গোপাল মাঝে মাঝে রসের কথা বলতে গিয়ে বেফাঁস কথা বলে ফেলত। মহারাজ সে সব কথা কানে বিশেষ তুলতেন না। একবার কিন্তু কথা প্রসঙ্গে গোপাল একটা বেফাঁস কথা বলায়, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের মনে বড্ড ঘা লাগে। রাজা চটে গিয়ে প্রহরীকে ডেকে বললেন, গোপাল ভাঁড়কে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বেত মারতে মারতে রাজসভা থেকে বের করে দাও এক্ষুনি। অমন লোক আমার রাজ্যে না থাকলেও চলবে। ভাঁড় ভাঁড়ের মতো না থেকে যেন মাথায় চড়েছে? বড় বাড়াবাড়ি করছে আজকাল ভাঁড় মশাই।
গোপাল গলায গামছা দিয়ে কাঁদো-কাঁদো হবে বলল, কথা প্রসঙ্গে একটা বেফাঁস কথা মুখ ফসকে হঠাৎ বেরিয়ে গেছে। আমাকে ক্ষমা করুন, আমাকে আর ঘাড় ধাক্কা দিয়ে মারতে মারতে
রাজসভা থেকে বের করে দিতে হবে না- আমি নিজেই বেরিয়ে চলে যাচিছ। তাছাড়া দূর যখন করে দিলেন, আপনার রাজ্যে ছেড়ে সাত দিনের মধ্যেই আমি চলে যাব। তবে এই বয়সে মারলে আর আমি বাঁচব না মহারাজ, এবারের মত ক্ষমা করুন, দয়া করুন। গোপাল বিষন্ন মনে বাড়িতে ফিরে এসে পাড়া পড়শীদের শুনিয়ে শুনিয়ে বললে, জিনিসপত্র সব গুছিয়ে নেয় গিন্নী, আমরা সাতদিনের মধ্যে এ রাজ্য ছেড়ে চলে যাব। জমি বাড়ির আসবাবপত্রের খদ্দের ঠিক করতে চললুম আমি। তুমি তো সব গুছিয়ে টুছিয়ে নাও। দেরি করলে মহারাজ রাগ করবেন। আমাদের চলে যেতে হুকুম হয়েছে।
গোপালের কথা শুনে গোপালের স্ত্রী কাঁদতে কাঁদতে বললে, নিজের দেশ সাতপুরুষের শ্বশুরের ভিটে ছেড়ে কোথায় যাবো আমরা? তুমি যেতে পার, আমি যাবো না। গোপাল গিন্নীর কানে কানে চুপিচুপি বললে, খুব করে পাড়াপড়শীদের শোনাও, আর পাড়া-পড়শীদের দেখিয়ে জিনিসপত্র গোছ-গাছ করতে থাক। কিন্তু আমরা যেন সত্য সত্যই চলে যাচ্ছি। এ কথাটা রাজার কানে পৌছান দরকার। গোপালও লোকজন এনে বাড়ি ঘর দোর দেখাচ্ছে, দাম দস্তর করছে-বিক্রী করবে।
তিন চারদিন পরে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র লোকমুখে জানতে পারলেনে যে, গোপালের মনের দুঃখে তার বসতবাটী বিক্রি করে স্ত্রী পুত্রের হাত ধরে অন্য রাজ্যে আজকালের মধ্যে চলে যাবে, শুধু বাড়ি ঘর বিক্রী করতে উপযুক্ত খদ্দের সহসা পাচ্ছে না বলে যেতে পারছে না, খরিদ্দাররা জুটলেই চলে যাবে। টাকা পয়সা না হলে কি করে যাবে।
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র খবর পেয়ে মনে মনে অশ্বস্তি বোধ করলেন। অনেক ভেবেচিন্তে কয়েকজন বন্ধুসহ তিনি নিজেই গোপালের বাড়িতে বিকেলে এলেন। গোপাল আর গোপালের স্ত্রী মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে আসতে দেখে যেন যারপরনাই বিস্মিত হল। দুজনে মহারাজকে ভূমিষ্ঠ হ প্রণাম করলে।
রাজা গোপালকে বললেন, গোপাল, তুমি নাকি এ রাজ্য ছেড়ে চলে যাচ্ছ? কবে যাচ্ছ, কোথায় যাচ্ছ। জানতে পারি কি?
গোপাল উদাস মুখে বললে, ঠিকই শুনেছেন মহারাজ। আপনি আমার অন্নদাতা প্রভু, আপনিই যখন আমার প্রতি বিরুপ, তখন আমার এ রাজ্যে থেকে লাভ কি? আমি আগামীকালই সপরিবার আপনার রাজ্য ত্যাগ করে চলে যাচ্ছি। আপনি আমার উপর রাগ করবেন না মহারাজ, যেতে দেরি হল বলে। এরজন্য ক্ষমা চাইছি।
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র বিষাদগ্রস্থ হয়ে বললেন, যাবে যখন ঠিকই করে ফেলেছো তখন আর কি হবে বলে? গোপাল আমার যে কি হয়েছে বলতে পারছি না- তোমাকে তাড়াতে পারছি না, আবার কাছে ডাকতেও পারছি না। যেন ভূতে পেয়েছে। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কথা শুনে গোপাল মুচকি হেসে বললে, প্রেমে পড়লে এমন অবস্থা হয় হুজুর। আপনি যে আমার প্রেমে পড়েছেন। যারা প্রেমে পড়ে তাদের সবারই এ অবস্থা হয় মহারাজ। গোপালের কথা শুনে রাজা রজার অন্তরঙ্গ সঙ্গীরাও হো হো করে হেসে উঠলেন। বলা বাহুল্য, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আদেশে গোপালের আর রাজ্য ত্যাগ করা সম্ভব হল না। কারণ মহারাজ গোপালকে সত্যিই ভালবাসার মত ভালোবাসতেন।
গল্পের বিষয়:
হাস্যরস