পড়ার টেবিল থেকে উঠতে যাবো এমন সময় কানে একটা অদ্ভুত শব্দ এলো। রাত তিনটা দশ বাজে। দুদিন পর ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা। সারারাত পড়ার ইচ্ছা ছিলো কিন্তু তিনটা পার হওয়ার পর থেকেই আমার ওপর স্বয়ং কুম্ভকর্ন এসে ভর করেন। চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে। ঝাঁপির মতন আচমকা নেমে এসে চোখদুটোকে বন্ধ করিয়ে ছাড়ে। ঢুলুঢুলু চোখে কোনোমতে রুমের দরজাটা লাগিয়ে দিলাম।
আবার শোনা গেলো শব্দটা! একটা শিস দেবার মতন শব্দ। শব্দটার উৎস সম্পর্কে জানার একটা কৌতূহল কাজ করছিলো কিন্তু ঘুমঘুম চোখে সেদিকে মনোযোগ দেবার ইচ্ছা হলোনা। মাথার ওপরে টিনের চাল।
চালের ঠিক ওপরেই একটা বেলগাছের ডাল ঝুলছে। গাছের বেল পেকে গেলে মাঝেমধ্যে আচমকা দড়াম করে চালের ওপর এসে পড়ে। সেই শব্দে আত্মা খাঁচা থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। দুবছরেও ঐ দুমদাম শব্দে অভ্যস্ত হতে পারিনি। যতবারই চমকে উঠেছি ততবারই মেসের মালিককে মনে মনে গালি দিয়েছি। মেস মালিক কি আর জায়গা পায়নি মেস করার? সোজা বেল গাছের তলায়। ন্যাড়া বেলতলায় নাকি দুইবার যায়না। যদি কোনদিন ন্যড়া হই তবে আগে বেলতলার এই মেস ছাড়বো।
শীতে পাতাঝরার সময়ে দূরের গাছগুলো থেকেও চালের ওপর উড়ে চলে আসে মরা পাতা।
মৃদু লয়ের বাতাসে শুকনো পাতার খসখসে শব্দটা বিচ্ছিরি লাগে। গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে যায় সেই শব্দে। মনে হয় চালের ওপর খসখসে চামড়ার কোন সরীসৃপ জন্তু খুব সন্তর্পনে হেঁটে বেড়াচ্ছে। আজকের শব্দটা অনেকটা ওরকম কিন্তু তবুও কোথায় যেন একটা ছন্দ আছে। খানিক পরপর সেই ক্ষীণ অথচ তীক্ষ্ণ শব্দটা কানে আসছিলো।
মাঝখানে খানিক বিরতি দিয়ে আবার শুরু হয়েছে। এবার চিন্তা হতে লাগলো। কারণ শব্দের মাত্রা বেড়ে গেছে। শব্দটা যেখান থেকেই আসুক সেটার অবস্থান আমার ঘরেই। কুম্ভকর্নের ঘুম ধীরেধীরে কর্পুরের মতন উবে যেতে লাগলো। খাটের কাছে যেতেই লাইট অফ করে দিয়েছিলাম। সেটা আবার জ্বালিয়ে দিলাম। বরাবরের মতন চরম অগোছালো রুম। কোথায় যে কোন জিনিস রেখেছি তার হিসেব আমি নিজেই জানিনা। টেবিল থেকে ছোট টর্চটা নিয়ে রুমের চারকোনায় জঞ্জালের পেছনে ভালোমতন দেখতে লাগলাম। চশমা ছাড়া প্রায় অন্ধ আমি। চোখের ওপরের মাইনাস টু পয়েন্ট ফাইভ পাওয়ারের চশমাটা আজ কেন জানি বেশ ভারী লাগছে। শরীরটা দুর্বল হয়ে আছে তাই বোধহয়। একটা ব্যপার খেয়াল করে বেশ অবাক হলাম। আমি সেদিকে টর্চের আলো ফেলছি শব্দটা ঠিক তার বিপরীত দিক থেকে শোনা যাচ্ছে।
বাইরে ঘনঘন বিদ্যুত চমকাচ্ছে। যেকোন মূহুর্তে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামবে। হতে পারে টিনের চালে গাছের পাতা পড়ে এমন শব্দ হয়েছে।
মেসের সবাই ঘুমে। আমার ঠিক পাশের রুমেই বন্ধু আনাম থাকে।
ও আমার চাইতে অনেক পুরাতন বোর্ডার। আগে থেকেই মেসের সবকিছুতে অভ্যস্ত। তবুও আমার মনে হলো আজকের শব্দটা ওর কাছেও একইরকম অদ্ভুত লাগবে।
হঠাৎ টর্চের আলো চকিতে ঘুরে গেলো আমার পেছনের দিকে! আমার অজান্তেই। কারণ এবার শব্দটা আমার ঘাড়ের ঠিক কাছে শোনা গেছে। হ্যা,স্পষ্ট শুনেছি কোন ভুল নেই। শব্দটার উৎস আমার বুঝতে কোন অসুবিধাই হচ্ছেনা। শিরদাঁড়া বেয়ে একটা প্রানী আমার ঘাড়ে উঠে যাচ্ছে। তার দেহ কাঁটাযুক্ত। পিঠের যে জায়গাগুলোয় ভর দিয়ে আমার ঘাড় পর্যন্ত উঠে এসেছে সে জায়গাগুলোতে যেন কেউ ছুরি দিয়ে বারবার আঘাত করেছে। না রক্তপাত হয়নি কিন্তু নরকযন্ত্রনা কাকে বলে সেটা বুঝতে পারছি। পিঠের মাংসে কাঁটা দিয়ে বিঁধিয়ে বিঁধিয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে প্রাণীটা!
কিন্তু এতদিন পর আবার কেন? সব তো শেষ হয়ে গিয়েছিলো। জীবনটাকে আবার নতুন করে শুরু করেছিলাম। আবার সেই ভয়ানক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হবে আমাকে!
প্রাণীটার কন্ঠ থেকে আবার বেরিয়ে এলো শব্দটা। হাড় হিম করা হিসহিস শব্দ! কানের কাছে ফোঁস করে উঠে তার বিষাক্ত ছোবল বসিয়ে দিলো আমার গলার কাছে। চোখের পলকেই চারটে দাঁত বসে গেলো ঘাড়ের মাংসে। পেশীতে সিরিঞ্জের সুঁই বিঁধিয়ে দেওয়ার পর তরল ওষুধ যেমন অনুভব করা যায় তেমন অনুভব করতে পারছি ওর উষ্ণ বিষের ধারা। গলিত সীসা যেন ঢুকে যাচ্ছে ঘাড়ের প্রতিটি রগে। আমি মরবোনা ঐ ভয়ানক বিষে। আমার বদলে অন্য কেউ হলে যখন প্রানীটা পিঠ বেয়ে উঠছিলো তখনি মারা পড়তো। শুধু বিষদাঁতে নয় ওর দেহে যে বিষ আছে তাতেই শেষ করে দেয়া সম্ভব হাজার হাজার মানুষকে। কয়েক মূহুর্তের মধ্যেই শেষ করে ফেলা সম্ভব হাজারো তাজা প্রান। অশুভ ক্ষমতার অধিকারী এই প্রানী শুধু আমাকেই কিছু করতে পারবেনা। ওকে সেই ক্ষমতা দেয়া হয়নি। কিন্তু আমাকে যন্ত্রণায় জর্জরিত করে ফেলার শক্তি ওর আছে। যেটা সাক্ষাত মৃত্যুর চাইতেও খারাপ। আমি সেই যন্ত্রনা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতে করতে শেষপর্যন্ত আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখানেই ধপ করে পড়ে গেলাম। পাশে থাকা বইয়ের তাকের ওপর রাখা স্টিলের গ্লাসটা রাতের নিস্তব্ধতাকে ভেঙ্গেচুরে ঠং করে একটা বিকট শব্দ করে উঠলো। পাশের ঘরে বন্ধু আনাম শোনেনি তো!
