ডেইলি প্যাসেঞ্জার

ডেইলি প্যাসেঞ্জার

।১।

ঢাকা শহরে মাঝে মাঝেই সিজনাল মোবাইল চেকপোস্ট বসে রাস্তায়। তিন চারজন পুলিশ গাড়ি থামিয়ে কাগজপত্র দেখতে চায়। ঈদের আগে অবশ্য কেন যেন এই চেক কর্মকাণ্ড বেড়ে যায়, কেন বাড়ে সেদিকে আমরা না যাই। বাংলা কলেজের সামনে একদিন বাস থেকে নেমে দেখি একটা চেকপোস্ট। একজন ট্রাফিক পুলিস ক্যাটক্যাটা লেমন ইয়োলো কালারের একটা বদখত ওভারকোট ইউনিফর্মের উপর চাপায়ে কানামাছি ভোঁ ভোঁ , যারে খুশি তারে ছোঁ এই মূলনীতিতে ইচ্ছামত মোটরসাইকেল, সি এন জি থামাচ্ছে। বাস থেকে নেমে পুলিশদের কাছাকাছি আসতেই শুনি একজন পুলিশ একজন মোটরসাইকেল আরোহীকে বলতেছে, ড্রাইভিং লাইসেন্স, গাড়ির কাগজ, মেইনটেন্যান্সের কাগজ বের করেন। ওই লোকের বাইকের পিছনে একজন মহিলা, মাঝখানে হাইফেনের মত বছর ছয় সাতের একটা মেয়ে আর সামনে মিনিপ্যাকেট সাইজের একটা ছেলে। দেখেই বুঝা যায় ফ্যামিলি প্যাকেজ।লোকটা মুখ কাচুমাচু করে বলল,কাল গাড়ির সার্ভিসিং করাইসি, পরে আর কাগজপত্র গাড়িতে রাখতে মনে নাই। এরকম ভুল হয়না সাধারণত। এই কথা শুনার পর ট্রাফিক পুলিশের এপিক একটা ডায়লগ – ” এইটা কেমন কথা ! বাড়ির জিনিস ( উনার বউ বাচ্চা দেখাইয়া) গাড়িতে আর গাড়ির জিনিস বাড়িতে !! “

।২।

বিআরটিসির প্রাগৈতিহাসিক কালের দুই একটা লক্করঝক্কড় মুড়ির টিন মার্কা দোতলা বাস মাঝে মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। মিরপুর থেকে এরকম একটা বাসে উঠার পর দেখলাম পুরা বাসের মধ্যে হাজার রকম পোস্টার আর লেখালেখি। হঠাত দেখি সামনের সিটের পিছনে লেখা, সামনে তাকা।সামনে ড্রাইভারের মাথার উপরে দেখি লাল কালি দিয়ে লেখা, বামে তাকা। কৌতূহলী হয়ে মানুষজনের মাথার মধ্যে দিয়ে এদিক ওদিক তাকালাম কিছু লেখা আছে কি না। বাসের দরজার উপরে একটা পোস্টারের পাশে ওই লাল কালি দিয়ে লেখা, ডানে তাকা। আবার ঘাড় ঘুরায়ে ডান দিকে খুঁজতে থাকলাম কিছু লেখা আছে কিনা। দেখি ছোট ছোট করে লেখা, মাথার উপরে তাকা। চোখ তুলে বাসের ছাদে তাকালাম। দেখি বড় বড় করে লেখা, ” এইবার তাকায়াই থাক ব্যাটা মদন !!”

কই যেন শুনছিলাম, মদন টাইপ একটা অপমানজনক শব্দের মানে নাকি প্রেমের দেবতা! উত্তর দক্ষিন , পূর্ব পশ্চিম তাকাতাকি করেই যে এক্কেরে ডাইরেক্ট প্রেমের দেবতা বনে গেলাম, ব্যাপারটা অবশ্য তখন হজম হয়নাই !!

।৩।

মিরপুর টু আজিমপুর সিটিং সার্ভিস (বলা ভাল, ফিটিং সার্ভিস, তিল তো দুর, সর্ষে ধরার জায়গাও থাকেনা)। একটা ছাড়া কোন সিট ফাঁকা নাই…গাদাগাদি করে সবাই দাঁড়ায়ে আছে কিন্তু কেউ ফাঁকা সিটটাতে বসেনা…কাহিনী হল, ফাঁকা সিটের পাশেরটাতে এক দশাসই মহিলা( বিলিভ মি, আমার চেয়েও মোটা!) বসে আছে,উনার বসার পর পাশের আধখানা সিটে একজন চেপেচুপে বসছিল, গাড়ি একটা মাঝারি সাইজের ব্রেক দিতেই বেচারি ভূপাত ধরণীতল মানে বাসের মেঝেতল! তারপর থেকে কেউ আর সাহস করে বসেনাই সিটটাতে.…শুক্রাবাদ থেকে একজন তালপাতার সেপাই বাসে উঠার পর চারপাশে চোখ বুলিয়ে ফাঁকা সিটে বসে পড়লেন…বাসের সবাই এক্ষুণি একটা ধপাস শব্দ শুনবে বলে বহুত আশা করে ছিল কিন্তু দুর্জনের আশার গুড়ে বালি দিয়ে লোকটা আধখানা সিটেই এঁটে গেল। ব্যাটা পিচ্চি হেল্পার দাঁত বের করে আনন্দের আতিশয্যে ড্রাইভার কে বলে উঠল- ‘উস্তাদ, খাপে খাপ মন্টুর বাপ ‘

।৪।

ঢাকার জ্যামের দুর্দশা আর নতুন কি, তবুও সেদিন কেন যেন অন্য দিনের চেয়ে জ্যাম বেশি ছিল। অবশ্য বাসে বিনোদনের অভাব ছিলনা। জ্যামে বসে গরমে সিদ্ধ হতে হতে শুনতেছিলাম কি নিপুণ দক্ষতায় আমার পিছনে বসা ছেলেটা পাশে বসা সম্পূর্ণ অপরিচিত মেয়েটাকে এই বাসযাত্রায় পটায়ে ফেলসে । প্রশংসার পর প্রশংসা শুনে মেয়েটা তখন পুরাই আবেগাপ্লুত, ঠিক এমন সময়ে ছেলেটা মেয়েটার মোবাইল নম্বর চাইল। মেয়েটিও দিয়ে দিল। কিছুক্ষণ পর মেয়েটি নামতে গিয়ে ওড়না আটকাইছে ছেলেটির বাসের সিটের চিপায়। আর ঠিক তক্ষুণি ছেলেটার রিংটোন বেজে উঠল- ” যেও না সাথী, চলেছ একেলা কোথায়?পথ খুঁজে পাবে না তো ” । মেয়েটা অবশ্য এই কাতর আহ্বানে সাড়া না দিয়ে ছেলেটার দিকে তাকায়ে হৃদয় হরণ করা হাসি দিয়ে নেমে গেছিল !

।৫।

হন্তদন্ত হয়ে শ্যামলী থেকে বাসে উঠল একটা মেয়ে। মেয়ের হাতের “প্রাইমেট” লেখা ট্রান্সপারেন্ট ফাইল দেখে অনুমান করা যায় তার গন্তব্য ফার্মগেটের কোচিং পাড়া ।মেয়েটা দেখতে যে অসাধারণ, তা মেয়েটা বাসে উঠার সাথে সাথে একদৃষ্টিতে সবার তাকিয়ে থাকা দেখেই বুঝা যাচ্ছিল। মেয়েটা বসার পরপরই পাশের ছেলেটার মুখ এক্কেবারে ফিলিপস বাতির মত জ্বলে উঠল। কিছুক্ষণ পর শুরু হল প্রশ্নোত্তর পর্ব।

-কোথায় যাও?কোচিং?
মেয়েটা উত্তর না দিয়ে মাথা নাড়ল।
-মেডিকেলের কোচিং?প্রাইমেট? আমিও প্রাইমেটে পড়ি।
আবার মেয়েটা মাথা নড়ল
-হোস্টেলে থাকো না?
মেয়েটা আবার এপাশ ওপাশ মাথা নাড়িয়ে বলল, না

যাই হোক, ছেলেটা যাই জিজ্ঞেস করে মেয়েটা চুপ করে থাকে, তখন ছেলেটা একটা অপশন দেয়।ভুল ঠিক অনুযায়ী মেয়েটা উপর নিচ না হয় ডানে বামে মাথা নাড়ে।এক পর্যায়ে ছেলেটা বিরক্ত হয়ে বলে উঠল-কি ব্যাপার?এত কিছু জিজ্ঞেস করতেছি।তুমি কথা বলনা কেন?

মেয়েটা তখন বাজখাই গলায় বলে উঠল- ” মায়ে হইয়ি দি, মরুতপোয়াইন্দর লই হতা ন হইত। ঢাহা শরর মরুতপুয়াইন খুব হারাপ। মিডা হতা দিয় ভুলাইয়রে ভাগি যাইবগই। এরলাইবলি মুখত তালা দি রাখিবি,এরলাই আই তো শুধু মাথা লাইরজি, ”

(( এই কথার মর্মার্থ হল- মা বলে দিসে , ছেলেদের সাথে কথা বলবি না, ঢাকা শহরের পোলাপান খুব খারাপ। মিষ্টি কথা বইলা ভাইগা নিয়া যাবে।এইজন্য মুখে তালা দিয়ে রাখবি, এইজন্য আমি শুধু মাথা নাড়সি ))

বলাই বাহুল্য, এরকম হাই ভিডিও কোয়ালিটির চেহারার সাথে এরকম ভয়ঙ্কর রকম অডিও কোয়ালিটির কম্বিনেশনে ছেলেটা যে পুরাই তব্দা খাইয়া গেসিল, সেই ব্যাপারে আর কোন সন্দেহ নাই।

।৬।

প্রায় আধাঘন্টা ধরে সিগন্যালে আটকা গাড়ি। চান্দি ফাটা গরমে বাসের মধ্যে মানুষের গায়ের ঘামের উৎকট গন্ধে সবার হালুয়া টাইট অবস্থা। বাসের জানালা দিয়ে তাকায়ে দেখি পাশের লেনে একটা আট নম্বর বাসের পিছনে লেখা – “চলেন চাচা দ্যাশে যাই, ঢাকায় কুনু মজা নাই”

প্রায় বছরখানেক আগে এই লেখাটা এরকম আরেকটা আট নাম্বার বাসের পিছনে দেখসিলাম,এইটাই সেইটা কিনা আল্লাহ মালুম। তবে যেই লিখুক, জ্যামে আটকে থাকার পর এরকম একটা যুগান্তকারী দর্শন আবিষ্কৃত হইছিল, এইটা ৯৯.৯৯% নিশ্চিত !!!

গল্পের বিষয়:
হাস্যরস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত