ঘুম

ঘুম

আমি আবার প্রচন্ডরকম ঘুম পাগল। রাতে তো তাড়াতাড়ি ঘুমাই ঘুমাই দিনেও কমপক্ষে দু-তিন ঘন্টা না ঘুমালে আমার চলেই না। দুপুরে খাওয়ার পর ভাত ঘুম দেওয়া যেন আমার দৈনন্দিন অপরিহার্য কার্যে পরিণত হয়েছে। বাড়িতে থাকলে হয়তো মায়ের বকাঝকা শুনে হলেও ঘুমানো কিছুটা কমতো, কিন্তু পড়াশোনার জন্য বাইরে থাকতে হয় তাই শাসন করার কেউ নেই।

ছুটির সময় যখন বাড়ি যাই তখন বাচ্চাকাচ্চাদের জ্বালায় আমার দিনের ঘুম তো দূরে থাক রাতের ঘুম ও হারাম হয়ে যাওয়ার অবস্থা হয়।
বাচ্চারা যে কি জিনিস তা তো আগেই হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি আর কিছুদিন আগে শিরা উপশিরায় টের পেলাম।

দুপুরে খাওয়ার পরে যেইনা বিছানায় একটু গা এলিয়ে দিলাম সাথে সাথে বাড়ির দুইটা সহ আশেপাশের বাচ্চারা এসে কেউ বলল

— ফুপী চলো খেলি, কেউ বলল ফুপী চলো পুতুলের বিয়ে দেই, ছেলেরা বলল
আমরা ক্রিকেট খেলবো তোমাকে আম্পায়ার হতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমি কোনদিকে যাব বলেন? ভাবলাম এক হিসেবে ভালই হলো। বুদ্ধি করে ওদের বললাম

— দেখো আমি একটা মানুষ আর তোমরা এতগুলা দল আমার পক্ষে তো সবার সাথে যাওয়া সম্ভব না। যদি একজনের দলে যাই বাকিরা মন খারাপ করবে, আর আমি চাইনা কেউ মন খারাপ করুক। তারচেয়ে ভাল তোমরা তোমাদের মত খেলো আর আমি আমার মত ঘুমাই।

সবাই আমার কথা মেনে নিলেও ঘরের শত্রু বিভীষণ আমার ভাতিজা বলল,
— তাহলে লটারি করি তুমি কাদের সাথে যাবা।
পরে গেলাম প্যাঁচে। শয়তান বাচ্চারা সেদিন আমাকে ঘুমাতেই দিলো না। তবে ওদের সাথে একটা চুক্তি করেছি। চুক্তিটা হলো, আমি যদি ওরা ডাকতে আসার আগে ঘুমিয়ে যাই তবে ওরা আমায় ঘুমাতে দিবে। কিন্তু আমি ঘুমানোর আগে যদি ওরা আসে তবে আমাকে ওদের সাথে যেতে হবে।

পরেরদিন,
ইমনকে ৫০ টাকা ঘুষ দিলাম যেন নতুন কোনো বুদ্ধি না বের করে। ওর মাথায় যে হাজারটা শয়তান তার শয়তানি বুদ্ধি নিয়ে ঘোরে তা আমার চেয়ে বেশি আর কেউ জানেনা।

দুপুরে তাড়াতাড়ি করে খাবার খেয়ে ঘুমাতে গেলাম। যাক আজ বাঁচা গেলো এত তাড়াতাড়ি আর কেউ ডাকতে আসবেনা। কিন্তু বিধিবাম বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করার আগেই দেখি মারিয়া হাজির। এখন যে চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান করবো সে উপায়ও নেই। অগত্যা চোখ খোলা রেখেই চুপচাপ শুয়ে থাকলাম।
মারিয়া এসেই বলল,
–এইতো তোমাকে জাগনা পাইছি চলো আমাদের সাথে এলোন্টি বেলোন্টি খেলবা।