প্রানীটা আসার পরেই আমি আনামের ঘরে একটা মন্ত্র পড়ে ফুঁ দিয়েছিলাম যেন ওর ঘুমটা আরো গাঢ় হয়। অনেকদিন পর এধরনের কাজ করতে গিয়ে একটা বিশাল ভুল হয়ে গেছে। আমার ভেতরকার অবশিষ্ট ক্ষমতা আগের মতন আর কার্যকরী নেই। কারণ গ্লাসটা পড়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই আনামের ঘুম ভেঙে গেছে। বরাবরের মতই ও ভেবেছে বেড়াল খাটের তলায় লুকিয়ে ছিলো। সেই লাফাতে গিয়ে শব্দ করেছে। ঘুমের ঘোরে উঠে দাঁড়িয়েছে আনাম। আমি প্রমাদ গুনছি। আমার রুমে এলেই ভয়ানক কান্ড ঘটে যাবে। আমি ওর ভারী শরীরে থপথপ শব্দে পায়ের আওয়াজ পাচ্ছি। এদিকেই আসছে ও। কিন্তু আসলে যে ওর সাথে কি কি ঘটনা ঘটতে পারে ও নিজেও জানেনা। আমি যদি ওকে ঘরে ঢুকতে না করি তাহলে ও আরো দ্বিগুন আগ্রহ নিয়ে ঘরে ঢুকবে। ভাববে বন্ধু হয়ে আমি কি এমন লুকাচ্ছি ওর কাছ থেকে! উঠে যে দরজা বন্ধ করে দেবো সেই উপায় ও নেই। শরীর থেকে সমস্ত শক্তি যেন শুষে নিয়েছে প্রানীটা। ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে গলার চারটে ছিদ্র। মনে মনে চাইছি প্রানীটা ওর আগের অভ্যাস অনুযায়ী আমার দেহ ভেদ করে আশ্রয় নিক হৃদপিণ্ডের ঠিক পাশে গিয়ে। ওকে যেন আগের মতন দেহের বাইরে ছুড়ে না ফেলি সেইজন্য।
আনাম যদি এই মূহূর্তে ওকে আমার ঘাড়ে দেখে তাহলে মেসের সবাইকে জাগিয়ে তুলবে। মেস উঠবে মাথায়। এতে শুধু ওর নয় মেসে অন্যন্য যারা আছে তারা সবাই ক্ষতিগ্রস্থ হবে । প্রানীটা যদি জানে যে ওকে নিয়ে সমস্যা হচ্ছে তবে সে কাউকে ছাড়বেনা। বীভৎস প্রতিশোধ নিতে এই প্রানীর জুড়ি নেই।
কিন্তু আনাম আসার আগেই আমার দেহের ভেতরে আশ্রয় নিলো প্রানীটা। ঘুমে ঢুলতে থাকা আনামকে কৈফিয়তের সুরে বললাম
” পানি খেতে গিয়ে পিছলে পড়ে গেছিরে। মারাত্মক ব্যথা পেয়েছি। আমাকে ধরে ওঠা তো। ”
ও কি বুঝলো জানিনা । দু মিনিট হা করে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে পরে ওর মোটা হাতদুটো বাড়িয়ে দিলো আমার দিকে। আমি ওর হাত ধরতে যাবো এমন সময় মনে হলো আরেকটূ হলেই সর্বনাশ হয়ে যেতো। ভাগ্য ভালো যে ওর গায়ে আমার হাত লাগেনি। লাগলে দুর্ঘটনা ঠেকানো যেতোনা। মুখে ফেনা উঠে সাথে সাথে মারা পড়তো আমার বন্ধু। “নীলকন্ঠ” যতক্ষণ আমার দেহে অবস্থান করবে ততক্ষন আমি নিজেও মহা বিষধর একটা প্রানী। প্রানীটাকে “নীলকন্ঠ” নামটা আমিই দিয়েছিলাম। বাস্তবে ওটা পাখির নাম হলেও ওর গলায় ফুলে ওঠা নীলাভ বিষের থলি দেখে প্রথম মুখ থেকে বেরিয়ে আসে “নীলকন্ঠ” নামটি। একটা বিষাক্ত সরীসৃপকে নাম ধরে ডাকতে ইচ্ছা করবে তা ভাবিনি। অবশ্য যদি ওটা জন্ম থেকেই সাপ হতো তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা ছিলো।
ওর উপস্থিতিতে আমার গায়ের চামড়া বা নিঃশ্বাসের সংস্পর্শে এলেই পৃথিবীতে দু তিন মিনিটের অতিথি হয়ে যাবে সে ব্যক্তি। জিবের তলায় মারণ বিষ সায়ানাইড রাখলেই একমাত্র এই অনুভূতি হয়।
তাই ও কিছু বুঝে ওঠার আগেই শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে বুকশেলফ ধরেই সটান উঠে দাড়ালাম। তারপর এক লাফে খাটে গিয়ে বসলাম। আনাম একটু অবাক দৃষ্টিতে তাকালো আমার দিকে। যেন কি করছি ঠিক বুঝে উঠেতে পারছেনা। না পারারই কথা। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। কিন্তু ও ওর রুমে ফিরে যাচ্ছেনা কেন? অন্যন্যদিনের মতো ঘুম, ভেঙে যাওয়ায় আড্ডা দেবে এমন প্ল্যান করে বসেনি তো? তাহলে তো সর্বনাশ! অনেক কষ্টে নিজের দম বন্ধ করে রেখেছি। দম ছাড়লেই ঘরে ছড়িয়ে পড়বে নীলকন্ঠের বিষ। আনাম এগোলো না । ঘুরে নিঃশব্দে ওর নিজের রুমের দিকে চলে গেলো। ওর ঘুমটা ঠিকমতন না ছাড়ায় রক্ষা।
আমি হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লাম। বুকভরে শ্বাস নিলাম।
ইচ্ছা নেই, ঘুম ধরছেও না তবুও আমাকে ঘুমুতে হবে। না ঘুমুলে নীলকন্ঠ আমাকে ছেড়ে যাবেনা। ঘুমে থাকলে দেহের আত্মা শরীর থেকে বেরিয়ে আসে। আত্মাহীন দেহ নীলকান্তের কাছে মূল্যহীন। তাই সে আত্মার সাথে বেরিয়ে আসবে দেহ থেকে । পরে ঢুকে পড়ার আগেই আমাকে কিছু একটা করতে হবে। কিন্তু তার জন্য আবার ফিরে যেতে হবে কালিগোলা অন্ধকার স্মৃতির রাজ্যে। বিষ আর বিষাদের মেলবন্ধনে গঠিত এক রাজ্যে।
টিনের চালে বৃষ্টীর ঝমঝম শব্দ শুনতে পাচ্ছি। আহত দেহ আরাম পাচ্ছে। চোখ ঘুমে জড়সড় হয়ে আসছে। হৃদপিণ্ডের পাশে ঘাপটি মেরে থাকা গরল উগড়ে দেয়া প্রানীটা তার দেহের কাঁটা দিয়ে এফোঁড়ওফোঁড় করে দিচ্ছে বুকের বামপাশ। প্রচন্ড ব্যথা আছে অথচ কোন রক্তপাত নেই। এ এক দুঃসহ অনুভূতি। অবশেষে চোখ বন্ধ হলো। আর একটা বিশালাকার সাপের চেহারা ফুটে উঠলো মনের দেয়ালে। একটা সিংহাসনে কুন্ডুলি পাকিয়ে বসে আছে সে। এই সাপ সাধারণ কোন সাপ নয়। সাপদের দেবতা। ওর নাম এপোফিস। মিশরে একসময় এই দেবতাকে পূজা করা হতো। এবার দৃশ্যপট পালটে এক মহিলার চেহারা ফুটে উঠলো চোখের সামনে। এই মহিলার নাম মনসা। ভারতবর্ষে একে সাপের দেবী হিসাবে পূজা করা হয়। আমার সাথে নীলকন্ঠের পরিচয়ের পর থেকে এই দুজনকে নিয়ে রোজ দেখতাম বীভৎস সব দুঃস্বপ্ন।
যেদিন ডাব কাটতে গিয়ে আমার ডানহাতের বুড়ো আঙুলটা কব্জি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তখন আমি হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েছিলাম। ব্যথার চাইতেই বেশি অসহ্য ছিলো বিকলাঙ্গ না হবার আকুতি। ভয়ের চোটে বাড়ি ফিরতে পারলাম না। ডাব কাটার সময় গ্রামের এক বন্ধু ছিলো সাথে । ওকে হাত পা ধরে রাজি করালাম যেন খবরটা চাপা থাকে। সন্ধ্যার পর হাত থেকে আলাদা হওয়া আঙ্গুল একটা পরিস্কার কাপড়ে পেঁচিয়ে নিয়ে চলে গেলাম বুড়ো খবিশের কাছে। দানবাকৃতির পুরাতন বটগাছের তলায় যে বিশাল ফাটলটা আছে সন্ধ্যার পর সেখানে গুটিসুটি মেরে বসে থাকে বুড়োটা। ও নাকি খারাপ সব জাদুমন্ত্র জানে ।
মানুষের ক্ষতি করে বলেও শুনেছি। ওর নাকি অনেক ক্ষমতা। তাই সবাই বুড়ো খবিশ বলে ডাকে। কেউ কেউ বলে বুড়ো খবিশ মানুষ নয়। জ্বীন ভূত গোছের কেউ। আবার এটাও শুনেছি যে ও সুযোগ পেলে মানুষের উপকার ও করে। আমি শেষ ভরসা হিসেবে ডাক্তারের কাছে না গিয়ে ওর কাছে এসেছি। ঐ কাঁটা আঙুল জোড়া লাগাবার ক্ষমতা কোন ডাক্তারের নেই। ঘটনাটা ঘটেছে বিকালে আর এখন অন্ধকার নেমে এসেছে। চটচটে রক্তেভেজা ভেজা ফুলে ওঠা কাঁচা ঘায়ের যন্ত্রনায় প্রায় মূর্ছা যাচ্ছিলাম। নিজের ধৈর্য্যশক্তি দেখে নিজেই অবাক হয়েছি। তারচেয়ে অবাক হয়েছি বুড়ো যখন বললো সে আমাকে সাহায্য করবে। তবে অশুভ কালোজাদুর দুনিয়ায় যে উপকার পাওয়া যায় তার বিনিময়ে দিতে হয় কঠিন পরীক্ষা। উৎসর্গ করতে হয় নিজের পরবর্তী জীবনের শান্তি। সুখ আসে জীবনে কিন্তু শান্তি কোনদিনই ফিরে আসেনা।
আমার তখন এতোকিছু শোনার সময় নেই। আমার আঙ্গুল আবার আগের জায়গায় ফেরত চাই। ব্যথায় কাতরাচ্ছিলাম । বুড়ো কি যেন বিড়বিড় করে বলাতে অনেকটা কমে গেলো ব্যথা। তাতে বুড়োর কাজের প্রতি ভরসা বেড়ে গেলো। বুড়োর সাবধানবানী আর মাথায় রইলোনা, কিইবা হবে আর? কাঁটা আঙ্গুল জোড়া লাগানো গেলে কিছু আর কিছু চাইনা আমার।
আমি রাজী হয়ে গেলাম । তখন বুড়ো আমার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া আঙ্গুলটা তার মুঠোর মধ্যে প্রথমে শক্ত করে ধরলেন। তারপর নিচে পড়ে থাকা ময়লা ঝোলা থেকে একটা চাকু বের করে কুঁচি কুঁচি করে ছাড়িয়ে নিলেন আঙুলের অবশিষ্ট মাংস। দেখলাম বটগাছের কোণে যে মশাল জ্বালানো হয় সেটার আগুনে জায়গা হলো কাঁটা মাংসের। মাংস খুলে নেয়ার দৃশ্য দেখে গা টা কেমন শিউরে উঠেছিলো। হাজার হোক ওটা তো আমারই দেহের মাংস। তবুও অধীর আগ্রহে বুড়োর কার্যকলাপ দেখতে লাগলাম। বুড়ো রক্তাক্ত সাদাটে হাড়ের টুকরোগুলো নিয়ে চোখ বন্ধ করে আবার বিড়বিড় করতে লাগলেন। সময় কেটে যেতে লাগলো কিন্তু কিছু হচ্ছেনা। ভাবলাম বুড়ো খবিশ বাস্তবে পাগল নয়তো। ওর কাছে এসে শুধুশুধু আঙ্গুলটা হারালাম না তো!
কিন্তু না ।
উত্তর পেলাম বুড়োর কর্মকান্ডের মধ্যেই। আমার হাড়গুলো মুঠোর মধ্যে চেপে সে কড়মড় করে শব্দ করতে লাগলো । যেন হাতের মধ্যে লুডোর ছক্কা নাড়ানো হচ্ছে। বুড়োকে আমার কাছে আসতে হলোনা। ও দূরে থাকতেই আমি আমার কাঁটা আঙুলের জায়গায় একটা কিছুর উপস্থিতি লক্ষ্য করলাম। ঘায়ের ভেতর থেকে জীবন্ত কিছু একটা ভীষণভাবে নড়েচড়ে উঠছে। তার দৈর্ঘ্য আমার বুড়ো আঙুলের প্রায় সমান। তবে দেখতে মোটেই আঙুলের মতন নয়। প্রথম দর্শনে বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। আমার আঙুলের গর্ত থেকে বের হচ্ছে সর্পিল কাঁটাযুক্ত কোন প্রানী। সেটার নিজের মুখ আছে, লালাভ ভয়ংকর চোখ আছে । অন্ধকারে ভাটার মতন জ্বলে সেগুলো। হিসহিস করতে থাকা লকলকে একটা জিহ্বা আছে। সাপের সাথে চেহারার বেশ মিল আছে। চারটে সাদা ধারালো দাঁত দেখে বুকটা কেঁপে উঠলো। কিন্তু পুরোপুরি সাপের মতন নয়। গলার কাছে একটা পুঁটুলির মতন নীল রঙের থলি দেখে শুরুতে বুঝিনি কত ভয়ানক এই প্রানী। আমি তখনো জানিনা এই প্রানী আমার আঙ্গুলের আদলে নিজেকে বদলে ফেলতে পারে। সেদিন একদিনের জন্য ঘরে ফিরে গিয়েছিলাম। কেউ জানেনি আমার আঙুলের ঘটনা।
কিন্তু দুদিন পরেই যখন বুঝলাম আমার ঐ আঙ্গুল, আমার নিঃশ্বাস আর চামড়ার সংস্পর্শে এলে মানুষের মৃত্যু নিশ্চিত তখন আর ঘরে টিকতে পারিনি। দাদুকে ছোঁয়ার পর তার মুখ দিয়ে ফ্যানা উঠে প্রায় সাথে সাথেই অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার কারণ বুঝিনি। তার মরে যাওয়ার কারণ বুঝতে সময় লেগেছিলো। কিন্তু পোষা কুকুরটাকে যখন অভিশপ্ত আঙ্গুলটা নিজেই ছোবল দিলো তখন আর কিছু করার ছিলোনা। ঘরভর্তি প্রিয় মানুষজন। তাই একদিন যাযাবরের মতন ঘর থেকে বেরিয়ে গেছিলাম কাউকে কিছু না জানিয়েই। কি জানাবো! কেউ বিশ্বাস করবে? করলেও বুড়ো খবিশের কাছে সাহায্য চাওয়ার অপরাধে আমাকে আবার শাস্তি ভোগ করতে হবে। ওদিকে আমার উপস্থিতিও সবার মৃত্যুর ফরমান জারি করবে।
একদিন সহ্য করতে না পেরে রাগে ক্ষোভে সাপের মতন আঙুলের মাথা ধরে দাঁ দিয়ে বসিয়ে দিলাম একটা ঘা।
যেন গোড়া থেকে উপড়ে ফেওলা যায় ওটাকে। রক্তে ভিজে উঠলো আঙুলের চারপাশ। সবুজ সেই রক্তের রঙ!
আমার বিষাক্ত আঙ্গুল আমাকেই দংশন করে গেলো বারবার। অবশেষে সফল হলাম । ফুঁসে ওঠা সাপের মতন আঙুলটাকে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে নদীর জলে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। ডুবন্ত আঙ্গুলটার মাথায় দুটো রক্তবর্ণ চোখ একবারের জন্য আমার দিকে তাকিয়েছিলো। সে দৃষ্টি ভোলার নয়। নিজের প্রতি মায়া করতে গিয়ে অনেক অন্যায় করে ফেলেছি। আর না। তবুও তো বিষমুক্ত হতে পেরেছি। এই অনেক।
কিন্তু আজ এতবছর পরে নীলকন্ঠ ফিরে এসেছে ঠিকই। আনাম কে দংশনের পর কিছুটা শান্তও হয়েছে। আনামের শরীর সম্পূর্ন নীল হবার আগেই কেটে পড়তে হবে মেস থেকে । সাপের স্মৃতিশক্তি খুব ভালো হয় শুনেছি। ও শুধু শিকার খুঁজবে এখন। আমার মেসে তাজা শিকারের অভাব নেই! তাছাড়া মানব নিধনের এই অনাবিল আনন্দ যে আমাকেও পেয়ে বসেছে!
……………………………………………..(সমাপ্ত)……………………………………..