই প্রানীর চাহনি। একটা বিশাল সাপের মাথার চারপাশে যেন অজস্র শিকড়বাকড় গজিয়ে উঠেছে। । মাথার ঠিক ওপরে তিনটে চোখ। সেগুলো আগুনের লেলিহান শিখার মতন জ্বলজ্বলে। সেই চোখগুলোকে ঘিরে রেখেছে একটা ত্রিভূজাকার মুকুট। যেন সমস্ত সাপেদের সম্রাট এই প্রানী। সবচেয়ে আজব ব্যাপার এই যে প্রাণীটার মাথার শিকড়ের জঞ্জালে আগুন জ্বলছে । এই জলাশয়ের ঢেউ বা স্রোতে সেই আগুন নিভে যাচ্ছেনা। বরং আরো বেড়ে গেছে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের তেজ। আলোর রেখা টেনে বেড়াবার রহস্য তাহলে এই।
ওডিলিকে বললাম “এই কি সেই এপোফিস? যার সাথে আখেনাতুনের শত্রুতা ছিলো?”
” হ্যা ডক্টর। সে অনেক কাল আগের কথা। আপনার বাবার সাথে এক তুমুল যুদ্ধে হেরে যায় এই অপদেবতা। আখেনাতুনের সাথে যুদ্ধে সহায়তার জন্য ছিলেন সূর্যদেবতা আমেন রা। এপোফিস দেখতে সাপের মত হলেও মূলত সাপের দেবতা নয় সে। সে ছিলো বিষাক্ত সাপের মতই বিশ্বাসঘাতক আর কুচক্রী। ক্ষমতার লোভে পাগল এই দেবতা ইচ্ছা করেই দেবতাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলো। কিন্তু পারেনি। যুদ্ধে হারিয়ে দেবার পর তাকে এনে বন্দি করা হয় একটা কাঠের দোতালা বন্দিশালায়। সেখান থেকে একদিন সুযোগ পেয়ে পালিয়ে যায় সে । তারপর আশ্রয়
নেয় মিশরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা পবিত্র নদ নীলনদে। আখেনাতুন জানতেন এপোফিসের কোন ধ্বংস নেই । তাই সে যে অন্তত মিশর থেকে একটু দূরে অবস্থান করছে সেটা মেনে নিয়েই রাজ্য শাসন করে যেতে লাগলেন। আর সূর্যদেবতার সাহায্য নিয়ে নদের তীর ঘেঁষে একটা সুর্যরশ্মির বলয় তৈরি করে দিলেন । যেন এপোফিস আর কখনোই ডাঙায় উঠতে না পারে। আরেকটা কাজ করলেন তিনি । যে কাঠের বন্দিশালায় ওকে আঁটকে রাখা হয়েছিলো সেই কাঠের বন্দিশালাকে ভাসিয়ে দিলেন নদের জলে। এপোফিসের সাথে জড়িত কোন অভিশপ্ত জিনিস তিনি রাখবেন না মিশরের মাটিতে। কিন্তু ঘটনা ঘটলো কয়েক বছর পর।নিজের ক্রোধ সংবরণ করতে না পেরে নীলনদে যেসকল প্রানীরা ছিলো তাদের ধরে ধরে মেরে ফেলতে শুরু করে দিলো এপোফিস। নদের জল হতে লাগলো রক্তাক্ত। দেবতারা আবার ক্ষুদ্ধ হলেন।
যে কাঠের বন্দিশালাকে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিলো সূর্যদেবতা আমেন রা সেটাকে দিলেন বিশেষ ক্ষমতা। যেখানেই এপোফিস নদের প্রানীদের হত্যা করতে যেতো সেখানেই ভেসে চলে যেতো সেই কাঠের বন্দিশালা। আর ঘরটা তার কাছে গেলেই ভয়ে পিছিয়ে যেতো এপোফিস। বন্দিশালার কষ্টের অভিজ্ঞতা সে ভোলেনি। তাই পালিয়ে বেড়াতে লাগলো সেই কাঠের ঘর থেকে। ওর মনে ভয় ছিলো যে এই ঘরটাই তাকে আবার নিজের ভেতর পুরে নেবে। জীবন্ত প্রানীর মতন গ্রাস করে ফেলবে। আদতে ঘরটাকে কিছুটা সেরকম ক্ষমতাই দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু সব
ক্ষমতারই একটা সীমা থাকে। সূর্যদেবতার দেয়া ক্ষমতায় শুধু সূর্যালোকে কাঠের ঘরের শক্তি উজ্জীবিত থাকতো । কিন্তু ঝড় বৃষ্টির দিনে বা রাতেরবেলা ঘরের শক্তি লোপ পেয়ে যেতো। সেটা আর সাধারণ কাঠের বস্তুর মতন স্রোতে ভেসে এপোফিসের কাছ থেকে অনেক দূরে চলে যেতো। এপোফিস যেতো পিছুপিছু। সুযোগ পেলেই ঘরটাকে ধাক্কা দিয়ে নীলনদ যেখানে সমুদ্রে গিয়ে মিশেছে সেদিকে নিয়ে যেতে লাগলো। ওর পরিকল্পনা হলো ঘরটাকে সোজা সমুদ্রে নিয়ে গিয়ে ফেলবে। কারণ একবার সমুদ্রে পড়লে আবার স্রোতের বিপরীতে ফিরে আসতে পারবেনা সেই ঘর। ওটার ক্ষমতা এই নীলনদের ভেতরেই সীমাবদ্ধ।
এপোফিসের কান্ড দেখে ক্ষেপে গেলেন দেবতারা। তাই সেই একই কাঠের ঘরে এপোফিসকে বন্দি করার ফন্দি আঁটলেন তারা।
কিন্তু এই কাজ সহজ নয়। এপোফিস আর এখন সূর্যের আলোয় শিকারে বের হয়না। কাজেই সেই বন্দিশালা ওর কাছে নিয়ে যাবার উপায় নেই। ওদিকে রাতেরবেলা ঘরের ক্ষমতা চলে যায় । তখন ইচ্ছা করলেই এপোফিসকে আঁটকে রাখা যাবে এপোফিসকে। কিন্তু এটাও দূরুহ। কারণ এই মস্ত প্রানীকে বশে আনতে হলে লড়াই করতে হবে।
সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে নীলনদের মতন পবিত্র জায়গায় যুদ্ধবিগ্রহ করতে পারবেনা দেবতারা। তাই তাদের এমন কাউকে দরকার ছিলো যার শরীরে মিশরের রাজার রক্ত আছে এবং এই দানবকে বন্দিশালায় আটকানোর শক্তি এবং সাহস রাখে । বন্দিশালা সাগরের মোহনায় পৌঁছে গেলে আর এই নীলনদের অসহায় প্রানীদের বাঁচানো যাবেনা। বিকৃতমনা এই অপদেবতাকে রুখতে তাই আপনাকে ডাকা হয়েছে ডক্টর!”