আমি কিছু না বলে চোখ খোলা রেখে যেমন ছিলাম তেমনই থাকলাম। ও আরও কয়েকবার ডেকে যখন কোনো সাড়া পেলোনা তখন আমার নাকের কাছে হাত রাখলো। হয়তো ভেবেছে মরে টরে গেছি কিনা আবার। মরিনি এখনো এটা সিওর হয়ে ও ইমনকে ডাকতে ডাকতে বাইরে গেল। আমি তখন চোখ বন্ধ করে ফেললাম। কিন্তু একি মারিয়া সবাইকে এসব কি বলতেছে? সবাইকে বলতেছে আমি নাকি চোখ খুলে ঘুমাই।
এক মিনিটের মধ্যে সবাই হাজির আমার ঘুম দেখার জন্য। আমি যদি ওদের সামনে চোখ খোলা না রাখি তবে তো বুঝে যাবে আমি ঘুমাইনি অভিনয় করছি, তাই বাধ্য হয়ে চোখ খোলা রাখতে হলো। কিন্তু কতক্ষণ আর এভাবে থাকা যায় তাই একটা হাত দিয়ে চোখ ঢেকে ফেললাম।
আমায় নিয়ে যেন ওদের উৎসাহের শেষ নেই। একেকজন একেক কথা বলে যাচ্ছে আমায় নিয়ে। ওদের কথা শুনে আমার হাসি পেলো, একটু হেসেই আবার চুপ হয়ে গেলাম আগের মতো কিন্তু হাসির রেশ ঠোঁটে লেগেই থাকলো। আঁখি সবাইকে বলল,

— ফুপী ঘুমায় নাই, দেখ হাসতেছে। ঘুমালে তো আর হাসতো না। সবাই আবার আমায় ডাকতে লাগলো। যাই করুক আমি উঠবো না। হঠাৎ শুনি ইমন ওদের বলতেছে,

— কে বলে ফুপী ঘুমায় নাই? ফুপী তো অনেক আগেই ঘুমিয়ে গেছে। এখন মনে হয় স্বপ্ন দেখতেছে। ছবিতে দেখিস না নায়িকারা স্বপ্ন দেখলে হাসে?
ইমনের কথা শুনে তো আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম। এইটুকু ছেলের মাথায় কি বুদ্ধি! যাক ইমন নিমকহারামি করেনাই। ওরা সবাই ইমনের কথা মেনে হয়তো চলেই যেত কিন্তু ইমনের এই কথা শুনে আমি হাসতে হাসতে বসে পরলাম।
তারপর কি ঘটেছিল তা মনে হয় না বলাই ভাল।

সেদিন ঘুমাতে না পারলে কি হবে গল্প করে বাচ্চাদের মাথায় ঘুমের ভুত ঢুকিয়ে দিয়েছি৷ দুপুরের ঘুমের কতরকমের যে উপকারিতার কথা বলেছি ওদের তার ইয়ত্তা নেই। যদিও সব মনগড়া, বানোয়াট। বাচ্চারা বলেছে পরেরদিন থেকে দুপুরের খাবার খেয়ে ওরাও ঘুমাবে। এমনভাবে যে ওদের ব্রেইনওয়াশ করতে পারব ভাবিইনি।

এর পরেরদিন,
আজ তো মনের সুখে ঘুমাতে পারবো, ভাবতেই খুশি খুশি লাগছে। ২টা বাজে, আমি ৫ টার এলার্ম দিয়ে শুয়ে পরলাম। একটু পরেই দেখি আবার সব বাচ্চাকাচ্চারা হাজির। মারিয়া, ইমন, নাজমুল, ফারুক, ফরিদ, মাহিন, সুমাইয়া, আঁখি, আলামিন, বিজলী এমনকি মাহিনের দুইবছর বয়সী ভাইটাও। কি ব্যপার ওরা কেন? ওদের তো আজ ঘুমানোর কথা ছিল। পরে শুনি সবাই আমার সাথে ঘুমাতে এসেছে।
এতজন লোক যে একসাথে ঘুমানো যায়না ওদের বুঝাতেই পারলাম না। অনেক বুঝিয়ে মাহিনের ভাইকে রেখে আসা হলো।
খাটে থাকা একেবারেই অসম্ভব তাই মাটিতে বিছানা করা হলো। সবাই আমার পাশে শুতে চায়। এই নিয়ে ওদের মধ্যে দ্বন্দ্বও শুরু হয়ে গেলো। অনেক কষ্টে ওদের থামিয়ে শুয়ে সবাইকে নিয়ে শুয়ে পরলাম।

বিজলী বললো,
— ফুপী ঘুম আসেনা কি করব? একটা গল্প শুনাও না। গল্প শুনলে আমার ঘুম আসে।

বাকিরাও ওর সাথে সুর মেলালো। কি আর করা শোনালাম একটা গল্প।
“একটা বোকা ছেলে স্কুলে পড়ে। সেদিন ওদের স্কুলে ভিজিটর আসার কথা তাই তার ক্লাস টিচার খুব চিন্তিত যদি ওকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে তবে কি হবে? তাই স্যার জনাব আমিরুদ্দিন একটা বুদ্ধি করলো। প্রথমে ভিজিটর কে ‘ক’ শাখায় নিয়ে গেলো। ওখানে কি প্রশ্ন করে এটা শুনে বোকা ছেলেকে উত্তর শিখিয়ে দিবে। ভিজিটর একজন কে প্রশ্ন করলেন –তোমার ক্লাস টিচারের নাম কি?

তারমানে ক্লাস টিচারের নাম জিজ্ঞেস করবে৷ উত্তর টা বোকা ছেলে কে শিখিয়ে রাখলো। বলা তো যায়না যদি ওকেই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে।
ভিজিটর ওদের ক্লাসে এসে বললো তোমাদের মধ্যে কাকে প্রশ্ন করা যায় বলোতো। বোকা ছেলে দাড়ালো। ভিজিটর খুব খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করলো বলোতো বাবা জাতীয় পশুর নাম কি? ছেলেটি উত্তর দিল জনাব আমিরুদ্দিন।”

গল্প শেষে সবাইকে চুপচাপ ঘুমাতে বললাম।
কিছুক্ষণ পর মাহিন বলে,
— বাবা রে কি মশা! আমার সব রক্ত খেয়ে ফেললো রে….।
এভাবে চিল্লাতে থাকলে তো আমার ঘুমানোই হবে না তাই একটা কয়েল জ্বালিয়ে দিলাম।
কিছুসময় যেতে না যেতেই আঁখি বলে,
— ও ফুপী কয়েলের গন্ধে আমার বমি আসে। কয়েল নিভিয়ে দাও প্লিজ।
মাহিন আঁখির উপর রেগে গিয়ে বলল,
— ফুপী কয়েল নিভাবে না তাতে তোর কি?
এই নিয়ে আবার ওদের মধ্যে ঝগড়া লেগে গেল।
ঝগড়া মিটমাট করে কয়েল বন্ধ করে ফ্যান ছাড়লাম। সবাইকে বলে দিলাম আর যেন কথা না বলে।

আমি বললে কি হবে কুকুরের লেজ আর বাচ্চাদের স্বভাব যেন পাল্টাবার নয়।
একটু পরেই মারিয়া বললো ওর নাকি ফ্যানের বাতাসে ঠান্ডা লাগছে। হয় আমি ফ্যান অফ করে দিব নয়তো ওকে কাঁথা এনে দিব।
উফফ এত বিরক্তিকর এরা কে জানতো? নিজের হাতে কাঁথা এনে নিবে তা না আমাকেই এনে দিতে হলো।
সবাইকে খুব করে শাসিয়ে দিলাম- এর পর যদি কোনো সমস্যা হয় তবে নিজেরাই যেন তার সমাধান করে নেয় আমায় যেন না ডাকে।

আবার ঘুমানোর জন্য চোখ বন্ধ করলাম। কিছুটা তন্দ্রার মত আসছিলো আর তখনই ওদের চেঁচামেচি তে আমার ঘুম পগারপার। রেগে গিয়ে বললাম,
— ওই শয়তানরা আবার চিল্লাচ্ছিস কেন? সমস্যা কী তোদের? আমায় কি ঘুমাতে দিবি না তোরা?
আলামিন কিছুটা কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল,
–আমাদের দোষ নাই, ওই ফরিদ পাদ দিয়ে বলে দেয়নাই৷
ছি ছি কি অসভ্য শব্দ। রাগ উঠে গেলো শুনে। তবুও রাগ চেপে রেখে মিষ্টি করে বললাম,
–নেক্সট টাইম থেকে যেন এটাকে গ্যাস বলা হয়। এটাও বললাম এতে ফরিদের কোনো দোষ নেই, হঠাৎ করে গ্যাস এসে গেলে বেঁচারা কি করবে?
যাইহোক, তোদের সবাইকে বলে রাখি পরেরবার থেকে কারো গ্যাস ছাড়ার সময় হলে সবাইকে বলে ছাড়বি। বলতে যদি লজ্জা লাগে তবে বলবি সবাই নাক ধরো তাতেই আমরা বুঝে নিব। মনে থাকবে তো?
ওরা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল।
এবার আর কোনো ঝামেলা নেই মনের সুখে ঘুমাতে পারবো। চোখ বন্ধ করার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে গেলাম।
ঘুমিয়ে একটা সুন্দর স্বপ্ন দেখতে লাগলাম।

আমি যেন পরী হয়ে গেছি। উড়ে উড়ে চারপাশ ঘুরতে লাগলাম। একসময় সুন্দর একটা ফুলের বাগানে ঢুকে দেখি অনেকগুলা প্রজাপতি খেলছে। আমায় দেখে তারা আমাকে ওদের সাথে খেলতে ডাকলো। আমি ওদের সাথে খেলছি খেলতে খেলতে দেখি প্রজাপতিগুলো আমার শয়তান ভাতিজা ভাতিজিদের মত হয়ে যাচ্ছে। আমার দিকে তাকিয়ে বলতেছে ফুপী চলো ক্রিকেট খেলি, চলো পুতুল খেলি, চলো এলোন্টি বেলোন্টি খেলি। হায়রে কপাল এরা এখানেও এসে গেছে? ওদের থেকে বাঁচার জন্য উড়তে গিয়ে দেখি আমার পাখা নাই মানুষ হয়ে গেছি। অগত্যা দৌড়াতে লাগলাম। পিছন পিছন ওরার দৌড়াচ্ছে আর বলছে ফুপী দাড়াও, আমাদের নিয়ে যাও। আমি দৌড়াচ্ছি ওরাও দৌড়াচ্ছে। হঠাৎ ইমন আমায় ধরে ফেলে কি যেন বলতে লাগলো।
ঠিক তখনই আমার ঘুম ভেঙে গেল।

হায় আল্লাহ আমি কোথায় যায়। দেখি ইমন আমায় ডাকতেছে। হারামজাদাটার উপর প্রচন্ড রাগ উঠতে লাগলো৷ বললাম,
— কি হইছে? ষাঁড়ের মত চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে আমাকে ডাকছিস কেন? আমার স্বপ্নের মধ্যে গিয়েও নিস্তার দিলিনা এখন কাঁচা ঘুম ভাঙালি। সমস্যা কি?
ইমন আমার কথায় কোনো কর্ণপাত না করে বললো নাক বন্ধ করো আমি গ্যাস ছাড়বো।

এই কথা বলার জন্য আমায় ঘুম থেকে ডেকে তুললো, মেজাজ কতটা খারাপ হয় আপনারাই চিন্তা করুন। লাঠি নিয়ে সব কয়টারে দৌড়ানি দিলাম। শালার পোলাপান এটা বলার জন্য আমার এত সুন্দর ঘুম নষ্ট করে দিলি? আজ তোদের একদিন কি আমার যতদিন লাগে। হারামজাদার দল।

দূর থেকে ইমন বলে উঠলো,
— আমার দোষ কোথায় এখানে তুমিই তো বলছো পাদ আসলে আমরা যেন বলি গ্যাস ছাড়ব নাক বন্ধ করো। তোমার কথা তোমাকেই না বললে কি হয় বলো? তাইতো তো ঘুম থেকে ডেকে তুললাম। কোথায় ধন্যবাদ দিবে তা না উল্টা মারতে আসে।

ওদের তো ধরতেই পারলাম না উল্টা ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেলাম। তবুও ভাল হারামি বাচ্চাদের তো দূর করতে পারলাম।
এতেই আমি অনেক খুশি। একরাশ আনন্দ নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। রাজ্যের ঘুম যেন চোখে নেমে এসেছে। কিন্তু হায় তখনই মোবাইলের এলার্ম বেজে উঠলো। শালার মোবাইলও আমার সাথে গুটিবাজি শুরু করছে। কেউ আমাকে ঘুমাতে দিতে চায়না। নইলে কি এত তারাতারি পাঁচটা বাজে…..?

গল্পের বিষয়:
হাস্যরস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত