বীরবল ১৫২৮ সালে যমুনার তীর সংলগ্ন টিকাভানপুরে এক দরিদ্র ব্রাম্মন পরিবারে জন্ম নেন। তার প্রকৃত নাম ছিলো মহেশ দাস। প্রজ্ঞা, কৌতুক ও ন্যায়-বোধের জন্যে তিনি সম্রাট আকবরের রাজসভায় একজন উপদেস্টা হন। তিনি আকবরের সামরিক ও প্রশাসনিক কর্মকান্ডের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। কথিত আছে তিনি ১৫৮৩ সালে আফগানিস্থান অভিযানে মারা যান। তার মৃত্যুতে সম্রাট খুব মর্মাহত হন এবং কয়েকমাস কাল বেশ কাতর ছিলেন।
বীরবলের রচিত কবিতাও ছিলো সমাদৃত। কিন্তু তিনি বেশী পরিচিত তার প্রজ্ঞা ও যুক্তিপূর্ন বাক্য বিনিময়ের জন্যে। সম্রাট আকবরের সাথে বীরবলের কথাপোকথন আজও আমাদেরকে বীরবলের কৌতুক ও প্রজ্ঞার কথা মনে করিয়ে দেয়। এই কথাপোকথনগুলো বীরবলের গল্প হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। তিনি হাস্য-কৌতুকের আবরনে কোন ব্যক্তি বা ঘটনার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতেন। একদিন সম্রাট আকবর দরবারের সমবেত সকলকে নিয়ে খোশ-আলাপ করছিলেন। হঠাৎ সবাইকে অবাক করে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “ সে ব্যক্তিকে কি সাজা দেয়া হবে যে আমার গোঁফ টানবে?” কেউ বললো বেত্রঘাত। কেউ বললো, “ ব্যাটাকে শূলে চড়ান”। কেউ বললো শিরোচ্ছেদ। বীরবল চুপচাপ ছিলো। সম্রাট জিজ্ঞেস করলেন, “ কি বীরবল, তুমি কি বল?” বীরবল বললো, “জাহাপনা, তাকে মিষ্টি খেতে দিন!” সম্রাট রেগে উঠলেন। “তোমার মাথা খারাপ হয়েছে? যে ব্যাটা আমার গোঁফ টানবে তাকে মিষ্টি খেতে দেবো?” বীরবল ধীরে সুস্থে বললো, “হুজুর, আমার মাথা ঠিকই আছে। এই পৃথিবীতে আপনার পৌত্র ছাড়া আর কোন ব্যাক্তির সাহস হবে আপনার গোঁফে টান দিতে? জাহাপনা, আপনিই বলুন, আপনার গোঁফ টানার জন্যে নাতীকে মৃত্যুদন্ড নাকি মিষ্টি দিবেন?” সম্রাট বীরবলের সুক্ষ চিন্তায় আবারো খুশী হলেন।
একবার সম্রাট আকবর বীরবলকে আদেশ দিলেন তাঁর রাজ্যের সবচেয়ে বেশী চারজন বোকা লোককে ধরে নিয়ে আসতে। বীরবল সময় চেয়ে বোকা লোক খুঁজতে দরবার হল থেকে বের হয়ে গেল। রাস্তায় বের হতে বীরবল দেখলো একজন মস্ত পুরুষ বিরাট কাঁসার বাসনে করে কিছু ঝলমলে কাপড়-চোপড়, পান ও মিষ্টি নিয়ে যাচ্ছে। কৌতুহলী মনে বীরবল লোকটিকে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি এসব জিনিস নিয়ে কোথায় যাচ্ছো? লোকটি বললো, “আমার স্ত্রী আমাকে তালাক দিয়ে অন্য একজন পুরুষের সাথে বের হয়ে গেছে। তাদের একটা সন্তানও হয়েছে। তাদের জন্যে এই উপহার নিয়ে যাচ্ছি।” বীরবল ভাবলো এই হতভাগাটার মতো দ্বিতীয় কোন বোকা লোক এই রাজ্যে বোধহয় আর নেই। বীরবল তার নাম-ঠিকানা রেখে পথ চলতে লাগলো।
কিছুটা পথ পার করে বীরবল দেখলো এক লোক মহিষের পিঠে চড়ে যাচ্ছে এবং লোকটার মাথায় বিরাট একটা ঘাসের বোঝা। বীরবল জিজ্ঞেস করলো, “তুমি মহিষের পিঠে যাচ্ছো, কিন্তু ঘাসের বোঝা নিজের মাথায় বইছো কেন?” লোকটা বললো, “ আজ্ঞে মহাশয়, আমার মহিষ গর্ভবতী। তার পিঠে বেশী ওজন দেয়া ঠিক হবেনা। আমাকে পিঠে নিয়ে হাটতেই মহিষটার কষ্ট হচ্ছে। তাই ঘাসের বোঝা মহিষের পিঠে না দিয়ে আমার মাথায় করে নিচ্ছি”। বীরবল ভাবলো এই মহেষ ওয়ালা আরেক বোকার হদ্দ। তার নাম-ঠিকানা নিয়ে বীরবল চলে গেল।
কয়েকদিন পরে বীরবল এই দু’জন লোককে নিয়ে আকবরের দরবারে হাজির হলো। বললো, “হুজুর আপনার রাজ্যে বাস করা বোকাদের দরবারে নিয়ে আসলাম”। সম্রাট বললেন, “ এখানেতো মাত্র দু’জন। আমি বলেছিলাম চারটে বোকা ধরে আনতে”। বীরবল দু’হাত জোড় করে বললো, “জাহাপনা, বোকাদের খুঁজে খুঁজে ধরে আনতে আমি হয়েছি তৃতীয় বোকা। আর বোকাদের ধরার আদেশ দিয়ে আপনি হলেন চতুর্থ বোকা। সব মিলে আমরা হলাম চার বোকা।“ বীরবলের কাছে ধৃত দু’জন বোকার কাহিনী শুনে সম্রাট আকবর হেসে ফেললেন।