এক সময়ে চীন দেশের এক শহরে এক দর্জি বাস করতো। দিল দরিয়া মেজাজের লোক। কারো সাতে পাঁচে নাই। খায় দায় গান গায় আর দোকানে কাজ করে চলে। খাওয়া পরার জন্যে যতটুকু দরকার রোজগার করে তারপর বাকী সময়টুকু হৈহল্লা আনন্দ করে কাটায়। বিকেল হলেই আর কোন কাজ নয়, বিবিকে সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে বের হয়। নদীর ধারে ময়দানে ঘুরে বেড়ায়। আবার সন্ধ্যার মুখে দু-চারটে কেনাকাটা করেবাড়ি ফেরে।
সেদিনও তেমনই বেড়াতে বেরিয়েছিলো তারা দুজনে। অনেক হৈহল্লা করে অনেক জায়গা ঘুরেন্টুরেবাড়ি ফেরার পথে এক কুঁজোর সঙ্গে দেখা হলো। কুঁজোেটা দেখতে কেমন অদ্ভুত হাস্যকর। লোকটা ওদের দেখে হঠাৎ হো হো করে হাসতে লাগলো। দর্জি বেশ মজা পেলো। ওর হাসি আর বিচিত্র অঙ্গভঙ্গী দেখে। কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো, কী ব্যাপার হাসছে কেন?
—এমনি, হাসি পেলো তাই হাসছি।
এই বলে আবার হাসতে লাগলো। দর্জি জিজ্ঞেস করলো, আমাদের সঙ্গে যাবে আমাদের বাড়িতে। আজ রাতে আমাদের ওখানেই খাবে থাকবে, বেশ মজা হবে।
কুঁজে বললো, যাবো।
ওরা কুঁজোটাকে সঙ্গে নিয়ে দোকানে এলো। ওকে দোকানে বসিয়ে রাতের দরকার মতো কয়েকটা জিনিস সওদা করে আনলো। ভাজা মাছ, রুটি, লেবু আর লম্বা একফালি ক্ষিরা।
রাতে বেশ মৌজ করে খানাপিনা করতে লাগলো তিনজনে। এক সময় দর্জির বিবি মজা করার জন্যে বড় দেখে একখানা মাছের টুকরো নিয়ে কুঁজোর মুখে পুরে দেয়। বেঁটেখাটো ছোট্ট মানুষ। অত বড় মাছের টুকরোটা ওর মুখে আর ধরে না। কিন্তু উগরে ফেলারও জো নাই। দর্জির-বিবি হাত দিয়ে চেপে ধরে থাকে ওর মুখ। আল্লাহর দোহাই, খেয়ে নাও, তা না হলে ভীষণ রাগ করবো।
অনেক কষ্টে এগাল-ওগাল করে মাছের টুকরোটি গলাধঃকরণ করতে পারলো। কিন্তু বিপত্তি এড়ানো গেলো না। গলায় গেঁথে গেলো একটা হাড়। আর সঙ্গে সঙ্গে কুপোকাৎ—মরে গেলো লোকটা।
এই সময় শাহরাজাদ দেখলে রাত্রি শেষ হতে আর বেশি দেরি নাই। গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো সে।
পরদিন পঁচিশতম রজনী।
দুনিয়াজিদ আব্দার ধরলো, তোমাদের কাজ কাম সব তো মিটলো। এবার তাহলে সেই গল্পটা শুরু করে, দিদি।
শাহরাজাদ বললো, এখুনি করছি, বোন। কিন্তু তার আগে বাদশাহজাদার অনুমতি চাই তো!
শারিয়ার বললো, ঠিক আছে, বলো, শুনি।
শাহরাজাদ বলতে থাকে :
তারপর শুনুন শাহজাদা, সেই দর্জি আর তার বিবি দেখলো, তাদের চোখের সামনে অসহায়ের মতো লোকটা মরে যাচ্ছে। দেখলো, কিন্তু কিছুই করতে পারলো না। নিয়তির লেখা। তা না হলে লোকটাকে কেনই বা তারা ঘরে নিয়ে আসবে। আর কেনই বা তার বিবির আমন প্রাণঘাতী বিদঘুটে রসিকতার নেশা মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে। ওর মোৎ বোধ হয়। এইভাবেই লেখা ছিলো।
—এখন কি করা যায়?
