তখন নব্য ক্লাস নাইনে পড়ি , পড়ি বললে ভুল হবে , মাত্র জেএসসি এক্সাম শেষ করে ক্লাস নাইনে ওঠার প্রতিক্ষায় থাকা এক কিশোর ।
উঠতি বয়স , মনে রঙ লাগার সময় । কারো কারো যে মনে রঙ লেগেছিল না এমনটা নয় ।
যাদের মনে রঙ লেগেছিল তাদের আমরা চেয়ে চেয়ে দেখতাম আর ভাবতাম “যা শালা ! জীবনে কি করলাম ?
নিজের জন্য না হোক বন্ধুদের “ভাবী” ডাকার আক্ষেপ ঘোচানোর মত একজন মানবীকে নিজের করে নিতে পারলাম না ?”
সারাদিন সাইকেল নিয়ে শহরের এ গলি থেকে ও গলি প্রাইভেটের নাম করে চষে বেড়ানোর সাথে কম্বাইন্ড প্রাইভেট শেষে অথবা শুরুতে “ভাবী”
আর একে অপরের ক্রাশের নাম ধরে ডাকা ছিল নিত্যদিনের রুটিন । সাথে গোপন কথা ফাস না করে দেয়ার শর্তে দেদারসে ট্রিট আদায় ।
মনে রঙ লাগানো দিনগুলি এভাবেই কেটে যাচ্ছিল ।
সরকারী স্কুল , ক্লাসে পড়ালেখার চাপ কম সাথে স্কুলে গেলেই টিফিন ফ্রি , সেই লোভেই হোক বা উপশহর মাঠে….
ডে শিফট আর মর্নিং শিফটের মধ্যকার ক্রিকেট খেলার লোভেই হোক স্কুলের নাম করে বাসা থেকে বেড়িয়ে পড়তাম কুয়াশা ভেজা সকালেই ।
তো এভাবেই বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে ফেলি । রেজাল্ট যে আহামরি হবে না তা বরাবরই জানা , তাই বলে কি দিন পনেরর ছুটি মাটি হতে দেয়া যায় ?
মোটেই না , আমরা সেই দলেই পড়ি না ।
চোখে চশমা লাগিয়ে একগুচ্ছ বই হাতে নিয়ে এই দিন পনেরর ছুটি মাটি করে অর্ধেকের বেশি সিলেবাস শেষ করে রাখার চিন্তা
আমাদের মাতাদের মনে উদ্রেক হলেও আমাদের মনে তা কোন কালেই দোলা দিতে পারে নাই ।
বড়জোড় বাবার কাছে থেকে নতুন ইন্টারনেট প্যাকের অফার বা সাইকেল মডিফাইএর অফার গুলো মাঝে মাঝে বই এর সাথে সাক্ষাতের সুযোগ করে দিত,
সেটাও শুধুমাত্র বৃহস্পতিবার আর শুক্রবার সন্ধ্যা বেলায়, হাজার হলেও বাবাকে দেখাতে হবে তো তার গুণধর ছেলে আসলেই তার কথা শুনেছে ,
তার কথা মতোই পড়াশোনা করছে ।
বই নিয়ে বড়জোড় টেবিলে বসে থেকে মশা মারাই হতো বা মায়ের হাতে তৈরী করা চা – পিঠা শেষ করাই হতো , কাজের কাজ কখনোই কিছু হত না ।
এমনি এক ছুটিতে দিন তিনেক যাওয়ার পরেই হাপিয়ে ঊঠেছি , বাসার কিছুই ভালো লাগে না ,
বালিকার মনের গলিতে দাগ ফেলতে গিয়ে একই রাস্তায় সাইকেল নিয়ে বারংবার ব্রেক কষতেও আর ইচ্ছা করে না । আর পড়াশোনা !
তার সাথে তো দিন তিনেক আগেই ব্রেক আপ করে ফেলেছি , মাস তিনেকের জন্য ।
রোজকার আড্ডায় , কি করা যায় , এই চিন্তায় বসে থেকে যখন মাছি মারছি তখন হঠাৎ করেই হাসিব বলে উঠল ওর দাদার বাড়ির কথা ।
গ্রামীণ পরিবেশ , এক পাশে নদী , সাথে কাশবন আর অন্য পাশে সর্পিল গতিতে এগিয়ে চলা রেললাইন সাথে ওর দাদার বড়ই এর বাগান ।
সবচাইতে বড় কথা আমাদের মত সাইক্লিস্ট দের জন্য সাইক্লিং এর একটা অপূর্ব সুযোগ ।
মোটামুটি বিনা ভোটাভুটিতেই এটা নির্বাচিত হয়ে গেলো যে আমরা আগামী পরশুদিন হাসিবের দাদা বাড়ির দিকে যাচ্ছি ।
বাসায় বলতেই তুলকালাম কান্ড , ” একা একা কেনো যাবি, বাসায় ভালো লাগে না ? নিজের আত্মীয়সজ্বন কী মরে গেছে ? ”
অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে সেবার বাসায় ম্যানেজ করলাম ।
তো ঠিক করা দিন ক্ষণেই সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে পরলাম বিবর্তন তত্ত্ব মেনে মানুষ হওয়া কিছু বাদড় ।
সারাদিন বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়িয়ে , এর ওর গাছের ফল চুরি করে , ক্ষেতের মাঝে গরু ছেড়ে দিয়ে ,
নদীতে ঝাপা ঝাপি করে চোখ লাল করে আবার যখন সেই কাঠখোট্টা শহুরে হওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে আদরের সাইকেল টাকে একটু ঘষামাজা করছি
তখনই হাসিবের দাদু বলে ঊঠলেন আজকের রাতটা থেকে যাওনা , বাবারা ?
জানিনা তার কন্ঠে কি ছিল, কিন্তু সেই অনুরোধ ফেলবার ক্ষমতা আমাদের কারোই ছিল না । কিন্তু আমরা চাইলেই তো আর হবেনা ,
আমাদের উপর আরেক ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ আছেন যারা সহজেই আমাদের এহেন আবদার মেনে নেয়ার জন্য বসে থাকেননি ,
বড়জোড় ভাঙ্গা ঝাড়ু নিয়ে বসে আছেন , কখন সুপুত্তর গণ রাজকার্জ সম্পাদন করে ঘরে ফিরবেন ,
আর কখন তাদের পারিবারিক ভাবে রাজকীয় সংবর্ধনা দেয়া হবে । আমাদের এই রাজকীয় সংবর্ধনার হাত থেকে বাচাতে দাদুই এগিয়ে এলেন ,
তিনিই সবার বাসায় ফোন দিয়ে আমাদের জামিন আদায় করে দিলেন ।
আমরাও এই সুযোগে দাদুর কাছে থেকে আমাদের দাবী আদায় করে নিলাম যে আজ রাতে আমরা পিকনিক করব ।
কথা অনুযায়ী কাজ তো করতে হবে , এ সময় আমাদের সাথে যুক্ত হলো হাসিবের দুই চাচাতো ভাই বশির আর সাকিব ।
তারাও যে আমাদের প্রজাতিভূক্ত তা টের পেলাম মিনিট দু পরেই। হাসিব যখনই বলে ঊঠল খেতে হলে তো বাজার সদাই করতে হবে।
দুই কিমি দূরের বাজার বন্ধ হয়ে যায় সন্ধ্যার পরপরই , জোলামাতি খেতে হলে দ্রুতই আমাদের সেদিকে যাওয়া উচিৎ ।
হাসিবের কথা শুনে তার দুই ভাই তার দিকে এমন ভাবে তাকালো যেনো তারা ভুলে বাদড়
এর পরিবর্তে শান্ত শিষ্ট বাম দিকে সিথি করে চুল আচড়ানো কোন মা নেওটে ছেলেকে দেখে ফেলেছে ।
তারপর ওরা যা বলল তার সারমর্ম হলো এই যে এই বয়সেও যদি নিজ নিজ ঘর থেকে সকল সরঞ্জাম দিয়ে জোলামাতি খাই ,
তাহলে আর যাই থাকুক, তাদের মানসম্মানের আর ছিটেফোঁটাও বাকি থাকবে না ।
তাদের মানসম্মান বাচানোর জন্যই হোক আর নতুন এ্যাডভেঞ্চারের ফাদে পরেই হোক, তাদের প্রস্তাবে রাজী হয়ে গেলাম ।
তেল, নূন, চাউল এগুলোর জন্য হাসিবের দাদু তাও আছেনই , বাকীগুলোর ব্যাবস্থা করার দায়িত্ব আমাদের।
ক্ষেত হতে সদ্য তোলা টাটকা সবকিছুর নেশায় পেয়ে বসেছে আমাদের , ফরমালিন দেয়া একবিন্দু পানি খেতেও আমরা আর রাজী নই ।
প্ল্যান হলো গ্রামের উত্তর প্রান্তে হলুদ , মরিচ , পেয়াজ আর পেপের বাগান আছে , ঐদিকে যাবে হাসিব আর আদিব ,
আর তরতাজা গাজর, টমেটো আর মটরশুটি আনতে যাবে হাসিবের চাচাত ভাই সাকিব আর আমাদের গ্রুপের সংগ্রাম ।
আর মাংস ? এটাই বোধহয় সবচাইতে হাস্যকর চুরি হয়ে থাকবে আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে ।
সাকিবের তথাকথিত প্রেমিকা তথা আমাদের ভাবী শেফালীর বাড়ি হলো পাশের গ্রামে ।
সাকিব ওর সাথে আগেই কথা বলে রেখেছিল যে ওদের হাসের ঝাক থেকে একটা রাজহাস দিতে হবে , আমাদের জোলামাতি পর্ব নির্বিঘ্নে শেষ করার জন্য।
আমাদের দায়িত্ব হলো তা গিয়ে নিয়ে আসা । অনেকটাই অবাক হয়ে আমরা শহুরে বাদড়গুলো সমস্বরে জিজ্ঞাসা করলাম কীভাবে সম্ভব ?
হাসিব অনেকটা রেগেই বলে উঠল ইয়ার্কী করিস , একটা মেয়ে কি এই সন্ধ্যা বেলায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে তোর জন্য , সাথে হাতে একটা হাস নিয়ে ?
ভাব খানা এমন যেনো তুই ঐ বাড়ির জামাই , তার মেয়েকে নাইওর রাখতে গেছিস,
আর আসার সময় মেয়ের বাপ তোর হাতে দুই তিনটা হাস ধরায় দিয়া বলতেছে যাও বাবা বিয়াইন রে নিয়া দিও ।
সাকিব তখন এমন ভাবে হেসে উঠল যেনো এই মাত্র সে শতাব্দীর সেরা হাসির কৌতুকটি শুনল ।
হাসতে হাসতেই সে ব্যাপারটা ব্যাখা করল এভাবে , আজ ওদের হাসের খাচার তালা লাগাবে শেফালী ।
তালা লাগানোর সময় ও তালা টা না লাগিয়ে শুধু চাবি নিয়ে চলে যাবে ।
আর আমরা হাস নিয়ে তালা টা টিপে দিয়ে চলে আসব ।
এহেন বুদ্ধি শুনে কিছুক্ষণ তব্দা খেয়ে বসে থাকার পর টের পেলাম এ কাজের ভার আমার উপরেই নাজিল হয়েছে ।
অনুরোধে ঢোক গেলার মত আমারও বাধ্য হয়ে পেডেল চাপতে হল পাশের গ্রামে যাওয়ার উদ্দ্যেশে ,
ভেবেছিলাম আমার দায়িত্ব সাইকেলের ব্যাপারটা , আর বাকিটা বশির ।
দ্রুতই জায়গামতো পৌছে গেলাম , আমি সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি এই আশাতে যে আমি দায়মুক্ত ,
কেউ কিছু বললেই ঝেড়ে টান দিয়ে বেড়িয়ে যাব , তখনই মোড়লের সাথে খানা খাওয়ার ব্যাপারটার মতোই আমাকে নিয়ে বশির বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেলো।
গ্রামের এলাকা , সন্ধ্যা না নামতেই কুয়াশা আর অন্ধকারে ঘিরে ফেলেছে চারদিক ।
একেবারে নিপুন হাতে দুটো রাজহাঁস বের করে নিয়ে এলো বশির ।
আমি ভাবছি হয়ত মেপে দেখছে কোনটা বড় কিন্তু আমার ধারণা কে বরাবরের মতোই ভুল প্রমাণ করে দিয়ে
দ্রুত হাতে রাজহাঁস দুটোকে বেধে আরেকটা রাজহাঁস বের করে নিয়ে এসে খাঁচার তালাটা টিপতে টিপতে বলে ঊঠল , আহ সেই রকম ।
আমি কিছু বলার আগেই আমার হাতে একটা ধরিয়ে দিয়ে বলল দ্রুত চল ,
এগুলা চিল্লিয়ে উঠলে পিঠের হাড় আর একটাও আস্ত থাকবে না , সাথে বাপের দেয়া প্রাণটাও।
আমি বলে উঠি আমাদের না একটা নেয়ার কথা ছিল!
বশির হেসে ওঠে , আর বলে , আরে সাকিবরে জামাই আদর খাওয়াইতে হবেনা ?
বাশ যার যাওয়ার তার যাবে আমরা ভেবে কি আর করতে পারি ? কারো বাশ যাওয়ার জন্য তো আর খাওয়া কমাতে পারি না ।
দ্রুত সাইকেল চালিয়ে আমরা আমাদের নির্ধারিত জায়গায় ফিরে আসি , হাঁস গুলোকে জবেহ দিয়ে রান্না শেষের পথে তখন এসে হাজির হয় সাকিব।
বেচারা তখনো জানে না যে ওর জন্য কাল কোন বাগানের কোন বাশঝাড় ওয়েট করছে , জানলে নিশ্চিত আধ রান্না হওয়া হাস গুলোই ফিরিয়ে দিয়ে আসত।
রাত দশটার দিকে রান্না শেষ হয়ে যায় , ক্লান্ত শরীরে রান্নার খুত ধরার মত সময় আর থাকেনা , রান্নায় লবণ কম হলো কি ,
হলুদ বেশী হলো তা নিয়ে কারো কোন চিন্তাই নেই , গাপুস গুপুস খেয়ে চলি । শুধু মাঝখানে সাকিব জিজ্ঞাসা করে এক হাসের এতো মাংস ?
বশির বলে বড় ছিল তো , আর এদিকে আমার দিকে তাকিয়ে মুখ চেপে হাসতে থাকে। আহ! বেচারা , যদি জানত ।
খাবারের ঝক্কি ঝামেলা শেষ হতেই ক্লান্ত দেহটা কে এলিয়ে দেই মাটির উপর বানানো খড়ের বিছনায় , রাতটা দ্রুতই শেষ হয়ে যায়।
আমরাও রওনা দেই আমাদের গন্তব্যে যেখানে আমাদের রাজকীয় সংবর্ধনা দিতে অপেক্ষা করছে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ।
যেখানে মুচলেকা দিয়ে এসে ছিলাম এবারের মত যেতে দাও , এসে তোমার কথামতই পড়াশোনা করব।
প্রমিস আম্মু, প্রমিস ।