পাপ্পুদের বাসায় কল করলেই টেলিফোন রিসিভ করেন ওর বাবা এবং আঙ্কেলের প্রথম প্রশ্নই হলো, ‘রোল নম্বর কত?’ রোল এক থেকে তিনের মধ্যে হলে পাপ্পুর সঙ্গে কথা বলার দুর্লভ সুযোগ পাওয়া যায়; অন্যথায় হাজার লিটার চোখের পানি ফেলেও কোনো লাভ হয় না। সংগত কারণেই পাপ্পুর বাসায় ফোন করলে আমার রোল হয়ে যায় ‘দুই’। একদিন আমার কণ্ঠস্বরে রোল নম্বর ‘দুই’ শুনে আঙ্কেলের সন্দেহ হলো! তিনি মেঘগম্ভীরস্বরে বললেন, ‘এ প্লাস বি হোল স্কয়ার-এর সূত্র বলো’। ক্লাসের লাস্ট বয় হলেও প্র্যাকটিক্যাল লাইফে গাধা ছিলাম না। গণিতের বই সামনে নিয়েই ফোন করেছিলাম! পাপ্পুর দারোগা বাবার গুগলি প্রশ্নের জবাবে বাউন্ডারি হাঁকালাম। ক্লাস সেভেনের ঘটনা এটি। তারপর পদ্মার বুকে কত পলি জমল, কত ম্যানহোলের ঢাকনা চুরি হয়ে গেল; সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও বড় হলাম।
পাপ্পু বেচারাকে নিয়ে তার বাবার বিশাল পরিকল্পনা। ছেলেকে তিনি এমনভাবে গড়ে তুলতে চান, যেন আইনস্টাইন-নিউটনের নামের পাশে উচ্চারিত হবে আরেকটি নাম—পাপ্পু। বাপের চোখে স্বপ্ন, কিন্তু ছেলের চোখে সরষে ফুল! পিচ্চি পাপ্পু ক্লাস ওয়ানে যখন সবে উনিশের ঘরের নামতা মুখস্থ বলতে পারে, তখনই তার চোখে উঠল উত্তলাবতল (উত্তল+অবতল) লেন্সের চশমা। যে ওজনের ব্যাগ কাঁধে চেপে আমাদের মুসা ইব্রাহিম এভারেস্ট জয় করে ফেলেছেন, তেমনি ভারী ব্যাগ কাঁধে চাপিয়ে পাপ্পু হাজির হতো ক্লাসে। জীবনে পাপ্পুকে কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে যেতে দেখেছি একবারই। সে সময়ও তার সঙ্গে ছিল পাঁচ টন ওজনের স্কুলব্যাগ। তখন থেকে পাপ্পুর নাম হয়ে গেল ‘সমগ্র বাংলাদেশ-৫ টন’!
আমরা যখন ‘ফালুদা’ খেতে খেতে ‘ফেলুদা’ পড়তাম, পাপ্পু তখন অনুশীলনীর উপপাদ্য সমাধান করায় ব্যস্ত থাকত। কৃষিশিক্ষায় গরু মোটা-তাজাকরণের চ্যাপ্টার পড়ানোর সময় হাতে-কলমে জ্ঞান লাভের জন্য পাপ্পুর বাবা একটি ফ্রিজিয়ান গাভি কিনে ছেলেকে উপহার দিয়েছিলেন। টেস্ট পরীক্ষার প্র্যাকটিক্যালে কুনোব্যাঙ ব্যবচ্ছেদ করতে হয় বলে আঙ্কেল অর্ডার দিয়ে গ্রাম থেকে ব্যাঙ আনিয়েছিলেন। টাকার লোভে নাকি পুরো গ্রামে কয়েক শ ব্যাঙ ধরেছিল গ্রামবাসী। এই অভিযানে বিরল প্রজাতির দু-একটা ব্যাঙও যে বিলুপ্ত হয়েছে, তা গবেষণা করলেই বেরিয়ে আসবে। এতকিছুর পরও ছেলেটার রোল নম্বর দেখলে বড় মায়া হতো!
পাপ্পুর জীবনেও একবার প্রেম এসেছিল নীরবে। সুপ্ত প্রেম যখন উপযুক্ত আলো-বাতাস পেয়ে অঙ্কুরোদ্গমের অপেক্ষায়, তখনই দৃশ্যপটে দুঃস্বপ্নের মতো হাজির হলেন ‘রোগা দারোগা’ (আঙ্কেলের প্রতি পূর্ণ সম্মান রেখে এ নামটি আমরা তাঁকে দিয়েছিলাম)। প্যাদানির মহিমায় প্রেমের ফুল ফুলদানিতেই শুঁটকি হলো। শৈশব-কৈশোরহীন পাপ্পু যথারীতি নতুন পড়া গিলতে আর পুরোনো পড়া জাবর কাটতে শুরু করল।
ঘটনা ঘটল এসএসসি পরীক্ষার প্রথম দিন। পরীক্ষার হলে এক ঘণ্টার মাথায় পাপ্পু হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেল। বেচারার কী দোষ, আগের চার রাত না ঘুমিয়ে শুধুই পড়াশোনা করেছে। অসুস্থতার কারণে পাপ্পু আর কোনো পরীক্ষাই দিতে পারল না। কাজের সময় আট ঘণ্টা করার জন্য ‘ইন্টারন্যাশনাল লেবার ল’ হয়েছে; কিন্তু পড়াশোনার সময়সীমা নির্ধারণ করতে ‘ইন্টারন্যাশনাল স্টাডি ল’ নেই। এটি অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়! ছাত্রসমাজের উচিত, লেখাপড়ার জন্য নির্দিষ্ট সময়ের দাবিতে ফেসবুকের মাধ্যমে আপসহীন ডিজিটাল আন্দোলন গড়ে তোলা।
রেজাল্টের দিন যখন আমরা মিষ্টি বিতরণ করছি, তখন পাপ্পু পরের বছরে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে ব্রেকিং নিউজ হচ্ছে, বাবার তাড়নায় ছেলে কলেজের ‘ক্যালকুলাস’ করাও শুরু করেছে। বাবা-মায়ের অতি যত্নে নির্যাতিত পাপ্পুর মতো বন্ধুদের জন্য রইল প্রাণঢালা সমবেদনা!