দর্জি জিজ্ঞেস করে তার বিবিকে। বিবি বললো, কাঁধে তোলো লোকটাকে। আমি শাল দিয়ে ঢেকে দিচ্ছি। আচ্ছা দাড়াও শালে জড়িয়ে কাঁধে নিচ্ছি আমি। যা করার আমিই করছি, তোমাকে কিছু করতে হবে না। তুমি শুধু আমার পিছনে পিছনে এসো।
দর্জির বিবি কুঁজোটাকে কাঁধে করে রাস্তায় নামলো। ইনিয়ে বিনিয়েকাঁদতে কাঁদতে তাঁর তর করে হেটে চলতে থাকে। মাঝে মাঝে কোন লোকজন আসছে দেখলেই-আরও গলা চড়িয়ে দেয়।—ওগো আমার কি হবে গো; আমার ছেলেটা আর বাঁচবে না। আমার ঘরে বসন্তের। দয়া হলো কেনো গো; ওগো তোমরা কে কোথায় আছো দেখে যাও আমার জানের কলিজার দশা। বসন্তে সারা গা ছেয়ে গেছে বাছার আমার।
দর্জি-বিবির কান্নাকাটিতে পথচারীরা বেশ ভালো করেই বুঝলো। বৌটার ছেলের বসন্ত রোগ হয়েছে। আশায় আশায় হেকিমের কাছে নিয়ে যাচ্ছে। যদি বাঁচে। শোনামাত্র সবাই আর কোন কথাবার্তা জিজ্ঞেস না করে রাস্তার ওপাশে চলে যেতে লাগলো।
এইভাবে সারাটা পথ লোক সরাতে সরাতে শেষে এক ইহুদী হেকিমের বাড়ির দরজায় এসে কড়া নাড়লো। একটা অল্প বয়সের কালো নিগ্রো ক্রীতদাসী এসে দরজা খুলে দিলো।
দর্জি-বিবি জিজ্ঞেস করে, হেকিমসাহেববাড়ি আছেন। মেয়েটি ঘাড় নেড়ে বলে, আছেন। এই নাও সিকি একটা! তোমার মনিবকে গিয়ে দাও। আর বলো, শিগ্গির করে আসতে। আমার বাছাটার খুব অসুখ। যেন দেরি না করে, বুঝলে?
মেয়েটি ঘাড় নেড়ে উপরে চলে যায়। দর্জির বেঁটা উকি দিয়ে দেখলো নিগ্রো মেয়েটাকে আর দেখা যাচ্ছে না। দর্জিকে ফিসফিস করে বললো, আর এক লহমা দেরি না, চলো কেটে পড়ি এখন থেকে।
কুঁজোটাকে সিঁড়ির একটা ধাপের উপর বসিয়ে দিয়ে একরকম প্রায় জোর করেই দর্জির হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে নামালো রাস্তায়। তারপর লম্বালম্বা পা ফেলে জোর কদমে হেঁটে চললো। রীতিমতো দৌড়ানোই বলা যায়।
ইহুদী হেকিমের হাতে সিকিটা দিয়ে নফরাণীটা বললো, নিচে একটা রুগী এসেছে। খুব খারাপ অবস্থা। এখুনি একবার চলুন।
চকচকে সিকিটা ছোঁ। মেরে তুলে নিয়ে বলে, বাঃ, ভালো খদ্দের তো। একেবারে আগাম পয়সা দিয়েছে! চল দেখি। পড়ি মারি ভাবে তড়বড় করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে ইহুদী হাতে চিরাগ নেবার আর তার সয় না। অন্ধকারে সিঁড়ির ধাপগুলো দেখা যায় না। আন্দাজে পা চালাতে থাকে। সিঁড়ির প্রায় শেষ ধাপে এসে কিসে যেনো ধাক্কা লেগে হুমডি খেয়ে পড়ে যায়। হেকিমের পড়ে যাওয়ার শব্দে বাতি নিয়ে নেমে আসে মেয়েটা। দেখে একটা কুঁজে লোক মৃত অবস্থায় পড়ে আছে সিঁড়ির নিচে। ইহুদী ভাবলো, সেই তার মৃত্যুর কারণ। তার ধাক্কাতেই লোকটা মরে গেলো। মনে খুব দুঃখ হলো তার। হায় প্রভু, একি হলো, একি পাপের ভাগী করলে আমাকে? ইহুদী ভেবে পেলো না কি করা যায়। মৃতদেহটা বাড়ির প্রাঙ্গণে বের করে তার বৌকে খবর পাঠালো। ইহুদী বৌ এসে বললো, এক্ষুণি সরাতে হবে ওটাকে। এভাবে এখানে রাখা যাবে না কিছুতেই! যা হোক একটা ব্যবস্থা করো।
ইহুদী বলে, এই রাতবিরেতে কী ব্যবস্থা করি বলো তো?
ইহুদী বৌ বলে, চলো, ধরাধরি করে ছাদের উপরে নিয়ে যাই। ওখান থেকে পাশের মুসলমান বাড়ির ছাতে ছুঁড়ে দেবো। ও বাড়ির মালিক সুলতানের বড়ো বাবুর্চি। অনেক ইদুর কুকুর বেড়াল আছে ওবাড়িতে। রাতের অন্ধকারে এসে খেয়ে ফেলবে।
অতঃপর ইহুদী আর তার বৌ ধরাধরি করে কুঁজোর মরদেহটা ছাতে উঠিয়ে এনে পাশের বাড়ির ছাদে ছুঁড়ে দিলো। কিন্তু এমনই দুৰ্ভাগ্য পাশের বাড়ির ছাদের ওপর ফেলতে পারলো না। নিচে পড়ে গেলো বাবুর্চির রান্নার ঘরের পাশে।
কিছু পরে সুলতান প্রাসাদের কাজ শেষেবাড়ি ফিরে বাতি জ্বালতেই চমকে ওঠে লোকটা। একি! এ যে একটা মানুষ মরে পড়ে আছে? লোকটা বোধহয় চুরি করে খেতে এসেছিলো। কিন্তু খোদার মার দুনিয়ার বার। একেবারেই শেষ খাওয়া খাইয়ে দিয়েছেন তিনি। কিন্তু এই রাতে এই মড়াকে নিয়ে কি করা যায়?
কুঁজোর লাশটা কাঁধে তুলে বাজারের দিকে যেতে থাকে। খুঁজে পেতে একটা জুৎসই জায়গায় এক দোকানের দরজার পাশে দাঁড় করিয়ে চলে আসে।
রাত্রি তখন অনেক। এক খ্ৰীষ্টান মাতাল পথ দিয়ে চলেছে। আর নেশা জড়ানো কণ্ঠে বলে চলেছে, ঠিক আছে যিশু আসছেন, যিশু এক্ষুণি এসে পড়বেন, তারপর বাছাধনরা কোথায় পালাবে। আমার মাথায় মদ ঢেলে দেওয়া? এতো বড়ো আসাপরুদা। দাঁড়াও যিশু এসে পড়লেন বলে।
একবার এপাশ, একবার ওপাশ সাপের মতো একে বেঁকে চলতে চলতে বাজারের পাশে হামামের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে লোকটা। হাসি মজাক করে ওর সঙ্গের লোকীরা মদ ঢেলে দিয়েছে মাথায়। বেচারী গোসল করবে। এই মাঝ রাতে।
ঐ দোকানটার পাশে এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করলো। কিন্তু মদের নেশায় এমনই কুঁদ হয়ে হয়ে টলছে যে কোন দিকেই ভ্বদক্ষেপ নাই। মরা লাশটা যে তার পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে দেখলে না। কিন্তু টলতে টলতে এক-পা পিছু হটতেই বুঝতে পারলো, কে যেনো তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। খ্ৰীষ্টানের আর বুঝতে বাকী রইলো না, সে এখন ছেনতাই-এর কবলে। এসব ব্যাপার খুব চট্ট করে বুঝে ফেলে। চোখের পলকে নিজের শরীরটাকে ঘুরিয়ে নিয়েই ধী করে এক ঘুষি বসিয়ে দিলো লোকটার মুখে। আর এক ঘুষিতেই পাপাত ধরণীতলে।–তবে রে ব্যাটা, একেবারে খুন করে ফেলবো। ওঠু, উঠে দাঁড়া বলছি। ই ই বাবা, কোথায় তুমি খাপ খুলতে এয়েছিলো? একেবারে বাঘের মুখে পড়ে গেছে।
তার চিৎকারে, তরফানীতে বাজারের ঘুমন্ত পাহারাওলা লাফিয়ে ওঠে। নিশ্চয়ই কোন চোর ছাঁচোড়। লাঠি হাতে দৌড়ে আসে। কিন্তু যখন দেখলো একটা খ্ৰীষ্টান একজন মুসলমানকে মেরে মাটিতে ফেলে দিয়েছে, সে তখন বললে, ঠিক আছে ছেড়ে দিন সাহেব। এই, ওঠ!
কিন্তু লোকটা আর ওঠে না। তখন ঝুকে পড়ে দেখলো, লোকটা মরে গেছে। আর সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে সারা বাজারের লোকজন জাগিয়ে তুললো–কে আছে, বেরিয়ে এসো, দেখো, এক খ্ৰীষ্টানের বাচ্চা একজন মুসলমানকে মেরে ফেলেছে।
পাহারাওলা দড়ি দিয়ে পিছমোড়া করে বাঁধলো খ্ৰীষ্টানটাকে। কোতোয়াল সাহেবের বাড়ির দিকে যেতে থাকলো। হায় যিশু তুমি নেমে এসো, রক্ষা করো। আমি তো লোকটাকে মেরে ফেলতে চাইনি। আর এক ঘুষিতেই মরে যাবে-তাই বা ভাববো কি করে? তুমি এসে যিশু, তুমি না বাঁচালে এ মাতালকে কেউ উদ্ধার করবে না।
কোতোয়াল সাহেব ঘুমুচ্ছেন। তাকে বিরক্ত করা যাবে না। সুতরাং বাকী রাতটা তালাবন্ধ ঘরে কাটাতে হলো খ্ৰীষ্টানকে। সকালবেলায় বিচারে বসলো কোতোয়াল। সব শুনেটুনে রায় দিলো—খ্ৰীষ্টানের ফাঁসী।
শহরের পথে পথে দড়ি বেঁধে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে প্রথমে। তারপর হাজারো লোকের সামনে বাজারের মধ্যে তাকে ফাঁসীতে ঝুলাতে হবে।
সারা শহর ঘুরিয়ে এনে যখন তার গলায় ফাঁসীর দড়ি পরাতে যাবে এমন সময় সুলতানের সেই বড় বাবুর্চি এসে বলে, তোমরা দাঁড়াও একটু। কেন, এই নিরীহ নিরপরাধ লোকটাকে ফাঁসীতে ঝুলাতে চাইছো। ওতো মারেনি। ঐ কুঁজোটাকে। মেরেছি আমি।
কোটাল বললো, তার প্রমাণ?
প্রমাণ দিচ্ছি। গতকাল আমি সুলতানের খানা পাকিয়ে যখনবাড়ি ফিরি তখন অনেকখানি রাত। বাতি জ্বালাতেই দেখি একটা লোক আমার রসুইখানার কাছে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে। খানা চুরি করতে এসেছিলো। আমি একটা লোহার ডাণ্ডা দিয়ে এক ঘা বসাতেই বেচারা মরে গেলো। তখন আমি কাঁধে করে এনে বাজারের পাশে ঐ দোকানটার পাশে মর্যাটাকে দাঁড় করিয়ে রেখে যাই। আমার দোষে একজন মুসলমানের প্রাণ গেছে। আবার আমার কারণেই একজন খ্ৰীষ্টানের প্রাণ যেতে বসেছে। এতো পাপ আমার সইবে না। আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করবেন না। তার চেয়ে আপনি আমাকে ফাঁসী দিন। আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হোক।
বাবুর্চির কথা শোনার পর খ্ৰীষ্টানকে ছেড়ে দিলো কোটাল। জল্লাদকে বললো, ওকে ছেড়ে দাও, ওর কোনও দোষ নাই। বাবুর্চি যখন নিজের মুখে তার দোষ স্বীকার করছে তার উপরে তো আর অন্য কোনও প্রমাণের দরকার নাই। নাও, আর দেরি করো না, ফাঁসীর দড়ি বাবুর্চির গলায় পরিয়ে দাও।
জল্লাদ এবার বাবুর্চির গলায় দড়ি পরাতে যায়। এমন সময় সেই ইহুদী ডাক্তার ছুটে আসে। একটুখানি সবুর করো, বাবা। ওকে ছেড়ে দাও ওর কোন দোষ নাই! আমিই ঐ কুঁজোটাকে হত্যা করেছি।
ইহুদীর বক্তব্যে পরিষ্কার বোঝা গেলো বাবুর্চির কোনো দোষ নাই। হত্যাকারী আসলে ইহুদীই।
এবার ইহুদীর গলায় ফাঁসীর দড়ি পরানো হলো। এমন সময় ভীড়ের মধ্যে থেকে একটা চিৎকার শোনা গেলো। এই রোকো, রোকো, থামাও। এই হেকিমের কোন দোষ নাই। সে ঐ কুঁজোটাকে হত্যা করেনি, গতকাল বিকেলে আমি আর আমার বিবি বেডিয়ে ফিরছিলাম। এই কুঁজোটাকে দেখলাম একটা রাস্তার মোড়ে বিনা কারণে খুব হাসছে। আমার খুব মজা লাগলো, ওকে আমাদেরবাড়ি নিয়ে এলাম। লোকটা খুব মজার ছিলো। কথায় কথায় খুব হাসাতে পারতো। সুতরাং অতি অল্প সময়েই আমার এবং আমার বিবির প্রিয় পাত্র হয়ে উঠলো। আমরা এক সঙ্গে খেতে বসেছি। কিন্তু খাওয়ার ব্যাপারে ও ভীষণ লাজুক। কিছুই যেন খেতে চায় না। কিন্তু আমার বিবিও নাছোড়বান্দা। খাওয়াবেই। এক টুকরো মাছ জোর-জার করে ওর মুখে পুরে দিয়েছিলো সে। মাছের টুকরোটা গলায় আটকে গিয়ে বেচারা সঙ্গে সঙ্গেই মারা যায়। আমাদের চোখের সামনে। নিরুপায় হয়ে আমার স্ত্রী ওকে চাঁদর চাপা দিয়ে কাঁধে করে নিয়ে গেলো। এই হেকিমের বাড়ি। সঙ্গে আমিও ছিলাম। কড়া নাড়তেই একটা নিগ্রো নফরাণী দরজা খুলে দেয়। তার হাতে একটা সিকি দিনার দিয়ে বলি হেকিম সাহেবকে জলদি ডেকে আনো। রুগীর অবস্থা খুব খারাপ। নফরাণীটা ওপরে গেলো হেকিম সাহেবকে ডাকতে। ইতিমধ্যে আমার বিবি সিঁড়ির একটা ধাপের ওপর কুঁজোটাকে বসিয়ে দিয়ে আমাকে হিড়ী হিড় করে টেনে নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে। তারপর বোধহয় হেকিম সাহেব অন্ধকারে সিডি দিয়ে নামতে গিয়ে ধাক্কা খায়। তার ধারণা হয়, তার ধাক্কাতেই লোকটার জীবনান্ত হয়েছে। তাই না হেকিম সাহেব?
ইহুদী তখন মাথা নেড়ে বলে, একদম ঠিক।
দর্জি বলে, তাহলে, দারোগা সাহেব, ওকে ছেড়ে দিয়ে আমাকে ফাঁসী দিন।
দারোগা সাহেব হুকুম দিলো, ইহুদীকে ছেড়ে দাও। আর এই দর্জিকে ফাঁসীতে ঝুলাও। আমি এবার আসল লোককে পেয়ে গেছি। আর আমার হুকুমের রদবদল হবে না।
ইতিমধ্যে সুলতানের কানে গেলো। এই খবর। এই কুঁজোটা সুলতানের খুব প্রিয়পাত্র ছিলো। তার আগেরদিন সকালে সে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে পড়ে। সারাদিন মদ খেয়ে রাস্তায় রাস্তায় মাতলামী করে বেড়ায়। শেষে এক দর্জি তাকে বাড়িয়ে নিয়ে যায়। তারপর কিভাবে তার মৃত্যু ঘটে এবং দরোগা সাহেব সেই অপরাধে প্রথমে এক খ্ৰীষ্টান, পরে সুলতানের বাবুর্চি, তারপর এক ইহুদী হেকিম এবং সব শেষে ঐ দর্জিকে ফাঁসীর হুকুম দেয় তার বিস্তারিত বিবরণ শুনলো সুলতান।
–দর্জিটাকে কি ফাঁসী দেওয়া হয়ে গেছে।
–আজ্ঞে না, তাকে ফাঁসীর মঞ্চে দাঁড় করানো হয়েছে।
সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়সওয়ার পাঠানো হলো সুলতানের আদেশে। ফাঁসী রদ করার ফরমান দিয়ে ঘোড়সওয়ার ছুটলো কোটালের কাছে।
কোটাল এসে কুর্নিশ জানিয়ে সবিস্তারে জানালো সব বৃত্তান্ত। সুলতান অবাক হলেন। এমন ঘটনা জীবনে সে শুনেনি কখনও। নকলনবীশদের নির্দেশ দিলো, ঘটনাটা ভালো করে লিখে রাখে। এমন ঘটনা কি তোমরা কখনও কেউ শুনেছো?
সেই খ্ৰীষ্টান লোকটি এগিয়ে এসে বললো, হুজুর আমি আপনাকে আরও অবাক করার মতো গল্প শোনাতে পারি। যদি হুকুম করেন।
সুলতান বললো, নিশ্চয়ই। বলো, শুনবো।
তখন সুলতানকে কুর্নিশ জানিয়ে খ্ৰীষ্টানটি তার গল্প আরম্ভ করলো।