—তাহলে শুনুন, জাঁহাপনা। শাহরাজাদ শুরু করে। কোন এক সময়ে এক। কোটিপতি ধনী ব্যবসায়ী ছিলো। তামাম দুনিয়ায় যতো ধনী ছিলো তাদের সকলের সেরা সে। এক সময়ে বাণিজ্যের অন্বেষণে ঘোড়ায় চেপে নানা দেশ ঘুরে বেড়াতে থাকে সে। একদিন মধ্যাহ্ন সূর্যের খরতাপে দগ্ধ হয়ে শ্ৰান্ত হয়ে এক বিশাল বটবৃক্ষের ছায়ায় এসে বসলো সেই সওদাগর।
খাবারের ডিবেটা বের করে খান কয়েক চাপাটি একটু শব্জী। আর একটা ফল নিয়ে খানা শেষ করলো। হাত মুখ ধুয়ে মুখ তুলতেই দেখে সামনে দাঁড়িয়ে এক বিশাল আফ্রিদি দৈত্য। হাতে তার শাণিত খাড়া। বলে, উঠে দাড়াও, আমি তোমাকে খুন করবো।
ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বণিক বললো, আমার কী গুনাহ্?
—তুমি আমার একমাত্র পুত্রকে হত্যা করেছে।
–আমি? কী করে?
–হ্যা তুমি। হুঙ্কার ছাড়ে আফ্রিদি। খাওয়ার সময় একটা ফল খেয়ে আঁটিটা ছুঁড়ে দিয়েছিলে। সেই আঁটির ঘায়ে আমার প্রাণের বাছা প্রাণ হারিয়েছে। আমি তোমাকে রেহাই দেবো না। জানের বদলে জন নেবো।
সওদাগর তখন জোড় হাতে আবেদন করে, তুমি দানব শ্রেষ্ঠ। আমি জীবনে কখনও মিথ্যাচার করিনি। সজ্ঞানে কোন পাপ করিনি। যাই হোক, আমার অজ্ঞাতসারেই যদি তোমার পুত্রের মৃত্যুর কারণ হয়ে থাকি তবে যে শাস্তি দেবে মাথা পেতে নেবো। কিন্তু তার আগে আমার আত্মীয় পরিজনদের সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই। তুমি সেই অনুমতি আমাকে দাও, এই আমার মিনতি। অগাধ বিষয় সম্পত্তি আমার। আমার মৃত্যুর আগে তার একটা বিলি ব্যবস্থা করা দরকার। সেজন্যেও একবার দেশে যাওয়া নিতান্ত প্রয়োজন। আমার জাত ব্যবসা বাণিজ্য করা। সেই হেতু কিছু দেনা পাওনা থেকে যায়। সেগুলো মিটিয়ে আসাও আমার কর্তব্য। কোন ঋণ রেখে আমি মরতে চাই না। মরতে আমি আদৌ ভয় পাই না। কারণ এক সময় না এক সময় মৌত আসবেই জীবনে। কেউ তা এড়াতে পারবে না। সে চাই-দুদিন আগে হোক আর পিছে হোক। তাই মৌত-এ আমার কোন ভয় নাই। আমাকে বিশ্বাস করে ছেড়ে দাও কিছুদিনের জন্য। আমি দেশে যাই। সেখানকার কাজকাম সমাধা করে আবার এখানে ফিরে আসবো। তখন তোমার যা বিধান হয়। সেই শাস্তি আমাকে দিও, মাথা পেতে নেবো। আল্লার নামে হলফ করে বলছি, আমি ফিরে আসবো—আসবো—আসবো।
দৈত্য বিশ্বাস করে ছেড়ে দিলো বণিককে। দেশে ফিরে এসে যা যা দায়দায়িত্ব ছিলো, এক এক করে সমাধা করতে লাগলো। বিবি আর বাচ্চাদের কাছে সব খুলে বললো নিজের দুর্ভাগ্যের কাহিনী। হাপুসা নয়নে কাঁদতে লাগলো তারা। বিষয় সম্পত্তি যাকে যা দেবার সাধ ছিলো সেইভাবে দানপত্র তৈরি করে দিলো। এই সব করতে করতে বছরের প্রায় তিনভাগই কেটে গেলো। বাকী কাঁটা দিন বৌ ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কাটিয়ে আবার একদিন সেই দৈত্য-সন্ধানে বেরিয়ে পড়লো। তার শোকে ছেলেমেয়ে বৌ, পাড়াপাড়শী সবাই আকুলভাবে কাঁদতে লাগলো।
চলতে চলতে একদিন সেই বিশাল বৃক্ষটার নিচে এসে দাঁড়ালো বণিক। নিজের দুর্ভাগ্যের কথা ভেবে অঝোর নয়নে কাঁদতে লাগলো। এমন সময় দেখলো, শিকল বাঁধা একটা বুনো রামছাগলকে সামনে করে এক জোয়ান শেখ এগিয়ে আসছে তার দিকে।
বণিকের সামনে পৌঁছে সালাম জানালো শেখ! জিজ্ঞেস করলো, এই দৈত্যদানবের রাজ্যে বসে কী করছেন সওদাগর সাহেব?
