—ধীবর বলতে শুরু করে। তবে শোনো : পুরাকালে রুম দেশে ফার শহরে এক প্রবল প্রতাপ
ধনদৌলত ছিলো তার। কিন্তু মনে কোন শান্তি ছিলো না। সারা দেহে দুরারোগ্য কুণ্ঠব্যাধি। কত না ডাক্তার কবরেজ দেখিয়েছে। কিন্তু কেউ সারাতে পারে নি। কত শত জডিবাডি খেয়েছে। কত রকমের মলম মালিশ লাগিয়েছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি।
একদিন এক বৃদ্ধ হেকিম এলো বাদশাহর কাছে। শুধু বয়সে না, জ্ঞানেগুণেও সে বৃদ্ধ। তার নাম রায়ান। নানা ভাষায়, নানা বিদ্যায় তার তুল্য পণ্ডিত সে তল্লাটে কেউ ছিলো। কিনা সন্দেহ! গ্ৰীক, পার্শি, ল্যাটিন, আরবি-নানা ভাষার কিতাব পড়তে পারতো সে। নানা দেশের নানা বিদ্যা রপ্ত করেছিলো। গাছ-গাছড়ার গুণাগুণ বেশ ভালো ভাবে শিখেছিলো।
সুলতান য়ুনানের দরবারে এসে সালাম জানালো রায়ান-আমি আপনার ব্যাধির খবর পেয়ে এসেছি। শুনেছি, আপনার ব্যাধি নাকি দুরারোগ্য। কোন ওষুধেই নাকি তা সারানো যায় না। কিন্তু আমি আপনাকে সারিয়ে তুলবো। শুধু এই জন্যেই এ শহরে আমি এসেছি। আপনি সারা দেশের সুলতান। আমি এক নগণ্য হেকিম। আমাকে আপনি জানেন না, চেনেন না। আমার দেওয়া দাওয়াই আপনি খাবেন কেন? আমি দেবোও না। না, খাওয়ার বা লাগাবার কোন ওষুধ দেবো না আপনাকে।
তবে, সুলতান কৌতুহলী হয়, কী করে সারাবে শুনি? যাই হোক, যদি সারাতে পারো আমার এই দুরারোগ্য ব্যাধি, তাহলে যা চাও—অঢেল ধনদৌলত পাবে। শুধু তুমি না, তোমার ছেলেমেয়ে, নাতিনাতনি-বংশানুক্রমে মাসোহারা পাবে আমার কাছ থেকে। তোমাকে আমার সভার প্রধান পারিষদ করে রাখবো। তুমি হবে আমার আপনজন। বন্ধু।
এই বলে বাদশাহ য়ুনান সূক্ষ্ম কারুকার্য করা, মূল্যবান একখানা শাল উপহার দিলো রায়ানকে। তোমার যেমন ইচ্ছে সেইভাবে আমার চিকিৎসা করতে পারো, কোন আপত্তি নাই। আমার শুধু একমাত্র আশা, তুমি আমার রোগ সরিয়ে দেবে।
রায়ান ভরসা দিলো, আপনি নিশ্চিত থাকুন, হুজুর। আমি আপনাকে সম্পূর্ণ সারিয়ে তুলবো।
অনেকদিন বাদে সুলতানের মুখে হাসি দেখা গেলো, তাহলে আর দেরি করে কী লাভ? কাল থেকেই শুরু করো, বন্ধু!
