গ্রামে এক গোঁপেশ্বর বাবু। ইয়া লম্বা গোঁপজোড়া। মুখের দুই ধার
হইতে দুইটি গোঁপের গুচ্ছ ২০-৩০ হাত ওপরে উঠিয়াছে। রোজ তেল আর আঠা লাগাইয়া গোঁপেশ্বর বাবু তার গোঁপজোড়াকে আরও শক্ত করিয়া রাখে।
গ্রামের ছোটরা গোঁপেশ্বর বাবুর বড়ই ভক্ত। ওই আগডালে পাকা আমটি রাঙা টুকটুক করিতেছে। ঢিল দিয়া কিছুতেই
সেটি পাড়া যাইতেছে না। গোঁপেশ্বর বাবু পথ দিয়া যাইতে ছেলেরা তাকে ধরিয়া বলিল, আমটি পাড়িয়া দাও। গোঁপেশ্বর বাবু তার গোঁপে একটু তা দিয়া গোঁপজোড়া আমের সঙ্গে আটকাইয়া মারিল এক টান।
অমনি আমটি পড়িয়া গেল। ছেলেরা কলরব করিয়া কুড়াইয়া লইল। শুধু কি আম! ওই আগডালের পাকা কুল, জামগাছের জাম আর খেজুরগাছের কাঁদিভরা পাকা খেজুর! যখন দরকার গোঁপেশ্বর বাবুকে ডাকিয়া আনিলেই পাড়িয়া দেয়। সেই জন্য ছেলেদের দলে গোঁপেশ্বর বাবুকে লইয়া কাড়াকাড়ি। এর মধ্যে হইল কি? কোথা হইতে গ্রামে আসিল এক দাড়িওয়ালা মিঞা। ২০-৩০ হাত লম্বা দাড়ি। চলিতে মাটিতে পড়িয়া যায়। যে পথ দিয়া যায়, দাড়িতে পথের ধুলা-বালু ঝাঁটাইয়া লইয়া যায়। পাড়ার বউ- ঝিয়েরা তাকে বড়ই খাতির করে। দেখিলেই বলে, দাড়িওয়ালা মিঞা, আইস, আইস, পান খাইয়া যাও।
দাড়িওয়ালা মিঞা বাড়িতে আসিলে বউদের আর উঠান ঝাঁট দিতে কষ্ট করিতে হয় না। ঠানের ওপর দিয়া ঘুরিয়া গেলেই উঠানের যা কিছু খড়-কুটা ধুলা-বালি তার দাড়িতে জড়াইয়া উঠানখানাকে সাফ করিয়া দিয়া যায়। শুধু কি তাই! কারও
বাড়িতে ছেলের ভাত খাওয়ানি, মেয়ের বিবাহ, বহু লোক খাওয়াইতে হইবে। মাছের জন্য আর জেলের পথ চাহিয়া থাকিতে হইবে না।
দাড়িওয়ালা মিঞাকে পুকুরে বা নদীতে নামাইয়া দিলেই হইল। রুই, কাতল, বোয়াল যত মাছ দাড়িওয়ালা মিঞার দাড়িতে আটকাইয়া আসিবে। তারপর ধরিয়া লইয়া যত পারো রান্না করো, খাও। সেই জন্য বউদের মধ্যে দাড়িওয়ালা মিঞার খুব খাতির। ছোটরা কিন্তু গোঁপেশ্বর বাবুকেই ভালোবাসে।
সেবার হইল কি? দেশে আসিল এক নতুন রকমের বাঘ। আজ ওর ছাগল লইয়া যায়, কাল ওর গরু লইয়া যায়। শুধু কি তাই! ছোট ছেলে মায়ের কোলে বসিয়া বোতলে দুধ খাইতেছে, কোথা হইতে বাঘ আসিয়া তাহার হাত হইতে বোতলটি কাড়িয়া লইয়া গেল। বাঘের জ্বালায় ছোটদের বিস্কুট, লজেন্স, চিঁড়ে, মুড়ি কিছুই খাইবার উপায় নাই।
কোথা হইতে বাঘ আসিয়া কাড়িয়া লইয়া যায়। শুধু কি তাই। মুন্দিরার মায়ের পানের ডিবা, রহিমের মায়ের তামাক পোড়ার কৌটা, করিম বুড়োর হুঁকো-কলকে কখন যে বাঘ আসিয়া ছোঁ মারিয়া লইয়া গেল, কেউ টের পাইল না। এই কথা রাজার কানে গেল। রাজা সমস্ত দেশে ঢোল পিটাইয়া দিলেন। যে বাঘ মারিতে পারিবে, তাকে হাজার এক টাকা পুরস্কার আর যে গ্রামে সে থাকে, সে গ্রাম তাকে লাখেরাজ দেওয়া হইবে। অর্থাৎ সে গ্রামের লোক রাজাকে খাজনা দিবে না। যে বাঘ মারিবে তাকেই দিবে। খবর
শুনিয়া গোঁপেশ্বর তার গোঁপে তেল দিতে দিতে ভাবিল, যদি বাঘ মারিতে পারি তবে কি মজাই না হইবে! সমস্ত গায়ের লোক আমাকে খাজনা দিবে। আমি পায়ের উপর পা ফেলিয়া কেবল আরাম করিব।
দাড়িওয়ালা মিঞাও তাহার দাড়িতে তা দিতে দিতে ভাবিল, যদি বাঘ মারিতে পারি, তবে কি মজাই না হইবে। হাজার এক টাকার ফুলেল তেল কিনিয়া কেবল দাড়িতে মাখাইব। সন্ধ্যা হইলে গোঁপেশ্বর বাবু গ্রামের একধারে যাইয়া তাহার গোঁপজোড়া মেলিয়া ধরিয়া বসিয়া রহিল। দাড়িওয়ালা মিঞা গ্রামের ওই ধারে বনের মধ্যে তাহার দাড়ির জাল ফেলিয়া বাঘের জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিল।
রাতের এক প্রহর গড়াইয়া দুই প্রহর হইল। বাঘের কোনো দেখা নাই। দুই প্রহর গড়াইয়া প্রভাত হয় হয়। বাঘের কোনো দেখা নাই। এধারে গোঁপেশ্বর বাবু গোঁপ মেলিয়া, ওধারে দাড়িওয়ালা মিঞা। এমন সময় হনহন করিয়া বাঘ হুংকার করিয়া গোপেশ্বর বাবুর সামনে আসিয়া তাড়া করিল। অমনি আর বাঘ যায় কোথায়? গোঁপেশ্বর বাবু বাঘের গলায় তার গোঁপজোড়া দিয়া গলফাঁস লাগাইয়া দিল। গোঁপসমেত গোঁপেশ্বর বাবু সমেত টানিয়া-হেঁচড়াইয়া বাঘ ছুটিল ওদিক পানে।
ওদিকে তো দাড়িওয়ালা মিঞা দাড়ির জাল পাতিয়া বসিয়াই আছে। বাঘ যাইয়া আটকা পড়িল তাহার দাড়ির জালে। দাড়ি ধরিয়া বাঘকে টানিতে টানিতে দাড়িওয়ালা মিঞা যাইয়া রাজসভায় উপস্থিত।
‘মহারাজ! ইনাম, বকশিশ দিন। বাঘ ধরিয়া আনিয়াছি।’ দাড়ির তলা হইতে গোঁপেশ্বর বাবু চিৎকার করিয়া বলে, ‘মহারাজ! ও বাঘ ধরে নাই। আমি বাঘ ধরিয়াছি। এই দেখুন, আমার গোঁপের সঙ্গে বাঘ আটকাইয়া আছে।’ এত টানা হেঁচড়ায় বাঘটি তখন মরিয়া গিয়াছে। অবাক হইয়া সকলেই দেখিলেন, সত্যিই তো গোঁপেশ্বর বাবুর গোঁপের সঙ্গে বাঘ আটকাইয়া আছে।
তখন এ বলে, আমি বাঘ ধরিয়াছি—ও বলে, আমি বাঘ ধরিয়াছি। অনেক বিচার করিয়া রাজা বলিলেন, তোমরা কেউ কারও চাইতে কম নও। দুইজনেই পুরস্কার পাইবে। পুরস্কার পাইয়া গোঁপেশ্বর বাবু আর দাড়িওয়ালা মিঞা গ্রামে সুখে বাস করিতে লাগিল।