আফ্রিকার পূর্বদিকে, ভারত-সাগরের মধ্যে মোম্বাসা হচ্ছে একটি ছোট দ্বীপ। তার বাসিন্দার সংখ্যা চল্লিশ হাজার। হাতির দাঁত, চামড়া ও রবারের ব্যবসার জন্যে এ দ্বীপে অনেক লোক আনাগোনা করে ।
এই দ্বীপটি ইতিহাসে অনেক দিন থেকেই বিখ্যাত । ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে প্রসিদ্ধ নাবিক ভাস্কো ডা গামা এখানে এসেছিলেন। সেই সময়ে একজন আরবি, জাহাজ-শুদ্ধ তাকে ডুবিয়ে মারবার ষড়যন্ত্র করে। ভাস্কো ডা গামা কোন গতিকে সেটা জানতে পেরে মহাখাপ্পা হয়ে মোম্বাসা শহরকে তোপের মুখে উড়িয়ে দিতে উদ্যত হন, কিন্তু স্থানীয় সুলতান পায়ে-হাতে ধরে তাকে ঠাণ্ডা করেন। মোম্বাসার প্রধান রাজপথ ভাস্কো ডা গামা স্ট্রিট আজও এই অমর নাবিকের স্মৃতি বহন করছে।
মোম্বাসা শহর প্রতিষ্ঠা হয় প্রায় হাজার বছর আগে। কিন্তু এ শহরটি যে আরো পুরোনো, এখানে আবিষ্কৃত প্রাচীন চীন, মিশর ও পারস্য দেশের অনেক জিনিস দেখে তা বোঝা যায়। ১৫০৫ থেকে ১৭২৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই দ্বীপটি ছিল পর্তুগিজদের অধিকারে। আরবদের সঙ্গে পর্তুগিজদের কয়েকবার যুদ্ধবিগ্রহও হয়ে গেছে। ১৬৯৬ খ্রিষ্টাব্দে মার্চ মাস থেকে সুদীর্ঘ তিন বছর তিন মাস ধরে পর্তুগিজরা আরবদের দ্বারা এই দ্বীপে অবরুদ্ধ হয়ে থাকে। পর্তুগাল থেকে সাহায্য পাবার আশায় অবরুদ্ধ পর্তুগিজরা প্রাণপণে আত্মরক্ষা করে। কিন্তু তাদের আশা সফল হয় না। আরবদের তরবারির মুখে শেষটা পর্তুগীজদের আবালবৃদ্ধবনিতার প্রাণ যায় এবং নিয়তির এমনি নিষ্ঠুর পরিহাস যে, সেই হত্যাকাণ্ডের ঠিক দুদিন পরেই পর্তুগাল থেকে সাহায্য এসে উপস্থিত হয়।
কিছুদিন পরে মোম্বাসা আবার পর্তুগিজদের হাতে যায় বটে, কিন্তু তাদের সে প্রাধান্য স্থায়ী হয় না। মোম্বাসা এখন জাঞ্জিবারের সুলতানের অধীনে। এবং দ্বীপের যিশু কেল্লা আজও প্রাচীন পর্তুগিজ প্রাধান্যের নিদর্শনের মত দাঁড়িয়ে আছে।
মোম্বাসা শহরটি বেশ । আফ্রিকার বিশাল বুকের ভিতর যে গভীর জঙ্গল দুরারোহ পর্বতমালা ও বিজন মরুভূমি লুকিয়ে আছে, মোম্বাসাকে দেখলে তা মনে হয় না। এই শহরটিতে আধুনিক সভ্যতার কোন চিহ্নেরই অভাব নেই। বাষ্পীয়-পোত, মটর গাড়ি, রেলগাড়ি, দোতলা-তেতালা বাড়ি ও বড়-বড় হোটেল সবই দেখা যায়। বাসিন্দাদের ভিতরে আরবদের সংখ্যাই বেশি হলেও অন্যান্য অনেক জাতীয়-এমন কি, ভারতীয় লোকের সঙ্গে ও পথে-ঘাটে সাক্ষাৎ হয় । রাজপথের প্রধান গাড়ি হচ্ছে একরকম ট্রলি, সরু রেল-লাইনের উপর দিয়ে আনাগোনা করে এবং তাকে ঠেলে নিয়ে যায় সোয়াহিলি জাতের দুজন করে কুলি।
শহরের বাইরেই সুন্দর সবুজ বন । সে বনে বাওবাব্ (আর এক নাম, বাদুরে-রুটিগাছ) কলা, আম, খেজুর ও নারিকেল প্রভৃতি নানা গাছ চোখে পড়ে। মাঝে মাঝে ছোট ছোট পাহাড়। উজ্জ্বল রোদের সোনার জল দিয়ে ধোয়া মোম্বাসা নগরী যখন নিস্তরঙ্গ ভারত-সাগরের স্থির নীলদর্পণে নিজেই নিজের ছায়া দেখতে পায়, তখন তার কী শোভাই যে হয় তা আর বলবার নয়।
হোটেলের বারান্দায় বসে বিমল, কুমার ও মানিকবাবু চুপি-চুপি কথা কইছিলেন। একটু তফাতে দাঁড়িয়ে রামহরি চা তৈরি করছে এবং তার সামনে বসে বাঘা মুখ উঁচু করে ঘন-ঘন ল্যাজ নাড়ছে – একটু-আধটু চিনি বা দু-এক টুকরো রুটি বখশিস পাবার লোভে।
মানিকবাবু বললেন, “তাহলে এখান থেকে আমাদের যেতে হবে উজিজিতে?”
কুমার বললে, “হুঁ, বুড়ো সর্দার গাটুলার খোঁজে।”
—“যদি সে মরে গিয়ে থাকে, কি তার দেখা না পাই, তাহলে আমরা কি করব?”
বিমল বললে, “সে কথা নিয়ে এখনো মাথা ঘামাইনি … আচ্ছা কুমার, আমার সঙ্গে যাবার জন্যে তুমি কত লোক ঠিক করেছ?”
–“ঠিক একশো চব্বিশ জন ।”
–“তাদের জন্যে মাসে কত খরচ পড়বে?”
—“প্রায় সাতশো টাকা ।”
—”আস্কারি নিয়েচ কজন?”
—“চব্বিশ জন ।”
মানিকবাবু সুধোলেন, “আস্কারি কী?”
—“সশস্ত্র কুলি।”
—“ও বাবা! অত অস্ত্ৰ-শস্ত্র নিয়ে কী হবে? আমাদের যুদ্ধ করতে হবে নাকি?”
বিমল গম্ভীরভাবে বললে, “হতে পারে।”
রামহরি চা দিয়ে গেল। সকলে নীরবে চা পান করতে লাগল।
কুমার বললে, “আচ্ছা বিমল, মানিকবাবুর মেজো কাকা যে ম্যাপ দিয়েছেন, সেখানা তুমি কোথায় রেখেচ?”
বিমল অকারণে কণ্ঠস্বর চড়িয়ে বললে, “ম্যাপখানা আমার কোটের ভিতরকার পকেটে আছে।”
কুমার বললে, “আঃ, অত চেঁচিয়ে কথা কইচ কেন, কেউ যদি শুনতে পায়!”
—“তার মানে?”
—“আমাদের পিছনে ঐ যে থামটা রয়েছে, ওর আড়ালে দাঁড়িয়ে একজন লোক এতক্ষণ আমাদের কথা শুনছিল।”
সভয়ে চেয়ারখানা টেনে নিয়ে বিমলের কাছে সরে এসে মানিকবাবু বললেন, “ও বাবা! বলেন কি মশাই? আপনি কি করে জানলেন?”
—“আমার সামনে টেবিলের ওপরে এই যে আর্শিখানা আছে, এর ভেতর দিয়েই সেই লোকটার ওপরে আমি নজর রেখেছিলুম।”
–“কে সে?”
—“বোধ হয় সে বাঙালি!”
—“অ্যাঁ! বাঙালি!”
–“হ্যাঁ, ঐ দেখুন মানিকবাবু, হোটেল থেকে বেরিয়ে সে রাস্তায় গিয়ে পড়েচে!” বলেই বিমল পকেট থেকে একটা ছোট দূরবীণ বার করে লোকটাকে দেখতে লাগল।
মানিকবাবু হঠাৎ একলাফে দাঁড়িয়ে উঠে, বারান্দার ধারে গিয়ে চেঁচিয়ে ডাকতে লাগলেন, “ছোটকাকা। অ ছোটকাকা! ছোট কাকা!”
লোকটা যেন শুনতেই পেলে না, আপন মনে এগিয়ে গিয়ে একখানা চলন্ত ট্রলি গাড়িতে উঠে অদৃশ্য হয়ে গেল!
চোখ থেকে দূরবীণ নামিয়ে বিমল ধীরে ধীরে বললে, “উনিই আপনার ছোট কাকা? ওঁরই নাম মাখনবাবু?”
—“হ্যাঁ। কিন্তু কী আশ্চর্য! আমি এত চেঁচিয়ে ডাকলুম, তবু উনি শুনতে পেলেন না ।”
—“মাখনবাবু আপনার ডাক শুনতে রাজি নন।”
–“রাজি নন! কেন?”
—“কেন? তাও বুঝতে পারচেন না? উনিই যে ঘটোৎকচের প্রভু!”
অতিরিক্ত বিস্ময়ে মানিকবাবু অবাক হয়ে বিমলের মুখের দিকে মূঢ়ের মতন তাকিয়ে রইলেন ।
বিমল দুলতে দুলতে বললে, “আমার মনের ক্যামেরায় আমি মাখনবাবুর ফটোগ্রাফ তুলে নিয়েচি। ওর মুখ আর ভুলব না।”
কুমার বললে, “বিমল, মাখনবাবু টের পেয়েছেন, ম্যাপখানা কোথায় আছে। ম্যাপখানা তুমি অন্য কোন জায়গায় লুকিয়ে রাখো।”
সে কথার কোন জবাব না দিয়ে বিমল ফিরে বললে, “রামহরি, আজ রাত্রে তুমি বাঘাকে ভেতর থেকে বার করে দিও।”
* * *
অনেক রাত্রে বিমলের ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘরে ঘুটঘুট করছে অন্ধকার ।
সেই অন্ধকারের ভিতরে খুস খুস করে শব্দ হচ্ছে-যেন কে আস্তে আস্তে চলে বেড়াচ্ছে ।
বিমলের মনে হল যেন তার মুখের উপর কার গরম নিঃশ্বাস এসে পড়ল। সে অত্যন্ত আড়ষ্ট হয়ে শুয়ে রইল, রিভলভারটা জোরে চেপে ধরে।
পায়ের দিকে একটা খোলা জান্লা দিয়ে আকাশ দেখা যাচ্ছে। আকাশের বুকে চাঁদের মুখ নেই,—খালি হাজার হাজার তারা মিট্ মিট্ করে জ্বলছে, স্থির জোনাকির মতো ।
হঠাৎ জানলার আকাশ অদৃশ্য হয়ে গেল-একটা চলন্ত অন্ধকার এগিয়ে এসে যেন জানলার ফাঁকাটা একেবারে বুঁজিয়ে দিলে।
আচম্বিতে অন্ধকার অদৃশ্য হল এবং তারা ভরা আকাশ আবার দেখা যেতে লাগল । বিমলও শান্তভাবে পাশ ফিরে আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
সকাল বেলায় চোখ মেলেই কুমার দেখলে, বিমল একটা জান্লার কাছে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।
কুমার বললে, “ওখানে কী করচ?”
–“ঘটোৎকচ কোন স্মরণ-চিহ্ন রেখে গেছে কীনা দেখছি।
কুমার ধড়মড় করে উঠে বসে বললে, “তার মানে?”
–“এই জানলার গরাদ ভেঙে কাল রাতে ঘটোৎকচ ঘরের ভেতরে এসেছিল।”
–“ম্যাপ, ম্যাপ, তোমার পকেটে ম্যাপখানা আছে তো?”
–“না।”
–“সর্বনাশ!”
–“ঘটোৎকচ ম্যাপখানা নিয়ে লম্বা দিয়েচে । আমার হাতে রিভলভার ছিল, ইচ্ছা । করলেই আমি তাকে গুলি করতে পারতুম, কিন্তু আমি তা করি নি। আমি তাকে পালাতে দিয়েচি।”
–“বিমল, “তোমার মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে?”
—“শোনো? ম্যাপখানা কোথায় আছে, সে খোঁজ কাল বিকালে আমি শত্রু পক্ষকে দিয়েছিলাম। শত্রু যে আসবে সেটা আমি আগে থেকেই জানতাম। ধরতে গেলে, ঘটোৎকচকে আমি একরকম নিমন্ত্রণ করেই এখানে আনিয়েছিলুম। বাঘাকে পর্যন্ত ঘরের ভেতরে রাখি নি, পাছে সে ঘটোৎকচকে পছন্দ না করে।”
—“বিমল, তোমার কথা আমি কিছুতেই বুঝতে পারচি না!”
বিমল জানলার কাছ থেকে সরে এসে বললে, “কুমার, ঘটোৎকচ যে ম্যাপখানা নিয়ে গেছে, সেখানা হচ্ছে নকল। আসল ম্যাপ আমার কাছে।”
কুমার আনন্দে এক লাফ মেরে বলে উঠল, “ওহো বুঝেচি-বুঝেচি!”
বিমল বললে, “ঐ নকল ম্যাপ দেখে এ গুপ্তধন আনতে যাবে তাকে ভুল পথে ঘুরে ঘুরে মরতে হবে। নকল ম্যাপখানা অনেক কষ্টে আমি তৈরি করেচি।”
আরো গল্প পড়তে লিংক এ ক্লিক করুন……