রায়ান মাথা নুইয়ে সম্মতি জানালো, তাই হবে জাঁহাপনা।
প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে নিজের বাসায় ফিরে এলো রায়ান। ভাড়া করা একটা ঘর। শহরে এসেই এই ঘরটা ভাড়া করেছে। তার যতো সব গাছ-গাছড়া, জড়িবড়ি আর মোটা মোটা বইপত্তরে ঘরটিা ভরে গেছে।
প্রথমে একটা ওষুধ বানালো রায়ান। তারপর একটা ফাঁপা বাঁশের লাঠির মধ্যে পুরলো সেই গাছ-গাছড়ায় তৈরি খানিকটা ওষুধ। লাঠিটার মাথায় হাতল লাগিয়ে দিলো। এবার তৈরি করলো একটা পোলো বল। ভেতরে পুরে দিলো খানিকটা ওষুধ।
পরদিন সকালে সেই ছডি আর বল নিয়ে প্রাসাদে এলো রায়ান। আভুমি আনত হয়ে সুলতানকে কুর্নিশ করলো। তারপর বললো, আজ থেকে আপনাকে ঘোড়ায় চেপে পোলো খেলতে হবে। এই নিন। আপনার ছডি আর বল। ঘোড়ায় চেপে ছডিটা মুঠো করে ধরে পোলো খেলতে থাকবেন। যতক্ষণ না সারা শরীরে দর দর করে ঘাম ঝরে ততক্ষণ খেলবেন। তারপর প্রাসাদে গিয়ে বেশ ভালো করে গোসল করবেন। আর কিছু করতে হবে না। আপনাকে। এই আপনার চিকিৎসা। এতেই আপনি সেরে উঠবেন।
রায়ানের কথা মতো বাদশাহ য়ুনান তার আমির-অমাত্য-ওমরাহ-উজির-নাজির সমভিব্যাহারে ময়দানের দিকে রওনা হলো। সঙ্গে ধন্বন্তরী রায়ান।
ময়দানে পৌঁছে কী করে ছডিটা ধরতে হবে-নিজের হাতে ধরে শিখিয়ে দিলো রায়ান। ঘোড়ার পিঠে চেপে শক্ত মুঠিতে ছডিটা ধরে পোলো খেলতে লাগলো সুলতান। এক সময় ঘেমে নেয়ে গেলো সারা শরীর।
রায়ান থামিয়ে দিলো। আজ এখানেই থামান। এবার প্রাসাদে ফিরে গিয়ে হামামে ঢুকে পড়ুন।
সেদিন রাত্রে সুলতানের সুখ নিদ্রা হলো। সকালে উঠে। মনে হলো, দেহের জড়তা যেন অনেকটা কেটে গেছে। খুশি খুশি মেজাজ। ফুর্তি ফুর্তি ভাব।
রায়ান আসতেই সাদরে ডেকে কাছে বসালো। বললো, অনেকটা আরাম বোধ করছি। সেদিনও তাকে এক মূল্যবান পোশাক উপহার দিলো সুলতান। তারপর সদলবলে রওনা হয়ে গেলো ময়দানের দিকে।
এইভাবে আরও কয়েকটা দিন কাটলো। বাদশাহ দেখলো, তার দেহ থেকে কুষ্ঠের ক্ষতিগুলো আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। দারুণ আনন্দ হলো মনে।
রায়ান প্রতিদিনই দরবারে আসে। বাদশাহর সঙ্গে দেখা করে। খুশি হয়ে রোজই মূল্যবান সামগ্ৰী উপহার দেয় বাদশাহ।
একদিন লক্ষ্য করলো বাদশাহ, তার শরীরে আর কোন কুণ্ঠব্যাধি নাই। রায়ানকে ডেকে অনেক ধনদৌলত, মূল্যবান পোশাক-আশাক-অনেক কিছু দান করে দিলো। তার মনে আজ আনন্দের সীমা নাই।
তার এই দান-ধ্যান উজিারের সহ্য হলো না! হিংসায় কাতর সে। সুলতানের বিশ্বস্ত অমাত্য। প্রয়োজন হলে নিজের জানকেও কবুল করতে পারে সুলতানের জন্যে। সে কথা জানেনও তিনি। অথচ তার ওপর কোন নজর নাই বাদশাহর। কোথাকার কে এক গুপ্তচর্য! তাকে নিয়ে এতো
পরদিন সকালে খুস মেজাজে দরবারে এসে বসলো বাদশাহ। তার দুই পাশে আমি-অমাত্য-উজির-সবাই নত মস্তকে দণ্ডায়মান। একটু পরে রায়ান এলো। বাদশাহ শশব্যস্ত হয়ে উঠে এলো সিংহাসন ছেড়ে। বুকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে গিয়ে বসালো তার পাশের আসনে। সে আসনে সমমর্যাদার কোন সুলতান ছাড়া বসতে পায় না।
বাদশাহর এবংবিধ আচারে ক্ষুব্ধ হলো অনেকেই। চাপা গুঞ্জন উঠলো দরবারে। কিন্তু মুখ ফুটে বলতে সাহস নেই কারও।
সেই হিংসা-কাতর উজির ফুসতে লাগলো। ভেতরটা জুলে পুড়ে খাক হয়ে যেতে থাকলো। সব মানুষই কাউকে না কাউকে হিংসা করে। কেউ প্রকাশ্যে কেউ মনে মনে। যারা দৃঢ়চেতা তারা প্রকাশ্যে করে। আর যারা হীনমন্য তারা করে মনে মনে।
সেই উজির বাদশাহর সামনে এগিয়ে এসে কুর্নিশ করে বললো, জাঁহাপনার শতায় কামনা করি, বাদশাহ চিরজীবী হোন, প্রার্থনা করি। এই অধমের একটা ছোট্ট আর্জি আছে আপনার দরবারে। কথাটা বলবো বলবো করেও বলতে পারি না। কিন্তু আমি আপনার একান্ত অনুগত, বিশ্বস্ত নোকর। না বলাও গুনাহ৷
উজিরের এই ভণিতায় বিরক্ত হয়ে বাদশাহ কিছু রুষ্টভাবেই বললো, সোজাসুজি খুলে বলে।
কী বলতে চাও?
