গুজব

গুজব

রতন মিয়া সকালে ঘুম থেকে উঠেই বৌকে জিজ্ঞেস করল, “বৌ, রাইতে কি তুমি দরজা ধাক্কানোর কোনো শব্দ হুনছো?” তার বৌ না সূচক মাথা ঝাঁকালো। তারপর রতন মিয়া নিজে নিজেই বিড়বিড় করে বলতে লাগলো, “আমার আরো মনে হইতেছিলো কেডা জানি দরজা ধাক্কা দিতাছিলো। কি জানি!”

রতন মিয়ার বৌ পুকুর ঘাটে গিয়ে পাশের ঘরের আখতার ভাই এর বৌকে পেল। উনাকে বলল, “জানেন ভাবী! গতকাইল রাইতে চোর আইছিলো মনে হয়। রাইতে আমাগো দরজায় কেডা জানি অনেক গুলান ধাক্কা দিসিলো।”

কথা খানা শুনে আখতার মিয়ার বৌ খানিক চিন্তায় পড়ল। এরপর ধীরেসুস্থে বলল, ” কি কন ভাবী! তাইলে তো পরিস্থিতি সুবিধার না। সাবধানে থাইকেন।”

এটা বলে আখতার মিয়ার বৌ ঘরে গেল। স্বামীকে চা এগিয়ে দিয়ে বলল, “জানেন গতকাইল রতন ভাইগো ঘরে চোর আইছিলো। ভাই আর ভাবী মিল্লা চোর তাড়াইছে। ”

আখতার মিয়া বৌ এর হাত থেকে চা এর কাপ নিতে নিতে বলল, “তাইলে হুঁশিয়ার থাইকো বৌ। রাইতে যখন আইছিলো। দিনেও আইবার পারে।”

চা শেষ করে শার্ট গায়ে দিয়ে আখতার মিয়া বাড়ি থেকে বের হলেন। বের হওয়া মাত্রই রাস্তায় দেখা হলো তাদের গ্রামের বয়স্ক শিক্ষক নিমাই বাবুর সঙ্গে।

কুশলাদি বিনিময়ের পর আখতার মিয়া নিমাই বাবুর গায়ের কাছে সরে এসে বলল, “জানেন মাস্টার সাব! গতকাইল রতন মিয়াগো ঘরে চোর ঢুকছিল। জিনিসপাতি কি নিছে এখনও জানা যায় নাই। তই রতন মিয়ার ঘরে তো গরু-ছাগল আছে কয়েকখান। ওগুলা নিবার আইছিলো কিনা কি জানি!”
আঁতকে উঠে নিমাই বাবু বললেন, “গ্রামে চোর আইলো কোত্তেকা আবার। নিশ্চয়ই এলাকার ছোকরা পোলাগো কাম অইবো। যাই তাইলে।”

ঘরে ঢুকতেই নিমাই বাবু ছুটলেন রান্নাঘরের দিকে। বৌকে সেখানে পেলেন না। কয়েক বার হাঁক দেওয়ার পর বৌ এলো।

রাগের সাথে নিমাই বাবু জিজ্ঞেস করলেন, “কই আছিলা? রতন মিয়াগো ঘরে চোর আইসা নাকি গরু ছাগল সব নিয়া গ্যাছে। আর তুমি দরজা জানালা খোলা রাইখ্যা গেছাে কই?”

বৌ একটু ভয় পেয়ে বলল, “পুকুরে গ্যাছিলাম। আইচ্ছা এহন থেইকা ঘরে তালা দিয়া যামু আমি।”
খানিকটা স্বস্তি পেয়ে নিমাই বাবু বিছানায় শরীর খানা এলিয়ে দিলেন। এদিকে বৌ এর মনে শান্তি নাই। উঠান হতে উঁকি দিয়ে পাশের বাড়ির রত্নাদিকে ডাকলেন। উনাকে এক নিশ্বাসে সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বললেন।

তারপর বললেন, ” দুনিয়া কই আইয়া পড়ছে। বেচারার শেষ সম্বল গরু-ছাগল গুলাও নিয়া গেলো।” এমন সময় রত্নাদির স্বামী হরিপদের ডাক শোনা গেল। “আসি দিদি।” বলে রত্নাদি বিদায় নিল।
বৌ এর গম্ভীর মুখ দেখে হরিপদ জিজ্ঞেস করল, ” কি অইছে তোমার?”