“দাঁড়াও! দাঁড়াও! দাঁড়াও! আমি ওডিলিকে থামিয়ে দিয়ে বললাম “কিন্তু তুমি তো বললে এটা কয়েক হাজার বছর আগের ঘটনা। তাহলে এতদিনে তো এপোফিসের ঘরটা নিয়ে মোহনায় পৌঁছে দেবার কথা। এতদিন পর আমায় ডাকা হলো কেন?”
” আপনার প্রশ্ন যুক্তিযুক্ত ডক্টর। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলেও জানাতে হচ্ছে যে আপনি এখন আর আপনার চেনা জগতে নেই। অর্থাৎ বর্তমান পৃথিবীতে নেই । আপনাকে নিয়ে আসা হয়েছে সুদূর অতীতে। দেবতাদের দূত হয়ে আপনি এসেছেন এখানে। নীলনদে এপোফিসের সাথে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। প্রস্তুতি নিন ডক্টর !
যুদ্ধ করার মতন কোন অস্ত্র তো নেই আমার কাছে । আমার পোষা প্রানী গ্রিফিনো কোথায় যেন চলে গেছে। অনেকদিন দেখিনা ওকে। পিঠের ডানাদুটোর ব্যবহার প্রায় ভুলেই গেছি। শার্টের তলায় পিঠের খাঁজে পড়ে থেকে থেকে প্রায় অকেজো হয়ে গেছে ওগুলো। আমার ডানহাতের সঞ্জীবনী পরশ ভায়োলেট হিলিং টাচটা শুধু কাজ করে যাচ্ছে। আমার আশেপাশে যারাই অসুস্থ হচ্ছে তাদের চোখের আড়ালেই ছুঁয়ে দিয়ে সুস্থ করে ফেলছি । তারা মাঝেমধ্যে ভয় পেয়ে যাচ্ছে নিজেদের দ্রুত আরোগ্য লাভ করতে দেখে। আবার সেই সাধারণ জীবনে ফিরে গিয়েছিলাম শেষ অভিযানের পর। আজ আবার সাড়া পেলাম তোমার।
যদিও তুমি বলোনি কিন্তু আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি এই ঘরটাই সেই প্রাচীন বন্দিশালা। এপোফিসকে এই ঘরেই বন্দি করতে হবে। তাই আমাকে সরাসরি এখানে এনে ফেলা হয়েছে। আমি জানি এবারের অভিযানে মৃত্যুঝুকি আছে। তাই তোমাদের সবাইকে একবার দেখে নিতে চাচ্ছি। তুমি কি একবার দেখা করতে পারবে ওডিলি? বলতে পারবে আমার পরম বন্ধু গ্রিফিনো কোথায়? আমি খুব একা বোধ করছি।”
ওডিলি বললো আমি সবসময় আপনার সাথেই আছি। কিন্তু এই অতীত সভ্যতায় আমার প্রবেশাধিকার নেই। তবে আপনি চাইলে আমি আমার দেহের একটা অংশ অর্থাৎ আমার প্রতিনিধি পাঠাতে পারি আপনার প্রয়োজনে। হ্যা । আমার প্রতিনিধি। আপনার আসন্ন বিপদে সে আমার মতই সাহায্য করে যাবে। আর গ্রিফিনো কি কোনদিন আপনার বিপদে না এসে পারে?”
এরপর ওডিলির সাথের টেলিপ্যাথিক যোগাযোগ কেন যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো । প্রায় সাথে সাথেই একটা পোড়া গন্ধ এসে ঠেকলো নাকে। গন্ধের উৎস আর কিছুই নয় । জানালার পাশে একটা বিরাট ফণা এসে স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিকড়বাকড়ে ঘেরা মাথাটায় একটা মুকুট। শিকড়গুলো আগুনে জ্বলছে দাউদাউ করে। আমি সেই পোড়া গন্ধই পেয়েছি। আমার থেকে হাত পাঁচেক দূরে জলের ওপর প্রায় সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে সরীসৃপটা। ওর মাথার ওপরের তিনটে চোখ এখন নিচে নেমে এসেছে। আমায় খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে প্রাণীটা। দেবতা এপোফিসের কবলে কোন প্রস্তুতি ছাড়া এত তাড়াতাড়ি পড়ে যাবো ভাবিনি। কোনরকম প্রস্তুতিও নিতে পারিনি। আর বাস্তবতা এখানেই। বিপদ কখনো বলে আসেনা। প্রস্তুত হবার সময় দেয়না।
আমি সম্মোহিতের মতন এপোফিসের তিনটে বিচিত্র চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। চাহনি দেখেই গা গুলিয়ে এলো। ভয়ে জমে গেলাম। পা দুটো থেকে যেন শিকড় বেরিয়ে কাঠের মেঝেতে গেঁথে গেছে। নড়াচড়া করতে পারছিনা । বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছি ক্ষণিকের জন্য। আর থাকলেই বা চিৎকার করে কাকে ডাকবো আমি? এই ভাসমান কাঠের ঘরে আমি তো একা। কে বাঁচাবে আমায়। কিছুই করার নেই ভেবে মনে মনে সবটা ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেবো ভাবছি এমন সময় একটা ব্যপার ঘটলো । কাঠের মেঝেতে থপথপ শব্দ শুনছে পেলাম। একদম কাছেই কোথাও। ভয় হলো হয়তো এপোফিস লেজ দিয়ে ধাক্কা দিচ্ছে ঘরটাতে।
কিন্তু কিছুক্ষণ পর সে ধারণা ভুল প্রমানিত হলো । শব্দটা আসছে আমার ডান দিক থেকে। শব্দের মাত্রা ততোটা বেশি নয়। অনেকটা স্পঞ্জের বল মাটিতে আছড়ে ফেললে যেমন শব্দ হয় তেমন শব্দ। ভয়ে ভয়ে ডানদিকে তাকালাম। মন এপোফিসের কোন কূটচালের আক্রান্ত হবার ভয়ে আচ্ছন্ন ছিলো। তাকাতেই দেখলাম সত্যিই একটা প্রায় ফুটবল আকৃতির গোলগাল প্রানী আমার জানালার ঠিক পাশের জানালার ধারে একটু পরপর লাফাচ্ছে আর একধরনের কু কু শব্দ করছে।
প্রাণীটার পুরো চেহারা দেখা যাচ্ছেনা। এটা আমার জন্য কোন টোপ নয়তো? এপোফিস হয়তো কোন কারণে আমাকে বাগে নিয়ে আসতে পারছেনা। তাই এই কৌশল। যদিও ওর একটা ছোবলই যথেষ্ট আমাকে এখান থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার জন্য। নাকি ঘরের ভেতরের প্রবেশাধিকার নেই ওর ?