বণিক তখন তার দুর্ভাগ্যের কাহিনী বললো তাকে সব শুনে শেখ তো অবাক। বললো, খোদা মেহেরবান, কিন্তু সত্য রক্ষার জন্যে আপনার এই কাহিনী বিশ্বাস করবে না দুনিয়ার মানুষ।
শেখ নানাভাবে সান্ত্বনা দিতে থাকে বণিককে। খোদা ভরসা, তিনিই রক্ষা করবেন! দুশ্চিন্তা, ভয় মুছে ফেলুন মন থেকে।
এই সময় আর এক শেখের আগমন হলো সেখানে। তার সঙ্গে ছিলো দুটি গ্রে-হাউন্ড জাতের কুকুর। তারও সেই একই প্রশ্ন। এই দৈত্যদানবের আস্তানায় কেন এসেছে সে? বণিকের দুর্ভাগ্যের কাহিনী সেও শুনলো। এই সময়ে আরও এক শেখ এসে হাজির হলো সেখানে। তার সঙ্গে ছিলো ছাই রঙের এক মাদি খচ্চর। যথারীতি একই প্রশ্ন তারও। সব শুনে তো তাজব সবাই।
এমন সময়ে সামনের তপ্ত বালুকায় ঘূণী ঝড় উঠলো। চতুর্দিক অন্ধকার হয়ে এলো। একটা বালির স্তম্ভ খাড়াই উঠে যেতে থাকলে উধৰ্ব্ব মুখে। ক্রমশ বৃক্ষটার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে সেটা। ধীরে ধীরে সেই বিশাল বালুকারাশির গগনচুম্বী স্তম্ভটা এক বিকটাকৃতি আফ্রিদি দৈত্যের রূপ ধারণ করে দাঁড়ালো ওদের সামনে। শাণিত তলোয়ার উচিয়ে গর্জে উঠলো, উঠে এসো সওদাগর। তোমাকে আমি কোতল করবো। তুমি আমার জানের কলজে-প্ৰাণের বাছাকে মেরেছে।
সওদাগর তখন কান্না, ভয়ে ভেঙে পড়লো। তার দুঃখে তিন শেখও মুহ্যমান। প্রথম শেখ বুকে সাহস বেঁধে উঠে দাঁড়ালো। দৈত্যটার সামনে এসে একটা সালাম ঠুকে বললো, তুমি দানব-কুল শ্রেষ্ঠ, তোমাকে আমি আমার এই বুনো রামছাগলের কাহিনী শোনাতে চাই। শুনে যদি ভালো লাগে। তবে সওদাগরের গোস্তাকি মাফ করে দিও, এই আমার আর্জি।
আফ্রিদি তখন বললো, ঠিক আছে, আমার যদি ভালো লাগে। তবে সওদাগরের তিন ভাগ অপরাধের এক ভাগ আমি রেহাই দিয়ে দেবো।