১. রাতের কালো আকাশে বিন্দু বিন্দু তারার আলো দেখে আমার হঠাত ঘুম পেয়ে গেল । রাতের আকাশ আমার ভীষণ প্রিয় , প্রতিদিন রাতে আমার বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে শুধুমাত্র তারা দেখেই আমি অনেকটা সময় পার করে দিতে পারি । অন্যান্য দিনের চেয়ে আজকের আকাশটাকে আরো বেশি সুন্দর লাগছে , তাই আমি কেমন যেন বুভুক্ষের মত তারার মেলা দেখছিলাম । যদিও আজকের প্রেক্ষাপট অন্যদিনের চাইতে ভীষণ আলাদা , এরকম সময়ে কেউ কোনদিন রাতের আকাশ উপভোগ করতে পারেনা । সত্যি কথা বলতে কি , আমিও ঠিক উপভোগ করতে পারছিলাম না , শুধুমাত্র সময় কাটাচ্ছিলাম । ঘড়িতে এখন রাত সাড়ে নয়টা বাজে ,আর আমি কাজি অফিসের বারান্দায় একটা রুপবতী মেয়েকে পাশে নিয়ে বসে আছি । বসে থাকতে থাকতে আমি বুঝলাম ,মিস্টার আইনস্টাইন আসলে ঠিক বলেন নি । কারন আমি নিধি নামের একজন রুপবতী মেয়ের সাথে প্রায় তিনঘণ্টা ধরে বসে আছি ,আইনস্টাইনের ভাষ্যমতে আমার কাছে এটাকে তিন মিনিট লাগা উচিত অথচ আমার এই সময়টাকে তিনশ যুগের কাছাকাছি মনে হচ্ছে , সাথে ভয়াবহ টেনশান ও হচ্ছে । আইনস্টাইনের আমলে আমি বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই তাঁকে গিয়ে বলতাম ,” আপনি যে এমন লুইস প্রজাতির , সেটা কি আপনার বাসায় জানে ?”
নিধি মুখ শক্ত করে বসে আছে । তার পরনে লাল রঙের সুন্দর একটি শাড়ি , মাথায় লাল ওড়না, চোখে মোটা চশমা । মেয়েটি চশমা ছাড়া ঠিকমত কিছুই দেখেনা ,তাই বিয়ের ধামাকা সাজেও তাকে চশমা পরতে হয়েছে । এই মেয়েটির আজকে বিয়ে হবার কথা ছিল । তার বাবা মা তার জন্যে যে ছেলেটিকে ঠিক করেছিল তার নাম আসিফ , সেই ছেলেটিকে নিধির পছন্দ হয়নি ,কারন নিধি শাহেদ নামের একটা বলদকে ভালবাসে । তাই বিয়ের সন্ধ্যায় কনের সাজেই সে বাসা থেকে পালিয়েছে শুধুমাত্র এই বলদকে বিয়ে করবার জন্য । ঘটনাক্রমে আমি আর নিধি এখন কাজি অফিসের বারান্দায় ঝিম মেরে বসে আছি। নিধির সাথে পালানোর জন্য আমাকে আলাদা করে মাইক্রোবাস ভাড়া করতে হয়েছে , সেই মাইক্রো দিয়ে আমি আর নিধি এখন বিপদসীমার খানিকটা বাইরে ।কাজি অফিস খুঁজে পেতেও সমস্যা হয়নি, তবে অফিসের বারান্দায় রাখা চেয়ারে তিন ঘন্টা ধরে বসে থেকে আমি বুঝতে পারলাম , এখানকার মশাগুলি আসলে মহামতি কাউন্ট ড্রাকুলার খুব কাছের আত্মীয় । আর ঘন্টাখানেকের মাঝে তারা আমাকে ছিবড়া বানিয়ে ফেলবে , তারপর হয়ত আমি ও মশা হয়ে কাজি অফিসের বারান্দায় উড়াউড়ি করব ,কে জানে ?
আমি নিধির দিকে তাকিয়ে আছি ,তার মুখে বেদনার আলোআধারী ছায়াটা ভীষণ স্পষ্ট । অথচ কি স্নিগ্ধই না লাগছে তাকে । এত সুন্দর একটা মেয়েকে পেতে হলে জীবনে অনেক পুন্য করতে হয় , আমি তো এত পুন্য করিনি । তবুও আমি কেন এই মেয়েটিকে এত চেয়েছি ? আমি নীরবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম । হঠাত নিধি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ভাঙ্গা গলায় বলল , ” আমার না ভীষণ ভয় করছে ” আমি তখন একটা মশাকে নির্মম ভাবে মারতে মারতে বললাম ,” ঠিক বলেছ নিধি , এই মশাগুলি আসলে অমানুষ , আমাদের একদম শেষ করে ফেলবে ” নিধি হাল ছেড়ে দিয়ে বলল ,” প্লিজ আমার জোক ভাল লাগছেনা । আমরা আর কতক্ষন এভাবে থাকবো ?” আমি কিছু বলবার আগেই কাজির রুম থেকে চামচা টাইপ কেউ একজন মাথা বের করে বলল ,” হুজুর আর পনের মিনিট পর বাড়ি যাইবেন । আপনেরা কি করবেন সেই রাস্তা মাপেন ।” আমি চোখ গরম করে তার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলাম ,খুব ইচ্ছে হচ্ছিল বেটাকে বলি ,” জনাব চামচা ভাই , রাস্তা মাপতে গজ ফিতা লাগবে , আপনি কি এক রাতের জন্য আমাকে গজ ফিতা ধার দিবেন ?” চামচা চলে গেল , নিধি ফুপিয়ে ফুপিয়ে আমাকে বলল ,” আই এম সরি , আই এম এক্সট্রিমলি সরি , আসিফ ”
এই পর্যায়ে দ্বিধান্বিত পাঠকের উদ্দেশ্যে বলছি , হ্যা ভাই আপনি ঠিকই দেখছেন ।নামটি আসিফ, নিধি আসিফকেই কথাটি বলেছে । যেই আসিফের সাথে তার বিয়ের কথা ছিল , আমিই হলাম সেই আসিফ ।
আমি হেসে বললাম ,” ধুর পাগলি , এভাবে কাঁদছ কেন ?” নিধি কাঁদতে কাঁদতে বলল ,” জানেন, আমি শাহেদকে প্রচণ্ড বিশ্বাস করেছিলাম , আমি ভাবতেও পারিনি ও এরকম করবে আমার সাথে ” আমি বেকুবের মত বললাম , ” আমিও কি পেরেছি ? সেই ভদ্রলোকের মোবাইলটা পর্যন্ত অফ ” নিধি চোখ মুছতে মুছতে বলল ,” আরেকবার দেখবেন ?” আমি ফোন দিলাম , আবার দিলাম , তৃতীয়বারের বেলায় হঠাত রিং হচ্ছে শুনে সোজা হয়ে বসে নিধির দিকে তাকিয়ে ওকে আশ্বাস দিলাম । শাহেদ ফোন ধরল , ” আসিফ ভাই, বলেন ” ” ঐ বেটা ফাইজলামি কর ? আমি কি বলব ? ফোন অফ করে রাখছিলা কেন ? তুমি কোথায় ?” ” আসিফভাই আমি আসলে আসতে পারবোনা , আব্বা টের পেয়ে গেছে , আমি যতগুলি টাকা সরাইছিলাম তিনি সব নিয়ে গেছেন ” ” তো ? তোমাকে কি আমি পিকনিকে ডাকছি ? টাকা দিয়ে কি করবা , তুমি চলে আসো ,তাইলেই হবে ” ” আমাকে মাফ করেন , নিধিকে বলেন আমাকে ভুলে যাইতে , আমি এখনও ছাত্র , ওকে নিয়ে কিভাবে চলব আমি ? ” মেজাজ আর ধরে রাখতে পারলাম না , ”শাহেদ , আমরা রাত পৌনে দশটা বাজে কাজি অফিসের সামনে বসে আছি আর তুমি এই টাইমে ফাইজলামি মারো ? নিধি পালিয়ে আসছে , ওর কি হবে ভাবছ একবার ? ” ” ভাই আমি বলি কি , আপনি নিধিকে বিয়ে করেন , আপনার সাথেই তো ওর বিয়ে ঠিক হইছিল , আমাকে প্লিজ বাঁচান । আপনি তো আমার ডিপার্টমেন্টের বড় ভাই , ছোট ভাইটারে বাঁচান প্লিজ ।” আমি রেগে গিয়ে ফোন কেটে দিলাম । মুখে খারাপ গালি চলে আসছে ।
এর চেয়ে কৌতুক আর কি হতে পারে ? একদিকে বাড়ির অবস্থা নিয়ে টেনশান আরেকদিকে নিধি । বিয়ের আসর থেকে বর কনে একসাথে পালিয়ে যাওয়ায় সেখানকার অবস্থা কি আমি সেটি কল্পনাও করতে পারছিনা । শুধুমাত্র শাহেদ আর নিধির দিকে তাকিয়ে আমি এই পুরো প্ল্যান করেছিলাম । আর এই অর্বাচীন এখন কি বলে ?
