সেদিন এক ছোটভাই এলো অফিসে। নানা কথার ফাঁকে আফসোস মিশিয়ে ঘরের কথাও বলল।
পোলাটারে নিয়া বড় বিপদে আছি ভাই।
কার পোলা?
কার পোলা আবার! আমার পোলা। মুগ্ধ।
তোমার পোলা না সেই দিন হইল?
দিন কি বইসা থাকে ভাই। ও এখন ক্লাস টুতে পড়ে।
ক্লাস টুয়ের পোলাই তোমারে বিপদে ফেলে দিল। সাব্বাস! তা কী বিপদ?
আর বইলেন না ভাই। মুখের মইধ্যে কুইজ কম্পিটিশনের উপস্থাপকগো মতো প্রশ্ন লাইগাই থাকে। এটা কী? ওটা ও রকম হলো কেন? ও রকম না হয়ে এ রকম হলো কেন? …উফফ! জান শেষ।
ভালো তো। সাধারণ জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ আছে। বড় হয়ে তোমার ছেলে বিসিএসে ভালো করবে। অবশ্যই বিসিএসটা দেওয়াইবা।
রাখেন তো ভাই। টুয়ের পোলারে পড়াইতে এখন আমার ওর চাইতে বেশি লেখাপড়া করা লাগতেছে।
ভালো তো। ছাত্রজীবনের ফাঁকিবাজি পোলার কল্যাণে উসুল হচ্ছে। এইবার বুঝলা তো, প্রকৃতি শূন্যতা পছন্দ করে না। ছাত্রজীবনে ফাঁকিবাজির পড়াশোনা করছ। পোলার কল্যাণে এখন সেই শূন্যতা পূরণ হচ্ছে। হা হা হা।
ছোট ভাই আমার রসিকতা গায়ে মাখে না। তার মুখ আগের মতোই গম্ভীর।
কালকের ঘটনা শোনেন। বই হাতে নিয়া ছেলেরে বললাম, বাবা বলো তো, আমাদের জাতীয় খেলার নাম কী?
ছেলে কী বলল জানেন? বলল, ক্রিকেট। আমি বললাম, হয়নি বাবা। আমাদের জাতীয় খেলার নাম হচ্ছে কাবাডি।
কাবাডি শুনে ছেলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, বাবা, তুমি কিচ্ছু জানো না। ক্রিকেট হচ্ছে আমাদের রিয়াল গেইম।
শোনো, তোমার ছেলে কী বলে।
আমি ছেলের মায়েরে ডাকলাম।
আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে রান্নাঘর থেকে ছেলের মা আসে।
কী বলছে আমার মুগ্ধ সোনা চাঁদের কণা।
আমি বলার আগে ছেলেই কথা শুরু করে।
দেখো না আম্মু। বাবা না কিচ্ছু জানে না। বলে ওই খেলাটা নাকি আমাদের জাতীয় খেলা।
ওইটা মানে কাবাডি। ছেলে যেহেতু কাবাডি খেলার সঙ্গে পরিচিত না, তাই নাম বলতে পারে না।
ওই খেলাটা মানে যে কাবাডি, সেটা ছেলের মাকে বললাম।
ছেলের মা আমার কথায় সায় দিল।
তোমার বাবা তো ঠিকই বলেছে। কাবাডিই হচ্ছে আমাদের জাতীয় খেলা।
তুমিও কিচ্ছু জানো না।
মায়ের কথাও বিশ্বাস করে না ছেলে। কারণ কাবাডি খেলাটা কী, সেটাই সে জানে না।
বাধ্য হয়ে স্বামী-স্ত্রী মিলে হাডুডু খেলে দেখালাম।
কাবাডি…কাবাডি…কাবাডি…
আমাদের খেলা দেখে ছেলে খিলখিল করে হাসে।
আচ্ছা আম্মু, এই খেলার নাম কাবাডি কেন?
কারণ, খেলার সময় কাবাডি কাবাডি বলা হয় সে জন্য।
ফুটবল খেলার সময়ও তো সবাই গোল গোল করে। তাহলে ওটার নাম গোল না কেন!
এই হয়েছে। এবার ঠেলা সামলাও।
খুন্তি হাতে আগের মতো আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে রান্নাঘরে চলে যায় ছেলের মা।
আমি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করি।
আসলে কাবাডি খেলায় খেলোয়াড়রা কাবাডি কাবাডি বলে, সে জন্য এই খেলার নাম কাবাডি। আর ফুটবল খেলায় দর্শকরা গোল গোল করে, সে জন্য ওটার নাম ফুটবল। যদি খেলোয়াড়রা গোল গোল করত, তাহলে ফুটবল খেলার নাম হতো ‘গোল’ খেলা।
এবার বলো তো বাবা আমাদের জাতীয় খেলার নাম কী?
ছেলে কিছু বলে না। আগের মতো আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
আমাদের জাতীয় খেলা হচ্ছে কাবাডি।
ছেলে এবার আরো জোরে হাসে।
তুমি আসলেই কিচ্ছু জানো না।
না বাবা, সত্যিই কাবাডি হচ্ছে আমাদের জাতীয় খেলা।
মিথ্যা।
আরে বাবা না, সত্যি…
তাহলে তামিম-সাকিব ওরা কাবাডি খেলে না কেন?
ছেলের প্রশ্ন শুনে আমি পুরাই থ।
বউ তো রান্নাঘরে গিয়ে বেঁচেছে। আমি কই যাই!
অনেক কায়দা করে ছেলেকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, আসলে তামিম-সাকিব ক্রিকেট খেলা নিয়ে অনেক বিজি থাকে, তাই কাবাডি খেলার সময় পায় না। কিন্তু ছেলে আমার কিছুতেই কাবাডি খেলাকে জাতীয় খেলা হিসেবে মানতে নারাজ।
ছেলের গল্প শেষ করে ছোটভাই আমার মুখের দিকে তাকায়।
এই পোলা নিয়া কী করি কন তো ভাই…
তোমার ছেলের তো কোনো দোষ দেখছি না। আমার তো মনে হয় বড় হয়ে তোমার ছেলে ট্যালেন্টের ওপর ইন্টেলিজেন্ট হবে।
সন্তানের প্রশংসা শুনতে সব বাবা-মাই পছন্দ করে। আমার মুখে ছেলের প্রশংসা শুনে ছোট ভাইয়ের মুখে হাসি ফোটে। এবার তার সব রাগ অদৃশ্য কোনো শক্তির ওপর গিয়ে পড়ে।
আচ্ছা ভাই, এইটা হইলো কিছু, কন তো।
কোনটা?
এই যে হাডুডু খেলাটা দেশ থিকা এক্কেবারে উইঠাই গেল…
প্রথম কথা হচ্ছে, খেলাটার নাম হাডুডু না, কাবাডি।
আরে ভাই, জানি তো। কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন। খেলাই নাই, তার আবার নাম। আচ্ছা ভাই, জাতীয় খেলাটা দেশ থিকা উইঠা যাওয়ার কারণ কী?
খুব সিম্পম কারণ। ‘ইগো’।
ইগো!
হমম! ইগো। দেশ উন্নত হচ্ছে। দেশে শিক্ষিতের হার বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে মানুষের ইগো।
আরে ভাই ইগো বাড়ছে, আত্মসম্মান বাড়ছে সে তো ভালো কথা। মানুষের মধ্যে ব্যক্তিত্ব থাকা ভালো। কিন্তু তার সঙ্গে হাডুডু-কাবাডির কী সম্পর্ক!
সম্পর্ক আছে। ইগো বাড়ার ফলে এখন আর কেউ অন্যের পা ধরতে চায় না। আর পা-ই যদি না ধরবে, তাহলে কাবাডি খেলবে কিভাবে? সুতরাং…
আমার কথা শুনে ছোটভাই এবার পুরোই থ।
সে বলল, আপনি তো দেখি আমার পোলার চাইতেও…।