নিরাপদ প্রেম

নিরাপদ প্রেম

প্রায় ১০ বারো বছর আগের কথা।
তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি।
আমাদের এক বড় ভাই ছিল নানান উদ্ভাবনী ক্ষমতা সম্পন্ন।
নমুনা দেওয়া যাক।
শুরু হোক নাম দিয়ে।

তার নাম আর দশটা গতানুগতিক নামের মতো না। বেশ শান দেওয়া নাম।
মোহাম্মদ আবু নাসের মোহাম্মদ আবু সাঈদ।
নামের মধ্যে মোহাম্মদ আর আবু’র বাড়াবাড়ি উপস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলাম আমরা।
ভাই দুইটা কইরা মোহাম্মদ আর আবু না দিয়া এই দুইটারে কমন ধইরা নামটা শর্ট করতে পারতেন।
আরে বলিচ্চা, এইখানে তো আমার নাম বলে কিছু নাই। তাই করারও কিছু নাই।
মানে!

আমরা অবাক হই।
হুমম। ছোটবেলায় দুইজনের নাম মিলিয়ে আমার নাম রাখা হয়। দাদার নাম আর নানার নাম। আমার দাদার নাম মোহাম্মদ আবু নাসের আর নানার নাম মোহাম্মদ আবু সাঈদ।
প্রথমে আমার নাম ঠিক করা হয়েছিল- আবু নাসের মোহাম্মদ আবু সাঈদ।
এই নাম শুনে দাদা বাড়ির লোকজন বেশ গোস্যা করল। বিশেষ করে আমার দাদা।
হতাশ হয়ে তিনি জায়নামাজে বসে পড়লেন।
তাঁর ছেলে এমন শ্বশুরবাড়ি পাগলা হবে সেটা তার ভাবনাতেই ছিল না।

দাদার গোস্যা করার কারণ আমার নাম থেকে তাঁর নামের মোহাম্মদ শব্দটা বাদ পড়েছে।
দাদাকে বোঝানোর চেষ্টা করল আমার বাবা।
একটা মোহাম্মদ তো আছে। একজনের নামে কয়টা মোহাম্মদ থাকবে।
বাদ যদি দিতে হয় তোর শ্বশুরের মোহাম্মদ বাদ দে। ছেলে হয়ে তুই বাপের মোহাম্মদটা বাদ দিতে পারলি।
বলতে বলতে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন দাদু।

ওদিকে নাম জানাজানি হয়ে গেছে।
নানার নামের মোহাম্মদ যে বাদ দেবে সে উপায়ও আর নেই।
কী আর করা। সবার আবেগ ধরে রাখতে গিয়ে শেষে আমার নামে আরো একটা মোহাম্মদ যুক্ত করা হলো। মোহাম্মদ আবু নাসের মোহাম্মদ আবু সাঈদ। আমার নাম আসলে আমার নাম না। আমার দাদার নাম আর আমার নানার নাম। দাদাবাড়ির লোকজনের কাছে আমার ডাকনাম নাসের। আর নানাবাড়ির লোকজন ডাকে সাঈদ নামে।

আমার নিজের বলে আসলে কিছু নেই।
করুণ মুখে বলে নাসের ওরফে সাঈদ ভাই।
তার কালো মুখ আমাদের মনেও গভীর দাগ কাটে।
আসলেই তো। একটা মানুষের মালেয়শিয়ান টাইপের এতবড় একটা নাম অথচ সেই নামে তার নিজের বলে কিছু নেই।
নামের মধ্যে নিজের বলে কিছু না থাকলেও ক্যাম্পাসে তার নিজের বলে একজন ছিল।
নিজের মানুষ। মনের মানুষ।

প্রেম নিয়ে নানান এক্সপেরিমেন্টের জন্য তিনি ক্যাম্পাসে বিখ্যাত ছিলেন। প্রেম সংক্রান্ত বিষয়ে উপদেশ-পরামর্শ নেওয়ার জন্য অনেকেই তাঁর কাছে যেত। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের দু-একজন তরুণ শিক্ষককেও তাঁর শরণাপন্ন হতে দেখেছি।
তো সেই বড় ভাইকে কোনো এক দরকারে খুঁজে না পেয়ে ফোন দিলাম।
ভাই কী করেন?
ভাই বললেন, নিরাপদে প্রেম করি।
নিরাপদে প্রেম!

