বা-সর রাত

বা-সর রাত

একের পর এক সিগারেট টেনে যাচ্ছি বারান্দায় দাঁড়িয়ে। ঘরে গিয়ে ঘুমাবো সেই উপায় নেই। শুনেছি মহিষ নাকি ঘড় ঘড় করে নাক ডাকে ঘুমানোর সময়। অথচ তুলিকার মত একটা স্নিগ্ধ মেয়ে কিভাবে মহিষের জাতী প্রজাতী হলো সেটা মাথায় আসে না।

বিয়ের আজ প্রথম দিন। সবার ভাষায় বাসর রাত। আর আমার ভাষায় বা-সর রাত। মানে হলো বাসর এর মাঝে একটা হাইফেন। তার মানে দাঁড়ায় আমাকে সরিয়ে দেয়া।

সবাই বলে বিয়ের রাতে বিড়াল মারার কথা। সবার কথা শুনে ইউটিউবে কিভাবে বিড়াল মারতে হয় তার কয়েকটা ভিডিও দেখে অভিজ্ঞতা অর্জন ও করেছি কিন্ত বিড়াল মারা তো দুরের কথা,মশাও মারতে পারব না যা দেখছি!!! বিয়ের কথা ভেবে আব্বাজান আমার স্বাধের ছোট্ট বিছানা পালটে বিশাল একটা বিছানা দিয়েছেন যেখানে অনায়াসে মিনি ফুটবল খেলা যাবে। আমি নাহয় ফুটবল খেলার কথা ভেবেছি। আব্বাজান কি ভেবে এমন খাট দিলেন বুঝতে পারলাম না। সবথেকে ভয়ঙ্কর কথা হলো সেই খাটেই আমি শোবার চান্স পাচ্ছি না।নাক ডাকছে মহিষের মত আর ঘুমের অবস্থা দেখার মত। ইংরেজি বর্নমালা X এর মত চার হাত পা চারদিকে ছড়িয়ে শুয়ে আছে। নিজেকে মনে হচ্ছে কোয়ি মিল গায়া মুভির যাদুর মত বস্তাবন্দি করে রাখতে।

এই ধরনীতে আমার বিছানা আজ অন্যের দখলে। বাবাকে কি একবার ডাক দিয়ে দেখাবো? “এই তোরে না বলছি খেলাধুলা কম করতে? সারাদিন তো খেলার সময় আছে নাকি? এই রাতের বেলাও খেলতে হয়?” তুলিকার চিতকারে চমকে উঠলাম। দৌড়ে ঘরে এসে দেখি তুলিকা ঘুমের মাঝে কার সাথে জানি ঝগড়া করতেছে। কি যে বলতেছে উপরওয়ালা জানে।

দুই একটা ভাষা যাও বুঝি তা বলার মত না। বহুভাষাবিদদের পক্ষেও বাকি ভাষা উদ্ধার করা অসম্ভব। চট করে মোবাইল টা বের করে কিছুক্ষন কথা রেকর্ড করে নিলাম। ভেবেছিলাম সারারাত যা বলবে তা রেকর্ড করে রাখবো। কিন্তু তুলিকার অমানবিক চিতকারে পাশের ঘর থেকে বাবা মায়ের ইচ্ছাকৃত কাশির শব্দ পেলাম। এমন লজ্জা মনে হয় জীবনে পাইনি। মন চাচ্ছে আলমারির সকল কাপড় বের করে নিজেকে ঢেকে ফেলি। শর্ট পরলে তো তুলিকার শাড়ি গহনা আছেই। হালকা করে তুলিকাকেধাক্কা দিলাম যাতে ঘুমটা হালকা হয়। কপাল খারাপ হলে যা হয়।