বৌ বলল, ” রতন ভাইগো গরু ছাগল নাকি সব চুরি অইয়া গ্যাছে। বেচারা এহন বৌ আর ছোট্ট মাইয়াডা লইয়া কই যাইবো ভগবানই জানেন।”

বৌ এর কথায় হরিপদও একটু গম্ভীর হলো। তারপর বলল, ” আমি তাইলে যাই। বাজারে গিয়া শুইনা আসি ঘটনা কি।”

বাড়ি থেকে বের হয়ে হরিপদ সোজা কালু মিয়ার চায়ের দোকানে চলে এলো। বাজারের সবচেয়ে বেশি জন সমাগম হয় এই কালু মিয়ার চায়ের দোকানে। দোকানে এসেই হরিপদ গ্রামের সবচেয়ে বড় বেকার মানুষ জামাল মিয়ার দেখা পেল। পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে চলে যাচ্ছে এই জামাল মিয়া। সারাদিন বাজারে পড়ে থাকে। এর দোকান না হয় ওর দোকানে তাকে পাওয়া যাবেই।

জামাল মিয়াকে দেখা মাত্র হরিপদ বলল, ” জামাল ভাই! গতকাইল নাকি চোর আইসা আমগো রতনের গরু ছাগল সব নিয়া গেছে গা। বৌ আর রতন মিয়া মিল্লা বহুত চেষ্টা করছে। মাগার রাখতে পারে নাই নাকি।”

কথাটা শুনে জামাল মিয়া বলল, ” কি কও হরি দা, হারা সকাল বাজারে থাইক্কা এই খবর এহনও আমার কানে আসলো না ক্যান। যাই তাইলে দেইখা আসি একবার রতনরে।”

দোকানের বিল দেওয়ার সময় জামাল মিয়া কালু মিয়াকে বলল, “দুইন্ন্যা কই চইল্ল্যা গেছে কালু মিয়া। রতনের গরু ছাগল সব নাকি গতকাইল চোরে নিয়া গ্যাছে গা। বৌ ডার লগেও নাকি ধস্তাধস্তি হয়ছে খুব। যাই দেইখ্যা আসি।” কালু মিয়া কিছু বলার আগেই জামাল মিয়া বিদায় নিল।

মিনিট দশেক পর বাজারে দেখা মিলল রতন মিয়ার। কালু মিয়ার দোকানে এসে বসতেই পুরো বাজার ঘিরে ধরলো তাকে। সবাই একসাথে কথা বলে উঠায় কারো কথা বুঝতে পারলো না সে। হঠাৎ গ্রামের মুরুব্বী ইকবাল সাহেব সবাইকে চুপ করতে বললেন।

তারপর তিনি রতন মিয়াকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার বৌ নাকি গতকাইল চোর নিয়া ভাইগা গেছে রতন মিয়া?”
প্রশ্ন শুনেই রতন মিয়া ক্ষেপে গেল।
চিৎকার করে বলল, “কার থেইকা হুনছেন এই কথা?”
সবাই সমস্বরে বলে উঠল, “কালু মিয়া!”

পরদিন সকালে আর কালু মিয়াকে বাজারে দেখা গেল না।
সপ্তাহ দেড়েক পর আবার বাজারের সবচেয়ে বড় দোকানটায় কালু মিয়ার দেখা মিলল ভাঙ্গা হাত, মচকানো পা ও থেঁতলানো মুখটার একপাশে বিশাল ব্যান্ডেজ নিয়ে।

গল্পের বিষয়:
হাস্যরস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত