গঙ্গার ধারে একদিন কথা প্রসঙ্গে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র গোপালকে বললেন, ‘আমাদের বাঙালির মধ্যে ইলিশ মাছ দেখলেই লোকে দাম জিজ্ঞেস করে, এর কারণ কি?’
গোপাল উত্তর দিল, ‘এটা বাঙালির স্বভাব মহারাজ। তবে আমি যদি ইলিশ মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরি আমাকে কেউ দাম জিজ্ঞাসা করবে না।’
মহারাজ বললেন ‘এ অসম্ভব, হতেই পারে না, লোকে দাম জিজ্ঞেস করবেই।’
গোপাল মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে বললেন, ‘আমি নদীর ধার থেকে হাতে করে বাড়ি পর্যন্ত ইলিশ মাছ নিয়ে যাব, আমায় কেউ একবারও দাম জিজ্ঞেস করবে না। আমি হলফ করে বলতে পারি পরখ করে দেখতে পারেন।
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র বললেন, ‘তা অসম্ভব। লোকালয় দিয়ে ইলিশ মাছ হাতে করে নিয়ে গেলে কেউ-না-কেউ তোমায় দাম জিজ্ঞেস করবেই, না করে পারেই না। আমি আজ পর্যন্ত সব সময়ই দেখে আসছি এবং শুনেও আসছি।’
গোপাল আবার জোর গইলায় বললে, ‘ইলিশ নিয়ে আমি নদীর পাড় থেকে লোকের ভিড়ের মধ্য দিয়ে বাড়ি পর্যন্ত যাব, আমার কাছে একবারও কেউ দাম জিজ্ঞেস করবে না দেখতে পারেন।’
গোপাল বলল, ‘তর্কাতর্কি করে লাভ নেই, আমি হাতে হাতে প্রমাণ করতে চাই এবং গোপাল আরও বলল, ‘আমি অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারি কিনা দেখুন।’
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র তখন গোপালকে বললেন, ‘বেশ, তুমি প্রকাশ্য রাজপথ দিয়ে ইলিশ মাছ হাতে নিয়ে করে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যাও। পথে যদি তোমাকে কেউ ইলিশ মাছের দাম না জিজ্ঞেস করে, তবে আমি তোমাকে একশো-টাকা পুরস্কার দেব। যদি একজনও তোমায় দাম জিজ্ঞেস করে, টাকা তো তুমি পাবেই না, উল্টো তোমায় পঁচিশ ঘা চাবুক খেতে হবে। রাজী থাকো তো তুমি কাজে নামতে পার। পরে তো আমাকে দোষ দিতে পারবে না।’
গোপাল বললেন, ‘বেশ, আমি আপনার এ প্রস্তাবে রাজি আছি, দেখি পারি কিনা।’
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র জেলেদের কাছ থেকে গোপালের হাতে একটি বড় ইলিশ কিনে দিলেন। ঠিক হলো মহারাজের তরফ থেকে দু’জন বিশ্বাসী লোক সত্যাসত্য যাচাই করার জন্য গোপালের বাড়ি পর্যন্ত গোপালকে অনুসরণ করে পিছু-পিছু যাবে। যাতে গোপাল ফাঁকি দিতে না পারে।
কথামতো ইলিশ মাছ হাতে ঝুলিয়ে লোকালয়ে পা দেবারত আগেই কিন্তু গোপাল একটা গাছের নিচে পরণের কাপড়খানা পাগড়ির মতো করে মাথায় বেঁধে নিল। কপালে কিছু কাদা মেখে নিল, তারপর সেই বড় ইলিশ মাছটি নিয়ে বাড়ির পথ ধরল এবং কোনও দিকে না তাকিয়ে চলে যেতে লাগল।
তাই দেখে লোকে ভাবলো গোপাল পাগল হয়ে গেছে। নানা রকম ঠাট্টা-বিদ্রুপ করল বটে, বাচ্চারা-দু’একটা ঢিলও ছুঁড়ল কিন্তু পথের কোনও লোক তার কাছে একবারও ইলিশ মাছের দাম জিজ্ঞেস করল না। বাড়ির কাছাকাছি এসেই গোপাল মাথা থেকে কাপড়টা খুলে নিয়ে কোমরে জড়িয়ে চট করে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লো। গোপালের পাগলামী দেখে এবং বাড়িতে ঢুকতে দেখে কিছুক্ষণ পরে মহারাজের বিশ্বাসী লোকেরা যে যার বাড়ি চলে গেল।
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র বিশ্বাসী সঙ্গীদের মুখে সব ব্যাপারটা শুনে অবাক ও হতবাক হয়ে গেলেন। তখন বাধ্য হয়ে তাকে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী গোপালকে একশো টাকা পুরস্কার দিতে হলো। মহারাজের ধারণাই ছিল না যে গোপাল এমন অসম্ভব কাণ্ড করবে।