ডানদিকের প্রাণীটা ক্রমাগত লাফিয়ে যাচ্ছে। প্রাণীটাকে অন্ধকারে ঠিক দেখা যাচ্ছিলোনা । কিন্তু ওটা যে লাফিয়ে লাফিয়ে ঘরের কোনার জানালায় উঁকি দিচ্ছে সেটা টের পেলাম। ওর শব্দ শুনেই কিনা জানিনা এপোফিসের মাথাটা ঘুরে গেলো ডানদিকের জানালাটার দিকে। এপোফিস থেকে নজর সরে যাওয়ায় একটু ভাবার সময় পেলাম । তাই দাঁড়ানো অবস্থা থেকে ঝটপট শুয়ে পড়লাম মেঝেতে। তারপর সোজা গড়িয়ে যেতে লাগলাম আমার ঘরে আবির্ভূত ছোট প্রাণীটার দিকে। এই ঘরে ও কিভাবে এলো বা কেন এলো তা আমার মাথায় আসছেনা। আমি শুধু ভাবছি অন্তত একা একা মরে যেতে হবেনা আমায় । কেউ একজন আমায় মরতে দেখবে।
প্রাণীটার চেহারা এবার কিছুটা স্পষ্ট হলো আমার কাছে। প্রাণীটা এখনো লাফিয়ে যাচ্ছে। আমি ধীরে ধীরে গড়িয়ে গড়িয়ে ওর কাছে পৌঁছুলাম। চেহারাটা ভালোমতন দেখা গেলো এবার । একটা ছোট্ট বাচ্চার মতন মুখ। দেহের রঙ্গটা বোঝা যাচ্ছেনা। চোখের আকৃতি দেখলে মনে হবে যেন ভারী গোল চশমা পরে আছে। হাত বলে যে একটা জিনিস থাকতে পারে সেটা এই প্রানীর নেই। শুধু দুতো গোলগোল পা আছে। ছোট্ট একটা মুখ আছে । নাকের জায়গায় লম্বা খাঁজকাটা পাতার মতন একটা বস্তু ঝুলছে। মাথায় গোছা গোছা চুল যেন কেউ রাবারব্যান্ড দিয়ে পরিপাটী করে বেঁধে দিয়েছে। এই কিম্ভুত প্রানীটাকে দেখার পরে আমার ভয়টা একটু কমলো । এপোফিস পাসের জানালায় যাবার পর প্রানীটা লাফিয়ে আমি যে জানালার কাছে ছিলাম সেখানে চলে গেলো। বুঝলাম এপোফিসের মনোযোগ আমার দিক থেকে সরানোর জন্যই অমন লাফাচ্ছে ও।
কিন্তু এপোফিস যেন বুঝতে পারলো ওর চালাকি। তাই আগের জানালাতেই দাঁড়ালো । কিন্তু আমাকে দেখতে পেলোনা। আমি ওকে ঠিকই মেঝের ওপর শুয়ে দেখছি। ওকে বোধহয় এই ঘর ভেঙে ফেলার ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। তাই ও শুধু বাইরে থেকে আমার ওপর নজর রাখার চেষ্টা করছে । শুয়ে শুয়ে ভাবছি কি করা যায় তখন হঠাৎ একটা বিকট গর্জনের আওয়াজ শুনতে পেলাম। তার পরমুহুর্তেই ভাসমান ঘরে এসে প্রবলবেগে এসে ধাক্কা মারলো এপোফিস। ওর আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে দেওয়া চিৎকারে কানে তালা লেগে গেছে।এমনিতেই ঢেউয়ের ধাক্কায় দুলছিলো ঘরটা। এপোফিসের আঘাতে ঘর কেঁপে ওঠায় আমি ছিটকে গিয়ে পড়লাম ঘরের এক কোণায়। কাঠের ঘর হওয়ায় তুলনামূলক কম ব্যথা পেয়েছি। ছোট্ট প্রাণীটা ছিটকে এসে আমার কোলে এসে পড়লো । তাই ব্যথা পায়নি । প্রানীটার শরীর সত্যি স্পঞ্জের মতন নরম তুলতুলে। এর পরিচয় কি ওডিলি আমায় জানাবে ?
“ জানাবো অবশ্যই । আপনাকে আমি বলেছিলাম যে আমার প্রতিনিধি পাঠাবো। এই সেই প্রতিনিধি।“
আকস্মিকভাবে ওডিলির গলা শুনে হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। ও আবার যোগাযোগ করছে ভেবে আনন্দিত বোধ করলাম। তারচেয়ে বেশি আনন্দিত বোধ করলাম ও ওর প্রতিনিধি পাঠিয়েছে সেটা দেখে। এই ছোট্ট আদুরে প্রানীটাও তাহলে ওডিলির গ্রহের বাসিন্দা।
ভাবতেই প্রাণীটার একটা নাম মাথায় চলে এলো। মিনি ওডিলি অথবা মিডিলি। মিডিলিই মানায় বেশি। এরকম বিপদের মাঝেও নামকরনের করার চেষ্টায় কেমন যেন হাসি পেয়ে গেলো। এপোফিস একটু বিরতি নিয়ে আবার ওর তান্ডবলীলা শুরু করেছে। আমি এবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। গ্রিফিনোকে ছাড়াই যুদ্ধে নামতে হবে। আপাতত মিডিলি কে নিয়েই কাজ সারবো। আমার পিঠের ডানাদুটো শেষ অভিযাত্রার পর অনেকদিন কোন কাজে আসেনি। আজ সেগুলো উন্মুক্ত করে দিলাম। শার্টের কাপড় ফুড়ে বেরিয়ে এলো অতিকায় দুটো ডানা। উড়তে গিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করা আজ একটু কঠিন হবে অনেকদিনের জড়তার জন্য ।
কিন্তু অসম্ভব নয়। এবার বেরোনোর উপায় খুঁজতে হবে। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিলাম। প্রথমে কিছুই চোখে পড়লোনা। খানিক বাদে টের পেলাম এই ঘরে একটা দরজাও আছে। সেই দরজা বাতাসে খুলে না গেলে বোঝা মুশকিল হতো। দেরি না করে মিডিলিকে কাঁধে চাপিয়ে এক দৌড়ে পৌঁছে গেলাম দরজার কাছে।
এপোফিসকে আপাতত দেখা যাচ্ছেনা। জলের তলায় ডুব দিয়েছে বোধহয়। এই ফাঁকে আমাকে ওড়ার বিদ্যাটা আরেকটু রপ্ত করে নিতে হবে।তাই সৃষ্টিকর্তার নাম নিয়ে চোখ বন্ধ করে লাফ দিলাম । কিন্তু ডানার জড়তা ছাড়েনি। ভাবলাম শেষ । আমি বোধহয় এখন মিডিলিকে নিয়ে ডুবেই যাবো। কিন্তু না। নীলনদের স্বচ্ছ জল স্পর্শ করার আগেই ফড়ফড় করে একটা আওয়াজ করে ডানাদুটো আমায় ভাসিয়ে নিয়ে চললো । আমি আবার উড়ছি। ঠান্ডা বাতাসের কেটে কেটে ধীরগতিতে উড়ে চলেছি আমি। কানের পর্দায় মৃদু একটা শো শো শব্দ ধাক্কা দিচ্ছে।
স্নিগ্ধ বাতাসের দোলায় ক্ষণিকের জন্য ভুলেই গেলাম যে একটা ভয়ানক অপদেবতা , এক মৃত্যুদূত আমার ঠিক নিচেই জলের তলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। মিডিলির কু কু শব্দে চটকা ভাঙলো। ও ওর নাকের খাঁজকাটা পাতার মতন অংশটা দিয়ে একটা নির্দিষ্ট দিকে ইংগিত করে কি যেন দেখাতে চাইছে।
আমি সেদিকে তাকালাম। মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে উঠলো। জলের তল দিয়ে একটা আগুনের হলকা হলকা ঠিক আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছে । বলাই বাহুল্য ওটাই এপোফিস। ও আমাদের দিকে ক্ষিপ্র গতিতে আসছে ঠিকই কিন্তু ওকে থামানোর বা বন্দিশালায় বন্দি করার কোন পরিকল্পনা আমার মাথায় নেই। বোকার মতন ভেসে রইলাম শূন্যে। এবার কি হবে? এপোফিসের গতি বেড়েছে। ও একদম কাছে এসে আচমকা লাফ দিলো আমাদের লক্ষ্য করে। মিডিলি চিৎকার দিয়ে উঠলো । আমি অল্পের জন্য হাওয়ায় ভেসে সরে গেলাম একদিকে। একটা ব্যপার খটকা লেগে আছে। আমাকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে ওকে বন্দি করে বন্দিশালায় রাখার জন্য। এই ব্যাপারটা কি ও জানে? সেইজন্যেই কি আমার ওপর ওর এই আক্রোশ! যেন আমার
কথাটা ওর কানে গেলো । আমার মনে মনে করা প্রশ্নটার উত্তর ওর কাছ থেকেই পেলাম। একটা বিচিত্র উপায়ে। ও আমাদের আক্রমন করা বাদ দিয়ে বৃত্তাকারে ঘুরতে লাগলো জলের ওপরের স্তরে । ওর মাথার শিকড় থেকে ছিটকে বের হওয়া আগুন দিয়ে কি যেন আঁকতে লাগলো জলকে ক্যানভাস বানিয়ে। তারপর সরে গেলো সেখান থেকে। আমি দূর থেকেই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি
জলের ওপরে অদ্ভুতভাবে আগুন জ্বলছে। সেই আগুন দিয়ে কিছু একটা লেখা হয়েছে। প্রাচীন হায়ারোগ্লিফিক্সে লেখা কথাটার অর্থ এই “আমাকে ধরার জন্য
তোমাদের মতন তুচ্ছ দুটো প্রানী কে পাঠিয়েছে আমেন রা! কি বোকা আর মুর্খ এই সূর্যদেবতা।!”
তারমানে এই হিংস্র সরীসৃপ সব জানে! এবার তো আমাদের আরো সাবধান হতে হবে। আমি ভাবতে লাগলাম । ওদিকে ডানাদুটো ক্লান্ত হয়ে গেছে অল্পেই। একবার মনে হলো আমার তলোয়ারটা থাকলে এক কোপে ঐ অহংকারী জানোয়ারের মাথাটা নামিয়ে ফেলতাম। কিন্তু পরক্ষনেই মনে হলো এপোফিসের কোনো ধ্বংস নেই। স্বয়ং দেবতারা যেটা পারেননি সেটা আমি পারবো কি করে? কিন্তু এও তো ঠিক যেদেবতাদের আমার সাহায্যের প্রয়োজন পড়ছে। নীলনদের পবিত্রতা রক্ষার খাতিরে ওরা যেটা করতে পারছেনা সেটা আমি করার চেষ্টা করছি।
মিডিলি এতক্ষন চুপচাপ ছিলো। হুট করে আবার শব্দ করে উঠলো । আর সাথে সাথেই জলে একটা ছপাশ করে আওয়াজ হলো। এপোফিস ছোঁ মেরে আমায় ধরতে চেয়েছিলো পারেনি। কিন্তু আমার হটাৎ নড়ে যাওয়ায় মিডিলি পরে গেলে জলে। আর পড়ামাত্রই টুপ করে ডুবে গেছে। আমি হতভম্ভ হয়ে একপলক দেখলাম যে এপোফিস ওকে গ্রাস করার জন্য ওর চোয়ালটা ফাঁক করেছে। ওর মাথার আগুনের ঝলকে জলের তলায় ডুবন্ত মিডিলির শিশুর মতন নিষ্পাপ চেহারাটা দেখা গেলো। সেইসাথে এপোফিসের ধারালো দাঁতের চোয়াল থেকে আত্মা কেঁপে উঠলো। সম্বিৎ ফিরে পেতেই আর কোন দিকে না তাকিয়ে আমি মিডিলিকে লক্ষ্য করে সোজা ডুব দিলাম জলে।
এপোফিস তার দুটো লক্ষ্যবস্তুকে একসাথে পেয়ে গেছে। ওর তো আর কিছুর দরকার নেই। আমার নিজের জীবন নিয়ে একটুও চিন্তা হচ্ছেনা। মিডিলিকে বাঁচানো চাই। এপোফিস গর্জন করে এগিয়ে এলো আমি মিডিলিকে নাগালে পেতেই ডুব দিলাম আরো গভীরে। কিন্তু সমস্যা হয়ে গেছে। আমার ডানা ভিজে গেছে । ওপরে উঠবো কি করে! ভেজা ডানা মেলে ধরা গেলেও সেটা দিয়ে আর যাই হোক ওড়া যায়না। ওদিকে আমাদের প্রদক্ষিণ করে চলেছে এপোফিস। ওর চোখে চরম জিঘাংসা। আমাদের খতম করে দিয়ে ও ওর বন্দিশালাকে রেখে আসবে সমুদ্রে। তারপর দাপিয়ে বেড়াবে এই নীলনদে। ইচ্ছামতন শিকার করবে এখানে
বসবাসকারী প্রানীদের। নিজের রক্তলালসা মেটাবে। দেখতে পেলাম ওর হাজারো কাঁটার মতন দেখতে দাঁতের সারি । শেষবারের মতন একটা লাফ দেবার চেষ্টা করলাম । তারপর আর মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরলো তখন দেখি একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে গেছে। খুব বেশি হলে পাঁচমিনিটের মতন অজ্ঞান ছিলাম আমি । মিডিলি ক্রমাগত মুখ দিয়ে কু কু শব্দ করে যাচ্ছিলো আর আমার পিঠের ওপর লাফাচ্ছিলো তাই জ্ঞান ফিরে পেয়েছি। উঠেই দেখি আমার ডান হাতটা আঁটকে গেছে এপোফিসের মাথার শিকড়ের মতন জায়গায় । যেখান থেকে জেট ইঞ্জিনের মতন আগুন বের হচ্ছে লাগাতার। আমার হাতে সেই আগুন লেগে ছিটকে যাচ্ছে উল্টোদিকে। বুঝলাম আমার হাতের সঞ্জীবনী বেগুনী স্পর্শ আমার হাতটাকে পুড়ে যাওয়া থেকে বাঁচিয়েছে। এপোফিস ওর মাথা থেকে হাতটা সরানোর জন্য বারবার মাথা ঝাঁকাচ্ছে। কিন্তু সরাতে পারছেনা।রাগে গজরাচ্ছে সে ।
ও যখন আমাদের খেতে এসেছিলো তখনই আমি শেষ লাফটা দিয়েছিলাম। সেই লাফেই কাজ হয়েছে । ওর মাথার উপরে উঠে গেছি। হাতটা আঁটকে যাওয়ার আর কায়দা করে উঠতে পারেনি শয়তানটা। মিডিলি ওর লম্বাটে নাক দিয়ে আমার ডান হাতটা নির্দেশ করলো। দেখলাম একটা মৃদু পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে সেটাতে। ভায়োলেট হিলিং টাচের বেগুনী আভা ক্রমে বদলে গিয়ে একটা লালচে আভার সৃষ্টি হচ্ছে । এপোফিসের মাথার আগুনে হাত পুড়িয়ে আমি আমার ক্ষমতা হারাতে বসলাম! হাজার চেষ্টা করেও লাল রঙয়ের আভা আবার বেগুনীতে ফিরিয়ে আনতে পারছিনা। বেশ কিছুক্ষণ এভাবেই কেটে গেলো। ধ্বস্তাধস্তি চলছে কিন্তু এপোফিস সুবিধা করে উঠতে পারছেনা।
আমার ভাবনা চিন্তার জালে জট পাকিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় একটা ভয়ানক কান্ড ঘটলো। এপোফিস ওর লম্বা লেজটা বাঁকিয়ে নিয়ে এসে খপ করে পেঁচিয়ে ধরলো আমায়। এতক্ষনে বাগে পেয়েছে আমাকে। বুদ্ধি খুলে গেছে ওর। আর খুলেছে আমাদের মৃত্যুর দুয়ার। ওর দেহের চাপে দম বন্ধ হয়ে আসছে । হাড়ে চাপ পড়ছে প্রবলভাবে। যেকোন মুহূর্তে মট করে ভেঙে যাবে। মিডিলি ভয়ে চুপসে গেছে। আমার অবস্থা দেখে ওর কষ্ট হচ্ছে বুঝলাম। এটাই কি শেষ দেখা । হতে পারে।
রাত কেটে গিয়েছে কখন যেন। ভোরের সূর্য উঁকি দিচ্ছে পুব আকাশে। আর সেই সূর্যই আমার মুক্তির একমাত্র কারণ হয়ে দাঁড়ালো। কারণ সূর্যের আলোতে প্রান ফিরে পায় সেই বন্দিশালা। সেসময় কেউ এপোফিসের কবলে পড়লে তাকে বাঁচাতে আসে কাঠের ঘরটা। ঘরটা একটা দ্রুতগামী স্পিডবোটের মতন এগিয়ে আসছে আমার কাছে। চোখদুটোর ঝাপি পড়ে যাচ্ছে। শরীর দুর্বল। মিডিলির আওয়াজ কানে ভেসে আসছে খুব ধীরে । যেন ধীর লয়ে সাইরেন বাজছে।
যখন চেতনা ফিরে পেলাম তখন নিজেকে আবিস্কার করলাম ঘরের নিচতলায়। কিভাবে এখানে পৌঁছেছি জানিনা। মিডিলিকে দেখতে পাচ্ছিনা। আশেপাশেই আছে হয়তো। মরে যে যাইনি সেটাই তৃপ্তির ব্যপার। কিন্তু শরীরের ব্যথা এতটুকু কমেনি। ডানাদুটোর ভেতরের হাড় ভেঙে গেছে নিশ্চিত। ব্যথায় কুকড়ে যাচ্ছে মুখের মাংসপেশি। শুয়ে শুয়েই দেয়ালে টাঙানো চিত্রকর্মগুলো দেখছিলাম। যেন অনন্তকাল পেরিয়ে গেছে। নিজেকে নেশাগ্রস্থের মতন মনে হচ্ছে। ঘরটা ঢেউয়ের ধাক্কায় দুলে দুলে স্রোতের টানে ভেসে চলেছে তার গন্তব্যে। দেয়ালের চিত্রকর্মগুলো ঘরের দুলুনির সাথে তাল মিলিয়ে দুলছে। যেকোন মুহূর্তে পড়ে যাবে কাঠের মেঝেতে।
হঠাৎ খেয়াল হলো এই চিত্রকর্মগুলোর মধ্যে একটা ধারাবাহিকতা আছে। হ্যা, ঠিক ধরেছি। কোনক্রমে শরীরের সমস্ত শক্তি ব্যয় করে উঠে বসলাম। দেহের সমস্ত হাড়গোড় যেন আর্তনাত করে উঠলো মটমট শব্দে। পাটকাঠির মতন ভেঙে পরতে চাইছে সব। তবুও একটা মুক্তির পথ খুঁজতে হবে। কে জানে সাগরের মোহনা আর কতদূর। যদি কাছে কোথাও হয় তবে এ যাত্রায় বেঁচে যাবে এপোফিস আর দুর্ভাগ্য বয়ে আনবে নদের সকল জলজ প্রানীর জন্য। এটা হতে দেয়া যাবেনা।
দেয়ালের চিত্রগুলো দেয়াল ধরে বাম থেকে ডানে চলে গেছে খানিক দূরে। একদম শুরুর চিত্রটাতে অস্পস্টভাবে একটা সাপের মাথা আঁকা। তারপরের চিত্রগুলোতে সাপের বাকি দেহ স্তরে স্তরে আঁকানো হয়েছে। এটা অবশ্যই এপোফিসের দেহ। কিন্তু এই চিত্রগুলো দিয়ে ঠিক কি বোঝানো হয়েছে? কিছুক্ষণ মাথা খাঁটাতেই সব পরিস্কার হয়ে গেলো একদম জলের মতন। আকারে ইঙ্গিতে এপোফিসের মাথার মুকুট টা মাথা থেকে কেটে আলাদা করে ফেলার নির্দেশ দেয়া হয়েছে ছবিগুলোতে।। অর্থাৎ মুকুটটা ওর দেহেরই একটা অংশ। মুকুটের তলায় যে তিনটে চোখ আছে তা কোনক্রমে সূর্যের আলোয় নিয়ে আসতে পারলেই মারা পড়বে এপোফিস। এই চিত্র কে এঁকেছে জানিনা। দেবতারা আমাকে সাহায্যের জন্যই কি এই উপায় বাতলে দিচ্ছেন? বলতে পারবোনা।
কিন্তু মুকুট আলাদা করতে হলে তো ধারালো অস্ত্র দরকার। তারসাথে দরকার ক্ষিপ্র ডানা।
আমার ডানা তো আহত। এখন কি করবো? এখন এই অবস্থায় একমাত্র গ্রিফিনোই আমাকে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু ও কোথায় সেটা এখনো আমি জানিনা।
ঘাড়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে কেউ। ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম মিডিলি। ও চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে ওর লম্বা নাকটা নাড়ছে। আর আমাকে দোতালায় যাবার সিড়িটা দেখাচ্ছে।
কি আছে ওপরে? ও বোধহয় কিছু দেখেছে ওখানে। অগত্যা ব্যথা যন্ত্রনা ভুলে উঠতে হলো। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দোতালায় উঠলাম। মিডিলি এলো পিছ পিছু। বিশেষ কিছু চোখে পড়লোনা। তবু খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগলাম সব । মিডিলি কিছু না দেখে তো আমায় ডাকেনি। হুট করে মনে পড়লো নিচের চিত্রগুলোকে এপোফিসের মুন্ডুপাত করার উপায় খুঁজে পেয়েছি। এখানকার চিত্রে নতুন কিছুর ইশারা নেই তো! যেই ভাবনা সেই কাজ । কিন্তু কোন ছবিতেই কোন বিশেষত্ব নেই। সবগুলো ছবিতেই প্রাচীন মিশরকে দেখানো হয়েছে। শুধু একটা ছবিতে “ভ্যালি অব দি কিংস” অর্থাৎ আমার গতজন্মের অবতার রাজা তুতানখামেনের মমি যেখান থেকে আবিস্কার করা হয়েছিলো সেই ছবিটা অন্যান্য ছবি থেকে একটু সুন্দর করে আঁকানো হয়েছে বলে মনে হলো। এর বেশি কিছুই না। হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম ছবিটার দিকে। মিডিলি এবার একলাফে আমার হাতে এসে চড়ে বসলো। হাবভাবে বুঝলাম ও এই ছবিতেই কিছু একটা খুঁজে পেয়েছে। ওর নাকটা আবার খাঁড়া হয়ে উঠলো । তারপর দেখিয়ে দিলো যে ছবিটার ওপরের দিকের
আকাশে একটা পাখি উড়ছে। ওটা দেখার কি আছে বুঝলাম না। তবুও আরেকবার মনোযোগ দিলাম। হ্যা! পাখিটা যেন ছবির এক যায়গা থেকে আরেক জায়গায় ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। অস্বাভাবিক একটা ব্যপার ঘটে চলেছে সামনে। ছবির মধ্যে একমাত্র পাখিটাই জীবন্ত বলে মনে হচ্ছে। আমার ডান হাতটা আপনা আপনি চলে গেলো পাখিটার ওপর। ঠিক তক্ষুনি ছবির ভেতরের পরিবেসে যেন কড়কড় করে বজ্রপাত হলো। সেই ব্জ্রপাতের পর থেকেই ছবির পাখিটা আকারে বড় হতে শুরু করলো। পাখিটার বড় হওয়া দেখে প্রথমে ভয় পেয়ে গেলেও পরে ঠোঁটের কোণায় একটা হাসির রেখা দেখা দিতে লাগলো আমার। এই পাখিটা আর পাঁচটা পাখির মতন কোন পাখি নয়। এর শুধু মাথা , সামনের দুটো পা আর ডানা ঈগলের মতন। বাকি অংশটা শক্তিশালী সিংহের মতন। প্রচন্ড শক্তিশালী এক জন্তু বড় হতে হতে বেরিয়ে আসছে ছবি ফুঁড়ে। এই জন্তু আর কেউ না । আমার গতজন্মের পোষা প্রানী গ্রিফিনো!
গ্রিফিনো ওর স্বভাবমতো আমার হাঁটুর কাছে এসে ওর মাথা ঘষলো কিছুক্ষণ। আমি ওকে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিলাম। আমার হাতের ভায়োলেট হিলিং টাচ যদি বদলে গিয়ে লাল একটা আভায় পরিণত না হতো তবে এখনি নিজেকে সুস্থ করে গ্রিফিনোকে সাথে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তাম এপোফিসের ওপর। সূর্যাস্তের এখনো অনেক দেরি। এরইমাঝে কিছু একটা করতে হবে।
নইলে রাত হয়ে গেলেই ঘরটাকে মোহনার দিকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে এপোফিস। এখন আমার বিশ্রাম নেওয়া উচিৎ। কিন্তু শেষমেশ দায়িত্বের কাছে হার মানলো শরীরের জরা। গ্রিফিনো একা আসেনি। ওর পিঠে ঝোলানো খাপে আমার বিশেষ তলোয়ারটা সাথে করে নিয়ে এসেছে। এবার আর এপোফিসের মুক্তি নেই। ওর মুকুট আলাদা করে তবে ছাড়বো।
দরজা খুলে দিয়ে গ্রিফিনোর পিঠে চড়ে বসলাম । বামহাতে তলোয়ারটা ধরে রেখেছি। ডানহাতে বেগুনীর বদলে লাল আলো জ্বলছে। এই আলোর কোন বিশেষত্ব আছে কিনা আমি জানিনা। হয়তো কোন না কোন কাজে লাগবে এই বিশ্বাসে ঝাঁপিয়ে পড়লাম দোতালা থেকে। আমার ঠিক সামনে গুটিসুটি মেরে বসে পড়েছিলো মিডিলি। ও আমাদের রাডার হিসেবে কাজ করবে। এপোফিসকে খুঁজতে সাহায্য করবে। কারণ রাতের বেলা এপোফিসের মাথার আগুন দেখে ওকে দূর থেকে সনাক্ত করা যেতো কিন্তু দিনে সেই আলো ম্লান দেখাবে। ও যেন চুপিচুপি আমাদের ওপর হামলা করতে না পারে সেদিকে নজর রাখতে হবে। কিন্তু জলাশয়ের অনেকটা উড়ে উড়ে ঘুরে দেখার পরেও এপোফিসের কোন দেখা পেলাম না। কোথায় গেলো সে! যখন ফিরে আসতে যাবো তখন আমাদের ঠিক নিচে জলের তলায় একটা
আলোড়ন সৃষ্টি হলো। ওটা যে এপোফিস তাতে কোন সন্দেহ নেই। মাথাটা আস্তে আস্তে উপরের দিকে উঠে এলো। চিনতে কোন অসুবিধাই হচ্ছেনা। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ওর মাথার মুকুট টা , আমাদের লক্ষ্যবস্তু ওটাই। ওটাকে ওর দেহ থেকে আলাদা করতে পারলেই ও মরবে। কিন্তু এই কাজটা খুব সাবধানতার সাথে করতে হবে। যদি উনিশ থেকে বিশ হয় তবেই সবার একসাথে বিপদে পড়তে হবে তিনজনকেই । এপোফিস আমাদের ওর মাথার ওপরে বসানো চোখ দিয়ে দেখেছে। কে জানে ও হয়তো আমাদের কিভাবে আক্রমন করা যায় সে পদ্ধতির কথাই ভাবছে। যা করার দ্রুত করতে হবে। এটাই শেষ সময়। এপোফিস ধীরেধীরে উঠে আসছে আমরাও প্রস্তুত। আক্রমন করতে যাবো এমন
সময় ও আচমকা একটা ডিগবাজি দিলো। লেজ চলে এলো ওপরে আর মাথা চলে গেলো জলের তলায়।ওর লেজের ধাক্কায় আমরা তিনজন ছিটকে পড়লাম তিনদিকে। ভাগ্য ভালো যে গ্রিফিনো টাল সামলে নিয়েছিলো । জলে পড়ে যায়নি। কিন্তু মিডিলি কোথায় পড়েছে জানিনা। আমি জলে পড়ে গেছি। দেহের ব্যথা চাগাড় দিয়ে উঠেছে জলের ধাক্কায়। সাঁতরাবার মতন শক্তি নেই গায়ে। কিন্তু একি! তলিয়ে যেতে যেতে আমি দেখছি মিডিলি ঠিক এপোফিসের মাথায় বসানো তিনটে চোখের ওপর গিয়েই পড়েছে। আর ক্রমাগত লাফাচ্ছে পিংপং বলের মতো। এপোফিসের কোন হাত বা পা নেই যে ওর মতন ছোট একটা প্রানীকে সরাবে। মাথা এদিকওদিক ঘুরিয়েও কোন লাভ হচ্ছেনা।