নিধি , শাহেদ এবং আমি একই ভার্সিটিতে পড়তাম , ওরা দুজনই আমার জুনিয়র । মিথ্যে বলব না , আমি নিধিকে আমার প্রথমজীবন থেকেই পছন্দ করতাম , কারন ও আমার এলাকারই মেয়ে । কিন্তু শেষের দিকে এসে আমি জানতে পারলাম , শাহেদ ছেলেটা আমার নিধির বয়ফ্রেন্ড । ঘটনায় জট লাগল আমি চাকরি পাবার পর , হঠাত একদিন শুনলাম আমার পরিবার নিধিকে নাকি আমার জন্য পছন্দ করেছে । আমি নিধির সাথে কথা বললাম , ও আমাকে বারবার অনুরোধ করল বিয়েটা ঠেকাতে । আমি অনেক সাহস নিয়ে বাবার সামনে গিয়ে বললাম , ” বাবা আমার মেয়ে পছন্দ হয়নি ” বাবা বরফ গলায় বলল ,” কেন ?” ” ইয়ে মানে , বাবা মেয়ের চোখে তো মোটা চশমা , আমার ছেলেমেয়েরা তো কানা হবে ” দুর্ভাগ্য হলেও সত্যি , আসিফ নামের এই ধাড়ি ছেলে সেদিন বাবার হাতের পঞ্চাশতম চড় খেয়ে হাফ সেঞ্চুরি করেছিল । যখন কোন উপায় রইলনা , তখন আমি আর নিধি মিলে পুরো প্ল্যান সাজালাম । শুধু নিধি পালালেই হয়ত চলত , কিন্তু এতে নিধির এলাকায় যে দুর্নাম হবে তার ভাগ নিতে আমিও পালানোর সিদ্ধান্ত নিলাম । জামাই বউ একসাথে পালিয়েছে , খারাপ কি ? নিধিকে হয়ত পাবোনা , কিন্তু তাকে সুখি হতে দেখার লোভ আমি সামলাতে পারছিলাম না ।
আমি যখন শাহেদকে ছোটখাট গালি দিয়ে ফোন কাটলাম , তখন দেখলাম , নিধির মুখটা ফ্যাকাশে , ও বলল ,” শাহেদ কি বলল ?” আমি মাথা নামিয়ে বললাম , ” ও বলছে ও নাকি আসতে পারবেনা ” ” আর কি বলল ? আমাকে বিয়ে করতে বলেছে আপনাকে , তাইনা ?” আমি দাঁড়ালাম ,” তুমি চিন্তা করোনা নিধি, আপাতত চল এখান থেকে যাই । ” নিধি এক মুহূর্ত অন্য দিকে তাকিয়ে বলল ,” আমার জন্য এতকিছু করছেন কেন ?” ” আমি আসলে বুঝাতে পারবোনা ” নিধি একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল , ” আসিফ , আমাকে বিয়ে করতে তোমার কি খুব সমস্যা ?”
২. মাঝরাতে আমি যখন নিধিকে নিয়ে ওদের বাসায় গেলাম , আমাদের একসাথে দেখে ওর মা আর আমার মা একসাথে অজ্ঞান হয়ে গেলেন । নিধির বাবা দৌড়ে এসে মেয়েকে ধরে বললেন , ” আম্মিজান তুমি ঠিক আছো ? তুমি ঠিক আছো তো আম্মিজান ?” আমি এই মধুর দৃশ্য দেখতে দেখতে লক্ষ্য করলাম , আমার বাবা পাকিস্তানি মিলিটারি অফিসারদের মত এক পা এক পা করে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন । আমার সামনে দাঁড়াতেই আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল , শুকনো গলাতেই ব্যাঙের মতন চেচাতে চেচাতে বললাম , ” বাবা ,বিশ্বাস কর, নিধিকেই আমি বিয়ে করেছি , এই যে দেখ কাবিন নামা , দেখ ” কাগজ টাগজ দেখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন ,” তাইলে পালাইছিলি কেন হারামজাদা ? ” ” আসলে বাবা হয়েছিল কি , ইয়ে আমাদের না , মানে আমার না , পালিয়ে বিয়ে করার অনেক শখ ছিল ,তাই অনেক প্ল্যান করে ……” বাবা মেঘের মত গর্জন দিয়ে বললেন ,” অনেক কি করে …?” ”বাবা প্ল্যান …”
তারপর ঘটনা কিছুই না , বাবার হাতের আরেকটা থাপ্পড় আমার ডান গালে নাযিল হল । সবাই হা করে তাকিয়ে আছে , বিয়ের আসরে নতুন বউএর সামনে জামাই চড় খেল ,এর চেয়ে মজার ঘটনা আর কি হতে পারে ? তবে আমি এখনও বিস্মিত , আমার দাতগুলি এখনও যথাস্থানে আছে কিভাবে ? থাপ্পড় দিয়েই বাবা নিধির বাবার দিকে অট্টহাসি দিয়ে বললেন ,” ভাইসাহেব আমি আপনাকে বলেছি না , সব শয়তানির গোঁড়া এই হারামজাদা পোলা ”
আমি নিধির দিকে তাকিয়ে দেখি ,তার মুখে দুর্যোগের ঘনঘটা, সে বিস্মিত হয়ে আমাকে দেখছে । আমি ওর কানের কাছে এগিয়ে নিচুগলায় বললাম ,” don’t freak out ,it’s the only 51st slap of my dad ”
৩.
আমি কখনই ভাবতে চাইনি , এভাবে ধুম করে বিয়ে করেছে বলেই নিধি আমাকে ধুম করে ভালবেসে ফেলবে । আর আসল কথা , সেটা হয় ও নি । ওর আর আমার মাঝে অদৃশ্য একটা দেয়াল ছিল যেটা টপকাবার সাহস আমার কোনদিনই ছিল না । ওকে পেয়ে আমি ধন্য ছিলাম , কারন আমি প্রতিদিন ওকে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি , ওর রান্না খেতে পারছি , ও ঘুমিয়ে গেলে চোখ থেকে চশমাটা খুলে রাখতে পারছি , আমার এর চাইতে বেশি কিছু চাওয়ার ছিলনা । কিন্তু ঢাকার বাইরে পোস্টিং হওয়ার পর আমি যখন ওকে নিয়ে একা বাসায় চলে আসলাম ,তখন বুঝলাম ওর সাথে আমার কতটা দূরত্ব । এমনকি মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে আমি প্রায়ই ওকে জানালার পাশে নির্ঘুম চোখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতাম ।
একদিন আমি খুব সাহস করে ওর হাতটা আমার হাতে নিয়ে বললাম , ” নিধি , কাঁদতে কাঁদতে একসময় যখন চোখের পানি ফুরিয়ে যাবে তখন কিন্তু তুমি ভালবাসাটাকে খুঁজে পাবেনা । শুনেছি, চোখের পানিতে ভালবাসা নাকি ভেসে যায় । কিছু ভালবাসা বাঁচিয়ে রেখ নিধি ।” ও কান্না চেপে বলল ,” তুমি আমাকে ক্ষমা করো আসিফ , তোমাকে ঠকাতে আমার ভীষণ কষ্ট হয়, ভীষণ । ” আমি ওর হাত শক্ত করে ধরে বললাম ,” আমার কখনই মনে হয়নাই আমি ঠকেছি ” নিধি কিছুই বলল না , শুধু আমার হাত থেকে ওর হাতটা ছাড়িয়ে নিল ।