“আবার ধাক্কাচ্ছো কেন? বলেছি না ধাক্কাতে না? এত ধাক্কাধাক্কি সহ্য করা যায়?” এইবার দ্বিগুন আওয়াজে তুলিকা ঘুমের মাঝে চিতকার করে উঠলো। নাহ এই সংসারে আমাকে আজ থেকে বোরখা পরে থাকতে হবে বাবা মায়ের সামনে। কেন যে ছেলেদের জন্য বোরখা বানায় না কেউ। বোরখা যে কত কাজে লাগে তার উদাহরন হিসেবে হোক আর ব্র্যান্ড এম্বাসিডর হিসেবেই হোক আমাকে নিলে ভবিষ্যতের কথা আর চিন্তা করতে হতো না। নাহ এই অমানবিক চিতকার বন্ধ করতে হবে নাহলে সংসারে আমার ইজ্জতের দুয়ার মা বাবা বোনের সামনে আজ বন্ধ হবে নির্ঘাত। তাই সাবধানে বালিশ নিয়ে চেপে ধরলাম মুখের উপর। হাপাতে হাপাতে লাফিয়ে উঠলো তুলিকা।

এই আপনি কি করছেন? আপনি আমার মুখে বালিশ ধরলেন কেন? আপনি আমাকে খুন করতে চান নাকি? এই কেউ আছেন নাকি? প্লিজ আমাকে বাচান। আমাকে কেউ দয়া করে বাচান এই জালিমের হাত থেকে। কিছু বলার আগেই দরজায় ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে গেল। দরজার ওপাশে বাবা মা আর বোনের মরাকান্নার শব্দ।

ও বাবা!! কি হইছে বাবা? বউমা এমন করে কেন? কি করছিস তুই? বউরে মারিস না বাবা। দরজা খোল বাবা। জীবনে এতবার বাবা বলে ডাকেনি আমার আম্মা। সারাজিবন বিভিন্ন পশুপাখির বাচ্চা বলেই ডেকেছে। মাঝে মাঝে আমি নিজের নাম ভুলে যেতাম এত পশুপাখির সম্বোধনে। আর আজ বাবার উপর বাবা হয়ে গেছি। তুলিকার হাত চেপে ধরলাম যাতে দরজা না খুলতে পারে আর আমি জানি বুঝাতে পারি। ফল হলো উলটো। হাতে কাচের চুড়ি ভেঙ্গে তুলিকার হাত কেটে রক্তারক্তি অবস্থা। আর রক্তে হাত পিছলিয়ে তুলিকা সোজা দরজার সামনে। সেকেন্ডের মাঝে দরজা খুলে মায়ের বুকে হামলে পড়লো।

আম্মা আমি শেষ। এই জালিমের সাথে আমাকে বিয়ে হয়েছে আম্মা। আমার মৃত্যুর বেশিদিন বাকি নেই। আমাকে এখনি বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দিন নাহলে আমি নারী নির্যাতন মামলা করবো বলে দিলাম। সাক্ষাত আজরাইলের সাথে মোলাকাত করে আসছি। না না এই সংসারে আমি আর এক সেকেন্ড ও থাকবো না।আম্মাআআআআআআআআআআ কিছু বুঝে উঠার আগেই বাবার হাতে ফটাস করে একখান দশাসই থাপ্পড় খেলাম। আমার বাবা আবার তড়িৎকর্মা লোক। জীবনে কোনকিছুতে দেরি করেনা। আর সেটা যদি হয় আমার গায়ে হাত তোলা বা আমাকে কথা শুনানো তাহলে তো উসাইন বোল্ট ও বাবার হাছে হার মানে। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে বাবার থাপ্পড়ে।

** বিয়ে করবি না আগে বললেই পারতি। এত তামাশা করার কি ছিলো? বলেছিলাম আরো কয়েকটা দিন যাক। তা না। বিয়ের জন্য তাওড়াশ লেগে গেছে। তা যখন বিয়ে করলি এখন বউমারে খুন করতে চাইলি কেন?(বাবা) না বাবা আসলে……

** একটা থাপ্পড় দিয়ে চাপার হাড়সহ দাত খুলে ফেলব বদের বাচ্চা বদ। অন্যায় করে আবার মুখে মুখে কথা বলে। সাহস কত বড়। এই এইটা কি আমার ছেলে তুমি শিওর? নাকি ভ্যাজাল আছে?

এই তুমি এইসব কি বলো। (মায়ের মুখে ৭ মার্চের মত বজ্রকন্ঠ)
** না মানে বলছিলাম হাসপাতাল থেকে উলটপালট হয়ে গেল কিনা। নাহলে তো এমন এন্টিক পিস হবার কথা না। যা কথা হবার সকালে হবে। এখন ঘুমাতে চলো।

না আম্মা আমি এই জালিমের সাথে ঘুমাবো না। আমি এই অল্প বয়সে আমি মরতে চাইনা। আওয়ামী লীগ নেতা তুফানের নামানুসারে তুফানের মত ঘটনা ঘটে গেল কিছু বুঝার আগেই। নাহ এর একটা বিহীত করতেই হবে। আমাকে বলে আমি নাকি হাসপাতাল থেকে উলট পালট হয়ে গেছি। এই অপমান মানা সম্ভব না। ধম করে ফোন লাগালাম স্কুল ফ্রেন্ড নাদিমকে।

কিরে দোস্ত ব্রেক টাইম নাকি?(নাদিম)
আরে রাখ তোর ব্রেক টাইম। আমার লাইফের ব্রেকফেইল হয়ে গেছে।
কি হইছে রে?

আমি ঘটনা সব খুলে বললাম ধীরে ধীরে। নাদিম হেসে চোটপাট অবস্থা। মেজাজ গেল ৪২০ হয়ে। কিন্তু একটা সমাধান শেষে বাতলে দিলো। নাহ সমাধানটা মনে ধরেছে। নিশ্চিন্তে এইবার খাটে ইংরেজি বর্নমালা X এর মত করে ঘুমানো যায়। ঘুম ভাংতে একটু দেরি হয়ে গেল যেটা সবসময়ই হয়। এ আর নতুন কিছু না। বিছানা থেকে নেমে দাত মাজতে মাজতে বারান্দায় এসে দম আটকে গেল। বাসার নিচে শ্বশুড় আব্বার সদ্য ক্রয় করা প্রাডো দাঁড়িয়ে আছে। বুঝতে বাকি রইলো না যে কথাগুলো ওই বাড়িতেও পৌছে গেছে। ফেনা সমেত মুখের মাঝে ব্রাশের পেষ্ট গিলে ফেললাম ভয়ে। নিজের বাপ তো যেমন তেমন। শ্বশুড় আব্বা তো সাক্ষাত আজরাইল।

তাড়াতাড়ি কোন রকমে ফ্রেশ হয়ে রুমের বাহিরে এসে দেখি বিরাট ব্যাপার স্যাপার। শ্বশুড়,শ্বাশুড়ি,শালা,সুমুন্দী,চাচা শ্বশুড় থেকে শুরু করে যারা বিয়েতে আসে নাই তারাও এসেছে। আজ মনে হয় পিঠের অবস্থার ১২ টা বাজবে। সবাই যদি একটা করে কিল ও মারে তাহলে স্টিফেন হকিং এর মত হয়ে যাওয়া ছাড়া গতী নেই। তবে ভরসার কথা হলো,,, সবার মাঝে নাদিমকে দেখা যাচ্ছে।

না না বিয়াই সাহেব আমার মেয়েকে আমি তো জেনে শুনে হত্যা হতে দিতে পারিনা তাইনা?

না মানে বলছিলাম কি…

আপনার কিছু বলতে হবে না বিয়াই সাহেব। আপনাদের কোন দোষ নেই। আপনারা কেমন তা আমি জানি। আপনাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মেয়েকে আপনাদের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। কিন্তু ছেলে যে এইরকম করবে তা জানা ছিলো না। না না এইভাবে আর চলবে না।

আসলে বিয়াই সাহেব বলছিলাম যে বিয়ের পরদিন যদি বিয়ে ভাঙ্গার কথা উঠে তাহলে তো সমাজে মুখ দেখানো যাবে না।

সমাজ দিয়ে কি হবে বলেন বিয়াই সাহেব। মেয়ে হত্যা হলে কি সমাজ আমাকে আরেকটা মেয়েকে দিতে পারবে??? এত কথা বুঝিনা। আমি কাজী ডেকে এনেছি। যা হবার এখনই হবে। আজই ডিভোর্স হবে।