চোখের ওপর লাফানোর কারণেই কিনা জানিনা এপোফিস টাল সামলাতে পারছেনা। এরকম কঠিন অবস্থাতেও হাসি পেলো । এই দৃশ্যটুকু আমার মনে একটা মৃদু আশার আলো জ্বালিয়ে দিলো। এভাবে হাল ছেড়ে দিলে চলবেনা । মরলে লড়াই করেই মরবো। হাত পা ছুড়ে জলের ওপরের দিকে ওঠার চেষ্টা করতে লাগলাম। যতটা শক্তি ব্যয় করছি তার অর্ধেক কাজ হচ্ছে। দম ও ফুরিয়ে আসছে। তবে আশার প্রদীপ এখনো জাজ্বল্যমান। কারণ মাথার ওপর জলের উপরিভাগে একটা হাত আমাকে ধরার জন্য অপেক্ষা করছে। গ্রিফিনো চলে এসেছে আমাকে বাঁচাতে। অনেক কষ্টে
ওর হাতটা ধরলাম। ও উপরের দিকে উড়ে চললো। তারপর ছোঁ মেরে আমায় তুলে নিলো পিঠে। এপোফিস কাছাকাছিই ছিলো । আমি দেরী না করে খাপ থেকে তলোয়ারটা বের করে নিলাম তারপর দূর থেকেই ইশারায় মিডিলিকে বুঝিয়ে দিলাম কি করতে হবে। মিডিলি প্রস্তুত হতেই আমি গ্রিফিনোর পিঠ থেকে সরাসরি লাফ দিলাম এপোফিসের মুকুট লক্ষ্য করে । মিডিলি ইশারা বুঝে সরে গেলো। আর আমার তলোয়ার বিধে গেলো এপোফিসের মাথায়। এপোফিস হিংস্র হয়ে উঠলো। একটা হলুদ তরল বেরিয়ে আসছে ওর মাথা থেকে । ধীরে ধীরে আলগা হয়ে আসছে ওর মুকুট। শোনা যাচ্ছে ওর বিকট চিৎকার। আমি ফিরে এসেছি গ্রিফিনোর পিঠে। অন্য কোন তলোয়ার হলেএপোফিসের ঐ বিশাল মুকুট একবারে খুলে নিয়ে আসাটা অসম্ভব ছিলো। গ্রিফিনোর সুযোগ বুঝে ছোঁ মেরে ওটা তুলে নিয়েছে ওর নখরযুক্ত হাতে। মুকুটের ভারে প্রায় জলের গা ঘেঁষে উড়তে হচ্ছে ওকে।
এরপরের কাহিনী খুব বেশি কিছু নয়। এপোফিসের বিশাল দেহটা বন্দিশালায় তুলতে অনেক কষ্ট হয়েছিলো আমাদের। দুঃখের বিষয় হচ্ছে ও আসলে মুকুট হারানোতে একেবারে মরে যায়নি। শুধুমাত্র ওর ক্ষমতাগুলো হারিয়েছে। ধারণ করেছে সাধারণ একটা অজগরের রুপ। আমি জানি এটা ওর কাছে সাক্ষাৎ মৃত্যুর চাইতেও ভয়ানক।
মেসে ফিরে এসে ডানহাতের লাল আলোর ক্ষমতা বুঝেছি। ওটা আসলে একধরনের সম্মোহনী আলো। আমার রুমমেটের সামনে ভুলে সেই আলো জ্বলে ওঠায় ভয় পেয়েছিলাম। ভাবলাম এই রে! এই বুঝি সে সবাইকে বলে দেয় যে আমি জাদুমন্ত্র জানি, ভুতগোছের কেউ বা এরকম কিছু একটা। কিন্তু উলটো হিপনোটাইজড হয়ে যাওয়ায় মজা পেয়েছি। যে কাজগুলো কোনদিনই রুমমেটকে দিয়ে করানো সম্ভব হয়নি সেগুলো এখন থেকে করানো যাবে ওকে দিয়ে।
আমার এই নতুন ক্ষমতাটার নাম দিয়েছি রেড হিপনো বিম। খুশির খবর হলো আমার আগের সব ক্ষমতা ফিরে এসেছে। ভায়োলেট হিলিং টাচ বহাল তবিয়তে আছে। ডানহাতের তর্জনীতে চাপ দিলে হাতের আলোর রঙ বদলায়। একবার লাল আরেকবার বেগুনী। অনেকটা সুইচের মতন কাজ করছে আঙুলটা।
হিলিং টাচ ব্যবহার করেই সুস্থ হয়েছি।
মিডিলিকে পোষা প্রানীর মতন কাছে রাখার ইচ্ছা হয়েছিলো কিন্তু সেটা সম্ভব না।
আমার কাছে রাখলে মেসে হইচই পড়ে যাবে। ও “কি ধরনের প্রানী?” “কোথায় পেলাম?” এসব শুনতে শুনতে কানের পোকা নড়ে যাবে। গ্রিফিনো আবার ফিরে গিয়েছে । নীরব চাহনিতে বুঝিয়ে গেছে যে আবার প্রয়োজনে আসবে ঠিকই। আর সবার মনে ঠিক এই মূহুর্তে যে প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছে সেটা হচ্ছে কাঠের ঘরটার কি হলো?
ওটা ভাসছে নীলনদে। একসময় একমাত্র বন্দি প্রাণীটাকে নিয়ে সাগরের মোহনা পার করে ঢুকে পড়বে সাগরে। ঘরের ভাগ্যে তো এমনটাই লেখা ছিলো। বিশ্বাসঘাতক অপদেবতা এপোফিসও তো তেমনটাই চেয়েছিলো।
………………………………………………………………..(সমাপ্ত)…………………………………………………………