ঢাকা শহরের মতো একটা আনরোমান্টিক অনিরাপদ শহরে নিরাপদে প্রেম করার সুযোগ কোথায়! জীবনই যেখানে নিরাপদ না। সেখানে নিরাপদে প্রেম!
আমাদের খটকা লাগে।
হ। নিরাপদে প্রেম করি। তাও মাত্র আশি টাকায়। সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ কথাটি নাসের ওরফে সাঈদ ভাই এমনভাবে বলেন যে একটা ঠান্ডা স্রোত আমাদেরও ছুঁয়ে যায়।
কিন্তু তাতে আমাদের মন শীতল হয় না। খটকাও কাটে না।
খটকা উল্টো জটে পরিণত হয়।

ঢাকা শহরে নিরাপদে প্রেম করার জায়গা কই? তাও আবার ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল!
আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করি। রহস্যের কূল খুঁজে পাই না।
আরে। আছে, আছে। মাত্র আশি টাকায়। নিরাপদ প্রেম।
ছেলেপেলে যেখানে শয়ে শয়ে টাকা খরচ করতে রাজি একটু সেফটির আশায়। সেখানে মাত্র আশি টাকায় নিরাপদে প্রেম!
তরিকাটা জানতে চাই আমরা।
ভাই বললেন, ডিস্টাব দিছ না। নিরাপদে প্রেম করতে দে। সাক্ষাতে তরিকা বলব।

নিরাপদ প্রেমের অন্তরায় না হয়ে আমরা সাক্ষাতের অপেক্ষায় থাকি।
দেখা হলে ভাইকে ঘিরে ধরি।
আমাদের তরিকা জানার ব্যাকুলতা তাকে স্পর্শ করে না।
নির্লিপ্তভাবে বলেন, এতবড় একটা বুদ্ধি শিখায়া দিব। খরচাপাতি ছাড়া। একটু নিরাপদের আশায় কত টাকা খরচ করিস। আর বুদ্ধির জন্য কোনো বাজেট নাই!
ভাইয়ের কথা শেষ হওয়ার আগে আমরা তিনজন একসাথে চা-সিঙ্গারার অর্ডার দিয়ে ফেলি।
গরম সিঙ্গারায় কামড় দিয়ে আসল কথায় আসেন বড় ভাই।

আস্তে আস্তে নিরাপদ প্রেমের রহস্য উন্মোচন করেন।
তখন ঢাকা শহরে নিরাপদ পরিবহন নামে একটা এসি সার্ভিস ছিল।
মতিঝিল থেকে আব্দুল্লাহপুর। জনপ্রতি কুড়ি টাকা ভাড়া।
বড় ভাই তার প্রেমিকাকে নিয়ে নিরাপদে উঠে বসতেন। বসতেন গিয়ে একদম লাস্ট সিটে। দুজনে কুড়ি কুড়ি চল্লিশ টাকা দিয়ে প্রেম করতে করতে চলে যেতেন আব্দুল্লাহপুর। আবার ফিরতি বাসে কুড়ি কুড়ি চল্লিশ টাকায় ফিরে আসতেন ক্যাম্পাসে। সর্বমোট আশি টাকায় ‘নিরাপদে প্রেম’।

এসি বাসে যেহেতু জানলা বন্ধ থাকে তাই বাদাম খাওয়ারও সুযোগ নেই। বাড়তি খরচও নেই। আশি টাকায় ফুল প্যাকেজ।
নাসের ওরফে সাঈদ ভাইয়ের তরিকা পাওয়ার পর আমাদের অনেকেই নিরাপদে প্রেম করার জন্য নিরাপদ সার্ভিসকে বেছে নিয়েছিল।
এখন নিরাপদ সার্ভিস আর নেই।
আচ্ছা, নিরাপদ প্রেম কি আছে?

গল্পের বিষয়:
হাস্যরস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত