বিশিষ্ট ইঁদুর পিকু দেখল, ইদানীং তার স্ট্যাটাসগুলোতে লাইক পড়ছে না। ফলোয়ারও আটকে আছে আগের জায়গায়। ঘুম থেকে উঠে একটা সেলফি আপলোড করলেও লাইক মাত্র দশটা। পিকুর ধারণা, জাতীয় ইঁদুর নিধন সপ্তাহের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী কোনো স্ট্যাটাস না দেওয়ায় তার কদর কমে গেছে। বিষয়টা নিয়ে পিকু বেশ চিন্তায় আছে। গত রাতেও দুঃস্বপ্ন দেখেছে সে। একটা বিড়াল কম্পিউটারে ‘কিল আ মাউস’ গেম খেলছে। কম্পিউটারের মাউসের বদলে বিড়ালের হাতের মুঠোয় ছটফট করছে পিকু! কী ভয়ংকর! ভাবলেই পিকুর লেজ গুটিয়ে যায়। তবে ব্যাপারটা কাউকে বলেনি সে। বিড়ালবিরোধী স্ট্যাটাস দেওয়া ইঁদুর যদি স্বপ্নে বিড়াল দেখে ভয় পায়, তাহলে সমাজে সে প্রোফাইল পিকচার দেখাবে কী করে?
–
পিকু ভাবল, গ্রামে বেড়াতে যাবে। ভ্রমণ স্বাস্থ্যের পক্ষে উত্তম। দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে রওনা দিল সে। সঙ্গে স্মার্টফোন, ক্যামেরা। মালবাহী ট্রেনের কোনায় উঠে চেক ইন দিতে গিয়ে মনে পড়ল, মোবাইলের চার্জার আনেনি সে!
দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে নিজ গ্রামে নামল পিকু। গ্রামের কিছু নৈসর্গিক ছবি তুলল সে। নৈসর্গিক ছবিতে লাইক বেশি। ফলোয়ার বাড়ে। পিকু ভাবল, বন্ধু চিকুর বাড়িতে গিয়ে তাকে চমকে দেবে। সরষেখেতের এক গর্তে থাকে চিকু। কিন্তু গর্তটা কোথায়, তা মনে করতে পারল না সে। গুগল ম্যাপে খুঁজতে গিয়ে দেখে নেট নাই। মেজাজ বিগড়ে গেল তার। ‘হোয়াট দ্য প্লেস? নেট নাই?’ ভাবল সে। হঠাৎ দূর থেকে কে যেন কিচকিচ করে ডেকে উঠল। পিকু তাকিয়ে দেখে, তার ছোটবেলার বন্ধু চিকু ছুটে আসছে। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে শুভেচ্ছা বিনিময় শেষে গর্তে ঢুকল ওরা।
–
গর্তে ঢুকে মন খারাপ হয়ে গেল পিকুর। কী অস্বাস্থ্যকর স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ! পিকু এদিক–ওদিক তাকাচ্ছে দেখে চিকু বলল, ‘কী খুঁজছিস?’
‘ওয়াইফাই নাই?’
‘না।’
‘ওয়াইফাই ছাড়া বাসা হয় নাকি? রান্নাঘর ছাড়া তা–ও থাকা যায়, ওয়াইফাই আর টয়লেট ছাড়া… ইমপসিবল।’
‘আমরা আছি না!’
‘সরষেখেতে থেকে এখনো “খ্যাত”ই আছিস। একটু স্মার্ট হ, বুঝলি? গান শুনিসনি? ঢাকার ইন্দুর ভেরি ভেরি স্মার্ট?’
‘আরে চল, বাজারে যাই। কোনার দোকানে সুস্বাদু পচা আলু পাওয়া যায়।’
‘তাই? দোকানের রেটিং কেমন?’
‘রেটিং?’
‘কই থাকিস? এখন সব জায়গারই রেটিং থাকে ফেসবুকে। সবাই যায়, ভালো লাগলে ভালো রেটিং দেয়, নইলে খারাপ!’ ‘তুই রেটিং দিস। আলুগুলা এত পচা! কী যে মধুর ঘ্রাণ আসে সেগুলো থেকে!’
‘রিয়েলি? কুল!’
‘কুলের সময় আসে নাই এখনো। কয়েক দিন পর উঠবে।’
‘ধুর! এই কুল মানে বরই না। মানে… দারুণ আরকি! চল।’
–
খেতে যাওয়ার আগে সরষেখেতের সামনে দাঁড়িয়ে একটা সেলফি তুলল ওরা। ‘ওয়াচিং সরষে ফুল’ লিখে সেটা ফেসবুকে আপলোড করল পিকু। দোকানে এসে আরও বিরক্ত সে। বসার জায়গা নেই, নেই নিরাপত্তাও। সবচেয়ে বড় কথা, এই জায়গার কোনো চেক ইন পেজই নাই। কখন বিড়াল আসে তার নাই ঠিক। ‘শহরে থেকে তুই আরও ভীতু হয়ে গেছিস।’ পিকুকে বোঝানোর চেষ্টা করল চিকু। ‘আরে এটাই তো জীবন। বিড়াল আসবে, আমরা বিড়ালকে ধাঁধায় ফেলে খাবার খাব! এটাই তো মজা!’
‘রাখ! এটা লাইফ? ওপেন প্লেস, সিকিউরিট নাই! শিট ম্যান! চল। রুমে যাব।’
–
রাতে শুয়ে চিকু বলল, ‘দোস্ত, তুই গ্রামকে কত ভালোবাসতি…’
পিকুর মেজাজ খারাপ। গর্তের ভেতর নেটওয়ার্ক কাজ করছে না। এক রাত স্ট্যাটাস না দিলে এমনিতেই তার ঘুম হয় না। তার ওপর মাটির গন্ধটাও গুমোট। সে বিরক্ত হয়ে বলল, ‘এয়ার ফ্রেশনার নাই রুমে? পরিবেশটা কেমন যেন…’
‘ইঁদুর হয়ে গর্তে অস্বস্তি বোধ করছিস? শহরে গিয়ে তোর কী হলো?’
‘গেলে বুঝবি, হোয়াট ইজ লাইফ! সকালে যাব আমি। এখানে নেট ছাড়া, ফোন ছাড়া কোনো ইঁদুর থাকতে পারে? একটা তেলাপোকাও এর চেয়ে বেটার লাইফ লিড করে। তুইও চল শহরে।’
–
পরদিন ট্রেনে চেপে শহরে এল পিকু-চিকু। বড় দালান, ঝলমলে আলো দেখে চিকু তো অবাক। ‘তুই ঠিক বলেছিস। আসলে শহরেই জীবন।’ পিকুকে বলল সে। শুনে হাসল পিকু। ভাবল ‘খ্যাত’ বন্ধুকে দেখিয়ে দেবে তার স্ট্যাটাস! কয়েক ঘণ্টায় চিকু দেখে ফেলল বিশাল শপিং মল। চলন্ত সিঁড়ি। চিকু–পিকুকে দেখে চিত্কার করে উঠল কিছু তরুণী। চিকু ভাবল, মানুষগুলো ওদের দেখে কতই না খুশি হয়েছে! পিকু এ ঘটনা স্ট্যাটাসে লিখল, ‘ওয়ান্স অ্যাগেইন! মেয়েরা আমাকে দেখে অজ্ঞান! ভক্তদের ভালোবাসার যন্ত্রণায় ঘর থেকে বের হওয়াই টাফ। লোল! অ্যাট শপিং মল’।
–
ঘুরতে ঘুরতে খিদে পেল দুজনেরই। পিকু তার পছন্দের রেস্টুরেন্ট ‘র্যা টস ডেন’–এ বসল চিকুকে নিয়ে। বেশ কিছু খাবার অর্ডার দিল তারা। চিকু অবাক হয়ে দেখল, আশপাশের সবাই লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে। অদ্ভুত তো! পিকুকে বলতেই হাসল সে, ‘ও ম্যান! ওরা লজ্জায় মাথা নিচু করেনি। ওরা ফোনে ফেসবুকিং করছে, গেম খেলছে, মেইল চেক করছে। এখন স্মার্টদের যুগ। দুনিয়া তো এখন স্মার্টফোনেই! তুই তো…’
–
চিকু বুঝল সে কত বোকা। সবার মাঝে অস্বস্তিবোধ করল সে। কেউ কারও সঙ্গে কথা বলে না, মাথা নিচু করে ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাহলে সবাই মিলে খেতে আসার দরকার কী? একটু পর খাবার এল। কী ঘ্রাণ খাবারের! চিকু খাওয়া শুরু করতে গিয়ে দেখে, পিকু খাবারের ছবি তুলছে।
‘কী করিস?’
‘ছবি তুলছি। পাবলিক দেখুক কী খাচ্ছি।’
–
ছবি তুলে চেক ইন দিয়ে খাওয়া শুরু করল পিকু। স্মার্ট হওয়া কেন জরুরি, তা নিয়ে একটা দীর্ঘ লেকচারও দিল সে। হঠাৎ পোঁ পোঁ শব্দে বাজল অ্যালার্ম। সবাই পালাতে শুরু করল। চিকু কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার হাত ধরে টেনে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটল পিকু। একটা আলমারির নিচে লুকাল ওরা। চিকু ভয়ে ভয়ে বলল, ‘ঘটনা কী?’
‘কিছু টেররিস্ট বিড়াল ঢুকে পড়েছে!’
‘তুই না বলেছিলি এটা নিরাপদ?’
‘মানুষের মতো কথা বলিস না তো! বেকুব! নিরাপদ বলেই তো অ্যালার্ম বেজেছে।’
‘ওরা জানল কীভাবে?’
‘আরে, চেক ইন দিলাম না! চেক ইন দেখেই জেনেছে। আগেই সন্দেহ করেছিলাম, আমার ফ্রেন্ডলিস্টে কিছু বিড়ালের ফেক আইডি আছে। আজ শিওর হলাম। সবগুলাকে ব্লক মারতে হবে।’
‘তুই থাক। আমি গেলাম।’
‘মানে কী? কই যাস?’
‘গ্রামে। এমন স্মার্ট লাইফ আমার দরকার নাই। এর চেয়ে আমার সরষেখেতের গর্ত, পচা আলুর দোকান অনেক ভালো। ওখানে ফেসবুক, চেক ইন, স্মার্টফোন নাই। কিন্তু শান্তি আছে। বিদায়।’
–
চিকু অন্ধকার আলমারির তলা থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল। সেই দুঃখে হতাশ হয়ে ‘আজ ছোটবেলার বন্ধুর সঙ্গে ব্রেক আপ হয়ে গেল’ লিখে স্ট্যাটাস দিল পিকু। সঙ্গে সঙ্গেই নোটিফিকেশনের আওয়াজ। একজন কমেন্ট করেছে। কমেন্ট দেখতে যাওয়ার আগেই কান ফাটা ‘মিঁয়াও’ গর্জনে গর্জে উঠল এক বিড়াল!
–
ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেল পিকুর। আজও ফোনটা সাইলেন্ট করতে ভুলে গেছে সে।
গল্পের বিষয়:
হাস্যরস