আমি রাইসা। লেখাপড়া শেষ করে দু বছরের রিলেশনে থাকা সেই ভালোবাসার মানুষটির সাথে বিয়ের পর্বটাও সেরে ফেলেছিলাম। কিন্তু আমার কপাল ভালো ছিলো না
হয়তো। আর এজন্যই আমার বিয়ের দুই মাসের মাথায় রাইহান ট্রাক এক্সিডেন্টে মারা যায়। রাইহানের বাবা-মা ছোটো বেলায় মারা যান। রাইহান ওর দাদু-দাদীর কাছেই
বড়ো হয়। তারপর ও মারা যাওয়ার পর ওর এই স্মৃতিমাখা বাড়িতে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিলো নাহ্। তাই আমি পাটনা চলে যাই। আজ প্রায় পাঁচবছর পর এ
বাড়িতে আসলাম।
.
আগের পুরাতন বাড়িঘর ভেঙ্গে এখন এখানে ইট-সুরকী দিয়ে নতুন দোতলা বাড়ি বানানো হয়েছে। ঘুরে ঘুরে সব রুমগুলো দেখছি। দোতলায় একটা ঘরের দরজায় হঠাৎ
চোখ আটকে গেলো।
.
দরজায় এরিস্টটল সহ কয়েকজন বিখ্যাত ব্যাক্তিদের ছবি দেখেই চিনে নিলাম আমার অতিকাঙ্ক্ষিত সেই ঘরটি।
হ্যাঁ এখন এটাই সেই ছবির ঘর। আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। দাদু আর দাদীমনির কাছে এই ঘরটা অনেক স্পেশাল। স্পেশাল হওয়ার কারনটা একটু পরই জানতে
পারবেন। ঘরে প্রবেশ করেই দাদুকে দেখলাম ছবি আঁকছেন। আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন।
.
দাদু-গুড মর্নিং দাদুভাই।
.
আমি – গুড মর্নিং দাদু।
.
দাদু- আমি জানতাম তুমি একাই এই ঘরটা খুঁজে নিবে।
.
আমি- খুঁজে তো নিতেই হতো দাদু। পৃথিবীর সব মনকাড়া জীনিসগুলো এই ঘরেই যে দেখতে পাই আমি।
.
দাদুর রংতুলিতে তিনি পুরো পৃথিবীটাই যেন কাগজে স্থান দিয়েছেন। পৃথিবী বিখ্যাত তাজমহলের ছবি। বড়ো বড়ো মনীষীদের ছবি, স্ট্যাচু অব নির্বাটির মতো পৃথিবী
বিখ্যাত মুর্তিগুলো সহ আরো কতকিছু দাদুর হাতের রংতুলির জাদুতে কাগজে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। আর সেসব গুলো ছবি এই ঘরেই সংরক্ষণ করা হয়। এজন্যই এটা
আমার প্রিয় জায়গা। এখানে আমি পৃথিবীর সব মনকাড়া জিনিসগুলো দাদুর চিত্রকর্মে দেখতে পাই।
দাদু- এখানে কিছু পেইন্টিং আছে, দেখো। তোমার ভালো লাগবে। এগুলো কাল আমেরিকায় প্রিন্স জ্যাকলোর কাছে পাঠিয়ে দেবো। ছবিগুলো নাকি ওনার মন কেড়েছে।
.
আমি ছবিগুলো দেখতে থাকলাম।
.
আমি- কি আঁকছো তুমি দাদু?
.
দাদু- হুম…. তুমিই দেখে নেও।
.
আমি- রাইহান!!!
.
দাদু- হ্যাঁ দাদুভাই!! রাইহানকে আঁকছি।
.
.
দাদু বলেন দূর্ঘটনায় মারা গেলে তার আত্না সহজে মুক্তি পায় নাহ্। এই বাড়িতে নাকি এখনো রাইহানের অস্তিত্ব মাঝেমাঝেই তিনি অনুভব করেন।
দাদুর গায়ের চাদর, ঘড়ি হারিয়ে গেলে অদৃশ্য হয়ে সে খুজে দেয়।
.
.
আমি- রাইহানকে দেখতে খুব ইচ্ছে করে দাদু।
.
দাদু- হুম।
.
ইন্ডিয়া থেকে আনা মামার ওই প্লানচেট করে একবার ডাকলে যদি রাইহানের আত্মাকে দেখা যায়। এটা করি দাদু? প্লিজ দাদু।
.
.
প্লানচেটের মাধ্যমে রাইহানের আত্মার সাথে দেখা করার ইচ্ছেটা এর আগেও ছিলো। দাদু কখনোই রাজি হন নি। তবে আজ আমার জেদের কারনেই দাদু রাজি হয়ে
গেলেন।
দেখলাম প্লানচেটের পেছনে লেখা আছে “without possession planchette” নিয়ম দেওয়া আছে…
আত্মা ডাকার সবচেয়ে উপযুক্ত সময় অমাবস্যার রাত আর প্লানচেট করার সময় বোর্ডের সামনে একটা মাথার খুলি রাখতে হবে।
.
আজ অমাবস্যা নয়, আর হঠাৎ করে মাথার খুলিও পাওয়া গেলো না। আমার মন যে মানছে না। আমার যেদের কারনে এভাবেই কাজ শুরু করা হলো। ঘর অন্ধকার
করে চারপাশে চারটা মোমবাতি জ্বালিয়ে আমরা চারজন আমি,দাদু, মামাতো ভাই রবিন আর পাশের বাড়ির পলি আপু প্লানচেটের বোর্ডের চারদিকে বসলাম। নিরব,
নিস্তব্ধ রাত। বোর্ডের মাঝে লাভ আকৃতির সেফে চারজন হাত রাখতেই আকাশে ভয়ঙ্কর গর্জন শুরু হয়ে গেলো। দাদু রাইহানের আত্মাকে ডাকতে শুরু করলেন।
.
রাইসা- দেখো দেখো…!! বোর্ডের ভেতর দিয়ে কালো ধোয়া বের হচ্ছে।
.
রবিন – কোথায় ধোয়া বের হচ্ছে রাইসা? মজা করিস না তো।
.
রাইসা- আমি মজা করছি না। সত্য বের হচ্ছে।
.
আমি ছাড়া সেই ধোয়া আর কেউ’ই দেখতে পেলো না। ধোয়ার আড়ালে আমার রাইহান’কে দেখলাম। আমি রীতিমত বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। একটু পরই সে মিলিয়ে গেলো।
.
দাদু তখনও রাইহানের আত্নাকে ডেকেই চলেছেন।
.
হঠাৎ বাতাসের তীব্রতা বেড়ে গেলো। মোমবাতির শিখা কেঁপে কেঁপে উঠলো। আকাশে প্রচন্ড জোরে মেঘের গর্জন হলো। তারপর ঘূর্ণঝড়ের মতো বাতাস আমাদের
চারদিকে গোল গোল হয়ে ঘুরতে থাকলো। মোমবাতিগুলো সব নিভে গেলো। হো হা হা হা হা করে একটা মানুষ আকৃতির লাল আগুন আমাদের সামনে প্রকট হলো।
দাদু চিৎকার করে বলছেন আমাকে বাঁচাও। আমার পুরো শরীর জ্বলছে।
মানুষ আকৃতির আলোটা বলছে.., পারবে না। বাঁচতে পারবে না।
.
তারপর চারপাশের পরিবেশ শান্ত হলো। আলোটা অদৃশ্য হয়ে গেলো আর দাদু অজ্ঞান হয়ে গেলেন। আমরা সারারাত অনেক চেষ্টা করেও দাদুর জ্ঞান ফেরাতে পারলাম
নাহ্। সকালে দাদুর হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিলো। বুকের ভেতরটা ধুক করে উঠলো।
.
পলি আপু বললো প্লানচেটের সব রহস্য ওঝারাই বুঝতে পারে। আমরা আর এক মুহূর্তও দেরী না করে দাদুকে নিয়ে ওঝার কাছে চলে গেলাম।
.
.
ওঝার বক্তব্য মতে আমরা এক অসুভ আত্নাকে ডেকে এনেছি আর এখন সেই আত্মাটা দাদুকে তার সাথে নিয়ে যেতে চায়। দাদুকে বাঁচানোর জন্য ওই আত্মার বিনাশ
করতে হবে। আর এর জন্য শ্বশানের ছাই লাগবে।
আমি আর রবিন গেলাম ছাই আনতে। শ্মশানঘাটে এসে রবিনের পা ভারী হয়ে গেলো। রবিন কষ্টভরা কন্ঠে বলছে, আমি আর যেতে পারবো না। মনে হচ্ছে কেউ এক
গাদা পাথর আমার পায়ের সাথে বেঁধে দিয়েছে। আমি পা তুলতে পারছি না। বাকি পথটা তোকে একাই যেতে হবে রাইসা। দাদুকে বাঁচাতে হলে এতটুকু সময় নষ্ট করা
ঠিক হবে না। ওঝা বলেছিলো আত্মারা আমাকে এ কাজে বাঁধা দিতে সর্বপ্রচেষ্টা চালাবে। আমার প্রাণবিনাশও হতে পারে। প্রয়োজনে নিজের জীবন দিয়ে হলেও দাদুকে
আমি বাঁচাবোই। আর কিছু না ভেবে রবিনকে ওখানেই রেখে আমি পা বাড়ালাম।
শশ্মানঘাটে পা রাখা মাত্র পুরো পৃথিবী আধারে ছেয়ে গেলো। এই মধ্য দুপুর বেলায়ও আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেলো। ওঝার কথা মতো এখন আমাকে পেছনে না
তাকিয়ে সোজা সামনের দিকে যেতে হবে। পেছনে তাকালেই আত্মারা আমাকে আর ছাড়বে না। কিছুটা যেতেই পাশের বাড়ির শিলা খালামনির আওয়াজ শুনতে
পেলাম। খালামনি চিৎকার করে কান্না করছে আর বলছে রাইসা বাঁচাও আমাকে। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। আমি দাড়িয়ে গেলাম। পেছনে তাকাতে গিয়েও ভাবলাম,
এখানে খালামনি আসতে পারে না। এটা নিশ্চই আত্মাদের চক্রান্ত। আবার হাঁটতে শুরু করলাম।
.
এবার দেখলাম একটা মরা লাশ পড়ে আছে। কয়েকটা সাপ লাশটাকে পেঁচিয়ে রেখেছে। লাশটার হাত, পা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে, মনে হচ্ছে তার দেহে এক বিন্দুও রক্ত নেই। চোখের জায়গাটা দেখে বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো। চোখগুলো কেউ নির্মমভাবে বের করে নিয়েছে। এমন ভয়ানক একটা লাশ আমার সামনে পড়ে আছে। একটু দূরেই মামার সেই প্লানচেটের বোর্ড ঝুলতে দেখছি। বোর্ডের ভেতর থেকে রক্ত গরিয়ে পরছে। সর্বনাশ! এখানে এই লাসটা আর প্লানচেট থাকার মানে কি? এই প্লানচেট শ্বশানে আসলো কিভাব?!! এটার ভেতর থেকে অতৃপ্ত আত্মারা রক্ত খেতে আসে নাতো?
.
হঠাৎ বাতাসের তীব্রতা বেড়ে গেলো। কাল রাতের মতো আকাশে মেঘের গর্জন শুরু হলো।
ঝুলন্ত প্লানচেটটা মাটিতে পড়ে গেলো। প্লানচেটের ভেতর থেকে রক্তের ধারা বের হতে লাগলো। শশ্মানঘাটের মাটি ভিজে রক্তাত্ব হয়ে গেল। তারপর প্লানচেটটা ভেঙ্গে
গেলো। প্লানচেটসহ নিচের মাটি ফাক হয়ে গেলো। মাটির ফাক দিয়ে বেরিয়ে আসলো অসংখ্য কঙ্কাল। তারা সারিবদ্ধভাবে আমার দুপাশে নাঁচতে লাগলো। তারা
অনেকে খিক খিক করে হাসছে, আবার অনেকে হু হু কাঁদছে। শশ্মাশঘাটের সান্ত নিস্তব্ধ পরিবেশ হঠাৎই কোলাহলপূর্ণ হয়ে এক ভয়ানক রুপ ধারন করলো।
কঙ্কালগুলো বলছে.. আসো, আমাদের কাছে আসো। আমাদের চিরশান্তির দেশে আসো। তাড়াতাড়ি আসো। দেরী করো না। কঙ্কালগুলো বারবার হাত বাড়িয়ে আমাকে
ধরতে চাইছে। আমি একমনে দ্রুত পায়ে হাঁটতে থাকলাম।
.
অবশেষে অতিকাঙ্ক্ষিত ছাইয়ের দেখা মিললো। ওঝার দেওয়া লাল কাপড়টা পকেট থেকে বের করলাম। একমুঠো ছাই কাপড়টাতে ভরে নিয়ে যেই উঠে দাড়িয়েছি।
ওমনি আমার সামনে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো। আগুনের ফুলকির তীব্রতায় আমি চার-পাঁচ কদম পিছিয়ে গেলাম। একটা ভয়ঙ্কর নারীমুর্তি হা হা করে
চিৎকার করে হাসতে হাসতে,, সেই আগুনের ভেতর থেকে উঠে দারালো। নারীমূর্তিটা বলছে ,,, হা হা হা!!,, আমি থাকতে, এই শ্বশানের ছাই নিতে এসেছিস তুই?
এত্তোবড়ো দুঃস্বাহস তোর!!!.
আমার চোখজোড়া ভয়ে বড়ো বড়ো হয়ে গেল। আশেপাশের বালিগুলোতে যেন ঘূর্ণঝড় লেগেছে। বাতাসে বালিগুলো গোল গোল হয়ে ঘুরতে লাগলো।আকাশে হঠাৎ
তীব্র বজ্রপাতের আওয়াজ হলো। থর থর করে কাঁপছি আমি। নারীমূর্তিটার পুরো শরীর আগুনের ছিলো,, মাথায় চুলের বদলে একগুচ্ছ লম্বা লম্বা সাপ নরে চরে
যাচ্ছিলো। তোর চোখ নেই। চোখের স্থানে শূন্যতায় অন্ধকার গভীর গর্ত। গর্তের মাঝে রক্তলাল চোখের মনি। তার ডান চোখের গর্ত দিয়ে তাজা রক্ত বেরিয়ে আসছিলো।
নারীমূর্তিটা আস্তে আস্তে বিশাল আকারের হয়ে গেলো। উচ্চতায় আমার থেকে দশগুন বড়ো হলো। কেউ কিভাবে এত্তো ভয়ঙ্কর হতে পারে!! অনবরত ধুক ধুক করতে
থাকা হৃদপিন্ডের স্পন্দনের কারনে রবিনের চিৎকারের আওয়াজও শুনতে পারছিলাম নাহ্। নারীমূর্তিটার বিশাল হাত এতোক্ষনে রবিনকে ধরে ফেলেছে। সে রবিনকে
মুখের সামনে আনলো। রবিনের ঘাড়ে দাঁত বসিয়ে ওর দেহের সব রক্ত চুসে খেয়ে নিলো।
তারপর রবিনের নেতিয়ে যাওয়া দেহটাকে টেনে চিরে দু টুকরো করে ফেললো। এবার নারীমূর্তিটা রবিনকে খাওয়ার জন্য তার মুখ খুললো। তার মস্তবড়ো মুখগহব্বরের
ভেতর থেকে জিহ্বার মতো একটা কালো কুচকুচে সাপ বেরিয়ে আসলো। সেই জিহ্বা দিয়ে সে রবিনকে টেনে নিয়ে গিলে ফেললো। আমার মাথা ঘুরছে। সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসলো। আমি জ্ঞান হারালাম।
.
.
চোখ খুলে নিজেকে আমার ঘরে
আবিষ্কার করলাম। ছাই আনতে দেরী হওয়ায় দাদুকে আর বাঁচানো সম্ভব হয় নি। ওঝার কাছে জানতে পারলাম আমার রাইহানের আত্মাই আমাকে ওই পিশাচ আত্মাটার হাত থেকে বাঁচিয়ে আমাকে বাড়িতে রেখে গিয়েছে।
শুনে কষ্ট লাগলো আমি দাদুকে বাঁচাতে পারলাম নাহ্।
.
পরদিন আমার জন্মদিন ছিলো। রাত বারটা বেজে এক মিনিট, ক্লান্ত আর বিস্বাদ ভরা মন নিয়ে গা এলিয়ে ইজি চেয়ারে বসে আছি। এমন সময় গিটারের সেই
চিরপরিচিত গানের সুর কানে ভেসে আসলো। দরজাটা খুলেই মেঝেতে কুড়িয়ে পেলাম একগুচ্ছ লাল গোলাপ। সুরের মূর্ছনা আমাকে বাড়ির আঙ্গিনা পর্যন্ত টেনে
আনলো। সেখানে এক কোনায় গিটারটা পেলাম আর আঙ্গিনার দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম পুরো আঙ্গিনায় লাল গোলাপের পাপড়ি দিয়ে লেখা….
ভালোবাসি রাইসা,
ইতি,
“তোমার রাইহান”
.
মনে হালকা দোলা লেগে গেলো। আমার রাইহান ফিরে এসেছে।
………………………………………………সমাপ্ত……………………………………………….