লোডশেডিং। বারান্দায় বসে আছি। সময় রাত দশটার আশেপাশে। চারপাশ অন্ধকার, আকাশে মেঘ, মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে। বৃষ্টির মধ্যে বারান্দায় বসে কফি খেতে খেতে অবন্তীর সাথে গল্প করার লোভ সামলাতে না পেরে অবন্তীকে ডাকলাম,
-অবন্তী।
-বলো।
-দু’কাপ কফি করে নিয়ে এসে আমার পাশে বোস।
কিছুক্ষণ পর অবন্তী দু’কাপ কফি নিয়ে এসে পাশে বসলো। এক কাপ আমার হাতে দিয়ে আরেক কাপ নিজের হাতে রাখলো। আমি বললাম,
-দুটোই দাও।
সে বাধ্য বালিকার মতো দুটো কাপই আমার হাতে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-আমি খাবো না?
আমি একটা কাপ আমার ওপর পাশে রাখতে রাখতে বললাম,
-অবশ্যই খাবে। কেন খাবে না? আমরা যদি দুজন আলাদা আলাদাভাবে কফি খাই ব্যাপারটা খুবই সাধারণ হবে। কিন্তু, আমরা যদি একই কাপ দু’জন ভাগাভাগি করে খাই যেমন, আমি এক চুমুক খেয়ে তোমাকে দিলাম আবার তুমি এক চুমুক খেয়ে আমাকে দিলে। ব্যাপারটা রোমান্টিক না? বলা হয়ে থাকে, ভাগাভাগিতে ভালোবাসা গভীর হয়।
অবন্তী দারুন খুশি হলো। যেন, এমন মজার আইডিয়া কোনোদিন সে শোনেনি।
বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। হালকা বাতাস, শরীরে খানিকটা ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছে। আমরা ভাগাভাগি করে কফি খাচ্ছি। অবন্তী আমার কাঁধে মাথা রেখে গল্প করছে। মেয়েটি অনেক কথা বলতে পারে। অবশ্য, যার কন্ঠ এতো সু-মধুর তার একটু বেশী কথা বলার অধিকার নিশ্চয়ই আছে। এক কাপ কফি শেষ করে আমি অবন্তীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। মিনিট খানেকের মধ্যে অবন্তী ঘুমের ঘোরে চলে গেছে। একা একা কফি খেতে ইচ্ছে করছে না। আরেক কাপ কফি কাপেই রয়ে গেল।
শুক্রবার। ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হয়েছে। অবন্তী কয়েকবার এসে বলে গিয়েছে নাস্তা করার জন্য। ফ্রেশ হয়ে টেবিলে গিয়ে বসলাম। সিয়াম বসে আছে, অবন্তীর একমাত্র ছোট ভাই।
-আসেন দুলাভাই। আপনার জন্যেই নাস্তা নিয়ে বসে আছি, খেতে পারছি না।
-তোকে কতবার বলেছি, আমাকে দুলাভাই বলবি না? ভাইয়া বলবি, জাস্ট ভাইয়া।
-আচ্ছা দুলাভাই।
-আবার! আর তুই আমাকে আপনি বলা শুরু করলি কবে?
-আচ্ছা, সরি ভাইয়া। খাওয়া শুরু করো।
আমি পাউরুটিতে জেলী মাখাতে মাখাতে জিজ্ঞেস করলাম,
-কখন এলি?
-ঘন্টাখানেক হবে। আমি একা আসিনি।
-বিয়ে করে বউ নিয়ে এসেছিস? আমি তোকে আমার বাসায় জায়গা দিতে পারবো না। এমনিতেই আনিস সাহেব আমার উপর ভীষন ক্ষেপে আছেন তোর আপুকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম তাই। দুপুরে কি খাবি বল? তোর আপুকে বলি রান্না করতে। খেয়ে বিদেয় হ।
-ধুর! তুমি এত কথা বলছো কেন ভাইয়া? তুমি তো এত কথা বলতে না।
-বলতে হয়, তুই দুপুরে কি খাবি সেটা বল।
-বিয়ে করে বউ নিয়ে আসিনি। আব্বু আসছে আমার সাথে।
পাউরুটি চিবোচ্ছিলাম, থেকে গেলাম। গিলতে চেষ্টা করছি, হচ্ছে না। মহাবিপদ! আনিস সাহেব আমাকে উনার দু’চোখে দেখতে পারেন না। উনি আমার বাসায় আসছেন ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। পানির গ্লাস নিয়ে কয়েক ঢোক খেয়ে নিয়ে বললাম,
-ইয়ার্কি করিস?
-না ভাইয়া, সত্যি।
-কোথায় উনি?
-ঐ রুমে, রেস্ট নিচ্ছে।
আমি খাবার ছেড়ে উঠে গেলাম সত্যতা যাচাই করতে। পা টিপে টিপে ঘরে গেলাম। হ্যা, আনিস সাহেব শুয়ে আছেন, চোখ বন্ধ। আমি দাঁড়িয়ে আছি। উনার চোখ খুলে গেলো। আমি ওনার দিকে তাকিয়ে আছি। উনি গম্ভীর গলায় বললেন,
-কি ব্যাপার এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?
আমি একটু হকচকিয়ে গেলাম।
-না মানে আব্বা, শার্টটা অনেক সুন্দর তো। আপনাকে অনেক মানিয়েছে শার্টটা। মনে হয় আপনার জন্যই বানিয়েছে এটা। একদম পারফেক্ট। দেখেই খুশিতে অবাক হয়ে গেছি। এই যে দেখুন এত অবাক হয়েছি যে, সালাম দিতে ভুলে গেছি। স্লামালিকুম আব্বা।
-ওয়ালাইকুম সালাম।
কণ্ঠের গম্ভীরতা কমেনি। মনে হয় প্রশংসায় কাজ হয়নি।
-কখন এসেছেন আব্বা?
-তোমাকে না কতবার বলেছি, কথায় কথায় আব্বা আব্বা করবে না?
-নাস্তা করেছেন আব্বা?
উনি চোখ বড় বড় করে তাকালেন।
-সরি। নাস্তা করেছেন?
-হ্যা। তুমি ঘুমোচ্ছিলে। এত বেলা করে ঘুমোলে জীবনে আর উন্নতি করতে পারবে না। এখানেই শেষ। এত বেলা করে ঘুমোবে না।
-জ্বী, আ… (উনি আবার চোখ বড় করে চাইলেন? আচ্ছা।
-আপনি বিশ্রাম করুন আমি নাস্তা শেষ করে আসি আব্বা।
বলেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম। উনার দিকে তাকালাম না। নিশ্চয়ই আবারও চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন আর বিরিবির করে বলছেন, “রাবিশ”। ভদ্রলোকের চোখ এমনিতেই বড়। নরমাল চোখের দিকে তাকাতেও ভয় হয়।
অবন্তীর কাছে গিয়ে বললাম,
-আনিস সাহেব আসছে আগে বলবে না?
-বাবা বলো পিয়াস।
-কি মুসিবত! মেয়ে বলে বাবা বলো। বাপ বলে আব্বা আব্বা করবে না। কি করবো আমি?
অবন্তী হেসে দিয়েছে। হাসলে ওর গালে টোল পরে। গালে টোল না পরলেও হতো। ওর হাসি এমনিতেই অসম্ভব রকম সুন্দর। টোল পরাতে ভয়ঙ্কর রকম সুন্দর দেখায়। দুই গালেই টোল পড়াতে অতি ভয়ঙ্কর সুন্দর রকম দেখায়।
দুপুরে নামাজ শেষ করে এসে খেতে বসলাম আমরা। আনিস সাহেব বললেন,
-ঢাকা এসেছিলাম একটা কাজে। ভাবলাম অবন্তীকে দেখেই যাই, তাই এখানে আসা। অবন্তী আমার সাথে যাবে। তুমি সপ্তাহ খানেক পর গিয়ে তাকে নিয়ে আসবে।
আনিস সাহেবের মুখের উপর না করবো সেই সাহস আমার কোনোদিনও ছিলো না। আবার অবন্তীকে ছাড়া এক সপ্তাহ থাকবো সেটাও চিন্তা করতে পারছিলাম না। আমি বললাম,
-আব্বা, আমিও যাই আপনার সাথে অনেকদিন যাওয়া হয়নি।
উনি ভ্রু কুঁচকিয়ে বললেন,
-তোমার যাওয়ার দরকার কি? তাছাড়া তোমার অফিস আছে।
-আপনি বললে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে নিব।
আনিস সাহেব কিছু না বলে খাওয়ায় মনোযোগ দিলেন।
আমি গাড়ি চালাচ্ছি পাশে অবন্তী। পিছনের সিটে আনিস সাহেব আর সিয়াম। কিছুদূর যাওয়ার পর আনিস সাহেব বললেন,
-এই,গাড়ি থামাও।
আমি ভাবলাম হয়তো প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যাবেন।
-আব্বা, সামনে একটা ভালো রেস্টুরেন্ট আছে। ওদের ওয়াশরুম অনেক পরিষ্কার।
-চুপ করো ননসেন্স। গাড়ি থামাও এক্ষুনি।
আমি গাড়ি থামালাম। উনি নেমে সামনে এসে আমাকে বললেন, ‘গাড়ি থেকে নামো।’
আমি চুপচাপ গাড়ি থেকে নামলাম।
-তোমার চালানোর ধরন আমার কাছে ভালো মনে হচ্ছে না। লাইসেন্স আছে তো তোমার?
-জ্বী আব্বা, তবে মেয়াদ আছে কিনা মনে নেই। দাঁড়ান, চেক করছি।
-চুপ থাকো, বেয়াদব।
আমি চুপ করলাম। অবন্তী আর সিয়াম একটু একটু হাসছে। আনিস সাহেব গাড়িতে উঠে বসলেন। লোকটিকে ড্রাইভিং সিটেই ভালো মানায়। উনি গাড়ি স্টার্ট দেয়ার সাথে সাথে আমি দৌড়ে গিয়ে পিছনে সিয়াম এর সাথে বসলাম। নয়তো আমাকে ফেলে চলে যেত এই লোক শিওর। গাড়ি চালাচ্ছেন আনিস সাহেব। এই গতিতে গাড়ি চললে সম্ভবত তিনদিন লাগবে ঢাকা থেকে গাজীপুর পৌঁছতে। সেক্ষেত্রে, একটু ঘুমিয়ে নেয়া যাক। চলছে গাড়ী, শশুর বাড়ী।