যখন জ্ঞান হলো, চোখ মেলে বিমল দেখলে যে, ভোরের আলোয় চারিদিক ঝলমল করছে ।
প্রথমে তার কিছুই স্মরণ হলো না; তার মনে হলো সে সবে ঘুম থেকে জেগে উঠলো। কিন্তু হঠাৎ ব্যথা অনুভব করে সে মাথায় হাত দিলে। সঙ্গে সঙ্গে তার হাত ভিজে গেল। চমকে হাতখানা চোখের সামনে এনে সে দেখলে, হাতময় রক্ত!…তখন তার সব কথা মনে পড়ল।
সে চিৎ হয়ে শুয়েছিল, তাড়াতাড়ি উঠে বসল। তারপর যে-দৃশ্য দেখলে, তাতে তার বুকের ভিতরটা যেন ঠাণ্ডা হয়ে গেল ।
তার চারিদিকে গোল হয়ে প্রায় ৩০/৪০ জন লোক বসে আছে। প্রত্যেকেরই চেহারা কারো যেন কষ্টিপাথর, দেহ প্রায় উলঙ্গ, কেবল কোমরে লেংটির মতো একখানা ন্যাকড়া জড়ানো। তাদের প্রত্যেকেরই হাতে একটি করে বর্শা, সকালের রোদে বর্শার ফলাগুলো জ্বলে-জ্বলে উঠছে আগুনের ফুলকির মতো। লোকগুলো যে আফ্রিকারই বুনোমানুষ, বিমলের তা বুঝতে বিলম্ব হলো না। তার পরে হঠাৎ বাংলা কথা শুনে তাড়াতাড়ি পিছনে ফিরে বসল এবং সবিস্ময়ে দেখলে, খাঁকি পোষাক-পরা তিনজন লোক সেখানে বসে আছে। তারা পরস্পরের সঙ্গে বাংলা ভাষাতেই কথাবার্তা কইছে ;–সুতরাং তারা যে বাঙালি সে বিষয়ে তার সন্দেহ রইলো না ।
আর একটু লক্ষ্য করে দেখে সেই তিনজনের ভিতরে দুজনকে সে চিনতেও পারলে, তাদের একজনকে সে মোম্বাসার হোটেলের ভিতরে দেখেছিল এবং তিনি হচ্ছেন মানিকবাবুর ছোট কাকা সেই মাখনবাবু।
আর-একজন হচ্ছে সেই রামু, কলকাতায় মানিকবাবুর বাড়িতে ম্যাপ চুরি করবার জন্যে যে চাকর সেজে কাজ নিয়েছিল।
বিমলকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকতে দেখে মাখনবাবু গাত্রোত্থান করে এগিয়ে এলেন। তারপর হাস্যমুখে বললেন, “কী বিমলবাবু, এখন কেমন আছেন?”
বিমল কোন জবাব দিলে না।
—“আমার সঙ্গের লোকগুলোকে দেখে কি আপনার ভয় করছে ? ভয়েই কি আপনার মুখ দিয়ে কথা বেরচ্ছে না?”
মাখনবাবুর চোখের উপরে চোখ রেখে শান্তস্বরে বিমল বললে, “ভয়ের সঙ্গে এ-জীবনে কোনদিন পরিচয় হয় নি–এ জগতে কারুকে আমি ভয় করি না।”
মাখনবাবু হো-হো করে অট্টহাসি হেসে উঠলেন। তারপর বললেন, “আপনি যে খুব একজন সাহসী ব্যক্তি সেটা জেনে খুশি হলুম। কিন্তু আপনার এ-সাহস আজ কোনো কাজে লাগবে বলে মনে হচ্ছে না।”
বিমল সে কথায় কোন জবাব না দিয়ে বললে, “আপনাকে আমি চিনি। আপনি মানিকবাবুর কাকা মাখনবাবু। কিন্তু আমাকে আপনারা ধরে এনেছেন কেন?”
মাখনবাবু বললেন, “ধরে এনেছি কেন? নিমন্ত্রণ করলে আপনি আসতেন না বলে ।”
—“কিন্তু আমি আসি-না আসি, তাতে আপনার কী আসে যায়?”
—“আসে-যায় অনেকখানি । বেশি কথায় দরকার নেই, একেবারেই আসল কথা শুনুন। আপনার কাছ থেকে আমি একখানা ম্যাপ চাই ।”
বিমল বিস্ময়ের ভান করে বললে, “ম্যাপ? কিসের ম্যাপ?”
—“ম্যাপখানা যে কিসের, তা আমিও জানি, আপনিও জানেন। তা নিয়ে আর লুকোচুরি করা বৃথা। সে ম্যাপখানা আমার হাতে দিন, সমস্ত গোলমাল এখুনি মিটে যাবে।”
—“একখানা ম্যাপ আমার কাছে ছিল বটে, কিন্তু মোম্বাসার হোটেলে সেটা চুরি গেছে, একথা আপনি জানেন বোধহয়?”
–“হ্যাঁ। কিন্তু সেখানা যে জাল ম্যাপ তাও আমার অজানা নেই। বিমলবাবু, আপনার চালাকিকে ধন্যবাদ দিই। কিন্তু ও চালাকির চাল আজ আর চলবে না। আপনি বুদ্ধিমান, ম্যাপখানা যে এখন আমাকে দেওয়াই উচিত একটু ভেবে দেখলেই তা বুঝতে পারবেন!”
বিমল চুপ করে রইলো। তারপর ধীরে ধীরে মাথা তুলে বললে, “সে ম্যাপ এখন আপনাকে আমি কী করে দেবো? সেখানা তো আমার কাছে নেই।”
মাখনবাবু বললেন, “ম্যাপখানা যে আপনার কাছে নেই তা আমরা জানি, কারণ, আমরা আপনার কাপড়-চোপড় খুঁজে দেখেছি। কিন্তু সেখানা আপনাদের তাঁবুর ভেতরে নিশ্চয় আছে । কোথায় আছে এখন কেবল সেইটেই আমরা জানতে চাই। একবার তার খোঁজ পেলে সেখানা হস্তগত করতে আমাদের বেশি বিলম্ব হবে না।”
বিমল বললে, “ম্যাপের ঠিকানা পেলেই আপনারা আমাকে ছেড়ে দেবেন তো?”
মাখনবাবু হাসতে-হাসতে বললেন, “আপনি খুব মূল্যবান জীবন নন। ম্যাপখানা পেলে পরেও আপনাকে ধরে রেখে আমাদের কোনই লাভ নেই!”
বিমল বললে, “আর ম্যাপের ঠিকানা যদি না বলি?”
—“তাহলে বিনা বাক্যব্যয়ে পরলোকে যাবার জন্যে প্রস্তুত হোন!”
বিমল আবার খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলো। তারপর দৃঢ়কণ্ঠে বললে, “আমি পরলোকে যাবার জন্যে প্রস্তুত, আপনারা কী করতে চান, করুন।”
মাখনবাবু কর্কশকণ্ঠে বললেন, “তাহলে ম্যাপের ঠিকানা আপনি বলবেন না? দেখুন, ভালো করে ভেবে দেখুন।”
বিমল বললে, “এর মধ্যে ভাববার কিছুই নেই। ম্যাপের ঠিকানা আমি বলবো না।”
—“বলবেন না? বলবেন না?”—বলতে-বলতে দারুণ ক্রোধে মাখনবাবুর সমস্ত মুখখানা লাল-টকটকে হয়ে উঠলো। একেবারে বিমলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে তিনি আবার বললেন, “বিমলবাবু, আপনার সঙ্গে বেশি কথা কইবার সময় আমাদের নেই। আমাকে যারা চেনে তারা সবাই জানে, বেশি কথার মানুষ আমি নই। আমি হাসতে হাসতে মানুষকে আলিঙ্গন করতে পারি। আবার পরমুহূর্তে তেমনি হাসতে-হাসতেই তার বুকে ছুরি বসিয়ে দিতে পারি। আর একমাত্র আপনাকে জিজ্ঞাসা করছি, ম্যাপের ঠিকানা আপনি দেবেন কিনা বলুন।”
বিমল হাসতে-হাসতে বললে,“আপনারা অনেক লোক আর আমি একলা আপনাদের বাধা দেবার শক্তি আমার নেই। আপনাদের যা খুশি করতে পারেন ম্যাপের ঠিকানা আমি বলবো না।”
মাখনবাবু হঠাৎ উচ্চকণ্ঠে ডাকলেন- “রামু!”
রামু তখনি উঠে মাখনবাবুর কাছে দাঁড়ালো।
মাখনবাবু বললেন, “এই হতভাগাকে এখনি ঐ গাছের ডালে লটকে দে।”
সামনেই একটা মস্তবড় গাছ অনেক উঁচুতে মাথা তুলে আকাশের অনেকখানি ছেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তারই একটা লম্বা ডালে দড়ি ঝুলিয়ে রামু মহা-উৎসাহে ফাঁসির আয়োজনে লেগে গেল ।
বিমল আর-একবার চারিদিক চেয়ে দেখলে । সেই প্রায় উলঙ্গ অসভ্য লোকগুলো এক-একটা কালো পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে বসেছিল। কিন্তু তাদের চোখগুলো তখন প্রদীপ্ত হয়ে উঠেছে ঠিক যেন সব নিষ্ঠুর হিংস্র পশুর মতো ।
নিজের অসাধারণ শক্তির কথা বিমল জানত। এবং ইচ্ছা করলে সে যে এখনই মরবার আগে অন্তত পাঁচ-ছয় জন শত্রুকে বধ করে যেতে পারে, এটাও তার অজানা ছিল না। কিন্তু অকারণে নরহত্যা করতে তার সাধ হলো না। কারণ, পাঁচ-ছ’জন শত্রুকে বধ করলেও তার মৃত্যু যে নিশ্চিত এটা সে বুঝতে পারলো। কাজেই সে আর কোনরকম বাধা দেবার চেষ্টা করলে না।
হঠাৎ পিছন থেকে কে এসে বিমলের দুই কাঁধের উপরে দুই হাত রাখলে। মুখ ফেরাতেই বিমলের চোখে পড়ল সেই প্রকাণ্ড লম্বা মড়া-দেঁতো কাফ্রিটার কদাকার মুখখানা। এও যে ভিড়ের ভেতরে ছিল এতক্ষণ বিমল তা দেখতে পায় নি।
মাখনবাবু হাকলেন, “রামু ফাঁস ঠিক হয়েছে তো?”
রামু বললে, “আজ্ঞে, সব তৈরি।”
মাখনবাবু বললেন, “তাহলে ওকে ঐখানে নিয়ে যাও!”
মড়া-দেঁতো বিমলের একখানা হাত ধরে টেনে বাওয়াব্, গাছের দিকে অগ্রসর হলো, বিমলও কোন বাধা না দিয়ে আস্তে-আস্তে তার সঙ্গে গাছের তলায় এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো। রামু এক মুখ হাসি নিয়ে বিমলের গলায় দড়ির ফাঁসটা পরিয়ে দিলে ।
মড়া-দেঁতো দড়ির অন্য প্রান্তটা ধরে বিমলকে টেনে শূন্যে তোলবার জন্য প্রস্তুত হয়ে দাঁড়ালো।
মাখনবাবু বললেন, “ছোকরা, এই শেষবার তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি, ম্যাপের ঠিকানা আমাকে বলবে কি ?”
বিমল অটল স্বরে বললে, “না।”
সঙ্গে-সঙ্গে মাখনবাব হুকুম দিলেন, “তাহলে ওকে টেনে তোল।”
চারপাশের লোকগুলো মহা-আনন্দে অজানা-ভাষায় চেঁচিয়ে উঠলো। মড়া-দেঁতো ফাঁসির দড়ি ধরে টান মারতে উদ্যত হলো —
—সঙ্গে সঙ্গে কোথা থেকে উপরি-উপরি ছয় সাতটা বন্দুকের আওয়াজ ! পরমুহূর্তেই ভিড়ের ভেতর থেকে তিন জন লোক আর্তনাদ করে মাটির উপরে লুটিয়ে পড়লো!
আবার অনেকগুলো বন্দুকের আওয়াজ — আবার আরো কয়েকজন লোক মাটির উপরে পড়ে গড়াগড়ি দিতে লাগল।
আরো গল্প পড়তে লিংক এ ক্লিক করুন……