–আমার গোস্তাকি মাফ করবেন জাঁহাপনা, যে লোক দানের যোগ্য নয় তাকে দান মানে অপাত্রে দান। যে গ্রহীতা শ্রদ্ধা না করে দান গ্রহণ করে সে পরম শত্ৰু।
–হেয়ালী রাখো, বাদশাহ গর্জে ওঠে, কে সেই লোক, নাম বলো।
উজির তখন আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলে, এই হেকিম রায়ান। তার যা প্রাপ্য নয়। তাই তাকে আপনি দিচ্ছেন। আর সে অকৃতজ্ঞভাবে আত্মসাৎ করছে। ও আপনার পরম শত্রু। এইভাবে দিতে থাকলে আপনার আস্ত খাজাঞ্চিখানাই ও গিলে ফেলবে।
–থামো। ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয় উজিরকে। কার সম্বন্ধে কী ভাবে কথা বলতে হয় তাও ভুলে গেছে দেখছি। তামাম দুনিয়ায় যদি একজনও পরম প্রিয় আপনজন থাকে আমার তা সে এই রায়ান। সে আমাকে নতুন জীবন দিয়েছে। আমার দুরারোগ্য কুণ্ঠ ব্যাধি সারিয়েছে। তার বদলে কতটুকু দিয়েছি তাকে! আমার সাল-তানিয়ৎটাই যদি তাকে দিয়ে দিই তাও এমন কিছু বেশি দেওয়া হয় না। তার পাওনা শোধ করা যায় না। তার ঋণ পরিশোধ হয় না। না না, এসব কথা তোমার মুখে সাজে না উজির। তুমি হিংসায় জুলছে। তোমার দিল সাফা করো। বাদশাহ সিনবাদকে নিয়ে ঠিক এই ধরনের একটা কাহিনী শুনেছিলাম—কোন এক পারিষদের কাছে।
এই সময় সুলতানের অনুমতি নিয়ে দরবার ছেড়ে চলে গেলো রায়ান।
শাহরাজাদ দেখলো প্রভাত সমাগত। এবার সে থামালো। দুনিয়াজাদ খুশিতে গদগদ হয়ে বলে, বাঃ মিষ্টি, কী সুন্দর তোমার গল্প দিদি।
শাহরাজাদ বলে। এর চেয়েও ভালো কাহিনী শোনাতে পারি বোন, যদি বেঁচে থাকি। শারিয়ার ভাবে, বাকী গল্পগুলো শোনার জন্যে আরও কিছুদিন ওকে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে।
পরদিন পঞ্চম রজনীতে শাহেনশাহ শারিয়ারের অনুমতি নিয়ে আবার গল্প শুরু করে শাহরাজাদ। শুনুন শাহজাদা, সেই বাদশাহ য়ুনান তার উজিরকে ভর্ৎসনা করতে লাগলো, তোমার দিল সাফা করো উজির। তুমি হিংসায় জুলছো। তোমরা হয়তো চাও, রায়ানকে আমি হত্যা করি। এবং বাদশাহ সিনবাদ যেমন তার প্রাণ-প্রিয় বাজপাখীটাকে হত্যা করে অনুতাপের অনলে দগ্ধ হয়েছিলো, তেমনি আমিও দগ্ধ হতে থাকি।
উজির জানতে চাইলো, সিন্বাদের সেই কাহিনী আমি শুনিনি জাঁহাপনা। যদি মেহেরবানী করে শোনান, বুঝতে পারি।