একদিন রাতে খলিফা হারুন-অল-রসিদ উজির জাফর অল-বারমাকীকে বললেন, আজ রাতে শহরের ভিতরটা একটু ভালো করে ঘুরে দেখতে চাই। আমার কাছে কিছু নালিশ এসেছে। নগরপাল এবং ওয়ালিরা নাকি তাদের কাজে গাফিলতি করছে। যদি প্রমাণ পাই, তবে ওদের বরখাস্ত করবো আমি।
জাফর সবিনয়ে বললো, হুজুরের যেমন মর্জি।
খলিফা, জাফর এবং খলিফার দেহরক্ষী মসরুর শহরের পথে বেরিয়ে পড়ে। এক সরুগলি দিয়ে যাবার সময় খলিফা দেখলেন, এক বৃদ্ধ ধীবর তার মাছধরা জাল মাথায় নিয়ে চলেছে। আর স্বগতোভাবে মনের দুঃখ প্রকাশ করছে।-এতো বড় শহরে সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খেটেও দু’খানা রুটি দিতে পারি না বাছাদের। কি নসীব নিয়ে জন্মেছি, খোদা। এই কি তোমার বিচার।
বৃদ্ধের কথা শুনে খলিফা এগিয়ে গেলেন। মনে হলো লোকটা অনেক দুঃখকষ্টে দিন কটায়। কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা বাবা, তোমার কীসের কারবার?
-আমি মাছ ধরে খাই, মালিক। বুড়ো হয়ে গেছি। খাটার বল কমে গেছে। কিন্তু সংসারটা কম না, বেশ বড় সড়। সেই দুপুর থেকে এখন পর্যন্ত খেটে চলেছি। কিন্তু আল্লাহর কি বিচার, এখন পর্যন্ত বাল-বাচ্চাদের মুখে দু’খানা-পোড়া রুটি যোগাবার পয়সা রোজগার হলো না। রোজ এই একই হল। চোখের সামনে ছেলেমেয়েদের কষ্ট আর সহ্য হয় না। খোদার কাছে আর্জি জানাই আর কেন, এবার কোলে টেনে নাও।
খলিফা বললেন, আমার একটা কথা শুনবে? নদীর ধারে চলো। টাইগ্রিস-এর পানিতে একবার মাত্র জাল ফেলবে তুমি! জালে যা উঠবে আমার। আর যদি কিছু নাও ওঠে। তবু তোমাকে একশো দিনার দেবো। তোমাকে দিয়ে আজ আমার ভাগ্য পরীক্ষণ করাতে চাই।
বৃদ্ধ উল্লসিত হলো, এ আর এমন কি কথা, চলুন মালিক।
টাইগ্রিসের তীরে এসে জাল ফেললো বৃদ্ধ। আস্তে আস্তে গুটিয়ে আনলো উপরে। মাছটাছ কিছু ওঠেনি। উঠে এসেছে একটা তালাবন্ধ বাক্স। পোল্লাই ভারি। খলিফার কাছ থেকে একশোটা দিনার নিয়ে খুশি হয়ে চলে গেলো বৃদ্ধ। জাফর আর মসরুর ধরাধরি করে বাক্সটা নিয়ে এলো প্রাসাদে! একটা চিরাগবাতি এনে আলো দেখালেন খলিফা। মসরুর ভেঙে ফেললো বাক্সের তালাটা। ডালোটা তুলতেই দেখলো, কতকগুলো তালের পাতা। পাতাগুলো সরাতেই চোখে পড়ে একখানা কর্পেট। তারপর একখানা সাদা বোেরখা। তারপর এক বীভৎস দৃশ্য—একটা মেয়েকে টুকরো টুকরো করে কেটে দেহাংশগুলো সাজানো আছে। শিউড়ে উঠলেন খলিফা। এ দৃশ্য চোখে দেখা যায় না। দু-হাতে চোখ ঢাকলেন তিনি চিৎকার করে জাফরকে বললেন, আমার সালতানিয়তে এই সব কাণ্ড ঘটছে, জাফর! তোমরা কেনো আছো আমার দরবারে। কি কর তোমরা, সব অপদাৰ্থ? এইরকম নিষ্ঠুরভাবে মানুষ মানুষকে খুন করছে। আর তোমরা আমাকে বোঝাচ্ছে, এমন ন্যায় বিচারের দেশ আর হয় না। যত্তে সব ধোঁকাবাজী। শোনো, জাফর, তোমাকে তিন দিনের সময় দিচ্ছি আমি। তার মধ্যে যদি এই খুনীকে ধরে না আনতে পারো তা হলে তোমার প্রাণ যাবে। ঐ যে দেখা দু দরবারের সিংদরজা-ওই দরজার পাল্লায় পেরেক দিয়ে গেঁথে মারা হবে তোমাকে। আর শুধু তোমাকে না, তোমার বংশের যত মেয়েপুরুষ আছে সবাইকে এনে কোতল করা হবে। তোমার বংশ আমি নির্বংশ করে দেবো। যাও, তিন দিনের সময় দিলাম। তার মধ্যে খুনীকে খুঁজে বার করো। এতো বড় একটা অপরাধ নিজের চোখে দেখে চুপচাপ সহ্য করতে পারি না আমি। এর বিহিত করতেই হবে আমাকে। তা না হলে আল্লাহর দরবারে শেষ বিচারের দিনে কী জবাবদিহি করবো আমি?
বিষণ্ণ মনে ঘরে ফিরে আসে জাফর। এতো বড় একটা শহর। কে কোথায় কাকে খুন করেছে কী করে তার হদিশ মিলবে। যে খুন করেছে সে কি সোধে এসে বলবে, আমি খুন করেছি? আর যে খুন করে, সেকি কোন সাক্ষীসাবুদ রেখে করে? আর যদি কারো চোখেই পড়তো তা সে তো নিজে থেকেই দরবারে এজাহার দিয়ে যেতো। এখন শুধু-মুদু রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে কোন ফয়দা আছে? একি গরুছাগল হারিয়েছে—যে খুঁজতে খুঁজতে এক সময় পাওয়া যাবেই। আর বিনা কারণে যাকে তাকে সন্দেহ করে ধরে আনাও তো ঠিক না। কারণ এ বিচারের একমাত্র সাজা প্ৰাণদণ্ড। তা সন্দেহ করে কোন লোককে পাকড়াও করে নিয়ে যাওয়া তো উচিত হবে না। আবার খালি হাতে গেলেও নিস্তার নাই। খলিফার মুখ থেকে একবার যে কথা বেরিয়েছে তার নড়াচড় হবার জো নাই। উভয় সংকটে পড়লো জাফর। একদিকে তার নিজের এবং পরিবারের প্রাণ সমস্যা-অন্য দিকে কোন নিরীহ লোকের জীবননাশের আশঙ্কা। অনেক ভেবেচিন্তে জাফর ঠিক করলো, যায় যাক প্রাণ, তবু সেমিথ্যাচার করতে পারবে না। যাকে তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে হাডি-কাঠে ঢুকিয়ে দেবার পাপ সে কিছুতেই করবে না।
তিন দিন কেটে গেলো। জাফর চিন্তায় জর্জরিত। দেহটাকে কোনরকমে টেনে নিয়ে এলো দরবারে। মৃত্যু অবধারিত। সে জন্যেও সে ভীত নয়। তার শুধু চিন্তা তার পরিবারের চল্লিশজন নিরপরাধী ছেলেমেয়ে নারীপুরুষেরও প্ৰাণ যাবে আজ তারই কারণে। এই পাপই বা সে রাখবে। কোথায়। চিন্তায় চিন্তায় জাফরের শরীর আধখানা হয়ে গেছে এই তিন দিনে।
চার দিনের দিন সকালবেলায় দরবারে এলো জাফর। খলিফা জিজ্ঞেস করলেন, খুনীর হদিশ পেয়েছো?
জাফর বলে, কেউ কি সোধে এসে আমাকে ধরা দিয়ে বলবে, সে খুন করেছে। আর সারা শহরে কোথায় খুঁজবো? না আমি হাত গুণতে জানি? না, লোকের মুখের চেহারা দেখে বোঝা সম্ভব?
জাফরের কথা শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো খলিফা। তোমার কোন ওজর শুনতে চাই না। আমি তোমাকে শূলে দেবো।
জল্লাদকে ডেকে হুকুম দিলো, জাফরকে দরবারের সদর দরজার পাল্লায় শূলে গেঁথে হত্যা করবে। তার আগে সারা শহরে ঢাড়া পিটিয়ে আমার এই ফরমান জারি করে দাও। যারা দেখতে চায় আসতে পারে।
খলিফার এই হুকুমনামায় শঙ্কিত হয়ে উঠলো শহরবাসী। তার মতো জ্ঞানীগুণী সজ্জন মানুষকে হত্যা করার কী কারণ ঘটতে পারে, কিছুই বুঝতে পারলানা কেউ। প্রতি ঘরে প্রতি জনে নানারকম জল্পনা করতে লাগলো। কেউ বললো, আহা বড় ভালো লোক ছিলো। কেউ বলে, অমন ইমানদার লোক আজকালকার দিনে হয় না। কেউ অনুমান করার চেষ্টা করে, নিশ্চয়ই এমন কোন মারাত্মক গোস্তাকি করেছে-যার জন্যে খলিফা ক্ষেপে আগুন হয়ে বারম্যাকী বংশ নির্বাংশ করে দিচ্ছে।
সারা শহর ভেঙে পড়লো প্রাসাদ প্রাঙ্গণে। এমন দৃশ্য দেখবে তারা স্বপ্নেও ভাবেনি। কান্নার রোল উঠলো। এমন একটা সাচ্চ আদমী আজ শূলে যাবে! যেন তাদের কোন আপনজন হারাতে বসেছে তারা। জাফর, আর তার পরিবারের সবাইকে সকলেই ভালবাসতো। তাদের আচার ব্যবহার, দয়াদাক্ষিণ্য সকলের মন কেড়ে নিয়েছিলো।
শূলে বিদ্ধ করার সব আয়োজন শেষ। এখন শুধু অপেক্ষা-খলিফার হুকুমের। হঠাৎ একটা সোরগোল পড়ে গেলো। এক যুবক ভীড় ঠেলে খলিফার একেবারে সামনে এসে দাঁড়ালো। মাটিতে দু-হাত ছুঁইয়ে কুর্নিশ জানালো খলিফাকে। তারপর বললো, আপনি আল্লাহর পয়গম্বর দীনদুনিয়ার মালিক, আপনাকে আমার একটা কথা বলার আছে।
–কী কথা?
আপনি জাফর সাহেবকে বিনা দোষে হত্যা করবেন না। আমিই সেই আসামী। আমিই ঐ
রেহাই দিয়ে আমাকে হত্যা করুন, জাঁহাপনা। ওঁর কোন দোষ নাই!
যুবকের কথা শুনে জাফরের অন্তর ব্যথায় টনটন করে ওঠে। আহা, বেচারা। কিন্তু নিজের পক্ষে যে এটা কত বড় আনন্দের খবর তা সে ভুলেই গেলো। যুবকের কাছ থেকে বিস্তারিত বিবরণ শোনার জন্য প্রশ্ন করতে যাবে এমন সময় পিছন থেকে এক বৃদ্ধ এগিয়ে এলো সামনে।
-ওর কথা বিশ্বাস করবেন না, হুজুর। ও সব বানিয়ে বলছে। আসলে খুন করেছি আমি। শাস্তি যা দেবার আমাকে দিন, হুজুর। যুবক তখন প্রতিবাদ করে বলে, উজির সাহেব, লোকটার বোধহয় মাথা খারাপ হয়েছে। আপনি ওর কথা শুনবেন না। যেমন আপনার ইচ্ছে সেইরকম শাস্তি আমাকে দিন; আমি মাথা পেতে নিচ্ছি।
বৃদ্ধ তখন যুবকের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো, বাবা, তোমার বয়স কম; আমি বুড়ো হয়ে গেছি। আজ বাদে কাল মরে যাবো। কেন বাধা দিচ্ছে। আমার এই বরবাদ হয়ে যাওয়া জানটার বদলে তোমার, উজির-সাহেব। আর তার পরিবারের সকলের জান যদি বাঁচে তাতে আমার চেয়ে আর কেউ বেশী সুখী হবে না। তুমি বাধা দিও না, সরে যাও। জাঁহাপনা আমি আবার বলছি, আমিই সেই খুনী। আমাকে শাস্তি দিন।
খলিফা হারুন-অল-রাসিদ মহা ফাঁপরে পড়লেন। এ আবার কি অদ্ভুত কথা। জাফরকে বললেন, ওদের দু’জনকেই শূলে চাপাও।
জাফর বললেন, কিন্তু একজনের অপরাধে দু’জনের প্রাণদণ্ড-এ যে ঘোরতর অবিচার হবে, জাঁহাপনা।
যুবক তখন চিৎকার করে বলতে থাকে, এই চন্দ্র সূৰ্য গ্বহতারা যার হুকুমে কাজ করে সেই পরম পিতা আল্লাহর নামে হলফ করে বলছি, খুন। আমি করেছি। এবং তার প্রকৃত প্রমাণ আমি খাড়া করতে পারি।
এই বলে যুবক কী করে মেয়েটাকে খুন করেছিলো তার আদ্যোপোন্ত ঘটনা বিবৃত করলো। যুবকের বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো খলিফার। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী করে খুন করেছিলে তাতো শুনলাম। কিন্তু কেন খুন করেছিলে, সে কথা বলতো! আর খুন করে সব প্রমাণপত্ব লোপাট করার জন্যে যদি লুকিয়ে ছুপিয়ে লাশটাকে নদীর পানিতেই ডুবিয়েই দিয়েছিলে, তবে আর নিজে থেকে এসে ধরাই বা দিলে কেন? কী ব্যাপার?
যুবক তখন বলতে থাকে। তবে শুনুন জাঁহাপনা, এই মেয়েটি আমার শাদী করা বিবি। এই বৃদ্ধ তার বাবা-আমার শ্বশুর। অনেক দিন আগে আমাদের শাদী হয়েছে। একসঙ্গে ঘর করেছি। সুখে দুঃখে। আমার তিনটি সন্তানের মাসে। আদর্শ ঘরণী হিসাবে কোন খুঁত ছিলো না তার। আমি তার স্বামী-আমার ওপর তার গভীর ভালোবাসা ছিলো বরাবরই।
এই মাসের গোড়ার দিকে সে অসুখে পড়ে। আমার সাধ্যের অতীত নামকরা হেকিমকে দিয়ে দেখলাম। দাওয়াই পত্র খাওয়াতে লাগলাম। আমার দোকান-পাট মাথায় উঠলো। বিবির বিমার আর সারতে চায় না। দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়তে লাগলো সে। কয়েকদিন বাদে জুরের প্রকোপটা একটু কমলো বটে, কিন্তু একেবারে ছেড়ে গেলো না। মুখে রুচি নাই। কিছুই খেতে পারে না। ঘুসঘুসে জ্বর প্রায় সারাদিন লেগেই থাকে।
একদিন আমাকে বললো, কিছু খেতে রুচিছে না মুখে। যদি পারো ভালো দেখে আপেল পাও তো নিয়ে এসে।
কিন্তু সারা বাজার টুড়েও কোন ভালো জাতের আপেল পেলাম না একটা। পাওয়া গেলো না, পাওয়া যাবে না একথা মুখ ফুটে বলতে পারলাম না তার কাছে। তখন আমার একমাত্র চেষ্টা, কী করে তাকে ভালো করা যায, কী করে তাকে খুশি রাখা যায়, কী করে তার মুখে একটু হাসি ফোটানো যায়।
রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবলাম, কাল সকালে আপেলের বাগানে যাবে। যদিও এটা আপেলের মরশুম না, তবু কোন কোন গাছে দু-চারটে আপেলও তো ধরতে পারে।
ভোর না হতেই বেরিয়ে পড়লাম। অনেকগুলো বাগানে ঘুরলাম। কিন্তু না, কোন গাছেই আপেল নাই। শেষে এক বাগানের বৃদ্ধ মালিক আমাকে বললো, এ সময়ে আপেল পাওয়া খুবই মুসকিল বাছা। এ তল্লাটে কোথাও পাবে না। একমাত্র পাওয়া গেলেও যেতে পারে–যদি বসরোহর বড় বাজারে যাও। ওখানে কিছু ফল আসে। তবে শুনেছি, সে আপেল সাধারণ লোকের খাবার জন্যে বিক্ৰী হয় না। সবই চলে যায় খলিফার প্রাসাদে।
বাড়ি ফিরে এসে বিবিকে বললাম সব কথা। শুনে সে নির্বিকারভাবে বললো, পাওয়া যখন যাবে না, -তুমি আর কি করবে।
মনটা আমার খারাপ হয়ে গেলো। ঠিক করলাম, বসরোহর বাজারেই যাবো; পনেরো দিনের পথ। পথের শ্রান্তির কথা ভুলে গেলাম। আল্লাহর নাম নিয়ে বসরোহর পথে পা বাড়ালাম।
বরাতের জোরে তিনটি আপেল জোগাড় হলো। ইনাম মোট তিন দিনার। তা হোক। বিবির যদি মুখে রুচি ফিরে আসে তা হলেই আমার এতো পরিশ্রম, এতো দাম দিয়ে কেনা সার্থক হবে।
মনে বড়ো আশা নিয়েবাড়ি ফিরলাম। আপেল কটা দেখে নিশ্চয়ই সে খুশি হবে। কিন্তু না, আপেল তিনটে হাতে করে নিয়ে একপাশে রেখে দিলে সে। বোধ হয়। শরীরটা আবার বেশি। খারাপ হয়েছে। আমিও মুসড়ে পড়লাম। পরে শুনলাম, আমি যে দিন বসরোহর বাজারে আপেল সওদা করতে রওনা হয়ে গিয়েছিলাম। সেইদিনই আবার কাঁপিয়ে জ্বর এসেছিলো তার। গতকাল থেকে একটু কম।
আমার আর দোকান-পাট খোলা হলো না। বিবির শয্যাপার্শ্বে বসে রইলাম এক হগুপ্ত। এই কদিনের দাওয়াইপত্র আর আমার অক্লান্ত সেবা শুশ্রুষায় একটু ভালোর দিকে মনে হলো।
স্মরণ করে দোকানে গিয়ে বসলাম পরদিন। ঠিক দুপুর বলা যায় না। তখনও—দেখলাম একটা নিগ্রো ছোড়া একটা আপেল এক হাত দিয়ে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে অন্য হাতে লুফতে লুফতে এগিয়ে চলেছে।
—ও ভাই, শুনছো, নিগ্রো ছেলেটাকে ডাকলাম আমি। আচ্ছা বলতে পারো, এই অসময়ে এই আপেলটা কোথায় পেলে তুমি?
-আমার পিয়ারীর কাছ থেকে পেয়েছি, কেন?
–পিয়ারী, কে তোমার পিয়ারী? কোথায় থাকে সে?
নিগ্রো যুবকটা বেশ গর্বের সঙ্গেই জবাব দেয়, ঐ যে তীতীপাড়ায় ঢুকতে একটা ছোট্ট তালাও আছে না? সেই তালাও-এর পশ্চিম পাড়ের যে জাফরানী রঙের বাড়িটা-সেই বাড়ির একটা মালিকের বিবি আমার ভালোবাসা। লোকটা এমন হাঁদা কিসসু বোঝে না। বিবি-অন্ত প্ৰাণ। ব্যাটা মেয়েমানুষের কথায় ওঠ বোস করে। ওর বিবিটার আজ মাস-খানেক বিমার। আহাম্মকটা পনেরো দিনের পথ হেঁটে বসরাহর বাজারে গিয়েছিলো আপেল আনতে। মনে আশা, যদি সে খুশি হয়। আমি আজ গিয়ে দেখি ওর বিছানার পাশে তিনটি আপেল। আমাকে এটা খেতে দিলো।
আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যেতে লাগলো। আপনি বিশ্বাস করুন জাঁহাপনা, সেই মুহূর্তে মনে হলো সারা দুনিয়াটা মিথ্যে মস্ত বড় একটা ধাপ্পা। মাথাটা তু, বোঁ বৌ করে ঘুরতে লাগলো। এই বিশ্বসংসার সব অন্ধকার হয়ে! গেলো আমার চোখের সামনে। ক্ৰোধে উন্মত্ত এক সিংহের মতো এ ছুটে এলাম বাড়িতে—আমার বিবির ঘরে। হাতে আমার শাণিত * ছোরা। কোন প্রশ্ন করলাম না, কোন কিছু জানতে চাইলাম না। শুধু একবার তাকিয়ে দেখলাম, আজ সাতদিন ধরে যেখানে তিনটি আপেল রাখা ছিলো। সেখানে আজ দুটি আছে—আর একটা নাই। কোথা দিয়ে কী হয়ে গেলো জানি না, দেখলাম আমার ছুরিটা আমূল বসে গেছে আমার বিবির বুকে। এক অসহায় আর্তনাদ করে থেমে গেছে তার বুকের সম্পন্দন—চিরদিনের মতো।
যখন আমার জ্ঞান ফিরে এলো, ভয়ে প্ৰাণ শুকিয়ে গেলো। আমি খুন করে ফেলেছি। আমার ফাঁসী হবে। আতঙ্কে শিউড়ে উঠলাম। এখন কি করা যায়? হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি এসে গেলো। ক্ষিপ্র হস্তে খাটের তলা থেকে একটা বাক্স টেনে বের করলাম। বিবির হাত, পা, ধড়, মুণ্ডু সবটুকরো করে কেটে বাক্সটায় ভরলাম। কাপেট আর ওর বোরিখটায় রক্ত লেগে গিয়েছিলো। ও দু’টোও বাক্সে ভরে তালের পাতা দিয়ে ঢেকে বন্ধ করে দিলাম। ডালাটা। একটা তালা এটে মাথায় করে নিয়ে গিয়ে ফেলে দিয়ে এলাম টাইগ্রিসের জলে।
যুবক থামলো একটু। তারপর কাতর অনুনয় জানিয়ে বললো, আপনি ন্যায়বিচারক, আল্লার পয়গম্বর, আপনার কাছে আমার আর্জি, যতো তাড়াতাডি হয় আমার প্রাণদণ্ড মঞ্জর করুন। তা না হলে আল্লাহর দরবারে আমাকে আরও কঠোর সাজা পেতে হবে।
আমি যখন টাইগ্রিসের জলের তলায় বাক্সটা ডুবিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরলাম দেখি, আমার বড় ছেলেটা সরজার সামনে বসে আকুল নয়নে কাঁদছে। জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে, কাঁদছিস কেন?
কাঁদতে কাঁদতে ও বলতে থাকে, মায়ের বিছানার পাশ থেকে একটা আপেল নিয়ে গিয়েছিলাম খেলা করতে। মা টের পায়নি। ঘুমিয়েছিলো। ভেবেছিলাম খেলাটেলা শেষ করে আবার ওখানে রেখে আসবো। কিন্তু পথ দিয়ে যাচ্ছিলো একটা তাগড়াই নিগ্রো। আমার গালে দু’টো থাপ্পড় দিয়ে আপেলটা কেড়ে নিয়ে দু-হাতে নাচাতে নাচাতে চলে গেলো। লোকটা কী জাঁদরেল। বাবাঃ দেখলে পিলে চমকে যায়।
ওর কথায় বুঝলাম, আপেলটার জন্যে সে বাড়ির ভিতরে ঢুকতে সাহস করেনি। সদর দরজার ওপর বসে কাঁদছিলো। আহা বেচারী, ওর মা যে আর এ জগতে নাই, সে খবরও জানে না।
ছেলের কথায় বুঝলাম, যে ভুল আজ করলাম তার আর কোন চারা নাই। হারামজাদা নিগ্রোর বাচ্চা—একেবারে ডাহা মিথ্যা কথা বলে গেছে। বিবির কোনও দোষ ছিলো না। একটা নিষ্পাপ। মেয়েকে খুন করার পাপ বোধ। দংশন করতে লাগলো আমাকে। আমি আর আমার এই শ্বশুর সারা রাত ধরে কাঁদলাম।
আজ পাঁচদিন হলো আমি খুন করেছি। আমার আদরের বিবিজানকে। পাঁচটা রাত ঘুমুতে পারিনি। মনের শোকতাপ প্রকাশ করতে পারিনি কারো কাছে। পারলেও বা কিছুটা হালকা হতো বুকের জ্বালা। অপরাধী আমি, আমার শাস্তি একমাত্র মৃত্যু। আপনি আমার ভাগসুবিধাতা, আল্লাহর পয়গম্বর। আপনার কাছে আমার একটাই আর্জি, আপনি আমাকে যত তাড়াতাডি হয় শূলে দিন। আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে দিন আমাকে।
খলিফা বিস্ময়ে হতবাক। কয়েকটা মুহুর্তমাত্র। তারপর চিৎকার দিয়ে উঠলেন, আমি ওই বদমাইশ নিগ্রোটাকে শূলে দেবো। এতো বড় একটা সর্বনাশ সে করেছে?
এই সময় প্রভাত সমাগত দেখে গল্প থামিয়ে চুপ করলো শাহরাজাদ।
তারপর শুনুন শাহজাদা, শাহরাজাদ আবার উনিশতম রজনীর দ্বিতীয়যামে গল্প শুরু করলো, খলিফা দেখলেন, যুবকের কোন দোষ নাই। যত নষ্টের মূল ঐ নিগ্রোটা। বললেন, আমি ঐ নিগ্রোটাকে শূলে চড়াবো, ধরে নিয়ে এসো তাকে। তাকে যদি ধরে আনতে না পারো জাফর, তাহলে তোমাকেই শূলে চাপবো আমি।
জাফর কাঁদতেকাঁদতে বাড়ি গেলো।—কোথায় পাবো তাকে। কোথায় থাকে সেই নিগ্ৰো—কে তার হদিশ দেবো? এ যাত্রায় যদি বা বাঁচলাম, কিন্তু এর পরে বোধহয় বাঁচার আর কোন আশা নাই। এখন আল্লাহ ছাড়া আর কেউ বাঁচাতে পারবে না আমাকে।
তিন দিন আরবাড়ি থেকে কোথাও বের হলো না। মনে মনে ভাবে এই তিন দিনে যদি খলিফার রাগ পড়ে যায়। যদি তিনি তাকে অব্যাহতি দেন। কিন্তু লোক মারফৎ খবর পাওয়া গেলো খলিফা প্রতীক্ষা করে বসে আছেন। জাফর নিগ্রোটাকে ধরে নিয়ে যাবে। আর তিনি তাকে শূলে চাপাবেন! আর যদি ধরে না নিয়ে যেতে পারে তবে তার মরার ব্যবস্থা পাকা করে রেখেছেন sSf
কাজীকে ডেকে পাঠালো জাফর। তার বিষয় সম্পত্তির উইল বানালো বাচ্চাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দরবারে যাবার জন্য তৈরি হতে লাগলো। একে একে সবাইকে আদর জানালো; সব শেষে সবচেয়ে ছোট মেয়েটাকে কোলে তুলে নিয়ে চুমু খেতে যাবে এমন সময় ওর কামিজের পকেটে কি একটা গোলাকৃতি বলের মতো বস্তু অনুভব করলে সে। অশ্রু রুদ্ধ কণ্ঠে জাফর
—একটা আপেল আব্ববাজান, আপেলটা বের করে দেখালো সে।–দিন চারেক আগে আমাদের নিগ্রো নফর রেহান আমাকে কোথা থেকে এনে দিয়েছে।
‘নিগ্রো’ এবং ‘আপেল’ এই শব্দ দুটো শুনে কেমন যেনো ফ্যাকাশে হয়ে গেলো জাফরের মুখ। এক মুহূর্ত। তারপর এক অদ্ভুত আনন্দে নেচে উঠলো তার সারা দেহ মন। তক্ষুণি ডেকে পাঠালো তাকে। রেহান এলে জিজ্ঞেস করলো, এই আপেলটা কোথায় পেয়েছিলি রে?
নিগ্রোটা বললো, আজ্ঞে মালিক, কদিন আগে পথ দিয়ে যেতে যেতে দেখি, কয়েকটা বাচ্চা খেলা করছে। একজনের হাতে ছিলো এই আপেলটা। আমি ওকে দু’টো থাপ্নড় দিয়ে কেড়ে এনেছিলাম। আমাদের খুকুমণির জন্যে। ছেলেটা কেঁদে উঠে ফেরৎ চেয়েছিলো আমার কাছে। ‘নিও না, ফেরৎ দিয়ে দাও। ওটা। আমার মা আমাকে খুব বকবে। তার ভীষণ অসুখ। বাবা সেই বাসরাহর বাজার থেকে তিনটি আপেল কিনে এনেছে মার জন্যে। মা একটাও খায়নি। আমি একটা চুরি করে এনেছি। ফেরৎ দিয়ে দাও আমাকে, তোমার দু’টো পায়ে পড়ি। না হলে মা আমাকে মারবে।’ আমি কিন্তু ওর কথায় কান না দিয়ে লুফতে লুফতে চলে এলাম। আমার তখন মনে ঘুরছে, খুকুমণি আপেলটা পেলে খুব খুশি হবে।
জাফর বড় সমস্যায় পড়লো। তার নিজের গৃহভৃত্য এর সঙ্গে জডিত। ব্যাপারটা কেউ ভালো চোখে দেখবে না। কিন্তু হতভাগাটা একি কাণ্ড করে বসেছে। এই হ্যাপা এখন কী করে সামাল দেবে সে? খলিফার যা রাগ, তাতে তো রেহাই দেবে বলে মনে হয় না। যাক, ভেবে আর কী হবে? রেহানকে বন্দী করে দরবারে নিয়ে এলো সে।
জাফর ভাবে, নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে দু-দুবার কীভাবে সে রক্ষণ পেলো। একেই বলে আল্লাহ যাকে বাঁচাবেন, মারবে কার সাধ্য?
প্রাসাদে এসে সমস্ত বৃত্তান্ত খুলে বললো খলিফাকে। খলিফা শুনে তো অবাক।—এমন অদ্ভুত ব্যাপার তো জীবনে কখনও শুনিনি। সামান্য একটা তুচ্ছ ঘটনা একটা মানুষের জীবন নাশের কারণ; সে কথা কি ভাবতে পারে কেউ?
জাফর বলে, তাই হয় জাঁহাপনা। কোন একটা তুচ্ছতিতুচ্ছ ঘটনাই অনেক বিরাট বড় একটা ঘটনার মূলসূত্র হতে পারে। সবই আল্লাহর খেলা। সবই নিয়তি। তা না হলে বেচারী যুবকটাই বা তার অতো পেয়ারের বিবিকে বিনা দোষে খুন করতে যাবে কেন? ওর হাতে ওর বিবির মৃত্যু নিয়তির লেখা ছিলো। ঐ আপেল আর নিগ্রোটার বোকামী সবই উপলক্ষ মাত্র। যাই হোক আপনাকে আমি এর চেয়েও অবাক করার মতো কাহিনী শোনাতে পারি জাঁহাপনা। উজির নূর-আল-দীন আর তার ভাই সামস-আল-দীন-এর কাহিনী—আপনি শুনেছেন?
–না। কী সেই কাহিনী, শোনাও দেখি। জাফর বললো, বলবো নিশ্চয়ই। # কিন্তু আপনার কাছে আমার একটা আজি—ঐ বেচারী নিগ্রোটাকে আপনি রেহাই দিন ওটা একটা বোকা পাঠা। কিসে থেকে কি ঘটতে পারে সে চৈতন্য ওর নাই! ওর বোকামীর ফলে যা ঘটে গেছে তা আর ফেরানো যাবে না। কিন্তু এও ঠিক, খুন করার জন্যে খুন করা, আর তার অজ্ঞাতসারে বোকামীর জন্যে কেউ খুন হয়ে যাওয়া এক নয়। ও জানেও না। ওর একটা মিথ্যে কথা বলার জন্যে কী ঘটে গেছে। তাই আপনার কাছে আমার নিবেদন, আপনি ওর দোষ মাফ করে দিন। আমি আপনাকে আরো অদ্ভুত, অবাক করার মতো কাহিনী শোনাচ্ছি।
খলিফা বললেন, ঠিক আছে আমি ওকে রেহাই দিয়ে দিলাম। সত্যিই তো, এই গুরুদণ্ড পাওয়ার মতো গোস্তাকি সে করেনি।