-আরেকটু ভেবে দেখলে হতো না।(বাবা)
না না আমি সব ভেবেই সবাইকে নিয়ে এসেছি। নিন কাজী সাহেব শুরু করেন।(শশুর)

বুঝতে বাকি রইলো না যে আমার ডিভোর্স হতে চলেছে। করুন নয়নে নাদিমের দিকে চাইলাম। নাদিম শালা মিটিমিটি হাসছে। এইসকল বন্ধু আছেই খালি মজা নেবার জন্য। মেজাজ গেল আরো বিগড়ে। হঠাৎ “এই তোরে না বলছি খেলাধুলা কম করতে? সারাদিন তো খেলার সময় আছে নাকি? এই রাতের বেলাও খেলতে হয়? আবার ধাক্কাচ্ছো কেন? বলেছি না ধাক্কাতে না? এত ধাক্কাধাক্কি সহ্য করা যায়? ঘরররররররররররররররররর” হঠাত ফোন বেজে উঠলো আমার। আর রিংটোন হেসে এই দুটি লাইন বাজতে লাগল। কাপা কাপা হাতে ফোন হাতে নিয়ে দেখি নাদিম ফোন দিয়েছে। মোবাইল থেকে চোখ সরাতেই দেখলাম ২১ জন মানুষের ৪২ জোড়া চোখ আমার দিকে বড় বড় করে তাকিয়ে রয়েছে। নিজেকে তখন জনি লিভারের মত লাগছে। না পারছি কিছু বলতে না পারছি কিছু সইতে।

নিস্তব্ধতার মাঝে নাদিম হো হো করে হেসে উঠলো। নাদিম মাঠে নেমে গেল। আস্তে আস্তে সকল ঘটনা খুলে বলতে লাগলো সবাইকে। ঘটনা শেষে পিনপতন নীরবতা সবার মাঝে। হঠাত করে আমার শ্বশুড় আব্বা হো হো করে হেসে দিলেন আর সবাই তার হাসির সাথে তাল মিলাতে লাগলো। শুধু একজন বাদে। আর সে হলো তুলিকা। সবার হাসির মাঝেই জানতে পারলাম তুলিকা নাকি হাত পা ছড়িয়ে ঘুমায় আর ঘুমের মাঝে কথা বলে। রাতের খাবার খেয়ে সবাই যখন বিদায় নিলো তখন আস্তে করে আমি রুমে প্রবেশ করলাম। রুমে ঢুকেই চমকে উঠলাম। তুলিকা খাটের সামনে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এইবার মনে হয় আমাকে বলি হতে হবে।

* এইসবের মানে কি?(তুলিকা)
** কোনসবের?

আমার ঘুমের ঘোরের কথা আপনার মোবাইলে গেল কিভাবে?
** ভেবেছিলাম রেকর্ড করে রাখবো কিন্তু এইভাবে কাজে লেগে যাবে বুঝতে পারিনি।(আমি)
কিছুক্ষন গরম চোখে তাকিয়ে ভেউ ভেউ করে কেদে দিলো তুলিকা। একদম বাচ্চা মেয়েদের মত লাগছে। মন চাইছে ঠাশ করে গালে একটা লাগিয়ে দিয়ে বলি আরো বেশি করে কান্না কর। কান্না টা কি রেকর্ড করে নিবো নাকি? না থাক। কান্না করানোর জন্য সারাজীবন তো আছেই। আস্তে করে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম তুলিকাকে। আমাকে পেয়ে মনে হলো খুটি পেয়েছে। জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কাদতে লাগলো। কেন কাদতেছে বোধগম্য হলো না। মনে হয় একটু লজ্জা পেয়েছে ঘুমের মাঝে কথা বলে সেটা সবাই শুনে ফেলেছে বলে। কাদুক ইচ্ছা মত। ওহ হ্যা ভাবসাবে মনে হচ্ছে আজ বিড়াল মরবেই। ওএমন মরা মরবে যে হাড্ডিগুড্ডিও খুজে পাওয়া যাবে না।

গল্পের বিষয়:
হাস্যরস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত