আমি বরাবরই অঙ্কে কাঁচা, যেকোনো ছোটখাটো হিসাব-নিকাশেও সেই একই অবস্থা। তারপরও কী এক অজ্ঞাত কারণে বাসার সবধরনের ব্যাংকিংয়ের কাজ আমার ওপরেই বর্তায়। আর আমি সেই কাজ করতে গিয়ে যা-তাভাবে নাজেহাল হই।
একবার বাসার বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিল দেওয়ার দায়িত্ব আমার ওপর চাপিয়ে দিয়ে মা চলে গেলেন দেশের বাড়ি। যাওয়ার আগে শুধু বললেন যে, বিলগুলো দিতে হবে সোবহানবাগে। আমি সে কথার ওপর ভিত্তি করে মেয়েকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে সোবহানবাগের জনতা ব্যাংকের গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। উদ্দেশ্য নয়টায় ব্যাংক খোলামাত্র (সেসময় ব্যাংক নয়টায় খুলত) আমিই প্রথম বিল দিয়ে অফিসে চলে যাব। একটি পত্রিকা অফিসে কাজ করতাম বলে আমার ডিউটি ছিল এগারোটা থেকে।
সে যাক। সময়মতো গেট খুলল। আমিই প্রথম কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়ালাম। যিনি বিল নেবেন, তিনি তখনো এসে বসেননি বলে আমি বেশ বিরক্ত। এত দেরি হলে কীভাবে সময়মতো অফিসে পৌঁছাব? লাইনে দাঁড়ানো অন্যদের সাথে ব্যাংকিংখাতের অব্যবস্থাপনা নিয়ে একটা ঘোঁট পাকানোর চেষ্টা করছিলাম। পনের মিনিট বাদে ব্যাংকের ক্যাশ কাউন্টারের ভদ্রলোক হন্তদন্ত হয়ে এসে বসলেন। বেশ হাসিখুশি চেহারার লোকটি বসেই বললেন, ‘খুবই দুঃখিত দেরি হওয়ার জন্য।’
আমি তার ব্যবহারে খুশি হয়ে ঘোঁট পাকানো বন্ধ করলাম। এবার আমার বিল দেওয়ার পালা। বিলটি তাঁর হাতে দিয়ে যেই টাকার ব্যাগে হাত দিয়েছি, দেখলাম ব্যাগটি নেই। ব্যাপার কী, হারাল নাকি? পরক্ষণেই বুঝলাম বিলের টাকাটি আমি নিয়েই আসিনি, শুধু বিলটি নিয়ে এসেছি। তাড়াতাড়ি তাঁর হাত থেকে বিলটি ছিনিয়ে নিয়ে, লজ্জিতভাবে বেরিয়ে এলাম। উহ! এতক্ষণ সময় নষ্ট!
নিজের ওপর প্রবল বিরক্ত। আমার বাসার সামনের রাস্তা আবার কাটা। রিকশা নিয়ে কোনোরকমে খানাখন্দ পেরিয়ে তল্লাবাগের বাসায় এলাম। সত্যিই আমি টাকার ব্যাগটি চেস্ট অফ ড্রয়ারের ওপর ফেলে গিয়েছিলাম। যাক, ব্যাগটি নিয়ে আবার এসে পৌঁছলাম ব্যাংকে। ততক্ষণে ঘড়ির কাঁটা দশটা পার হয়ে গেছে। ব্যাংকের লাইন আরও বড় হয়েছে। তাও আমি লাইনে দাঁড়ালাম।
এক পা-এক পা করে যখন কাউন্টারে এলাম ভদ্রলোক আমাকে দেখে হেসে বললেন, ‘টাকাটা পেয়েছেন তো?’ আমি লজ্জিত হয়ে তাঁর সামনে টাকাটা ধরলাম। কিন্তু একি!
বিলগুলো কই? সারা ব্যাগ হাতড়ে বিল পেলাম না। হঠাৎ মনে হলো টাকাটা নেওয়ার সময় বিলগুলো কি তবে চেস্ট অফ ড্রয়ারের ওপর রেখে এসেছি? হ্যাঁ, তাই তো। রাগে-দুঃখে দাঁতে দাঁত কাটতে লাগলাম। কাউন্টারে বসা লোকটিও তাজ্জব বনে গিয়ে বললেন, ‘ম্যাডাম এবার কি তাহলে আপনি বিলগুলো রেখে এসেছেন?’
আমি বাক্যহারা। কোনোভাবে মাথা নেড়ে লাইন থেকে সরে এলাম। পরিষ্কার মনে হলো আড়ালে-আবডালে ব্যাংকের লোকজন হাসাহাসি করছে।
ব্যাংকের বাইরে এসে নিজেকে প্রচণ্ড গালাগালি করতে শুরু করলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম ফোন করে বিলগুলো এনে নেব। আর ওই কাটা-রাস্তা পার হয়ে যাব না। একটা দোকান থেকে বাসার ল্যান্ডলাইনে (তখন আমাদের মোবাইল ছিল না) ফোন দিয়ে জানতে পারলাম আমি বিলগুলো রেখে এসেছি। প্রায় আধঘণ্টা বাদে একজন এসে হাতে বিলগুলো দিল।
এবার আমি ওভারশিওর। বিলগুলো বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলাম; যেন আর কোনো ভুল না হয়। এরপর যখন আমি বিল দিতে দাঁড়ালাম, ঘড়ির কাঁটা তখন এগারোটা পার হয়ে গেছে। আমি এবার এক হাতে টাকা, অন্য হাতে বিল নিয়ে দাঁড়িয়েছি, যেন কোনো ঝামেলা না হয়। কাউন্টারে আমি এসে দাঁড়াতেই, কাউন্টারে বসা লোকটি হেসে দিয়ে বলে উঠলেন, ‘ম্যাডাম, এইবার সব আনছেন তো?’ আমি মুখে বড়ধরনের গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললাম, ‘হুম। এই যে, নেন।’ বলে বিলটি এগিয়ে দিলাম। তিনি বিলটি হাতে নিয়ে বেশ খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তাঁর মুখভরা হাসি আর বিস্ময়। আমার মেজাজটা ভয়াবহ খারাপ হয়ে উঠল। রাগত স্বরে বললাম, ‘এইবার সমস্যাটা কী?’
তিনি আরও বেশি বিনয়ের সাথে বললেন, ‘ম্যাডাম, আপনার বিলগুলো রাস্তার উল্টোদিকে অগ্রণী ব্যাংকে দিতে হবে। এই ব্যাংকে, মানে জনতা ব্যাংকে নয়।’
এবার আমার মনে হলো ব্যাংকের ফ্লোর ফাক হোক আমি সেটায় ঢুকে যাই। নিজেকে সবধরনের গালিগালাজ করতে করতে রাগে দুঃখে বললাম, দুর শালা, বিলই দিবো না আর আজকে, অপদার্থ আমি। পৌনে নয়টা থেকে সাড়ে বারোটা, এই সাড়ে তিন ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আমি এসব কী করলাম? নিজেকে এই প্রশ্ন করতে করতে ও আহাম্মকির কারণ খুঁজতে খুঁজতে, সেদিনের মত বিল না দিয়েই অফিসে চলে গেলাম।
পুনশ্চ : সেইবারই কিন্তু শেষ নয়। এখনো আমি দায়িত্ব নিয়ে ব্যাংকের কাজ করে যাচ্ছি। সেটা করতে গিয়ে কীসব ঘটছে, সেসব গল্প অন্য দিনের জন্যই তোলা থাক তবে!