মুহাম্মাদ নামের এক যুবক তার মায়ের সাথে বাস করতো। মুহাম্মাদের পেশা ছিল শিকার করা। এই শিকারী যুবক একরাতে বড়ো একটা জানোয়ার দেখতে পেলো। ঐ পশুটার চামড়া ছিল বেশ জ্বলজ্বলে। মুহাম্মাদ পশুটাকে শিকার করে চামড়াটা তুলে নিয়ে ভাবলোঃ বাদশাকে এই সুন্দর চামড়াটা উপহার দিলে নিশ্চয়ই ভালো পুরস্কার পাওয়া যাবে। এই ভেবে সে চামড়াটা নিয়ে রওনা হলো বাদশার দরবারের দিকে। পথিমধ্যে বাদশার এক উজির বা মন্ত্রী তাকে দেখে ফেলাল। উজির ঐ চামড়াটা মুহাম্মাদের কাছ থেকে নিজেই কিনে নিতে চাইলো। কিন্তু মুহাম্মাদ রাজি হলো না। এ কারণে মুহাম্মাদের ওপর ঐ উজির ক্ষেপে গেল। মুহাম্মাদ উজিরকে চামড়াটি না দিয়ে বাদশার কাছে নিয়ে গেল। বাদশা চমৎকার চামড়াটি দেখে খুশি হলো এবং মুহাম্মাদকে পুরস্কার দেওয়ার জন্যে উজিরকে আদেশ দিল। কিন্তু উজির মুহাম্মাদকে একটা নির্জন স্থানে নিয়ে গিয়ে পুরস্কার দেওয়া তো দূরের কথা উল্টো বরং মারধর করল, পেটালো। পিটিয়েও উজিরের সাধ মিটলো না। তাকে আরো শাস্তি দেওয়ার জন্যে বাদশাকে গিয়ে বললোঃ ‘মুহাম্মাদকে বলুন আপনার জন্যে হাতির হাড় দিয়ে একটা প্রাসাদ বানাতে।’ বাদশা তাই করল। মুহাম্মাদকে বললোঃ ‘হাতির হাড় দিয়ে আমার জন্যে একটি প্রাসাদ বানাও।’ মুহাম্মাদ বাদশার ঐ আদেশ শুনে ভীষণ কষ্ট পেল। কী আর করবে সে, অবশেষে মন খারাপ করে ঘরে ফিরে এলো। মা ছেলের মন খারাপের কারণ জানতে পেরে উপদেশ দিল। কীভাবে হাতিদেরকে ফাঁদে ফেলা যায় সেই ধারণা দিল এভাবেঃ বাজারে গিয়ে অজ্ঞান করার কিছু ঔষধ কিনবে। অমুক জায়গায় একটা পানির ঝর্ণা আছে। শেষ বিকেলে প্রতিদিন হাতিরা সেখানে পানি খেতে আসে। অজ্ঞান করার ওষুধটা সেই পানিতে ঢেলে দেবে। হাতিগুলো তখন ওষুধের গন্ধ পেলে আর পানি খাবে না। তবে একটা পঙ্গু হাতি আছে। সে সবার শেষে পানি খেতে আসে। ও এসেই পানি খাবে তারপর অন্য সব হাতিও তাকে দেখে পানি খেতে থাকবে। আর যে হাতিই পানি খাবে অজ্ঞান হয়ে যাবে। তখন তুমি সকল হাতির মাথা কাটতে পারবে। মায়ের কথামতো ছেলে তাই করল এবং যথার্থই সফল হলো। প্রাসাদ বানানোর জন্যে প্রয়োজনীয় পরিমাণ হাড় সংগ্রহ করল এবং প্রাসাদ বানালো। কিন্তু এতো কষ্টের পরও মুহাম্মাদ পুরস্কার পাবার পরিবর্তে সেই মন্ত্রীর হাতে মার খেল। ঐ মন্ত্রীর কুবুদ্ধিতে বাদশা আবারো মুহাম্মাদকে আরো অনেক পরীক্ষায় ফেলাল। মুহাম্মাদও মায়ের পরামর্শ নিয়ে সবগুলো কাজই ঠিকঠাকমতো করে ফেলাল। এতে মন্ত্রী আরো ক্ষেপল। এবার সে বাদশাকে বলল, মুহাম্মাদকে বলুন চীনে গিয়ে সম্রাটের কন্যাকে নিয়ে আসতে। মুহাম্মাদের মা এবার আর ছেলেকে কোনোরকম সাহায্য করতে পারল না। তবু মুহাম্মাদ চীনের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। যেতে যেতে দেখা হলো এক রাখালের সাথে। রাখাল মুহাম্মাদের কাহিনী শুনে তার সফরসঙ্গী হয়ে গেল। কয়েকদিন পথ চলার পর দেখতে পেল দানবের মতো বিশালদেহী এক মানুষের সাথে। লোকটা চেহারা বিকৃত করে ভ্রু কুঁচকে ঘুমিয়েছিল। অদ্ভুত ব্যাপার হলো প্রখর রোদের মাঝেও তখন জায়গাটা ছিল ভীষণ ঠাণ্ডা। রাখাল ঐ বিশালদেহী লোকটাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলাল। ঘুম থেকে জেগে লোকটা যে-ই তার বিকৃত চেহারা আর কুঁচকানো ভ্রুটাকে ঠিক করল অমনি ভীষণ গরম অনুভূত হলো। রাখাল ঐ গরমের মধ্যেই বিশালদেহী লোকটাকে মুহাম্মাদের বিপদের ঘটনা বলল। ঘটনা শুনে বিশালদেহী লোকটাও মুহাম্মাদের সঙ্গী হয়ে গেল এবং মুহাম্মাদ আর রাখালকে তার দুই কাঁধে বসিয়ে হাওয়ার বেগে চলে গেল একটা শহরে। সেখানে একটি ভবনে তারা অতিথি হলো। ঐ বাড়ির মালিক ছিল এক মহিলা। মহিলার সাথে পরিচিত হবার পর তারা সব ঘটনা খুলে বলল। এবার মহিলা তাদের উদ্দেশ্যে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল। বলল: “তোমরা যে মেয়ের সন্ধানে যাচ্ছে সে আমার বোনের মেয়ে। তোমরা প্রথমে যাবে মেয়ের বাবা সম্রাটের কাছে। প্রাসাদের সামনে দেখতে পাবে বিশাল একটি পাথর। ঐ পাথরের ওপরে বসবে। কারো কোনো চাওয়া থাকলে ঐ পাথরে বসেই চায়। ফলে তোমরা পাথরে বসলে তোমাদেরকে জিজ্ঞেস করবে কী চাও! তখন তোমরা বলবে ‘আমরা তোমার কন্যাকে চাই।’ বাদশা তখন কয়েকটি শর্ত দেবে। ঐ শর্তগুলো তোমাদেরকে পূরণ করতে হবে। পূরণ করার পর তোমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হবে মেয়ের প্রাসাদে। ঐ প্রাসাদটি যাদুমন্ত্রে ঘেরা। সেখান থেকে মেয়েকে নিয়ে আসতে হবে। মেয়ের প্রাসাদে যাবার পথে পানির একটা উৎস আছে। বিচিত্র কাঁটা আর ধূলিকণায় ঢেকে আছে তা। তোমরা সেসব সরিয়ে পানি খাবে আর বলবেঃ কী সুস্বাদু পানি একেবারে গোলাবের মতো এবং মিষ্টি। পথে আরো পড়বে কাঁটাভর্তি প্যাঁচানো লতাগুল্ম। ঐ প্যাঁচগুলো খুলে আলাদা করে দুটোকেই লাল রঙের