বছরটা এভাবেই কাটল , কিভাবে জানিনা । একদিন হঠাত শাহেদ ফোন দিল আমাকে । আমি ওর সাথে ভালভাবেই কথা বললাম , কারন আমার নিধি যে ওকে ভালবাসত , হয়ত এখনও বাসে । আমি শাহেদকে বললাম ওকে ছেড়ে নিধি এখনও কতটা কষ্ট পাচ্ছে । হঠাত ও আমাকে বলল , ” আসিফ ভাই আপনাদের সংসারের এই যখন অবস্থা , তাহলে বলি , আমি ঈদের কিছুদিন পর আমেরিকা চলে যাচ্ছি , নিধি কি আমার সাথে যাবে ?” শাহেদের এই একটা কথায় আমি বালির বাঁধের মত ভাংতে লাগলাম । কত্ত বড় সাহস এই ছেলের , আমার বউকে নিয়ে যেতে চায় ? পরক্ষনেই আমার মনে হল , আমি কিসের অধিকার দেখাচ্ছি যেখানে নিধি কখনই আমার ছিলনা , আজো নেই । আমি শাহেদকে নিধির সাথে কথা বলতে বললাম ।
কদিন বাদে একদিন রাতে দেখলাম নিধির মুখটা ভীষণ শুকনো । আমার সামনে এসে বলল , ” আসিফ , আমাকে শাহেদ ফোন দিয়েছিল আজকে ” ” হুম আমি সম্ভবত জানি ” নিধি চোখ তুলে বলল ,” ও আমাকে ওর কাছে ফিরে যেতে বলছে ” আমার আর সহ্য হলনা , আমি এক নিঃশ্বাসে বললাম ,” নিধি তুমি চলে যাও শাহেদের কাছে । সেটাই সবচেয়ে ভাল হবে । তোমাকে পাবার যোগ্যতা আমার কোনদিনই ছিলনা , তবুও কপালের জোরে পেয়েছিলাম , কিন্তু আকড়ে রাখবার ক্ষমতাটা সৃষ্টিকর্তা আমায় দেন নি । আমি তোমায় মুক্ত করে দিলাম নিধি ” নিধি চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল । আমার কথা গুলি শেষ হওয়া মাত্র তার চোখ ফেটে পানি আসতে লাগল । মুখ চেপে কান্না আটকাতে আটকাতে সে রুম থেকে চলে গেল ।কে জানে, হয়ত আনন্দেই সে কান্না আটকাতে পারেনি ।
পরদিন অফিস থেকে বাসায় ফিরে আমি দেখলাম নিধি চলে গেছে । ড্রেসিং টেবিলে একটি চিরকুট রাখা ,তাতে দুইটি লাইন – ” আমি চলে যাচ্ছি । ভাল থেকো আসিফ ” কি নির্মম রসিকতা , আমাকে ভাল থাকতে বলে গেছে , দুঃখে হাসি পেয়ে গেল । মেয়েটা দেখছি ভালোই রসিকতা জানে । নিধিকে ছাড়া আমার এমন ভয়াবহ কষ্ট হবে আমি সেটি ভাবতেও পারিনি । নিজের অজান্তেই আমি দেবদাস হয়ে গেলাম । অগোছালো হয়ে বেড়াতে লাগলাম , রোজার দিন ছিল বলে আমার খাওয়াদাওয়ার চিন্তা ছিলনা , তবুও মানসিক অশান্তিতে কয়দিনেই আমি ভীষণ রকম শুকিয়ে গেলাম ।
ঈদ প্রায় চলে এসেছে ,আর দুইটা রোজা বাকি । কিন্তু আমার মনে ঈদ নেই , পাংশু মুখে আমি শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছিলাম , হঠাত রিং শুনে দেখি শাহেদ ফোন দিয়েছে আমাকে । হারামি মনে হয় আমাকে বিয়ের দাওয়াত দিতে ফোন করেছে । কয়েকবার রিং হবার পর ধরলাম । যখন কথা বলা শেষ হল তখন আমি পুরোপুরি বিদ্ধস্ত । আমি নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না । শাহেদ বলল নিধি নাকি ওর কাছে যায়নি , নিধির ফোন ও নাকি অফ । শাহেদ আরো ভেবেছে নিধি নাকি আমাকে ছেড়ে যাবেনা বলে ফোন অফ করে রেখেছে । এবং সবশেষে আমাকে ” গুডলাক ” জানিয়ে ফোন কেটে দিয়েছে । সর্বনাশ , এই মেয়ে তাইলে গেল কোথায় ?
কৌশলে ছোটশালার কাছ থেকে জানলাম , নিধি আমাদের এলাকায়ই গিয়েছে, তবে নিজের বাসায় না গিয়ে আমাদের বাসায় গিয়ে উঠেছে । হায়রে , এই ছিল মেয়ের মনে , তাইতো বলি আম্মা আমাকে এই কয়দিন ফোন দেয়নাই কেন । আব্বা নিশ্চয়ই আমাকে কাবাব বানাবার জন্য কসাই রেডি করে রেখেছে । চাঁদ রাতে আমি যখন বাসায় পা রাখলাম ,দেখলাম সবাই ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে , বাবার মুখের দিকে তাকানোর সাহসই পেলাম না । একছুটে ঘরে গিয়ে দেখি , আমার বউ তার ছোট ননদকে মেহেদি দিয়ে দিচ্ছে । আমি পিচ্চিকে রামধমক দিয়ে বের করে দিলাম । নিধি ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বলল , ” এইরকম চাষার মত বিহেইভ কেন তোমার ?” আমি কথা কানে না তুলে নিধির হাত ধরে বললাম ,” থ্যাংক ইয়ু নিধি , আমি ভেবেছিলাম তোমাকে আর কখনও পাবোনা আমি ” ” আমি কি যেতে চাইছি ? তুমি যেতে বলছ আমাকে । এখন আবার নেকামি । কে না কে তোমাকে কি না কি বলবে আর তুমি তোমার বউ রে বের করে দিবা তাইনা ? ” আমি জিভে কামড় দিয়ে বললাম ,” আমার ভুল হয়ে গেছে , সাংঘাতিক ভুল । মাফ করে দাও ” ” তোমার গায়ে এত গন্ধ কেন আসিফ ? তুমি গোসল করোনা কয়মাস ? ইয়াক থু ” নিজের গায়ের গন্ধে আমি অবশ্য নিজেই থাকতে পারছিলাম না , তাও বললাম ,” আমি গোসলে যাচ্ছি , তার আগে বল , বাবাকে তুমি কি বলেছ ?” নিধি মুখ বাকিয়ে বলল ,” বলছি তুমি আরেকটা বিয়ে করবা , তাই ……” আমি চোখ বড়বড় করে তাকাতেই শুনলাম বাবা আমার ঘরের দিকে আসছেন আমাকে ডাকতে ডাকতে । ” আসিফ , ঐ বেটা আসিফ ” আমি উঠে দাঁড়ালাম । বাবা ঘরে ঢুকতেই আমি বললাম , ” বাবা , আমার সত্যিই ওরকম প্ল্যান ছিল না ” বাবা এগিয়ে আসলেন ।
বাবার হাতে বায়ান্নতম থাপ্পড় খেয়ে আমার ” কি আছে জীবনে ” টাইপ ফিল হবার কথা ছিল । কিন্তু না , আমার নিজেকে খুব সুখি মনে হচ্ছে । নিধি ভয়ে ভয়ে আমার গালে হাত দিয়ে বলল ,” দাঁত গুলি ঠিক ঠাক আছে ?” আমার দাঁতের স্থায়িত্ব বোঝাতেই আমি নিধির দিকে তাকিয়ে সবগুলি দাঁত বের করে বিশাল একটা হাসি দিলাম । নিধি হাসতে হাসতে বলল ,” অর্বাচীন কোথাকার !”
ভাগ্যিস আমি প্রতিদিন পেপসোডেন্ট দিয়ে দাঁত ব্রাশ করি ।