এইরে পনেরো টা কল মিস হয়ে গেছে। আজ আমি গেলুম। হালুম করে গিলে না নেয়, ক্রোধবহ্নি। ভয়ে ভয়ে দশটা নাম্বার টিপলুম। ওপ্রান্তের যে মেজাজ তখন সপ্তমে, তা ফলাও করে বলার দরকার পড়ে না। একবার রিং হওয়াতেই ফোনটা ধরল।
-‘কি তোর আক্কেল বল দিকিনি’!
-‘ সেই কখন থেকে নেতাজীকে দর্শন করেই চলেছি’।
-‘ঘোড়াটাও আমাকে দেখে, লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে’।
আমার আক্কেল তখন গুড়ুম। হাসি চেপে রাখিদি কে বললুম, এই বেরিয়ে পড়েছি। তুমি আট্টু নেতাজী কে দেখো আমি চলে আসছি। রাগটা একটু গলানোর বিফল চেষ্টা। নাগেরবাজার থেকে দুশো ঊনিশের বাস যখন পৌঁছাল পাঁচটি মাথার মোড়ে, আকাশে তখন গোধূলির লাল আভা লেগেছে। লাল লাইট তার রং পরিবর্তন করার আগেই নেমে গেলাম। নেমেই দেখি, বইপোকা রাখিদি রাস্তার মধ্যেও বই গিলছে। কাঁপা কাঁপা পায়ে নামলাম। আমাকে দেখেই বকাবকি করার বদলে ঢিল ছোঁড়ার মতো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল দূর থেকেই।
-‘এ কেমন ধারা ইস্টাইল’?
-‘মাথায় ফেট্টি বেঁধেছিস কেন’?
না মানে ইয়ে। ইয়ে মানে ইয়ে ইয়ে করতে গিয়ে কথাটাই বলতে পারলাম না। বেশী ইয়ে করতে গেলে, রাস্তায় ইয়ে পেয়ে গেলে মুস্কিলে পড়তে হবে। হাত তুলে রাখিদি বলে উঠল,
-‘থাক অনেক ইয়ে ইয়ে করেছিস’।
-‘আর তোকে বলতে হবে না’।
-‘ওদিকে সবাই ওয়েট করছে চল’।
দাঁড়াও। দাঁড়াও। একটা জিনিস নেব। গগনদা ফুচকা নিয়ে গপ্পো লিখতে বলেছে না! ব্যাটাকে আজ খাওয়াচ্ছি ফুচকা। এরপর আর কোনো দিন ফুচকা কেন চাউমিন, সমোসা নিয়েও লিখতে বলবে না। রাখি দি কে সঙ্গী করে পরিচিত ফুচকা দোকানে হানা দিলুম।
সত্য দা। ও সত্য দা। তোমার ইস্পেশাল ফুচকা টা বানিয়ে ভালো করে জামা কাপড় পরিয়ে দাও দিকিনি। দেখো আবার মাখামাখি না করে বসে। বেশী মাখামাখি হয়ে গেলে মুখ দেখাতে পারবে না। চেনা পরিচিত হলেও বিনামূল্যে চক্ষু দান, রক্ত দানের মতো ফুচকা দান! কদাপি নেহি। জিন্সের পকেট হাতড়ালাম। শুধু বাস ভাড়া পড়ে আছে। কাঁচুমাচু মুখে, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা…. ঘুগনির হাঁড়ি ভরসা এর মতো রাখিদির দিকে তাকাতেই করুণ হৃদয়ের রাখিদি আমার করুণ মুখের প্রতি বিগলিত হয়ে টাকা বাড়িয়ে দিল।
ফুচকার প্যাকেট নিয়ে দেশবন্ধু পার্কে হাজির হলাম। পার্কের চেয়ার গুলো বসার উপযুক্ত ছিল না কস্মিন কালেও। পাখিরা একটু বেশী পরিমাণ দয়া পরবশ হয়ে সেগুলিতে নিজেদের ইচ্ছানুযায়ি সাদা রঙ দিয়ে, ভোটের কাগজে টিপ ছাপ দেওয়ার মতো সহস্রাধিক টিপ ছাপ দিয়েছে। কোথাও কোথাও সেই রঙের পরিবর্তন ঘটেছে। সেটাই স্বাভাবিক। এটা পশ্চিম বঙ্গ বস।
সে যাকগে। গগনদা কে মধ্য মণি করে সবাই বসে আছে ঘাসের উপর। একটা বৃত্ত তৈরী করেছে, পিন্টু ভাই, দাভাই; সৌভিক দা; ভাস্কর দা প্রমুখরা। দূর থেকে আমরা দেখলাম, হাত উঁচিয়ে নেতাদের মতো কি সব যেন বলছেন। আমাদের মাস্টারদা। সবাই গদগদ হয়ে সে সব গিলছে। আমরা এগিয়ে যেতেই রাখি দিকে ছেড়ে আমার উপর হামলে পড়ল সক্কলে।
সমস্বরে সবাই, “তোর মাথায় ফেট্টি কেন বাঁধা”। কি জ্বালায় পড়লুম রে বাবা। হাতের ফুচকা ছেড়ে দিয়ে মাথার ফেট্টি নিয়ে সবাই পড়ল। অগত্যা। গোপনীয়তা ত্যাগ করে বলতেই হল। মাথার কিছু পরিমাণ চুল আমার সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করেছে। আমাকে না বলে কয়ে, আমার অজান্তেই গিরগিটির মতো রঙ বদল করে অন্য পার্টি তে জয়েন করেছে। প্রতিবাদ স্বরূপ আমি বন্ধ ডেকেছি।
সবার জোরাজুরি তে মাথার ফেট্টি খোলানো হল আমার। এ অত্যাচার কাঁহাতক সহ্য করা যায়! সবাই সলিউশন দিল, মধ্যস্থতা করার। সবাই কে এক রঙে পরিণত করার। মতানৈকের কারণে একটু সমস্যা হবে বৈকি। এছাড়া আর যে রাস্তাও নেই। ফুচকা ছেড়ে সবাই পড়েছে আমার মাথার চুলের চুলোচুলি নিয়ে। কত্ত ভালোবাসে সবাই। এই ভালোবাসা দেখে, নিজেকে একটু অপরাধী মনে হ’ল।
চুল নিয়ে চুলোচুলি শেষ হবার পর, লোভনীয় জিনিসটা সবার মুখের সামনে তুলে ধরলাম। একটু দেরী হলেই মাখামাখি করে ব্যপারটা যা নয় তাই হয়ে যেত। মুখ লোকানোর জায়গা থাকত না তাদের। ইস্পেশাল ফুচকাটা গগনদার দিকে না এগিয়ে নিজে গিললাম। তার জন্য চারশো চল্লিশ ভোল্টেজের একটা ঝটকা লাগল। দু’টো কান দিয়ে আগুন বেরোতে লাগল। সে হোক। এত ভালোবাসা পাওয়ার পর, মাস্টারদার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলে নিজের বিবেকের কাছে ছোট হয়ে যেতাম।
সবাই তখন পরম তৃপ্তিতে চাকুম চুকুম আওয়াজ তুলে সত্যদার ফুচকা খেতে ব্যস্ত। আমি ঢকঢক করে জল গিলছি তখন। এই পরিস্থিতিতেও মনে মনে, ফুচকা নিয়ে গল্পের প্লট ভেবে চলেছি।