রুমাল দিয়ে বেঁধে রাখবে।” মুহাম্মাদ এবং তার সঙ্গীরা ঠিক ঠিকমতো সবকিছু করে বাদশার প্রাসাদে গিয়ে বড়ো পাথরটার ওপর বসলো। বাদশা তাদেরকে তিনটি পরীক্ষা দিল। এক, ত্রিশটি গাধা টানতে পারে সেই পরিমাণ ভাত দিল যা বিশালদেহী লোকটা একাই সাবাড় করে দিল। দুই, চল্লিশ তশতরি অশ্রু চাইল। তারা চল্লিশটি তশতরিতে পানি ভর্তি করে তাতে লবণ মিশিয়ে দিল। রাজা-মন্ত্রী তাকেই অশ্রু বলে ধরে নিলো। তিন, ফুটানো গরম পানিতে মুহাম্মাদকে গোসল করতে বলা হলো। বিশালদেহী লোকটা যেই তার ভ্রু কুঁচকালো অমনি পানি ঠাণ্ডা হয়ে গেল এবং মুহাম্মাদ আরাম করে গোসল করে নিলো। এরপর রাজা এবং মন্ত্রী কন্যার প্রাসাদ দেখিয়ে দিল। মুহাম্মাদ এবং তার সঙ্গীরা মেয়ের খালার কথামতো সব কাজ করল এবং সহজেই প্রাসাদে চলে গেল এবং মেয়েকে নিয়ে দেশে ফিরল। মুহাম্মাদের সঙ্গীরা যে যার জায়গার ফিরে গেল আর মুহাম্মাদ গেল রাজপ্রাসাদে। প্রাসাদে যাবার পর রাজকন্যা বাদশাকে বললোঃ আমি ভীষণ ক্লান্ত। তাই চল্লিশ দিন মুহাম্মাদের বাসায় বিশ্রাম নেব।’ বাদশা রাজি হয়ে গেল। কিন্তু ধূর্ত মন্ত্রী বাদশাকে কানে কানে বললোঃ মুহাম্মাদ তো দেখছি সবই পারবে। তাকে তুমি বলো আমাদের পূর্বপুরুষদের খবরাখবর নিয়ে আসতে।’ বাদশা এবারও মন্ত্রীর প্ররোচনায় মুহাম্মাদকে তাই করতে বলল। মুহাম্মাদ ঘটনাটা রাজকন্যাকে বলল। রাজকন্যার পরামর্শ অনুযায়ী মুহাম্মাদ চল্লিশ দিন সময় নিলো বাদশার কাছ থেকে। এই সময়ের ভেতর পুকুর খননকারীদের খবর দিল কবরস্থানের পাশে এমন একটা পুকুর কাটতে যেন বিশটা সিঁড়ি থাকে। চল্লিশতম দিনে রাজকন্যা বাবার স্বাক্ষর নকল করে বাদশাকে একটা চিঠি লিখলো। ঐ চিঠিতে মেয়ের মোহরানার কথাটিও লেখা হলো। বাদশাহ এবং উজির এই চিঠি পেয়ে অবাক বনে গেল। চিঠিতে লেখা ছিল: চিঠি পাওয়ামাত্রই মুহাম্মাদের নির্দেশনায় রাজকন্যার বাবার সাথে যেন তারা দেখা করতে আসে। বাদশা এবং মন্ত্রী তাই করল। মুহাম্মাদের সাথে তারা রওনা হলো। যখন তারা কবরস্থানের কাছে এলো, মুহাম্মাদ তাদেরকে বলল সিঁড়ি বেয়ে ভেতরে যায়। বাদশা এবং মন্ত্রী সিঁড়ি বেয়ে নীচে যেতেই মুহাম্মাদ ধাক্কা মেরে তাদের নীচে ফেলে মেরে ফেলাল। এরপর মুহাম্মাদ তার মা আর রাজকন্যাকে নিয়ে প্রাসাদে গিয়ে চল্লিশ দিন ধরে বিয়ের আনন্দ অনুষ্ঠান করল। তারপর থেকেই তারাই দেশ চালাল।
গল্পের বিষয়:
ফ্যান্টাসি